এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-১০

0
931

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১০

ঘুমহীন চোখজোড়া মেলে রাতজাগা নিশাচর পাখির মতো তাকিয়ে আছে তোহা।সন্ধ্যাবেলা এত ঘুমিয়েছে যে এখন কেনোক্রমেই ঘুম আসছেনা।অনেকক্ষণ যাবত এপাশ ওপাশ করে শেষমেষ উঠে বসলো তোহা।চুলগুলো কোনোরকম পেঁচিয়ে হাতখোঁপা করে বিছানা থেকে নামলো।আসার সময় খোলাচুলে এসেছিলো।বিধায় চুলের কাঁটাটা সঙ্গে আনেনি।খোঁপা আলগা হয়ে আসছে বারবার।
অন্ধকারেই গুটি গুটি পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে।ওয়াশরুমের আলো জ্বালিয়ে মুখে তিন চারবার পানির ঝাঁপটা দিয়ে বেরিয়ে আসলো।মুখ মোছার জন্য কিছু নেই।গায়ের ওড়নাটাও খসখসে জরজেট কাপড়ের।এটা দিয়ে মুখ মুছলে চামড়ায় ঘষা লাগে খুব।ঘরের লাইট জ্বালায়নি,যদি দরজার ফাঁক দিয়ে আলো যেয়ে তিহানের ঘুম ভেঙে যায় এই ভয়ে।মুখ না মুছেই আস্তে করে শব্দহীন ভাবে রুমের দরজাটা খুললো সে।
ড্রইংরুম জুড়ে নীল আলোর ডিমলাইটের ছড়াছড়ি।কেমন ভুতুরে একটা পরিবেশ।বড় সোফাটায় সটান হয়ে শুয়ে আছে তিহান।মাথার পিছের বালিশটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।বালিশের জায়গাটা দখল করেছে তার বামহাত।মাথার নিচে বামহাত দিয়ে শুয়েছে সে।লম্বা দেহ জায়গা হয়নি সোফায়।পা জোড়া সোফা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে অনেকটা।তোহা পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়।
তিহানের ফর্সা চেহারায় নীলাভ আভাস যেন ক্ষণে ক্ষণে তার অতি আকর্ষনীয় চেহারা আরো বেশি আকৃষ্ট করে তুলছে।খাঁড়া নাক,গালের দাঁড়ি,বামগালের মাঝ বরাবর একটা বাদামী তিল আর তাকিয়ে থাকলে সেই গাঢ় ধুসর চোখের মণি সবমিলিয়ে এক অনন্য স্বপ্নপুরুষ।তোহা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।হাতের তর্জনী দিয়ে হাল্কা স্পর্শে গালের তিলটা ছুঁয়ে দিলো।মেঝের বালিশটা উঠিয়ে অনেকটা ঝুঁকে গিয়ে একহাত তিহানের ঘাড়ে ঢুকিয়ে আলতো করে মাথাটা উঠিয়ে বালিশটা নিচে দিতে নিলেই বাঁধলো বিশাল বিপত্তি।তার খোঁপা খুলে গিয়ে পুরো চুল বিছিয়ে পরলো তিহানের মুখের উপর।মুখ দিয়ে “আ” ধ্বনিটা বের করতে নিয়েও থেমে গেলো তোহা।ঠোঁট কামড়ে ধরে বালিশটা নিচে দিয়ে তিহানের মাথাটা রাখতেই তিহান ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,
—“চুলগুলো সরা তিহু।…তোকে কি আমি বলেছি বালিশ দিতে?”

তোহা আৎকে উঠলো।হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেলো কিছু সময়ের জন্য।ঠোঁটটা আরো জোরে কামড়ে ধরে আস্তে করে চুলগুলো সরিয়ে উঠে যেতে নিলেই তিহান তার হাত ধরে আটকে দিয়ে চোখ মেলে বললো,
—“জাস্ট চুলগুলো সরাতে বলেছি।তোকে সরতে বলিনি।”

তোহা হতবিহ্বল বিচলিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।হঠাৎ ভেজা মুখের পানি চুঁইয়ে টুপ করে তিহানের চোখের পাতার উপর পড়তেই ধ্যান ভাঙে তার।চাঁপা গলায় সে বলে,
—“ছাড়ুন।”

তিহান ছাড়ালোনা।বরং পকেট থেকে একটা চাবি বের করে তোহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চোখের দৃষ্টি আরো খানিকটা গম্ভীর করে বললো,
—“আলমারির বাম দিকের দুই নাম্বার ড্রয়েরে তোর চুলের কাঁটা রাখা আছে।রুমে যেয়েই চুল বেঁধে নিবি।খোলা চুলে ঘুমাবিনা।খবরদার!”বলে তোহার হাতটা ছেড়ে দিলো সে।মাথার বালিশটা ঠি ক করে নিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করে বললো,
—“শোন?”

—“বলেন।”

—“চুলে কি শ্যাম্পু দিস,নাকি আ্যালকোহল?”ঘোর লাগা জড়ানো কন্ঠে কৌতুহল নিয়ে বলে তিহান।

তোহা উওর দেয়না।নিরুত্তর ভঙ্গিতে তিহানের বাহুর নিচ থেকে ওড়নার আটকে পরা অংশটা টেনে নিয়ে দ্রুতপায়ে ঘরে যেয়ে দরজা আটকে দেয়।
_________________

ঘরে যেয়েই লাইট জ্বালালো তোহা।হাতের মুঠোয় থাকা চাবিটা দিয়ে আলমারি খুলে বামদিকের ড্রয়ারটা খুলতেই নজরে এলো তিহানের বেশ দামি ব্র্যান্ডের কিছু হাতঘড়ির বক্সের ভিঁড়ে খুব যত্নের সহিত একটা চুলের কাঁটা সাইড করে রাখা আছে।কপাল কুঁচকে সেটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতেই মনে পরলো এটা সে হারিয়েছে প্রায় বছরখানেক হবে।তবে কবে হারিয়েছে সেটা মনে নেই।আরো কয়েকবার কাঁটাটা নেড়েচেড়ে দেখে নিয়ে মুচকি হেসে সেটা আগের জায়গায় রেখে দিলো তোহা।এতো যত্নের সাথে রাখা জিনিসটা আবারো নিজের অযত্নের মাঝে হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিটা নিলোনা আর।

আলমারিটা আটকে দিয়ে আশেপাশে তাকায় তোহা।তিহান তাকে বলেছে চুল বেঁধে ঘুমাতে।বলেনি যে এই কাঁটা দিয়েই চুল বাঁধতে হবে।শুধু চুল বাঁধলেই হবে তা সে যাই দিয়েই বাঁধুক না কেনো।চুলগুলো উঁচু করে খোঁপা করে টেবিলে রাখা কলমদানি থেকে দুটো কলম ঢুকিয়ে শক্ত করে তা আটকে ফেলে তোহা।এ কাজে একেবারে পাঁকা হাত তার।সারারাত বালিশের সাথে যুদ্ধ করলেও এ খোঁপা খুলবেনা।”
________________

খিঁচুরির গন্ধে মৌ মৌ করছে পুরো ফ্ল্যাট।সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বা মাঝারি বেগে বৃষ্টি হচ্ছে।সরকারি ছুটিতে কলেজ বন্ধ আজকে।কি দিবস জানি আছে।সকাল সকাল এসে শাওয়ার নিয়ে চুল শুঁকানোর জন্য ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে ফোন নিয়ে বিছানায় বসেছে তোহা।
বাজে প্রায় সাড়ে দশটা।আতিয়ার ভুনাখিঁচুরি বানানো শেষ প্রায়।এখন সে ব্যস্ত ইলিশ মাছ ভাঁজতে।ভুনাখিঁচুরির সাথে ইলিশ ভাঁজা এ বাড়ির সকলেরই প্রিয় খাদ্য।বৃষ্টির দিন হলে প্রায়শই এটা রান্না করে সে।
গরম গরম ইলিশভাঁজা গুলো কড়াইয়ে তুলতে তুলতে সে হাঁক ছাড়লো,
—“তোহা,খাবারগুলো টেবিলে নিয়ে সাজাতো।”

—“আসছি।”বলে উঠে দাঁড়ায় তোহা।চুল শুকিয়ে এসেছে প্রায়।ঘরের ফ্যানটা বন্ধ করে দিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে।সবশেষে পিস করে কাঁটা লেবু নিয়ে এসে রাখতেই কলিংবেল বেজে উঠে।দ্রুতপায়ে যেয়ে দরজা খুলতেই দেখে তিহান দাড়িয়ে আছে।পরণে খয়েরি রংয়ের গেন্জি আর কালো ট্রাউজার।চুলগুলো ব্রাশ করা সুন্দরমতো।

—“সর সামনে থেকে।এমন সঙ সেজে দাড়িয়ে আছিস কেনো?”

তোহা সরে দাড়ায়না।বরং এক একদম এগিয়ে এসে রাস্তা আটকে প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠে,
—“আমাকে আপনার কোনদিক দিয়ে সঙ মনে হচ্ছে তিহান ভাই?”

তিহান জ্বালাময়ী হাসি হেসে বলে,
—“আপাতত সবদিক থেকেই।শুনেছিস?এবার সর।নয়তো দেবো এক থাপ্পর।”

—“আপনি কথায় কথায় আমাকে থাপ্পড় দিতে চান কেনো?আমার গালটা কি আপনার নিজস্ব সম্পদ?”

তিহান উওর দেবার আগেই আতিয়া চেঁচিয়ে বলেন,
—“তিহান এসেছে তোহা?ওকে তাড়াতাড়ি টেবিলে বসাতো।খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।সেই কখন ডেকেছি”

একরাশ বিরক্তি আর রাগ নিয়ে পথ ছেড়ে দাড়ায় তোহা।তিহান ধীরগতিতে জুতো খুলে পাশে রেখে এগিয়ে যাওয়ার আগে তোহার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
—“শুধু গাল নয়,গোটা তুমিটাই আমার নিজস্ব সম্পদ।”বলে আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে হনহন করে হেঁটে টেবিলে যেয়ে বসে সে।
আতিয়া নিজেই এসে তার প্লেটে খাবার তুলে দেয়।তোহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“তুইও বসে পর।আমার রান্না আছে।ছেলেটা একা বসে খাবে নাকি?”

আতিয়া কথাটা বলতেই তার দৃষ্টির অগোচরে নিজের পাশের চেয়ারটা টেনে দেয় তিহান।আদেশসূচক চোখের ইশারায় তোহাকে সেখানে বসতে বলতেই তোহা বিনা বাক্য ব্যায়ে চুপচাপ সেখানে বসে পরে।

—“তূর্য আর খালু কোথায় খালামনি?

—“তূর্য বোধহয় এখনো ঘুমাচ্ছে।রাত জেগে পড়াশোনা করেছেতো তাই আর ডাকিনি।যখন উঠবে তখন খাবে।আর তোর খালু গিয়েছে কোন কাজে।ছুটির দিনেও তার কাজের শেষ নেই।”

তিহান মৃদু হাসলো।তাদেরকে খাবার দাবার বেড়ে দিয়ে ব্যস্তভাবে আবারো রান্নাঘরে ছুটলো আতিয়া।
বাড়ির কাজে সেই মহিলাটা সাহায্য করে সে আজকে আসেনি।সেজন্যই কাজের ভারটা আজ একটু বেশি।

খুব মনোযোগ দিয়ে ইলিশের কাঁটা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে তোহা।সবসময় আতিয়াই তার মাছের কাঁটা বেঁছে দেয়।কিন্তু আজ কাজের চাপে সে সেটা করতে পারছেনা।তোহাও আগ বাড়িয়ে ডাকেনি।অনেকক্ষন বাদে ব্যর্থ হয়ে সে যখন মাছের টুকরাটা সাইডে রেখে প্লেটে ডিম ভাঁজা তুলে নিতে যাচ্ছিলো ঠি ক তখনই অনেকগুলো কাঁটা বাঁছা মাছ তার প্লেটের কোঁণায় রাখে তিহান।তোহা বিস্মিত নয়নে তাকাতেই সে নিজে খাবার চিবাতে চিবাতে বলে,
—“চুপচাপ খাবি।বেশি কথা বলবিনা।”

—“এতগুলো লাগবেনাতো।আমি এত খাইনা।”দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলে তোহা।

তিহান একপলক তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
—“তুই কতটুকু খাস আর না খাস আমার জানা আছে।তোর বলতে হবেনা।তবে এখন প্লেটে যতগুলো খাবার রাখা আছে সবগুলো না শেষ করলে…” এতটুকু বলেই চোখ রাঙায় তিহান।

তোহা কিছুক্ষণ বিরবির করে বাধ্য মেয়ের মতো পুরো খাওয়াটা শেষ করে।তিহান যে এতক্ষন নিজের খাওয়া শেষ করে তাকে পর্যবেক্ষন করছিলো ব্যাপারটা তার নজরেই আসেনি।খাবার শেষে পানির গ্লাস হাতে নিতেই তার মুখের সামনে ইলিশ মাছের বড় একটুকরো ডিম তুলে ধরে তিহান।নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,
—“হা কর।”

এই ডিমটা আফিয়া নিজে তিহানের প্লেটে তুলে দিয়েছিলো।ইলিশ মাছের ডিম তিহানের খুব বেশি পছন্দের তাই।আর এই এতটুকু ডিমই হয়েছে আজকের মাছটায়।তাই সেটা তিহানকেই দিয়ে গিয়েছে আফিয়া।

মুখটা একটু সরিয়ে নেয় তোহা।ইততস্ত কন্ঠে বলে,
—“না,এটা আপনি খান।”

তিহান তার ঠোঁটের সাথে টুকরাটা ঠেকিয়ে ধরে বললো,
—“আমি হা করতে বলেছি।”

—“কিন্তু..”

—“তিহু…”।নিচু কন্ঠেই গর্জে উঠলো তিহান।

এবার ছোট্ট করে মুখ খুললো তোহা।নিমিষেই পুরো ডিমটা তার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে ছোট্ট করে শ্বাস ফেললো তিহান।অত:পর উঠে দাড়িয়ে হাত ধুঁয়ে এসে আতিয়াকে বলে চুপচাপ দরজার দিকে পা বাড়ালো।

~চলবে~