#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৭
চামচে টুংটাং শব্দ তুলে লেবুর শরবত বানাচ্ছে তোহা।কাঁচের গ্লাসের সাথে স্টীলের চামচের ঘর্ষণের শব্দটা বেশ লাগছে তার।রান্নাঘর থেকে একটু পরপরই তেলের ঝাঁঝালো শব্দ কানে আসছে।আতিয়া আর আফিয়া মিলে কিসব যেনো বানাচ্ছে সেই বিকেল থেকে।নিশারা চলে গেছে আজ সকালে।যদিও আরো একদিন থাকার কথা ছিলো কিন্তু সৌহার্দ্যর জরুরি কাজ পরে যাওয়ার আজই যেতে হয়েছে।তারা যাওয়ার পর বিকালেই স্বর্ণারাও চলে গিয়েছে।
বাড়ি এখন আবার ফাঁকা ফাঁকা।তবে তাদের সাথে অনন্তও চলে যাওয়ায় বেশ স্বস্তি লাগছে তোহার।
॥
শরবতটা বানিয়ে মাত্র একচুমুক খেয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই ঝড়ের গতিতে কলিংবেল বেজে উঠলো।
দরজার দিকে একবার বিরক্তিকর দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করে দ্রুতপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো তোহা।দরজা খুলতেই তিহান ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত কন্ঠে দ্রুত বলে উঠলো,
—“মা কোথায় রে?ফ্ল্যাটের চাবিটা দিতে বলতো”
গাঢ় বেগুনী রংয়ের শার্ট তিহানের পরণে।হাতাগুলো কনুই পর্যন্ত গুটানো।হাতের পশমগুলো ঘেমে চামড়ায় সাথে লেপ্টে আছে।শার্টের উপরের তিনটে বোতাম খোলা বিধায় ফর্সা বুকের অনেকাংশই দৃশ্যমান।সেদিকে চোখ পরতেই মাথা নুইয়ে দরজা থেকে সরে দাড়ালো তোহা।নিচু গলায় বললো,
—“ভেতরে আসেন।খালামনি রান্নাঘরে।আমি এনে দিচ্ছি চাবি।”
তোহার নত চেহারার দিকে তীর্যক চাহনীতে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো তিহান।অত:পর এর অর্থোদ্ধার হতেই একহাতে শার্টের বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে সোফায় যেয়ে বসলো সে।দরজা আটকে ড্রইংরুমের ফ্যান ছেড়ে দিলো তোহা।
আফিয়ার থেকে চাবি আনার জন্য যেতে নিলেই তিহান জোড় গলায় বলে উঠলো,
—“এক গ্লাস পানি দে তো তিহু।”
কথাটা শোনার সাথেসাথেই নিজের হাতের ঠান্ডা শরবতের গ্লাসটা তিহানের দিকে এগিয়ে দিলো তোহা।বললো,
—“এটা খান।আমি অল্পএকটুই খেয়েছি,অতো এঁটো হয়নি।নয়তো নতুন করে বানিয়ে…”
এতটুকু বলতেই তার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে নিলো তিহান।গটগট করে প্রায় অর্ধেকটা শেষ করে বললো,
—“চাবিটা নিয়ে আয় জলদি।”
পাল্টা কিছু বললোনা তোহা।আফিয়ার কাছ থেকে চাবি নিয়ে এসে দেখলো কানে ফোন ধরে শরবতে চুমুক দিতে দিতে কারো সাথে কথা বলছে তিহান।ঠোঁটের কোঁণে হাসি।তোহা কাছাকাছি যেয়ে দাড়াতেই সে না তাকিয়েই শরবতের গ্লাসটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে হাত বাড়িয়ে দিলো।তিহানের ফোনের মধ্য হেসে হেসে কথা বলা তোহার মোটেও পছন্দ না।একদম অসহ্য লাগে।ক্ষীপ্ত মেজাজে ধপ করে তার হাতের উপর চাবিটা রাখতেই চোখজোড়া সংকুচিত করে আড়চোখে তার দিকে তাকালো তিহান।তোহার চাপা রাগত চেহারা দেখে বিশেষ কোনো ভাবাবেগ দেখা দিলোনা তার মধ্য।নির্বিকার ভঙ্গিতে চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে গ্লাসের বাকি শরবতটুকু খেয়ে নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো সে।ফোনের ওপাশের মানুষটার কথার তালে তালে ঠোঁটের হাসিটা আরো গাঢ় হতেই স্হান ত্যাগ করলো তোহা।
ডাইনিং টেবিলে চিনির কৌটা,লেবু কাটার ছুড়ি সব এলোমেলো করে রেখেছে সে।সেসব গোছাতে গোছাতেই হঠাৎ পেছন থেকে তার হাতটা টেনে নিলো তিহান।তোহার ছোট্ট হাতের মুঠোটায় বড়সড় একটা চকলেটের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
—“দরজা আটকে দিয়ে যা।”
তিহান চলে যেতেই দরজাটা আটকে দিয়ে হাতের চকলেটটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তোহা।আচ্ছা,এই হুটহাট মন ভালো হয়ে যাওয়া কি ভয়ংকর প্রণয়ের আভাস?
_____________
হাতে এক বাটি ডালের বড়া।আতিয়া গরম গরম ভেঁজে দিয়েছে তিহানের জন্য।তা নিয়েই বাধ্য মেয়ের মতোন পাশের ফ্ল্যাটে ছুটেছে তোহা।কলিংবেল চাপার আগে একবার দরজার লক ঘুরাতেই তা খুলে গেলো।ভ্রু কুঁচকালো তোহা।লোকটা কি একটু সাবধানে দরজাটাও লাগিয়ে রাখতে পারেনা?
নি:শব্দে ফ্ল্যাটে ঢুকে তিহানের রুমে উঁকি দিলো সে।তিহান রুমে নেই।হয়তো বারান্দায়।হয়তো না,সে বারান্দাতেই।হাসস্যজ্জ্বল কন্ঠের কথাবার্তা এখান অবধি শোনা যাচ্ছে।
হাতে বড়ার বাটিটা নিয়েই চুপচাপ তিহানের পিছে যেয়ে দাড়ালো সে।তার উপস্থিতি টের পেতেই ঘুরে তাকালো তিহান।কিছু বলার আগেই তোহা হাতের বাটিটা সামনে বাড়িয়ে অভিমানি রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
—“আপনার জন্য,আম্মু পাঠিয়েছে।
ঠোঁট এলিয়ে হাসলো তিহান।ঠোঁটে হাসি রেখে দু’কদম এগিয়ে যেতেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো তোহার।মূহুর্তেই হকচকিয়ে গেলো সে।চোখের অভিমানি ভাবটা সরে গিয়ে এখন লজ্জা আর অস্থিরতার সংমিশ্রণ
খেলা করছে।তিহান আরো একটু অগ্রসর হয়ে তার মাথার কাছের দেয়ালটায় একহাত রেখে বাহুডোরে আটকে দিতেই সে কম্পিত চাপা স্বরে বললো,
—“কি করছেন?কেউ এসে পরলে….”
তাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলোনা তিহান।নিজের কান থেকে ফোনটা সরিয়ে তোহার কানে চেপে ধরলো।আওয়াজ করতে যেয়েও থেমে গেলো তোহা।ওপাশ থেকে একটা লোকের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।উচ্ছসিত স্বরে কারো নাম জিজ্ঞেস করছে লোকটা।কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকালো তোহা।অল্প শব্দ তুলে
হেসে ফেললো তিহান।তোহার কান থেকে ফোনটা সরিয়ে নিজের কানে নিয়ে বললো,
—“হ্যাঁ নিরব,আমি একটু পরে ফোন দিচ্ছি তোমাকে।ততক্ষনে একটু নাম ভেবে দেখি।ভালো কিছু পেলেই জানাচ্ছি।”
ওপাশের কথাটা তোহার কানে এলোনা তবে একসেকেন্ড পরেই তিহান”আচ্ছা”বলে ফোনটা রেখে দিলো।
ফোনটা পকেটে রেখে তোহার চোখে চোখ রাখলো তিহান।তোহা নিচে তাকাতে নিলেই তিহান একহাতের তর্জনী দিয়ে তার থুতনি উপরে তুলে শীতল গলায় বললো,
—“চোখ নামাবানা,তাকাও আমার দিকে।”
লজ্জায় দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো তোহা।তবে তিহানের কথার অমান্য করেনি সে।পলকহীন পাপড়িতে তিহানের অতি আকৃষ্ট ধূসর চোখজোড়ায় নিবদ্ধ হয়ে থেমে আছে তার দৃষ্টি।তার অনেকটা কাছে থাকা সত্তেও শোভনীয় দুরত্ব বজায় রেখেছে তিহান।নিজ থেকে বাড়াবাড়ি রকমের কাছাকাছি কখনোই আসেনা সে।
তিহান শান্ত সাবলিল কন্ঠে বললো,
—“আমার এক কলিগের আজকে বাচ্চা হয়েছে।ছেলেটা আমার থেকে বয়সে ছোট।বড় ভাই হিসেবে খুবই মান্য করে আমাকে।তাই তখন খুশির সংবাদটা সর্বপ্রথম আমাকেই জানিয়েছে।কারো প্রথম বাবা হওয়ার সংবাদটা শুনে হাসাটাই তো খুব স্বাভাবিক।তাই নয় কি?…আর এখন ফোন করেছে মেয়ের নাম কি রাখবে তা নিয়ে।ওর প্রথম মেয়ের নাম নাকি আমাকেই রাখতে হবে।শুনলেইতো কতটা অস্থির ধৈর্যহীন শোনাচ্ছিল ওর কন্ঠ।এটুকু বলে থামলো তিহান একটু সময় নিয়ে আবার বললো,তোমার অভিমান করার কারণটা যুক্তিযুক্ত নয়।এবার বুঝতে পেরেছো?”
—“হু”।মিহি স্বরে উওর দিলো তোহা।
মুখটা একটুখানি এগিয়ে আনলো তিহান।প্রচন্ড লজ্জায় তিহানের বাহু আঁকড়ে ধরে কাঁচুমাচু হয়ে দাড়ালো তোহা।শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে তিহানের।তোহার সাড়ামুখে চোখ বুলিয়ে গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে আচ্ছন্ন কন্ঠে সে বললো,
—“তুমি আমার প্রণয়রাজ্যের সেই বিধ্বংসী প্রণয়ীনী যে কিনা মূহুর্তেই তার মায়াভরা চাহনী দিয়ে আমার বুকে আটকে রাখা শান্তশীতল প্রণয়টুকুকে ধংস্বাত্বক করে তুলে।আমি তবুও নিজেকে প্রতিনিয়ত সংযত করে যাচ্ছি ‘প্রণয়ী’।শুধু তোমার জন্য।আর তুমি কিনা সেই সংযম টাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার প্রণয়লীলায় নেমেছো?”
~চলবে~
#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৮
পায়ের কাছে একটা ছোট্ট লোমশ তুলতুলে কালোসাদা বিড়ালছানা।চোখে না পড়ায় ভুলবশত তার লেজে পা মারাতেই সজোরে “মিয়াউ” বলে চেঁচিয়ে উঠে বিড়ালছানাটা।তার চেঁচানোর পরমুহূর্তেই তোহাও চেঁচিয়ে উঠে চিৎকার করে।তিহানের বাহু টেনে ধরে তাকে বেসামালভাবে টান দিতেই উল্টাপাল্টা কদমে অগোছালো হয়ে যায় তিহান।কোনরকমে নিজেকে সামলে তোহার মাথায় হাল্কা চাঁটি মেরে বলে,
—“মাথায় সমস্যা নাকি তোর?এভাবে কেউ টান দেয়?পরে গেলে আমাকে টেনে তোলার শরীরটাওতো নেই তোর।যত্তসব।”
—“আপনি ওর লেজে পাড়া দিলেন কেন?আপনার এত বড় আর শক্ত পায়ের পাড়া খেলেতো বাচ্চাটা মরেই যাবে।”
তোহার কথাগুলো বেমালুম তোয়াক্কা না করে বিড়ালছানাটাকে সযত্নে কোলে তুলে নিল তিহান।বারকয়েক জোরে জোরে “মিয়াউ” করে হঠাৎই শান্ত হয়ে গেলো ছানাটা।নরম দেহটা গুটিয়ে তিহানের বুকের সাথে লেপ্টে রইলো।মৃদু হাসলো তিহান।প্রাণীদের একটু ভালবাসা দিলেই মানুষকে আপন মনে করে তারা।তবুও কেনো যে মানুষ এদের সাথে নির্মম আচরণ করে বুঝে আসেনা তার।এতটুকু ছানাটাকে দেখেও কারো মায়া হয়নি যে একটু রাস্তা থেকে সরিয়ে নিরাপদ জায়গায় রাখবে।এই রোডের সাইডে যখন তখন গাড়ি এসে চাঁপা দিয়ে দিবে বাচ্চাটাকে।
আস্তে করে হাতের তর্জনী দিয়ে বাচ্চাটার মাথায় আদর করে দিলো তিহান।পকেট থেকে রুমাল বের করে তোহার হাতে দিয়ে বললো,
—“লেজটা মুছিয়ে দে তো।ময়লা লেগে গেছে।”
-–-“আপনার জুতোর ময়লা এগুলো।”আলতো করে লেজটা মুছতে মুছতে খোঁচা মেরে বললো তোহা।
তিহান শান্তভাবে উওর দিলো,
—“আরে বাবা,আমি কি ইচ্ছা করে পাড়া দিয়েছি নাকি?ভুলে লেগে গেছে।”
—“কি করবেন ওকে?এখানেই রেখে যাবেন?”
তোহার প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠের মাঝেও কোনো একটা আবদারের আভাস পেলো তিহান।হাঁফ ছাড়লো সে।তারা দাড়িয়ে আছে বাড়ির গেটের বাইরে।এই ছুটির দিনেও তোহার কলেজে যেতে হচ্ছে।কলেজের বেতনের ডেট পার হয়ে গেছে অথচ তোহা বেখেয়ালিতে তা ভুলে বসে আছে।তাই অফিস রুমে বলে আজ বেতন দিতে হবে।নয়তো আবার পরবর্তী মাসের পরীক্ষায় ঝামেলা হতে পারে।বেতন পরিশোধ না করলে আবার পরীক্ষায় এটেন্ড করতে দেয়না কর্তৃপক্ষ।
ড্রাইভার আঙ্কেল গাড়ি নিয়ে কই যেনো গিয়েছে বিধায় এখানে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাদের।বলেছে দশ বিশ মিনিটেই ফিরে আসবে।উনি ফিরে আসলেই তারা যাবে।তাঁড়া নেই কোনো।এখন বাজে বেলা এগারোটা।অফিস রুম খোলা থাকে বিকাল চারটা পর্যন্ত।
কিছুক্ষণ ভাবলো তিহান।ছানাটাকে কি করা যায়?এতটুকুন বাচ্চাতো খাওয়া খুঁজেও খেতে পারবে না।উপায়ন্তর না পেয়ে তোহাকে নিয়ে আবারো গেটের ভিতর পা বাড়ালো তিহান।বলল,
—“আপাতত দারোয়ান চাচাকে বলে এখানটায় রেখে যাই পরে কোনো একটা ব্যবস্থা করে দিবোনে।বলে বাচ্চাটাকে ভিতরের গেটের এককোঁণায় রাখলো তিহান।পাশে বসা দারোয়ান চাচার হাতে একশো টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বললো,
—“আমি আসা পর্যন্ত একটু খেয়াল রেখেন চাচা।কেউ যেনো কিছু না করে।”
পান খাওয়া লাল লাল দাঁতগুলো বের করে হাসলো দারোয়ান চাচা।বললো,
—“আচ্ছা,তুমি চিন্তা কইরোনা।আমি দেইখা রাখুমনে।নিশ্চিন্তে যাও।”
ভদ্রতার হাসি হাসলো তিহান।বাইরে গাড়ির হর্ণের শব্দ শোনা যাচ্ছে।গাড়ি চলে এসেছে।তোহার হাত থেকে রুমালটা নিয়ে হাল্কা ঝেড়ে তা পকেটে ঢুকালো তিহান।
অত:পর তোহাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।
পরিবেশটা আজকে কেমন যেনো একগুয়ে।আকাশ কেমন গুমোট হয়ে আছে।মেঘ নেই তবে বৃষ্টি হবে হবে মনে হচ্ছে।আটকে থাকা ঘনকালো মেঘগুলো যেন স্বচ্ছ নীল আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
___________
নানা ঝামেলা পুড়িয়ে অবশেষে অফিস হেড এর সাথে কথা বলে বেতনটা দিতে পেরেছে তিহান।সে একাই আসতো কিন্তু একজায়গায় তোহার সাইন লাগবে সেজন্যই তাকেও সাথে নিয়ে আসতে হয়েছে।
কলেজ গেট পেরোতেই চটপটি,ফুচকার গন্ধে মনটা ভালো হয়ে গেলেও পরমূহুর্তেই তোহা ভাবলো তিহান কস্মিককালেও তাকে এসব কিনে দিবেনা।স্ট্রিট ফুডগুলোর প্রতি তার প্রচন্ড অনিহা।নিজেও খায়না,তোহাকেও খেতে দেয়না।।একটু আগেই তাকে এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা বেমালুম ভুলে বসে থাকার জন্য তুমুল ঝেড়েছে তিহান।
সুতরাং এখন আর তিহানের কাছে এসব খাওয়ার কথা বলার সাহস হলোনা তার।ফলস্বরুপ গোমড়ামুখে চুপচাপ তিহানের হাত আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চললো সে।
গাড়িতে বসিয়ে দেয়ার সময় তার ভার হয়ে থাকা মুখশ্রী চোখ এড়ালোনা তিহানের।দরজা আটকে গিয়ে জানলায় হাল্কা ঝুঁকে সে বললো,
—“বাবার কিছু ওষুধ কিনতে হবে তিহু।তুই একটু বস।আমি আসছি।”
মাথা কাত করে সম্মতি জানাতেই তার চোখের আড়াল হয়ে গেলো তিহান।গায়ের গাঢ় সবুজ ওড়নাটা ভালোমতো মাথায় টেনে নিয়ে আঁটসাঁট হয়ে বসলো তোহা।কিশোরী মনে অভিমানের বিন্দু বিন্দু কণা জমেছে।তিহান তাকে এভাবে না বকলেও পারতো।মানুষতো ভুলে যেতেই পারে তাই বলে বকবে হবে?
অনেকক্ষন এসব ভাবতে ভাবতে চোখজোড়া বন্ধ হয়ে এলো তার।একটু মাথা এলিয়ে আরাম করার আগেই
তিহানের অনবরত ডাকে তন্দ্রাঘোরে মূহুর্তেই বিচ্ছেদ ঘটলো তার।ধরফরিয়ে উঠে বসতেই তিহান ঠেস দিয়ে বললো,
—“এতটুকু সময়েই ঘুমিয়ে পরলি?গাধী।ধর এগুলা।পরে যাবে হাত থেকে।”
কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে বিস্মিতনয়নে চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে তোহা।তিহানের একহাতে ফুচকার প্লেট আরেকহাতে চটপটির।আবার কনুইয়ের কাছটায় ভাঁজ করে বুকের সাথে ঠেস দেয়া দুটো ঝালমুরির প্যাকেট।ফুচকার প্লেটের নিচে আঙ্গুলের সাথে ঝুলছে একটা ভেলপুরি ভর্তি পলিথিন।তিহানের ঘাড়ে কপালে ঘাম চিকচিক করছে।তোহা দ্রুত হাত বাড়ালো।ফুচকার প্লেটটা আর ঝালমুড়িগুলো হাতে নিতেই খুব সাবধানে গাড়ির সামনের অংশটায় চটপটির প্লেটটা রাখলো তিহান।নিজে সিটে বসে পকেট থেকে একটা কোলড্রিঙ্কের বোতল বের করে তোহার কোলের উপরে রাখতেই তোহা ভ্রু কুচকে বললো,
—“আপনি কি পাগল তিহান ভাই?এত কিছু এনেছেন কেনো?”
তিহান উওর দিলোনা।পকেটে কোনরকমে ঢোকানো বাবার জন্য কেনা ওষুধগুলো ভালো করে ঢুকিয়ে নিলো।
অত:পর তোহার একপ্যাঁচ দিয়ে মাথায় জড়ানো ওড়নার কাঁধে ছড়িয়ে রাখা অংশটা খুলে নিয়ে
নিজের মুখ গলা ঘাড় মুছতে লাগলো সে।চোখে হাল্কা লজ্জাভাব নিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো তোহা।
আড়ষ্ট কন্ঠে বললো,
—“আপনি সবসময় এরকম পাগলামি করেন কেনো?”
মুচকি হাসলো তিহান।তোহার ওড়নাটা পুনরায় পরিয়ে দিয়ে বললো,
—“তখন ওভাবে বকতে চাইনি আমি।”
—“বকেছেন তো।”তীব্র অভিমান তোহার কন্ঠে।
কিছুক্ষন চুপ তাকালো তিহান।ফুচকার প্লেট হাতে ধরে রেখেও খাচ্ছেনা তোহা।হতাশ শ্বাস ছাড়ালো তিহান।
একটা ফুচকা হাতে তুলে তোহার মুখের সামনে ধরে গলা খাদে নামিয়ে কাতরকন্ঠে বললো,
—“অভিমানের পাল্লাটা কি বেশি ভারি?একটু খেলে…”
এটুকু বলতেই ফুচকাটা নিজের মুখে পুড়ে নিলো তোহা।কোলের উপর রাখা কোলড্রিঙ্কের বোতলটা তিহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিচু কন্ঠে বলল,
—“এটা আপনি খান।ঘেমে গেছেন।খেলে ভালো লাগবে।”
ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো তিহান।এখন শান্তি লাগছে তার।বুকের উপরের ভারি পাথরটা যেনো নেমে গেছে এক সেকেন্ডেই।
_______________
মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে সেই বিকেল থেকে।এখন প্রায় সন্ধ্যা।মাগরিবের আজান দেয়নি অবশ্য।তবুও আকাশ কালো হয়ে যাওয়ায় চারদিকে অনেকটা অন্ধকারই নেমে এসেছে।
খালামনির হন্তদন্ত ডাকে ছুটে এসেছে তোহা।সে আসতেই আফিয়া কোন ভূমিকা না করে সরাসরি তার হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধের স্বরে বললো,
—“তিহান টা সেই বিকেল থেকে বৃষ্টিতে ভিজছে।আমি এতবার মানা করলাম তবুও ছাদে ছুটলো।জানিসইতো কতো একরোখাও জেদি স্বভাবের ও।এত ভিজলে অসুখ করবে।তুই একটু যেয়ে ডেকে আননা মা।তোর কথা ফেলবে না।”
খানিকটা লজ্জা পেলো তোহা।হাতের ছাতাটা খুলে বললো,
—“যাচ্ছি খালামনি।”
____________
অবিরাম পানি পরার রিনিঝিনি শব্দ।ছাদের মেঝেতে যেনো অবিশ্রাম জলনৃত্য চলছে।স্নিগ্ধ স্নিগ্ধ ঘ্রাণ প্রকৃতিজুড়ে।আকাশের আবছায়া নীলাভ আলোয় দেখা যাচ্ছে চারিপাশ।হিমশীতল ঠান্ডা পরিবেশ।
একটা চিরচেনা মেয়েলি ঘ্রাণ নাকে ঠেকতেই এতক্ষন একদৃষ্টিতে মানিব্যাগের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখজোড়া তুলে তাকালো তিহান।তোহাকে দেখে আবারো নিরুদ্বেগ ভাবে মানিব্যাগের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।এই প্রথম না বিগত দেড়ঘন্টায় প্রায় পাঁচ-দশবার এসে গেছে তোহা।সে ছুঁয়ে দিতে নিলেই হারিয়ে যায়,মিলিয়ে যায় বৃষ্টির পানিতে।তাই এবার আর এই ভুল করলোনা তিহান।তোহার উপস্থিতিটাই অনেক তার কাছে।কিন্তু কল্পনায় কি মানুষের শরীরের ঘ্রানও অনুভব করা যায়?
ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে তোহা।ছাতাতে তেমন কাজ হচ্ছেনা।বৃষ্টির ছাঁট এসে প্রায় ভিজিয়েই দিচ্ছে তাকে।ক্ষণে ক্ষণে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে শরীরে।
তিহানের পরণে জামা নই।সম্পূর্ণ উন্মুক্ত বলিষ্ঠ দেহ তার।বৃষ্টির পানিতে যেন মাদকতা আরো বেড়ে গেছে পুরুষালি দেহের।রেলিংয়ে বসে পা ঝুলিয়ে বসে আছে সে।
তোহা একদম এগিয়ে ঠান্ডায় কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
—“তিহান ভাই,আপনাকে খালামনি নিচে যেতে বলেছে।রেলিং থেকে নেমে আসুন।”
চমকে তাকায় তিহান।ব্যস্তহাতে মানিব্যাগটা পকেটে ভরে কৌতুহলী কন্ঠে বলে,
—“তুমি সত্যিই এসেছো?”
—“কিসব বলছেন?আর এভাবে বসে আছেন কেনো?উল্টে পরে যাবেনতো।নামুন।”
হাল্কা লাফে নেমে আসলো তিহান।
তিহান তার সাথে নিচে নামবে ভেবে তোহা যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়াতেই হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নিলো তিহান।শিঁউরে উঠলো তোহা।তাকে আরো অবাক করে দিয়ে হাতের ছাতাটা নামিয়ে বেশ দুরত্বে ছুড়ে ফেললো তিহান।মূহুর্তেই ঝমঝম বৃষ্টির আদুরে আলিঙ্গনে কাকভেজা হয়ে গেলো তোহা।
আকস্মিক ঘটনায় বোকা বনে গেলো তোহা।আমতা আমতা করে বললো,
—“তিহান..”সম্মোধনটা সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই তার ঠোঁটে একআঙ্গুল চেপে ধরলো তিহান।এলোমেলো অনুভূতি খেলে গেলো তোহার মুখ জুড়ে।
মুখটা কিন্চিৎ এগিয়ে আনলো তিহান।তোহার ঠোঁটে মৃদু স্লাইড করে বললো,
—“তিহান”…শুধু এই নামেই ডাকা যায়না?আগে পিছে কোনোকিছু নেই।শুধুই তিহান,তোমার তিহান।”
“তোমার তিহান”কথাটা মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই চোখজোড়া আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে এলো তোহার।কেমন যেনো লাগছে।অসাড় অসাড় হয়ে আসছে শরীর।মনে হচ্ছে নড়ার গতিটাই হারিয়ে ফেলেছে সে।মুখ নাড়িয়ে কিছু বলার শক্তিটাও হঠাৎ হ্রাস পেয়েছে।
মাথায় জর্জেটের লাল রংয়ের ওড়না জড়ানো ছিলো তোহার।এখন তা লেপ্টে আছে আষ্টেপিষ্টে।তীব্র ঘোর লেগে যায় তিহানের।লাল ওড়নায় একদম বউ বউ লাগছে তোহাকে।মেয়েটা এখন কেনো এলো এখানে?না আসলেই তো হতো।অন্তত তার তো নিজেকে সামলানো উচিত।সে কেনো এতোটা বেপরোয়া হচ্ছে?
জোড়ে একটা শ্বাস ছাড়লো তিহান।তোহার কোমড়ে হাত রাখতে যেয়েও হাতটা গুটিয়ে তোহাকে ছেড়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো সে।রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বললো,
—“এটাকেই বোধহয় প্রেমের বৃষ্টি বলে?তাইনা?”
তিহান সরে যাওয়ায় একটু সহজ হয়ে এলো তোহা।নিজেকে স্বাভাবিক করে এগিয়ে যেয়ে নিজেও রেলিংয়ে দুহাত রেখে তিহানের উল্টো হয়ে দাড়ালো।বললো,
—“কি হয়েছে আপনার আজ?”
তিহান মাথা নিচু করে হাসলো।অযথাই ভেজা চুলগুলো ঝেড়ে বললো,
—“কিছু হয়নি।তুমি রাগ করলে?”
—“না”বলে কিছুক্ষন চুপ থাকলো তোহা।তারপর বললো,”আপনি কি পাগল?তখন মানিব্যাগে ওভাবে কি দেখছিলেন?”
তিহান আবারো হাসলো।হুট করে তোহার পেছনে দাড়িয়ে তার একহাতের উপর হাত রাখতেই দ্বিতীয়বারের মতোন শিঁউরে উঠলো তোহা।তিহান মুচকি হেসে অপরহাতে মানিব্যাগটা পকেট থেকে বের করে তোহার সামনে মেলে ধরতেই বজ্রপাতের আলোর ঝলকানিতে স্পষ্ট নিজের দশ-এগারো বছরের একটা ছবি দেখতে পেলো তোহা।ঠোঁট জোড়া কিন্চিৎ ফাঁক হয়ে গেলো তার।চোখবেয়ে নোনাজল গড়িয়ে যাওয়ার কারণটা খুঁজে পেলোনা সে।যদিও বৃষ্টির কারণে চোখের পানিটা আড়াল হয়ে গেছে।আচ্ছা,আসলেই কি সে এতো কিছু পাওয়ার যোগ্য?
তিহান তার কাঁধে থুতনি ঠেকালো।ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“যখন থেকে আমার কাছে মানিব্যাগ থাকা শুরু হয়েছে তখন থেকেই এই ছবিটার স্হান এখানে।মাঝেমধ্য মানিব্যাগটা বদলালেও ছবিটা সঠিক জায়গায় রাখতে কখনোই ভুলিনি আমি।”
তোহা নির্বাক,নিশ্চুপ।ছবিটার উপর পানি পড়ছে,গড়িয়ে যাচ্ছে আবার পানি পড়ছে।কিন্তু সেটা একরত্তিও ভিজছেনা কারণ সেটা খুব যত্নে লেমোনেটিং করা।মানিব্যাগের সেই ছবি রাখার নিখুঁত জায়গাটায়ও ছবিটাকে লেমোনেটিং করে তারপর রেখেছে তিহান।
—“কেউ যদি দেখে ফেলে?”
—“এত বছরে তুমিই দেখতে পাওনি।অন্যকেউ কেমনে দেখবে?”
চুপ করে রইলো তোহা।এতসময় ভেজার কারণে গা গরম হয়ে আছে তিহানের।তার প্রশস্ত বুক তোহার পিঠের সাথে লেগে আছে বিধায় তোহাও সেই উষ্মতার ছোঁয়া পাচ্ছে শরীরজুড়ে।
একটু সময় নেয় তোহা।থেমে থেমে বলে,
—“আপনি এটা এখানে রেখেছেন কেনো?”
—“তোমার ঠোঁটে তো ঠোঁট ছোয়াঁতে পারিনা বৃষ্টিকন্যা।কিন্তু ছবিতে চুমু খেতেতো কোনো বারণ নেই তাই যখনই প্রেমতৃষ্ণা টা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়,তখন এই ছবিতে ঠোঁট ছুঁইয়েই নিজের তৃষ্ণা মেটাই।নিজেকে নিজেই বুঝ দেই যে,”তুমি আমার”,”তুমি আমার”,”তুমি শুধুই আমার”।
~চলবে~