#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৬
গমগমে দুপুরবেলা।কলেজ থেকে ফিরে শাওয়ার নিয়ে মাত্র বেরিয়েছে তোহা।চুলে এখনো ভেজা তোয়ালে পেঁচানো।গুনগুন করতে করতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে বারান্দায় লাগানো ফুলের টবটার দিকে চেয়ে আছে সে।সাদা সাদা ফুল ফুটেছে গাছটায়।ফুলের আকার খুবই ছোট তবে দেখতে বেশ লাগে।সুগন্ধও আসে একটু আধটু।এই নাম না জানা ফুলের প্রতিও একটা অদ্ভুত মায়া কাজ করে তোহার।”ফুল”বস্তুটাই এমন।মনকাড়া,নজরকাড়া,হৃদয়কাড়া।
বেশ অনেকক্ষন যাবত বাসায় গোলাপজাম বানানোর অদম্য চেষ্টায় অব্যাহত আছে আতিয়া।রান্নাঘরের অবস্থা দেখার মতো।আর আতিয়ার অবস্থা আরো বেশি গোলমেলে।
বাসায় মিষ্টি বানানোর ভূতটা অবশ্য এমনি এমনি চাপেনি তার মাথায়।এর পেছনে আরমান সাহেবের কৃতিত্বই বেশি।দুদিন আগে মোড়ের দোকানের মিষ্টি নিয়ে অতি প্রশংসায় মেতে উঠেছিলেন উনি।একপর্যায়ে এক কথা দু’কথা হতে হতে বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলে ফেলেছিলেন তার স্ত্রীর পক্ষে নাকি এমন মিষ্টি বানানো অসম্ভব ব্যাপার।ঠিক তখনই এই মিষ্টি বানানোর ভুতটা মাথায় ঢুকেছে আতিয়ার।আর ফলস্বরূপ আজ দুপুরের রান্না শেষেই নিজের স্বামীকে ভুল প্রমান করার খেলায় নেমেছে সে।
তবে বিপত্তি বাঁধছে বারংবার।কিছুতেই মিষ্টির মন্ডটাকে বানাতে সক্ষম হচ্ছেনা সে।হয়তো কখনো পানি বেশি পরে পাতলা হয়ে যাচ্ছে আবার কখনো বেশি ময়দা পরে ঘন হয়ে যাচ্ছে।
যারপরনাই মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে এলো আতিয়ার।গলা বাড়িয়ে হাঁক ছাড়লো সে,
—“তোহা,এদিকে আয় শিগগির।”
মায়ের ডাকে হতাশাপূর্ণ শ্বাস ছাড়লো তোহা।গোসলের আগেই দেখে গেছিলো মা মিষ্টি বানানোর চেষ্টা করছে।চুলে তোয়ালেটা খুলে রান্নাঘরের দিকে গেলো সে।উঁকি দিয়ে বললো,
—“তুমি পারছোনা তাইতো?খালামনিকে ডাকতে হবে?”
গরম চোখে তাকায় আতিয়া।উত্তপ্ত মেজাজে ফুঁসে উঠে বলে,
—“তিহানকে কখনও দেখেছিস আপার সাথে বেয়াদবি করতে?মুখে মুখে তর্ক করতে?ওর থেকে কিছু শিখতে পারিসনা?দিন দিন তো চরম বেয়াদপ হচ্ছিস।খালি মায়ের মুখের উপর কথা বলা।যা আপাকে ডেকে নিয়ে আয়।”
মায়ের তিক্ত কথায় মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে গেলো তোহার।যদিও সে জানে মা এগুলো রাগের বশেই বলেছে তবুও তার মনটা তো খারাপ হলোই।মুখ ভার করে আফিয়াকে ডাকতে গেলো সে।
গেট খুললো তার খালু।অর্থ্যাৎ তিহানের বাবা।আমজাদ সাহেব।
খালুকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো তোহা।মিষ্টি করে বললো,
—“খালামনি কোথায় খালু?আম্মু ডাকছিলো একটু।”
আমজাদ হাসলেন।পথ ছেড়ে বললেন,
—“ভেতরে আয় মা।তোর খালামনিতো তিহানের ঘরে।তুই ডেকে নে।”
মৃদু গতিতে মাথা নাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো তোহা।নিজেই দরজাটা আটকে দিয়ে তিহানের ঘরের সামনে যেতেই লক্ষ্য করলো মেঝেতে বসে আছে তিহান।আর উপরে বিছানায় বসে তার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে আফিয়া।
আরামে চোখ বন্ধ করে রেখেছে তিহান।তার উপস্থিতি টের পায়নি।
আঙ্গুল দিয়ে হাল্কা করে দরজায় টোঁকা দিলো তোহা।চোখ মেলে তাকালো তিহান।তাকালো আফিয়াও।
তোহা দৃষ্টি আফিয়ার দিকে স্হির করে ছোটমুখে বললো,
—“আম্মু তোমাকে ডাকছে খালামনি।”
তোহার বিষন্ন কন্ঠ আর নত দৃষ্টিতেই যা বোঝার বুঝে গেলো তিহান।ঘাড় বাকিয়ে আফিয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে মৃদু কন্ঠে সে বললো,
—“তুমি যাও মা।আমি দেখি কি হয়েছে।”
আফিয়া ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।তারও বোঝার বাকি নেই তোহার মন খারাপ।তিহানের কথার মানে বুঝতে পেরে তেলের বাটিটা তিহানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠে দাড়ালো সে।বেরিয়ে যাওয়ার আগে তোহার গালে হাত রেখে বললো,
—“মন খারাপ করিসনা।তুই থাক এখানে।আমি যাচ্ছি।”
মাথা নাড়ালো তোহা।আফিয়া বেরিয়ে যেতেই তিহান গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“দরজাটা ভিজিয়ে দে।”
গোমড়ামুখেই দরজা চাপিয়ে দিলো তোহা।
—“আপনি বাসায় কেনো?আমাকে নামিয়ে দিয়ে আর অফিসে যাননি?”বলতে বলতেই তিহানের পাশে এসে দাড়ালো সে।কিছুক্ষণ হাতের তেলের বাটিটা নাড়াচাড়া করলো তিহান।তারপর দুচোখ বন্ধ করে ব্যাথাতুর কন্ঠে উওর দিলো,
—“মাইগ্রেনের ব্যাথা হচ্ছে রে তিহু।মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে বোধহয়।”
সেকেন্ডেই অস্থির হয়ে উঠলো তোহা।ঝুঁকে গিয়ে তিহানের হাত থেকে তেলের বাটিটা নিয়ে হন্তদন্ত কন্ঠে বললো,
—“আচ্ছা,আপনি বসুন।আমি তেল দিয়ে চুল টেনে দেই।ব্যাথা চলে যাবে।”
প্রচন্ড ব্যাথা নিয়েও প্রশান্তিদায়ক হাসি হাসলো তিহান।উঠে দাড়িয়ে যেতেই তোহা মিনমিনে কন্ঠে বললো,
—“এভাবেই তো ঠি ক ছিলো।আপনি তো অনেক লম্বা আমার থেকে।”
বাম ভ্রু উচালো তিহান।তোহার কথা তোয়াক্কা না করে বিছানায় পা তুলে হেলান দিয়ে বসে বললো,
—“তোর থেকে কয় বছরের বড় আমি?”
—“আট।”বোকা বোকা কন্ঠে ফটাফট উওর দিলো তোহা।তিহানের প্রশ্নের মানেটা বুঝতে পারেনি সে।
—“আমি নিচে মাটিতে বসব আর তুই বিছানার উপর?”
আবারো মুখ কুঁচকালো তোহা।বিরক্তি নিয়ে ঠেস দিয়ে বললো,
—“ধ্যাত্ ,বসুন উপরে।বলে তিহানের কাছে যেয়ে দাড়ালো।বাটিটা পাশের টেবিলে রেখে দুহাতে গরম করা তেল মেখে নিয়ে মাথার তালুতে ঘঁষে দিতে দিতে বললো,এত ভাব নিয়ে থাকেন কিভাবে?এজন্যই তো আপনার মাইগ্রেনের এত ব্যাথা।একদম উচিত বিচার।”
প্রত্যুওর করলোনা তিহান।ব্যাথা উপশমের আরামে চক্ষুযুগল আবারো বন্ধ হয়ে এসেছে তার।
॥
প্রায় ঘন্টা খানেক যাবত পরম যত্নে তিহানের চুল টেনে দিচ্ছে তোহা।তার পেটের কাছটায় মাথা কাত করে আলতো ভাবে ঠেকিয়ে রেখেছে তিহান।চোখ এখনো বন্ধ।তোহার একমুহূর্তও বিরক্তি আসেনি।বরং অস্থির মনটা শান্ত হচ্ছেনা কোনোক্রমেই।তিহানের ব্যাথা কমেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলেও করতে পারছেনা।ভাবছে লোকটা হয়তো আরামে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে কথা বললে আবার বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
আরো কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই তোহা নিচু গলায় বললো,
—“ব্যাথা কমেছে?”
আধো আধো চোখে তাকালো তিহান।মাথা সরিয়ে আচমকাই তোহার হাত ধরে নিজের সামনে বসিয়ে দিলো।আধভেজা চুলগুলো ততক্ষনে পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে তোহার।
তোহার চেহারার দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা ঢোঁক গিললো তিহান।মেয়েটার উদাসীনতা সহ্য হয়না তার।তথাপি হাত বারিয়ে দিলো সে।থুতনি ধরে তোহার নত মুখ তার দিকে তুলে কপালের উপর বেরিয়ে আসা চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে বললো,
—“মন খারাপ কেনো?খালামনি বকেছে?”
বিরস নয়নে তাকালো তোহা।মুখ ফুটে বলতে হলোনা তার।তিহান আপনাআপনিই বুঝে নিলো।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,
—“তুই কি বাচ্চা নাকি?জানিসইতো খালামনি একটু শর্ট টেম্পার।এতটুকুতে কেউ মন খারাপ করে?মায়েরা তো বকতেই পারে।”
—“তাই বলে আম্মু শুধু শুধু এভাবে বকবে আমাকে?”চাপা স্বরে বললো তোহা।
বকার কারণ আর জিজ্ঞেস করলোনা তিহান।তোহার তিরতির করে কাঁপা ঠোঁটগুলো নজর এড়ায়নি তার।এ বিষয়ে আরো কিছু বললে এখনি কেঁদে দিবে মেয়েটা।
উঠে দাড়ালো সে।আলমারি থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করতে করতে বললো,
—“ওয়াশরুম থেকে হাতটা ধুয়ে আয়।”
চুপচাপ হাত ধুয়ে আসলো তোহা।বিছানায় বসতেই তিহান পকেট থেকে ফোন বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—“এখানেই থাক,আমার ফোন চালা,ঘুম আসলে ঘুমা।যা ইচ্ছা কর।কিন্তু রুম থেকে বের হবিনা।মাথা গরম আছে…শুধু শুধু খালামনির সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলবি।”
—“আমি খারাপ ব্যবহার করি তিহান ভাই?আম্মু অযথাই বকেছে আমাকে…”
ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁইয়ে তাকে থামিয়ে দিলো তিহান।অত:পর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—“আচ্ছা চুপ কর।আমি গোসলে যাচ্ছি।তুই কিন্তু ঘরেই থাকবি।ঠিকাছে?”
উপরনিচে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো তোহা।তিহান একটু হাসলো।অত:পর জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
______________
প্রায় দেড়ঘন্টার লম্বা শাওয়ার শেষে রুমে ঢুকলো তিহান।তোহা তখন উল্টেপাল্টে ঘুমাচ্ছে।গায়ের জামাকাপড় এলোমেলো।একটু এগিয়ে গেলো তিহান।ফোনের স্ক্রীনে তোহারই একটা হাস্সোজ্জ্বল ছবি জ্বলজ্বল করছে।হয়তো ছবি দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পরেছে মেয়েটা।
মিটমিট করে হাসলো তিহান।তার গ্যালারির একটা বড় অংশ জুড়ে শুধুই তোহার ছবি।বিষয়টা তোহার অজানা নয়।উপরন্তু তার ফোনের সব পাসওয়ার্ডই মেয়েটার জানা।তবে ছবিগুলো দেখলেও সরাসরি কিছু বলেনা সে।না বলে তিহান নিজে।
একটু ঝুঁকে গেলো তিহান।তোহার হাত থেকে ফোন নিয়ে সরিয়ে রেখে হাতটা ধরে হাতের উল্টোপিঠ আলতো করে নিজের দু গালে ছুঁইয়ে দিয়ে মুচকি হাসলো।
~চলবে~
#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৭
মাস তিনেক পেরিয়ে গেছে।বর্ষার শেষে শরতের আগমন আসবো আসবো করছে।এতদিনের বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি ধীরে ধীরে স্নিগ্ধ কাঁশফুলের নরম চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে নিচ্ছে।আকাশে আজকাল বর্ষার ধুসর কালো মেঘের আধিপত্য দেখা যায় না,সেখানে শুধুই সাদা শুভ্র মেঘের বিস্তর আনাগোনা।নিরব নিরব শান্ত পরিবেশ থাকে সবসময়।
তোহার মিডটার্ম পরীক্ষা শেষ হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে।মাসের শেষে রেজাল্ট।ততদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে উরণচন্ডী ভাব নিয়ে আছে তোহা।পরীক্ষার শেষের পর কিছু দিন এমনেও পড়াশোনা হয়না তার।জোর করেও হয়না।সারাদিন এটা ওটা অকাজ করেই দিন কাটে।কলেজ যায়না মাঝেমধ্যেই।এ নিয়ে তিহানও কিছু বলেনা।একয়দিন পড়াশোনা নিয়ে বেশ চাপের মধ্যই ছিলো তোহা।পড়াশোনায় কোনরকম গাফিলতি করেনি।
তাই তিহান তেমন একটা বকেনা এখন।
॥
তুর্যর রুমে বিছানায় পা তুলে বসে আছে তোহা।বৃহস্পতিবার হওয়ায় আগামী দুইদিন ভার্সিটি বন্ধ তূর্যর।পড়াশোনা থেকে একটুখানি বিরতি।সেজন্যই বোনকে এখনো রুম থেকে বের করেনি সে।বোনের পাশেই বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে।সেরকম প্রকাশ না করতে পারলেও বোনকে প্রচন্ডরকম স্নেহ করে সে।
তোহার হাতে একটা উপন্যাসের বই।চোখের গভীর দৃষ্টি সাদা পাতার কালো কালির কাব্যিক অক্ষর গুলোয়।বলা বাহুল্য,বইটা তূর্যর শেলফ থেকেই নিয়েছে সে।তূর্য নিজের বুকশেলফে কাউকে হাত না দিতে দিলেও তোহাকে বারণ করেনা কখনো।এই সবগুলো বইই তার নিজের টাকায় কিনা।বেশ শখের।
—“পৃষ্ঠাগুলো আসতে উল্টা।ছিঁড়ে ফেলবি তো।”ক্রমাগত ল্যাপটপের কি-বোর্ডে হাতের আঙ্গুলগুলো চালাতে চালাতে বললো তূর্য।
তোহা মুখ তুলে না তাকিয়েই নির্বিকার কন্ঠে বললো,
—“আমি আস্তেই উল্টাচ্ছি ভাইয়া।ছিঁড়বেনা।”ভাইয়ের ছুক ছুক স্বভাব সম্পর্কে অবগত আছে সে।নিজের প্রিয় জিনিসগুলো প্রতি অত্যধিক যত্নশীল তূর্য।একটু উনিশ-বিশ হলেই আফসোস করতে করতে গলা শুকিয়ে ফেলে ।অর্ধেক বই শেষ করতেই বাইরে অতিপরিচিত কিছু কন্ঠে কান খাড়া হয়ে উঠলো তোহার।তূর্য ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে তাকালো।ভ্রু কুচকে বললো,
—“স্বর্নাদের আসার কথা ছিলো নাকি?আমি তো জানতাম না।”
—“আমিও জানতাম না ভাইয়া।দাড়াও দেখে আসি।।”বলে উঠতে নিলেই গেট খুলে ঘরে ঢুকলো সাইফ আর নুহাশ।তাদের পিছে পিছে স্বর্ণা।বইটা ধীরগতিতে হাত থেকে নামিয়ে কোলের উপর রাখলো তোহা।মুখে প্রগাঢ় হাসি টেনে বললো,
—“তোমরা আসবা আমরাতো জানিই না।বসো বসো।”
বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পরলো তারা।সাইফ খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বললো,
—“তুই জানিসনা?আজকেতো..”
তার আগেই সশব্দে দরজা খুললো তিহান।সাইফদের দিকে তাকিয়ে ঝাড়ি মেরে বললো,
—“তোদের না আরো আগে রওনা দিতে বলেছিলাম?আর সবকটা এখানে কি করিস?ব্যাগ ট্যাগ সব গোছানো শেষ নাকি..”
তিহানের কথা শেষ করতে দিলোনা তোহা।কৌতুহলী কন্ঠে বলল,
—“ব্যাগ গোছানো মানে?কেনো ব্যাগ গোছাবো তিহান ভাই?”
—“ওহ হো,তোর তো দিন দুনিয়ায় ধ্যানই নাই তিহু,কুনোব্যাঙের মতো এ ঘরে ও ঘরে পরে থাকা ছাড়া আর কিছুতো পারিসও না।জানবি কেমনে?”
—“আপনি আমাকে কুনোব্যাঙ বললেন?”ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো তোহা।
আরো কিছু বলার আগেই তূর্য মাথায় হাল্কা চাঁটি মেড়ে থামিয়ে দিলো তাকে।তিহানকে সবাই যথেষ্ট ভয় পেলেও এই তোহা একদম ঠোঁটকাটা স্বভাবের।
পাত্তা দিলোনা তিহান।তূর্যর দিকে তাকিয়ে ব্যস্তভাবে বললো,
—“নানুর বাড়ি..চট্রগ্রাম যাচ্ছি আমরা।তোরা হয়তো জানিসনা।খালামনি বলতে ভুলে গেছে বোধহয়।সকালেই হুট করে প্ল্যান হয়েছে।আজ রাতে রওনা দিব।আমরা কাজিনরা একসাথে যাব।আর খালা-খালুরা আলাদা গাড়িতে।”
বলতে বলতেই এগিয়ে এলো তিহান।তোহার কোল থেকে বইটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে ঠোঁট চেপে হেসে জ্বালাময়ী কন্ঠে ঠাট্টার স্বরে বললো,
—“আহা তিহু,ভাইয়ের সামনে বসে প্রেমের উপন্যাস পড়িস আজকাল?ধরে বিয়ে দিয়ে দিবো নাকি?অকালপক্ক কোথাকার।”
বাক্য পূর্ণ হওয়ার পরপরই সমস্বরে হাসির শব্দে মুহুর্তেই নাকের ডগা লাল হয়ে এলো তোহার।ঠোঁট আর চোয়াল শক্ত।চোখে মৃদুমন্দ আগ্রাসি হতাশ ভাব।নেহাতই তার থেকে বয়সে অনেক বড় বলে এই লোকটার উপর কিছু বলতে পারেনা সে।রীতিমত গা জ্বালানো অনুভূতি।নিজেকে আটকানো বড়ই অসহ্যকর!
_______________
“আকস্মিক” শব্দটাতেই একটা অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করে।হুটহাট ভালো কিছু ঘটে যাওয়ার থেকে আনন্দদায়ক কিছু এ ধরণীতে হতে পারেনা।এখানে কোনকিছু পূর্ব পরিকল্পিত থাকে না।কোন উচ্চ আশা থাকেনা।যা হয় তাই ই ভালোলাগে।তেমনই বহুদিনের পরিকল্পিত ভ্রমনের থেকে আকস্মিক ভ্রমনগুলোই বেশি মনকাড়া।
আড্ডায় মেতে উঠে আর হেলাফেলায় রওনা দিতে বেশ রাত হয়ে গেছে তোহাদের।সারারাত জার্নি করে সকালে পৌঁছাবে।ঘড়িতে বাজে সাড়ে দশটা।মাত্র সাইফদের গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসলো সে।সে বসেছে পেছনের সিটে জানলার পাশে।তার পাশে স্বর্ণালী আর স্বর্ণালীর পাশে নুহাশ।সামনের সিটে তূর্য আর ড্রাইভিং সিটে সাইফ।তিহান এখনো আসেনি।সবার ব্যাগপত্র পেছনে গুছিয়ে রেখে,খালা-খালুদের গাড়ি চলতে শুরু করলে তবেই এই গাড়ির দিকে এগোলো সে।তোহার পাশের দরজা খুলে পা ঢোকাতে ঢোকাতে বললো,
—“চেপে বস।”
তোহা চেপে তো বসলোইনা উল্টো একহাতে তিহানের বুকে ঠেস দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
—“আমি জানালার পাশে বসব।আপনি স্বর্ণা আপুর পাশে বসেন।আমাকে বের হতে দেন।”
তার কথা কানে যেতেই আৎকে উঠলো স্বর্ণা।এমনেই তিহানকে প্রচন্ড রকম ভয় পায় সে।তিহানের ধমকে সবসময় তথস্ত হয়ে থাকে।তার উপর তার ঘুম ভালোনা।দেখা যাবে ঘুমের মাঝে তিহানকে উলোটপালোট ধাক্কা দিয়ে দিলে তাকে ঘুমের মধ্যই চড় না বসিয়ে দেয় সে।বিচ্ছিরি ব্যাপার!
ভাবতে ভাবতেই তোহার জামা টেনে ধরলো সে।চোখে এক সমুদ্র অসহায়ত্ব নিয়ে চাপা স্বরে বললো,
—“তোহা রে,এমন করিস না বোন।আমি বসবোনা তিহান ভাইয়ের সাথে।প্লিজ।”
তিহান ততক্ষনে বেরিয়ে গেছে।তোহাকে বের হওয়ার জায়গা করে দিয়ে পাশে দাড়িয়েছে।
স্বর্ণালিকে চোখেমুখের ভীত ভাবটা দেখে আর না করতে পারলোনা তোহা।মাথা বারিয়ে তিহানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—“আচ্ছা থাক আসেন ভিতরে।”
বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়লো তিহান।ধুপ করে ঢুকে তোহার গা ঘেঁষেই বসে পরলো।আজাইরা খোশগল্প চললো বেশ কিছুক্ষন।তবে রাত ঘনিয়ে আসতেই একে একে প্রায় সবারই ঘুম ঘুম ভাব ধরে গেলো।এতক্ষনের হইহুল্লোর করা পরিবেশটা হঠাৎই নিভিয়ে আসলো।নিরবতার আচ্ছাদনে ছেঁয়ে গেলো আবছায়া পরিবেশ।
জানালা খোলা।আড়চোখে পাশে তাকালো তিহান।চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় মেয়েটার রুপের বর্ণনা অত্যাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে।লাইনের পর লাইন বলে গেলেও তা বর্ণনা করা অতি দুষ্কর।
হাসলো তিহান।তোহা পিটপিট করে তাকাচ্ছে।চোখ ডলছে আবার সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে।
তিহানের হাতে মোবাইল।দৃষ্টি যদিও সেদিকে নেই তবুও মনে হবে সে ফোনই চালাচ্ছে।
খানিকবাদে উষখুষ করে গভীর দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো তোহা।স্বর্নালি নুহাশের দিকে হেলে পরে মুখ কিন্চিৎ হা করে ঘুমাচ্ছে।বোনের ধাক্কায় নুহাশের মাথাটা আটকে আছে জানালার কাঁচের সাথে।তূর্যও ঘুম।শুধু সাইফ গাড়ি চালাচ্ছে।তবে তার দৃষ্টি আর মনোযোগ সামনের দিকেই।
বড় করে একটা হাই তুললো তোহা।তিহানের আরো একটু কাছে চেপে নিভু নিভু কন্ঠে বললো,
—“হাত সরান,ঘুম পাচ্ছে।”
তাকালোনা তিহান।তবে তৎক্ষণাৎ ফোনের স্ক্রীনের লাইটটা বন্ধ করে একহাত তোহার মাথার পেছন দিক দিয়ে মেলে দিয়ে ছোট্ট করে বললো,
—“আসো।”
একমূহুর্ত দেরি করলোনা তোহা।একহাতে তিহানকে জড়িয়ে ধরে বিড়াল ছানার মতো গুটিশুটি হয়ে তিহানের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো।মুচকি হাসলো তিহান।দৃষ্টি একবার আকাশের চাঁদটার দিকে নিতে যেয়েও মুখ ফেরালো সে।তবে বুকে ঘুমানো চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আর চোখ ফেরাতে পারলোনা।আটকে রইলো সেখানেই।
আবারো হাসলো তিহান।প্রেমিকার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে কি আর প্রেমিকের ঠোটের হাসি থামে?নাহ,একদমই না।
আলতো করে তোহার চুলে হাত গলিয়ে দিলো সে।অত:পর তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,
—“—“শোনো হৃদয়হরণী,তোমার এই আধো আধো আবদার গুলোয় আমি নাহয় আরো একটু ধংস্ব হই।এই হৃদয়ের প্রেমের বাসনাটা আরো খানিকটা উঁপচে পড়ুক।দিনশেষে আমার বুকে তোমার শান্তির ঘুম দেখে আমার অশান্ত প্রেমিক মনটা একটু হলেও শান্ত হোক।তুমি সবসময় এমনই থেকো।আমার অপ্রকাশিত প্রেমিকা হয়েই..।”
___________
দিনের একটু আধটু আলো ফুটেছে বোধহয়।আধো ঘুম আধো জাগরণেই কেটেছে সারারাত।তবে ভোরের দিকে একটু চোখ লেগেছিলো তিহানের।তবে ভেঙে গেলো ঘন্টাখানেক বাদেই।আকাশে তখন সূর্য উঁকি দিচ্ছে মাত্র।গাড়ি থেমে আছে একটা রোডের পাশে।গাড়ি থামিয়ে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে সাইফ।
তিহানের ঘুম ভাঙতেই চোখের উপর কালো রংয়ের একটা কাপড়ের আবরণে ভ্রু জোড়া অদ্ভুতভাবে কুঁচকে গেলো তার।মুখের উপর থেকে কাপড়টা সরাতেই এর অর্থোদ্ধার হয়ে গেলো।তার চোখের উপর নিজের ওড়না টেনে দিয়ে দিয়েছিলো তোহা।যেনো সকালের আলোতে তিহানের ঘুম না ভাঙে।
তোহা অবশ্য তখন সজাগ নয়।আষ্টেপিষ্টে তার সাথে লেপ্টে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা।হাতের মুঠোয় ওড়নাটা নিয়েই বেকিয়ে যাওয়া শরীরটা সোজা করে বসলো তিহান।হাতের ওড়নাটাও দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
—“”প্রেমিকার আজকাল প্রেমিকের খেয়াল রাখার নেশা উঠেছে?ইমপ্রেসিভ!”
~চলবে~