#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৮
সূর্য উঠে যাচ্ছে প্রায়।একটু আধটু আলোকিত হয়ে আসছে চারিপাশ।ফোন বের করে সময় দেখলো তিহান।সকাল ছয়টা।ফোনটা পুনরায় পকেটে ঢুকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।রাস্তা নির্জন।লোক সমাগম এখনো শুরু হয়নি।এখান থেকে আরো একঘন্টার পথ অতিক্রম করলেই তাদের নানুর বাড়ি।সাইফ বেচারা সারারাত ড্রাইভ করেছে এখন তাকে আবারো ডেকে গাড়ি চালাতে বলাটা একেবারেই বেমানান।ছোট্ট করে একটা হাঁফ ছাড়লো তিহান।হাতের মুঠোয় থাকা ওড়নার অংশবিশেষ তোহার গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে একহাত বারিয়ে সাইফের কাঁধে মৃদুভাবে ধাক্কা দিলো সে।প্রথমবার সাড়াশব্দ না করলেও দ্বিতীয়বারেরই চোখ মেলে তাকালো সাইফ।আচ্ছন্নের মতো লাল লাল চোখগুলো কঁচলে বললো,
—“আসলে চোখটা লেগে এসেছিলো তিহান ভাই,আমি এখনি স্টার্ট…”
মাঝেই তাকে থামিয়ে দিলো তিহান।গলার স্বর নামিয়ে স্নেহের সহিত বললো,
—“তুই পিছে এসে বস।ঘুমা একটু।আমি ড্রাইভ করছি।সমস্যা নেই।”
—“আরে না না,আমি পারবো।”অপ্রস্তুত হয়ে বললো সাইফ।
তিহান নিরুদ্বেগ কন্ঠে একটু গাম্ভীর্য ঢেলে বললো,
—“সাইফ,যা বলেছি তা কর।বের হয়ে,পিছে আয়।”
তিহানের কথার উপর আর কোন কথা বললোনা সাইফ।ধীরগতিতে বের হয়ে পিছে এসে দাড়াতেই তিহান দরজা খুললো।তোহার হেলে পরা মাথাটা বুক থেকে সরিয়ে হাতের তালুর উপর নিয়ে কোনরকমে বের হয়ে সাইফকে ঢুকতে বললো।চেপেচুপে ঢুকে পরলো সাইফ।ঢুকে বসতেই তিহান আলতো করে সাইফের কাঁধে তোহার মাথাটা ঠেকিয়ে দিয়ে খানিকটা আদেশসূচক ভঙ্গিতে বললো,
—“ওর ঘুম যেনো না ভাঙে,দেখিস।”
মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো সাইফ।এই হাসির মানে বুঝে তিহান।প্রত্যুওরে সেও হাল্কা হেসে আরো একবার তোহার ঘুমন্ত মুখখানায় চোখ বুলিয়ে দরজা আটকে দিলো।ঠান্ডা প্রকৃতির নির্মল বাতাসে জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো।
_______________
আভিজাত্য ধরণের একটা প্রাচীরঘেরা দোতলা বাড়ি।পুরনো যুগের হওয়ার পরও কদিন পরপরই রং করা হয় তাই অত বিভিষিকাময় অবস্থা নেই।নানার বহুকষ্টের পরিশ্রমের বাড়ি এটা।
গাড়ি থেমে যেতেই হাল্কা ডাকে সবাইকে উঠিয়ে দিলো তিহান।তবে তোহা তখনো ঘুমাচ্ছে।সাইফ এতক্ষন ঘুমালেও এখন চোখ মেলে তাকিয়ে মূর্তির মতো বসে আছে।বিন্দুমাত্র নড়াচড়া নেই তার মাঝে।সবাই নেমে যেতেই তিহানও নামলো।তাদের গাড়ি থামতে দেখেই ছুটে এসেছে মোসতাক চাচা।এ বাসার যাবতীয় দেখাশোনা কাজকর্ম তিনিই করেন।নানা নানু আর কয়েকজন রান্নাবান্না করার জন্য আছে তাছাড়া এই বিশাল বাড়ি খালিই পরে থাকে।ব্যাগ পত্রগুলো কয়েকজনের হাতে গছিয়ে দিয়ে সাইফের পাশের দরজা খুলে দাড়ালো তিহান।বললো,
—“বের হ,আমি উঠাচ্ছি ওকে।”
সাইফ বের হয়ে যেতেই মাথা হেলে পড়ায় ঘুম ঘুম চোখে তাকালো তোহা।জড়ানো কন্ঠে বললো,
—“সকাল হয়ে গেল কখন?”বলেই আশেপাশে তাকালো সে।কাউকে না পেয়ে চমকিত কন্ঠে বললো,”সবাই কোথায়?”
—“সবাই বের হয়ে গেছে।তুই ই ঘুমাচ্ছিস শুধু।আয় বের হ।”
আড়মোড়া ভেঙে উঠে এলো তোহা।ঘুম ভাঙলে সাধারণত মেজাজ চড়ে থাকলেও আজ তার ব্যতিক্রম হলো।আশেপাশের স্নিগ্ধতায় জর্জরিত সবুজ প্রকৃতি দেখতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো।কি সুন্দর গাছগাছালি।শরতের ছোঁয়ায় সব পাতায় পাতায় পরিপূর্ণ।পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে।আহা!
শেষবার নানুবাড়ি এসেছিলো প্রায় দুই বছর আগে।বিশেষ একটা আসা হয়না।নানা নানুর সাথে ব্যাবধাণিক দুরত্ব টা বেশি হলেও মনের দূরত্বটা একেবারেই কম।তার দাদা দাদি নেই।তার জন্মের আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।শুধু তিহান ছাড়া আর কেউই তাদের স্নেহের সান্নিধ্য পায় নি।
_____________
বাড়িতে ঢুকতেই গোসল সেরে নিয়েছে সবাই।খালা-খালুরা সবাই তাদের আগেই পৌছে গিয়েছিলো।
দোতলায় একলাইনে সারিবেঁধে অনেকগুলো ঘর।সামনে লম্বা বারান্দার মতোন।সেখানে দাড়ালে নিচের পুরো হলরুম দেখা যায়।বারান্দার সাইডের জায়গাটা গোলাকারে প্রসারিত।ওখানে থেকে পুরো উঠান বাগান একপাশের পুকুর সব দৃশ্যমান।কোণার দিকের বড় ঘরটায় তাদের নানা নানু থাকে।বাকি গুলো তারা আসবে শুনে পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে।
তিহান আর তূর্য এক রুমে।তাদের পাশের রুমে স্বর্ণালী আর তোহা।আর তার পরের টায় সাইফ আর নুহাশ।
॥
গোসল শেষে একটা হাল্কা সবুজ রংয়ের থ্রিপিস পরে বেরিয়েছে তোহা।ভেজা চুলগুলো ঝেড়ে নিয়ে ফ্যানের নিচে বসে আরাম করে চুলের বাকিটা শুকাচ্ছে।
স্বর্ণালির আগেই শেষ গোসল।দুবার লোক এসে ডেকে গেছে তাদের নিচে নামার জন্য।স্বর্ণালী আবারো তাঁড়া দিতেই আর দেরি করলোনা তোহা।মাথায় ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে গেল নিচের উদ্দেশ্য।নানা নানুর সাথে
দেখা হয়নি এখনো।তারা যখন এসেছে তখন ঘুমিয়ে ছিলেন তারা।
নিচে নামতেই নানাসহ সবাইকে সুবিশাল টেবিলে বসে থাকতে দেখলো তারা।তাদের নানা অর্থ্যাৎ নিজাম রহমান বসে আছে মাঝের চেয়ারটায়।মুখে প্রশস্ত হাসি।এতদিন পর বাড়িটা আবারো ভরা ভরা লাগছে।
মাঝে মধ্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলেও সুস্থ হলেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেন তিনি।মনেই হয়না এই লোকটার এত অসুস্থতা হয়।
তোহা আর স্বর্ণালী দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো।নানাকে সালাম দিয়ে দাড়াতেই তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন উনি।হেসে বললেন,
—“এতো বড় হয়ে গেছে নাতনি দুজন?বিয়েশাদির ব্যবস্থা করতে হবে কদিন পর।”
নানার ঠাট্টাটা গায়ে না মাখলেও খানিকটা লজ্জা পেলো দুজনেই।তবে প্রতিউওর না করে ভদ্রতার সহিত চুপচাপ টেবিলে বসলো তারা।
তোহার একপাশে তিহান আর আরেকপাশে আফিয়া।তাদের মাঝখানে বসেছে তোহা।মূলত এই চেয়ারটা তোহার জন্যই খালি রেখে দিয়েছিলো তিহান।
খাওয়ার টেবিলে খাবারের মেলা বসে গেছে।কোন কিছু আর বাদ নেই।
রুটি মাংস আছে আবার ভুনা খিচুড়িও আছে।
—“এই হচ্ছে আমাদের বিলেতি ছেলে,চোখের রং দেখছো মনোয়ারা?পুরা বিলেতিদের মতো।”রুটি দিয়ে মাংস চিবাতে চিবাতে স্ত্রীর উদ্দেশ্য বললো নিজাম রহমান।
অগোছালোভাবে হাসলো তিহান।তোহা আড়চোখে একবার তাকিয়ে নিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
তিহান খিচুড়ি দিয়ে নানারকমের ভর্তা মিশিয়ে খাচ্ছে।তোহা খাচ্ছে আটার রুটি আর মুরগীর মাংসের ঝোল।
খিচুড়ি নেয়নি সে।এই সকাল সকাল অযথা হাত মাখামাখি করে খেতে ইচ্ছে করছেনা তার।
ভর্তা দিয়ে খাওয়া শেষে একটুখানি আমের আচার প্লেটে তুলে নিলো তিহান।খিচুড়ি দিয়ে মাখিয়ে একবার মুখে নিয়ে দ্বিতীয় নলাটা তোহার মুখের সামনে ধরে ধীরকন্ঠে বললো,
—“হা কর,খেয়ে দেখ ভালোলাগবে।”
ছোট করে মুখ খুললো তোহা।তিহান তুলে দিতেই চুপচাপ খেয়ে আবারো হা করলো।হাসলো তিহান।নিজে আর একগালও খেলোনা।একটু পরপরই তোহার মুখে অল্প অল্প করে তুলে দিতে লাগলো।হাসি গল্পে মেতে থাকলেও এরমধ্যও পুরো ব্যাপারটা নজর এড়ালোনা নিজাম রহমানের।তিহানের ঠোঁটের কোণের ক্ষীণ হাসিটাও গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলো সে।অত:পর মাথা ঝুঁকিয়ে মুচকি হেসে চুপচাপ খাওয়ার মনোনিবেশ করলো।
~চলবে~
#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৯
বিশাল উঠানজুড়ে সবুজ দূর্বা ঘাস লাগানো আছে।নিয়মিত পরিচর্যার কারণে সব জায়গায় একেবারে সমানে সমান করে কাঁটা।একটু উঁচু নিচু নেই।নরম ঘাসের উপর নগ্ন পায়ের স্পর্শ লাগলে মনে হয় কোনো পশমি কার্পেটের উপর নির্বিঘ্ন পদচারণ চলছে।একটা কোঁণে পর পর দু তিনটা শিউলি ফুলের বড় আকারের গাছ।নিচে বিছিয়ে থাকা সাদা সাদা ফুলগুলো তাজা নয়।ভোরের দিকেই সেগুলো গাছ থেকে ঝড়ো পরেছে বিধায় তাদের সুরভী ভাবটা এখন আর নেই।কেমন যেন মিইয়ে চুপসে গেছে।
খালিপায়ে একপা দু’পা করে সেদিকটায় এগিয়ে গেলো তোহা।ঝুঁকে গিয়ে কতকগুলো ফুল হাতে উঠিয়ে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করলো।তীব্র সুঘ্রাণ না আসলেও হাল্কা হাল্কা আসছে।
—“জুতো ফেলে খালিপায়ে ঘুরছিস কেনো?পায়ে বিঁধে যাবেতো কিছু একটা।”
কথাটা শোনামাত্র সচকিত হয়ে পিছে ফিরলো তোহা।তিহানের মুখ দেখার আগে তার নজর গেলো তিহানের হাতের দিকে।তার খুলে রেখে আসা জুতোজোড়া হাতে নিয়ে সটান দাড়িয়ে আছে তিহান।শীতল দৃষ্টি তোহার ফুলভর্তি হাতের মধ্য।
তোহা মুখফুঁটে কিছু বলার আগেই এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পরলো তিহান।একহাতে জুতো নিয়ে আরেকহাত তোহার পায়ের দিকে বাড়াতেই আপনাআপনিই দুই কদম পিছিয়ে গেলো তোহা।মাটিতে পরে থাকা কয়েকটা শিউলি ফুল পদতলে পিষ্ট হয়ে পায়ের সাথে বিশ্রি ভাবে লেপ্টে গেলো।সেদিকে খেয়াল দিলোনা তোহা।তিহানের দিকে চেয়ে সপ্রতিভ কন্ঠে বললো,
—“পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?”
—“জুতো পরাবো।ইডিয়ট।পা’টা আগে আন।”দাঁতে দাঁতে চেপে উওর দিলো তিহান।
তোহার মধ্য পা এগিয়ে দেয়ার কোন উদ্বেগ দেখা গেলোনা।গলার স্বর নামিয়ে উষখুষ করে সে বললো,
—“আমি পরবোনা জুতো।এভাবেই ভালো লাগছে।”
কিছুক্ষন চুপ থাকলো তিহান।অহেতুক মাথাচাড়া দেয়া রাগটাকে সামলে একটু নরম হলো সে।মুখের কাঠিন্য কমিয়ে কোমলকন্ঠে বলল,
—“খালিপায়ে ঘুরে বেরানোর কোনো মানে আছে তিহু?কাঁটা মাটা বিঁধে গেলেতো তুই ই ব্যাথা পাবি।তোর হাতে ফুল,আমি পরিয়ে দেই।”বলেই তোহার পা রাখার জন্য হাতের তালু মেলে দিলো সে।
তোহা পা বাড়ালোনা।তিহানের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধাবোধ থেকেই তার হাতের উপর পা রাখতেই কেমন একটা ইততস্ত বোধ হচ্ছে।উপায় না পেয়ে হাতের ভুলগুলা ফেলে দিতে উদ্যত হয়ে বললো,
—“আমি পরে নিচ্ছি।”
—“তোমাকে ফুল ফেলতে বলেছি আমি?পা দাও।”
রাশভারি কন্ঠের ধমকিয় আদেশে থেমে যেতে হলো তোহাকে।হাতের ফুলগুলো হাতেই রয়ে গেলো।চুপচাপ ডানপাটা তিহানের হাতের উপর রাখলো সে।প্রথমেই জুতো পরালোনা তিহান।পকেট থেকে রুমাল বের করে পায়ের তালুতে পিষ্ট হয়ে লেগে থাকা ফুলগুলো মুছে পরিষ্কার করে তারপর জুতো পরিয়ে দিলো।জুতো টায় ফিতা আটকাতে হয় তাই নিজে নিজে পা ঢুকিয়ে পরার অবকাশ নেই।হাত দিয়েই পরতে হয়।
কাজ শেষ হতেই দ্রুত পা সরিয়ে নিলো তোহা।উঠোনের একপাশে বড় একটা কাঁঠাল গাছ আছে।যদিও এখন কাঁঠাল নেই তবে গ্রীষ্মের সময় গাছ ভরে উঠে।
সেই কাঁঠাল গাছের বিস্তৃত ডালপালার নিচে রোদের তেজ পৌছাতে পারেনা।সেখানে ইট সিমেন্ট দিয়ে বসার জায়গা বানানো আছে।লাল রংয়ের রং করা বসার সিট বিধায় বেশ দৃষ্টিনন্দন।
সেখানেই বসে আছে বাকি কাজিনরা।যদিও তাদের নজর এদিকে আসার সুযোগ নেই।কারণ এপাশে পিঠ দিয়ে বসেছে সবাই।তবুও কেমন একটা অদ্ভুত ভয় লাগে তোহার।যদি কেউ দেখে ফেলতো কি লজ্জায়ই না পরতো সে।
_______________
গ্রামের দিকটায় গাঢ় সন্ধ্যা হলেই নিরবতা নেমে আছে।সুনসান প্রকৃতির মাঝে ঝিঁ ঝিঁ পোকার এলোপাথারি ডাক।আলো না থাকলেই কেমন ভুঁতুরে পরিবেশ।সেই সাথে ঠান্ডা হাওয়ায় কেমন ঝিঁমানো অনুভূতি।সারাদিন হইহুল্লোর করায় গতকাল অনেকটা সন্ধ্যার দিকেই ঘুমিয়ে পরেছিলো তোহা।রাতের খাবারো খায়নি।
তথাপি ক্ষুধার জ্বালায় পেটে মোচর দেয়ায় আর আগেভাগে ঘুমানোর ফলে খুব ভোরবেলাই ঘুম ভেঙে গেলো তার।মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে।মেজমেজে লাগছে শরীর।শিরায় উপশিরায় আড়ষ্টভাব।
তার পাশে স্বর্ণালী ঘুমাচ্ছে।ঘুমানোর সময় অবশ্য সে একাই শুয়েছিলো।স্বর্ণালী বোধহয় রাতের বেলা এসেছে।
দু’হাত দুদিকে মেলে টানা দিয়ে উঠে বসলো তোহা।মুখে হাত ডলতেই বুঝলো তৈলাক্ত হয়ে আছে ত্বক।একটা হাই তুলে বিছানা থেকে নামলো সে।লাইট জ্বালাতে যেয়েও জ্বালালোনা।স্বর্নালির ঘুমে অযথা ডিস্টার্ব করে লাভ নেই।
ওয়াশরুমে যেয়ে মুখ হাত ধুলো।গায়ে তখনো কালকের সবুজ জামাটাই।ঘুমানোর আগে আর বদলানো হয়নি।
ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আস্তে করে রুমের দরজা খুললো তোহা।বাড়ির সবাই ঘুম।মুখ ঘুরিয়ে বড় বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো এখনো সব স্পষ্ট নয়।ধোঁয়াটে সাদা ভাব।একটু এগোলো সে।ছোট থেকেই শুনে এসেছে শিউলি ফুল রাতে ফোঁটে আর ভোরে ঝরে যায়।তবে শহরে থাকার দরুন চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হয়নি কখনো।এতদিনের সুপ্ত বাসনার কৌতুহল দমাতে না পেরে সিঁড়ি ভেঙে ধীরপায়ে নিচে নেমে গেলো তোহা।
অত:পর নরম ঘাস মাড়িয়ে উঠোনে উপস্থিত হতেই সেখানে সাদা পাতলা টি-শার্ট পরিহিত তিহানকে দেখে রীতিমত চমকে উঠলো সে।অষ্পষ্ট স্বরে আপনাআপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,
—“আপনি এখানে..?”
কথাটা খুব আস্তে বললেও চারদিকের নিস্তব্ধতার ভীড়ে তা তিহানের কানে যেতে খুব একটা অসুবিধা হলোনা।সাথেসাথেই ফিরে তাকালো তিহান।তোহাকে দেখে অনেকটা অবাকভাব মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠলেও পরমূহুর্তেই মুখ ফিরিয়ে আবারো আকাশের দিকে দৃষ্টি দিলো সে।সেদিকে তাকিয়েই কন্ঠে গাম্ভীর্য নিয়ে বললো,
—“কাছে আসো।”
তোহার গোছানো দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে গেলো মূহুর্তেই।শূন্যমস্তিষ্কে মাথায় হাল্কা সবুজ রংয়ের ওড়নাটা টেনে নিয়ে আস্তে করে তিহানের পাশে যেয়ে দাড়ালো সে।সে দাড়াতেই পেছন দিয়ে বাহু জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো তিহান।অপ্রস্তুত হয়ে পরলো তোহা।বিচলিত কন্ঠে বললো,
—“কি করছেন?কেউ..”
—“কেউ নেই এখানে।”তিহানের কাঠ কাঠ উওর।
হঠাৎই বাকশূন্য হয়ে গেলো তোহা।শিউলি ফুলের তীব্র সুঘ্রাণে চারিপাশ ম ম করছে।ফুলেল সুবাস সাথে প্রেমিকের উষ্ণ আবেগী ছোঁয়ায় মাথা কেমন ঝিম ঝিম করছে।মনে হচ্ছে এখনি মূর্ছা যাবে সে।
—“এত ভোরে উঠেছো যে?কালরাতে তো খাওনি,ক্ষুধা পেয়েছে?”
কিছুক্ষন আমতা আমতা করলো তোহা।অত:পর একটু থেমে থেমে বোকাকন্ঠে উওর দিলো,
—“আমি আসলে ফুল দেখতে এসেছিলাম।”
—“ফুল?”
—“ওইযে শিউলি ফুল..”হাতের তর্জনী উচিয়ে ইশারা করলো তোহা।তার ইশারা অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো তিহান।মাটিতে চাদরের ন্যায় বিছিয়ে থাকা শিউলি ফুলগুলো দেখতেই ঠোঁটের কোঁণে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তার।তোহা সমেত সেখানটায় গিয়ে দাড়ালো সে।তোহাকে ছেড়ে দুহাতের মুঠোয় ভর্তি ফুল নিয়ে তোহার হাতের আজলা ভরে দিলো।কেনো যেনো এতগুলো তাজা সৌরভী ফুল দেখে তোহার মনের কোঁণে নিভিয়ে থাকা বাচ্চাসূলভ মনটা জেগে উঠলো।খুশিতে লাফিয়ে উঠে নেহাতই ছেলেমানুষি কন্ঠে সে বললো,
—“দেখেছেন,কি সুন্দর!”
ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো তিহান।মেয়েটা অল্পতেই বাঁধভাঙা খুশিতে ফেটে পরে।তার আগে থেকেই জানা আছে।
উঠে দাড়ালো সে।আচমকাই তোহার মাথার ঘোমটা নামিয়ে দিয়ে কানে একটা ফুল গুঁজলো।তারপর আরো একটা অত:পর আরো আরেকটা।মোটমাট তিনটে ফুল।তোহার অস্থিরতায় ভরপুর দৃষ্টি মেঝের দিকে।
তিহানের ঠোঁটে তখন ধীর কন্ঠে গান চলছে,
বাতাসে ঠোঁট উড়িয়ে দিলাম তাকালে তুই ঘুরে
আমার মন তাই কান ধরে আর গান ধরে বেসুরে
বায়নাগুলো আয়না সেজে বুকের ঠোট্ট তিলে
যেভাবে জল কামান চলে মোমবাতি মিছিলে
তেষ্টাভেজা বালির দেশে ছুঁলি যখন জল
বৃষ্টি ভরা মেঘ ঝরিয়ে আমার হবি বল
এ কোন ভোরে শিউলি ফোটায়
দোরে কড়া নেড়ে বলে যায়
হারিয়ে যাব চলে আয়
~
জমা অভিমান,পড়ে ফেলা বই
মনে রেখো মুখ ফুটে বলনি তো কই
হেঁটে চলে কেউ,পথে অবরোধ
ভেজা জামা ভালবাসে দুপুরের রোদ
রঙ মুছে তুলি যদি সাদাকালো হয়
মুখে হাসি রাখা মানে ভালো থাকা নয়
তেষ্টাভেজা বালির দেশে ছুঁলি যখন জল
বৃষ্টি ভরা মেঘ ঝরিয়ে আমার হবি বল
এ কোন ভোরে শিউলি ফোটায়…
[Shiuli(শিউলি)-Rishi panda]
এটুকু গেয়েই থামলো তিহান।সামনে থাকা প্রেমিকার লজ্জারাঙা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট আর একরত্তিও চললো না তার।এই রূপ সহ্য করার মতো নয়।শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম তবুও চোখ ফেরাতে মন সাঁয় দেয় না।অগত্যা তিহান শুধু দেখেই গেলো,দেখেই গেলো এবং দেখেই গেলো।
~চলবে~