#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ২৯
আজকের ঘুমটা ধীরে ধীরে কাটলো সকালের উষ্ণ রৌদ্দুরের সংস্পর্শে। আজ হয়তো পর্দাটা টেনে দিতে ভুলে গিয়েছেন আনভীর। আমি পাশে ফিরে দেখলাম উনি বিছানায় নেই। ব্যাপারটা একটু অবাক করে দিলো আমায়। তাই উঠে বসলাম। ম্যাজমেজে ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে তুলে মুখহাত ধুয়ে নিলাম ওয়াশরুম থেকে। নিচে গার্ডেনের কাছে গিয়ে দেখি আনভীর পুলের একসাইডে ফ্রি হ্যান্ড এক্সেরসাইজ করছেন। একটা থ্রি কোয়ার্টার কালো প্যান্ট আর তার ওপর ‘A’ ওয়ার্ডের প্রিন্ট করা একটা ব্ল্যাক হুডি পড়েছেন। গৌরবর্ণের গায়ে যে কোনো ধরনের ডিপ কালারই দারুন মানায় উনাকে। বিগত কিছুদিন ধরেই ঠান্ডা কড়াকড়িভাবে ধরেছে আমায়। এদিকে আগামীকাল হসপিটালে প্রেজেন্টেশন বলে এই কয়েক দিন কাজের ব্যস্ততায় নিজের তেমন একটা যত্ন নেওয়াও হয়নি। আমার হঠাৎ হাঁচির শব্দে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন আনভীর।
নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম মিশ্রিত এই মুখমণ্ডল বুকে ঝড় তুলতে যথেষ্ট। বলতে বাধ্য যে ছোটোখাটো একটা ক্রাশ খেয়েছি উনার ওপর। আনভীরের চুলগুলো ভিজে হুলস্থূল হয়ে পড়ে আছে কপালে। চোখের প্রগাঢ় দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার দিকে। আনভীর নিজের ছোট থেকে ছোট কাজকর্মের মধ্যে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে ইনি একজন রকস্টার। বডি ফিগার, ড্রেসআপ, কথাবার্তা সবকিছু উনাকে অন্য চার পাঁচজন থেকে নিমিষেই আলাদা করে দিতে পারবে যা আরও এট্রাক্টিভ করে তুলতে পারবে উনাকে।
আমায় এভাবে নীরবে উনাকে স্ক্যান করতে দেখে দুষ্টু হাসি দিলেন আনভীর। হাত কোলে ভাঁজ করে বললেন,
‘ এভাবে কি দেখছো ‘জান’? ‘
শেষে উনি যেমনভাবে ‘জান’ শব্দটা বলে উঠলেন, আমার হৃদয়ে কম্পন ধরাতে যথেষ্ট ছিলো এটা। শশব্যস্ত হয়ে আমি তাই তাকাই উনার দিকে। এই লোক কি আমায় হার্টফেল টার্টফেল করিয়ে মেরে ফেলার চক্রান্তে আছে নাকি? যদি এমন হয় তবে উনি সার্থক। এমন ঘায়েল রূপের এমন ঘায়েল কন্ঠে যে কেউই ঘায়েল হয়ে যাবে। কিন্ত আমি এটা বুঝতে দিলাম না উনাকে। সমান পরিসরে ভাব নিয়ে প্রতিউত্তর দিলাম,
‘ আপনার হুতুমপেচা মুখখানা দেখছি। এভাবে যে এক্সেরসাইজ করে বডি ফিট রাখেন, শরীর তো একদিন কাঠ হয়ে যাবে। আমায় দেখেছেন? জীবনেও আপনার মতো এসবে মাথা ঘামাইনি, তবুও, আমার ফিগার কি খারাপ?’
ভেবেছিলাম আমার কথা শুনে থতমত খাবেন আনভীর। কিন্ত আমায় অবাক করে দিয়ে উনি এমন কিছুই বললেন না। বরংচ বলে ওঠলেন,
‘ তোমার ফিগার খারাপ হতে যাবে কেনো? তুমি হলে শুকনো কাঠ। আমার ভার তো জীবনেও নিতে পারবে না। আমি কিসের কথা বলেছি ডুইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’
শেষের ব্যাঙ্গাত্নক কন্ঠে আমার মুখ সিদুর রাঙা বর্ণে ধারন করলো। হাত মুঠো করে নিচের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেললাম তাই। হঠাৎ আবার হাঁচি দেওয়াতে আনভীর বলে উঠলেন,
‘ ঠান্ডা বাঁধালে কেনো আবার? বারবার বলি এই সিজনে নিজের এত যত্ন নিতে তবুও এত হীনমন্যতা কেনো?’
আনভীরের কন্ঠে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার রেশ। অহেতুক চিন্তিত হতে দেখে বিরক্ত হলাম আমি। বলি,
‘ এতে এমন বকাবাজি করার মতো কি আছে?’
‘ তুই এমন কাজ করবে আর আমি কিছু বলতে পারবো না?’
আমি চুপসে গেলাম। এইক্ষেত্রে কখনোই আমি পেরে উঠিনা আনভীরের সাথে। তপ্তশ্বাস ছাড়লাম তাই। মৌনতা কাটিয়ে বললাম,
‘ ওকে ফাইন। এখনই আদা চা বানিয়ে নিচ্ছি আমি। তাহলে ঠান্ডা কেটে যাবে। এবার খুশি তো?’
‘ নুড়ী আপাকে রুম থেকে ডেকে নিও।’
‘ আমি আপনার মতো জমিদার মহাশয় না যে নিজের চা বানাতে পারবো না। উনি ঘুমাক। আমি বানাতে পারবো।’
বলেই দ্রুত গার্ডেন থেকে রান্নাঘরের দিকে আমি এগিয়ে গেলাম। চুলায় গরম পানির পট রেখে চা বানাচ্ছি আমি। এভাবেই যখন চা প্রস্তুত হলো ডেস্ক থেকে একটা ব্ল্যাক কালার মগ হাতিয়ে সেটা কিচেন কেবিনেট রাখলাম। ভাবতে থাকলাম আনভীর আর অপূর্ব ভাইয়ার কথা। গতকাল হুট করে কি
একটা ভেবে আমার আগের সিমটা ওপেন করেছিলাম আমি। দেখি অপূর্ব ভাইয়ার অসংখ্য টেক্স আর কল। লাস্ট এর মেসেজটা এমন ছিলো, ‘ আই সোয়্যার আহি যদি তোমায় হাতের নাগালে পাই, একেবারে পাখনা কেটে দেবো। ওই রকস্টারের জন্যই এত সাহস বেড়েছে তাই না? আগে তোমায় পেয়ে নেই দ্যান ওই এআরকের ব্যবস্থা করব আমি।’ এই তিনটি বাক্য বাক্য ভয়ে শেষ করে ফেলেছিলো আমায়। এতটুকু নিশ্চিত হলাম যে সে জানে আমার অবস্থানের ব্যাপারে। আচ্ছা ভাইয়া যদি এটা জানে যে এআরকে আমার লিগ্যালি হাজবেন্ট তবে কি করবে সে? আনভীরের ক্ষতি করবে না তো! জীবনের একটা লম্বা সময় ওই পরিবারে কাটিয়েছি আমি। আমি জানি যে ওরা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। একজন স্মাগলার হিসেবে পলিটিক্যাল, আন্ডারকভার সব পাওয়ার আছে ওদের। যদি আনভীরের কোনো ক্ষ-ক্ষতি করে ফেলে তাইলে?
হঠাৎ অন্যমনষ্ক হওয়াতে গরম চায়ের অল্পাংশ আমার পায়ের ওপর ধপাধপ পড়ে গেলো। এমন করে হঠাৎ ফুল্কির স্পর্শের মতো অনুভূতি পাওয়াতে আর্তনাদ করে উঠি আমি। আমার চিৎকার শুনে আনভীর দ্রুত এসে পড়েন গার্ডেন থেকে। নুড়ী আপা আর নাহিদ ভাইয়াও তন্মধ্যে উঠে পড়েছেন। আনভীর আমায় এভাবে দেখে সময় বিলম্ব না করে দ্রুতই কোলে তুলে নিচের রুমের ওয়াশরুমে নিয়ে যান। বেসিনের পাশে বসিয়ে পা দুটো তুলে দিয়ে আস্তে করে সাইট থেকে কল ছাড়েন। আমি তখনও ঠোঁট কামড়ে উনাকে আঁকড়ে বসে আছি। চা একেবারেই গরম ছিলো। পায়ে ফোস্কা পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে ক্রমাগত। আনভীর যেন এটা দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন আরও। কিছু বলতে গিয়েও না বলে ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
পায়ের ওপর পানির শীতলআআস্তরণ গড়িয়ে যাওয়াতে অন্যরকম লাগছে। জ্বালা পোড়নের ওপর বরফ রাখলে যেমন লাগে, তেমনই। আনভীর তাকালেন আমার দিকে। উনার গালটা একেবারেই আমার মুখ ছুঁই ছুঁই । আনভীর হঠাৎ বলে উঠলেন,
‘ কেমন লাগছে এখন?’
শীতল কন্ঠের আহত প্রশ্ন আনভীরের। আমি এ কথা শুনে থমকে কি বলবো ভেবে পেলাম না। অতঃপর ব্যক্ত করলাম,
‘ ভালো।’
এই উত্তরটিতে সন্তুষ্ট হননি আনভীর। তবুও কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন পুনরায় । পানি তখনও আমার পায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ছে বিরতিহীনভাবে। বেশ কিছুক্ষণ পর আনভীর পুনরায় কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে সোফায় বসালেন। উনি নাহিদকে বললেন,
‘ বার্ন ক্রিম নিয়ে আয় নাহিদ।’
আমি তৎক্ষণাৎ অকপটে বললাম,
‘ আমার ডেস্কে আছে ভাইয়া।’
আনভীর সরু চাহিনী দিলেন আমাতে। আমি তাই আর কিছু বললাম না। নাহিদ ভাইয়া ক্রিম আনতেই আনভীর তা টেনে নিজ দখলে এনে সন্তর্পণে লাগিয়ে দিলেন পায়ে। প্রথমে মুখ দিয়ে ‘উহ’ প্রতিশব্দ বের হলেও আনভীর থমথমে গলায় বললেন,
‘ অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনেছি আহি। আমার হাতে চড় থাপ্পড় না খেতে চাইলে মুখ বন্ধ রাখো। ডক্টর হয়ে পেশেন্টের মতো আচরণ করবে না।’
‘ ব্যাথা পেলে তখন কি এতকিছুমনে রাখা যায়?’
আমি কথাটি বললাম মুখ ফুলিয়ে। আনভীর প্রতিউত্তর দিলেন না এবার। অতঃপর মৌনতা কাটিয়ে কাতর কন্ঠে বললেন,
‘ আমার কথাটা শুনলে কি হতো তখন?’
আমি নিশ্চুপ। ক্ষণকাল এভাবেই কাটলো প্রচ্ছন্ন নীরবতা। শুধু ঘড়ির টিকটক বহর বিদ্যমান। আনভীর আবার ঠোঁটজোড়া আবছা নাড়িয়ে বললেন,
‘ নেক্সট টাইম এ ভুল করো না আহি। তোমায় এভাবে দেখলে বুক মোচড় দিয়ে উঠে আমার। এখনই দেখো। কান্ড বাধিয়েছো তুমি আর হার্টবিট আমার বেড়েছে আতঙ্কে। তোমার কিছুই করতে হবে না আহি। রান্নাঘরে আর পা বাড়িও না।’
বাচ্চাদের মতো একএকটা কথা বলে যাচ্ছেন উনি। আমার হঠাৎ হাসি এসে পড়লো উনাকে এমন বাচ্চামো করতে দেখে।
___________
দুপুরেই আজকে নাহিদ ভাইয়ার বোন রিমি আপু এসে পড়লো কোথা থেকে। হয়তো নাহিদ ভাইয়াই এনেছে যাতে আমি রান্নাঘরে আর পা বাড়াতে পারি। এই দুই পাগলের পাগলামি দেখে মাঝে মাঝে মাথা ধরে যায় আমার। এক আনভীর সারাদিন এটা করোনা, ওটা করোনার পিছে লেগে থাকে ঠিক তেমনি নাহিদ ভাইয়ায় কথায় ছায়ার মতো আমায় অনুসরন করতে থাকতে। কেননা৷ আনভীর ভয়াবহ সংকেত দিয়েছে, উনার অবর্তমানে নাহিদ যদি ‘ ভাবি কেয়ার ডিউটি’ ঠিকঠাক মতো না করে তবে চপাট করে দু দুটো মাইর। বেচারা নাহিদ ভাইয়া না পেরেছিলো কিছু বলতে আর না পেরেছিলো সইতে।
এদিকে আনভীরকে ইগ্নোর করছি আমি। কারন আমি পানি খাওয়ার জন্য কিচেন রুমের সাইড দিয়ে জগটা আনতেই উনি হুংকার দিয়ে বলে ওঠলেন,
‘ বাচ্চাদের মতো এসব কাজকর্মের মানে কি আহি? তোমায় না আমি নিষেধ করেছি ওখানে যেতে? আবার গেলে পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবো।’
কথাগুলো শুনে রাগের তুলনায় কষ্ট হলো খুুব। কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করে চলে গেলাম এখান থেকে। নাহিদ ভাইয়া বললেন,
‘ এভাবে ভাবির সাথে…..’
‘ তোর এসব ভাবতে হবে না নাহিদ। বকাটা ওর দরকার ছিলো।’
আনভীরের এ কথায় কিছু বলেননি নাহিদ ভাইয়া আর। আনভীর তারপর চলে গেলেন স্টুডিওতে ভোক্যাল প্র্যাকটিসের জন্য৷ এতে অভিমান আরও চাড়া দিয়ে উঠলো। স্থির করলাম, থাকুক উনি উনার মতো। তারপর উনি কল করলেও হু হা করে কোনোমতে উত্তর দিয়ে রেখে দেই আমি। আনভীর টের পেয়েছন সেটা আমার ব্যবহারে।
রাতে যখন উনি ফিরে আসলেন তখন উনি নুড়ী আপাকে জিজ্ঞেস করলেন যে সবাই খেয়েছে? নুড়ী আপা বললো,
‘ হ সবাই খাইসে। নাহিদ, রিমি আর আফায় ছাদে আপনার জিমির লগে খেলা করতাসে এহন।’
অবাক হলো আনভীর। আহি তো ঠিক ছিলো শেষপর্যন্ত নাহিদও ভাবীপাগলা হয়ে গেলো? ফ্রেস হয়ে ডিনার সেরে অনেকক্ষণ ওয়েট করলে ছাদেও গিয়ে পায়চারি করে আসলো। কিন্ত কারওই ওর দিকে ধ্যান নেই। পরন্ত আনভীর স্থির করলো, ‘ আর না!’
আমি আড়চোখে দেখছিলাম আনভীরের কার্যকলাপ। উনি হঠাৎ সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেও কি ভেবে উপরে উঠে এসে চট করে কোলে তুলে নিলেন আমায়। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সেই সাথে নাহিদ ভাইয়া আর রিমি আপুও। আপু বললো,
‘ ভাই আপনি….’
‘ তোরা দুই ভাই বোন কোনো কথা বললে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিবো আমি। ‘
রেগে একথাটা বলেই উনি আমায় নিয়ে নিচের দিকে পা বাড়ালেন। ভয়ে আমার দুরুদুরু অবস্থা।
আমায় রুমে নামাতেই আমি কিছু বলতে যাবো তার পূর্বেই আমার কোমড় চেপে কাছে টেনে আনলেন উনি। থমথমে গলায় বললেন,
‘ আমায় ইগ্নোর করতে ভালোলাগে তাই না আহি? আজ সারারাত তোমার কাছাকাছি থাকবো। তারপর দেখি তুমি আর কত আমায় ইগ্নোর করতে পারো।’
#চলবে
#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩০
‘ আমায় ইগ্নোর করতে ভালোলাগে তাই না আহি? আজ সারারাত তোমার কাছাকাছি থাকবো। তারপর দেখি তুমি আর কত আমায় ইগ্নোর করতে পারো।’
কন্ঠস্বর বিধ্বস্ত আনভীরের। উত্তেজনায় কেঁপে উঠছে বারবার। আমি কিছুক্ষণ অনিমেষ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে নিচে তাকালাম। উনার কথাগুলো এখনও কানে বাজছে নুপুরের মতো। ক্রমাগত শুকনো ঢোক গিললাম আমি। কিন্ত আনভীরকে বুঝতে দিলাম না যে আমি আপাতত বিচলিত অবস্থায় আছি। নিজেকে উনার বাহু বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে প্রগাঢ় কন্ঠে বললাম,
‘ ছাড়ুন আমায়।’
উনি এক চিলতেও নড়লেন না। ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সেভাবেই। আমি চোখ নামিয়েই রুদ্ধ কন্ঠে পুনরায় বললাম,
‘ বধির হয়ে গেলেন নাকি মশাই? ছাড়তে বলছি ছাড়ছেন না কেনো?’
উনি এই কথার প্রতিউত্তর না দিয়ে ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘ আমার চোখের দিকে তাকাও।’
নিজের জমা রাগ গুলো বরফের ন্যায় ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে এবার। আশঙ্কা ঢুকেছে যে এবার এই মান অভিমানের দাঙ্গায় জিতবো কি-না। উনার ঘায়েল চোখের দিকে একবার তাকালেই তো সব ভুলে শুধু নির্লজ্জের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকবো, যেটা আমি নিশ্চিত। আর যদি আনভীর সেটা ধরতে পারেন তবে আমায় নিয়ে ঠাট্টা যে উনি থামাবেন না এ নিয়েও কোনো অনিশ্চয়তা নেই। নিজেকে স্থির করলাম তাই। তাকাবো না উনার চোখের দিকে। একটুও না। এই অসভ্য লোকটা তখন যেভাবে বকেছিলো নাহিদ ভাইয়ার সামনে, তা কি ভুলে গিয়েছি আমি? মোটেও না। তাই সেভাবেই অন্যত্র তাকাতে দেখে আনভীর তথারুপি জিজ্ঞেস করলেন,
‘ তাকাচ্ছো না কেনো আমার দিকে? সমস্যা টা কি?’
শেষ কথায় কেঁপে উঠলাম আমি। তবুও নিজেকে শান্ত করে বললাম,
‘ আমার কোনো সমস্যা নেই। আর সমস্যা হবে কেনো?’
‘ তাহলে তাকাচ্ছো না কেনো আমার দিকে?’
‘ ইচ্ছে করছেনা তাই।’
বলেই হাত কোনোরকম মুচড়ে নিজেকে উনার বেড়াজাল থেকে ছাড়ার চেষ্টা করতেই উনি হাত টেনে পুনরায় নিয়ে এলেন নিজের কাছে। এবার এমনভাবে চেপে ধরলেন যে আমি আর নড়াচড়া করতে পারলাম না। আনভীরের চোখে মুখে এবার স্বস্তির আভাস। আমার কানপিঠে চুল গুঁজে কাতর কন্ঠে বললেন,
‘ বড্ড অস্থির মেয়ে তো তুমি। এত ছটফট করছো কেনো?’
আমি কোনো কথা না বলে ফোস ফোস করতে থাকলাম এখনও। জানান দেই যে এখনও রেগে আছি। ভীষণ ভীষণ রেগে আছি। আনভীর আমার এ অবস্থা দেখে ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
‘ তখন ওভাবে ধমক দিয়েছিলাম বলে রেগে আছো?’
আমি নিরুত্তর।
‘ তাই জন্যে তাকাচ্ছো না আমার চোখে?’
আমি এবার চুপ থাকলাম না। প্রতিউত্তরে মৃদু কন্ঠে বলি,
‘ হ্যাঁ!’
আনভীরের দৃষ্টি ক্রমশ গম্ভীর হলো এতে। বলে উঠলো,
‘ আমায় শাস্তি দেওয়ার একটা ভালো ওয়ে খুঁজে বের করেছো আহি। জানো বিগত সময়গুলো কিভাবে কেটেছে আমার? একই বাড়িতে থেকেও তোমার হদিস নেই। কল দেই , রিসিভ করো না। রিসিভ করলে, কথা বলো না। আমায় দেখলে পালাই পালাই করে বেড়াও আর সবশেষে কি করলে? আমায় ছাড়া ডিনার করলে আর আমায় ছাড়াই ছাদে ওই হাদা দুটার সাথে আড্ডায় মশগুলো থাকলে। একবারও মনে হয়নি যে নিচে এই মানুষটার কেমন লাগছিলো?’
‘ কেন মনে হবে আমার এমন? যে আমার ইমোশনের দাম দেয় না তার ইমোশনের চিন্তা করে আমার লাভ আছে?’
কথাটি আমি একেবারেই বললাম অভিমানীনসুরে। আনভীর হেসে দিলেন এতে। আমি রগচটা হয়ে বলে উঠলাম,
‘ জানতাম যে আপনি এমনই করবেন। ছাড়ুন আমায়। কি দরকার আমার রাগের কথা চিন্তা করে?’
আমায় এভাবে ছটফট করতে দেখে উনার হাসির মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেলো। ভাবখানা এমন করেছেন যে মজা পাচ্ছেন বেশ। অতঃপর আমায় খাটে বসিয়ে দিলেন উনি সন্তর্পণে। নির্লিপ্ত চোখে তাকালেন আমার দিকে। আমার শরীর রি রি করছে রাগে। তাই একপলকও তাকালাম না উনার দিকে। আনভীর ডাক দিলেন,
‘ আহি!’
আমি প্রতিউত্তরহীন। আনভীর হাটু গেড়ে বসলেন আমার কাছে। কোমল কন্ঠে পুনরায় ডাকলেন,
‘ একবার তো তাকাও?’
‘ তাকাবো না।’
বাচ্চাদের মতো ফুসিয়ে বলি আমি। আনভীর হাসলেন এমন কান্ডে। আমার এসব বাচ্চামো সবসময় জানান দেয় যে আমার অস্তিত্বই গেঁথে আছে এই মানুষটার কাছে। আনভীর নিজের হাতের মধ্যে আমার হাত নিয়ে বললেন,
‘ সরি জান! নেক্সট টাইম কখনও বকা দিবো না। প্রমিস!’
এই তিনটা বাক্য আমায় অবাক করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো বলতে গেলে। আমি নিনির্মেষে তাকাই আনভীরের দিকে। উনার চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। সারাদিনের এত ব্যস্ততার পর দিনশেষে আমার প্রতি এই আড়ষ্ট কন্ঠ আমার অন্তরে এক অন্য আনন্দ দিলো। আনভীরের নিষ্প্রভ দৃষ্টি আমাতে আবদ্ধ। ঠোঁটের স্মিত হাসি যেন গৌরবর্ণের গায়ে নিদারুন ফুটিয়ে তুলেছে। গায়ে জড়ানো হালকা রঙের টিশার্ট আর অগোছালো চুল জানান দিচ্ছে মানুষটার সীমাহীন সৌন্দর্যের কথা।
আমায় এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আনভীর উঠে আবেশে ঠোঁটের স্পর্শ করালেন আমার চোখজোড়ায়। বলে উঠলেন,
‘ তোার ইগ্নোরেন্স বড্ড পোড়ায় আমায় আহি। আর সকালে অমন এক্সিডেন্টের পর তোমার পায়ের যেই হাল হলো তারপর একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমায় নিয়ে। ভেবেছিলাম কিচেনে গেলে আবার যদি এমন কিছু হয়? তাই তোমায় ওখানে আবার যেতে দেখে অনেকটা ভয়েই রুড বিহেভ করে ফেলি। ওয়ান্স এগেইন সরি আহি। নেক্সট টাইম আর এমন করবো না। প্রমিস!’
উনি কথাগুলো বললেন নিতান্তই জড়ানো কন্ঠে। তারপর উঠে গিয়ে লাইট নিভিয়ে আমায় টেনেই বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন। আমি এতক্ষণ পাথর হয়ে বসে ছিলাম। হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেতেই দ্বিধা নিয়ে বললাম,
‘ কি করছেন?’
‘ অনেক জ্বালিয়েছো আজকে। সবচেয়ে বড় ভুল করেছো আমায় এড়িয়ে চলার সাহস করে। এখন ভুলেও আমার থেকে দূরে সরার চেষ্টা করবে না আহি। লেট মি স্লিপ।’
উনি আমায় নিজের কাছাকাছি টেনে পেটের ওপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করলেন। আমার নিঃশ্বাস ক্রমশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ক-ক-কি করছেন উনি? এভাবে নিজে ঘুমিয়ে আমার ঘুম কেড়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন নাকি? আজ তোর ঘুম হবে না আহি। এই মানুষটা কাছাকাছি থাকলে মনে জেগে ওঠা ভয়ঙ্কর বাসনাগুলো তোকে ঘুমোতে দিবেনা।
____________________
হসপিটালে আজ প্রেজেন্টেশন আমার। শুধু আমার না। যারা রিসেন্টলি ইন্টার্নশিপ করে হসপিটালে জয়েন করেছেে তাদের সবার। স্বনামধন্য বেসরকারি হাসপাতাল বলে মাঝে মাঝে ফরেইন ডক্টরদের সাথে বিশাল মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। প্যানডেমিকের জন্য এই মিটিং গুগল মিট বা জুম এ হলেও এবার সেটা সরাসরি অফলাইনে ফেস টু ফেস হচ্ছে। টেনশন পুরো মনমস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে আমার। এতটাই টেনসড ছিলাম যে সকালে ব্রেকফাস্টও ঠিকমতো করতে পারিনি। আনভীর দেখেছিলেন আমায় অস্থির হতে। তারপর গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,
‘ ড্রিংক ইট।’
তাই করলাম আমি। পরপর দু তিন গ্লাস পান করলাম। আনভীর ব্রেডে বাইট দিয়ে বললেন,
‘ বি রিলেক্স আহি। ধরো এটা একটা নরমাল ফাংশন যেখানে সবার সাথে কথা বলো। তাহলেই চিন্তা কেটে যাবে।’
‘ আপনি আপনার হাজারো ফ্যানদের সাথে কথা বলাতে অভ্যস্ত বলে আমি আপনার মতো এতটা অভ্যস্ত নই আনভীর। এটা এতটাও সহজ না।’
‘ জানি আমি। তাই তো সহজ উদাহরণ দিলাম। নাও বেস্ট অফ লাক আহি।’
নাহিদ ভাইয়া এবার বললেন,
‘ আমি ড্রপ করে আসবো ভাবিকে?’
‘ নাহ্ থাক। তুই বডিগার্ডকে নিয়ে প্রেস ক্লাবে যা। ওখানে এখন তোর কাজবেশি। বাবাকে বলবি আমি আধঘন্টার মধ্যেই সেখানে পৌঁছাবো। আহিকে আমি ড্রপ করে আসি।’
বলেই আনভীর বেড়িয়ে পড়লেন আমায় নিয়ে। সারাপথে আমি চুপ ছিলাম। সেই সাথে আনভীরও। হসপিটালেন সামনে গাড়ি থামাতেই আমি নামলাম গাড়ি থেকে। আনভীর ডাকলেন,
‘ আহি!’
‘ কিছু বলবেন?’
‘ বেস্ট অফ লাক।’
মিহি হাসলাম আমি। তারপর আনভীর চলে গেলেন।
___________
আজকের মিটিংটা ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।বিশেষ করে ডক্টর ধ্রুব সহ বাকি ফরেইন ডক্টররা সবাই স্যাটিসফাইড আমাদের কাজে। আমি প্রসন্ন হলাম। এতদিন কাজ ভালোভাবে হয়েছে বলে ভালো লাগছিলো বেশ। এসব নিয়ে আমাদের জন্য যে লকার রুমটা বরাদ্দ করা হয়েছিলো সেখানে আলোচনা করছিলাম আমি আর আমার কলিগরা। সবাই মোটামুটি প্রসন্ন হয়েছে এতে। তারপর সবাই যে যার ডিউটি করার জন্য চলে গেলো লকার রুম থেকে। বাকি রইলাম শুধু আমি। কারন আমার ডিউটি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এখন শুধু ফিরে যাওয়ার পালা। আমি স্টেথোস্কোপ, এপ্রোন সব গুছিয়ে লকারো রাখার জন্য মনোনিবেশ করলাম। তখনই পেছন থেকে কেউ তীব্র কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ দিন দিন আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস তুই আহি!’
কথাটি শুনে হাত থেকে স্টেথোস্কোপ নিচে পড়ে গেলো আমার। মাথাটা ঝিম ধরে গিয়েছে। এত লম্বা প্রহর অতিবাহিত হওয়ার পর ভাবতে পারিনি এই মানুষটার মুখোমুখি আমি পুনরায় হবো। পাহাড় সমান ভয় নিয়ে পেছনে তাকালাম আমি। মনকে বারবার বলছিলাম যে আমি যা শুনেছিলাম সেটা ভুল। কিন্ত পেছনে তাকাতে পুরোই হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। মানুষটা আবার বলে উঠলো,
‘ এআরকের আশ্রিতা হয়ে এত দ্রুত ভুলে গেলি আমাকে?’
আমার চোখে এখনও বিরাজ করেছে আতঙ্ক। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অবশেষে বলেই উঠলাম,
‘ অপূর্ব ভ-ভাইয়া ত-তুমি?’
#চলবে
ভুলক্রুটি মার্জনীয়।