#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখনিতে – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪০+৪১
গাড়ির শব্দ পেতেই ওয়াচম্যান এসে খুলে দিলো বাড়ির গেইট। আনভীর গাড়ি ঘুরিয়ে তা ভেতরে নিয়ে গেলেন। উনার চোখ মুখ অন্যরকম লাগছে দেখতে। কিন্ত আমি কোনো প্রতিক্রিয়া করলাম না। সারাটা পথেই আমরা চুপচাপ ছিলাম। আভীর অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন আমায় মানাতে। আমি তখন শুধু এটাই বলেছিলাম যে,
‘ এখানে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আনভীর। এক্সপ্লেইন তো আপনাকে দিতেই হবে কেন প্রতারণা করেছেন আমার সাথে। তবে এটা মুখ্যম সময় না।’
তারপর দুজনেই আমরা চুপ। শুধু শোনা গিয়েছে গাড়ির ইন্জিনের শব্দ আর বৃষ্টির ছন্দপাত। গাড়ি থেকে নামতেই আনভীরের বাড়ির সামনের সিকিউরিটি গার্ড বললেন,
‘ ওয়েট ম্যাম। ছাতা নিয়ে আসছি।’
‘ প্রয়োজন পড়বে না।’
আমি হালকা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলাম। বিশাল আকারের ড্রইংরুম পুরোই অন্ধকার লাগছে এখন। যা দেখা যাচ্ছে তা হয়েছে শুধুমাত্র ইয়ার্ড আর সুইমিং পুল মুখী থাই গ্লাসের কল্যানে। এটা ভেদ করেই বাইরের আবছা আলো ঘরে ঢুকেছে। ড্রইংরুম খানিকটা অগোছালো। ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করে গুছিয়ে নিয়েছেন নুড়ী আপা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ১২ টা ২ বাজে এখন। নীলু আর এদিকে নাহিদ ভাইয়া হয়তো গভীর ঘুমের আরামে আবদ্ধ।
অনেকটা ছন্নছাড়া অবস্থা নিয়েই টলতে টলতে উপরে গেলাম আমি। চুপ করে রুমের খাটে বসে পড়লাম। আনভীরের রুমের বারান্দা থেকে চমৎকার ভিউ দেখা যায় বিলাস বহুল এই আবাসিক এলাকার। পাশের প্লটটা একজন স্বনামধন্য শিল্পপতির প্রোর্পার্টি যেখানে নানা জাতের গাছ আছে বিধায় আমাদের এখান থেকে মনোমুগ্ধকর লাগে দেখতে। ওই ফার্মহাউসটা খালিই থাকে বেশিরভাগ সময়। তবে মাঝে মাঝে শিল্পপির ছেলে তার বন্ধুদের বা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এখানে আনন্দ উল্লাস করেন। আজও এসেছেন। ছাদে করা ছাউনির নিচে আবছা আবছা মানুষের উপস্থিতি আর গান বাজনা হৈ হুল্লোড়ের শব্দ আলোড়িত হচ্ছে।
আমি নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ বেলকনির দিকে। হঠাৎ ঘরে দ্বিতীয় উপস্থিতি টের পেলাম আমি। আনভীর এসেছেন। না তাকানো সত্বেও বুঝতে পারছি উনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি শীতল কন্ঠে বললাম,
‘ এখানে কেন আপনি আনভীর? আপনাকে না রাহি আপু ডেকেছে?’
কথাটাতে যে পাহাড় সমান ভৎসর্না ছিলো সেটা স্পষ্টতই প্রকাশ পাচ্ছে। আনভীর পা চালিয়ে এলেন আমার কাছে। হাটু গেড়ে আমার বরাবর বসে পড়লেন। চোখের দৃষ্টিতে বিন্দু মাত্র অনুশোচনা নেই উনার মিথ্যে বলার বা প্রতারণা করার। তবে যেটা আছে সেটা ভয়, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। উনি নিজের দু’হাতে আকঁড়ে ধরলেন আমার হাত। চোখের দৃষ্টি প্রগাঢ় করে স্থির কন্ঠে বললেন,
‘ আমায় বিশ্বাস করো না?’
জানিনা কেন, তবে ঠোঁটকোলে হাসি ফুটলো আমার। বিদ্রুপের হাসি না কি তাচ্ছিল্যের হাসি সে সম্পর্কে অবগত নই। আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ বিশ্বাস করেছিলাম আপনাকে আনভীর। অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলাম। আপনি যখন বললেন রাহি আপু আমার ক্ষতির চেষ্টা করছে, মেনে নিলাম সেটা। আপনি বললেন আপনি এমন কিছু করবেন না যাতে আমি হার্ট হই, সেটাও মেনে নিলাম। শুধু তাই না, একটি মেয়ের বিয়ে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন থাকে। পৃথিবীকে সে দেখাতে চায় যে সে একা না, তার সঙ্গে এমন একজন আছে যে তার সঙ্গেপ্রতিটি পদে পদে থাকবে তার সাথো। অথচ আমার ক্ষেত্রে কি হলো? আপনি বললেন এখন আপনার আমার বিয়ের সম্পর্ক প্রকাশের উপযুক্ত সময় না সেটা মেনে নিলাম। মেনে নিলাম অপূর্ব ভাইয়া না জেনে যখন আমায় আপনার প্রোস্টিটিউট বললো। এগুলো কেনো করেছি আমি? এভাবেই করেছি বিশ্বাস ছাড়া? এখন বুঝতে পারছি কেন আমার প্রায়োরিটি আপনার কাছে বিশেষ। এটা তো জানেনই যে মায়ের উইল করা প্রোপার্টি আমি বিয়ের পর দখলে নিতে পারবো। সেজন্যই তো জোর করে তুলে আনা তাইনা? আপনার বাবাকেও এই ট্রাপে ফেলে দিলেন, এজ এ রেজাল্ট, আমার সাথে আপনার বিয়ে হওয়া। আপনি আসলে আমায় ভালোই বাসতেন না আনভীর। সবটা আপনি করেছেন প্রোপার্টির জন্য।’
এতক্ষণ চুপ ছিলেন আনভীর। কিন্ত আমার শেষ কথা শুনে ততক্ষণাৎ বললেন,
‘ অনেক কিছু বলেছো আহি। কিন্ত একথা ভুলেও মুখে আনবে না যে তোমার মায়ের ওই বিশাল প্রোপার্টির প্রতি আমার লোভ আছে। তুমি কি জানো ছোট মায়ের ব্যাপারে? সে আমার বাবার বান্ধবী ওরফে ইকবাল আঙ্কেলের ওয়াইফ ছিলো ঠিকই, কিন্ত আমার মায়ের মতো ছিলো সে। তোমার মায়ের সম্পর্কে তুমি যতটা না জানো তার চেয়ে দ্বিগুন জানি আমি।’
আনভীরের এই কথা বলার ধাঁচ অন্যরকম ছিলো কিছুটা। কিন্ত ধাতস্থ রাখলাম আমি নিজেকে। তখন গাড়িতে আমি একটু হাইপার হয়ে গিয়েছিলাম বিধায় এই না যে আমি এখন চুপ থাকবো। আনভীরকে আমার কাছে এখন জবাবদিহিতা করতেই হবে। আমি নিঃশ্বাস ফেললাম এবার। বললাম,
‘ অপূর্ব ভাইয়া আমায় একটি কথা বলেছিলো। আপনার আর আমার পাস্ট জড়িত কোনো না কোনোভাবে। এটা অস্বাভাবিক কিছুনা। কারণ যতটুকু আমি জানি আমার মা বাবা পালিয়ে বিয়ে করার পর আপনার বাবার কাছেই গিয়েছিলো। এটা কি সত্যি?’
‘ হ্যাঁ সত্যি। তখনই ছোটোমার সাথে পরিচয় হয় আমার।’
‘ আপনি আমায় কেন এনেছিলেন নিজের কাছে?’
‘ ইটস ট্রু যে আমি তোমায় বলেছিলাম আমার অনাগত সন্তানের মা হওয়ার জন্য নাটক করতে। জানো কেনো? যাতে আমায় বিয়ে না করেই তুমি এটলিসট বাচ্চার খাতিরে তোমার প্রাপ্য পেতে পারো। এতগুলো বছর তোমার বাপ চাচাই তোমার প্রাপ্য দিয়ে বিলাস করে গেলো আহি। তোমায় নুন্যতম শান্তিটুকু দিলো না। তাই বলেছিলাম এই অভিনয়টা করতে? কিন্ত তুমি কি ভাবলে? ভাবলে তোমার আপুকে পাওয়ার জন্য ইউজ করছিলাম তোমায়।’
‘ আপনি যেভাবে রাহি আপু আর নিজের কথা আমার সামনে রিপ্রেজেন্ট করলেন, আমার এমন ভাবনাটা কি স্বাভাবিক না?’
আনভীর কথা বললেন না। মৌনতাকেই আমি সম্মতি ধরে নিলাম।
‘ কেনো করেছেন আপনি এমন?’
……
‘ আপনার কথা শুনে তো মনে হলো আমায় বিয়ে করার ব্যাপারে আপনার কোনো প্ল্যান ছিলো না, তাহলে?’
‘ আমি তোমার সেফটি চেয়েছিলাম আহি। একজনকে আমি কথা দিয়েছিলাম। কথা দিয়েছিলাম তোমার প্রাপ্য তোমায় ফিরিয়ে দিবো।’
‘ তাই এমন করলেন?’
‘ হ্যাঁ।’
‘ এর মানে এই দাঁড়ায় আপনি আমায় বিয়ে করেছিলেন আমার প্রোপার্টি আমার দখলে দেওয়ার জন্য তাইতো? আর এটা পাওয়ার পর আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিতেন?’
‘ আহি লিসেন…….’
‘ হ্যাঁ, অথবা না, এই দুটো শব্দের যেকোনো একটি দিয়ে এক্সপ্লেইন করেন আনভীর। আপনার কি এরকম প্ল্যান ছিলো?’
নিঃশ্বাস ছাড়লেন আনভীর ফোস করে। মৌনস্বরে বললেন,
‘ হ্যাঁ। রাহির সাথে আমার এমন কথাই হয়েছিলো।’
বৃষ্টি পড়ছে বেগতিকভাবে। বারান্দা খোলা থাকায় ছাড়িয়ে পড়ছে শীতল বাতাস। আমার চোখ বেয়ে টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আনভীর অস্থির হয়ে গেলেন হঠাৎ। বললেন,
‘ আগের কথা ভুলে যাও আহি প্লিজ। আমি এখন এরকমটা মোটেও চাইনা আহি। আগে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও এখন যা করছি সব করছি স্বেচ্ছায়। কারন ভালোবেসে ফেলেছি আমি তোমায় আহি। তুমি ভাবতেও পারবে না তোমার জন্য কতটা ঝড় ঝন্ঝাট পেরিয়েছি। কেন জানো? কেননা সামনে বসা এই মেয়েটা আমার নিঃশ্বাসের একমাত্র কারন। আগে আমি এতটা পাগলাটে ছিলাম না আহি। এখন যা করছি সবই তুমি নামক একটা মায়াজালের জন্য। যাকে ছাড়া
একদন্ড বাঁচা অসম্ভব।’
‘ আর যদি আমায় ভালো না বাসতেন তাহলে? এভাবেই ছেড়ে দিতেন?’
‘ তাহলে আমিও এমন ব্যবহার করতাম যাতে তুমি আমায় ঘৃণা করতে পারো। ইমোশনসের দাম আমি জানি আহি। তোমার মা আমার সামনে হাজার বার কেদেছে তোমার বাবার জন্য। হাজার বার কষ্ট পেয়েছে এই ভেবে যার জন্য নিজের পরিবারকে ছেড়ে দিলো সে আসলে টাকাকে ভালোবাসে।’
আমার চোখ দিয়ে এখনও পানি পড়ছে অবিরামহীন ভাবে। আসলে ট্রমায় পড়ে গিয়েছি আমি। জীবনে এতগুলো মানুষকে অবিশ্বাস করার পর শেষ বার যখন একজনকে বিশ্বাস করে বাঁচার প্রচেষ্টা করলাম সেও ঠকিয়ে দিলো। যদি এম হতো যে আনভীর আমায় ভালোবাসতে পারলেন না, তাইলে? তখন তো উনাদের পরিকল্পনাই সফল হতো। আমি এবার তাকালাম আনভীরের দিকে। জিজ্ঞেস করলাম,
‘ কার কথায় আমার জন্য এতকিছু করলেন আনভীর?’
উনি নিরুত্তর।
কেদে দিলাম আমি। বলে উঠলাম,
‘ আর কত কথা লুকাবেন আমার কাছ থেকে? কার কথা এমন করছেন, আমার মায়ের সিথে আপনার সম্পর্ক কি, মা’র মৃত্যু আদৌ এক্সিডেন্টে হয়েছে কি না, আমি জানি যে সবটা আপনার জানা। তাইলে? তাইলে বলছেন না কেন?’
আনভীর কোনো উত্তর দিলো না। এতে স্পষ্টই প্রমাণ হয় যে উনি এখন ও কিছু বলতে চাচ্ছেন না। আমি সরে আসার চেষ্টা করলাম উনার কাছ থেকে। বললাম,
‘ বুঝেছি। সবাই শুধু ব্যবহার করতে চায়। আমি নিতান্তই তুচ্ছ জীব আনভীর। সবার কাছে প্রয়োজন হলেও প্রিয়জন হতে পারলাম না। মায়ের সাথে আমার মরে যাওয়া উচিত ছিলো। মা তো চলে গিয়েছেই এবার আপনিও…..’
অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। উনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে আমি হঠাৎ এতকিছুর মুখোমুখি হওয়াতে শকে আছি। আচমকা একটা কাজ করে বসলেন আনভীর। আমার হাত দুটো চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে আনলেন। আমি বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। অশ্রুমাখা চাহিনীর প্রয়োগ করলাম আনভীরের উপর। উনার চোখসমুদ্রে হাজারো অব্যক্ত কথার আনাগোনা। রাতের আলো আধারে বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে অন্যরকম লাগছে এই চোখ জোড়াকে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন উনি। ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে ধীর স্থির ভাবে ভিজিয়ে নিয়ে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেও থেমে গেলেন। আমি বুঝতে পারলাম না কিছু।
আনভীর বা হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন আমার গাল। সময় বিলম্ব না করে টুপ করে নিজের ওষ্ঠ্যদ্বয় মিশিয়ে দিলেন আমার টার সাথে। শরীর শীতল হয়ে এলো আমার। এতটা কাছাকাছি আসাতে টের পেলাম শরীর মৃদু কাপছে। আমার হঠাৎ কি হলো জানিনা চোখ বন্ধ করে সায় দিলাম উনাতে। চোখের পানি এখনও বাঁধ ভাঙেনি। কিন্ত ভাঙবে হয়তো যেকোনো মুহূর্তেই। উনার উত্যপ্ত নিঃশ্বাস মুখে আছড়ে পড়াতে আস্তে করে আবেশে উনার চুলে হাত গুঁজে দিলাম।
ছমছমে আবহাওয়া। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলছে মস্তিষ্কে। আনভীর আমার ঠোঁটজোড়া ছেড়ে আমার চোখের পানিগুলো মুছে দিলেন। উনার মুখভঙ্গি শীতল। জানান দেয় আমায় যেকোনো পরিস্থিতিতেই সামলাতে উনি সক্ষম। আমার দুগাল উনার দু’হাতে আঁকড়ে ধরলেন আনভীর। প্রগাঢ় আড়ষ্ট গলায় ব্যক্ত করলেন,
‘ আমি তোমায় ছেড়ে যাবোনা আহি। যাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। আনভীর রেজওয়ান খান শুধুমাত্র এক নারীতে আসক্ত। সেটা হলো তুমি। তোমার ঠোঁট, তোমার চোখ, তোমার শরীরের ঘ্রাণ যত সহজ আমায় কাবু করতে পারবে , অন্য কারও ক্ষমতা নেই আমায় এতটা কাবু করার। এইযে তোমার কি ধারনা আছে যে এই অশ্রু বুকে কতটা ঝড় তুলছে আমার? এই ঝড়টা খুবই ভয়ঙ্কর আহি। এটা নিরাময় করতে হলেও আমার একটা আহি প্রয়োজন।’
আমি চোখব ন্ধ করে ফেললাম এবার। ওই বিক্ষিপ্ত চোখ, কন্ঠ শোনার সাধ্য শক্তি আমার নেই। আনভীর বললেন,
‘ তুমি তোমার বাকি প্রশ্নের উত্তর শীঘ্রই পেয়ে যাবে আহি। শুধু ধৈর্য ধরো। এতটুকু যখন বলেছি, বাকিগুলোও আমি বলবো। শুধু তাই না, যারা যারা ছোটোমায়ের ক্ষতি করেছে, তোমায় কষ্ট দিয়েছে, সবগুলোর হিসেব সুদে আসলে উসুল করে নিবো আমি। শুধু আমায় একটু সময় দাও।’
আনভীর বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন আমায়। ঠোঁটে আরও একবার গাঢ় চু’ম্ব’ন করে আমায় জরিয়ে ধরলেন। আমি চুপচাপ অনুভব করতে থাকলাম উনার বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ গুলো। ঘুমুঘুমু কন্ঠে বললাম,
‘ কথাগুলো আমার কাছ থেকে লুকিয়ে ভুল করছেন আনভীর। এ শাস্তি আমি আপনাকে দেবো। যতদিন আপনি আমাকে সত্যিটা না বলবেন ততদিন দূরে থাকবো আপনার কাছ থেকে। আজকেই আমায় নিজের করে মিশিয়ে ঘুমান। নির্বিঘ্নে ঘুমান। পরবর্তীতে ক’দিন আমায় পাবেন না সেটা আপনার ওপরই নির্ভর। আপনাকে এভাবে ছটফট করতে দেখে আমার বড্ড ভালোলাগে যে!’
_____________
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন ইকবাল সাহেব আর অপূর্বের বাবা। অপূর্ব বাড়িতে নেই। গতকালই এক এমপির সাথে ডিল ফাইনাল করার জন্য শহরের বাইরে গিয়েছে। এদিকে দু’জনের আতঙ্কে ঘাম ঝরছে কপাল দিয়ে। যদি অপূর্ব শুনে এ কথা রাগের বশে কি করে ফেলবে অপূর্বের নিজেরও ধাটনা নেই। ইকবাল সাহেব টিস্যু দিয়ে মুছে নিলেন নিজের কপাল৷ নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ এবার কি হবে ভাইজান?’
‘ কি আর হবে? মাথা হবে। বারবার, আমি বারবার না করেছিলাম যেটা জানেনা সেটা কাউকে জানানোর দরকার নেই। কিন্ত তুই কি করলি? শুনলি না আমার কথা। এখন ভালো হয়েছে না? রাহি তো গোয়েন্দা বিভাগের গুপ্তচর, ভাবতে পারছিস যদি ও বলে দেয় যে তুই আহির মা’কে খুন করে তার সম্পদ এভাবে স্মা’গ’লিং এর জন্য ইনভেস্ট করছিস তাইলে কি হবে?’
‘ আপনি আমার ওপর সব দোষ ঢালছেন কেন ভাইজান? ভাব তো এমন করছেন আপনি কিছুই জানেনা না। ভুলে যানেন না সাবেনা কে মারার জন্য আমাদের দুইজনেরই হাত ছিলো। ওর গাড়ি ব্রেকফেইল কিন্ত আপনিই করাইসিলেন। ‘
অপূর্বের বাবা ক্ষুব্দ হলেন। দ্বিগবিদিক চেয়ে সামনের টি টেবিলে থাকা পানির গ্লাস হাতিয়ে গড়গড় করে সব পানি খেয়ে ফেললেন। বলে উঠলেন,
‘ আমি এতবছর ভেবেছিলাম রাহি বুঝি আমাদের পক্ষে। ওরও বুঝি এই প্রোপার্টি চাই। এতদিন তো এমনই ভান করে আসছিলো। অপূর্বের স্মা’গ’লিং আর খু’ন করার মতো সকল ই’লিগ্যাল কাজকর্ম একবারও কতৃপক্ষের নজরে পড়তে দেয়নি ও। আমি তো ভেবেছিলাম ও বুঝি আমাদের পক্ষেই আছে। এখন তাইলে ও ব্ল্যাকমেইল করছে কেন আমাদের।’
টেবিলের সামনের কাগজপত্র দেখিয়ে বললেন উনি। আসলে রাহি বক্স পাঠিয়েছে একটা, সেখানে ওরা যে আহির মাকে খু’ন কিভাবে করেছে সকল রেফারেন্স আছে। রাহি ধমকি সুরে বলেছে যে আহির প্রোপার্টির কাগজপত্র যেভাবেই হোক, অপূর্বকে না জানিয়ে এনে দিতে। নাইলে এগুলো ফাঁস করবে। আর এতবছর ওদের যে গোপন তথ্যগুলো ও সোভ করে রেখেছিলো সেগুলোও প্রকাশ করবে। হতাশায় হাসফাস করতে থাকলেন ইকবাল সাহেব। বললেন,
‘ মোর খোদা! আমি যদি জানতাম যে রাহি এতবছর আমাদের সাথে নাটক কইরা ওই ইমতিয়াজের ছেলের সাথে মিলা আছে তাইলে ইহজিন্দেগিতেও ওরে এই খবর বলতাম না। ‘
অপূর্বের বাবার এখনও মনে আছে সেই রাতের কথা। যেদিন কিভাবে ওর মাকে মারা হয়েছিলো। আহি তখন ছিলো ছোট। কোনো এক কারনে ওর মা ওকে নানু বাড়ি পাঠিয়েছিলো। হুট করে এক আননোর নাম্বার থেকে কল আসলো যে আহি অসুস্থ। শরীরের অবস্থা খারাপ। তাই ওর মা তড়িঘড়ি করে গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলো মায়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আর এটাই ছিলো ওর মায়ের বড় ভুল। আননোন নাম্বার টা ছিলো ইকবালের লোকের। পূর্বেই গাড়িটা ব্রেকফেইল করা ছিলো। তাই এক্সিডেন্টের নাটক সাজাতে কষ্ট হয়নি খুব। এসবই করা হয়েছিলো আহির মার সেই বিরাট পৈতৃক সম্পত্তির জন্য।
অপূর্বর বাবা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
‘ বাদ দাও এসব। এবার যতদ্রুত সম্ভব এটার ব্যাবস্থা করতে হবে। ইকবাল, অপূর্বকে ফোন দিয়ে ফিরে আসতে বল। বল ওর ললনাকে আর না উড়িয়ে এবার খাচায় এনে আটকে ফেলতে।’
.
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ