এবং তুমি পর্ব-১৪

0
484

গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১৪.

ইশানের মুখ রাগে আবারো লাল হয়ে উঠলো। টকটকে লাল,একদম টমেটোর মতো। সে খুব শান্ত স্বরে বললো,

— এত বেশি বুঝো কেনো? বেশি বুঝা কি তোমাদের মেয়েদের স্বভাব? ডিবোর্স চাও,ডিবোর্স?

আমি জবাব দিলাম না। এ মুহূর্তে কথা বলার অর্থই হলো কান্না করা। চোখ পর্যন্ত জল পৌঁছে গেছে। যেকোনো সময় কান্না চলে আসার সম্ভবনা রয়েছে।হুট করে ইশান আমার দুই বাহু খামচে, চেপে ধরলেন। তার নখ বোধহয় শরীরে গেঁথে যাচ্ছিলো। আমি ব্যাথায় আহ্ করে উঠলাম। ইশান সেদিকে পাত্তা দিলেন না।

—কি হলো চুপ করে আছো কেনো? জবাব দাও। আন্সার মি ড্যাম ইট!

আমি কেঁপে উঠলাম। আমার শরীরের ঘুমন্ত লোমগুলোও জেগে উঠলো। আশ্চর্য! ইশান চিৎকার দিয়ে কথা বলছে কেনো? সে কি জানে না, বাসায় আমার বাবা আছেন। আমি বলতে না বলতেই ‘ আমার নাম উচ্চারণ করতে করতে বাবা এসে দাড়ালেন। ইশানকে দেখে পর-মুহূর্তেই তিনি চমকে গেলেন।

—এই,ছেলে,এই আমার মেয়েকে ছাড়ো। তুমি ওর সাথে এমন করছো কেনো?

ইশান আমাকে তো ছাড়লোই না উল্টো অন্যদিকে তাকিয়ে দ্বিগুণ জোরে আওয়াজ করে বললো,

—সেটা নিতান্ত আমার আর আমার ওয়াইফের ব্যাপার। আমি ওর সাথে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। আপনি বলার কে? প্রভা, তোমার বাবাকে এখান থেকে এক্ষুণি যেতে বলো। এক্ষুণি!

বাবা বিষ্মিত হয়ে বললেন,

—আমি বলার কে মানে? আমি ওর বাবা। তুমি আমার বাড়ীতে এসে আমার মেয়ের সাথে অত্যাচার করবে আমি চুপ থাকবো?

ইশান আমাকে দাত চেপে বললো,

— তুমি উনাকে যেতে বলবে?

—বাবা তুমি এখন যাও।

আমার নিষ্প্রাণ কন্ঠে বাবা আরো বিষ্মিত হলেন। তিনি বললেন,

—কিন্তু…

—কোনো কিন্তু নয় বাবা। তুমি এখন যাও, আমারও উনার সাথে কথা আছে।

বাবা যাবার পাত্র ছিলেন না। থম মেরে দাড়িয়ে ছিলেন। অতঃপর আমার রিকুয়েস্টে যেতে বাধ্য হলেন। বাবা যেতেই ইশান আমাকে ছেড়ে দিল। হন্তদন্ত হয়ে ছুট দিলো দরজা লাগাতে। দরজা আটকানোর পর বোধহয় তার হুশ চলে গিয়েছিলো। সে এদিক-ওদিক চক্কর কাটছিলো। হঠাৎ তার বিছানার পাশের ছোট্ট টুলের উপর পানির দিকে নজর পড়লো। সে দ্রুত পায়ে হেটে জগ টি হাতে নিলো। প্রথমে ঢকঢক করে অর্ধেক পানি পান করে নিলো তারপর বাকি পানি মাথায় দিলো। তবে সেখানে দাড়িয়ে নয়, জানালার পাশে যেয়ে মাথা টা বের করেই দিয়েছিলো। জগ টা রেখে কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে মাথাটা তাক করে রেখেছিলো। সম্পূর্ণ বিষয় টা কেবল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলাম। তিনি এমন করছেন কেনো? সে কি রাগ কমাচ্ছিলেন নাকি অন্যকিছু। আমার ভাবনা চিন্তার মাঝেই ঘটে গেলো বিষ্ময়কর ঘটনা। সে কখন আমার নিকটে এসে হাত ছুঁয়ে ক্ষমা চাচ্ছিলো টের ই পেলাম না।

—আই এম সরি প্রভা। রিয়েলি ভেরি সরি। আই সোয়্যার আমার তোমাকে হার্ট করার কোনো ইনটেনশন ছিলো না। তুমি ডিবোর্সের কথা বলায় আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। আই নো এতটা রিয়েক্ট করার বিষয় ছিলো না,কিন্তু কীভাবে যে হয়ে গেলো আমি বুঝি নি। আই এম সরি! সরি!সরি!

সরি বলতে বলতেই তিনি আমার হাতের পৃষ্টের উপর চুমু খেলেন। একটা নয় পরপর অনেকগুলো। তার কারনামা দেখে আমার রিয়েকশন বাটন কাজ করা বন্ধ করে দিলো।আমি শুধু তাকিয়েই ছিলাম। সে যে এতকিছু করেছে, আমার কোনোরকম প্রতিক্রিয়ায় ছিলো না। আমি জানি তিনি ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট পারসন। কখনো কোনোরকম অনুভূতি এক্সপ্রেস করেন না। ফুফুমণি এ কথা জানানোর পূর্বেই আমি অবগত ছিলাম। কারণ উনার সাথে যখন কাজ করতাম তখন থেকেই দেখেছি,তিনি এমন। ব্যবসায় লাভ-লোকসান যা ই হোক তিনি কোনোরকম অনুভূতি দেখাতেন না। সে সবসময় চুপচাপ গম্ভীর থাকতেন।

আমার ভাবনা-চিন্তার দুনিয়া থেকে বেরিয়ে পড়লাম ইশানের আরেক দফা কান্ডে। তিনি আমার কাপড় গুছাচ্ছেন। আর বলছেন,

—আমরা এক্ষুণি চলে যাবো, ঠিক আছে? তুমি ফ্রেশ হয় নাও তো। এই যে এই লাল শাড়ী টা পরো তো। আজ তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।

আমি বললাম,—এদিকে আসুন। কাপড় রাখুন। আপনার সাথে কথা আছে।

—রাখার দরকার নেই। তুমি বলো আমি শুনছি।

—না,আগে আপনি এদিকে আসুন। আমি এখন যাবো না তো। আগে কথাবার্তা ক্লিয়ার করে নিন।

ইশানের হাত থেমে গেলো। সে একপলক আমার দিকে তাকালো। কিছু একটা ভেবে কাপড়গুলো রেখে দিলেন। আমার সামনে একটা টুল টেনে বসলেন। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

—এবার বলো, কি বলবে?

আমি বললাম,
— আপনি যে এতক্ষণ অস্বাভাবিক কার্যকলাপ করেছেন সেটা বুঝতে পারছেন?

ইশান কয়েক মুহূর্ত নিরব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মাথা নেড়ে সায় জানালো।

—গুড। এবার আমার কথা শুনুন, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আমি আপনার সাথে যাবো না। অর্থাৎ আমার দ্বারা আপনার সংসার করা সম্ভব না। চাপে পড়ে বিয়ে টা তো করেছিলাম,কিন্তু এখন আমার দ্বারা এ সংসার হবে না। একদম না। তো বেটার অপশন হলো, আপনি আমাকে ছেড়ে দিন।আর আবার নতুন বিয়ে করুন, যাকে আপনার পছন্দ হবে,যে জারজ সন্তান হবে না। টেনশন করবেন না এ ছাড়াছাড়িতে আপনার উপর একটা আঙ্গুলও উঠবে না। কারণ সবাই জানে আমার মা বোন কেমন ছিলো আর আমি ও কেমন হবো। বুঝতে পারছেন?

ইশান জবাব দিলেন না। বিনিময়ে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বুঝতে পারলাম কথাগুলো তার হজম হচ্ছে না। আমিও তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। বেশ খানেক সময় পর সে অস্পষ্ট আওয়াজ করে বললো,

—কে্ কেনো ছ্ ছেড়ে দিতে চ্ চাইছো?

—কারণ আমার দ্বারা আপনার সাথে সংসার করা সম্ভব নয়। আমি পারবো না।

— ওহ!

ইশানের নিস্তেজ কন্ঠ আমার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলো। কিছুক্ষণ পর সে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মাথা নাড়াতে লাগলো। এরপর কয়েক মুহূর্ত সেখানেই ঝিমুতে লাগলো।

অনেক ভাবনা চিন্তার পর–‘ওকে’ শব্দটা উচ্চারণ করে দরজার দিকে পা বাড়ালো। আমি খেয়াল করেছিলাম, তখন তার পা দুটো টলছিলো। সে দরজার খিলে হাত রেখেই উঠিয়ে নিলো। কি মনে করে পুনরায় আমার কাছে এসে বললো,

—আমি কি তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি? বেশি নয় একবার। শুধু একবার!

আমি কোনো জবাব দিলাম না।তার আকুতি ভরা চাহনি দেখে আপনাআপনি আমার মাথা নড়ে সায় জানালো। এতটা বিমোহিত হয়েছিলাম যে মুখ দিয়ে শব্দই বের হচ্ছিলো না। ততক্ষণে ইশান শক্ত বন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছিলো। সে এত টাইট করে ধরেছিলো যে মনে হচ্ছিলো ছেড়ে দিলেই বুঝি আমি পালিয়ে যাবো। আমি জানি তার সাথে আমার এইজ গ্যাপ অনেক বেশি। গ্যাপ টা প্রায় বিশ বছরেরও অধিক হবে। যদিও কাগজে কলমে পার্থক্য সতেরো হবে। আমাদের যে মতের মিল হবে না তা পূর্ব থেকেই তার বোধহয় জানা ছিলো। সে একদিন আমায় বলেছিলো, ‘ তুমি তো আমার সাথে সারাজীবন থাকবে না। তাই নিজের জন্য কিছু করো। নিজের একটা অবস্থান করো। যাতে পরবর্তীতে অন্যের উপর নির্ভরশীল না হতে হয়।’ আমি জানি না সে কেনো বলেছিলো। ব্যাস একদিন কাজ থেকে ফিরে হুট করেই বলেছিলো। একটা বিষয় বলতে ভুলে গেছিলাম, সে কিন্তু বিয়ের ৩য় দিন থেকেই আমাকে আমার পড়ালেখা করার কথা বলেছিলো। আমি ক্ষীণ সন্দেহ আমার শাশুড়িকেও সে ই বলেছিলো, আমাকে পড়ার কথা বলতে। আমিই আগ্রহী ছিলাম না। সেইদিনের মিটিং এর উদ্দেশ্য কিন্তু এটাই ছিলো। এটা ফুফিমা আমাকে জানিয়েছিলো।

#চলবে….

®সোনালী আহমেদ