এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ১১
সানজিদা মাহি
_________________________________
” আপাআআআআ ”
” আরে গলা ছাড় আগে। দমবন্ধ হয়ে আসছে ”
বিনু বোনের গলা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
” তুই আসছিস একটাবার বললি না আমাকে। একটা টেলিফোন করতে পারতি, চিঠি লিখতে পারতি… সত্যি বিয়ের পর মানুষ এমন স্বার্থপর হয়ে যায়? ”
” বেশি কথা বলিস। আমি এসেছি মাত্র কাল ”
বিনু একটু ভেতর দিকে উঁকি মেরে ফিসফিসিয়ে বলল,
” দুলাভাই কি ভিতরে? ”
” না নেই। আয় ভেতরে। আমি একা এসেছি ”
” একা এসেছিস??? ”
বিস্মিত বিনুর হাত টেনে তনু ভিতরে নিয়ে চলল। সবাই তখন খাচ্ছে। বিনুকে দেখে তনয় বলে উঠলো,
” আরে আপা তুমিও চলে এসেছো। কি মজা! এখন বাসার সবাই উপস্থিত আছে ”
নুরুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ” একা এসেছিস? জামাই আসেনি? ”
” ও মিষ্টি আনতে গেছে, বাবা। একটুপর চলে আসবে ” তারপর বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ” একি ভাইয়া! তুমি গোঁফ রেখেছো কবে থেকে? কেমন দেখা যায়? ওয়াক! ”
যে কথাটা তনু বলতে পারেনি সেটা বিনু বলে দিল অকপটে। বিনয় ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো৷ মুখে খাবার বলে কিছু বলতে পারছে না। ফরিদা বিনয়ের পক্ষ নিয়ে বললেন,
” থাক রেখেছে ও শখ করে। এমনভাবে বলিস কেন? তুই যা বোরকা বদলে, হাত-মুখ ধুয়ে আয়। নাস্তা দিচ্ছি ”
মায়ের প্রথম কথার জবাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো সে। তারপর কি মনে করে আর বলল না।
” আচ্ছা আমি বদলে আসি। তোমরা নাস্তা করো ”
যাবার সময় বিনু তনুকে টেনে নিয়ে গেল।
লাগেজ থেকে এক রকমের দুটো শাড়ি বের করলো বিনু। একটা শাড়ির রঙ আসমানী আরেকটা জলপাই রঙের। দুটো শাড়ি বিছানার ওপর রেখে তনুর দিকে ফিরে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো,
” কোনটা পছন্দ হয়?”
দুটো শাড়িতে হাত দিয়ে ভালো করে দেখে অবচেতন মনে তনু বলে ফেলল, ” জলপাই রঙেরটা নেব ”
পরক্ষণেই মনে পড়লো সেদিন শান্তার পরনেও জলপাই রাঙা শাড়ি ছিল। বিনু সোৎসাহে বলতে লাগলো, ” গত সপ্তাহে ও চট্টগ্রাম গিয়েছিলো। যাবার আগে বললাম একই নকশার ভিন্ন রঙের দুটো শাড়ি এনো। শাড়িটা সত্যি পছন্দ হয়েছে তো তোর আপা? ”
তনু উপর নিচে মাথা নাড়লো সন্তর্পণে। তার থেকে চার-পাঁচ বছরের ছোট বিনু কত সহজভাবেই না স্বামীকে ‘ও’ বলে ডাকছে। অথচ সে তো কোনোদিন আহ্লাদ করে ডাকবার কথা ভাবতেও পারেনি। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আনমনে। শাড়িটাকে গায়ে জড়িয়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। শাড়িটা বেশ সুন্দর। বিনুর জামাইর পছন্দ আছে। অবশ্য বিনুটাও তো কম না। পছন্দ না হলে ঠিক বদলে আনাতো। বোনের দিকে ফিরে তনু আমতা আমতা করে বলল, ” ইয়ে..মায়ের জন্য শাড়ি আনিসনি? ”
” মার জন্য তো আগেই এনে রেখেছি। আমাদের জন্য মিল করে এনেছি পরে ”
তনুর মনে পড়লো আসার সময় সে এক্কেবারে শূন্য হাতে এসেছে। সামান্য কিছুও আনেনি কারো জন্য। সত্যি, এ কাজটা আরও বেশি সন্দেহের উদ্রেক ঘটাবে। আর তা না ঘটালেও নিজের স্বামী কতটা কৃপণ সেটা কাউকে প্রমাণ দেবার প্রয়োজন হবে না। কর্তামশাইয়ের সঙ্গে ওর ভেতরে ভেতরে যাই হোক না কেন তার অপমান মানে তো তনুর নিজেরও অপমান। সেই অপমানটা সে কি দিয়ে ঢাকবে?
বিনু মেরুন রঙের আরেকটা শাড়ি বের করে তনুর হাতে দিল।
” এটা কেমন দেখতো। মায়ের জন্য এনেছি ”
শাড়িটা ভালো করে নেড়েচেড়ে তনু উত্তর করলো,
” না ভালোই। মাকে মানাবে। মাকে কিন্তু সব রঙেই মানায় ”
” সুন্দর মানুষ যে তাই ”
” সেজন্যই তো তোরা সুন্দর হয়েছিস ”
” ইশ যাহ্! তুই যেন বান্দরের মতো হয়েছিস? ” তারপর মুখে হাত দিয়ে হাসি চেপে বলল, ” তবে বিনয় ভাইয়ার কথা বলতে পারি না ” বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো সে।
হাতের শাড়ি দিয়ে বিনুর ঘায়ে মৃদু আঘাত করে তনু কৃত্রিম ভয় দেখাবার চেষ্টা করলো ওকে।
” এভাবে বলিস না। ভাইয়া একবার শুনতে পেলে রক্ষে নেই ”
হাসতে হাসতেই বিনু বলল,
” হ্যা সে জানা আছে আমার। চোখ পাকানো ছাড়া আর কি করতে পারে সে? ”
তনুও বোনের সাথে হাসিতে যোগ দিল।
বিনুর বর ওকে এ বাড়িতে পৌছে দিয়েই চলে যেতে চেয়েছিলো। ব্যবসায়ের কাজে তাকে চট্টগ্রাম যেতে হবে আবারও। কিন্তু মিষ্টি এনে ভেতরে বসতেই ফেঁসে গেল। বাসার পুরুষ মানুষেরা সবাই নিজেদের কাজে বাইরে বেরিয়ে গেছে ততক্ষণে। তাই তার সাথে শ্বশুর বা শ্যালক কারো সাথেই দেখা হয়নি। এদিকে ফরিদা কিছুতেই তাকে নাস্তা না খাইয়ে ছাড়বে না। অবশেষে শ্বাশুড়ির চাপে পড়ে নাস্তা করতে হলো তাকে। ফরিদা বহুবার দুপুরে খেয়ে যাবার কথা বললেও লাভ কিছু হলো না। দুপুর পর্যন্ত থাকলে চট্টগ্রামে যেতে তার অনেকটা দেরি হয়ে যাবে। অগত্যা ফরিদাকে ক্ষান্ত দিতে হলো। বিনুর বর চলে যেতেই তনু চেপে ধরলো বিনুকে।
” তুই কিরে হ্যা? জামাই দুপুরে খাবে না বললো আর তুই একবার থাকতেও বললি না? ”
” কি দরকার? সে এমনিতেও থাকবে না আগেই বলেছে আমাকে। বলেছে, আমি কিন্তু তোমাকে দিয়েই চলে আসব। থাকার জন্য জোরাজোরি করতে পারবে না ”
” আর তুইও অমনি মেনে গেলি? ”
” ধূর ওর কথা ছাড় তো। Now husband time is end and sister time is start! “, বলেই জড়িয়ে ধরলো বিনুকে।
” হ্যা বুজুর্গ হয়েছেন তো আপনি ”
” হিহি ”
ফরিদা রান্নাঘরে গিয়ে কি কি রান্না করবেন সে হিসেবে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তখনও কাটাকাটি শুরু করেননি। দুই বোন গিয়ে হাজির হলো সেখানে। রান্নাঘরটা অতো বড় নয় বলে তিনজন একসাথে কাজ করতে অসুবিধা হয়। ওরা মাকে অন্য কাজ করতে বলে রান্নাঘর দখল করে নিল। বাবা অফিসে যাবার আগে ছোট একটা ছেলেকে দিয়ে তেলাপিয়া মাছ কিনে পাঠিয়েছেন। বিনু বসলো মাছ কাটতে। তনু এক চুলায় ভাত আর আরেক চুলায় ডাল বসিয়ে মেঝেতে বসে বোনের মাছ কাটা দেখতে লাগলো। বিনু সুনিপুণ হাতে অতি দ্রুত মাছগুলো কেটে ধুয়ে ফেলল। তনু না বলে পারলো না,
” মাত্র এক বছর সংসার করেই দেখি তোর হাত পাকা হয়ে গেছে ”
” না হয়ে উপায় কি বল? যৌথ ফ্যামিলিতে পড়লে তুইও বুঝতি। তুই তো সুখেই আছিস। শ্বশুর- শ্বাশুড়ি, জা, ননদ-ননস কিছুই নেই। ঝামেলাহীন সংসার। সারাদিন খালি জামাইয়ের সঙ্গে প্রেম করবি ”
শেষের কথাটা রসিকতা করে বললেও কথাটা সূচের মতো ফুটলো তনুর বুকে। হ্যা ঝঞ্জাটহীন সংসার। কিন্তু মাত্র দুটো মানুষের সংসারে সুখটুকুই ছিল না। তৃতীয়পক্ষ অনাহূতের মতো প্রবেশ করলো তারই অগোচরে। না ভুল বলা হলো। সে নিজেই তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ঢুকে পড়েছিলো ওদের দু’জনের মাঝে। যে চেতন মনে কারো সামান্য ক্ষতি হবে এমন চিন্তা থেকে নিজেকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত রেখেছিল আজীবন, সে-ই স্বয়ং আজ তৃতীয় ব্যক্তি। “তৃতীয় ব্যক্তি” কথাটা ক্রমে ক্রমে ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো সাইক্লোনের ন্যায়। সম্বিত ফিরলো বিনুর ডাকে।
” এই আপা! বৃষ্টি পড়ছে তো। তুই রান্নাটা দেখ আমি বাইরে থেকে জামাকাপড় নিয়ে আসছি ”
তনু তড়িৎ গতিতে ছুটে গেল বাইরের দিকে। অনেক কষ্টে তাড়াহুড়ো করে জামাকাপড় গুলো ঘরে নিয়ে এলো। বৃষ্টি এরই মধ্যে অনেকখানি ভিজিয়ে দিয়েছে। ফরিদা পাশের ঘর থেকে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
” ভিজে গেল নাকি? ”
” হ্যা, কিছুটা তো ভিজেছে। একটু কষ্ট করে মেলে দাও তো মা ”
মাকে জামা মেলতে বলে সে বোনের কাছে রান্নাঘরে এলো। চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে হঠাৎ তনুর হাত চেপে ধরলো।
” এই তাড়াতাড়ি চল! ”
” কোথায়? ”
” বৃষ্টিতে ভিজব! তাড়াতাড়ি আয়। বৃষ্টি থেমে যাবে ”
তনু শঙ্কিত হলো। এই পাগল বোনটার পাগলামি সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে তার। বলল,
” পাগল নাকি? চুলায় রান্না হচ্ছে ”
” রান্না মা দেখবে। তুই আয় তো ”
বিনু তনুর হাত ধরে টেনে বাইরে বেরিয়ে এলো। আসার সময় মাকে চেঁচিয়ে বলল,
” মা রান্নাটা একটু দেখো তো ”
অবিরত ধারায় বারিপাত হচ্ছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা গুলো টপ টপ করে পড়ছে সিমেন্টের মেঝেতে। তনুদের টিনের চাল গড়িয়ে বৃষ্টির পতন হচ্ছে উদ্যোমশীল গতিতে। বিনু ছোটাছুটি করা আরম্ভ করলো৷ তনু কিছুটা গা বাঁচাতে এসে বসলো বকুল গাছের নিচে সিমেন্টের তৈরি ব্যাঞ্চে। কৌতুহলী চোখে দেখতে লাগলো ছোট বোনের কান্ড কারখানা। কে বলবে এই মেয়ের বিয়ে হয়েছে? তনু জানে, বিনুর মনের একপাশ এতো ছেলেমানুষ হলেও অন্যপাশটা ব্যাপক পরিণত বুদ্ধিসম্পন্ন। বিনুর বর পরিবারের বড় ছেলে। যৌথ পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী তাকে যেমন অধিক দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকতে হয় সর্বদা, তেমনি বিনুকেও সব কাজে অধিক তৎপরতা বজায় রাখতে হয়। সংসারের অনেকটা দায়িত্ব সে একাই পালন করে। প্রায়শই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকের কাছ থেকে অপ্রিয়, শ্রতিহীন,কটুক্তির বাণে জর্জরিত হতে হয় তাকে । সেসব আঘাতকে একপাশে সরিয়ে রেখে হাসিমুখে, প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিতে সকলের মন রক্ষা করে দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবিচল থাকতে হয়। বিনুর আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো সে কখনো শ্বশুরবাড়ির মানুষের নিন্দা করে না। কারো আচরণে খুব বেশি কষ্ট পেলে নাম না উল্লেখ করে এমনভাবে বলে যেন ব্যক্তিটি সম্পর্কে ধারণা করা না যায়৷ যেমন বলবে, “এত কষ্ট করে রান্না করে, সারা বাড়ি পরিষ্কার করলাম তবু কিছু মানুষ বলল, আমি নাকি ঠিকমতো কাজ করি না। থাক সে যা বলার বলেছে। কাজ করেছি কি করিনি সেটা তো আল্লাহই দেখেছেন। তার কাছেই না হয় প্রতিদান প্রত্যাশা করব ”
তনু আর বিনু তো একই বাবার মেয়ে। তবুও বিনুর এসব সুন্দর গুণাবলি গুলো ওরমধ্যে নেই কেন? যদি ছোট বোনের এই সুন্দর গুণগুলো সে আত্মস্থ করতে জানতো তবে আজ হয়তো এতোটা কষ্ট পেতে হতো না ওকে। কৌশলে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে নিতে পারতো। না রূপ, না গুণ। তনু যেন কোনো ক্ষমতাই নিজ গুণে অর্জন করতে পারেনি৷ আল্লাহ তা’আলা মানুষকে কিছু জিনিস দিয়ে দুনিয়াতে পাঠান। আর কিছু জিনিসকে নিজের প্রয়াসে অর্জন করে নিতে হয়। নিজে কোনো প্রকার চেষ্টা না করে কিছু মানুষ আজীবন স্রষ্টার প্রতি অভিযোগ পোষণ করে যায়। অথচ ব্যর্থতার কারণ যে সে স্বয়ং নিজেই এ সহজ কথার ভাবার্থ উদ্ধার করবার ইচ্ছেও জাগে না কখনো। অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে শান্তি পাওয়া গেলে কে-ই বা শান্তি বিনষ্ট করতে চায়?
তনুকে বসতে দেখে বিনু আবার দৌড়ে এলো। তনুর হাত ধরে টেনে ওকে ওঠাবার চেষ্টা করলো।
” বসে থাকলে বৃষ্টি বিলাসের কোনো মজাই পাবি না। আয় মাঝখানে যাই ”
মাঝখানে এসে বিনু বোনের হাত ছেড়ে মেঝেতে আসন গেড়ে বসে পড়লো। ওর দেখাদেখি তনুও তাই করলো। চোখ বন্ধ করে দু’বোন আকাশের দিকে মুখ তুলে বসে রইলো দীর্ঘক্ষণ। তনু চোখ মেলতেই দেখলো বিনু ওর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে।
” হাসছিস কেন? ”
কথা বলতে গিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়লো ওর মুখের ভেতর। আচম্বিতে এহেন অবস্থায় সেও ঢোক গিলে ফেলল। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। চোখেমুখে ঢুকে পড়ছে একপ্রকার জোর খাটিয়ে। তনু চোখের ওপর হাত রেখে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো বিনুর দিকে। বিনু মুখটাকে সামনে বাড়িয়ে বলল,
” তুই এতো সুন্দর কেন আপা? তোর জামাই কি করে তোকে একা একা পাঠিয়ে দিতে পারলো? যদি পথে হঠাৎ কেউ তোকে চুরি করে নিয়ে যেত? ”
তনু আলতো করে থাপ্পড় লাগালো বিনুর গায়ে।
” খালি ঠাট্টা ”
” না সত্যি বলছি ”
” বিনু! ”
” হ্যা ”
” তোর মাঝে এত প্রাণ কেন রে? আমাকে একটু ধার দিবি? ”
হৃদ প্রকোষ্ঠের অতলে মৃয়মান বিষাদে আচ্ছন্নিত হয়ে কথাটা বলেছিল তনু। বিনু সেটাকে ঠাট্টা হিসেবে ধরে নিল।
” নিবি? সবটুকু নিয়ে যা তাহলে ”
খিলখিল করে হাসতে লাগলো সে। তনু মুগ্ধ হয়ে দেখলো বোনের হাসি। তার গাল গড়িয়ে বেয়ে আসা ফোঁটায় ফোঁটায় উষ্ণ অশ্রু সন্তর্পণে মিশে গেল প্রবল বর্ষনের সঙ্গে। বিনু তা দেখতে পায়নি। তনুর কষ্ট কেউ দেখে না এক আল্লাহ ছাড়া। তার মুখ না ফোঁটা গভীর নিনাদ পৌছায় না কারো কর্ণকুহরে। তার মন খারাপের সঙ্গী কেবল বৃষ্টি। বৃষ্টি তাকে সবার থেকে আড়াল করে রাখে। যাতে করে তার কষ্ট কারো কাছে প্রকাশ না হয়ে যায়। আবার প্রচন্ড কষ্টের সময় জড়িয়ে রাখে নিগুঢ় মায়ায়। বৃষ্টি তার বিষাদ সঙ্গী। তাই তো সে বৃষ্টিকে এত বেশি ভালোবাসে। স্বার্থহীন ভাবে বর্ষনের ন্যায় প্রশ্ন করা ছাড়া কে আপন করে নেয়? অপ্রয়োজনীয় কৌতুহল ছাড়া অবলীলায় আর কারই বা সযতনে আগলে রাখার ক্ষমতা আছে।
বৃষ্টিতে ভিজে আশ্চর্যজনকভাবে একের পর এক হাঁচি দিতে লাগলো তনু। অথচ অচিন্তপুর সে এতবার বৃষ্টিতে ভিজলো তবু সর্দি, জ্বর কিছুই হলো না। তনু অবাক হয়ে ভাবলো, ভারী আশ্চর্য কারবার। শাড়ি বদলে বিনু রান্নাঘরে ঢুঁ মারলো। ফরিদা মাছ বসিয়েছেন চুলায়।
” কিরে বৃষ্টিতে ভেজা হলো তোদের? সর্দি-জ্বর হলে কিন্তু আমি কিছু জানি না ”
” তোমাকে কিছু জানতে হবে না মা। এ বয়সে বৃষ্টিতে না ভিজলে কি বুড়ো বয়সে ভিজব বলো? আচ্ছা চুলা খালি আছে না একটা? চা বসাই। আপার সর্দি লেগেছে। একটু চা খেলে ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ ”
তনু বারান্দায় চেয়ারে বসেছে। বৃষ্টি কমেছে তবে একেবারে থেমে যায়নি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি কুয়াশার ন্যায় সম্মুখের সবকিছু ঢেকে দিয়েছে আবছাভাবে। বৃষ্টিতে ভেজা আর বসে বসে বৃষ্টি দেখা এ দুটো জিনিস উপভোগের অনুভূতি হয় ভিন্ন ভিন্ন। দুটোই সুন্দর এবং বৃষ্টিপ্রেমীদের কাছে ভীষণ মিষ্টি। ইশ! সারা বছর যদি বৃষ্টি থাকতো কি ভালোই না হতো। অবশ্য সারা বছর বৃষ্টির মৌসুম থাকলে বৃষ্টিটা আর পছন্দের ব্যাপার থাকতো না। ভারী একঘেয়ে হয়ে যেত তখন। তাছাড়া বৃষ্টি তো আর সবার জন্য আরাম বয়ে আনে না। জীবিকার জন্য এধার থেকে ওধারে ছুটে চলা মানুষের কাছে বরং ভীষণ কষ্টের। বিনু দুই কাপ নিয়ে এসে এক কাপ বোনকে দিল আরেক কাপ নিজে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসলো। এ বাসার বারান্দাটা লম্বাটে। তাই অনেক বড়। এক পাশে দুটো চেয়ার আর টি-টেবিল রাখা হয়েছে। এখানে বসে নুরুল সাহেব বিকেলে পত্রিকা পড়তে পড়তে এক কাপ চা খান। তনু বিয়ের আগে যখন তখন এখানে এসে বসে থাকতো। বসে বসে বই পড়তো কিংবা এক ধ্যানে কত কি ভেবে যেত আপন মনে।
বারান্দার উপরে সানশেড থাকায় ভেতরে বৃষ্টি ছিটকে আসতে পারে না। তাই এখানে বসে নির্ভাবনায়, নিশ্চিন্তমনে বৃষ্টি দেখা যায়। গেটের ওপাশে রাস্তা পেরিয়ে কিছু বড় বড় গাছ আছে। গাছের সবুজ পাতা গড়িয়ে বৃষ্টির পানি পড়া দেখতেও অসাধারণ লাগে।
” আপা সত্যি করে বল তো দুলাভাইয়ের সাথে তোর সব ঠিকঠাক আছে? ”
চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো তনু। আচম্বিতে বোনের কাছ থেকে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নে হোঁচট খেল যেন। হাতের কাঁপুনিতে ধাক্কা খেয়ে গরম চা মুখে গিয়ে জিহ্বা পুড়ে যাবার উপক্রম হলো। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলো সে। এ কথার উত্তরে কি বলা যায়? কি বললে সবদিক রক্ষা হবে? সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙ্গবে না। অর্থাৎ ওর সন্দেহ থেকে বাঁচবে আবার মিথ্যে বলাও হবে না। ধুরুধুরু বুকে বোনের দিকে ঘুরে বসলো তনু।
চলবে ইন শা আল্লাহ…
এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ১২
সানজিদা মাহি
________________________________
” এ কথা কেন মনে হলো?
” না মানে তোকে একা আসতে দিল… ব্যাপারটা মানতে পারছি না আমি ”
তনু কিয়ৎক্ষন চুপ করে থেকে বলল,
” তোকে বলিনি আমি? ”
” না কি বলবি? ”
” উনি আসবে আরো কয়েকদিন পর ”
তনু চায়ে চুমুক দিল। যেন বড় রকমের একটা ফাড়া কাটলো এই মাত্র। বিনুর কিঞ্চিৎ রাগ হলো।
” ধূর তোকে কি বলি আর তুই কি বলিস! ”
তনু মুখ না তুলেই বলল,
” কি বলিস? ”
” বললাম, তোকে পাঠালো নাকি তুই রাগ করে চলে এসেছিস? ”
” রাগ করে কেন আসব? আমি কি এতটাই বোকা যে রাগ হলো আর অমনি দুম করে ব্যাগ গুছিয়ে এতদূর চলে আসব ”
” না, তোকে যতটুকু জানি এমন করবি না। এসব সাহস আমার থাকতে পারে কিন্তু তোর নেই। আমার কথা হলো বিয়ের পর কেউ বউকে একা বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিবে? কেমন না ব্যাপারটা? ”
তনু বিরক্তসূচক শব্দ করে বলল,
” বললাম তো উনার কাজ ছিল। বলেছে কয়েকদিন পর আসবে। আমি এতদিন অপেক্ষা করতে পারব না বলে…”
” তুই বললি আর দিয়ে দিল? আঁটকালো না তোকে? ”
তনু থমকালো। শেষ অবধি এ প্রশ্নটার সম্মুখীন হতে হলো ওকে? ও যে শেষ মুহূর্ত অবধি চেয়েছে লোকটা তাকে আঁটকে রাখুক। অন্তত একবার থেকে যেতে বলুক। অথচ…সেই মুহূর্তটা মনের আয়নায় ভেসে উঠতেই অপরিমেয় রাগ আর অভিমানে তনুর হৃদয় দুমরে মুচড়ে দিতে লাগলো অদৃশ্য জন্তুর মতো এক যন্ত্রণা। ভেতর থেকে আবারো কেউ ওকে মনে করিয়ে দিল, সে বড্ড বোকা বলেই এভাবে, এত অবলীলায় ঠকানো গেছে তাকে।
” বাহ্! তাহলে তো তোর জামাই দেখছি বউয়ের হাতের পুতুল। বউ যা বলে তাই শোনে ” বিনু হাসতে লাগলো তার স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। এ কথাটায় গুমোট ভাব কেটে গিয়ে পরিবেশ হালকা হলো। তবু তনুর মনের আশঙ্কা কাটলো না কিছুতেই।
নিজের ভঙ্গুর মনের অবস্থা প্রকাশ হবার ভয়ে বিনু থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করলো তনু। তাতে যেন বিনু আরও বেশি আষ্ঠেপৃষ্ঠে শামুকের মতো ওর সাথে লেগে রইলো। তনু জানে সে অভিনয়ে বড় বেশি কাঁচা। আর এই ভয়টাই ওকে ক্ষনে ক্ষনে বিমূঢ় করে ফেলে। সে শুধু দুঃখগুলো নিজের মাঝে আড়াল করতে জানে কিন্তু মুখের ওপর প্রলেপ পড়া দুঃখকে অভিনয় দিয়ে ঢাকতে পারে না। নিজের প্রতি তার নিজেরই হাজারটা অভিযোগ। নিজের আরোপিত সেসব অভিযোগে সময়ে সময়ে সে নিজেই বিহ্বলিত হয়ে পড়ে। কেন সে কোনোকিছুই ঠিকভাবে পারে না?
দুপুরে যোহরের সালাত আদায় করে, খেয়ে শুয়েছিলো তনু। ভাবনা এই যে, ঘুমালে মানসিক চাপটা কমবে৷ বিনুর মুখোমুখি হওয়া থেকেও বাঁচা যাবে অনায়াসে। তনুকে কোথাও না পেয়ে শোবার ঘরে উঁকি দিল বিনু। তনুকে শুয়ে থাকতে দেখে সেও পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। অভ্যাসবশত নানান কথায় আলোচনা জমাবার চেষ্টা করলো। এক পর্যায়ে বুঝতে পারলো সে একাই বকবক করছে। তনু কিছুই বলছে না। ভালো করে খেয়াল করে দেখলো তনু ঘুমিয়ে গেছে। সেও ঘুমাবার চেষ্টা করলো। অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পরও ঘুম না আসায় উঠে পড়লো সে। ওকে চলে যেতে দেখে তনু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক আপাতত মুক্তি। কোলবালিশটাকে হাত দিয়ে টেনে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবার চেষ্টা করলো।
ঘুমটা হালকা হয়ে আসছিলো। আধো ঘুম আধো জাগরণে তনুর কানে বাজতে লাগলো রিমঝিম হাসির কলতান। বাস্তবের আংশিক চিত্র স্বপ্নে পরিণত হলো। তনু দেখলো অনেক অনেক মানুষ একটা বড় ঘরে ভিড় জমিয়েছে। পুরো ঘর জুড়ে মানুষের ছোট ছোট জটলা। সবাই হাসছে, হৈ-হুল্লোড় করছে। মেতে আছে সকলে এক অনিঃশেষ আনন্দে। চারদিকে আলোর ঝলকানি৷ বৃত্তাকারে ওপর হতে নিচে নেমে আসছে লাল, নীল, হলুদ- কত রঙের আনন্দের ফল্গুধারা। সেগুলো এসে আলতো স্পর্শে স্থান করে নিচ্ছে মানুষের গায়ের ওপর, পোশাকের উপরিভাগে। বাতাসে ভাসছে উচ্ছসিত আবেগের ঘ্রাণ। তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো সবকিছু — ভীড়সমেত সমগ্র মানুষ, হাসির কলতান, রং-বেরঙের আনন্দের ফল্গুধারা। সবকিছু মিলিয়ে গেল, নিভে গেল সব আলো। এবার তনুর চোখের সামনে শুধু নিকষ কালো তিমির৷ তনু চোখ মেলল। হাসির শব্দ আসছে পাশের ঘর থেকে। কার কন্ঠ তা বুঝতে কষ্ট হয় না। বাবার উচ্চস্বরে, উত্তেজিত কথাও কানে এসে ধাক্কা খেল। তনু উঠে গিয়ে পাশের ঘরে উঁকি দিল। বিনুটা এমনই। যেখানে যায় মুহূর্তে আড্ডা জমিয়ে ফেলে। দেয়ালের বড় ঘড়িটায় নজর পড়তেই তনু বুঝলো আসরের আজান দিয়েছে আরো আধঘন্টা আগে। সে নামাজ পড়ে এসে সবার সাথে আড্ডায় যোগ দিল। তাকে দেখে নুরুল সাহেব বলে উঠলেন,
” ওই তো এলো তনু ”
তনু প্রতিত্তোরে স্মিত হাসলো।
নুরুল সাহেব আর তনয় চেয়ারে বসে আছে। ফরিদা খাটে বসে শুকনো জামা-কাপড় ভাঁজ করে রাখছেন। বিনুকে দেখা যাচ্ছে না৷ তনু রান্নাঘরে এলো। বিনু চাল ভাজছে।
” কিরে ঘুম ভাঙলো? যে একখান ঘুম দিয়েছিলি ”
” আমি পেঁয়াজ, মরিচ কেটে ফেলি ”
” চানাচুর আছে? ”
” জানি না তো ”
” দাঁড়া না থাকলে তনয়কে দিয়ে আনাই ”
বিনু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো চানাচুর আছে কিনা। নেই বলে তনয়কে চানাচুর আনতে পাঠালো। তনু রান্নাঘর থেকে ওর কথা শুনতে পাচ্ছিলো।
খাওয়ার আগ মুহূর্তে কোথা থেকে বিনয় এসে জুটলো।
” আমাকে রেখে খাওয়া হচ্ছে না? সত্যি বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা ভাইয়ের কোনো খোঁজ খবরই রাখে না ”
বিনু সুযোগ পেয়ে কথা বলতে ছাড়লো না।
” ইহ সারাদিন বোহেমিয়ানের মতো ঘুরে বেড়াবে উনি আর আমাদের উপর দোষ চাপাবে। সারাদিন থাকো কোথায় বলো তো? দুপুরে খাও কোথায়? ”
” এক বন্ধুর সাথে ওর মেসে খেয়েছি ”
” কেন আমাদের বাসায় কি খাবারের অভাব পড়েছে? ”
নুরুল সাহেব বাঁধা দিয়ে ওদেরকে থামালেন।
” আহা তোরা ঝগড়া করিস কেন? যা চুলায় চা বসিয়ে আয় তো বিনু ”
” সেটা কি আর বলতে হয় বাবা? আপা বসিয়ে এসেছে ”
খেতে খেতে এবার আলোচনা অন্যদিকে মোড় নিল। দেশের হালচাল নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। স্বাধীনতার পর কতটা উন্নতি হলো আর কতটা হবার প্রয়োজন ছিল তা নিয়ে চলল তুমুল আলোচনা – সমালোচনা। বলাই বাহুল্য এমন আলোচনা পেলে বিনয় তার জ্ঞান জাহির করতে ভুলে না। দেশের সব খবরাখবরই যেন হাতের মুঠোয়। বাসার সবার উপস্থিতিতে তনুর কাছে উৎসব উৎসব লাগছিলো। খানিকটা সময়ের জন্য হলেও ভুলে গেল ক্ষতের কথা। আঘাতের কথা মনে পড়লেই যেন ব্যাথাটা বাড়তে থাকে ক্রমশ। অথচ যতক্ষণ আমরা ক্ষত ভুলে থাকি, বুঝতে পারি না তার কার্যকারণ।
.
দুপুরের আগ থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা অবধি আষাঢ়ের আকাশ অবিশ্রান্তভাবে নিরন্তর রোদন করে গেছে। কিছু কান্না হয় না একান্ত সুখের? আকাশের এ কান্নাটাও যেন তেমনি সুখের। অথবা আজ তনুর মনের আনন্দের আবাসে দু’দিন আগের ক্ষতে প্রলেপ পড়ায় অবিরাম বর্ষনটাকে সুখ বলে আখ্যায়িত করতে ইচ্ছে হলো তার। আরেকটু সুখের বিষয় এই যে, সন্ধ্যায় বৃষ্টি থেমে আকাশের মুখ হতে মেঘ মেঘ ভাবটা কেটে , ক্লান্তির ছাপটা উবে গিয়ে একরত্তি চাঁদটা নতুন বউয়ের মতো সলজ্জ ভঙ্গিতে উঁকি দিল। মেঘ যদিও সম্পূর্ণ কাটেনি। তবে এটাই যেন পরিবেশটাকে আরেকটু মধুর করে দিল। মিঠে মিঠে আলো ছড়ানো লাজুক চাঁদ টাকে মাঝে মাঝে এক খন্ড মেঘ ভাসতে ভাসতে খানিক সময়ের জন্য ঢেকে দিয়ে যায়। ওই সামান্য সময়টুকু চাঁদ টাকে দেখার যে অভিলাষে মনটা আকুপাকু করে ওঠে সেটাও তনুকে পুলকিত করে চলেছে। বারান্দায় রাখা কাঠের চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে বিমুগ্ধ চাহনীতে মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখছিলো তনু। ভাঁজ করা হাঁটু জড়িয়ে রেখেছে তার দুটো সরু হাত। দু’হাতের দুটো সোনালী চুড়ি শীর্ণকায় মেয়েটার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিল দ্বিগুণ করে। তনু দেখতে বিনুর মতো রূপসী না হলেও ভালো করে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, কি ভীষণ স্নিগ্ধ মায়া জড়িয়ে থাকে মেয়েটার সারা মুখ জুড়ে। কিছু মানুষের সৌন্দর্য প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ করে না। কিন্তু বারবার দেখতে পেলে গভীর, প্রচ্ছন্ন, কুয়াশার মতো আবছা একটা মায়া আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। সহজে সেটা ছাড়ানো যায় না৷ বারবার দেখার প্রবল আগ্রহ, উৎকন্ঠা, উদ্বেগে মলিন লাগে সুখের সরঞ্জামকেও। মৃয়মান চোখ খুঁজতে থাকে পেলব মৃত্তিকার আদলে গড়া, মায়ায় লেপ্টে থাকা মুখটাকে।
দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টি হওয়ায় চারদিকে শীতল সমীরণ বইছে লঘু হারে। শীত শীত অনুভব হওয়ায় আঁচলটা টেনে ভালো করে কাঁধ ঢেকে নিল তনু। পরিবারের সাথে সময়টা ভালো কাটছে তার। ওখানে থাকলে হয়তো অপমান আর গ্লানিতে পর্যুদস্ত হতে হতে ভেতর ভেতর সে অনেক বেশি নিঃশেষ হয়ে যেত। প্রচন্ড আঘাতে তৈরি হওয়া ক্ষত অনেকদিন অবধি থেকে যায়। সেখানে হঠাৎ চোখ পড়তেই আশেপাশের সবকিছু যেন থমকে যায়। শুধুমাত্র সম্পর্কিত ঘটনাটির পুনঃ পুনঃ দৃশ্যায়ন হতে থাকে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে একসময় ক্ষতটা শুকিয়েও যায়। তবে দাগ থেকে যায় বহুদিন পর্যন্ত, কারো বা আজীবন ৷ সুখ পেলে মানুষ ফেলে আসা দুর্দিনের স্মৃতি ভুলে যায় অক্লেশে। পুনরায় যখনই একই জায়গায় আঘাত লাগে, তখন পুরনো ক্ষত জেগে ওঠে তেজদীপ্ত হয়ে । তরতাজা রক্ত জানান দেয় তার অস্তিত্বের অবস্থান। একা একা লড়াই করা অত্যন্ত কঠিন। অন্তত তার মতো নাজুক মনের মেয়ের জন্য। তনুর শুধু চিন্তা একটাই, যে সত্য থেকে সে পালিয়ে এসেছে, পূর্নোদ্দমে সহসা তারই মুখোমুখি হতে হবে তাকে। আর তার জন্য প্রয়োজন নিরলস প্রস্তুতি। তাই তো প্রস্তুতি স্বরূপ সে আগে ক্ষত শুকাবার চেষ্টায় আছে। ক্ষত শুকোলেই সত্যের মুখোমুখি হবে ভেতর থেকে টেনে বের করা সর্বোচ্চ সাহসটুকু নিয়ে। মুখ তুলে, চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করা যদি সে একবার শিখতে পারে তবে বাকিটুকু সহজ হয়ে যাবে অনায়াসে। যদি তাকে ঠকানোই হয়ে থাকে তবে তার প্রায়শ্চিত্ত করবার সুযোগ কি সে পাবে না? অবশ্যই পাবে। তনু তাকে সুযোগ দেবে। আর যদি সে ফিরে না আসে? তনুর পৃথিবীতে আবারও গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো। চাঁদের মিঠে আলো পৌছালো না সেখানে। যদি সে ফিরে না আসে তবে তনুর কিছু করার থাকবে না। তনুকে ভুলে যেতে হবে সমস্ত কিছু…। দুর্বিনীত পীড়নে একা এক নক্ষত্রের মতো সে আরো বহুদূর চলে যাবে এই মননে পারিপার্শ্বিক সবকিছু দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। গৌরবর্ণের, শান্ত চোখের লজ্জাবনত, আরক্তিম তনুখানি ভেসে এলো কল্পিত দৃশ্যপটে। তনুর ধারনা ছিল সে সামান্য হলেও চোখের ভাষা পড়তে জানে৷ ওই চোখে স্বল্প হলেও তার প্রতি মুগ্ধতা দেখেছিলো সে। তবে সবই কি ভুল ছিল? ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে তনু কল্পনা করে নিল ওই চোখদুটোতে বিমুগ্ধতা ছিল, খানিকটা মায়া আর আপন করে নেবার প্রয়াস ছিল? মন খারাপি চিন্তাগুলো এমন হুট করেই আসে। আর এসেই বিষিয়ে দিয়ে যায় মনটাকে। ভালোই তো চলছিল সব৷ আরাম করে বসে চন্দ্রবিলাসে মত্ত ছিল সে। কেন যে ওই লোকটার কথা ভাবতে গিয়েছিলো! ক্ষত শুকাবার আগ অবধি ওই লোকটাকে সে মনেই করতে চায় না। তার ঘৃণিত কাজের খেসারত সে নিজে দিবে। কেন তনু মিছে মিছে অনলে দগ্ধ হবে বারংবার ? না মোটেই ওই লোকটার কথা ভেবে সে তার মন খারাপ করবে না। দুনিয়াতে সে ছাড়াও তার অনেক প্রিয় মানুষ আছে৷ যারা সত্যিকার অর্থে তাকে মনে প্রাণে ভালোবাসে। তনু বরং তাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাকে নিজের করে নেবে। নিজেকে ভালো রাখার এই একটা উপায়ই তার জানা আছে। আর সেটাকেই সে সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে। আপাতত কয়েকদিন তাকে সব ভুলে যেতে হবে। ভুলে যাওয়াই সমীচীন।
” আপা! একা একা কি করিস? ”
ভাবনার অতল সমুদ্রে ডুবুরির দায়িত্ব পালনে রত ছিল তনু। আচম্বিতে বিনুর তারস্বরে বলা কথাটা মস্তিষ্কে জোর ধাক্কা দিল। কেঁপে উঠলো সে। সেই সাথে ভীষণ দুর্ভেদ্য একটা জেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ওর। কিন্তু বোনকে বকা দেবে এ ধরনের চিন্তা সে কখনোই করতে পারেনি। ওরই বা কি দোষ? বিনু হেলতে দুলতে এসে বসলো তনুর পাশের চেয়ারটায়।
” এভাবে কানের কাছে চেঁচানো ঠিক না, জানিস না? ”
বিনু চোখ পিটপিট করে বলল, ” Very sorry ”
” মাফ করে দিলাম যা ” একটা মহৎ কাজের পর সন্তুষ্ট ও প্রফুল্লে চিত্তে মানুষের মুখ যেমন করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তনুও তেমন একটা ভাব করলো। ফিক করে হেসে ফেলল বিনু। বলল,
” আপা মুখ গোমড়া থাকিস কিভাবে যখন তখন? আমার একটুও ভালো লাগে না ”
” সবাই তার মতো মন খারাপ নিয়ে হাসতে পারলে তো মুখ গোমড়া করে থাকতো না ”
” আয় চল সাজি। দেখবি মন খারাপ দুম করে উড়ে যাবে ”
” ঘুমের সময় মানুষ সাজে? ”
” ঘুমের আগেই তো সাজতে হয়। কেউ দেখবে না৷ লজ্জা পেয়ে কারো কাছ থেকে আড়াল হতে হবে না। মজার ব্যাপার কি জানিস? ও যখন বাড়ি থাকে না তখন আমার সাজগোজ দ্বিগুণ বেড়ে যায় ”
” তুমি বিরহে কাতর হও বলে সাজো তাহলে? ”
বিনু লজ্জা পেল। গালদুটো ঈষৎ আরক্তিম হলো।
” ধূর আয় তো। নতুন শাড়িগুলো পরে দেখি কেমন লাগে ”
তনু বাঁধা দিল না৷ বাঁধা দিলেও বিনু যা বলেছে তা করতোই। তার এই পাগলামি গুলোই মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে৷ এগুলো তার লোক দেখানো কলাকৌশল বা ছল নয়। তার ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যই এমন। আর এ কারণেই এই অল্প বয়সী মেয়েটা থেকে ব্যবসায়ের কাজে কিছুদিন দূরে থাকলেই বিনুর বরের কাছে পাগল পাগল লাগে। বাড়ি থেকে বের হলেই মনে হয় কি একটা যেন সঙ্গে নিতে ভুলে গেছে। বিনু এ ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ করে। তবে ভাব দেখায় জামাইয়ের এসব টান ফানে তার কিছুই যায় আসে না। অথচ মানুষটা দূরে গেলেই সাজগোজ করে কাঁদতে বসে যায় আয়েশ করে৷ বিনিদ্র রজনী ছটফট করে কাটিয়ে দেয়। এই যে এখানে এসে তার এত হৈচৈ তার মূল কারণ মানুষটার অনুপস্থিতির শূন্যতার হাত থেকে রেহাই পাওয়া। মানুষ যত বেশি একা থাকে, দুঃখ, শূন্যতা, বিষন্নতা তত বেশি আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাই শূন্যতাকে দূরে সরিয়ে রাখতেই এতো আয়োজিত কোলাহল।
ছোট ছোট ফুল আঁকা আসমানী আর জলপাই রঙের শাড়ি পরা দুটো পরি মাঝরাতে বারান্দায় আবছা আলোর নিচে চেয়ারে বসে আছে। পরি না হলেও বিনুর কাছে নিজেদেরকে পরির কাছাকাছি কিছু একটা মনে হচ্ছে। দুজনের সাজ একই ধাঁচের। একপাশে লম্বা বিনুনি, গাঢ় নেত্রপল্লবের নিচে অবস্থিত চোখদ্বয়ের কিনারায় কাজলের নিবিড় ছোঁয়া। দুই হাতে একগাছা সোনালী চুড়ি। আর কানে স্বর্ণের ঝুমকো। কারুকাজে ভিন্ন হলেও সাজের সরঞ্জামকে একই রকম বললে খুব একটা ভুল হয় না। বিনু ফিসফিস করে বলল,
” মন ভালো হয়েছে? ”
” হয়েছে ”
” মজার কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছে আপা ”
” এই মাঝরাতে মজার কি করা যাবে? ”
” চলো বকুল গাছের নিচে বসে টুপ টুপ করে জোছনা গিলে খাই ”
রিনরিনে হাসির কলতান উঠলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর সচকিত হয়ে অতি সাবধানতা অবলম্বন করতে হাসি থামাতে হলো । তনু বলল,
” মাঝরাতে মানুষের মাথায় ভূত ওঠে, কথাটা মিথ্যে না ”
” মাঝরাত লাগে না। আমার মাথায় যখন তখন ভূত ওঠে ”
আবার সমস্বরে হাসির কলতান বেজে উঠলো। যেমন হুট করে হাসির রিনিঝিনি বেজে উঠলো তেমনি ধপ করে নিরবতা নেমে এলো। পাশাপাশি বসে থেকেও বহুক্ষণ কথা হলো না দু’জনের মাঝে। দুই জোড়া চোখ স্থির হয়ে রইলো একফালি চাঁদকে লক্ষ করে। চাঁদের আলোয় আশেপাশের মেঘের দ্রত গতিতে এগিয়ে গিয়ে আবার অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে যাওয়াটা স্পষ্ট হলো। নিবিষ্টমনে ওরা চেয়ে চেয়ে দেখলো চাঁদ টাকে নিজের মতো একলা করে দিয়ে বিবর্ণ মেঘদলেরা দৌড়ে পালাচ্ছে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে। বৃষ্টি ভেজা জোছনা চুইয়ে পড়ে চাঁদ হতে ধরনীতলে। সে জোছনা ছুঁয়ে দেখার বড্ড স্বাদ জাগে ৷ মুঠো মুঠো জোছনা যদি বোতল বন্দি করা রাখা যেত। আর যখন আকাশে চাঁদ উঠতো না, জোছনা বিলাতো না — তখন বদ্ধঘরে সে জোছনা ছড়িয়ে দিয়ে জোছনা বিলাস করা যেত। পরিবেশ আর সময় মানুষকে নানা রকম উপমা জড়িত চিন্তায় বিভোর করে রাখে৷ তনু আর বিনু পাশাপাশি বসেও জোছনায় আলোকিত কল্পিত জগতে বিচরণ করতে গিয়ে একসময় দুটো ভিন্ন পথ মাড়িয়ে আলাদা আলাদা নগরীতে প্রবেশ করলো। আলো থেকে আরেকটু ভেতরে প্রবেশ করে আবছা, কুয়াশামাখা চিন্তা দ্বারা দুটো মানুষের ভাবনা আলাদা দুটো মানুষে স্থির হলো।
বিনু ভাবছিলো তার বরের কথা। মানুষটা কাছে থাকলে নিতান্ত অবহেলা দেখিয়ে কত সময় সে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। পাশে বসে, হাতে হাত রেখে রাজ্যের গল্প করতে না পেরে সে যখন উশখুশ করতে থাকে, বিনু তখন বড় মজা পায়৷ ভালোবাসার মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখে তার বিরহ, উদাস মনের আকুলিবিকুলি করা ভাব দেখে প্রচ্ছন্ন স্বস্তি হয়। মনে হয় থাক মানুষটা তো আমাকে নিয়েই ভাবছে। সেই সঙ্গে অদমনীয় আবেগ দেখে তার পৈশাচিক আনন্দ হয়৷ অথচ দূরে গেলেই মানুষটা যেন না থেকেও প্রতিশোধ নিতে থাকে অদৃশ্য বলে। তখন বিনু নিজের মনে আরও বেশি কষ্ট পায়। প্রতিবার সংকল্প করে, এবার থেকে সে আর অমন কাজ করবে না৷ ঠিক ঠিক মানুষটার খেয়াল মতো চলবে৷ তার অনুপস্থিতে সে যে সাজগোজ করে আয়োজন করে কাঁদতে বসে এ কথা প্রকাশ হলে কি লজ্জাটাই না পেতে হবে। ছিঃ ছিঃ! এমতাবস্থায় পড়লে আর কি কি হতে পারে সেটা কল্পনা করে আপনমনে লজ্জায় লাল হলো সে।
তনু তখন চলে আসার শেষ মুহূর্তটির কথা ভাবছিলো৷ চোখমুখে উদাসীনতা দেখিয়ে লোকটা কেমন করে দাঁড়িয়ে রইলো। পিছু ফিরে চাইবে না ভেবেও তনু নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। ট্রেনটা যখন গতি বাড়িয়ে দিচ্ছিলো তখন হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে দিয়েছিলো। সে মুহুর্তে মনে হয়েছিলো এই নিষ্ঠুরতম মানুষটিকে ভুলে যাওয়া তার পক্ষে কতটা কষ্ট হবে। তনুর কানে ট্রেনের সেই ঝিকঝিক শব্দ বাজতে লাগলো। দূরে…বহুদূর… কর্তামশাই নামক মানুষটা হারিয়ে যাচ্ছিলো। অভিমানে মন ভার হয়ে আসে তনুর। না এতটা দূর্বল হলে হবে না। ওই মানুষটা তো নিজের পথ বেছেই নিয়েছে৷ যদি তনুকে ফিরিয়ে নেবার ইচ্ছে হতো তবে অন্তত নিজের ভুল স্বীকার করে নিত। তা তো সে করেনি…
কোনো এক বৃষ্টি ভেজা রাতে
যখন ক্লান্ত দিন ঢোলে পড়ে নিঝুম রাত্রির কোলে,
আমি তোমায় খুঁজে ছিলাম।
তুমি আসোনি, ফিরে তাকাওনি
আজও বিদীর্ণ সংশয়ে কাটে প্রতিটি নির্ঘুম মুহূর্ত
সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাক— আকাশ হতে মর্ত,
আমি আর ফিরে তাকাব নাহ জেনে রেখো!
কুয়াশা ঘেরা নগরী থেকে বাস্তবে বেরিয়ে এলো তনু। চাঁদের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,
” আচ্ছা বিনু! ভালোবাসা জিনিসটা কেমন? ”
” ভালোবাসা? ভালোবাসা বড় অদ্ভুত জিনিস। কাছে থাকলে মূল্যহীন লাগে। আর দূরে গেলেই উপলব্ধি করা যায় সে কত অমূল্য ” ঘোরের মধ্যেই উত্তর করলো বিনু। এখনো সে নিজের ভাবনাতে ডুবে আছে। আর সে ভাবনার রেশ থেকেই ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়েছে।
বিনুর কথাটা ভাবিয়ে তুলল তনুকে। তাহলে এই যে তনু এতো দূরে তাকে একা ফেলে চলে এলো। সে কি ওকে অনুভব করে? বুঝতে পারে, কি সে হারিয়েছে? তনুর মতো তারও কি শূন্য শূন্য লাগে? মনের মাঝে ভীষণ ফাঁকা লাগে? তনু মনের আয়নায় দেখতে পেল কর্তা মশাই বড্ড মন খারাপ করে একা একা বসে আছে জানালার ধারের চেয়ারটায়। তনু যেন নতুন করে এই একমাসে বহুবার নিজেকে বহুভাবে আবিষ্কার করলো। নির্দিষ্ট কারো জন্য এত মন খারাপ তার আর কখনো হয়নি। আবার মিশ্র অনুভূতির সম্মুখীন হলো এই প্রথম। কিছুক্ষণ আগে রাগ করা মানুষটার মন খারাপ করা চেহারা কল্পনা করে তার মন খারাপ উবে গেল। সে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে। বিনুর দিকে ফিরে বলল,
” চল ঘুমাতে যাই ”
চলবে ইন শা আল্লাহ…