এমন দিনে তারে বলা যায় পর্ব-১০

0
186

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ১০
সানজিদা মাহি
_______________________________

তনুকে একা বাড়ি ফিরতে দেখে মা রীতিমতো অবাক হলেন। বিয়ের পর মেয়ে প্রথমবার বাড়ি এলো অথচ জামাই সঙ্গে এলো না। এ কেমন কথা? এতো ব্যস্ততা থাকলে জানিয়ে দিতে পারতো। না হয় তনুসহ আর কয়টা দিন পরেই আসতো৷ ফরিদা শুধু জিজ্ঞেস করলেন জামাই এলো না যে? তনু বলল,
” উনি এখন আসতে পারছেন না। কাজে ব্যস্ত। কয়েকদিন পর আসবে বলেছে। অনেকদিন পর আপনাদেরকে দেখিনি। তাই চলে এলাম ”
ফরিদা এরপর আর কিছুই জিজ্ঞেস করেননি। কিন্তু স্বামীকে কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আচ্ছা, দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়নি তো? কিন্তু তনুকে দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷ এসেই গেল গোসল করতে। ফরিদার হঠাৎ রান্নার কথা মনে পড়লো। ভালো কিছু রান্না হয়নি আজ৷ তিনি গেলেন চিংড়ি মাছ ভুনা করতে৷ তনুর প্রিয় মাছ।

গোসল করে মনটা অনেকটা ঝরঝরে হয়ে গেল তনুর। ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছে নিল। তার কোঁকড়ানো, কালো চুলগুলো বিছিয়ে রইলো পিঠ জুড়ে। স্যুটকেস থেকে জামা কাপড় নামিয়ে আলনায় গুছিয়ে রাখলো। বইগুলো তুলে রাখলো টেবিলের ওপর। এরপর স্যুটকেসটাকে জায়গা মতো রেখে বিছানায় বসলো। একমাস আগে যেমন করে ঘরটা রেখে গিয়েছিল এখনো তেমনি আছে৷ শুধু মা এসে ঝাড়ু দিয়ে যেতেন সেটা বোঝা যায়। তনুর মনে পড়লো বিয়ের দিনের কথা। অনাড়ম্বরভাবে অল্প কয়জন মানুষ নিয়ে বিয়ে হয়েছিল তার। বিয়ের পর বিনু বারবার বলছিলো, ” আপা তোরও বিয়ে হয়ে গেল অবশেষে! ইশ কি মজা হবে! ” কথাগুলো সে এমনভাবে বলছিলো যেন তার এখনো বিয়ে হয়নি। তনু তখন বোঝার চেষ্টা করছিলো তার অনুভূতি বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা কতটুকু বদলেছে। অনুভূতি আগের মতোই ছিল। কিন্তু আশেপাশের সবার আনন্দ, হাসিমাখা মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ওর বিয়ে হয়ে গেছে এ কথা মিথ্যে না। আর বিয়ের রাতে বরকে দেখে মনে মনে আওড়াচ্ছিল এ তার স্বামী? এখন থেকে সে বিবাহিত? কি আশ্চর্য! তনুর হঠাৎ ভয় লাগা শুরু হলো। এ অচেনা, অজানা লোকটা এখন কি আচরণ করে বসবে তা ভাবতেই ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মনে মনে বারংবার আল্লাহকে ডাকছিলো। বুঝতে পারছিল শঙ্কা, উৎকন্ঠায় গলা শুকিয়ে আসছে তার। কিন্তু তেমন কিছু ঘটলো না৷ লোকটা শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লো। আসলেই কি ঘুমিয়ে পড়লো? তনু বুঝতে পারছিল অদূরে শুয়ে থাকা লোকটা যে কিনা তার স্বামী, সে আসলে ঘুমের ভান ধরে শুয়ে আছে। স্বস্তি পেল তনু৷ যাই হোক এটাই ভালো। সেও শুয়ে শুয়ে নানান কথা ভাবতে গিয়ে একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

বিয়ের রাতের সেই তনু আর আজকের দিনের তনু কত আলাদা। স্বামী নামক মানুষটা থেকে যে পালিয়ে বাঁচতে পারলে স্বস্তি পেত, সেই মানুষটাই স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্ত আঘাতে ভঙ্গুর হৃদয় নিয়ে একা একা ফিরে এলো ময়মনসিংহ থেকে এতদূর। সারা ট্রেনে তনু শুধু ভেবেই গেল। কি থেকে কি হয়ে গেল। আচমকা ঝড়ের প্রলয় তান্ডবে ভেঙে গেল সাজানো একটা বাগান। যে বাগানটা তনু নিজ হাতে অতি যত্নে গড়েছিল। ছোট্ট একটা পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা তনুর জগতে একটা নতুন মানুষের আগমন ঘটলো। সে মানুষটা প্রথমে দূরবর্তী তারার মতো এক চিলতে আলোয় জ্বলজ্বল করতো। তারপর ধীরলয়ে একটু একটু করে গভীরভাবে জুড়ে বসলো তনুর জগতের সমগ্র স্থান। মায়া যত গাঢ় হয় আঘাতের গুণ তত বৃহৎ হয়৷ একই কথা দুটো মানুষের কাছ থেকে শুনলে আমাদের প্রতিক্রিয়া একরকম হয় না। যার প্রাধান্য কম তার সূচালো, তীক্ষ, কাটার মতো আঘাতও আমাদের গায়ে লাগে না। অথচ কাছের মানুষের কাছ থেকে এরচেয়ে কম আঘাত পেলেও তা থেকে তৈরি ক্ষত হয় অনেকটুকু পুরু। আবার সহসা সে ক্ষতে প্রলেপও পড়তে চায় না। তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো। বিছানার চাদর, বালিশের কাভারের ওপর হাতের কাজ করা। এমনকি নকশিকাঁথাটাও তনু নিজ হাতে করেছে। তনু ঘ্রাণ শুঁকলো বাতাসে। আহা সেই পুরনো ঘ্রাণটা এখনো পাওয়া যাচ্ছে। যে ঘ্রাণ শুধু একা তনুই পায়৷ এই ঘ্রাণ তনুর কানে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, “এই যে তোমার ঘর। এখনো তোমারই আছে! ” তনু নস্টালজিক হয়ে পড়ে মুহূর্তেই। এই ঘরটা তার ছোট্ট রাজত্ব। ঘরের প্রত্যেকটা জিনিসে রয়েছে তার নিজের হাতের ছোঁয়া। প্রত্যেকটা জিনিসই তার বড় আপন। এমনকি জানালার কার্নিশে যে ভাঙা মগটা পড়ে আছে ধূলোয় মাখামাখি হয়ে, সেই মগটাও তনুর বড় আপন। ধীরে ধীরে তনুর মনের মেঘ কেটে যেতে লাগলো। সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিল। ফরিদা চুলায় পেঁয়াজ বেশি দিয়ে চিংড়ি বসিয়েছেন। তনু পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
” কি করছেন মা? ”
” তোমার জন্য চিংড়ি ভুনা করছি ”
চুলার পাশে বাটিতে বিলেতি ধনেপাতা রাখা। তনু বাটি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” এগুলো দিবেন চিংড়িতে? কেটে ফেলি তাহলে? ”
উত্তরের অপেক্ষা না করে তনু ধনেপাতা কাটতে বসে গেল। ফরিদা ভালো করে দেখতে লাগলেন মেয়েকে। কোথাও কোনো ত্রুটি বা “কিন্তু ” আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলেন৷ তনু দেখতে আগের মতোই রয়ে গেছে৷ তবে মুখটা যেন আগের চেয়ে শুকনা লাগছে। আরও ভালো করে দেখে ফরিদার মনে হলো, মোটা তো হয়নি আরো বরং চিকন হয়ে ফিরলো মেয়েটা৷ বিয়ের পর মেয়েদের মধ্যে একটা অন্যরকম পরিবর্তন দেখা যায়। চোখমুখে সলজ্জ ভাব বিরাজ করে সর্বদা। তনুকে দেখে তেমন কিছুই লাগছে না৷ ফরিদার মুখ গম্ভীর হয়ে এলো। এতদূরে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে ঠিক করেছেন তো? ও কি সেখানে ভালো ছিল আদৌও?

তনু কাটা ধনেপাতা গুলো নিজের হাতে মাছের উপর ছড়িয়ে দিল। ফরিদা মাছগুলো নেড়েচেড়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর তনু ঘ্রাণ শুঁকে বলল, ” অনেক সুন্দর ঘ্রাণ বেরিয়েছে মা! ”
ফরিদা হাসলেন৷ মেয়েটা স্বল্পভাষী। নিজের কষ্ট সবসময় নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখে৷ কিন্তু কাউকে সেটা বুঝতে দেয় না৷ সুযোগ পেলেই অন্যকে খুশি করার চেষ্টা করে।
ফরিদা চুলা থেকে মাছ উঠিয়ে রাখলেন।
” তুমি নামাজ পড়ে ফেলো। আমিও গোসলটা সেরে ফেলি৷ ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিও ”
” না আপনাদের সঙ্গে খাব৷ তনয় কখন আসবে? ”
” চলে আসবে দুইটার পর ”
” আর বাবা? ”
” উনি আসতে আসতে চারটা তো বাজবেই৷ আর বিনয় কখন আসে বলতে পারি না ”
” ভাইয়াটার এখনো কোনোকিছু ঠিক হলো না৷ কবে যে একটু গোছালো হবে! ” বিজ্ঞের মতো অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে কথাটা বলল তনু৷ সেটা দেখে ফরিদা হেসে ফেললেন।
” আচ্ছা আমি যাই গোসলে ”
” ঠিক আছে ”

নামাজ শেষ করে তনু কিছুক্ষণ এ ঘর, ও ঘর ঘুরে বেড়ালো। ফরিদা নামাজ পড়ে টেবিলে খাবার বারতে লাগলেন৷ ফরিদা আর নুরুল সাহেবের ঘরটা অন্য ঘরগুলোর চেয়ে অনেকটা বড়। এ ঘরের একপাশে ডাইনিং টেবিল বসানো হয়েছে। খাবার সময় এ ঘরেই খাওয়া হয়। এ ঘরের পাশেই রান্নাঘর। ওদের খেতে বসার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো৷ তনু দৌড়ে গেল দরজা খুলতে। তনুকে দেখে তনয় একই সঙ্গে অবাক এবং খুশি হলো।
” আপা তুমি কখন এলে? ”
” কয়েক ঘন্টা হয়েছে মাত্র। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে, হাত-মুখ ধুয়ে আয়। তুই এলে একসঙ্গে খাব ”

তিনজনে একসাথে খেতে বসে টুকটাক গল্প করতে লাগলো। তনু ভাবার চেষ্টা করলো সবকিছু আগের মতোই আছে। তার কখনো বিয়ে হয়নি। সে কখনো অচিন্তপুর যায়নি। এমনকি কর্তামশাই বলেও কেউ নেই। মাহমুদ সম্পর্কিত যাবতীয় ভাবনা থেকে সে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু হঠাৎ ফরিদা বলে বসলেন,
” এরমাঝে একদিন তোমার শ্বশুরবাড়ি থেকে চিঠি এলো ”
তনুর মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
” কি বলল চিঠিতে? ”
” তেমন কিছু না। এই আমরা কেমন আছি, ওদের কি অবস্থা.. এই আরকি। তোমাকে ওরা চিঠি দিত না? ”
তনু মনে করার চেষ্টা করলো শ্বশুরবাড়ি থেকে কোনো চিঠি এসেছিল কিনা। কিন্তু মনে করতে পারলো না৷ এ বাড়িতে চিঠি দিয়ে থাকলে ওখানে তো আলবৎ দেয়ার কথা৷ তাহলে কি চিঠিগুলো কর্তামশাই একাই পড়তেন? ওরা নিশ্চয়ই তনুর খোঁজ খবরও নিতেন। অথচ…অথচ কর্তামশাই ওকে কিনা একবারও এ সম্পর্কে তাকে কিছু বলেনি! তনুর মনটা আবারও বিষিয়ে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে। হঠাৎ টের পেল মা আর তনয়ের মধ্যে অন্যকিছু নিয়ে কথা হচ্ছে। তনয় হঠাৎ বোনের দিকে ফিরলো,
” ঠিক বলেছি না আপা? ”
তনু বুঝতে পারলো না কিছু। আমতা আমতা করে বলল,
” কি ঠিক..? ”
” স্কুলের ব্যাপারটা ”
” কোন স্কুলের ব্যাপারটা? ”
” আরে শুনোনি এতক্ষণ তুমি? আচ্ছা বাদ দেও। আজকে একটা মজার ব্যাপার হয়েছে, সেটা শুনো। হাবিব নামে আমার এক দুষ্ট বন্ধু আছে না? তোমাকে বলেছিলাম ওর কথা আগে। ও কি করেছে আজ জানো? স্যারের চেয়ারে একটা কাগজ দিয়ে ওটার উপর চুইংগাম লেপ্টে দিয়েছে। বাংলা ঘন্টার আগে এ কাজ করেছে ও। তারপর বাংলা ক্লাসের ঘন্টা দেয়ায় স্যার ক্লাসে এসে চেয়ারে কাগজ দেখে ভেবেছেন চেয়ারে ময়লা দেখে কাগজ রাখা হয়েছে। তো উনি চেয়ারে বসলেন। আমাদেরকে অনুচ্ছেদ মুখস্থ করে লিখতে বললেন। ক্লাস ঠিকঠাক মতোই হলো কিন্তু ঘন্টা শেষ হওয়ার পর স্যার যখন চেয়ার থেকে উঠলেন তখন তো কাগজটা একদম স্যারের প্যান্টের সাথে লেগে রইলো। ক্লাসের সব ছেলেরা এটা দেখে হাসতে হাসতে শেষ “, বলেই তনয় জোরে জোরে হাসতে লাগলো৷
তনু গম্ভীর গলায় বলল, ” কাজটা ঠিক করিসনি ”
ফরিদাও সায় দিয়ে বললেন, ” হ্যা তনয় এগুলো ঠিক না। আর কখনো এমন করবে না ”
” আমি করিনি তো! হাবিব করেছে ”
” এই যে তুই ওর নামে এটা আমাদের কাছে বলেছিস এটাও ঠিক হয়নি ”
বোনের কথা শুনে তনয় চুপসে গেল। ওর কি দোষ? ও তো শুধু ঘটনাটাই বলল। অবশ্য আপু সবসময় বলে অন্যের দোষ গুলো বলে বেড়ানো ঠিক না। যে অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ তা’আলাও তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখেন।

নুরুল সাহেব এলেন সাড়ে চারটার দিকে। এবারও তনু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। হাসিমুখে বাবাকে অভ্যর্থনা জানালো৷
” আসসালামু আলাইকুম বাবা! কেমন আছো? ”
” আরে তনু যে! ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কখন এলি? ”
” দুপুরের ট্রেনে ”
তনু ভেবেছিলো বাবা এবার মাহমুদের কথা জিজ্ঞেস করবে কিন্তু নুরুল সাহেব কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। তনু বাবাকে হাত-মুখ ধুয়ে আসতে বলে টেবিলে খাবার বেরে নিল। তারপর সামনে বসে বাবার খাবার তত্ত্বাবধান করতে লাগলো। খাবার টেবিলে নুরুল সাহেব মেয়ের জামাইর কথা জিজ্ঞেস করলেন। তনু মাকে যা বলেছে বাবাকেও একই কথা বলল। নুরুল সাহেব বললেন,
” সরকারি চাকরি এমন এক জিনিস। চাইলে কি আর ছুটি পাওয়া যায়? তা ওর অসুবিধা হবে না তো? একা একা কি খাবে টাবে..”
” কেন আগে যেন না খেয়ে থাকতো! আগে যেভাবে খেত এখনো সেভাবেই খাবে। উনার সহকারী একটা ছেলে আছে৷ নজু নাম। ওর মা-ই মনে হয় রান্না করে পাঠাবে ”
” একা থাকার কষ্ট আছে। সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো খাওয়ার কষ্ট। একবার আমার পোস্টিং হলো খুলনায়৷ তোর মা তখন গ্রামে। বিনয় তখন খুব ছোট। ওখানে একা একা থাকতে হলো পাক্কা দুই বছর। এই দুই বছরে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি খাবার নিয়ে। নিজে নিজে রান্না করে খাওয়া তারপর আবার অফিস করা। কার ভাল্লাগে এসব? ”
তনু বুঝতে পারলো বাবা ওর নিজের মায়ের কথা বলছে। তাছাড়া বাবার খুলনায় পোস্টিং হওয়া নিয়ে সে আরও অনেক গল্প শুনেছে। বাবার খাওয়া হয়ে গেলে তনু দুই কাপ চা বানিয়ে এক কাপ বাবাকে দিল আর এক কাপ নিজে নিল। নুরুল সাহেব চা পেয়ে খুশি হলেন।
” যাক তুই আসায় অনেক ভালো হয়েছে। তোর মা তো দুপুরে খাওয়ার পর আর চা বানিয়ে দিতে চায় না। বলে, ভাত খাওয়ার পর আবার কিসের চা? ”
তনু মৃদু হাসলো। বাবার সাথে গল্প করতে তার ভালো লাগছে। পাথর চাপা হৃদয়ের ভার অনেকখানি কমেছে। সে নিজেকে অন্যদের সাথে গল্পের ছলে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলো। যাতে ফেলে আসা আঘাত, অসহনীয় কষ্ট আর বিষাদ ভরা মন খারাপেরা আবার হুট করে জাগ্রত না হয়ে ওঠে। আসরের নামাজের পর সে বাইরে হেঁটে বেড়ালো সন্ধ্যার আগ অবধি। ফরিদা দেয়ালের সাথে লাগিয়ে ইট দিয়ে ঘেরা মাটির ঢিবির মধ্যে বিলেতি ধনেপাতা, বেগুন গাছসহ আরও কিছু গাছ লাগিয়েছেন। বৃষ্টির কারণে গাছগুলো উদ্দীপনা নিয়ে সতেজতা ছড়িয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে যেন। মরিচা ধরা স্টিলের গেটের পাশে একটা বকুল গাছ দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের নিচে সিমেন্ট দিয়ে বসবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তনু সেখানে বসলো। সারাদিন বৃষ্টি হয়নি। তবে আকাশ সকাল থেকেই মেঘলা হয়ে রয়েছে। রোদও ওঠেনি আজ। মাগরিবের আজান পড়তেই সে ঘরে চলে এলো। বিনয় এলো সন্ধ্যার পর। এবারও তনুই দরজা খুলে দিল। আজকে সে সবাইকে দরজা থেকে স্বাগতম জানাচ্ছে। বিনয় ওকে দেখে বলল, ” কিরে কি অবস্থা? ” যেন তনুকে সে প্রতিদিনই দেখছে। তনু যে অনেকদিন পর বাড়ি এলো সেটা ওর ব্যবহারে মনে হলো না। তনু জানে তার বড় ভাইটা এমনই। সে বিনয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
” দুপুরে এলে না যে। ভাত খেয়েছো? ”
” হ্যা খেয়েছি ”
” চা করে দেব? ”
” মন চাইলে দে এক কাপ ”

তনু চা বানিয়ে বিনয়ের ঘরে গেল। বিনয় দুই হাত টেবিলে মেলে দিয়ে বই সামনে নিয়ে বিড়বিড় করে পড়ছে। তনু চায়ের কাপ টেবিলে রেখে খাটে বসলো। এখানে তনয় আর বিনয় থাকে। দুইটা সিঙ্গেল খাট দুই ভাইয়ের জন্য পাশাপাশি বিছানো হয়েছে। একপাশে বিনয়ের বইয়ের স্তূপ। সেখানে শুধু চাকরি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের না বাংলা, ইংরেজি সাহিত্যের অনেক বই আছে৷ তনু মোটেই পড়তে ভালোবাসতো না। একদিন ভাইয়ের কাছ থেকে একটা বই নিয়ে পড়লো। পড়ে ভালো লাগায় আরেকটা নিয়ে পড়লো। এভাবেই তার বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। বিনয় চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখলো। তনুর দিকে না ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
” বিয়ে করে কেমন লাগছে? রিভিউ দে ”
তনু ভ্রু কুঁচকালো। না, একটুও বদলায়নি তার ভাইটা। সদ্য বিবাহিত মেয়ের সাথে যে এমন রসিকতা করা অনুচিত এ ব্যাপারটাই তার জানা নেই।
” কি হলো বলিস না? ”
” কেন তুমি বিয়ে করবে? ”
” বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়ে তো করতেই হয়..”
” বেকার ছেলেদের মেয়েরা বিয়ে করে না ”
তনু উঠে পড়লো। এখানে বসে থাকলে আরো কিসব শুনতে হয় কে জানে!

রাতে খাওয়ার পর নিজের ঘরে আসতেই সেই একাকী, অসহায় ভাবটা তনুকে ঝাপটে ধরলো রীতিমতো তার রাক্ষুসে রূপ নিয়ে। চোখে ভাসতে লাগলো গতকালের রেল স্টেশনের ঘটনাটা। কানে বারি খেতে লাগলো মাহমুদ আর শান্তার কথোপকথন। ওই কথাগুলো ছুরির মতো একের পর এক আঘাত করে ক্ষত বিক্ষত করে দিতে চাইলে ওকে পুরোদস্তুর। তনু বালিশ মুখে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। এই এতটা কষ্ট ও আর নিতে পারছে না। ইচ্ছে করছিলো কাউকে গিয়ে বলে, সে মোটেই ভালো নেই৷ সারাদিনের হাসিমাখা চেহারার আড়ালে ওর দুঃখী মুখটাকে প্রকাশ করে দিতে পারলেই যেন কষ্টটুকু কমতো। কোন ঘটনা মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়.. জীবনের মোড়কে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেয় তা কে বলতে পারে? নোনাজল শুকিয়ে লেপ্টে রইলো ওর পেলব, আরক্তিম গালে। রাত বাড়লো। রাতকে পরোয়া না করে বালিশ জড়িয়ে কান্নাকে থামিয়ে একদা নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লো ভীষণ দুঃখী মেয়েটি….

সকাল বেলায় সবাই নাস্তার টেবিলে বসেছে নাস্তা করতে। এসময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। বাসার সবাই এখানেই আছে। তাই কোনো বাইরের লোক এলো কিনা তনু বুঝতে পারছে না। যখন দেখলো কারো মাঝে দরজা খোলার তাড়া নেই তখন সংকোচ নিয়ে সে-ই গেল দরজা খুলে দেবার জন্য। দরজা খুলতেই কেউ একজন আচম্বিতে দুই হাতে শক্ত করে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তনুর শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো প্রায়।

চলবে ইন শা আল্লাহ…