এলোমেলো হাওয়া পর্ব – ০৯

0
301

#এলোমেলো হাওয়া
#পর্ব-৯
#লেখনীতে- অলিন্দ্রিয়ারুহি

আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। মিঠা রোদে ঝলমলে প্রকৃতি। বাতাসের বুক চিঁড়ে শাঁই শাঁই করে এগিয়ে চলছে বাস। তীহা-আদ্র মাঝের দিকে বসেছে। তীহার দৃষ্টি খোলা জানালার বাহিরে। আর আদ্র’র দৃষ্টি তীহাতে নিবদ্ধ। তারা যাচ্ছে ঢাকার বাইরে,সিরাজগঞ্জে। সেখানে আদ্র’র ফুপুর বাসা রয়েছে। সেখানে কয়েকদিন থেকে সেইন্ট মার্টিন অথবা কক্সবাজার যাত্রার পরিকল্পনা আদ্র’র। তীহা অবশ্য এতসব পরিকল্পনার কথা জানে না। সে শুধু ফুপু শ্বাশুড়ির বাড়ি প্রথমবার যাচ্ছে, এই ভেবে ভেবে হাতুর তালু ঘামাচ্ছে। কিছুটা অপ্রস্তুত ভাব,কিছু অস্বস্তি,আবার প্রথমবারের মতো বাবা-মায়ের পর অন্য একজনের সাথে ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়ার অনুভূতি- সব মিলিয়ে কেমন দোনোমোনো অনুভূত হচ্ছে বারংবার। পথে যেতে যেতে গ্রাম বাংলার নানান রূপ চোখে পড়ছে। কখনো বা টিনের চালের বাড়ি,মাটির বাড়ি,আবার মাইলের পর মাইল শুধুই ক্ষেত! মাঝারি সাইজের ধান গাছ রয়েছে সেই ক্ষেত গুলোতে। ধান চাষের সময়,সব ক্ষেতেই ধান চাষ হচ্ছে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, একটা সবুজ কার্পেট মোড়ানো রাস্তা! কী অপূর্ব দেখাচ্ছে! দূরে দূরে দু-একজন মানুষও দেখা যায়। তারা মাথা নুঁইয়ে কাজে ব্যস্ত,কেউবা খাঁকে পানির কলস নিয়ে গন্তব্যের পথ ধরেছে। বাচ্চারা হাত ধরাধরি করে খেলছে কোথাও কোথাও, আবার কিছুদূর যেতেই গ্রামীন বাজার চোখে পড়ছে। একেক সময় একেক দৃশ্য, কিছুই থেমে নেই। তীহা মুগ্ধ নয়নে চোখ সরিয়ে নিলো। আদ্র’র দিকে তাকাতেই আদ্র থতমত খেলো। তীহাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আদ্র তার দিকেই নেত্রজোড়া বিদ্ধ করে রেখেছে। তাই দ্রুততার সঙ্গে চোখজোড়া সরিয়ে নিলো। তীহা ডাকলো,

“শুনছেন?”

আদ্র এবার তাকিয়ে জবাব দিলো,

“হ্যাঁ,বলো।”

“আমরা যেখানে যাচ্ছি,সেখানে অনেক সুন্দর জায়গা,তাই না?”

“বলতে পারলাম না। আমি এর আগে কখনো যাইনি।”

“কেন?”

“আমার এই ফুপু ঢাকাতেই থাকতেন। বছর দুয়েক আগে সপরিবারে গ্রামে চলে যান। ওটা উনার হাজবেন্ডের বাড়ি।”

“ওহ। তাহলে আপনিও প্রথমবার যাচ্ছেন।”

“হুম, প্রথমবার, বউ সমেত!”

কথাটা এমনভাবে বলল আদ্র, তীহার কেমন যেন লাগল বুকের ভেতর। যতবার আদ্র তাকে বউ বলে আখ্যায়িত করে, ততবার এরকম হয়। কেন হয়,কে জানে! তীহা চুপটি করে পুনরায় বাইরে তাকাল। জানলায় মাথা রেখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় চোখজোড়া মুদে ফেলল। কিছুসময় পর আদ্রর ডাকাডাকিতে তীহা চোখ মেলে তাকাল। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইলো,

“কী?”

আদ্র অবাক হয়ে বলল,

“এই না জাগনা ছিলে! ওমনি ঘুমিয়ে গেলে?”

তীহা লজ্জিত গলায় জবাব দিলো,

“ঘুম পেয়ে গেছিল,সরি।”

“সরির কী আছে এতে? আচ্ছা ঘুমাও তবে।”

“আগে বলুন, ডাকলেন কেন?”

“না মানে,সামনেই যমুনা সেতু। তুমি এর আগে দেখোনি বোধহয়। তাই ডাকলাম।”

মুহূর্তেই তীহার চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেল। আগ্রহী কণ্ঠস্বরে মাথাটা এদিক ওদিক করে সে খুঁজতে লাগল কোথায় সেতু। আদ্র সহাস্যে বলল,

“দু মিনিট,সেতুর একদম কাছেই আমরা।”

তীহা কপালে হালকা ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করে,

“আপনি কী করে জানলেন আমি এর আগে যমুনা সেতু দেখিনি?”

“কারণ এই রাস্তায় এর আগে এলে অবশ্যই এত এক্সাইটেড থাকতে না। সবকিছুই তোমার চোখে নতুন যেহেতু,তাই বুঝেছি তুমি এর আগে আসোনি এখানে।”

তীহা প্রত্যুত্তর করবার সময়ই বাস থামলো। তীহা মুখ বাড়িয়ে দেখল, একটা বক্সের ভেতর একজন লোক বসে রয়েছে কম্পিউটারের সামনে। বাসের হেল্পার তাকে কিছু টাকা দিলে বাস আবার সামনে এগিয়ে সেতুতে উঠতে লাগল ধীরে ধীরে। তীহা অবাক নয়নে দেখতে লাগল। যেকোনো কিছুতেই প্রথমবারের অনুভূতিই অন্যরকম! নিচে সচ্ছ টলমলে পানি, দূরে দূরে ফেরী চলাচল করছে। ইঞ্জিন বাহী ফেরী, বালি তোলার ট্রলার থেকে শুরু করে ছোট ডিঙি নৌকো,সবকিছুই আছে। মাঝে মাঝে ভেসে উঠেছে চড়,যা প্রায় ডুবু ডুবু এখন। আদ্র বলল,

“এখন জোয়ারের সময়। সামনেই বর্ষাকাল আসছে। ধান তোলা শেষ হতে হতেই সমস্ত ক্ষেত ভরে যাবে পানিতে। তখন এই নদী দেখতে আরও সুন্দর লাগে। পানিতে থৈথৈ করে একদম। আর যখন রোদের আলো পড়ে,চিকচিক করে। খুব সুন্দর লাগে দেখতে।”

“আপনি তো এর আগে ফুপুর বাড়ি যাননি, তবুও সেতুতে উঠেছেন?”

“হুম। তাও বেশ কয়েকবার,রাজশাহী গিয়েছিলাম বহু আগে বিভিন্ন কাজে। তখন আসা যাওয়ায় অনেকবারই সেতুতে ওঠা হয়েছে বিভিন্ন সময়। সবচেয়ে কম পানি থাকে শীতের সময়। পানি শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে যায়।”

“এই টুকুন? উপর থেকে দেখছি দেখেই এইটুকুন লাগছে। ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেই,দেখুন কত পানি।”

আদ্র হাসতে লাগল।

“তাই? থাক,তোমাকে কষ্ট করে ফেলতে হবে না। আর পানি মাপার অনেক যন্ত্র আছে। আমার মতো একটা আদ্রের কোনো প্রয়োজন নেই যেচে পড়ে পানি মাপতে যাওয়ার।”

তীহাও হাসতে লাগল। লোকটার সঙ্গে কথায় পারা যায় না। তীহা ঠোঁটে হাসি নিয়েই আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কিছু সময় পরই সেতু থেকে নেমে গেল ওরা। তীহা বলল,

“এবার একটু ঘুমিয়ে নেই।”

আদ্র বলল,

“এই না,আমরা প্রায় চলে এসেছি। একটু পরেই কড্ডার স্টপেজ। সেখানেই নামতে হবে আমাদের।”

“এত কাছে সিরাজগঞ্জ!”

“জি ম্যাডাম। ওখান থেকে টমটমে করে নিয়ে যাব আপনাকে।”

তীহা ভ্রু কুঁচকে বলল,

“টমটম আবার কী?”

“একধরনের যানবাহন। দেখলেই বুঝবেন।”

তীহা মৃদু শ্বাস ফেলে নেকাব মুখে তুলল। হাতের ফোন ব্যাগের ভেতর রেখে নেমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বসল।

____

তীহার লজ্জা করছে ভীষণ। কতক্ষণ যাবত তার চোয়াল ধরে দেখে চলেছে মহিলাটি। যেন এত সুন্দর কাউকে সে আর আগে কখনো দেখেনি! এই মহিলাটিই আদ্র’র ফুপু। যে ভয় আর অস্বস্তি তীহাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছিল,সেটা এখন নেই৷ তার জায়গায় একদল লজ্জা এবং শরম আশ্রয় নিয়েছে। তীহাকে দেখার পর থেকে বারবার বলে চলেছে, সে সুন্দর, অপূর্ব সুন্দর। এরকম সুন্দর কেউ আদ্র’র বউ হবে তা ভাবতেই পারেননি তিনি। শুনে তীহার লজ্জা আর আদ্র’র গর্বিত ভাব- যেন আদ্রই তীহাকে খুঁজে নিয়ে এসেছে!

“কাপড়চোপড় পাল্টাইয়া খাওয়া নাও তোমরা। আমি খাবার দেই।”

আদ্র’র ফুপু তারা বানু বললেন। আদ্র বলল,

“এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই ফুপি। আমরা ধীরেসুস্থে খেয়ে নিবো।”

“সে কী! এত সুন্দর বউ! ও কী না খাইয়া থাকবো নাকী এতক্ষণ? তুই কথা না বাড়াইয়া জলদি হাতমুখ ধুঁইয়া আয়। আমি ভাত দেই।”

অগত্যা আদ্রকে হাত-পা ধুতে যেতে হলো। তীহাও হাত-পা ধুতে গিয়ে আরেকটি নতুন জিনিস উপভোগ করল, আর সেটি হলো- চাপকল। এর আগে কখনোই এই জিনিসের মুখোমুখি হয়নি তীহা। ছোট ছোট বাচ্চারা কী সুন্দর চাপ দেয়, আর কলকল করে পানি নামে। তীহাও আগ্রহ করে চাপ দিতে গিয়ে হাতেই ব্যথা পেয়ে বসল। এত শক্ত! ওরা চাপে কীভাবে! তীহা দু-হাত এক করে চাপলো। পানি বেরোলো,তবে কলকল করে নয়,একটুখানি! তাই দেখে আদ্র হেসে কুটিকুটি। তীহা গাল ফুলালো। লোকটা তো ভীষণ খারাপ। মানুষের ব্যর্থতায় সুখ খুঁজে বেড়ায়। অবশ্য এই মন খারাপ ভাবটা খুব বেশিক্ষণ থাকল না, যখন ফুপু বকা দিয়ে দিলেন আদ্রকে ইচ্ছেমতো। কোন সাহসে আদ্র নতুন বউকে দিয়ে চাপকল থেকে পানি তোলায়,তা নিয়ে খুব হম্বিতম্বি করলেন তিনি। আদ্র বেচারা কাইকুই করে নিজের সাফাই গাইতে গিয়েও বিশেষ সুবিধে করতে পারল না। শেষতক চুপ হয়ে রইলো। আর আঁড়চোখে তীহাকে বারবার ইশারা দিয়ে বোঝালো, এর শোধ সে পরে তুলবে। ওদিকে তীহা বাহির থেকে ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে রইলেও ভেতরে ভেতরে পৈশাচিক আনন্দ পেল।

(চলবে)