ওয়ান ফোর থ্রি পর্ব-৫৬ এবং শেষ পর্ব

0
868

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
অন্তিম পর্ব.

ইরফান খুব দ্রুত ড্রাইভ করতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না। তাঁর হাতের শিরা কাঁপছে। এই মাত্র তমালিকার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় তমা বাড়িতেই আছে৷ ব্যাপারটা ইরফানের বিশ্বাস হচ্ছে না। যতক্ষণ তিনি নিজে বাড়ি গিয়ে মেয়েকে স্বচক্ষে না দেখবেন ততক্ষণ মন শান্ত হবে না৷ মুক্ত সড়কের মাঝখানে একটা বড় গাড়ি থেমে আছে। ইরফানের হৃদয় ধ্বক করে উঠল। সেদিনের মতো আজও কি কেউ তার পথ আটকাতে চাইছে? তিনি ভয়ে ভয়ে জানালার কাঁচ নামালেন। মাথাটা একটু বের করতেই দেখলেন সামনের গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। কালো ব্লেজার, ফরমাল প্যান্ট আর চোখে চশমা। তিনি এর আগে কখনও আমীরকে দেখেননি। তাই চিনতে পারলেন না। অবাক হয়ে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন,” কে আপনি?”

আমীর চারপাশে একবার তাকাল। তারপর জানালার কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,” আপনার কন্যার অপহরণকারী।”

ইরফানের চোখ দু’টো ধিক করে জ্বলে উঠল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চেহারায়। রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইলেন,” তুমি ওর সাথে কি করেছো?”

” তেমন কিছু না। শুধু একটু ভয় দেখিয়েছি। যদি আপনি আমার কথা না মানেন… তাহলে ভয়টাই সত্যি হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আপনি নিজের মেয়ের ক্ষতি চান না।”

” প্লিজ, ওকে এর মধ্যে ইনভলব কোরো না। ও ইনোসেন্ট।”

” তোহাও খুব ইনোসেন্ট। কিন্তু আপনি ওকে অলরেডি ইনভলব করে ফেলেছেন। আপনার জন্য আজকে আমাদের বিয়েতে বাঁধা পড়েছে।”

ইরফানের দৃষ্টি প্রসারিত হলো। বিস্ময়ের সাথে তিনি উচ্চারণ করলেন,” তুমিই তাহলে আমীর?”

আমীর হাসল। ইরফান অনুনয়ের স্বরে বলল,” তোহা খুব নরম মনের মেয়ে। তুমি শুধু শুধু ওর জীবনটা নষ্ট করছো। প্লিজ,ওকে ছেড়ে দাও। ওর ক্ষতি কোরো না।”

আমীরের মুখ উত্তপ্ত লাভার মতো রক্তিম হয়ে উঠল। সে অতি রূঢ় স্বরে জানালো,” তোহা আমার কাছে সবচেয়ে সুরক্ষিত। ওর ক্ষতির চিন্তা আপনার করার দরকার নেই। সেজন্য আমি একাই যথেষ্ট। আপনি শুধু আমাদের বিষয়ে ইন্টারাপ্ট করা বন্ধ করুন। নাহলে কিন্তু আমি আপনার আর আপনার মেয়ের মধ্যে ইন্টারাপ্ট করে ফেলব। আশা করি সেটা আপনার ভালো লাগবে না।”

ইরফানের মুখ ফ্যাকাশে দেখালো। তিনি শুকনো কণ্ঠে বললেন,” কি চাও আমার কাছে?”

” কি জরুরী কথা বলার জন্য ওকে আপনি ডেকেছিলেন? সেটা আমাকে বলতে হবে।”

” না। কোনো জরুরী কথা নেই।”

আমীর তার পকেট থেকে পিস্তল বের করল। সাথে সাথেই ইরফান উচ্চারণ করলেন,” ঠিকাছে, কাম ডাউন।আমি বলছি।”

আমীর গাড়ির বিপরীত পাশে গিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ইরফানের দূর্বল বক্ষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে কম্পিত হচ্ছে। তিনি ক্ষণে ক্ষণে শুকনো ঢোক গিলছেন। আমীর তার পাশে বসে খুব স্বাভাবিক স্বরে আওড়ালো,” বলুন, আমি শুনছি।”

ইরফান মাথা নত করে বললেন,” গতরাতে তোহার নামে আমার কাছে একটা পার্সেল এসেছিল। তোহার বাড়িতে পার্সেল পাঠানোর নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। সেজন্য প্রেরক আমাকে অনুরোধ করেছে আমি যাতে তোহাকে ডেকে এনে পার্সেলটা দেই।”

” কোথায় সেই পার্সেল? আপনার কাছে আছে?”

” আমার চেম্বারে আছে।”

” তাহলে চলুন আপনার চেম্বারে। কিন্তু খবরদার, যদি কোনো চালাকির চেষ্টা করেন তাহলে কিন্তু ইফেক্টটা আপনার মেয়ের উপর পড়বে।”

ইরফান গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। তারা দশমিনিটের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে গেল। চেম্বারে এসে ইরফান তার ডেস্ক থেকে পার্সেলটা আমীরের হাতে হস্তান্তর করলেন। হাতের লেখা দেখেই আমীর বুঝে ফেলল এটা হাসান। সে চিঠি পড়তে শুরু করল,

” প্রথমেই আমার সালাম নিবেন ইরফান সাহেব। না, আপনি আমাকে চিনবেন না। আর আমিও আপনাকে চিনতাম না। তবে আমাদের দু’জনের মধ্যে একটা কমন ব্যাপার আছে। আপনি রিসেন্টলি যার কেইসটা হাতে নিয়েছেন আমি তারই শুভাকাঙ্ক্ষী। সুতরাং আমাকে বলতে পারেন আপনার সহযোগী। কারণ আমরা দু’জন একই ব্যক্তির মঙ্গল চাই। ইয়েস, আমি মিস তোহার কথাই বলছি। তার নামে একটা চিঠি আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমি আপনার কাছে প্রেরণ করেছি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন মিস তোহার বিষয়ে সামান্যতম কৌতুহল প্রকাশ করাও লাইফ রিস্কের ব্যাপার। আপনার কাছেও তো জীবনের হুমকি এসেছে। এতো অল্পতেই ভয় পেলে কিন্তু চলবে না। আপনাকে একটু সাহস দেখাতে হবে। এই পার্সেলটা খুব সাবধানে মিস তোহার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমার বিশ্বাস আপনি সেটা পারবেন। এতে লাভ কি হবে জানেন? মিস তোহা তার এতোদিনের সন্দেহজনক সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। বিশ্বাস করুন, আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আমি আপনারই মতো মিস তোহার ভালো চাই।
ইতি
আগন্তুক।”

পুনশ্চ- আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে কেন আমি আপনার কাছেই সাহায্য চাইলাম। পার্সেলটা সরাসরি মিস তোহার বাড়ির ঠিকানাতেও পাঠানো যেতো। এর আগে আমি সেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। মিস তোহার বাড়ির পরিবেশ নিরাপদ নয়। তাই এবার আমার আপনার সাহায্য প্রয়োজন।”

আমীর মুখ বন্ধ খামে আরেকটা চিঠি পেল। আর একটা বাক্সে কিছু জিনিসপত্র। আমীর জিজ্ঞেস করল,” আপনি কি এই বাক্স খুলে দেখেছেন?”

ইরফানের মুখ ভয়ে ঘেমে যাচ্ছে। এয়ারকুলারের নিচে বসেও তিনি গরম অনুভব করছেন। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তিনি বাক্স খুলেছিলেন এবং ভেতরে কি আছে সেটা ভালো করেই জানেন। আমীর তাই আর প্রশ্ন না করে বাক্সের মুখ খুলল। একটা ঘড়ি, রক্তাক্ত শার্ট-প্যান্ট আর একটা ওয়ালেট পাওয়া গেল।

জিনিসগুলো দেখে আমীরের মাথার শিরা দপদপ করতে লাগল। সে হতাশ ভঙ্গিতে বসে পড়ল চেয়ারে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। ভাগ্যিস এই পার্সেল তোহার কাছে পৌঁছায়নি। এই সমস্ত জিনিস তার বাবার। মৃ-ত্যুর আগে জাবিদ সাহেব যা কিছু পরিধান করেছিলেন তা সব এখানে আছে। কিন্তু আমীর তো হাসানকে বলেছিল জিনিসগুলো পুড়িয়ে ফেলতে! সে আসলে প্রথম থেকেই বিশ্বাসঘাতক ছিল। আমীর জিনিসগুলো দুমড়ে-মুষড়ে তীব্র ক্রোধের সাথে উচ্চারণ করল,” বেঈমান।”

তোহাকে পাঠানো চিঠি খুলতেই একটা নাম্বার পাওয়া গেল। নিচে দুইলাইনে লেখা-” আগে বাক্স খুলুন, তারপর লেখা পড়ুন।”

অপর পৃষ্ঠায় লেখা-‘ মিস তোহা, বাক্সে কি দেখলেন? চিনতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। জ্বী ম্যাডাম, এগুলো আপনার বাবার জিনিস। মৃ-ত্যুর আগে তার বডিতে যা কিছু ছিল সব সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। প্রশ্নটা হলো, আমি কিভাবে এসব পেলাম? উত্তর জানার জন্য আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আগের পেইজে দেওয়া নাম্বারে যোগাযোগ করুন৷ কোথায় আসতে হবে আমি বলে দিবো। সেফটির জন্য প্রতিদিনই আমাকে জায়গা বদল করতে হচ্ছে৷ তাই চিঠিতে নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা লেখা সম্ভব হলো না। সেজন্য আমি দুঃখিত।
ইতি,
আপনার অনুগত শুভাকাঙ্ক্ষী। ”

আমীর চিঠি ভাঁজ করে ইরফান সাহেবকে বলল,” আপনাকে একটা কাজ করতে হবে, পারবেন?”

” কি কাজ? আমি কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না।”

আমীর তার পিস্তল পুনরায় বের করল৷ ইরফান ত্রাসিত কণ্ঠে বললেন,”ঠিকাছে, তুমি যা বলবে আমি করব।”

আমীর ইরফানের মাথায় পিস্তল ঠেঁকিয়ে রেখে বলল চিঠিতে দেওয়া নাম্বারে ফোন করতে। তিনি কম্পমান হাতে সেটাই করলেন। আমীর স্পষ্ট করে বলে দিল যদি এতটুকু উনিশ-বিশ হয় তাহলেই সে শ্যুট করবে। ইরফান সাহেবের মনে হচ্ছে তার জীবনটা এই আবদ্ধ ঘরে আটকে গেছে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওই পাশ থেকে ভেসে এলো ভারী কণ্ঠ,” হ্যালো, কে বলছেন?”

কণ্ঠ শুনেই আমীর বুঝতে পারল যে এটা হাসান। ইরফান সাহেব বললেন,” হ্যালো, আমি…”

তিনি কথা শেষ করার আগেই ওই পাশের ব্যক্তি বললেন,” ইরফান মির্জা?”

” জ্বী। কিভাবে চিনলেন?”

” চেনার কিছু নেই। এই নাম্বারে শুধু দু’জন ব্যক্তিই ফোন করতে পারে। মিস তোহা আর আপনি। বলুন, ইরফান সাহেব। তোহা ম্যাডামের কাছে পার্সেল দিয়েছেন?”

আমীর যা শিখিয়ে দিয়েছিল ইরফান মুখস্তের মতো সেটাই আওড়ালেন,” আমি ওকে ফোন করেছিলাম৷ জানতে পারলাম আজ ওর বিয়ে। কিন্তু পার্সেলের কথা শুনে ও আসতে রাজি হয়েছে। তবে ও বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। আমি ওকে একা আসতে বলেছি। আপনি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে হাফ এন আওয়ারের মধ্যে আমার চেম্বারে চলে আসুন। ঠিকানা নিশ্চয়ই জানেন।”

” কি বলছেন? আজকেই বিয়ে? ওহ গড! ঠিকাছে, আমি তো আসতে পারব না। তবে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। মিস তোহা কি আমার পাঠানো গাড়িতে আসতে রাজি হবে?”

ইরফান সাহেব আমীরের দিকে তাকালেন। আমীর ইশারায় হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল এবং কিছু একটা বোঝালো। ইরফান সেটাই বললেন,” নিজের বাবার জন্য সে সব করতে প্রস্তুত। আপনি গাড়ি পাঠান।”

” গ্রেইট। আমি বিশমিনিটের মধ্যে পাঠাচ্ছি।”

ইরফান ফোন রাখা মাত্রই আমীর তার পিস্তল নামিয়ে রাখল। পেছনে নরম গদিযুক্ত সোফায় হতাশ ভঙ্গিতে বসে পড়ল মাথায় হাত ঠেঁকিয়ে। তাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। ইরফান কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে আমীরের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বললেন,” তুমিই তোহার বাবার হ’ত্যাকারী, আমি কি ঠিক বলেছি?”

আমীর জবাব দিল না। তার চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু নির্গত হচ্ছে। মুহুর্তেই চশমা ঝাপসা হয়ে এলো। সে চশমাটা খুলে চোখ দু’টো মুছল। ইরফান হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমীরের মতো একটা ক্রিমিনালও যে এমন অসহায়ের মতো কাঁদতে পারে, এই ব্যাপারটি ইরফান সাহেবের কাছে ধারণাতীত। এ যেন তার কোনো দ্বিতীয় সত্ত্বা। একই মানুষের মধ্যে দুইটি ভিন্ন রূপ। প্রথমটি যত ভয়ংকর, দ্বিতীয় ততই অসহায়!

ইরফান আমীরের সামনে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন। নরম গলায় বললেন,” আমি কথা দিচ্ছি, তোহা কোনোদিন কিছু জানবে না।”

তার এমন প্রতিশ্রুতি শুনে আমীর অবাক হয়ে তাকাল। ইরফান মাথা নেড়ে আমীরকে ভরসা দিলেন। আমীরের দৃষ্টি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল।

সাজঘর থেকে বের হওয়ার পর তোহার রূপ দেখে জাবিদা এবং কথা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। দু’জনের মুখ থেকেই আচম্বিতে বেরিয়ে এলো একটি শব্দ,” মাশাআল্লাহ।”

সাদা রঙের উপর সোনালী সুতো আর গোলাপী পাথরের কাজ করা লেহেঙ্গায় তাকে এতো দারুণ মানিয়েছে! মেকাপও খুব কোমলভাবে স্ক্রিনে বসে গেছে। চোখে গাঢ় কাজল। ঠোঁট ভর্তি ম্যাট লিপস্টিক। কোথাও যেন কোনো কমতি নেই। মাথায় চূড়ো করে বাঁধা খোপা। খোপার চারপাশে ডেইজি ফুলের গাজরা। পেছন থেকে ঘোমটার মতো করে ওরনাটা সামনে আনা হয়েছে। জাবিদা মুগ্ধ দৃষ্টিতে বললেন,” বাহ, অনেক সুন্দর লাগছে তো!”

কথা বলল,” আচ্ছা তোহা, মুখটা এমন গোমরা করে রেখেছো কেন? একটু হাসো! না হাসলে সুন্দর দেখায় নাকি?”

তোহা জোরপূর্বক একটু হাসার চেষ্টা করল। সে চিন্তিতবোধ করছে। ইরফান সাহেব তাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বলেননি। কি হচ্ছে তার অগোচরে? যদি সাধ্য থাকতো তাহলে তোহা এই মুহূর্তে নিজের বিয়েটা ভেঙে দিতো। তার বিয়ে করতেই ইচ্ছে করছে না। বিয়ে মানে প্রবল আনন্দের একটা ব্যাপার। তোহা সেই আনন্দটাই খুঁজে পাচ্ছে না। কোথায় যেন একটা খাপ রয়ে গেছে। সবকিছু কেমন বিষণ্ণবোধ হচ্ছে।

তারা পার্লার থেকে বের হওয়ার সময় আমীর হাজির হলো। তার হাতে একটা বড় লাল গোলাপের বুকেট। কথা দুষ্টমি করে বলল,” কি ব্যাপার জামাই সাহেব, বউ ছাড়া ভালো লাগছে না? পার্লারে পর্যন্ত চলে এসেছেন? এটা কোনো কথা?”

আমীর হাসল। তোহাও হেসে ফেলল। জাবিদা জানতে চাইল,” তুমিই কি ওকে নিয়ে যাবে নাকি আমাদের সাথে যেতে দিবে?”

আমীর বলল,” আপনাদের সাথেই যাক। আমি গাড়ি নিয়ে পরে আসছি।”

” ঠিকাছে। ”

কথা ফোঁড়ন কাটতে বলল,” তবে চাইলে দু’জন একসাথেও যেতে পারো। আমরা মাইন্ড করব না। কি ননদী, যাবে নাকি?”

তোহা মাথা নিচু করে হাসিমুখে বলল,” না। আমি তোমাদের সাথেই যাবো ভাবী।”

” আহারে… আমীর এতো কষ্ট করে এসেছে। শুধু শুধু বেচারার মনটা খারাপ হবে। তুমি বরং ওর সাথেই যাও।”

জাবিদা বলল,” দরকার নেই। বিদায়ের সময় জামাই-বউ একসাথে যাবে। কিন্তু এখন তোহা আমাদের সাথে যাবে এটাই নিয়ম।”

কথা ফোন বের করতে করতে বলল,” মা থামুন। আগে ওদের দু’জনের কিছু ছবি তুলে নেই প্লিজ। কি ভালো লাগছে না একসাথে? আমীর ভাই, আপনি আমার ননদীর পাশে এসে একটু দাঁড়ান না। ফুলটা ওকে দিন। এই অবস্থায় আমি একটা ছবি তুলব।”

আমীর তোহার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। তোহা মিষ্টি করে আমীরের দিকে তাকিয়েছে। তার হাত থেকে ফুলটা নিচ্ছে। এরকম দৃশ্যে কথা বিভিন্ন এংগেল থেকে কয়েকটা ছবি তুলল। সড়কের পাশ দিয়ে যারা যাওয়া-আসা করছিল তারাও অভিভূত হয়ে এই দৃশ্য দেখছিল। যেন এমন সুন্দর জুটি কেউ আগে কখনোই দেখেনি।

কথা মোহিত কণ্ঠে বলল,” তোমাদের পাশাপাশি এতো দারুণ লাগছে! মাশাআল্লাহ, কারো নজর না পড়ে যাক।”

কথা দ্রুত পায়ে জাবিদার কাছে গিয়ে বলল,” মা চলুন আমরা গাড়িতে গিয়ে বসি। ওরা আস্তে-ধীরে আসুক।”

” ঠিকাছে চলো।”

তোহা নরম কণ্ঠে বলল,” যাই এবার?”

” আচ্ছা।”

তোহা খেয়াল করল সে এখনও জুতোই পরেনি। মাথায় হাত রেখে বলল,” উফ, একমিনিট দাঁড়ান। আমার জুতোগুলো পরে নেই।”

বাইরে বসার একটা আরামকেদারা আছে। তোহা সেখানে বসে জুতো পরার চেষ্টা করতে লাগল। আমীর বলল,” আমি পরিয়ে দেই?”

তোহা এই কথায় সামান্য লজ্জা পেল। কিন্তু নিষেধ করতে পারল না, বলল,” আচ্ছা।”

আমীর হাঁটু গেঁড়ে বসতেই তোহা বলল,” কি করছেন? আপনার প্যান্ট নোংরা হয়ে যাবে তো।”

” সমস্যা নেই।”

আমীর যত্ন করে তোহার পায়ে জুতো পরিয়ে দিল। ডানপায়ে জুতো পরানোর সময় সে খুব আদর নিয়ে চুমু দিল। তোহা কেঁপে উঠে বলল,” কি করছেন? পায়ে কেউ চুমু দেয়?”

আমীর বলল,” এতো সুন্দর পায়ে চুমু না দিলে আফসোস হবে।”

তোহা কি বলবে বুঝতে পারল না। আমীর উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল। এতো উঁচু হিল পরে তোহার হাঁটতে কষ্ট হবে। তাই সে হাত ধরে তোহাকে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাবে।তোহা আমীরের বাড়িয়ে রাখা হাতটি ধরে উঠে দাঁড়ালো। তার মনে আনন্দের ফোয়ারা বইছে। এতোক্ষণের মনখারাপ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সে মন ভরে গোলাপের সুগন্ধ নিল। আজকের দিনটা অসম্ভব স্নিগ্ধ। এখন আর বিয়ে ভাঙতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। এই বিয়ে না হলে সে তার পাশে দাঁড়ানো মানুষটিকে পেতো কিভাবে? এই মানুষটিকে না পেলে সে খুব ঠকে যেতো। তার পৃথিবী শূন্য হয়ে যেতো। আচ্ছা, বাবা কি দূর থেকে তাদের দেখছেন? তিনি নিশ্চয়ই আজ খুব খুশি!

__________________
রেস্টুরেন্টের সজ্জা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। বেশিরভাগ কাজ আমীরের তদারকিতে হয়েছে। সে নাকি সারারাত এখানেই ছিল। স্টেজটা সম্পূর্ণ ডেইজি ফুল দিয়ে সাজানো। মেঘ আর রংধনুর থিমে সজ্জিত আসন। এই সবকিছুই তোহার পছন্দের। আমীর যেন কোথাও কোনো কমতি রাখেনি। তোহা আরাম করে তার আসনে বসল। সাথে সাথেই ফটোগ্রাফার শাট শাট ফ্লাশে ছবি তুলতে শুরু করল। তোহা আমীরকে খুঁজছে। ওইতো দূরে দাঁড়িয়ে তোহাকেই দেখছে সে। তোহা তাকাতেই আমীর চোখ মারল। তোহা হেসে ফেলল। আমীর ফ্লায়িং কিস দিল। হাত দিয়ে না, শুধু ঠোঁটের ইশারায়। তোহা চোখ বড় করে আশেপাশে তাকাল। কেউ দেখলে কি মনে করবে? আমীর শুধু পারে হুটহাট তাকে লজ্জায় ফেলতে।

আলিফ তার কয়েকজন কলিগের সাথে তোহার পরিচয় করাতে নিয়ে এলো। তারা একে একে তোহার সাথে পরিচিত হয়ে ছবি তুলছিল। একটু পর সবাই চলে যেতেই আলিফ ফিসফিস করে বলল,” আমার কিন্তু এখনও একটা বিষয়ে সন্দেহ হচ্ছে তোহা।”

” সন্দেহ মানে? কি বিষয়ে?”

” ওই পার্সেল হারিয়ে যাওয়ার সাথে আমীরের কোনো কানেকশনও তো থাকতে পারে। আজাদ হারা*মজাদা যা শুরু করেছিল… আমার তো মনে হয় সে-ই কিছু করেছে পার্সেলটার। আর আমীরের সাথেও তার ভালো সম্পর্ক।”

তোহা কঠিন গলায় বলল,” তুমি কি বলতে চাও সরাসরি বলো।”

আলিফ নির্বিকার কণ্ঠে বলল,” তুমি চাইলে এখনও বিয়েটা আটকানো যায়। আমি আবারও বলছি এই বিয়ে তোমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সিদ্ধান্ত।”

তোহার মেজাজ গরম হয়ে গেল। সে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,” আমার সামনে থেকে সরো। এই ব্যাপারে আমি তোমার সাথে আর একটাও কথা বলতে চাই না।”

দূর থেকে আমীর সবকিছু দেখছিল। তার আশেপাশে অনেক মানুষ। সবার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফাঁকে সে তোহার দিকেও নজর রাখছে। আলিফকে তোহার সামনে গিয়ে ফিসফিস করতে দেখে সে এগিয়ে এলো। আমীরকে আসতে দেখে আলিফ একবার তোহার দিকে চেয়ে শুধু বলল,” ভেবে দেখো, সময় এখনও আছে।” এটা বলেই সরে গেল। আমীর ভ্রু কুচকে তোহাকে প্রশ্ন করল,” কি বলছিল তোমার ভাই?”

” কিছু না। ফালতু কথা। আপনি বসুন তো।”

” তোমার কি ক্ষিদে পেয়েছে?”

” হ্যাঁ… কিভাবে বুঝলেন?”

” সকালে ব্রেকফাস্ট করোনি তাই না?”

” করেছি কিন্তু অল্প। টেনশনে গলা দিয়ে খাবারই নামছিল না।”

” চকলেট পেস্ট্রি খাবে?”

” হ্যাঁ। ” তোহার চোখমুখ লোভনীয় তৃষ্ণায় ঝলমলিয়ে উঠল। আমীর হেসে ফেলল। আফশানকে ইশারা দিতেই সে একটা লম্বা ট্রে-তে করে অনেকগুলো পেস্ট্রি নিয়ে হাজির হলো,” ভাবী খান।”

তোহা একসাথে চার-পাঁচটা পেস্ট্রি হাতে নিয়ে ফেলল। আমীর বলল,” আস্তে, পুরোটাই তোমার। হাত নষ্ট করতে হবে না।”

তোহা ইতস্তত হয়ে বলল,” স্টেজে বউ হাতে একগাদা পেস্ট্রি ভরা পাত্র নিয়ে বসে আছে… ব্যাপারটা কেমন দেখায়?”

” ঠিকাছে, তাহলে আমি ধরে রাখছি। তুমি খাও।”

” ওকে।”

আফশান আমীরকে ইশারায় কিছু একটা বোঝাতে চাইল। আমীর বুঝল না। কপাল কুচকে ইশারায় জানতে চাইল,” কি?”

আফশান আমীরের পাশে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল,” নিচে হাসান এসেছে স্যার।”

আমীরের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ইরফান মির্জার চেম্বারে সে হাসানের পাঠানো গাড়ির জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। অবশেষে গাড়ি আসার পর সে নিজে উঠে গন্তব্যে যায় হাসানকে ধরার জন্য। কিন্তু হাসান তার মুখোমুখি হয়নি। তার উপস্থিতি বুঝতে পেরেই সেখান থেকে পালিয়েছে। আমীর তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছে যদি সাহস থাকে তাহলে যেন কাপুরুষের মতো না পালিয়ে সামনে আসে। হাসান তার সাহস দেখাতে এসেছে। আমীর ভাবেনি যে সে সত্যিই আসবে। সবসময় সাহস দেখানোর পরিণাম ভালো হয় না। সেটাই হাসানকে বোঝাতে হবে। আমীর বলল,” তুমি মায়াকে এখানে পাহারা দাও। আমি আসছি।”

” ওকে স্যার।”

আমীর চলে যেতেই তোহা জিজ্ঞেস করল,” আফশান ভাই, উনি এখন আবার কোথায় গেলেন?”

” মনে হয় ওয়াশরুমে গেছেন ম্যাডাম।”

নিচে রেস্টুরেন্টের করিডোরের একটা আসনে বসেছিল হাসান। আমীরকে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়াল সে। আমীর তার কাঁধের উপর হাত উঠিয়ে খুব আন্তরিক স্বরে বলল,” কি অবস্থা হাসান? কেমন আছো?”

” ভালো।” হাসানের কণ্ঠ ভারী। আমীর বলল,” আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? মানে আমি বাংলাদেশ থেকে ইটালি আসার কথা বলছি। অবশ্য তোমাকে যে পাঠিয়েছে সে এইসব বিষয়ে খুব এক্সপার্ট। তার কাছে কোনো কাজই অসম্ভব না।”

হাসান নিরস কণ্ঠে বলল,” স্নেহা ম্যাডামের কথায় না, আমি নিজের ইচ্ছায় এসেছি।”

” কি? নিজের ইচ্ছায় তুমি ইটালি চলে এসেছো?”

” না। ইটালি আসার ব্যবস্থা স্নেহা ম্যাডামই করেছেন। কিন্তু আমি এসেছি নিজের ইচ্ছায়।”

আমীর খুব বিস্মিত হওয়ার চেষ্টা করল।।আফসোসের স্বরে বলল,” তুমি তো আমাকে খুব হতাশ করে দিলে হাসান। এতোদিন ভাবছিলাম স্নেহা তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। কিন্তু এখন দেখছি নিমকহা’রাম তুমি নিজেই।”

” আমাকে নিমকহা’রাম বলার আগে আপনি নিজের কথাটাও ভেবে দেখুন স্যার। আপনি কি করছেন? যাকে বিয়ে করছেন সে জানেই না আপনি কে? আপনার সম্পর্কে তার সঠিক কোনো ধারণাই নেই। যদি থাকতো তাহলে বিয়ে করা তো দূর, আপনার চেহারাও সে দেখতে চাইতো না। সারাজীবন এই অপরাধবোধ নিয়ে টিকবেন কিভাবে? তার চোখে চোখ রেখে দিনের পর দিন মিথ্যা বলে যাবেন… ক্লান্ত লাগবে না?”

” ও…. তুমি তাহলে আমাকে এখানে উপদেশ দিতে এসেছো? তোমার কি মনে হয়? তোমার থেকে উপদেশ নিয়ে আমি আমার জীবনের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলব?”

” এটা উপদেশ না। আমি শুধু সত্যি কথা বলছি। যে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস আপনার নেই। আমাকে সৎসাহস দেখাতে বলেছেন। কিন্তু সেই সৎসাহস আপনার নিজের কতটা আছে? পৃথিবীর সবাইকে দমিয়ে রাখতে পারলেও একটা সাধারণ মেয়ের কাছে আপনি অসহায়। তাকে সত্যি কথা বলার সাহস পর্যন্ত আপনার নেই। ছি! শেইম অন ইউ স্যার।”

আমীর খুব কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,” বাইরে চলো হাসান। তোমার সাথে ভালো করে কথা বলি। এখানে খুব ক্রাউড।”

হাসান মুখের পেশি শক্ত করে বলল,” যা বলার এখানেই বলুন। আমি কোথাও যাবো না। যদি যাই তাহলে উপরে যাবো। তোহা ম্যাডামের সাথে কথা বলব। তাকে সব সত্যি জানাবো। এর আগে আমি এক পাও নড়ব না এখান থেকে।”

” তুমি শিউর?”

” শিউর।”

” তোমার আসলেই খুব সাহস হাসান। ব্রাভো।”

হাসান তাকিয়ে আছে। আমীরও হাসি মুখে তাকিয়ে আছে৷ তারা দু’জন- দু’জনের থেকে দৃষ্টি সরাচ্ছে না।

__________________
দুইঘণ্টা পার হয়ে গেছে। আমীর সেই যে গিয়েছিল, এখনও আসেনি। স্টেজে কাজী সাহেব উঠে বসে আছেন। তিনি অপেক্ষা করতে করতে আপাতত ঝিমোচ্ছেন। তোহা বিচলিতবোধ করছে। রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” আফশান ভাই, একবার বাইরে গিয়ে দেখে আসুন না যে উনি কোথায়?”

” আমি সাতবার বাইরে গিয়ে দেখেছি ম্যাডাম। আপনি বললে এখন আবার যাবো।”

” যান প্লিজ।”

জাবিদা অসন্তুষ্ট মুখে বলল,” এতো অসচেতন মানুষ হয়? আমরা সবাই কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি অথচ তার কোনো খোঁজই নেই। ফোনটাও ধরছে না। কি আশ্চর্য!”

কথা বলল,” কোনো বিপদও তো হতে পারে, তাই না মা?”

এই কথা শুনে তোহার অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। সে উঠে বলল,” আমি আর এখানে বসে থাকব না। আমার দমবন্ধ লাগছে। আমি বাইরে যাবো।”

আলিফ তাকে আটকাল,” থামো, এই অবস্থায় তুমি কোথায় যাবো? আর গেলেও কি ওকে খুঁজে পাবে? ও ইচ্ছে করেই গায়েব হয়েছে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ও আসবে না। চীট করেছে তোমার সাথে।”

তোহা রক্তিম দৃষ্টিতে তাকাল। মাহমুদ সাহেব আলিফের সাথে সহমত হলেন,” আমারও তাই মনে হচ্ছে। শুরু থেকেই ছেলেটার মধ্যে ঘাপলা ছিল। আমার তো তাকে কখনোই ভালো লাগেনি। তোহার বাড়াবাড়ির জন্য শুধু বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। এখন দেখা যাক কি হয়! যদি আসে তাহলে তো ভালোই। না আসলে মান-সম্মান যাবে।”

জাবিদা স্বামীর উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বলল,” মেয়েটার মনের অবস্থার ঠিক নেই আর উনি বসে বসে মান-সম্মানের চিন্তা করছেন। আজব মানুষ!”

তোহা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। আলিফকে ধাক্কা মে-রে সরিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে যেতে নিচ্ছিল। তখনি সামনে এসে দাঁড়ালো আমীর। তোহাকে ছুটতে দেখে দুইহাতে থামালো সে। শান্ত গলায় বলল,” কাম ডাউন। এইতো চলে এসেছি আমি। স্যরি, বেশি লেইট করে ফেললাম?”

উপস্থিত সবাই তাকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। তোহার রক্তিম মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুহূর্তেই। সে উদগ্রীব কণ্ঠে শুধাল,” আপনি কোথায় ছিলেন এতোক্ষণ ধরে? এতোবার ফোন করেছি…আপনার মোবাইল কই?”

আমীর তার ব্লেজারের পকেটে হাত রাখল। মোবাইলটা সেখানে নেই। হাসানের লা’শ পানিতে ফেলার সময় মোবাইলটাও কি পড়ে গেছিল? আমীর হাসার চেষ্টা করল,” কি জানি? রেখেছি হয়তো কোথাও। তুমি ফোন করেছিলে?”

তোহা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,” এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনি? কি এমন জরুরী কাজ পড়ে গেছিল যে বিয়ের দিনও উধাও হতে হবে?”

আমীর কোমল গলায় বলল,” আই এম স্যরি। আসলে আমার একজন ক্লায়েন্ট এসেছিল।”

তোহা ক্ষেপে উঠে চিৎকার করল,” ক্লায়েন্ট আপনার কাছে এতো জরুরী যে নিজের বিয়ের কথাও ভুলে যাবেন? ছেলে ক্লায়েন্ট নাকি মেয়ে ক্লায়েন্ট?”

তার এমন প্রশ্নে দুশ্চিন্তার মধ্যেও সবাই হেসে ফেলল। আমীর নিচু গলায় বলল,” ছেলে।”

” থাকুন আপনি আপনার ক্লায়েন্ট নিয়ে। বিয়ে করার কোনো দরকার নেই।”

” বললাম তো, স্যরি।”

” আপনার স্যরি নিজের কাছেই রাখুন।”

তোহার ভীষণ রাগ উঠেছিল। কিন্তু এতো মানুষের সামনে রাগ দেখানো সম্ভব না। তাই তাকে শান্ত হতে হলো। দু’জন স্টেজে উঠে একসাথে বসেছে। কাজী সাহেব কাগজ পত্র ঠিক করছেন। এমন সময় ইরফান সাহেবও উপস্থিত হলেন। তিনি এসেই বললেন,” আমি তো ভেবেছিলাম অনুষ্ঠান শেষ। ”

তোহা খুব উৎফুল্ল হয়ে বলল,” আঙ্কেল আপনি এসেছেন? থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। আপনি না এলে আমি খুব কষ্ট পেতাম।”

” তোমাকে কষ্ট দেই কি করে মা? এজন্যই চলে এসেছি।”

” সো সুইট অফ ইউ আঙ্কেল।”

কথা বলল,” তমালিকাকে আনলেন না কেন মামা?”

” ও আসতে পারেনি। কিন্তু তোহাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।”

তোহা আনন্দের সাথে আমীর আর ইরফান সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিল। তারা দু’জনেই এমন ভাব করল যেন এর আগে কেউই কাউকে দেখেনি। বিয়ের অনুষ্ঠান ঝামেলাহীনভাবে সম্পন্ন হলো। কবুল বলার পর আমীরের বিশ্বজয় করার মতো আনন্দ হচ্ছিল। তোহার মনে হলো তার শূন্য পৃথিবী পূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে আমীরের দিকে চেয়ে হাসল। আমীর তাকে চোখ মারল। একটু আগেই যে সে একটা আস্তো মানুষ খু’ন করে এসেছে তার এই জেন্টালম্যান লুক দেখে কেউ সেটা ঘূণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারবে না!

পরিশিষ্ট-
হুট করেই কারেন্ট চলে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। স্নেহা ঘুম ভেঙে এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল। আলতো গলায় ডাকল,” রাশেদ, রাশেদ।”

কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে উঁকি দিল সে। অন্ধকারে কিছু দেখাই যাচ্ছে না। রান্নাঘর থেকে ম্যাচ নিয়ে মোমবাতি জ্বালালো। রাশেদ বাসার কোথাও নেই। এতোরাতে সে যাবে কই? স্নেহার কেন যেন গা ছমছম করছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসতে চাইছে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই বাতাসে মোমবাতি নিভে গেল। আবারও ঘুটঘুটে অন্ধকার। এমন সময় পেছন থেকে একটা আবছা কণ্ঠ কানে এলো,” ম্যাডাম।”

স্নেহার গা শিরশির করে উঠল। কণ্ঠটা রাশেদের নয়। এটা অন্যকারো কণ্ঠ। কিন্তু কার? দেখার জন্য পেছনে ফিরেই স্নেহা গগন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে উঠল। গুলজার তেড়ে এসে তার মুখ চেপে তাকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ধরল। স্নেহা গলাকাটা প্রাণীর মতো তড়পাতে শুরু করল।তার দমটা যেন আটকে আসবে যেকোনো সময়। গুলজার তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,” আপনার সময় শেষ ম্যাডাম।শুধু শুধু আর কষ্ট করবেন না। আমি আপনাকে খুব শান্তির মৃত্যু দিবো। হাসানের আত্মা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”

স্নেহা স্তম্ভিত হয়ে গেল। শিরদাঁড়ায় প্রবাহিত হলো ঠান্ডা স্রোত। হাসান মা-রা গেছে! এর মানে সে আমীরের কাছে ধরা পড়েছিল। স্নেহার চোখের কার্ণিশ ভরে উঠল অশ্রুজলে। খুব কষ্টে সে উচ্চারণ করল,” রাশেদ কোথায়? ওর সাথে তুমি কি করেছো?”

” ওর কথা ভুলে যান। ওকে আপনি আর কখনও দেখবেন না। আপনার জীবনের শেষ সময়টুকু আমার সাথেই কাটাতে হবে। এটাই আপনার দূর্ভাগ্য ম্যাডাম।”

” তোমাকে আমীর পাঠিয়েছে তাই না? প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও গুলজার। আমি তোমাকে অনেক টাকা দিবো। তোমার জীবন বদলে যাবে।”

গুলজার শক্ত করে চেপে ধরল স্নেহার গলা। স্নেহার ছটফটানি বৃদ্ধি পেল। গুলজার ভারী গলায় বলল,” আমার জীবন বদলানোর জন্য না, আপনার জীবন শেষ করতে এসেছি আমি। বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, এই কাজ করতেই আমার বেশি সুখ।”

গুলজারের চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে তীব্র ক্রোধ। সে সবসময় স্নেহাকে কামনা করে এসেছে। কিন্তু স্নেহা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি যে তার মৃ-ত্যু এতোটা করুণ হবে। শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করে সে রাশেদের কথা মনে করতে চাইল। কিন্তু আশ্চর্য, রাশেদের মুখটা তার মনেই পড়ছে না! রাশেদ কি তাহলে মা-রা গেছে? না, সে ভালো থাকুক। স্নেহা একসময় রাশেদের অনিষ্ট চাইলেও এখন ঠিক নিজের মৃ-ত্যুর পূর্বমুহূর্তে সে মনে-প্রাণে চাইছে রাশেদ যেন ভালো থাকে!

উত্তর আকাশে ঝলমল করছে একরাশ তারা। তোহা চঞ্চল কণ্ঠে বলল,” গাড়িটা একটু থামান প্লিজ।”

আমীর সড়কের একপাশে নিয়ে গাড়ি থামাল। তোহা ঝটপট করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। দুইহাত প্রসারিত করে উপরে তাকিয়ে বলল,” দেখুন, আজকে আকাশে কত্ত তারা! মনে হচ্ছে তারারাও আজ আমাদের এক হওয়ার আনন্দে হাসছে। আমার অন্নেক ভালো লাগছে।”

তোহা কথা শেষ করে আমীরের দিকে ঘুরতেই দেখল তার চোখে অশ্রু। হাতে চশমা নিয়ে নিষ্পলক চেয়ে আছে সে তোহার দিকে। তোহা অবাক হয়ে বলল,” ওমা, আপনি কি কাঁদছেন নাকি?”

আমীর দুইহাতে চোখের জল মুছে চশমাটা পরে নিয়ে বলল,” জীবনে শেষবারের মতো কাঁদছি। এরপর আর কখনও কাঁদতে হবে না। আমার সব দুঃখ শেষ হয়ে গেছে।”

তোহা বিস্ময় নিয়ে বলল,” সব দুঃখ শেষ হয়ে গেছে?”

আমীর তোহার হাত ধরে বলল,” হ্যাঁ। সারাজীবন সুখে থাকার গ্রিনকার্ড পেয়ে গেছি। আমার আর কোনো দুঃখ নেই।”

সে তোহার দুইহাত নিয়ে অসংখ্য চুমু দিল। তোহা মায়াবী হেসে বলল,” আপনি একটা পাগল!”

আমীর সাথে সাথে তোহাকে জড়িয়ে ধরল খুব শক্ত করে। এখনও সে কাঁদছে। তার চোখের পানি বাঁধ মানছে না। কেঁদে কেঁদে সে নিজের সব কষ্ট বিসর্জন দিতে চায়। আজ থেকে তোহাকে হারানোর কোনো ভয় নেই। সে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তোহা দুইহাত আমীরের পিঠের উপর রেখে বলল,” সারাজীবন এভাবেই ভালোবাসবেন তো আমাকে?”

আমীর ভারী গলায় প্রশ্ন করল,” কোনো সন্দেহ আছে?”

তোহা নিশ্চিত স্বরে বলল,” না, একদম নেই।”

সে আরও গভীরভাবে আলিঙ্গন করল আমীরকে। তারা ঝলমলে আকাশের নীচে বিশাল ধরণীর বুকে একরাশ স্নিগ্ধতা নিয়ে শুরু হলো দু’টি ভালোবাসাময় জীবনের একটি নতুন উপ্যাখ্যান।

______________
সমাপ্ত।
® Sidratul Muntaz