#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
আকাশটা সাদা, ফ্যাকাসে। ভোর ছয়টায় যেমন আকাশ কল্পনা করা যায়,তেমনের মতোই আকাশটা। একটা দুটো মেঘ আলপনা আঁকছে আকাশের বুকে। অদ্ভুত সুন্দর সেই সাদা রঙের আলপনা। বাতাসটাও শীতল, নরম তুলোর মতোই আদুরে। ভোরের হিম নামার পর মুহূর্তে বাতাস যেমন হয়,ঠিক তেমন। তবে সেই বাতাসেও আভা ঘামছে। কপালের উপর কয়েক ফোঁটা মুক্ত ঘাম জমেছে। নাকের উপরদিকটায়ও পানির উপস্থিতি। পানিভর্তি মাটির কলসির বাইরে যেমন বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা জমে, তেমনই। আহনাফ এখনো আভার দিকে তাঁকায় নি।তার চোঁখের দৃষ্টি সামনে। রাগ করেছে খুব, মুখে স্পষ্ট। আভা এক ঢোক গিললো। গলা শুকিয়ে আসছিলো এতক্ষণ। আভা আহনাফের নির্লিপ্ততা দেখে আবারও বললো,
— ” সরি। আসলে সবাই আপনার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি কিভাবে আসতাম সেখানে বলেন? মানুষ ভাববে আমি বর পাগল। বিষয়টা খারাপ দেখাবে না, বলুন?
আহনাফের কপালের রগ ফুলে উঠলো। মুখের অভিব্যক্তি মুহূর্তের মধ্যেই পরিবর্তন হয়ে গেলো। চট করে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত দিলো আহনাফ। কোনো কথা বলবে না এই মেয়ের সাথে। তবে এই মিছে মিছে পণ যে খুব বেশিক্ষণ টিকবে না সেটা ও মানতেই নারাজ। আভা আহনাফকে গাড়ি ইঞ্জিন চালু করতে দেখে খুব বেশি অবাক হলো না। ও সাতপাঁচ চিন্তা না করে আহনাফের দরজা খুলে পাশের সিটটায় ধাম করে বসে গেলো। দরজা খুলার শব্দে আহনাফ পাশ ফিরে তাঁকালো। আভা গাল ফুলিয়ে আহনাফের দিকেই তাঁকিয়ে আছে। আহনাফ আভার দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শীতল গলায় শোধালো,
— ” দেরি হচ্ছে আমার। নামো গাড়ি থেকে। ”
আভা নাছোড়বান্দার মত বসেই রইলো। আহনাফের শীতল গলায় বলা ছোটখাটো আগ্নেয়গিরির একবিন্দুও পরোয়া করলো না ও। আহনাফ সিটে হেলান দিলো। এক হাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে চোঁখ বুজলো। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আভা আহনাফের স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে বাচ্চামো কণ্ঠে বললো,
— ” সরি বললাম তো। এত রাগ কিসের,হু?
আহনাফ এবারও কথা বললো না। চোঁখ’দুটো আগের মতই বুজে রাখা। শুধু চোঁখের পাঁপড়ি খানিক কেঁপে কেঁপে উঠছে। আহনাফের এমন ব্যবহার দেখে আভার ছোট্ট মন হাসফাঁস করে উঠলো। বুকের ভিতরে অভিমানের পাহাড় একটু একটু করে জমতেই আভা এক তপ্ত নিঃশ্বাস নিয়ে ভারী কণ্ঠে বললো,
–” থাকুন আপনি আপনার রাগ নিয়ে। আমি কখনোই আপনার রাগ ভাঙাতে আসবো না। এই,বলে দিলাম। সবসময় রাগ ভালো না। বুঝলেন? ”
আভা কথাটা বলেই হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোঁখের কোণে জমে থাকা জল মুছে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। গাড়ির দরজা খুলতেই হুট করে আহনাফ আভার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে আভাকে নিজের বুকের উপর ফেলে দিলো। দ্রুত ব্যাপারটা ঘটায় আভা থতমত খেয়ে গেলো। পরিস্থিতি বুঝতে তার খানিক সময় তো লাগলো’ই। আভার এক হাত আহনাফের বুকের উপর, অন্য হাত আহনাফের কোমরের টিশার্ট খামচে ধরলো। কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো সব উলোটপালোট হয়ে আহনাফের বুকে ছড়িয়ে পড়লো।
আহনাফ আভার দিকে তাঁকিয়ে আস্তে করে একহাত দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। আভা মাথা তুলে আহনাফের দিকে তাঁকালো। দু’চোখে তার এখনো অভিমানেরা খেলা করছে। আহনাফ মুঁচকি হেসে আভার চুল কানের পিছনে গুজে দিলো। একজন দায়িত্বশীল প্রেমিকের মত আঙুল দিয়ে আভার চোঁখের জল মুছে দিলো। নিজ চোখে আস্ত এক মায়ার সাগর পুষে নিয়ে বললো,
— ” এই সামান্য কারণে চোঁখের জল ফেলতে হয়? কিছু জল স্টকে রেখে দেওয়া ভালো, সুখের সময় কাজে লাগবে।”
আহনাফের কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। তবে,কি ছিলো? যার কারণে আভার শক্ত রাগ, আদুরে অভিমান এক নিমিষেই দ্রবীভূত হয়ে গেলো? আভা থুতনি নামিয়ে ফেললো। আস্তে করে বললো,
— ” আপনিই দায়ী এই কান্নার জন্যে। এত রাগ! বাপরে! আর একটু হলেই কেঁদে কেটে সমুদ্র বানিয়ে ফেলতাম আমি। ”
আহনাফ আরো দু একটা কথা বলতে যাবে তার আগেই ওর মুঠোফোন বেজে উঠলো। মুঠোফোনের শব্দ কানে প্রবেশ করতেই আভা তড়িৎ গতিতে সরে এলো আহনাফের কাছ থেকে। অস্থির হয়ে গেলো চাহনি। এই প্রথম,এই প্রথম আহনাফের এত কাছে ছিলো ও। ভাবতেই পেটের ভিতরে গুড়ুম গুড়ুম করছে। সর্বাঙ্গে আড়ষ্ট ভাব ঘিরে ধরেছে। মুখখানা কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ ধারণ করেছে। উফ! আহনাফের সামনে আর বসে থাকা যাচ্ছে না।
আভা যখন লজ্জার সাগরে হাবুডুবু খেতে মগ্ন তখন আহনাফ ফোন হাতে নিতে নিতে আরো একবার লজ্জা দিলো তাকে,
— “থাক। গাল আর লাল করতে হবে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। সে সম্পর্কে এত গভীরে যাওয়ার কিছু নেই। বি নরমাল। ”
আহনাফ ফোন রিসিভ করলো। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে। আহনাফ ফোন কানে ধরে অপরপাশের মানুষের কথা শুনলো। তারপর গম্ভীর সুরে বললো,
— ” উনাকে বিকেলের দিকে আসতে বলো। আমি এসেই প্রথমে উনাকে দেখে নিবো। এখন গাড়িতে আছি আমি। ”
আহনাফ ফোন কেটে সামনে রাখলো। আভাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আভা বলে উঠলো,
— ” সাবধানে যাবেন। আর হ্যাঁ, গাড়িতে ঘুম পেলে রাস্তায় কোনো রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেয়ে নিবেন। ঘুম ফুড়ুৎ হয়ে যাবে। ঘুম চোঁখ নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। ওকে?”
আহনাফ কিছুক্ষণ আভার দিকে তাঁকিয়ে থাকলো। এই মুহূর্তে আভার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, কোনো বুঝদার মেয়ে তাকে উপদেশ দিচ্ছে। আচানক আহনাফ আভার গাল টেনে দিলো। আভা গালে হাত দিয়ে অবাক চোঁখে আহনাফের দিকে তাঁকালে আহনাফ হেসে বললো,
— ” হুয়াই সো কিউট? ”
আভা হেসে ফেললো। যে হাসিতে আহনাফ মুগ্ধ হয়, বারংবার, বারংবার, বারংবার।
_______________________
খাবার টেবিলে বসে আছে আভাদের পুরো পরিবার। আভার মা সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে মাত্রই চেয়ারে বসলেন। দাদুমনি পালং শাক দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুললেন ভাতের লোকমা। মিনহাজ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। আভার বাবা মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও খাওয়ায় মন দিলেন।
এসবের মধ্যে হুট করে দাদুমনি বলে উঠলেন,
— ” এ জুনায়েদ, আভার তো বাগদান হইয়া গেলো। এখন ওরে বিয়ে দিবি কবে? কিছু ভাবসস ? ”
আভার বাবা মোহাম্মদ.জুনায়েদ ইসলাম ভাতের লোকমা মুখে তুলতেই যাচ্ছিলেন। মায়ের কথা শুনে তার হাত থেমে গেলো। গম্ভীর সুরে তিনি বলেন,
— ” আম্মা, আভার আটারো বছর হয়নি এখনো। আগে ভার্সিটি উঠুক, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে। ”
বিয়ের কথা শুনে আভার হাত থেমে গেলো। বুকের ভিতর এক সর্বগ্রাসী তুফান শুরু হয়ে গেলো। কেনো জানেনা, যখনই তার বিয়ের কথা উঠে তখনই আভা খুব বেশি নার্ভাস হয়ে যায়। এই সমস্যার যথাযথ কারন আভার জানা নেই। হতে পারে, এই সমস্যা সকল হবু বউদের জন্যেই কার্যকর। দাদুমনি একটু থেমে শ্বাস নিয়ে বলেন,
— ” তয়, মেয়েরে এত জলদি বাগদান করে দিলি কেন? বিয়ের কদিন আগেই নাহয় বাগদান করতি। এত তাড়ার কি আছিল? ”
জুনায়েদ একবার স্ত্রীর দিকে তাঁকালেন। আভার মা নির্দ্বিধায় ভাত খাচ্ছেন। যেন এই ব্যাপারে তার মত প্রকাশের কোনো ইচ্ছাই নেই। এই বাগদান নিয়ে মেয়ের বাবারই তো যত তাড়াহুড়ো ছিলো। সময় থাকতেই মেয়ে পর হয়ে যাচ্ছে, আভার মা এসব ভেবেই নিজের স্বামীর উপর রেগে যেতে লাগলেন। জুনায়েদ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
— ” আহনাফের পরিবার খুব তাগাদা দিচ্ছিলো। তাই বাগদান করিয়ে রেখেছি। সময় আসলে বিয়ের কথাটাও পাঁকা হবে। মেয়ে আমার এখনো ছোট, আম্মা। ”
দাদুমনির নজর এবার মিনহাজের উপর পড়লো। মিনহাজকে শান্ত থাকতে দেখে দাদুমনি এবার কথা তুললেন,
— ” মেয়ের নাহয় বিয়ের বয়স হয়নি। তা ছেলেরও কি বয়স হয়নি? মিনহাজের তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে। ওরে বিয়ে দিবি কবে? ”
দাদুমনির কথা শুনে মিনহাজের হেঁচকি উঠে গেলো। নাকে মুখে পানি উঠে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেলো তার। আভা তাড়াহুড়ো করে মিনহাজের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। মিনহাজ চকিতে ছুঁ মেরে আভার থেকে পানি নিয়ে এক ঢোকে সমস্ত পানি খেয়ে নিলো। মিনহাজের ওমন অদ্ভুত আচরনে টেবিলে বসে থাকা সবাই হতবম্ব। তবে,জুনায়েদ ছেলের এহেন আচরনেও স্বাভাবিক হয়ে বসে রইলেন। মিনহাজার বিয়ের কথা মায়ের আগে তার মাথায় এসেছিলো। ছেলের সামনে বিয়ের কথা তুলেছেন বটে। তবে ছেলে তার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।
‘ বিয়ে ‘ বিষয়টা মনঘটিত ব্যাপার। তাই এই বিষয়টি জুনায়েদ ছেলে-মেয়ে কারো উপরই চাপিয়ে দেননি। বাবা হিসেবে তারও সন্তানের খুশির দিকটা খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়।
দাদুমনি মিনহাজের এমন আচরণে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন না। বরং ধীরে সুস্থে জিজ্ঞেস করলেন,
— ” দাদু, তোমার কোনো মেয়ে পছন্দ আছে? থাকলে আমারে বলতে পারো। আমাদের তোমার পছন্দের উপর পুরা সমর্থন আছে। ”
মিনহাজ মাথা নিচু করে আরো এক ঢোক পানি খেলো। মা-বাবার, বোন, দাদুর সামনে নিজের বিয়ের কথা বলতে আড়ষ্টভাব কাজ করছে তার। তবুও বলতে হবে। কারণ, সে একজন প্রেমিক। প্রেমিকার খুশির দিকটাও তাকে বিবেচনা করতে হয়। আর তার প্রেমিকা যে তার সান্নিধ্যেই নিজেকে সবচেয়ে বেশি সুখী মনে করে,সেটা সে হলপ করে বলতে পারে।
— ” দাদু, আছে কোনো পছন্দের মেয়ে? বলো? ”
দাদুমনির কথায় মিনহাজ একটু থেমে নিজেকে ধাতস্থ করলো। ভারী নিঃশ্বাসের বহর ত্যাগ করে বললো,
— ” পছন্দের কিনা সেটা বলতে পারিনা। তবে একজনকে ভীষন ভালোবাসি। বিয়ে করলে তাকেই করবো।”
#চলবে
#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
— ” পছন্দের কিনা সেটা বলতে পারিনা। তবে একজনকে ভীষন ভালোবাসি। বিয়ে করলে তাকেই
করবো। ”
মিনহাজের কথা শুনে সম্পূর্ণ রুমটায় কয়েক মিনিট নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। একে একে সবার চোঁখ মিনহাজের উপর নিক্ষেপিত হলো। মিনহাজ এবার দাদুমনির দিকে তাঁকালো। চোঁখের দৃষ্টি গভীর। মনে আছে, প্রবল ইচ্ছাশক্তি। প্রিয়তমাকে আপন করে নেওয়ার মত প্রবল ইচ্ছাশক্তি। দাদুমনি মিনহাজের থেকে চোখ আলগোছে সরিয়ে নিজের ছেলের দিকে তাকালেন। জুনায়েদ এতক্ষণ মায়ের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। মা তার দিকে তাকাতেই জুনায়েদ গম্ভীর মুখে ভাতের থালায় হাত দিলেন। রুই মাছের তরকারি ভাতের সাথে মাখাতে মাখাতে বললেন,
— ” মেয়েটা কে? নাম-ধাম কি? কি করে? ”
মিনহাজ বাবার দিকে শুঁকনো চোঁখে তাকিয়ে রইলো। কি থেকে কি বলবে কোনো ঠায়-ঠিকানা পাচ্ছে না। বাবা কি রেগে আছেন, নাকি এই সম্পর্ক নিয়ে তার আপত্তি আছে? কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। ছেলেকে চুপ থাকতে দেখে জুনায়েদ ভাত মাখা হাত টেবিলে ভর দিয়ে রেখে মিনহাজের দিকে তাঁকালেন। থমথমে কণ্ঠে বললেন,
— ” মিনহাজ,কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমায়? ”
মিনহাজ এক ঢোক গিললো। বাবাকে যে যথেষ্ট সম্মান করে। তাই বাবাকে আর অপেক্ষা না করিয়ে চাঁপা কণ্ঠে বললো,
–” মেয়েটা আমাদের ভার্সিটির ছিলো।আমি যখন মাস্টারে পড়তাম তখন ও ফার্স্ট সেমিস্টারে ছিলো। এখন একই ভার্সিটিতে থার্ড সেমিস্টারে পড়ছে। নাম আরোহী। খুব ভালো মেয়ে, বাবা। আমাদের সাথে চলনসই। সবথেকে বড় কথা, আমি ওর সাথে সুখে থাকবো। বিয়ে করার জন্যে সেটাই কি বড় কারন নয়,বাবা? ”
জুনায়েদ খুব শান্ত ভঙ্গিতে ছেলের কথা শুনলেন। মিনহাজের কথা শেষ হতেই আবারও খাওয়ায় মন দিলেন তিনি। মিনহাজ বাবার এমন নির্লিপ্ততা দেখে ছোট্ট করে শ্বাস
ফেললো। বাবা কি তবে মেনে নিবেন না? নাকি, সে বাবাকে ভালো করে বুঝাতে পারেনি? নাকি, কি? মিনহাজ একবার দাদুমনির দিকে তাকালো। দাদুমনি নিজেও বাবার এমন ব্যাবহারে নিশ্চুপ হয়ে আছেন। মিনহাজ শেষ ভরসা নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। মিনহাজের মা, রেহেনা ছেলেকে চোখ দিকে আশ্বাস দিলেন। তবে, তিনি নিজেও এই বিষয়ে বেশ সন্দিহান। ওদের বাবা একবার যে সিদ্ধান্ত নেন, তার বিপক্ষে কথা বলার সাধ্য এঘরে কারো নেই। মিনহাজ লম্বা করে একটা শ্বাস টানলো। যা করার, যা বলার তা ওর নিজেকেই করতে হবে। কারো উপর ভরসা করলে চলবে না। মিনহাজ এবার বাবার দিকে তাকালো। মিহি সুরে ডাক দিলো,
— ” বাবা? ”
জুনায়েদ মিনহাজের কথার উত্তরে জবাব দিলেন না। বরং খেতে খেতে বললেন,
— ” আমরা কাল ঢাকা ফিরে যাচ্ছি।”
টেবিলে বসে থাকা সবাই এমন কথায় হতবম্ব হয়ে গেলো। মিনহাজ না চাইতেও ব্যর্থতার নিঃশ্বাস ফেললো। বাবাকে আরো কিছু কথা বলতে যাবে, তবে তা আর বলা হলো না। বাবা তার কথার ফাঁকেই দাদুমনির উদ্দেশ্যে বললেন,
— ” আম্মা, তোমার ব্যাগ রেডি করে রেখো। তুমিও যাবে আমার সঙ্গে। মেয়ে দেখতে যাবো, ছেলের দাদী থাকবে না। সেটা খারাপ দেখাবে। ”
‘ মেয়ে দেখতে যাবো ‘ কথাটা টেবিলে বসে থাকা সবার কানকে জ্বালাপালা করে ফেললো। মিনহাজের রাগ তরতর করে বেড়ে যেতে লাগলো। সে তো একবার বলেছে, তার একজনকে পছন্দ। তবুও বাবা কি করে এমন কথা বলতে পারেন? তবে মনের ভিতরকার রাগ মনের মাঝেই পুষে রাখলো সে। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা তাকে বেয়াদপ হতে দিলো না। মিনহাজ খাবার হাতে বসে রইলো ঠায়। মন চাচ্ছে, টেবিল থেকে উঠে যেতে। কিন্তু পারছে না। মনের বিপক্ষে থাকা বিবেক বাঁধা দিচ্ছে তাকে। জুনায়েদ ছেলের এমন অবস্থা দেখে আড়ালে হাসলেন। অতঃপর ছেলের দিকে চিরচেনা গম্ভীর চাহনি রেখে বললেন,
— ” মেয়েটার বাসার ঠিকানা কি? ”
মিনহাজ স্থব্দ হয়ে গেলো। চোখ বড়বড় করে বাবার দিকে তাকালো। বাবা রাজি হয়ে গেছেন, বিশ্বাস হচ্ছে না তার। জুনায়েদ ছেলের এমন হতবম্ব অবস্থা দেখে খুব মজা পেলেন। আবার খানিক গর্বও হলো তার। তার এহেন আচরনেও ছেলে চুপ থেকেছে। এক রত্তি কথা বাড়ায় নি। ছেলের তার প্রতি বাধ্যতা দেখে চোখটা ভরে এলো তার। তবে সেটা সবাই দেখার আগেই নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। কিছুসময় পর জুনায়েদ আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
— ” বলো,ঠিকানা কি? নাকি তুমি মেয়েটার বাসার ঠিকানা জানো না? ”
মিনহাজ হেসে ফেললো। চেয়ার থেকে উঠে এসে বাবাকে জোরে জরিয়ে ধরলো। সেই সাথে চোখ থেকে গড়ালো ছোট্ট এক ফোঁটা জল। অতি সুখের আবেশে সে নিজেকে ঠিক সামলে উঠতে পারছে না। জুনায়েদ নিজেও মুচকি হেসে ছেলের পিঠে হাত রাখলেন। মিনহাজ কিছুসময় পর শান্ত হয়ে চোখ মুছে আস্তে করে বাবাকে ছেড়ে দিলো। চুপচাপ চেয়ারে এসে বসে পড়লো ও। হুট করে বাবাকে জড়িয়ে ধরায় একটু লজ্জা লাগছে। তবে, তার থেকে অধিক শান্তি লাগছে। বাবাকে কখনোই এমন করে জড়িয়ে ধরে নি সে। কখনোই নিজের খুশির খাতা বাবার সামনে খুলেনি। তবে আজ? আজ সব বাঁধা, সমস্ত জড়তা ক্ষয় হয়ে গেলো। অনুভূতির প্রকাশ এতটা মিষ্টি হয়? এতটা শান্তিময় হয়?
______________________
আভা নিজের রুমে বসে আছে। চোখে মুখে অপার আনন্দ খেলা করছে তার। সে কত খুশি, সেটা বলে বুঝাতে পারবে না। অবশেষে ভাইয়ের বিয়ে হতে যাচ্ছে। আভার এখন উরাধুরা নাচতে মন চাইছে।
আভার এসব খুশি খুশি ভাবনার মাঝে তার ফোন বেজে উঠলো। আভা একটু বিরক্ত হয়েই ফোন হাতে নিলো। ফোনের স্ক্রিনে আহনাফের নাম্বার দেখেই আভার সেই বিরক্ত ভাব কেটে গেলো। চোখে মুখে মুগ্ধতা আঁচড় কাটলো। আভা ফোন রিসিভ করে কানে লাগিয়ে অত্যন্ত উচ্ছসিত গলায় সালাম দিলো।
আভার কণ্ঠে উত্তেজনায় ছোঁয়া বুঝতে পেরে আহনাফের মনটা ভরে গেলো। সে জিজ্ঞেস করলো,
— ” কি ব্যাপার? আজকে এত খুশি? ”
আভা হেঁসে হেঁসে বললো,
— ” ভাইয়ার বিয়ে লেগে যাচ্ছে। আপনি বুঝতে পারছেন, আমাদের বাসায় ভাবী আসবে। ওয়াও। গ্রেট হবে ব্যাপারটা, তাইনা? ”
আহনাফ মাত্রই চেম্বার থেকে ঘরে আসলো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় সটান করে শুয়ে বললো,
— ” শুধু আমারই ফুটা কপাল। কত আগ থেকে বিয়ের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু আমার নির্দয় শশুরমশাইয়ের দয়া হয়না। নিজের কাছে না রেখে মেয়েকে আমার কাছে তুলে দিলেই তো হয়। তার ঘর থেকে মেয়ে এনে আমার ঘরে শোপিসের মত সাজিয়ে রাখতাম। উফ। ভাবতেই বিয়ে করতে মন চাচ্ছে। ”
আভা আহনাফের এমন উদ্ভট কথাবার্তার সাথে পরিচিত। তবুও কেন যেন আহনাফের মুখে বিয়ের কথা শুনতেই লজ্জায় কুকড়ে যায় ও। মন চায়, লজ্জা নামক বস্তুকে কেটে কুচিকুচি করে নদীতে ভাসিয়ে দিতে। এতে যদি রক্ষে হয়! আভা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— ” আপনার যত আজগুবি চিন্তা ভাবনা! শুনেন, আমার বাবা খুব দয়ালু। নির্দয় না। বুঝলেন? ”
আহনাফ মুচকি হেঁসে বললো,
— ” ইয়াহ! শুধু আমার বেলায়’ই তার যত নির্দয় কাজ-কারবার। ”
আভা মুচকি হেঁসে চুপ করে রইলো। আজ খুব করে মন চাচ্ছে, শুধু আহনাফের কথা শুনতে। আহনাফের কথার বাইরে কোনো আওয়াজ, কোনো বাঁধা, কোনো শোরগোল না, এমনকি তার নিজের কণ্ঠস্বর না। শুধুই আহনাফের কথা! আজকাল, আহনাফকে নিয়ে ওর অবচেতন মন নানা কল্পনা-জল্পনা সাজায়। লজ্জার বানে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আহনাফকে নিয়ে ভাবে। কেনো, কারণ, কিন্তু, কিছুই জানে না । শুধু জানে, তার আহনাফকে ভালো লাগে। আহনাফের একেকটা কথা, রাগ, আচরন সব, সব ভালো লাগে। এই ভালো লাগার কারণ কি? এটা কি নিছক’ই ভালো লাগা নাকি অন্য?
#চলবে।