ওয়েডিং স্টোরি পর্ব-৩৬+৩৭

0
665

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

‘ তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা
আমি তোমাকে গড়ি, ভেঙেচুরে শতবার! ‘

রুফটপে গান বাজছে। সকল মেয়েজাতি নেমেছে রং খেলায়। বাচ্চাদের হাতে লম্বা লম্বা কালার গান। সবার মুখে আনন্দ-উচ্ছাস! আভা ও তার সঙ্গপাঙ্গ একপাশে দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ রং খেলতে খেলতে ক্লান্ত তারা। হাসাহাসির এক পর্যায়ে আভা বলে উঠলো,
— ” আমি ড্রেস চেঞ্জ করে আসছি। তোরাও চেঞ্জ করে আমার রুমে চলে আসিস। গল্প করা যাবে। ”
সবাই সায় দিলো আভার কথায়। আসলে, কারোর শরীরেই এখন আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। সব নিঃশেষ হয়ে শূন্যের কোটায়। আভা জামার রং ঝাড়তে ঝাড়তে নিচে নেমে গেলো।
আহনাফের রুম পেরিয়েই আভার রুম। আভা অন্যমনস্ক হয়ে আহনাফের রুম পেরিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছিল। কিন্তু, হুট করে ঘটলো এক বিপত্তি। আচানক, আহনাফের রুমের দরজা খুলে গেল। আভা সেদিকে তাকাতেই আহনাফ হাত বাড়িয়ে আভাকে হেচকা টান দিয়ে নিজের রুমে নিয়ে এলো। আভা যখন সম্পূর্ণ অবাক, তখন আহনাফ দরজায় সিটকিনি আটকে দিলো। সিটকিনির শব্দে আভার ঘোর ভাঙলো। কি হচ্ছে, সবই ধীরে ধীরে বোধগম্য হলো। আভা আহনাফের দিকে তাকালো। চোখে রাগ ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে। এই লোকের কবে বুদ্ধি হবে? কখন কোন কাজ করতে হয়, সেটা কখন বুঝতে শিখবেন? এই যে একটু আগে, ওভাবে টেনে নিয়ে আসলো, কেউ দেখে ফেললে? ছিঃ! আভা বললো,
— ” আপনি কি কখনোই শুধরাবেন না? কেউ দেখে নিলে কি হতো? আপনার তো কিছু না, নাক কাটা যাবে আমার! ”
আভার কণ্ঠ থেকে রাগ বালির মত ঝরে ঝরে পড়ছে। তবে, আহনাফ স্বভাবসুলভ সেসব পাত্তা দিলো না। বরং, আভার দিকে পূর্বের চেয়ে আরো একটু ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
— ” সবাই আমার বউকে রং মাখালো। শুধু আমিই বাদ পড়ে গেলাম। বিষয়টা খারাপ দেখায়। তো, এখন আমি…? ”
— ” এখন আপনি? ”
আভা ভ্রু উচুঁ করে বললো। আহনাফ আভার কোমরে নিজের এক হাত গলিয়ে দিলো। আভার কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলেও, মুখখানা থমথমে করেই রাখলো। আহনাফ আভার চোখের দিকে তাকিয়ে অন্য হাত দিয়ে পাশে থাকা রঙের ঢালায় হাত ডুবিয়ে দিলো। পুরুষালি হাতে মাখামাখি হলো, গোলাপি রং। আহনাফ সেই রঙ মাখা হাত নিজের দুগালে ছোঁয়ালো। আভা ভ্রু কুঁচকে আহনাফের একেকটা গতিবিধি লক্ষ্য করছে। কি করতে চাইছে এই লোক? বুঝা মুশকিল! আহনাফের গাল ভর্তি রঙ। যেনো মাত্রই রঙের নদীতে গোসল সেরে এসেছে ও। রঙ মাখা অবস্থায় আহনাফকে মারাত্মক সুন্দর লাগছে। আভার কুঁচকালো ভ্রু ক্রমশ স্বাভাবিক হলো। চোখে ভর করলো, প্রেমিক পুরুষ নামক মুগ্ধতা! আহনাফের গায়ে জড়ানো সাদা রঙের টিশার্ট রঙের ছোপ ছোপ ছিঁটে’তে গোলাপি হচ্ছে। আহনাফ আভার দিকে তাকিয়ে আছে, নিস্পলক! চোখের পল্লব ফেলছে ধীরে ধীরে। আহনাফ ধীরে ধীরে নিজের মুখটা আভার দিকে এগিয়ে আনলো। আভা কিঞ্চিৎ ভয় পেলো। তবে, আহনাফের প্রতি জন্মানো এতদিনের বিশ্বাস আভার ভয়কে কাবু করে ফেললো। আভা আলগোছে বুজে রাখা চোখ নিয়ে বললো,
— ” ক.কি ক.ক.করছেন? ”
আহনাফ উত্তর দিল না। আসলে, কথাটা কানে প্রবেশ করে নি তার। মত্ত হয়ে গেছে সে আভাতে। আহনাফ চোখ বন্ধ করে নিজের গাল আভার গালে ঘষলো। আভা কেঁপে উঠে চোখ খিঁচলো। আহনাফের গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ফুটছে আভার গালে। আভা এতে ব্যথা পাচ্ছে। তবে, সেই ব্যথা চাপা পড়ছে সুপ্ত এক ভালোলাগায়। মনে হচ্ছে, আভা নিজের মাঝে নেই। আড়াল হয়ে গেছে এই পৃথিবী থেকে। মত্ত হয়ে গেছে তার ‘ উনাতে ‘ ! আহনাফ আভার অপর গালেও নিজের গাল ঘষলো। আভা আবারও কেঁপে উঠলো। চোখ খিঁচে খামচে ধরলো আহনাফের বুকের কাছের টিশার্ট। আহনাফ মুচকি হাসলো। ধীরে ধীরে সরে এলো আভার থেকে। তাকালো আভার খিঁচে রাখা চোখের দিকে। আভার গালে লজ্জার রঙ! তাতে মেশানো দু’ফোঁটা আবির! উফ! মারাত্মক সুন্দর সেই মুখশ্রী। আভা ধীরে ধীরে চোখ খুললো। আহনাফ আভার কানে ফিসফিসালো,
— ” যাও, রাঙিয়ে দিলাম তোমায়, আমার রঙে। আমার ভালোবাসার রঙে! যে রঙ কখনোই ক্ষয় হওয়ার নয়। যে ভালোবাসা কখনো নিঃশেষ হওয়ার নয! ”
আভা আহনাফের চোখে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না। আহনাফের বুকে ধাক্কা দিয়ে তাকে একদমে সরিয়ে ফেললো। অতঃপর, এক দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো সেই হৃদ কাঁপানো ঘর থেকে। আহনাফ সেদিকে তাকিয়ে শুধু হাসলো। মাথার ঘন চুলে হাত চালিয়ে বিড়বিড় করলো,
— ” তুমি ফেঁসে গেছো, বউফ্রেন্ড! এবার শুধু মুখে বলার পালা। আমি অপেক্ষা করছি, সেই সুন্দর মুহূর্তের! খুব করে অপেক্ষা করছি! ”
_____________________
আজ হলুদের দিন। আগামীকাল বিয়ে। তারপরই, সব আয়োজন ফিকে। মিনহাজের ঘরে আসবে টুকটুকে এক নারী! তার ছোট্ট দুনিয়া মেতে উঠবে সেই নারীরা নূপুরের ঝনঝনাতে। তার এলোমেলো দুনিয়া আবারও গোছালো হবে,সেই কোমলবতি নারীর নরম নরম হাতে। মিনহাজ রেডি হয়ে নিচে নামলো।
হলুদের স্টেজে কনে আর বর পাশাপশি বসবে। মাঝখানে থাকবে হলুদ রঙের পর্দা। এই পর্দা দ্বারাই কনে,বরকে আলাদা করা হবে। দারুন নিয়ম! কিন্তু নিয়মটা যে মিনহাজের ভালো লাগলো না। কে বের করেছে এই অদ্ভুত নিয়ম? পাশাপশি বসবো, কিন্তু মুখ দেখব না। এ কেমন অত্যাচার! মিনহাজ মুখখানা হুতুম পেঁচার মত করে বসে রইলো।
হলুদের দিনে, আজ সবাই হলুদ আর সাদার মধ্যে লেহেঙ্গা পড়েছে। মেয়েরা সাদা টপস, হলুদ ঘাগড়া, সাথে জর্জেটের হলুদ ওড়না। ছেলেরা সাদা পাঞ্জাবি, তার উপর হলুদ কটি, সাথে সাদা পায়জামা। সবাই ম্যাচ করে জামা-কাপড় পড়েছে। আভা একহাত দিয়ে লেহেঙ্গা সামলিয়ে হেঁটে আসলো স্টেজে। ভাইকে দুগালে হলুদ লাগিয়ে দাঁত কেলালো,
— ” হলুদ লাগলাম।এবার দোয়া দাও। ”
মিনহাজ ভ্রু উচুঁ করে ডান হাত আভার মাথার উপর রেখে হাবিজাবি বিড়বিড় করে বললো,
— ” যা দিলাম। এবার বিদায় হ। ”
আভা মাথার ওপর থাকা মিনহাজের হাত এক টানে সরিয়ে ফেললো। মুখ ফুলিয়ে বললো,
— ” তোমার মুখে বলা দোয়া চায়নি। এত কষ্ট করে তোমাকে হলুদ লাগালাম। দোয়া হিসেবে, টাকা দাও। ”
মিনহাজ বিরক্ত চোখে তাকালো। মুখে কৃত্রিম রাগ নিয়ে বললো,
— ” কোনো টাকা না। ফুট এখান থেকে। ”
আভা মুখ কালো করে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। যাওয়ার আগে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কালো মুখে বললো,
— ” তোমার মানিব্যাগ ফাঁকা হোক, তোমার বউ তোমাকে ফতুর করে দিক। আমিন, আমিন। ”
আভা চলে গেলো। মিনহাজ কিছু বললো না, হাসলো শুধু!

আভা গল্প করছে কয়েকটা মেয়ের সাথে। দূরে একপাশে দাড়িয়ে আহনাফের মা, আভার মা, আরো দুজন মহিলা গল্প করছেন। এই বিয়েতে অ্যাটেন্ড করার কারণে, আহনাফ, আর ওর বাবা হসপিটাল কদিন অন্যের দায়িত্বে রেখে এখানে এসেছেন। তবে, এখানেও তাদের ডিরেকশনের কাজটা অনলাইনে করতে হচ্ছে। আর পেশেন্ট দেখার কাজ, এ কদিন অন্যের দায়িত্বে দিয়ে এসেছেন। তবে, সবকিছু এত সহজ মনে হলেও, ব্যাপারটা মোটেই সহজ না। এজন্যে, দুজনকেই বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। তবে, আভার বাবার অতি মাত্রার অনুরোধের কাছে তাদের সব কাজ হার মানতে বাধ্য হয়েছে।
আভা সবার সাথে গল্প করলেও তার চোখদুটি আহনাফকে খুঁজছে! কোথায় গেলেন উনি? আভা চারপাশে তাকালো। নাহ, নেই তো! আভা হতাশ হয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
— ” আমার তৃষ্ণা পেয়েছে। ঠান্ডা কিছু খেয়ে আসি। তোরা গল্প কর। ”
আভা চলে এলো ওদের থেকে।
দুজন স্টাফরা সবাইকে কোল্ড ড্রিংকস সার্ভ করছে। আভা ওদের থেকে এক গ্লাস কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে হাঁটা ধরলো সামনে। একসময় পা স্থির হলো আভার। দাঁড়ালো একপাশে। আহনাফ দাড়িয়ে আছে, একটু দূরে। নিজের বাবার সাথে কথা বলছে। আহনাফকে কথা বলতে দেখে আভা আর এগুলো না। হেঁটে অন্যপাশে চলে গেলো।

— “তোমায় ভয়াবহ ‘ আমিময় ‘ লাগছে, মিস বউফ্রেন্ড! ”
কানের কাছে আহনাফের ওমন ঝুঁকে কথা বলতে দেখে আভা তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়ালো। খানিক ভয় পেয়ে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফের ঠোঁটে ঘায়েল করা মুচকি হাসি। যা দেখে, আভা অজান্তেই গলে গেল। কোল্ড ড্রিংকসে ঠোঁট দ্বারা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ” ‘ আমিময় ‘ মানে? ”
আহনাফ আভার দিকে আরও একটু ঘন হয়ে দাঁড়ালো। আভার ছটফটে চোখে চোখ রেখে বললো,
— ” আমিময় মনে আমার একান্ত ব্যক্তিগত নারী, আমার সর্বস্ব, আমার বুকের স্পন্দন, আমার নিঃশ্বাস, আমার হৃদয়রানী।আমিময় মানে, আভা নামক এই আস্ত মেয়েটাই। যার অস্থিত্ব আমার মনের প্রতিটা অঞ্চল জুড়ে। ”

আভা পুনরায় কাঁপলো। আহনাফ ওমন করে কথা বলেন কেনো? সে কি জানে না, তার ওমন কথা শুনে আভার দম বন্ধ হয়ে আসে। বুকের ভিতর তবলা বাজে। নৃত্য করতে থাকে তার মনের প্রতিটা উচুঁ নিচু স্তর। হয়তো সে জানে। আর জানে বলেই তার এমন ব্যবহার! আভাকে নিজের ওমন কথা দ্বারাই মেরে ফেলতে চান, পণটা যেমন এরূপ!

— ” হ্যাই, রাত্রি! ”
পিছন থেকে পুরুষালি ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে আভা আর আহনাফ দুজনই পিছন ফিরলো। কে ডাকলো আভাকে?

#চলবে

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

— ” হ্যাই, রাত্রি! ”
পিছন থেকে পুরুষালি ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে আভা আর আহনাফ দুজনই পিছন ফিরলো। কে ডাকলো আভাকে?
কিন্তু, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলের দিকে তাকিয়েই আহনাফের মুখ শক্ত হয়ে গেলো। চোখে ঝিলিক দিলো, সুপ্ত রাগের আভাস! আভা নিজেও চিনতে পারলো না সেই শ্যামবর্ণের ছেলেকে! ছেলেটা মৃদ হাসি নিয়ে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। আহনাফের দিকে একনজর তাকিয়ে আভার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” হ্যাই, আমি নুহাশ। মিনহাজের বন্ধু। ”
‘ মিনহাজের বন্ধু ‘ কথাটা শুনে আভা তেমন অবাক না হলেও, অবাক হলো আহনাফ। নুহাশের দিকে তাকালো আহনাফ। চোখে প্রশ্নের ছাপ! জিজ্ঞেস করলো,
— ” তুই মিনহাজের বন্ধু? ”
নুহাশ হেসে উত্তর করলো,
— ” কেনো? হতে পারি না? ”
আহনাফ আর ব্যাপারটা ঘাটালো না। আভার দিকে চেয়ে থমথমে কণ্ঠে বলল,
— ” এখান থেকে চলো, আভা। আমার তোমার সাথে কথা আছে। ”
আভা আহনাফের চোখে তাকিয়ে বুঝলো, আহনাফ এই মুহূর্তে মারাত্মক রেগে আছে। তাকে এখন হাবিজাবি প্রশ্ন করা মানেই বিপদ! আর সিংহের রাগের কাছে বরাবরই আভা পরাজিত। তাই, নুহাশের দিকে চেয়ে সৌজন্যসুলভ বললো,
— ” আপনি কোল্ড ড্রিংকস নিবেন? ওদিকটায় আছে। ভাইয়াও আছে সেখানে। এনজয়! ”
নুহাশ হেসে উত্তর করলো,
— ” থ্যাংক ইউ, সুইট লেডি। ”
‘ সুইট লেডি ‘ শব্দটা আহনাফকে রাগানোর জন্যে যথেষ্ট ছিল। সে দাতে দাত চেপে আভাকে বললো,
— ” চলো আমার সাথে। ”
অতঃপর আভাকে টেনে নিয়ে আসলো নুহাশের সামনে থেকে।

ছাদের একপাশে এসে দাঁড়ালো আহনাফ। আভাকেও টেনে নিজের সামনে দাড় করালো। আভা এখনো আহনাফের রাগের কারণ ধরতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। আহনাফের এমন ধোঁয়াশা ব্যাবহার তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। আভা ভয় ভয় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ” আপনি তখন..? ”
— ” অ্যাই লাভ ইউ! ”
আচমকা আহনাফের বলা কথা শুনে আভা থতমত খেয়ে গেল। তবে, অন্যদিনের মত অস্বস্তি হলো না। বরং, উত্তর দিতে মন চাইলো এই বাক্যের। তবে, কোথাও যেন একটা সংকোচ রয়ে গেলো। গলার মাঝেই বাঁধা পড়ে গেলো বহু প্রতীক্ষিত উত্তরটার। আহনাফ আভার দিকে এগিয়ে এসে আভার দুবাহু খামচে ধরলো। আভার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,
— ” তুমি খুব ভালো করেই জান, আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার উপর কেউ নজর দিক, সেটা আমার মোটেও পছন্দ না। নিজেকে কখনোই অন্যের জন্যে এভেইলেবল করে দিবে না। কারণ তুমি আহনাফের চয়েজ। আর আহনাফের চয়েস সবসময় অমূল্য, দুর্লভ! গেট ইট? ”
আভা হতবম্ভের মত আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফের মুখে ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা এই প্রথম শুনেনি ও। এর আগে বহুবার আহনাফ বলেছে সেই শব্দ। তবুও, আজকের বলা শব্দটা অন্যদিনের চেয়ে আলাদা। একদম আলাদা। আভার মনে হচ্ছে, তার কান স্বার্থক! একটা ছেলে তাকে পাগলের মত ভালবাসে, এক মেয়ের কাছে এর চেয়ে বড় পাওনা আর কি থাকতে পারে পারে? আহনাফ আভার চুপ থাকা দেখে আবারও বললো,
— ” সে সামথিং? ”
আভা কাপা কণ্ঠে উত্তর করলো,
— ” কি বলব? ”
— ” তুমি কি এখনো আমায় ভালোবাসতে পারো নি, বউফ্রেন্ড? ”
আভা কেপে উঠলো। আহনাফের কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। যা ওর মধ্যে থাকা সমস্ত ইন্দ্রিয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে। আভা এবার কোনো উত্তর করলো না। কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারছে, আহনাফের প্রতি আভা দুর্বল হয়ে গেছে। ততটা দুর্বল, যতটা দুর্বল হলে আহনাফ নামক মানুষটা আভার আকৃষ্টে পরিণত হতে পারে। আভাকে চুপ থাকতে দেখে আহনাফ একটু কষ্ট পেলো। সে আভার বাহু ছেড়ে দিয়ে পিছন ফিরলো। কোমরে এক হাত রেখে আঙুল দিয়ে কপাল চুলকে শান্ত সুরে বললো,
— “জাস্ট, ফরগেট ইট। কেউ তোমাকে ডাকছে। যাও, দেখে আসো। ”
আভা ছলছল চোখে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ কি তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন? আর কতই বা সহ্য করবেন? একটা মানুষ তোমাকে পাগলের মত ভালবাসে, কিন্তু তার সেই ভালোবাসার বদৌলতে তুমি প্রতিদান স্বরূপ শুধু কষ্টই দিয়ে গেলে।এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে?

— ” আভা, গো ফ্রম হেয়ার। একটু একা থাকতে চাই আমি। প্লিজ। ”
আভা দু একবার ঢোক গিলে কান্না আটকালো। তবুও, এক চিকন জলের রেখা গড়ালো তার চোখে বেয়ে। দুহাত দিয়ে চোখ মুছে আভা চলে এলো সেখান থেকে।
________________
— ” তুই মেয়ে, নাকি? এখনো জিজুকে ভালোবাসি বলিস নি। হাও রুড, ইয়ার! ”
আভা মুখ ভার করে বসে রইলো চেয়ারে। কি বলবে? কিছুই বলার নেই তার। সিনথিয়া এবার বলে উঠলো,
— ” তাহলে,এখন গিয়ে বলে দে। বলে দে যে, আহনাফ তোমাকে দেখলে আমার মনে কুচ কুচ হোতা হে,, কিয়া কারো হাই, কুচ কুচ হোতা হে! ”
সিনথিয়ার ফাটা গলায় গান শুনে রুম জুড়ে হাসির ধুম পড়ে গেলো। তবে, আভা হাসলো না। সেই মুখ ভার করেই বসে রইলো। সাথী উঠে এসে আভার পাশে দাড়ালো। আভার কাধে হাত রেখে ভাবুক গলায় বললো,
— ” একটা প্ল্যান করা যেতে পারে। ”
‘ প্ল্যান ‘ সবাই উৎসুক হয়ে তাকালো সাথীর দিকে। সাথী আভার দিকে চেয়ে হেসে বললো,
— ” একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করলে কেমন হয়? ”
সবার চোখ মুখ উজ্জ্বল হলো। তারা তাচ্ছিল্যের সহিত বলে উঠলো,
— ” আমরা আর সারপ্রাইজ প্ল্যান? ভুলে যা সেসব।সেসব ক্রিয়েটিভ আইডিয়া আমাদের দ্বারা হবে না। ”
তারার কথা শুনে সবাই মুখ লটকালো। আভা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। ভেজা গলায় বললো,
— ” উনি কষ্ট পেয়েছেন আজ। শুধুমাত্র আমার জন্যে। আমার খুব খারাপ লাগছে,ইয়ার। ”

— ” সব কষ্টের দিন শেষ হোক। আহনাফের বউফ্রেন্ড আবার হেসে উঠুক! ওয়ে হয়ে, চাম্মাকচালো! ”
দরজার সামনে থেকে এক পুরুষালি কণ্ঠ শুনে রুমের সব মেয়েরা তাকালো ওদিকে। নুহাশ হাতে বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে। নুহাশকে দেখে আভার মনে পড়ে গেলো, আহনাফের কথা। আহনাফ ইন্ডিরেক্টলি বলেছিল, নুহাশ থেকে দূরে থাকতে। আভা মুখ ফিরিয়ে নিলো। তাকালো আবারও জানালার দিকে। নুহাশ এসে বসলো সোফাতে। বিরিয়ানি চামচ দিয়ে খেতে খেতে বলল,
— ” অ্যাই হেভ অ্যা গ্রেট সারপ্রাইজ প্ল্যান, গাইস! ”
আভা এবার তাকালো নুহাশের দিকে। বাকি সবার চোখ একে একে নিবদ্ধ হলো নুহাশের উপর। নুহাশ বিরিয়ানি প্লেট একপাশে রেখে সবার দিকে ঝুঁকে এলো। ফিসফিস করে বললো,
— ” সমুদ্রের তীর ইজ দ্যা বেস্ট প্লেস ফর লাভার। তোমাদের যা করতে হবে….”
আর শোনা গেলো না কিছু। নুহাদের ফিসফিস আওয়াজে ভাটা পড়লো সমস্ত কথা।
______________________
আজ বিয়ে মিনহাজের। স্টেজে শেরওয়ানি পরে বসে আছে মিনহাজ। তার পাশে লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে আরোহী মাথা নিচু করে আছে। আজ আরোহীর উপর থেকে চোখ সরানো দায় হয়ে পড়ছে মিনহাজের। আরোহীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। এতে আরোহী লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জায় রীতিমত আলুথালু হয়ে আছে। মিনহাজ এমন করে তাকিয়ে আছে কেনো? তার লজ্জা লাগে, জানেনা সে? মিনহাজ সবার অগোচরে আরোহীর কোমর জড়িয়ে ধরলো। আরোহী কেপে উঠলো তাতে। মিনহাজ আরোহীর দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
— ” ভয়ানক লাগছে আজ। এখন শুধু টুপ করে গিলে ফেলার অপেক্ষা, সুন্দরী! ”
ইশ! মিনহাজ কি বলে? একদম যা তা! আরোহী কি গিলে ফেলার জিনিস? মুখে একদম লাগাম নেই। কিন্তু, সবার সামনে মিনহাজকে কিছু বলতেও পারছে না। একদম পুতুল হয়ে বসে আছে স্টেজে। আর মিনহাজ সেই সুযোগটাই লুটছে।

আহনাফ একপাশে দাড়িয়ে আছে। হাতে কোল্ড ড্রিংকস। চোখ ঘুরিয়ে বারবার আভাকেই লক্ষ্য করছে ও। নুহাশ এখানে আছে, তারমানে আভা বিপদে। তাই, আভার উপর সর্বদা নজরদারি করছে ও।

— ” হ্যাই ব্রো! ”
আহনাফের পিঠে এক চাপর মেরে বললো নুহাশ। আহনাফ রক্তচুক্ষ নিয়ে তাকালো নুহাশের দিকে। নুহাশ আভার দিকে চেয়ে বলল,
— ” কেনো মিছেমিছে আভার পিছনে পড়ে আছ, ব্র! আভা তোকে ভালবাসে না। ”
আহনাফ নুহাশের দিকে তাকালো। চোখ বেয়ে যেনো লাভা গড়াচ্ছে। রাগ নিয়ে বললো,
— ” আভা আমাকে ভালোবাসলো কি বাসলো না, সেটা তোকে চিন্তা করতে হবে না। যা, নিজের কাজ কর গিয়ে। ”
নুহাশ হাসলো। বাঁকা হাসি। রিলাক্স হয়ে বললো,
— ” একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যাক, তাহলে। তুই আজ আভাকে সমুদ্রের তীরে বিয়ের জন্যে প্রপোজ করবি। আভা যদি তোর প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করে তবে বুঝবো তোর প্রতি আভার ফিলিংস আছে।আর যদি না করে, তবে…বুঝিসই তো! ”
আহনাফ জানে আভার উত্তর কি হবে! তাও, নুহাশকে এক শিক্ষা দিতে সে রাজি হলো এই চ্যালেঞ্জ-এ।

#চলবে।