#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
পরীক্ষা শেষ হলো দশমিনিট আগে। আভা হল ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছে। তার চোখ’দুটো আহনাফকে খুঁজছে। এখানেই তো ছিলেন, এখন আবার কোথায় গেলেন? হঠাৎ আভার চোখ যায় রাস্তার এক পাশে। আহনাফের গাড়ি মাত্র এসে থামলো রাস্তার মোড়ে। আভা মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে রইলো নিজ জায়গায়। আহনাফ গাড়ি থেকে নেমে এদিকেই আসছে। গায়ে নেভি ব্লু রঙের শার্ট। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা। শার্টের সামনের দুটো বোতাম খুলে রাখা। যার কারণে, আহনাফের পুরুষালি বুক অনেকটাই দৃশ্যমান। আভা একনজর আহনাফকে আপদমস্তক লক্ষ্য করলো। আহনাফ হঠাৎ আভার দিকে তাকাতেই আভা চটজলদি নিজের নজর সরিয়ে ফেললো।এত দিনে বড়জোর আহনাফের দিকে মাত্র কয়েক মিনিট’ই তাকিয়ে থাকতে পেরেছে। সারাক্ষণ আহনাফ ঘুরেফিরে আভার দিকেই তাকিয়ে থাকে। যার কারণে, আহনাফকে প্রাণ ভরে দেখার তেমন একটা সুযোগ হয়না।
আভার এসব ভাবনার মাঝে আহনাফ আভার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আভা অন্যমনস্ক। আহনাফ চারপাশে একবার সতর্ক চোখে তাকিয়ে আভার ডান হাত ধরলো। শক্ত করে, একজন দায়িত্বশীল প্রেমিকের মতন। আভার ধ্যান কাটলো। আহনাফের দিকে একবার তাকিয়ে, নিজের হাতের দিকেও তাকালো। ওর নরম হাতের পাঁচ আঙ্গুল আহনাফের শক্ত, পুরু হাতের মাঝে গুটিশুটি মেরে লুকিয়ে আছে। বড্ড ভালো লাগলো ব্যাপারটা! আহনাফ হাঁটা শুরু করলো হাঁটতে হাঁটতে একবার জিজ্ঞেস করলো,
— ” বউফ্রেন্ড, এক্সাম কেমন ছিলো? সব ঠিকঠাক আনসার করেছো তো? ”
আভা ঘাড় কাত করে আহনাফের দিকে তাকালো। লম্বা করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— ” মোটামুটি ভালো হয়েছে। কিন্তু, চান্স পাবো কিনা বলতে পারছি না। ”
আহনাফ আভার হাত ধরে হেঁটে রাস্তার কাছ গেসে দাঁড়ালো। এখন রাস্তা পাড় হতে হবে। আহনাফ ডানে বামে একবার তাকিয়ে আভার হাত শক্ত করে ধরলো। তারপর সবদিক তাকিয়ে আভাকে নিয়ে রাস্তার মাঝেপথে হেঁটে রাস্তা পাড় হলো। আভাকে নিয়ে আহনাফের এমন সতর্কতা দেখে আভা একটু বেশিই অবাক হলো। বাবার সাথে বাইরে বেরোলে, বাবাও সবসময় এমন করে হাত ধরে রাস্তা পাড় করায়। বাবা তো মেয়েদের সবচেয়ে ভরসার স্থল, তবে কি আহনাফকেও আভা বাবার মতই ভরসা করতে পারে? বলা হয়, বাবার পর স্বামীর স্থান। তবে?
আহনাফ আভাকে গাড়িতে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলো। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করতে করতে বললো,
— ” অ্যাডমিশন পরীক্ষা মোটামুটি হওয়া মানেই খুব ভালো। সো, ডোন্ট ওয়ারী! যেকোনো একটাতে চান্স হয়ে যাবে। কিন্তু প্রবলেম হচ্ছে, ঢাকা মেডিকেলে হলেই হয়। বাড়ীর মেয়ে বাড়িতে থাকবে তখন। ”
আভা চিন্তায় পড়ে গেলো। মুখখানা করুন করে বললো,
— ” কিন্তু যদি, ঢাকার বাইরে চান্স হয়, তবে? ”
আহনাফ আভার এমন কথা শুনে একটু চুপ করে রইলো। গাড়ি স্টার্ট করে ড্রাইভ করতে লাগলো। আভা আহনাফের এমন নিরবতা দেখে আবারও বললো,
— ” বললেন না যে, কি হবে? ”
আহনাফ গাড়ীর সামনের গ্লাসের বাইরে তাকিয়ে গম্ভীর সুরে বললো,
— ” হলে হবে। চান্স যেখানেই হোক, পড়তে যাবে সেখানে। নিজের ক্যারিয়ারটা সবার আগে! ”
আহনাফের কথায় কোনো সংকোচ না থাকলেও আভা খুব করে বুঝতে পারলো, আভা দূরে চলে গেলে আহনাফ কষ্ট পাবে। কথাগুলো আহনাফ আভার ক্যারিয়ারের কথা ভেবে বলেছে। মন থেকে মোটেও বলেনি! আভা কিছুক্ষণ চুপ থেকে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ” আমি ঢাকার বাইরে চলে গেলে,আপনি থাকতে পারবেন? ”
আহনাফ চুপ করে রইলো। এক হাত দিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। অপর হাত দিয়ে একবার কপাল ঘষছে, তো আরেকবার শার্ট কাধের পিছনে ঠেলে দিচ্ছে। আহনাফের এহেন কাণ্ডে আভা বুঝতে পারছে, আহনাফ মুখে যতই বলুক, আভা দূরে গেলে আহনাফ কখনোই সেটা অ্যালাও করবে না। আভা আর কোনো কথা বললো না! ও নিজেও চুপ করে বসে রইলো।
গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। গাড়ির পথ সোজা থাকলেও বেসামাল হলো আহনাফ। আভা দূরে চলে গেলে, সে কি করবে? যাকে সপ্তাহে একবার না দেখলে আহনাফের চলে না, সে কি করে মাসের পর মাস আভাহীন থাকবে? কিন্তু আভার ক্যারিয়ারটাও আগে! আভার ক্যারিয়ার কি করে সে নিজ হাতে নষ্ট করবে? আহনাফ অনেক কিছু ভাবছে, কিন্তু দিনশেষে একটা কথাতেই এসে থমকে যাচ্ছে, ‘ আভাহীন সে কি করে থাকবে? ‘
হঠাৎ গাড়ি থেমে গেলো। মাঝরাস্তায়, ফুটপাথের পাশ ঘেঁষে! আভা অবাক চোখে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ গাড়ি থামিয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে বসে আছে। নিশ্বাসের বেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আভা মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আহনাফ হুট করে আভার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে আভাকে নিজের একদম কাছে নিয়ে এলো। আভা বিস্ময় ভাব অনুভব করার আগেই আহনাফ আভাকে আচানক জড়িয়ে ধরলো। খুব জোড়ে, শক্ত করে। আচমকা আহনাফের এমন ব্যাবহারে আভা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। আহনাফ আভার পিঠে হাত রেখে, ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো। বস্তুত, নিজেকে সামলানোর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা! আভা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলো। এই মুহূর্তে কি করা উচিত, আভা জানে না। আভা নিজের অজান্তেই আহনাফের পিঠে নিজের ডান হাত রাখলো। অন্যহাতে নিজের জামা মুঠি করে বসে রইলো ও। আহনাফ কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে সরে এলো আভার থেকে।
কয়েকটা বড় বড় শ্বাস ফেলে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলো। গাড়ি ইতিমধ্যে চলতে আরম্ভ হয়েছে। আভা যখন এক চমকে আছে, তখন আহনাফ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে টিপ্পনী কেটে বললো,
— ” সামান্য জড়িয়ে ধরাতে এই অবস্থা! তাহলে, বিয়ের দিন রাতে তো তোমায় খুঁজে’ই পাওয়া যাবে না। ভাবতেই নিজের জন্য দুঃখ দুঃখ লাগছে। ”
আহনাফের কথা শুনে আভার জড়তা ভাব কেটে গেলেও, সেখানে জন্ম নিলো লজ্জার হরেক লাল-নীল প্রজাপতি। আভা লজ্জা আড়াল করতে জানালায় মুখ লুকিয়ে বসে রইলো। হঠাৎ আহনাফ গম্ভীর সুরে বলে উঠলো,
— ” তোমার ঢাকার বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেলে তো ভালো, আর না পেলে প্রাইভেট পড়বে। তবুও, ঢাকার বাইরে যাওয়া চলবে না। গট ইট? ”
আভা অবাক হলো। বললো,
— ” প্রাইভেট পড়বো? বাবা জানলে মেরে ফেলবেন। প্রাইভেটে কত টাকা লাগে আপনি জানেন। টাকা থাকলেও বাবা প্রাইভেট পড়তে দিবেন না। বাবা এ ব্যাপারে অনেক স্ট্রিক্ট! ”
আহনাফ ভ্রু কুঁচকালো। বললো,
— ” টাকা তোমার বাবা না দিলেও আমি দিবো। বউকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্যে এনাফ টাকা আমার আছে। তাও, তোমার ঢাকার বাইরে যাওয়া চলছে না। ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নাও কথাটা! ”
— ” কিন্তু… ”
আভার কথার পিঠে আহনাফ কড়া সুরে বলে উঠলো,
— ” নো মোর ওয়ার্ডস!আমি যেটা বলেছি সেটাই করবো। যদি আমার শশুরমশাই আমার একাজে বাঁধা দেন, তাহলে তার ঘর থেকে আমার রিজার্ভ করা বউ একেবারে তুলে নিয়ে আসবো। তবুও, আমার লাভ স্টোরিতে তাকে হ হিটলারগিরি করতে দিবো না। বলে দিও! ”
আহনাফের মুখে বলা ছোটখাটো আগ্নেয়গিরির বার্তা শুনে আভা চুপটি মেরে বসে রইলো। মুখে আর ‘ রা ‘ কাটার জো রইলো না। আহনাফের মুখের উপর কথা বলা মানে, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল দেওয়া। সেইসাথে, নিজের মান-সম্মান খোয়ানো। নাহ! দরকার নেই সেটার!
__________________
গাড়ি থামলো একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। আভা এতক্ষণ ধরে কিছুই খায়নি। না খেলে কোনসময় মাথা ঘুরাতে পারে, বলা যায়না। আভা প্রথম মানা করেছিল, কিন্তু আহনাফের তীক্ষ্ম চোখের সামনে আর কথা বলার সাহস হয়নি। আহনাফ আভাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে গেলো।
রেস্টুরেন্টে বসে আহনাফ খাবার ওর্ডার দিলো। কাচ্চি বিরিয়ানি, বোরহানি, কাবাব আর কোল্ড ড্রিংকস। আভা এত খাবারের আইটেম শুনে হতবাক। এত খাবার কর খাবে! ও কখনোই এক প্লেটের বেশি ভাত খেতে পারে না। আর, এখন?
একে, একে সব খাবার টেবিলে রাখা হলো। আভা অসহায় চোখ করে খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ আভার দিকে এক প্লেট ভর্তি কাচ্চি বিরিয়ানি এগিয়ে দিলো। আভা নিজের প্লেটের দিকে একবার তাকিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। বললো,
— ” আমি এত খাবার খেতে পারবো না। কমান একটু! ”
আহনাফ ইতিমধ্যে চামচ নেড়ে কাচ্চি বিরিয়াী খাওয়া শুরু করেছে। আভার একথা শুনে আহনাফ টেবিলে হাত রেখে আভার দিকে তাকালো। স্বাভাবিক সুরে বললো,
— ” বিয়ের পর বাচ্চা কয়টা নিবে, বউফ্রেন্ড? ”
#চলবে
#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
— ” বাচ্চা কয়টা নিবে, বউফ্রেন্ড? ”
মাথার ঠিক উপরে যেনো বজ্রপাত হলো আভার। চোখের আকৃতি বিশালকার করে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। বাচ্চা! আভা কি উল্টাপাল্টা কোনো প্রশ্ন করলো, যার উত্তরস্বরুপ আহনাফ বাচ্চার কথা টানলেন? নাহ! সেরকম কোনো কথা তো মনে পড়ছে না। আভা এক নিঃশ্বাস আটকে সহস্র দ্বিধা নিয়ে জিগ্গেস করলো,
— ” বাচ্চা, মানে? ”
আহনাফ আভার থেকে চোখ সরিয়ে প্লেটে চামচ নেড়েছেড়ে বললো,
— ” মানেটা হলো, আমাদের বিয়ে তো একদিন হবেই। তো বিয়ের পর বাচ্চা মানে বেবি কয়টা নিবে? ”
আভার এই মুহুর্তে হাত-পা ছড়িয়ে আহনাফকে গালি দিতে মন চাচ্ছে। যে গালি শুনলে, আহনাফ কানে হাত রেখে বলে উঠবে, ‘ ছেড়ে দে মা; কেঁদে বাঁচি । ‘ কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, আভা তো সেরকম কোনো গালি জানে না। তবে? গালির অভাবে আহনাফের এই ঠোঁটকাটা স্বভাব কি ওকে সারাটাজীবন সহ্য করতে হবে? ইয়া আল্লাহ! রক্ষা করো! ধৈর্য্য দাও! আহনাফ আভাকে চুপ থাকতে দেখে খেতে খেতে আভার দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— ” বাচ্চার কথা জাস্ট শুনেই এই অবস্থা! বাট, আই অ্যাম হেল্পলেস। আই লাইক বেবি’স। সো, আদর করার জন্যে নিজের বাচ্চা তো একটা লাগবেই। তাইনা? ”
আভার আর সহ্য হচ্ছে না। বিয়ে কতদূরের ব্যাপার। এখনই এসব নিয়ে কথা না বললেই কি চলছিল না? আভার এই মুহুর্তে পাতালে লুকিয়ে পড়তে মন চাচ্ছে! কিন্তু, ‘ পাতাল ‘ বলতে তো কিছু অস্তিত্ব নেই। তাহলে? কোথায় যাবে ও? কোথায় লুকাবে? আহনাফ এবার চেয়ার টেনে আভার পাশে এসে বসলো। চামচ রেখে হাত দিয়েই বিরিয়ানি মাখিয়ে এক লোকমা তুলে আভার মুখের সামনে ধরলো। স্বাভাবিক সুরে বললো,
— ” হা করো! ”
আভা ‘ হা ‘ করলো। আহনাফ আভাকে খাইয়ে দেওয়ার সাথে সাথে, নিজেও খেতে লাগলো। খাওয়ার মাঝখানে আহনাফ আরো এক অদ্ভুত কথা বলে বসলো,
— ” তোমার শরীরের যা হাল, তাতে আমার সবল বাচ্চারা তোমার এই ছোট্ট পাখির মত পেটে থাকবে কি করে? বাবা হিসেবে আমি তো সেই চিন্তায় শেষ! এখন থেকেই বেশি করে খাও! তোমার পেটে থাকাকালীন আমাদের বাচ্চার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়! ”
আভার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কান দুটো গরম হয়ে লাল রং ধারণ করেছে। আহনাফের মুখে বাচ্চার কথা আর শুনা যাচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আহনাফ আভার থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হলো? খাবে তো ঠিকমতো? ”
আভা শুধু মাথা নেড়ে ‘ হ্যাঁ-বোধক ‘ উত্তর দিলো। আহনাফ মুচকি হাসলো।
_________________________
একটা ক্যাফেতে মিনহাজ আর আরোহী বসে আছে। ওরা ক্যাফেতে এলো প্রায় অনেকক্ষণ হলো। কিন্তু, সেই কখন থেকে আরোহী চুপচাপ বসে আছে। মুখ দেখেই মনে হচ্ছে,তার মন খারাপ! মিনহাজ আরোহীর মন খারাপের কারণ জানার কয়েকবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। আরোহী গুম মেরে বসেছে তো বসেছেই! কোনো কথা নেই মুখে। একসময় মিনহাজ বিরক্ত হলো। টেবিলে জোরে এক থাপ্পড় দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সে। কাঠের টেবিলে মিনহাজের পুরুষালি হাতের থাপ্পড়ের আওয়াজ রীতিমত কাঁপিয়ে তুলেছে চারপাশ। আরোহীও একটু কাঁপলো। মিনহাজের রাগ ভয়ংকর! সেটা আরোহী জানে। তবুও,বারবার নিজের বোকামো কাজ দ্বারা মিনহাজকে রাগিয়ে তুলে। মিনহাজ রেগে আরোহীর দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
— ” সমস্যা কি? কখন থেকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছো। যদি মনব্রত পালন করার কথাই ছিল, তাহলে বাসায় করতে। এখানে কেনো? কতোদিন পর দেখা হলো, এখন এসব না করলে চলছে না? ”
আরোহী একবার মিনহাজের দিকে তাকালো। ছলছল করছে তার চোখ’দুটো। আরোহী উজ্জ্বল ফর্সা চেহারার অধিকারী। চোখের আকৃতি, কাব্যিক ভাষায় হরিণীর মতন। সেই ডাগর ডাগর চোখে জখন জল আসে, মিনহাজ তা দেখে উদভ্রান্ত হয়ে যায়। শত রাগ একদম পানি হয়ে উড়ে যায়। এবারও তাই হলো! আরোহীর চোখে পানি দেখে মিনহাজের রাগ কমে আসলো। যে নিজের চোখ বন্ধ করে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিজেকে সামলালো। অতঃপর আরোহীর পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। আরোহী মাথা নিচু করে আছে। মিনহাজের দিকে তাকালো না অব্দি! রাগ হয়েছে খুব! ওর মন খারাপ করেছে, কিন্তু মিনহাজ ওকে এভাবে ধমক দিলো কেনো? নাহ! আর কথা বলবে না এই রাগী লোকটার সাথে!
মিনহাজ আরোহীর পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আরোহীর দিকে তাকালো। মেয়েটা বড্ড অভিমান করেছে,সেটা ওর মুখে স্পষ্ট! মিনহাজ আরোহীর গালে একহাত রাখলো। আরোহী আর পারলো না, রাগ করে থাকতে। মিনহাজের দিকে তাকালো ও। মিনহাজ আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ” মন খারাপ কেনো? কেউ কিছু বলেছে? আমায় বলো! না বললে আমি বুঝবো কি করে? ”
আরোহী দুচোখ মুছে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বললো,
— ” আমি বিয়ে করবো না! ”
মিনহাজ স্তব্ধ হয়ে গেলো। বিয়ে করবে না, মানে? মিনহাজ যতটুকু আরোহীকে চিনে, আরোহী নিজ থেকে কখনোই এই বিয়েতে মানা করবে না। ওদের বিয়ে নিয়ে আরোহীর সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিলো। তাহলে, এখন? মিনহাজের রাগ তরতর করে কপাল বেয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করলো। তবে, নিজেকে সামলালো সে। আরোহীর দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” বিয়ে করবে না কেনো? আমায় বিয়ে না করার কারণ কি? ”
আরোহী থেমে থেমে বললো,
— ” তোমাকে বিয়ে করবো না কেনো? একশোবার করবো। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়! ”
মিনহাজের মনে হচ্ছে, ও পাগল হয়ে যাচ্ছে। আরোহীর এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা, তার বোধগম্য হচ্ছে না। মিনহাজ জিজ্ঞেস করলো,
— ” তাহলে? মেইন কারণ কি? ”
— ” আমার ফ্যামিলি। বিয়ের পর, ওদের ছেড়ে আমি থাকবো কি করে? ছোট থেকে যে বাসায় বড় হয়েছি, সেই বাসা ছেড়ে অপরিচিত এক বাসায় সারাজীবন থাকবো কি করে? আমার ভয় লাগছে খুব। আমার মনে হচ্ছে, আমি এসব পারবো না। এই সংসার-টংসার আমার জন্যে নয়। ”
মিনহাজ মন দিয়ে আরোহীর কথা শুনলো। সম্পূর্ণ কথা শোনার পর ওর অযথাই হাসি পেলো। তবে, হাসলো না সে। প্রেমিকা যেখানে মন ভার করে বসে আছে, সেখানে প্রেমিক কি করে হাসে? মিনহাজ আরোহীর গালে হাত রেখে বুঝালো,
— ” বিয়ের আগে সবারই এমন মনে হয়।ওই পরিবার থেকে তোমার বাবা মাকে ছেড়ে আসতে কে বলেছে তোমাকে। প্রতি সপ্তাহে একবার আসবে নিজের বাবার বাড়ি। আর বাকি রইলো সংসার! সেটা করার জন্যে আমি আছি। বিশ্বাস নেই আমার উপর? ”
আরোহী অপলক তাকিয়ে রইলো মিনহাজের দিকে। মুখ দিয়ে না বললেও, মনে মনে ভাবলো, এই মানুষটাকে সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে। কোনো জড়তা নেই।
____________________
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েছে আহনাফ আর আভা। আহনাফ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। হসপিটাল থেকে জরুরি কল এসেছে। আভা একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ রাস্তার ওপারে দেখলো, একটা আইস্ক্রিম পার্লার।সেটা দেখে, আভার মনটা খুশিতে যেনো নেঁচে উঠলো। আভা একবার আহনাফের দিকে তাকালো। এখনো কথা বলছেন। হয়তো , খুব বেশি দরকারি কথা! আভা আর ভাবলো না। আইস্ক্রিম খেতে, নিজেই রাস্তা পাড় হতে লাগলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো একদম আকস্মিক! আভা ডান দিকে একটা ট্রাক আভার দিকেই ধেয়ে আসছে। ট্রাকের ড্রাইভার মাতাল থাকায় গাড়ি বেসামালভাবে চালাচ্ছে। কোনো দিক-বেদিক চিন্তা করছে না। আভা যখন রাস্তা পাড় হয়ে ঠিক মাঝরাস্তায় এসে গেছে, তখনই ট্রাকটা খুব স্পিডে আভার শরীরের উপর দিয়েই চলে গেলো। সঙ্গেসঙ্গে আভা জোরে এক চিৎকার করে এক ছিটকে গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়। পিচ ঢালা রাস্তায় ছিটকে পড়তেই মাথাটা ফেটে গড়াতে লাগলো, লাল রক্ত! পাশ থেকে তুমুল শব্দ শুনে আহনাফ ফোন কানে রেখেই তাকালো পাশে। একটু দূরে আভাকে রক্ত মাখা অবস্থায় দেখে আহনাফের মাথা রীতিমত ঘুরে গেলো। আভা রাস্তায় নিথর হয়ে পড়ে আছে। সারা শরীরের রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। মাটিতে শরীর ছেড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো। গলা কাটা মুরগীর মত ছটফট করছে ও। আভার স্কুল ব্যাগ রক্ত লেগে রাস্তার একপাশে পড়ে আছে। নিজের প্রেয়সীকে এভাবে রক্তাক্ত দেখে আহনাফের মাথা কতক্ষণ হ্যাং হয়ে রইলো। যখন চারপাশ থেকে মানুষের শোরগোল কানে ভেসে আসলো, তখনই আহনাফের টনক নড়ল। কান থেকে ফোন সরিয়ে ফোনটা জোরে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেললো। দামী ফোন এক গাছের সাথে লেগে দু টুকরো হলো। আহনাফ পাগলের মত রাস্তা বেয়ে আভার দিকে দৌঁড় লাগালো।
#চলবে।