কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা পর্ব-২+৩

0
392

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-২ + ৩)

————-
গাড়ি এসে থেমেছে বিরাট বড় একটি আলিশান মঞ্জিলের সম্মুখে। নিঝুমের হুঁশ ফিরে গাড়ির ব্রেকের ধাক্কায়। ভাবনা ছেদ হতেই সে সিক্ত নয়ন জোড়া হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা মুছে নিয়ে সম্মুখে দৃষ্টি ভেড়ায়। তাদের গাড়িটি থামতেই পর পর কয়েকটি গাড়ি এসে পেছনে সারি বদ্ধ ভাবে জায়গা দখল করে নেয়। ওগুলোতে বর পক্ষের লোকজন আছে। নিঝুম বুঝতে পারে এটাই তার অনাকাঙ্খিত ভাবে তৈরি হওয়া শ্বশুর বাড়ি। পেছনের গাড়িগুলো থেকে একে একে সকলে বেড়িয়ে আসছে। তাদের মধ্য থেকে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে নিঝুমের কাছে আসে। ছেলেটি হাসোজ্জল মুখে দাড়িয়ে আছে আর মেয়েটি তখন নিঝুমের পানে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,

“এসো বউ-মনি।”

নিঝুম একটু টাসকি খায়। এ নামে প্রথম কেউ তাকে ডাকছে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। সে কী করবে,কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। নিজেকে কেমন জানি অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে। নিঝুমকে নিশ্চুপ দেখে মেয়েটি নিজে থেকেই নিঝুমের হাত টেনে ধরে ওকে গাড়ি থেকে বাহিরে বের করে নিয়ে এলো। অতঃপর পাশের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল,

“এ হলো ইশান। আমার ছোট ভাইয়া। আর আমি হচ্ছি ইরা। আমরা কে বলতো? আমি হলাম তোমার একমাত্র ননদ আর ও হলো তোমার একমাত্র দেবর। পেয়ে গেলে পরিচয় বাকিটা ধীরে ধীরে জেনে যাবে। তাহলে এবার ভেতরে চলো আমাদের মিষ্টি বউ-মনি।”

নিঝুম হতভম্বের ন্যায় চেয়ে রইল ইরার পানে। ইরা ফের মিষ্টি হেসে নিঝুমের কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে লাগল। ওদের পেছনে পেছন সকলে আসছে। ইহান আগেই চলে গেছে ভেতরে এটা এখনো টের পায়নি নিঝুম। কী করে টের পাবে তার তো কোনো কিছুতেই মন নেই। নিজেকে একটি যান্ত্রিক রোবট ধারণা হচ্ছে তার।

গেট দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই ওদের ওপর ফুলের বর্ষা শুরু হয়ে গেল যেন। বাগানের রাস্তা ধরে দু’পাশে সারিবদ্ধ ভাবে মেয়েরা ফুলের পাপড়িতে পরিপূর্ণ থালা হাতে দাড়িয়ে আছে। ওরা ভেতরে পা রাখতেই সেই মেয়েগুলো থালা থেকে ফুল নিয়ে ওদের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে স্বাগতম বার্তা সম্পন্ন করল। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নিঝুম বাড়িটার আশেপাশে চোখ বুলালো। বাড়িটির বর্তমান সাজসজ্জা খুবই মনোমুগ্ধকর। ঝলমলে মরিচবাতির সঙ্গে গোলাপ, গাঁধা ফুলের নিদারুণ কম্বিনেশন। এই মুহুর্তে চোখ ফেরানো দ্বায়। আনমনে এসব অবলোকন করতে করতে বাগানের রাস্তা পেড়িয়ে ওরা এসে পৌঁছল বাড়ির সদর দরজার সম্মুখে। নিঝুম মাথা নিচু করে আছে দাড়িয়ে আছে। তখনই ইরা তার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,

“বউমনি এই হলো আমাদের মা মিসেস অনিলা খান। মানে তোমার শ্বাশুড়ি। ঝটপট সালাম করে নাও তো।”

নিঝুম চোখ তুলে তাকালো। দরজার ভেতরে একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা হুইলচেয়ারে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলার চোখে মুখে গাম্ভীর্যতার ছাপ স্পষ্ট। নিঝুম বুঝতে পারল পছন্দের পাত্রীর জায়গায় অন্য কাউকে হয়তো সে মেনে নিতে পারছে না। নিঝুম ভয়ে ভয়ে তাকে সালাম করল। অদ্ভুত ভাবে অনিলা খান নিঝুমের মাথায় হাত রেখে বললেন,

“ভালো থেকো। ভালো রেখো। সংসারটাকে এক সুতোয় মালা গেঁথে রেখো কখনো ছিঁড়ে যেতে দিও না।”

নিঝুম বেশ অবাক হলো। এতো সহজে কী করে মেনে নিলো? বিষ্ময়ের রেশ কাটিয়ে নিঝুম মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। অনিলা চৌধুরী ওদের ভেতরে আসতে বলে নিজেও ভেতরে চলে গেলেন।

নিঝুমকে নিয়ে বসানো হয়েছে একেবারে ইহানের কক্ষে। কক্ষটি বর্তমানে ফুলে ফুলে সজ্জিত। সেই রয়েছে নানারকম ডেকোরেশন। খান বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা সবকিছুতেই এক্সট্রা মশলাদার আয়োজন। নিয়ম মাফিক আজ নিঝুম, ইহানের বাসর রাত। এই কক্ষে নিঝুমকে ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে তার মনের মধ্যে অসম্ভব তু’ফা’নে’র সৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তার ইচ্ছে করছে এখনই এখান থেকে ছুট্টে পালাতে। কিন্তু উপায় নেই। লোকজনে চারদিক গমগম করছে। নিঝুমকে ঘিরে আছে অল্প বয়সী মেয়ে, বউরা। নিঝুম বিছানার মধ্যে গোল হয়ে বসে আছে। তারপাশ থেকে তার ননদ, জা-য়েরা নানা রকম হাসিঠাট্টা করছে কিন্তু তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে আতঙ্কিত হয়ে আছে সেই আগত প্র’ল’য়ে’র অপেক্ষায়। এ প্র’ল’য় যে সে প্র’ল’য় নই নিশ্চিত এই প্রলয়ে নিঝুমকে বলি দিতে হবে অনেক কিছু। হয়তো নিজের পরিবার নয়তো সম্মান। ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা বাজতেই নিঝুমের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। কত-শত খাবার তার সম্মুখে উপস্থিত কিন্তু সে কিছুই খেতে পারছে না। টেনশনে গলা দিয়ে খাবার নামছে না। নিঝুমকে সকলে জোর করছে খাওয়ার জন্য কিন্তু ও কিছুতেই খেতে পারছে না। দেখা যায় এক পর্যায়ে অনিলা খান সেখানে উপস্থিত হন। তিনি সকলকে ঘরটা ফাঁকা করে দিতে বলেন। সকলে চলে যায় শুধু ইরা থাকে। তিনি ইশারায় ইরাকেও চলে যেতে বলেন। ইরাও চলে যায়। এখন শুধু নিঝুম আর তিনি আছেন। নিঝুম সো মাচ নার্ভাস। মৃদু কাঁপছে তার অন্তর। সে দু’হাতে আঙুল কচলাতে ব্যস্ত। অনিলা খান ওকে একবার পর্যবেক্ষণ করে হুইলচেয়ারটি টেনে নিয়ে একদম ওর কাছে চলে আসলেন। অতঃপর খাবারের প্লেটটি হাতে নিয়ে খাবার মাখতে মাখতে বললেন,

” তোমার কষ্ট টা বুঝতে পারছি। আমিও একজন মেয়ে এমন একটি দিন আমার জীবনেও এসেছিল। শুধু পার্থক্য একটাই আমার বিয়ে পূর্ব প্রস্তুতি ছিল কিন্তু তোমার টা হলো অনাকাঙ্খিত ভাবে। ওই যে কথায় আছে না জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। সময় হলে এই তিনটি জিনিস হবেই। কিন্তু কীভাবে হবে সেটা বিধাতা ছাড়া কারোরই জানা নেই। বিধাতার ইচ্ছে হয়েছে তিনি তোমার বিয়েটা এভাবে লিখেছেন। নিশ্চয়ই এর পেছনে তার বড় কোনো উদ্দেশ্যে আছে। এখন কথা হচ্ছে তোমার পরিবার নিয়ে। তুমি কোন পরিবারের, কোথা থেকে এসেছো, কোথায় থাকো এসবের কিছুই আমার জানা নেই। তবে আমি চেষ্টা করবো তোমার পরিবারকে ম্যানেজ করার বাকিটা আল্লাহ ভরসা। মেয়েদের বিয়ে একবারই হয়। জানি তোমার হয়তো অনেক স্বপ্ন ছিল নিজের জীবন নিয়ে। আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমার সব স্বপ্ন নিজ দ্বায়িত্বে পূরণ করবো। বাকি রইল আমার ছেলে ও একটু ব’দ’মে’জা’জী কিন্তু মনটা ভীষণ ভালো। ধীরে ধীরে সব বুঝে যাবে। আমি একজন মা। আমি চাইলেই পারতাম এই বিয়েটা অস্বীকার করতে কিন্তু না আমি সেটা করিনি। কেন জানো? এই সমাজে একবার বিয়ে হয়ে গেলে সেই নারীর শ্বশুর বাড়িটিই তার আসল পরিচয় বহন করে। যদি কোনো কারণে এই পরিচয় থেকে মেয়েটিকে বিতারিত হতে হয় তখন এই নোং’রা সমাজ তাকে ছেড়ে কথা বলে না। তার ললাটে লিপে দেয় অলক্ষীর নামক তকমা। আমি চাই নি তুমি সে সকল পরিস্থিতির স্বীকার হও। এখন তুমিই ঠিক করে নাও তুমি কী করতে চাও। মুক্তি চাও নাকি সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চাও। ডিসিশন এখনই চাইছি না তুমি ভাবো, সারারাত ভাবো, কাল আমাকে উত্তর টা দিও। এখন মুখটা খোলো তো ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।”

নিঝুম হতবাক। চক্ষে জল টলমল। এত সুন্দর করে কেউ ওকে এর আগে কখনো কোনো কিছুতে বোঝায় নি। সকলে শুধু ধমকে,শাসন করে এসেছে। ভালবাসেনি তা নয় ভালোবাসাতেও কেমন জানি দাম্ভির্য্য লুকিয়ে ছিল। নিঝুমকে চুপ থাকতে দেখে অনিলা খান ওর মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে বললেন,

“উহুম কান্না নয় এখন থেকে শুধু আনন্দ। এই মায়ের কাছে তুমি ভীষণ ভালো থাকবে। কথা দিলাম।”

নিঝুম চোখ মুছে কিঞ্চিৎ হেসে খাবার মুখে তুলে নিলো। অনিলা খান মনে মনে প্রশান্তির হাসি হাসলেন। অতঃপর পুরোটা খাবার তিনি নিঝুমকে খাইয়ে দিয়ে হুইলচেয়ার টেনে টেনে চলে যেতে লাগলেন। নিঝুম সেদিকে তাকিয়ে থাকল অপলক। এই মানুষটিকে নিঝুমের ভীষণ পছন্দ হলো। মনে মনে মায়ের স্থানে বসিয়ে নিলো। অনিলা খান দরজা অব্দি দিয়ে আবার কাঁধ বাকিয়ে নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“একটা কথা বলা হয়নি, তুমি কিন্তু ভীষণ মিষ্টি। আমার তোমাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। আমার পছন্দ করা পাত্রীর থেকেও বেটার।”

অতঃপর তিনি হুইলচেয়ার টেনে চলে গেলেন। নিঝুম ফের হতভম্ব হয়ে বসে রইল। সত্যিই এতটা আশা করে নি সে। সবকিছুই একটু এক্সট্রা পাচ্ছে যেন।

এ কক্ষে আর কারো প্রবেশ নিষেধ করে দেয় অনিলা খান। নিঝুম একা একা বেশ বোরিং ফিল করছে। সেই সঙ্গে বাড়ির জন্য টেনশনও বাড়ছে। কী হচ্ছে এখন ওখানে কে জানে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সকলে জানতে পেরে তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। মায়ের ওপর কী ঝ’ড়’টাই না আসতে চলেছে এটা ভেবে শিউরে ওঠে নিঝুম। ততক্ষণাৎ দরজা খোলার শব্দ হয়। নিঝুম চমকে ওঠে। দরজা সামনে ইহান দাড়িয়ে। তার দৃষ্টি শান্ত। ইহান দরজা লক করে দিয়ে এক পা এক পা করে এগোতে থাকে। নিঝুম শুকনো ডোক গিলে। দু-হাতে শক্ত করে বিছানার চাদর খামচে ধরে।

———————-

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি

(প্রিয় পাঠকমহল, এই গল্পে আপনাদের রেসপন্স দেখে আমি ভীষণ আনন্দিত। পুরো গল্পটিতে এভাবে পাশে থাকার আমন্ত্রণ রইল।

আমি গল্প লেখার সময় পাই রাতে। রাতে লিখে রাতেই পোস্ট করি। তাই সকলে রাতে এক্টিভ থাকবেন ৷ দিনে যে একেবারে দেই না তা নয় সময় পেলে দিনেও দেই।রিচেক করা হয়নি ভুল ত্রুটি মার্জনীয়)

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-৩)

————-
ধীরে ধীরে বিছানার সন্নিকটে এগিয়ে আসছে ইহান। তার দৃষ্টি নিঝুমের মুখে নিবদ্ধ। নিঝুমের দৃষ্টি চঞ্চল। সে শুধু এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাচ্ছে। ইহান যখন একদম বিছানার নিকটে চলে আসে হতবিহ্বল নিঝুম ঠিক তখনই ইহানের চোখে দৃষ্টি মেলায়। ইহান নিঝুমের দিকে ঝুঁকতে থাকে। নিঝুমের আ’ত্মা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ইহান এক হাত বাড়িয়ে দিতেই নিঝুম চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। উত্তেজিত কন্ঠে বলে,

“প্লিজ এখনই না। আমি প্রস্তুত নই এসবের জন্য। আমার সময় চাই। দয়া করুন।”

কথা শেষ করে নিঝুম কয়েকটি ঘন নিশ্বাস ফেলে। অতঃপর ধীরে ধীরে শান্ত হয়। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর নিঝুম যখন দেখল ইহানের কোনো সাড়া শব্দ নেই তখন সে মনে কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চার করে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। এতটুকুতেই ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছে সে যার প্রমাণ বহন করছে তার ঘামার্থ মুখশ্রী, কম্পিত দেহ। কিন্তু এর থেকেও বেশি নার্ভাস হয়ে পড়ল যখন সে চোখ মেলে দেখল ইহান তার একদম সম্মুখে ক্রোধান্বিত রুপে বসে আছে। ইহানের চোখের দৃষ্টি এই মুহুর্তে ভীষণ ভ’য়ং’ক’র। মনে হচ্ছে চোখজোড়া নিঝুমকে ভস্ম করে ফেলতে সক্ষম হবে হয়তো। নিঝুমের শরীরের কম্পন কমে অন্তরে ঝড়ের সৃষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে অন্তরিক্ষের গহবরে কোনো মহা ট’র্নে’ডোর আগমন ঘটতে চলেছে। নিঝুমের সেই আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে ইহান ওর কাঁধ বরাবর হাত বাড়িয়ে দিল। মুহুর্তেই নিঝুম ফের দুচোখ বন্ধ করে নিল। ইহান ওর কাঁধের ওপর থেকে হাত দিয়ে একটি বালিশ সংগ্রহ করে আবার সটান হয়ে বসে পড়ল। তার রাগ যেন কিছুতে কমছেই না। অতঃপর সে নিঝুমের এক হাত শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“আবরার খান ইহান অতটাও ক্যারেক্টর লেস নয় যে যেখানে সেখানে তাকে ঢলে পড়তে হবে। তুমি ভাবলে কী করে তোমার মতো একটা ঠ’ক’বা’জ মেয়েকে আমি স্পর্শ করব। এমন কথা ভুলেও কখনো মস্তিষ্কে স্থান দিও না নয়তো পরিণাম অনেক ভ’য়া’ব’হ হবে। তোমাকে আমি বিয়েটা করেছি শুধু মাত্র আমার সম্মান রক্ষা করতে যেটা তুমি আর তোমার ওই সো কল্ড বান্ধবী মিলে বিকিয়ে দিতে চেয়েছিলে। তোমার বান্ধবী তো চলে গিয়ে বেঁচে গেছে কিন্তু এখন সারাজীবন এরজন্য সাফার করতে হবে তোমাকে।”

কথা শেষ করে ইহান নিঝুমের হাতটা সর্বশক্তি দিয়ে ঝটকা মে’রে ফেলে চলে যায়। নিঝুম এতক্ষণে নিজের বন্ধ চোখ খুলার সাহস করে। অহেতুক তার চোখ জোড়া ভিজে ওঠে নোনাজলে। সব কথাকে ছাপিয়ে তার কানে শুধু একটি কথাই বাজছে, “সে নাকি ঠকবাজ।”

ইহান বালিশ নিয়ে হনহনিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। নিঝুম সেদিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। তার কী দোষ ছিল? সে কী ভীষণ অপরাধ করে ফেলেছে? নিঝুমের জায়গায় অদিতি থাকলে ইহান নিশ্চয়ই এমন করত না? ভালবেসে আপন করে নিতো কী?

———————-

ভোরের আলো চোখে পড়তেই মুখ ছুটে যায় নিঝুমের। পিট পিট করে চোখ মেলে তাকায় সে। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক জানান দেই নতুন জায়গায় তার উপস্থিতি। সে ধরফরিয়ে উঠে বসে। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে। অতঃপর ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক জাগ্রত হয়, মন শান্ত হয়, মনে পড়ে যায় গতকালের সকল ঘটনা। দেওয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ভোর ছয়টা বাজে। নামাজের সময় হয়েছে। নিঝুমকে গতকাল রাতে তার ননদ ইরা একটি লাগেজ দিয়ে গেয়েছিল। এগুলোতে মেবি নতুন বউয়ের জন্য আনা জিনিস-পত্র ছিল। ইরা বলেছিল ওখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে কিন্তু রাতে ইহানের উপস্থিতি এবং তার পরবর্তী ঘটনা তার মনে গভীর ভাবে রেখাপাত ঘটায় যার ফল স্বরুপ সে কিছু না করেই ওভাবেই কখন জানি ঘুমিয়ে পড়ে। ইরা তাকে তার নিজস্ব ফোনটাও দিয়ে গিয়েছিল যেটা সে বিয়ে বাড়িতেই ফেলে এসেছিল। ফোনের কথা মনে হতেই নিঝুম বালিশের নিচ থেকে ফোনটি সংগ্রহ করে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না তাতে বিন্দু মাত্র চার্জ অবশিষ্ট নেই। হতাশ হয়ে নিঝুম ফোনটি আবার যথা স্থানে রেখে দেয়। ইরার কাছ থেকে চার্জারের ব্যবস্থা করে ফোনটা চার্জ দিতে হবে তারপর বাড়িতে যোগাযোগ করতে হবে। ওখানকার কী অবস্থা কে জানে? তার আগে তাকে ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে নিতে হবে। বাড়িতে থাকতেও নিঝুম দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি নামাজ আদায় করা এবং কুরআন তেলওয়াত করার কথা কখনোই ভুলত না। এটি তার অন্যতম প্রিয় কাজ। এই সময়টায় সে গভীর ভাবে নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে।

ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে নিয়ে কিছু সময় কুরআন তেলওয়াত করল সে। কুরআন শরীফ খুব নিকটেই ছিল তাই ভাবল সময় আছে যখন তখন পড়ে নেওয়া যাক। এসব মানসিক পিড়া থেকে একমাত্র মুক্তি লাভের উপায় এই কুরআন।

কুরআন তেলওয়াত মিষ্টি ধ্বনি কর্ণপাতের মাধ্যমে ঘুম ভাঙে ইহানের। বেলকনির ডিভানে বসে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। বালিশটি এনেছিল হেলান দিয়ে বসার উদ্দেশ্যে কিন্তু শেষমেশ দেখা যায় ওটা তার শয়ন যোগ্য হয়ে উঠেছে।

ইহান চোখ মেলে দেখে ল্যাপটপটি এখনও তার কোলের উপরে পড়ে আছে। সিস্টেম গুলো এখনো চালু করা। সযত্নে সিস্টেমগুলো অফ করে ওটাকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে উঠে দাড়ায় সে। তারপর উঠে দাড়িয়ে বেলকনি দিয়ে বাহিরে দৃষ্টিপাত করে। বাহিরের মৃদু আলো দেখে বুঝতে পারে বেশি বেলা হয়নি। এত ভোরে কুরআন তেলওয়াত করছে কে এর আগে তো কখনো এমন মধুর ধ্বনি এত সকাল সকাল শোনার সৌভাগ্য তার হয়নি। অনিলা খান কুরআন তেলওয়াত করেন তবে তা সন্ধ্যা বেলা ভোরে নয়। ইহান হাই তুলতে তুলতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। অতঃপর সে স্তব্ধ। সুন্দর, পরিপাটি সাজে এক রমনী মন দিয়ে কুরআন তেলওয়াত করছে। কী অপরুপ সেই দৃশ্য। আশেপাশের পরিবেশটাও কেমন জানি স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ। ইহান বিরক্ত করে না নিঝুমকে। কাবার্ড থেকে প্রয়োজনীয় জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। আজ একটু বেশিই তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। সবই এই মেয়েটির কারিশমা।

বদ্ধ ঘর হওয়ায় কুরআনের ধ্বনি বাহিরে প্রবেশ করতে অক্ষম। আর নিঝুমও খুব মার্জিত ভাবে তিলাওয়াত করেছে যাতে করে বেশি উচ্চ শব্দের সৃষ্টি না হয়। মিডিয়াম আওয়াজে পড়াই অতি উত্তম।

———————-

ইহান ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে নিঝুমকে ঘরে পায় না। অযথাই তার চোখ এদিক ওদিক নজর বুলায়।ফের নিজেই নিজের মনকে শান্ত করে বেলকনিতে চলে যায়। বেলকনি থেকে ল্যাপটপটি নিয়ে এসে বিছানায় আরাম করে বসে। গতরাতে ঘুমাতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। একবার ভেবেছে ঘুমবে না কাজ করেই রাত কভার করে দেবে কিন্তু শরীর তার ঘোর বি’রো’ধি’তা করেছে। ফলস্বরূপ কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেরও জানা নেই। এখন একটু শান্তিতে কাজ করতে চায়।

রুম থেকে বেড়িয়েও নিঝুম পড়েছে মহা বিপদে। কোথাও কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে আছে। ইরার ঘর কোনটা তাও সে জানে না। ফোনটা চার্জে দেওয়া ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে বাড়িতে যে করেই হোক দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে। অবশেষে একজন মধ্য বয়স্ক লোক এসে তাকে ইরার ঘরের সন্ধান বলে দেয় সেই সঙ্গে ইরাকে ডেকেও দেয়। এই লোকটি হয়তো এই বাড়ির মেড সার্ভেন্ট। তার পোশাকআশাক, চালচলনে এই পরিচয়ই বহন করে।

ইরা নিঝুমকে দেখে ভীষণ খুশি হয়। নিঝুম ইরাকে তার সমস্যার কথাটা জানায়। ইরা ততক্ষণাৎ নিঝুমের ফোনটি তার ফোনের চার্জার দিয়ে চার্জে লাগিয়ে দেয়। অতঃপর দু’জনে নানাপ্রকার গল্প করতে থাকে। ইরা মেয়েটা বেশ মিশুক, প্রানোচ্ছল প্রকৃতির। এই অল্পক্ষণেই নিঝুমের বেশ মনে ধরে তাকে।

তারা গল্প করতে করতে নয়টা বেজে যায়। হঠাৎই নিচ থেকে অনেক শোরগোল ভেসে আসে। ইরা কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে যায় কী হয়েছে দেখতে। কিন্তু নিঝুম নড়াচড়া করতে ভুলে যায়। সে পাথরের ন্যায় শক্ত রুপ ধারণ করে। তার কানে ভেসে আসছে সেই পরিচিত কন্ঠস্বর, পরিচিত হুংকার, পরিচিত দাম্ভিকতা। এখানে দাড়িয়েই সে উপলব্ধি করতে পারছে আসন্ন বি’প’দে’র সংকেত।

———————

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি