কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা পর্ব-০৮

0
248

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
পর্ব সংখ্যা – ৮

——————
ইরা নাক ফুলিয়ে বসে আছে। এখনই উঠে যেতে চাইছে কিন্তু পারছে না। তরুও নাক,মুখ কুঁচকে আছে। মনে হচ্ছে ভীষণ বিরক্ত। নিঝুম ইরাকে খোঁচা দিলো। ইরা ইশারায় চুপ থাকতে বলল। অবশেষে নিঝুম চুপ মে’রে বসে রইল। ইতোমধ্যে ওদের টেবিলে খাবার চলে এসেছে। ওদের সামনে দাড়ানো ছেলেটি এতক্ষণে মুখ খুলল।গম্ভীর কণ্ঠে ওয়েটারকে বলল,’বিল আমি দিচ্ছি।’ ইরার মাথায় চট করে রাগ চড়ে বসল। সে চেয়ার ছেড়ে ধপ করে উঠে পড়ল। রেগে গিয়ে ছেলেটির দিকে আঙুল তাক করে বলল,’হাউ ডেয়ার ইউ।’ সাহস কী করে হয়? ছেলেটির দৃষ্টি শান্ত। সে কিছু বলছে না। ছেলেটির পেছনে দাড়ানো ছেলেগুলো আপাতত মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। ইরা আর কিছু বলার আগেই ছেলেটি চলে যেতে লাগল। তার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের ছেলেগুলোও চলে গেল। হঠাৎই কিছু টা দুর থেকে কেউ একজন, ‘নিহান’ বলে উচ্চস্বরে ডেকে উঠল। নিঝুম খেয়াল করল ওই ছেলেটি দাড়িয়ে পরেছে। তারমানে এর নাম নিহান। নিঝুম মনে মনে অঙ্ক কষে নিলো। ছেলেটির সঙ্গে ইরার নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা আছে। এখন থাক বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করা যাবে।

ওরা চলে গেছে। ইরা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে টেবিলে বসল। অতঃপর নিঝুমের দিকে দৃষ্টি দিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘ওহ কিছু না, এমনিই! খাওয়া শুরু করো।’ তরু আর ইরার মধ্যে চোখেচোখে কথা হলো যেটা চোখ এড়ায়নি নিঝুমের।

—————–
আজ খুব সুন্দর কাটল নিঝুমের দিনটি৷ ইরার সঙ্গে অনেক ঘুরেছে। বেশ মজা করেছে। শপিংও করেছে অনেক। এর আগে এভাবে মুক্ত বাতাসে ঘোরার তেমন একটা সুযোগ তার হয়নি। পারিবারিক নিয়মের গন্ডি পেরিয়ে মুক্ত পাখির ন্যায় ঘোরার সৌভাগ্য কখনোই মেলেনি। কিন্তু আজ সবকিছু অন্য রকম হলো। সবঠিক থাকলেও নিজের পরিবারের কথা কী আর ভোলা যায়। মনটা অনবরত খচখচ করে ওদিকের খবর জানতে।

নিঝুম ড্রয়িং বসে আনমনে ভাবাভাবি করছে ঠিক সেসময়ই ইহানের উপস্থিতি। সে ক্লান্ত শরীরে হেলেদুলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। নিঝুম খেয়াল করল ইহানের পরিস্থিতি। তার মায়া হলো। ইস! লোকটা হয়তো ক্লান্ত। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়ে আসি। নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।

ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে এক প্রকার ছুট্টে সে ইহানের কাছে পৌঁছে গেল। দরজার সামনে দাড়িয়ে আমতা আমতা করছে। কেমন যেন দ্বিধা দন্ডে ভুগছে। ইহান যদি কিছু বলে তখন। মনের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে এক পর্যায়ে নিঝুম ভেতরে ঢুকতে সক্ষম হলো। হুঁশ করে ইহানের সামনে গিয়ে পড়ল। ইহান তখন কেবল শার্টের কয়েকটি বোতাম খুলেছে। নিঝুমকে দেখে খানিকটা আশ্চর্য হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে ভ্রু উচিয়ে বলল, ‘কী চাই।’ নিঝুম ইহানের এরুপ চেহারা দেখে খানিকটা লজ্জা পেল।মাথা নিচু করে পানিটা এগিয়ে দিলো। ইহান কোনো দিন না তাকিয়ে পানির গ্লাসটা নিয়ে পুরোটা পানি শেষ করল নিমেষেই। লম্বা শ্বাস টেনে নিঝুমের হাতে গ্লাসটি ধরিয়ে দিল। তার এই মুহুর্তে পানির সত্যিই ভীষণ দরকার ছিলো। নিঝুম গ্লাস টা নিয়ে চলে যেতে লাগল ঠিক তখনই পেছন থেকে নরম কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাড়াল,
-‘ধন্যবাদ’

নিঝুম পেছন ফিরল না। মনের মধ্যে কেমন শান্তি অনুভব করল৷ চোখ বন্ধ করে উপভোগ করল। অতঃপর মুচকি হেসে চলে গেল।

ইহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ফের নিজের কাজে মন দিলো। আপাতত তার লম্বা শাওয়ারের প্রয়োজন আছে।

—————
ডিনারে সকলেই আপনমনে খেয়ে চলেছে। ইহান নিজের সেই বিশ্ব বিখ্যাত ফোনটিতে নজর রেখেই খাচ্ছে। নিঝুম চুপচাপ খাচ্ছে। ইরা খাচ্ছে কম খাবার নাড়ছে বেশি। এটা দেখে অনিলা খান বললেন,
-‘কী হয়েছে খাচ্ছ না কেন?’
-‘এ…এই তো খাচ্ছি। খাচ্ছি তো।’

ইরা থমথমে মুখ নিয়ে ঠেলেঠুলে খেতে লাগল। নিঝুম খেয়াল করেছে কলেজের সেই ছেলেটিকে দেখার পর থেকেই ইরা মাঝেমধ্যেই এমন অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ছে। কী হয়েছে ওদের মধ্যে এমন? জানতে হবে তাকে।

ইশান চুপচাপ খেয়ে চলেছে। রাতের খাবার যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় ততই মঙ্গল। সে আবার অতিরিক্ত ঘুম কাতুরে কি না।

ঘুমতে গিয়ে হলো মহা জ্বালা। নিঝুম কিছুতেই আজ বিছানায় শুবে না। এই দুদিন ইহান তারজন্য অনেক কষ্ট করে বেলকনিতে ঘুমিয়েছে। এভাবে তাকে কষ্ট দিয়ে সে কী করে মনের আনন্দে বিছানায় শুবে। কিন্তু এই কথাটা ইহানকে বলতেও পারছে না। সংকোচ হচ্ছে। ইহান সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। মনে হচ্ছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বেশ সিরিয়াস সে। নিঝুম একটু একটু করে ইহানের পাশে গিয়ে দাড়িয়ে পড়েছে। ইহানের গভীর মনোযোগ ল্যাপটপে। মনোযোগ ভেঙে তার চোখ যায় নিঝুমের পায়ের ওপর। অতঃপর চোখ তুলে তাকায় নিঝুমের মুখে। ইহানের গম্ভীর কণ্ঠ,
-‘কিছু বলবে’

নিঝুম আমতা আমতা করছে,
-‘ইয়ে মানে। আসলে।’
-‘বললে বলো নয়তো আউট’
-‘আ….আ..আপনি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ুন আমি সোফায় শুবো।’

ইহান ল্যাপটপ বন্ধ করে নিলো। হাতের মধ্যে হাত গুজে নিঝুমকে পর্যবেক্ষণ করল। নিঝুমের অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। এভাবে দেখার কী আছে? আশ্চর্য। পরপর ইহানের ভারাক্রান্ত কন্ঠ শোনা গেল,
-‘চুপচাপ শুয়ে পড়ো। বেশি বউগিরি করতে এসো না। ফল তেমন একটা ভালো হবে না।’

নিঝুমের খারাপ লাগল। তবু কিছু বলল না। চুপচাপ মাথা নত করে দাড়িয়ে রইল। ইহান ততক্ষণাৎ জোর কদমে হেঁটে রুমের বাহিরে চলে গেল। ইহান যেতেই নিঝুম সটান হয়ে বিছানায় বসে পরল। চোখ বেয়ে আপন ইচ্ছায় নোনাজল ঝরে পরতে লাগল। এভাবেই বেশ খানিক সময় অতিবাহিত হলো। ইহানের দেখা মিলল না আর। এক পর্যায়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

—————-
কেটে গেল দুদিন। এই দুদিন ইহান দরকার ছাড়া এ রুমে পা রাখে নি। দেখা যাচ্ছে প্রয়োজন জিনিস নিতে এসেছে আবার নিয়েই দ্রুত ফিরে যাচ্ছে। নিঝুম সাহস করে আর কিচ্ছু টি জিজ্ঞেস করতে পারে নি। ফের কী না কী বলে দেবে। এ বাড়িতে তো আর ঘরের অভাব নেই আছে হয়তো কোনোটায়। তবে তার একটু খারাপ লাগছে বটে। তাকে বললেই তো সে অন্য রুমে চলে যেত শুধু শুধু নিজের ঘর ছাড়তে গেল কেন?

সকাল সকাল ইরা, নিঝুম কথা বলতে বলতে নিচে নামছে। ইশানের ঘর পাস করার সময় নিঝুম দাড়িয়ে পরে। ভেতর থেকে মিউজিকের শব্দ হচ্ছে। নিঝুম কৌতুহল বসত দরজা ঠেলে উঁকি দিল। ওমা তার চক্ষু চড়কগাছ। রসগোল্লার ন্যায় বড় বড় করে চেয়ে আছে। ভেতরে ইশান মিউজিক বাজিয়ে উড়াধুড়া ডান্স করছে। তার হাতে টাওয়াল। বিছানা নিচ এক করে ফেলছে নামতে নামতে। ইরা কিছুদূর গিয়ে নিঝুমকে পাশে না দেখে পেছন ঘুরল। নিঝুমকে ইশানের ঘরের সামনে দেখে সে দীর্ঘ শ্বাস টেনে এগিয়ে গেল। নিঝুমের পিঠে হাত রাখতেই সে চমকে উঠল। নিঝুম ইরাকে বিষ্মিত চাহনিতে ইশানের দিকে দেখাল। ইরা অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বলল,
-‘আপদ একটা। আস্ত বাঁদর। এসো তো। ওগুলো ওর নিত্যদিনের কুকর্ম। কপালে ভীষণ দুঃখ আছে। বউয়ের হাতে নির্ঘাত মা’র খেয়ে ম’রে’ই যাবে।

নিঝুম, ইরা দুজন মুখ চাওয়া-চাইয়ি করল। অতঃপর দুজনেই উচ্চ স্বরে হাসতে হাসতে চলে গেল

নিত্যদিনের মতো ডাইনিংয়ে সকলে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করছে। তখনই ইহান অনিলা খানের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ট্রান্সফার কার্য শেষ আজ গিয়ে ভর্তি হয়ে আসতে বলো।’
অনিলা খান একবার ছেলের দিক তো একবার ছেলে বউয়ের দিক তাকালেন। এভাবে থার্ড এ্যাঙ্গেলে কথা বলার মানে টা কী সোজাসুজি বললেই তো হয়। তিনি মুখ খুললেন,
-‘তবে তুই নিয়ে যা সঙ্গে করে। ভর্তি করে দিবি৷ ইরা কী এটা এতকিছু পারবে তার ওপর ওর তো আবার ক্লাস আছে।’
-‘আমার সময় হবে না। ইশান যাক।’

ইশান লাফ মে’রে উঠল,
-‘নো নো আমার খুব ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে। আজ কিছুতেই সম্ভব নয়।’

নিঝুমের মুখটা চুপসে আছে। সে কিছুই বলছে না। চুপচুপ খাচ্ছে শুধু। অনিলা খানের মায়া হলো তিনি বুঝলেন নিঝুম হয়তো কষ্ট পাচ্ছে। তিনি কঠিন কন্ঠে ইহানকে বললেন,
-‘কোনো কথা শুনতে চাই না। তুমি নিয়ে যাবে ওকে এবং আজ এখুনি।’

তিনি খাবার ফেলে উঠে চলে গেলেন। ইহান সেদিক পানে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। অতঃপর নিঝুমকে বলল,
-‘তৈরি হয়ে এসো দ্রুত’

———————

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি