কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা পর্ব-১০+১১

0
256

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব সংখ্যা – ১০)

————————
গাড়ি এসে গেছে। ইরা আর নিঝুম গাড়িতে উঠে বসে। ইরার থমথমে মুখ দেখে নিঝুম চুপসে আছে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে অনেক কিছু কিন্তু কোথাও একটা বাঁধা কাজ করছে। নিঝুমকে উশখুশ করতে দেখে ইরা নিজেই মুখ খুলল,
-‘ কিছু বলবে?’

ইরা’র অগ্রীম কমেন্টে যেন নিঝুম সাহস পেল।
-‘হুম, বলব। আসলে ওই ছেলেটা কে? তোমার সঙ্গে কীসের ঝামেলা ওর?’

ইরা’র মুখটা দ্বিগুণ থমথমে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে মুখ খুলল,
-‘তেমন কিছু নয়।’

ইরা ফের নিশ্চুপ। নিঝুম বুঝতে পারল ইরা হয়তো বলতে চাইছে না। সেও আর কথা বাড়ায় না। কারো পারসোনাল ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করাটা ভালো দেখায় না।

বেশখানিক সময় নিয়ে চলল নিস্তব্ধতা। গাড়ি কিছুদূর যেতেই নিঝুমের চিৎকারে চমকে ওঠে ইরা। সে এতক্ষন গভীর ধ্যানমগ্ন ছিল। নিঝুম সে রাতের মতো থরথরিয়ে কাঁপছে। তার দৃষ্টি বাহিরে। এক হাত দিয়ে ড্রাইভারকে কিছু একটা বলতে ইশারা করছে। ইরা নিঝুমের হাতের ইশারা অনুসরণ করে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে। গাড়ি থেকে যায়। ইরা উদ্বীগ্ন কন্ঠে নিঝুমকে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে। নিঝুম গাড়ির জানালা হতে হাত বের করে দুরে কিছু দেখায়। এখনো শরীর অসম্ভব কাঁপছে তার। দৃঢ় দৃষ্টি বাহিরে নিবদ্ধ রেখে কম্পিত কন্ঠে বলে,
-‘ ব..ব.. বলেছি..লাম না তোমার ভা..ভাই একটা মা’স্তা’ন।’

ইরা নিঝুমের দেখানো পথে চোখ বুলায়। দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলতে নেয়, ‘আরে ভাইয়া তো…. ‘

ইরা কথা শেষ করতে পারে না। নিঝুমের দিকে তাকিয়ে দেখে সে সে’ন্স’লে’স হয়ে পড়ছে। দিশেহারা ইরা এক হাতে নিঝুমকে জড়িয়ে নেয়। অন্য হাতে ইশানকে কল করে। এদিকে ড্রাইভারকে বলে সিটি হসপিটাল গাড়ি টানতে।

——————-
ইরা আর ইশান চিন্তিত ভঙ্গিতে হসপিটালের করিডোরে বসে আছে। ইরা এসেই ইশানকে কল করেছে ইশানও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছে। ইহানকেও জানানো হয়েছে। সেও আসছে।

-‘কী হয়েছে ছোট ভাইয়া কী ভাবছিস?’
-‘ভাবছি এই মেয়েটাকে আর না জানি কত কী সহ্য করতে হয়।’
-‘হুম, বউমনি’র তো কোনো দোষ নেই। অযথাই কষ্ট পেতে হচ্ছে ওকে। আচ্ছা ভাইয়া কী কখনো ওকে মেনে নেবে?’
-‘কী জানি। হয়তো নেবে নয়তো না।’

ওদের কথার মধ্যেই ইহানকে দেখা যায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। ইহানকে দেখে দুজনেই এগিয়ে আসে।

-‘ কী হয়েছে? কী অবস্থা এখন?’
-‘ডক্টর দেখছে’
-‘ কী হয়েছিল?’
-‘ কলেজ থেকে ফেরার পথে তোমাকে ফাইট করতে দেখে নিয়েছে। আর যাকে মা’র’ছি’লে তার শরীরের রক্ত দেখেই সে’ন্স’লে’স।’
-‘ওহ শীট! ইডিয়েট একটা।’

তখনই ডক্টরের উপস্থিতি। তিনজনই এগিয়ে যায় ডক্টরের কাছে। ডক্টর ইহানকে বলেন,

-‘পেসেন্ট কী হয়?’

ইহান কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বলে,
-‘ মাই ওয়াইফ।’

ডক্টর কিছু একটা ভেবে ইহানকে তার চেম্বারে ডাকেন। ইহান ইরা আর ইশানকে নিঝুমের দিকে খেয়াল রাখতে বলে ডক্টরের সঙ্গে যায়।

-‘ ওনার রক্তে ফোবিয়া জনিত সমস্যা আছে। হার্ট ভীষণ দুর্বল। এ ধরনের রোগীরা রক্ত দেখলেই সেন্স হারায় এটাই স্বাভাবিক। তবে এই সেন্স হারানো বিষয়টি কিন্তু মা’রা’ত্ম’ক ক্ষতিগ্রস্ত বিষয়। রোগীর মন, মস্তিষ্কে সমান ভাবে চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম এই বিষয়টি। এ থেকে যেকোনো সময় বড় কোনো ক্ষতিও হতে পারে। সো বি কেয়ারফুল। আপনাদের অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রোগী যাতে এমন পরিস্থিতির স্বীকার খুব একটা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

-‘এ থেকে মুক্তি লাভের কী কোনো উপায় নেই?’

ডক্টর একটু ভেবে বললেন,
-‘ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন প্রচুর। সময় সাপেক্ষ। মনে হচ্ছে এ সমস্যা অনেক আগে থেকে। ট্রিটমেন্ট চলতে থাকলে ধীরে ধীরে হয়তো ঠিক হতে পারেন। আশা করা যায়। আচ্ছা ঠিক বলতে পারবেন রোগীর এমনটা কতবার হয়েছে বা হতে পারে? আই মিন মেডিকেল হিস্ট্রি চাইছি আরকি।’

-‘ মেডিকেল হিস্ট্রি তো জানা নেই। তবে বিয়ের পর এই নিয়ে তিনবার হলো। কিন্তু বিয়ের আগেরটা জানা নেই।’

-‘ওকে দেখছি কী করা যায়। এখন মেডিসিন দিচ্ছি বাড়িতে নিয়ে যান। আমি আপনাকে এ বিষয়ে পড়ে জানাচ্ছি।’

-‘ ডক্টর এখন কী রিস্ক মুক্ত?’
-‘এখনকার মতো।’
-‘ওকে! থ্যাংকিউ ডক্টর।’
-‘আপনাকেও।’
-‘ আসি তবে।’
-‘প্রয়োজনে আবার আসবেন।’
-‘সিওর।’

নিঝুম বেডে শুয়ে আছে। শরীর প্রচন্ড উইক। ইরা, ইশান টুকটাক কথা বলে ওকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছে। তখনই ইহান চিন্তিত মুখে প্রবেশ করে। ইশান এগিয়ে যায়।

-‘ কী বলল ডক্টর?’
-‘ আপাতত ডে’ঞ্জা’র মুক্ত কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে।’
-‘হুম’

নিঝুম ইহানকে দেখে কেমন জানি করে ওঠে। তার ফের তখনকার ঘটনা মনে পড়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে ইরাকে বলতে থাকে,
– ‘তুমি দেখেছ তো ইরা তোমার ভাই একটা মা’স্তা’ন। আমি বলেছিলাম না। ওই লোকগুলোকে কীভাবে ইশ….’

নিঝুম চোখ বন্ধ করে নেয়। কিঞ্চিৎ কাঁপছে তার শরীর। ইরা শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলে,।
-‘প্লিজ বউমনি আমার কথা শোনো। ভাইয়া কোনো মা’স্তা’ন নয়। ভাইয়া তো….. ‘

ইরা কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই ইহানের ইশারার চুপ হয়ে যায়। ইহান ইরা আর ইশানকে বাহিরে ওয়েট করতে বলে। ওরা তাই করে। কিন্তু নিঝুম ভয়ে সিটিয়ে থাকে। ইহান ধীর গতিতে এগিয়ে নিঝুমের সামনে গিয়ে বসে। নিঝুম কিছুটা সরে যায়। তার হাবভাব অস্বাভাবিক। ইহান নিঝুমের এক হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। নিঝুম দিতে নারাজ কিন্তু ইহান নাছোড়বান্দা। ইহান নিঝুমের অনেকটা কাছে এগিয়ে যায়। চোখে চোখ রেখে বলে,
– ‘তাকাও আমার দিকে।’

নিঝুম তাকায় না। সেভাবেই কাঁপতে থাকে। ইহানের ফের শান্ত কন্ঠ,

– ‘নিঝুম! তাকাও।’

ইহানের মুখ প্রথম নিজের নামটা শুনে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয় নিঝুমের। কিছুটা ভুলতে থাকে সবকিছু। ধীরে ধীরে ফিরে তাকায় ইহানের মুখের দিকে। ইহান নিঝুমের চিবুক তুলে ধরে,

– ‘ তুমি যা দেখেছ তা সম্পূর্ণই ভুল। এসব তোমার হ্যালুসিলেশন। তুমি সর্বক্ষণ এটাই ভাবো তাই তোমার চোখে শুধু এসবই ভাসে। বিশ্বাস না হয় ডক্টরকে জিজ্ঞেস করো। তিনিও এটাই বলবেন। আমি কোনো মা’স্তা’ন নই৷ আমি তোমার হাসবেন্ড।’

নিঝুম হয়তো কিছুটা গললো। ইহানের মুখের দিকে বোকাসোকা ভঙ্গিতে চেয়ে রইল। ইহান পর হাতটা ধরে বেড থেকে নামাল। নিঝুম এখনো ইহানকে দেখতেই ব্যস্ত। অতঃপর দু’জনে সেভাবেই বেড়িয়ে গেল। ইহান মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। আপাতত ব্রেইনওয়াশ সার্থক।

——————
কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। নিঝুম এখন এই পরিবারে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। এটা এখন তার নিজের বাড়ি বলেই মনে হয়। মাঝে মধ্যে বাবার বাড়ির জন্য মন কেমন করে তবে সেটাও আলগোছে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ইহানের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কেমন নোনতা নোনতা। ইহান সর্বদাই রেগে থাকে আর সে ইহানকে ইমপ্রেস করার টুকটাক চেষ্টা করে আরকি। মূলত সে কিছুটা ইহানের প্রেমে ভাসছে তবে মুখ ফুটে কাউকেই বলেনি। ইরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ইনিয়ে বিনিয়ে বেশ মজা নেয়। নিঝুম তখন লজ্জায় মিয়িয়ে যায়। সবকিছুর মধ্যে ইহান রাতে কোথায় থাকে এটা এখনো নিঝুমের অজানা। সে এটা নিয়ে গভীর তদন্তে আছে। ইহানকে ফলো করার বা কাউকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চায় না সে।

এমনই এক সকালে, নিঝুম তার শ্বাশুড়ি অনিলা খানের ঘরে পা রাখে। অনিলা খান তখন বুকশেলফের বইগুলো সোজা করে গুছাও নিচ্ছে। নিঝুম গিয়ে পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরে। আচমকা তিনি ভয় পেয়ে যান। পরক্ষণে বুঝতে পেরে হাত উল্টিয়ে নিঝুমকে আগলে নিয়ে বলে,

– ‘সকাল সকাল কী হয়েছে আমার মেয়েটার?’
– ‘কিছু না এমনিতেই।’
– ‘কিছু তো অবশ্য হয়েছে। বল তো তাড়াতাড়ি।’

নিঝুম আমতা আমতা করে বলে,’ একটা কথা বলি?’

-‘শুনতেই তো চাইছি।’
-‘সত্যি বলবে কিন্তু’
– ‘ হুম বল।’
– ‘ তোমার পায়ের এ অবস্থা কী করে হলো। মানে আমি ছবিতে দেখেছি তুমি আগে দাড়াতে পারতে তবে এখন এ অবস্থা কেন?’

অনিলা খান থমকে যান। মুহূর্তেই তার হাসোজ্জল মুখশ্রী ছেয়ে যায় ঘন কালো আধারে। নিঝুম জোরাজুরি করেই চলেছে কিন্তু সে শুনছে কী না কে জানে?

——————-

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব সংখ্যা-১১)

———————–
অনিলা খানের হঠাৎ চিৎকার আঁতকে ওঠে নিঝুম। মুহূর্তে পরিবেশ কেমন পাল্টে জানি যায়।
নিঝুমের বারংবার একই প্রশ্নে অনিলা খান বিচলিত হয়ে ‘চুপ কর’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। নিঝুম বুঝে উঠতে পারে না এই সহজ প্রশ্নে এমন রিয়েক্ট করার কারণ। যখন অনিলা খানের পায়ের সম্পর্কে নিঝুম জানতে চায় তখনও তিনি চুপ ছিলেন কিন্তু যখন নিঝুম তার মৃ’ত শ্বশুরের মৃ’ত্যু’র কারণ জানতে চায় তখনই কেঁপে ওঠে অনিলা খানের অন্তরিক্ষ। মনে পড়ে যায় ছয় বছর আগেকার সেই দুর্বিষহ স্মৃতি। অন্তঃকরণে সুক্ষ্ম যন্ত্রণার আঁচড় পড়ে। সেই এক্সিডেন্ট, সেই ম’র্মা’ন্তি’ক ঘটনা। নাহ নাহ! তিনি আর ভাবতে পারছেন না। দু-হাতে কান চেপে ধরে হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো জড়োসড়ো হয়ে কেঁদে ওঠেন। নিঝুম হতবাক। একজন কঠিন, শক্ত সামর্থ্য মহিলাকে হঠাৎ নিজ চক্ষু সম্মুখে এমন ভেঙে পড়তে দেখে সেও প্রচন্ড শকট। আনমনেই তার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে নানান প্রশ্ন,

– ‘মা কেন এমন করছে? আমি কী ভুল কিছু বলে ফেলেছি? ক্ষতটা খুব গভীর কিন্তু কী সেই ক্ষত? জানতে হবে আমায়। সবকিছু জানতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কে বলবে আমায়?’

নিঝুম ধীর পায়ে হেঁটে যায় অনিলা খানের নিকট। ভয়ে ভয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। অস্পষ্ট স্বরে বলে,

– ‘ প্লিজ কেঁদোনা মা। অজান্তেই তোমার মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে প্লিজ মাফ করে দাও। আমি আর কখনো এসব প্রশ্ন করব না। কক্ষনো না। তবু তুমি শান্ত হও।’

– ‘যদি আমাকে ভালো রাখতে চাস তবে আর কখনোই এসব প্রশ্ন করিস না।’

-‘করব না মা। কখনোই করব না।’

অনিলা খানের চোখের পানি মুছে দিয়ে নিঝুম দৌড়ে চলে যায় সেখান থেকে। অনিলা খান সেদিকে তাকিয়ে নিন্মস্বরে বলেন,

– ‘এসব কথা যে আমি কখনোই তোকে বলতে পারব না নিঝুম। কিছু কিছু সত্য জানতে নেই। সেগুলোর গোপনীয় প্রখর। যত অজানা থাকে ততই মঙ্গল।’

——————-
‘ইরা আছিস?’
-‘হ্যাঁ ভাইয়া আছি। ভেতরে এসো।’
-‘কী করছিস?’
-‘কলেজ যাবো তাই নোট’স গুলো চেক করে নিচ্ছি।’
-‘একটা কথা ছিল।’
-‘হুম বলো না।’
– ‘তুই আজকে হসপিটালে নিঝুমকে আমার সম্পর্কে যে সত্য জানাতে চাইছিলি সেটা যেন এখনই ও জানাতে না পারে। সময় হলে আমি নিজেই নিজেকে এক্সপোজ করব।’
– ‘আচ্ছা ভাইয়া ঠিক আছে।’
– ‘কখনো ভুল করেও যেন সত্যি টা ওর সামনে না আসে ইরা।’
– ‘হুম, তাই হবে। আমি সতর্ক থাকব।’
-‘ এই তো গুড গার্ল। আর একটা কথা…’

ইহান আমতা আমতা করছে। তা দেখে ইরা বলল,
– ‘ বলো না ভাইয়া। হ্যাজিটেড করছ কেন?’

ইহান একটা লম্বা শ্বাস নেয়। অতঃপর বলে,
-‘নিহান তোকে এখনো ডিস্টার্ব করে তাই না?’

ইরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে এমন প্রশ্নে। সেই সাথে চমকায়, থমকায়। কিছু বলতে চেয়েও পারে না। কথা গুলো যেন সব কন্ঠনালীতে এসে দলা পাকিয়ে আসছে। ইরাকে অপ্রস্তুত হতে দেখে ইহান ফের বলল,

-‘দেখ ইরা তুই আমার একমাত্র আদরের বোন। তোর সুখ-ই আমার কাছে বড় সুখ। তোর সুখের জন্য আমি যেকোনো কিছু করতে পারি। এখন তুই যদি চাস তবে আমি নিহানের…….. ‘

ইহানকে কথা শেষ করতে দেয় না ইরা। নিজেকে স্ট্রং করে উত্তর দেয়,

-‘ নাহ ভাইয়া। আমি এসবের কিছুই চাই না। তোমার কাছে যেমন আমি, আমার সুখ আগে তেমনই আমার কাছেও তুমি, তোমার সুখ আগে। যে পরিবার আমার ভাইয়ের জন্য ক্ষতিকর সেটা নিসন্দেহে আমার জন্যও ক্ষতিকর। আমি কখনোই চাই না ওদের ওই নোংরা পরিবারে পা রাখতে। ওরা শুধুই আমাদের দু’শ’ম’ন। আমি কখনোই এসব কিছু চাই না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। আর নিহানের ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। সামলে নেবো।’

ইহানের বুক থেকে যেন পাথর নেমে যায়। সে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। অতঃপর চোখ খুলে ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে বেসামাল পায়ে প্রস্থান করে।

ইহান চলে যায়। ইরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথার আভাস পায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সিক্ত গলায় বারকয়েক ঢোক গিলে। যেন চক্ষু বৃষ্টি আটকানোর প্রবল প্রচেষ্টা। যতই আটকাতে চাক চক্ষু কী আর বাঁধ মানে। অযথাই বেপরোয়া ভাবে গাল বেয়ে টুক করে মেঝেতে পড়ে। ইরা ধপ করে বসে পরে ফ্লোরে নেত্রযুগল আলগোছে বন্ধ করে নেয়।

কবে শেষ হবে এই লুকোচুরি খেলা? কবে শান্তি নামবে ধরনীর বুকে? কবে শা’স্তি পাবে অ’প’রা’ধী’র দল?

——————-
সেদিন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নিঝুম অসুস্থ থাকায় এখনো একদিনও ক্লাস এটেন্ড করতে পারে নি। এখন যেহেতু সে সুস্থ তাই ঠিক করেছে আজ কলেজে যাবে। ঠিক মতো ক্লাস এটেন্ড না করলে এক্সাম কীভাবে দিবে। ইশান আর নিঝুম তো একই ক্লাসে। তাই নিঝুম সকাল সকাল ইশানের রুমে এসে হাজির। উদ্দেশ্য ইশানের সঙ্গে ক্লাস বিষয়ক কথা বলা।

নিঝুম ইশানের ঘরের সামনে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে কারণ আগের দিন যা দেখেছে। আজও যদি বাঁদর টা তার ইতিহাসিক বাঁদর ডান্স দিতে থাকে তো আজকে ওকে খুব করে জব্দ করবে। ঘটনা টা হলোই তাই। ইশান ঠিকই মিউজিক বাজিয়ে ডান্সিং করছে। নিঝুম আলগোছে দরজার আড়াল থেকে সেই দৃশ্য কিছুটা ভিডিও করে নেয়। অতঃপর দাঁত কেলাতে কেলাতে ভেতরে প্রবেশ করে। ইশান নিঝুমকে এখনো খেয়াল করে নি। হঠাৎ মিউজিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইশান থেমে যায়। পাশ ফিরে দেখে নিঝুম ঠোঁট টিপে হাসছে। ইশান কিঞ্চিৎ লজ্জা পায়। দৌড়ে ওয়াশরুম চলে যায়। ইশানের কান্ড দেখে নিঝুম এবার খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। অতঃপর হাসতে হাসতেই ইশানের বুকশেলফের কাছে যায়। সেখান থেকে বই নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে।

ইশান বেশ সময় নিয়ে বের হয়। মূলত সে নিঝুমের সামনে আর পড়তে চাইছে না। কিন্তু বের হয়ে এখনো নিঝুমকে তার রুমে দেখে কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হয় সে। বুঝতে পারে নিঝুমের এখানে আসার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। ইশান এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে নিঝুমের কাছে গিয়ে বলে,

-‘বউমনি তুমি কী কিছু বলতে চাও।’

নিঝুম মাথা নাড়ে যার অর্থ হ্যাঁ। ইশান ভ্রু উচিয়ে বলে,
– ‘কী? তাহলে বলে ফেলো।’

– ‘আসলে আমি আজ থেকে নিয়মিত কলেজে যেতে চাইছি। তোমার আর আমার ক্লাস তো একই তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে যাই এ বিষয়ে আলাপ করে নেই।আমরা কী একসঙ্গে যেতে পারি।’

– ‘ওহ সিওর। এটা তো আরও ভালো হয়। তুমি রেডি হয়ে নাও একসঙ্গে বেড়চ্ছি আমরা।’

– ‘আর একটা কথা। তুমি আর আমি যেহেতু সেইম ইয়ার তখন তুমি আর আমাকে এসব বউমনি – টউমনি বলে ডেকো না।’

– ‘তবে কী বলতাম। সম্পর্কে তো তুমি আমার একমাত্র সুইট,কিউট বউমনি হও।’

– ‘তাতে কী আমরা তো একই বয়সী। তার ওপর কলেজে গিয়ে তুমি আমাকে বউমনি,বউমনি করলে ব্যাপারটা কেমন দেখায় না? আর আজকাল জেনারেশনে কেউ এতো নেম কল্ড’ এ গুরুত্ব দেয় নাকি। বন্ধুক্তই আসল।’

– ‘ হুম তা অবশ্য ঠিক। তবে আমি তোমায় কী বলে ডাকব?’

– ‘অবশ্যই নিঝুম বলে। উই ক্যান বি ফ্রেন্ডস?’

– ‘সিওর।’

নিঝুম আর ইশান একে অপরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে নেয়। যার তবে বাড়িতেই নিঝুমের একটা বন্ধু হয়ে গেল।

———————-
ইরা, ইশান, নিঝুম আজ একসঙ্গে কলেজে এসেছে। ইরা নিজের মতো তার ক্লাসে চলে গেছে। ইশান ও নিঝুম একসঙ্গে এগোচ্ছে। ক্লাসে ঢুকতেই ইশানের সঙ্গে সুন্দরী মেয়েকে দেখে ইশানের জুলিয়েট গুলো সাময়িক আহত হয়। ইশান তো আগে কখনো এমন করে নি তাহলে এই মেয়ে কে? সকলেরই এক প্রশ্ন। তখন ইশান বলে নিঝুম তার বেস্ট ফ্রেন্ড। যেটা শুনে নিঝুম মনে মনে বেশ খুশি হয়। ওরা দু’জনে আজ পাশাপাশিই বসে। ইশান নিত্যদিনের মতো আজকে আর কোনো জুলিয়েট নিয়ে ছুকছুক করছে না বরং নিঝুমের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে পাশাপাশি মন দিয়ে ক্লাস করছে। নিঝুম নতুন তাই তার এই মুহুর্তে কোনো সঠিক সঙ্গ প্রয়োজন এটা ভেবেই ইশান তাকে এভাবে গাইড করছে।

আজকের আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। রোদের ছিটে ফোঁটাও নেই। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে আকাশের বুক চিড়ে নেমে আসবে ঘন মেঘের বর্ষন। ইশান কিছু একটা জরুরি কাজে গেছে। ইরা আর নিঝুম নিজেরাই বাড়িতে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। নিঝুম ইরাকে আজকের সকল ঘটনা গুছিয়ে গুছিয়ে বলছে। ইরাও মিষ্টি হেসে উপভোগ করছে। তারা যখন কলেজের গেটের প্রায় কাছাকাছি ঠিক তখনই ধরনীর বুকে ঝমঝম করে বৃষ্টির আবির্ভাব। ইরা, নিঝুম মাথায় কোনো রকমে হাত দিয়ে দৌড় লাগায়। নিঝুম আগে আগেই গাড়িতে উঠে বসে কিন্তু ইরা যখনই উঠতে নেয় কেউ তার হাত খুব শক্ত করে টেনে ধরে। হঠাৎ হয়ে যাওয়া ঘটনায় ইরা ঘাবড়ে গিয়ে পেছনে তাকায়। পরক্ষণেই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুখশ্রী থমকে দেয় তার দুনিয়া। সেই হাসি,সেই চোখ, সেই নেশা ধরা চাহনি। উফহ! ইরার হার্ট অ্যাটাক না হয়ে যায়।

——————

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি