#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#২৫তম_পর্ব
ধারা আর কিছুই বলতে পারলো না, তার আগেই তার ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁট দিয়ে দখল করে নিলো অনল। আকর্ষিক ঘটনায় মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যায় ধারার। উষ্ণ ছোয়ার আবেশের চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসে তার। হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে চলেছে ধারার। শিরদাঁড়ায় যেনো উষ্ণ রক্তের প্রবাহ ছুটে যাচ্ছে। অনল তার অতৃপ্ত হৃদয়ের তৃষ্ণা মিটাতে ব্যস্ত। সময়টা থেমে গেলে হয়তো মন্দ হতো না। দুজন দুজনের আবেশে কত সময় ছিলো তারা নিজেরাও জানে না। যখন অনলের ঠোঁটের কবল থেকে মুক্তি পেলো তখন চোখজোড়া আর তুলতে পারছিলো না ধারা। রাগ তো দূরের কথা, মুখ থেকে স্বর অবধি বের হচ্ছে না তার। মাটির দিকে চোখ রেখে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। বুকের ভেতর যেনো কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে ধারার৷ গাল দুটো টমেটোর ন্যায় লাল হয়ে আছে। ধারা লাজে রাঙা মুখটা যেনো অনলের আরো বেশি ভালো লাগছে। বাঁকা হাসি দিয়ে দুষ্টুমির স্বরে বলে,
– বড্ড বেশি বকিস তুই, এতো বকলে তো মুখ ব্যাথা হয়ে যাবে। অবশ্য এভাবে মুখ বন্ধ করতে আমার আপত্তি নেই। একচ্যুয়ালি ইট উড বি বেটার ফর মি। প্রতিবার তোর নরম ঠোঁটজোড়ার স্বাদ নিতে পারবো।
– অসভ্য পুরুষমানুষ
– হাহাহা
গগণবিদারী হাসি দিয়ে আলতো হাতে ধারার লাজের রাঙা মুখটা তুলে ধরে অনল। কপালে উষ্ণ পরশ একে ধীর স্বরে বলে,
– আর কখনো এমন ভুল হবে না। এই প্রথম আর এই শেষ। কি করবো বল, আমি তো জানতাম না তুই আমাকে ভালোবাসিস। তোকে আটকে রাখার সাহস করে উঠতে পারি নি।
– কে বলেছে আমি তোমায় ভালোবাসি। একদম ভালোবাসি না তোমায়।
অভিমানী গলায় ধারা কথাটা বলে। অনল ও নাছোড়বান্দা আজ ধারার মুখ থেকে তার মনের কথাটা বের করবেই। আরেকটু কাছে এসে ধীর গলায় বলে,
– তাহলে দিগন্তকে ফিরিয়ে দিলি কেনো?
– এম…এমনি, ও যা করেছে তার পরে ওর কাছে ফিরে যাওয়া মানে নিজের আত্নসম্মানের জলাঞ্জলি দেওয়া। তাই
– আর দিগন্ত যে বললো, তুই নাকি ওকে বলেছিস, তুই আমাকে ভালোবাসিস।
– ও.. ওতো এমনি
– সত্যি?
– হু
অনলের গরম নিঃশ্বাস ধারার মুখমন্ডলে আছড়ে পড়ছে। কথাগুলো সব গলাতেই আটকে যাচ্ছে ধারার। নিঃশ্বাস ক্রমান্বয়ে ভারী হয়ে যাচ্ছে। মুচকি হাসি দিয়ে অনল তখন বললো,
– থাক তোর আমাকে ভালোবাসা লাগবে না। আমার একার ভালোবাসাই আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট। তোর মতো কিপটার ভালোবাসা দিয়ে কাজ নেই। হাহ। একবার ভুল করেছি বলে যে প্রতিবার করবো তার তো মানে নেই। এই যে তোকে আটকে রেখেছি সারাটাজীবন এভাবে আমার সাথে বেধে রাখবো। তুই এখন থেকে চাইলেও ছাড়া পাবি না। আমার কাছেই তোকে থাকতে হবে।
– তাহলে ফিরিয়ে দিচ্ছিলে কেনো?
– আমি দ্বিধাতে ছিলাম ধারা
– আমি কি স্ত্রী হিসেবে এতোটা অযোগ্য যে আমাকে কিছুই বলা যায় না?
– এটাই তো ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো হবে। এই কান ধরছি।
বলে কানে হাত দেয় অনল। অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললো ধারা,
– ভালোবাসো আমাকে?
– খুব, তোকে হারাবার যন্ত্রণা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তোকে কতোটা ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি
অজান্তেই চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো ধারার। সুখগুলো এভাবে হাতছানি দিবে সেটা যেনো কল্পনার বাহিরে। কাঁপা স্বরে অশ্রুসিক্ত চোখে বলে সে,
– আমার মতো কলঙ্কিনী তোমাকে কিছুই দিতে পারবে না অনল ভাই। যখন আমার কাছে আসবে
– আমি তোর শরীরকে ভালোবাসি নি ধারা। আচ্ছা, একটা কথা বলতো আমি যদি কোনো বিধবা বা ডিভোর্সী কাউকে বিয়ে করতাম তবে এটাই হয়তো তাই না? ভালোবাসাটা কখনোই অন্যায় না, অন্যায়টা ভালোবাসার নামে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলাটা। ভালোবাসা মানে কখনোই শারীরিক সম্পর্ক নয় ধারা। তোরা মেয়েরা এতোটা বোকা কেনো হোস বলতো? অবশ্য এটা তোদের দোষ না। মানুষ তো জীবন দিয়েও ভালোবাসার মানুষটাকে সুখী করতে চায়। সেখানে শরীর তো তুচ্ছ। তোর বয়স অল্প তাই আবেগের বশে ভুল করে ফেলেছিস। আর আমি তো তোর অতীত জেনে, আমার প্রিন্সেসকে মেনেই তোকে ভালোবেসেছি। তাহলের অতীতের তেতোটুকু বাদ দিয়ে আমরা আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎটাকে সাজাতে পারি না?
– হুম পারি।
– তাহলে আর কখনো নিজেকে কলঙ্কিনী বলবি না। আমার ধারা কলঙ্কিনী নয়। আমার সাথে সারাজীবনের পথটুকু চলবি? শুধু কাগজের স্ত্রী নয়, সত্যিকারের স্ত্রী হয়ে।
অনলের কথাটা শেষ হবার আগেই তাকে জড়িয়ে ধরে ধারা। কাঁপা কন্ঠেই বলে উঠে,
– ভালোবাসি
একটা শব্দ অনলের হৃদয়ে শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। ধারাকে যতটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরা যায় ততোটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে। সকল অভিমান,রাগ যেনো গলে জল হয়ে গেলো। এখন শুধু ভালোবাসার স্নিগ্ধতা বিরাজমান নিজেদের মাঝে, এটাই তাদের নতুন পথচলার সূচনা_________
সময় বহমান, দেখতে দেখতে আরো দু মাস কেটে গেছে। ধারার পেটটা আরো খানিকটা বড় হয়েছে। এখন চলাফিরা করতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। অনল তার ডিউটি সকাল সকাল নিয়ে নিয়েছে। যাতে বেশি সময় ধারাকে দেওয়া যায়। বাচ্চাটা পেটেই বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে। ডিলেভারীর সময় যত ঘনিয়ে আসছে অনলের বুকটা ততো ধরপর করছে। সারাটা রাত জেগে থাকে, এই ভয়ে যে যখন তখন পেইন উঠলে যাতে হাসপাতালে নিতে পারে। ধারাও বেশ যত্নশীল হয়ে উঠেছে। সেও চায় সুস্থভাবে বাচ্চাটার ডেলিভারি হোক। সুভাসিনী বেগম এবং রাজ্জাক সাহেবের সম্পর্কটাও বেশ ভালো হয়ে উঠেছে। এখন শুধু অপেক্ষা একটা ছোট মেহমানের বাসায় আসার।
রাত তিনটা,
বাথরুমে যাবে বিধায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে ধারার। অনল তার পাশে ঘুম। ক্লান্ত অনলের ঘুমন্ত মুখটা ধারার সবথেকে প্রিয়। এমনি সময় হলে হালকা ধাক্কা দিলেই অনলের ঘুম ভেঙ্গে যেতো। কিন্তু আজ কেনো যেনো ইচ্ছে হলো না অনলকে জাগাতে। লোকটা প্রচুর খাটাখাটুনি করে। সারাটাদিন ডিউটি করে রাতে তার জন্য জেগে থাকে, একটু ঘুম তার প্রাপ্য। আজ যেহেতু শান্তিতে ঘুমোচ্ছে, ঘুমাক না। এতোটুকুই তো পথ। ধারা একাই যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। অনলের কপালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে আস্তে আস্তে খাট থেকে নামে সে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বাথরুমের দিকে। সব ঠিক ই ছিলো, গোলটা বাধলো আসার সময়। বাথরুমের বিটটার দিকে আধার আলোতে চোখ যায় নি ধারার। ম্যাক্সিতে বেধে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে সে। অমনি মুখ থুবড়ে পড়ে যায় সে। আর বাথরুমের বিটটা পেটে যেয়ে লাগে। পেট নিচে করে পড়ায় অসম্ভব ব্যাথা পায় সে। চাপা আর্তনাদ করতে থাকে ধারা। আর্তনাদের শব্দ কানে যেতেই ধরফরিয়ে উঠে যায় অনল। ধরফরিয়ে উঠে বাথরুমের কাছে যেতেই দেখে রক্তে ভেসে যাচ্ছে ধারার ম্যাক্সি। পেটে হাত দিয়ে শুধু চাপা আর্তনাদ করছে ধারা। মৃত্যুকে যেনো সম্মুখে দেখছে সে। অনলের মাথাটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফাঁকা হয়ে গেছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে। ধারাকে এই অবস্থায় দেখে যেনো সারা শরীর হিম হয়ে গেছে তার। হাত পা কাঁপছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ছুটে গেলো ধারার কাছে। তাড়াতাড়ি তাকে কোলে তুলে নিলো। চিৎকার করে সুভাসিনী বেগম এবং রাজ্জাক সাহেবকে ডাকলো সে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা চলে এলো। ধীরে ধীরে গাড়িতে বসালো ধারাকে। সুভাসিনী বেগমের কোলে ধারাকে শুইয়ে শুধু একটা কথা বললো,
– ধারা চোখ বন্ধ করবি না। একটু সময় দে।আমরা পৌছে যাবো।
বলেই ছুট লাগালো হাসপাতালের দিকে। সময়টা যেনো প্রতি মিনিট এক এক বছর লাগছে অনলের কাছে। অপেক্ষা শুধু তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌছানোর।
ভোর ৪টা,
ধারাকে ওটি তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধারার ডাক্তারকে আনানো হয়েছে। তিনি ধারার পজিসন চেক করছে। বাহিরের সিটে বসে আছে অনল। হাতটা ধারার রক্তে লাল হয়ে আছে। ধারার জ্ঞান ওটিতে যাবার আগ পর্যন্ত ছিলো। অনলের হাতটা শক্ত করে ধরে ছিলো সে। চোখটা বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অনন্যাকে নিয়ে একদিন এভাবেই হাসপাতালের বাহিরে বসে ছিলো। আজ ধারাকে নিয়ে। বুকটা কামড় দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। বুকটা হাহাকার করছে। তখন ই ডা. ইশরাত বের হয়ে আসে। তার মুখটা আশংকায় ছোট হয়ে আছে। তার মুখ দেখেই কিছু একটা আশংকা করতে পারছে অনল। উদ্বিগ্ন হয়ে অনল তার কাছে ছুটে গেলো।
– ম্যাম কি হয়েছে? ধারার অবস্থা এখন কেমন?
– ভালো না অনল। কারোর অবস্থা ভালো না। এখনি অপারেশন করতে হবে। ব্লাড এর দরকার আছে। আর একটা কথা, বেবির পসিজন ভালো না। এখন তোমাকে ডিসিশন নিতে হবে হয় ধারা নয় বেবি।
কথাটা শুনতেই ধপ করে বসে পড়ে অনল। চোখ থেকে পানি পড়ছে। কি করবে এখন সে। এই বাচ্চাটা যে তার এবং ধারার বেঁচে থাকার একটা সূত্র ছিলো। তাদের সম্পর্কের সূত্রপাত ই হয়েছে এই বাচ্চাটার জন্য। আর ধারা তো তার ভালোবাসা। কিভাবে তার প্রিন্সেস আর ধারার মধ্যে বাঁচবে সে। ডা. ইশরাত বেশ জোর গলায় বললেন,
– অনল ফাস্ট ডিসিশন নাও। উই হ্যাভ টু ওপারেট।
– ম্যাম আমি তাদের মধ্যে কিভাবে বাছবো। তারা দুজন আমার কাছে সমানভাবেই জরুরি। দুজনকেই যে আমার চাই ম্যাম। আমি বাঁচতে পারবো না ওদের ছাড়া।
– বাট আমি শিওর নই অনল। বেবির যা পজিশন আমার মনে হয় না দুজনকে বাঁচামো সম্ভব। যদি না আল্লাহ কোনো মিরাকেল করেন।
– ম্যাম আমি কাউকে চুজ করতে পারবো না। প্লিজ ম্যাম, আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করেন ম্যাম।
– ওকে তাহলে তুমি ফর্মে সাইন করে দাও।
বলেই তিনি ভেতরে চলে যান। একজন নার্স এসে একটা ফর্ম নিয়ে এসেছে। অনলের হাত কাঁপছে, সাইন করার সময়। সুভাসিনী বেগম তখন তার ঘাড়ে হাত দেয়। অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে অনল বলে,
– মা, আমার ধারা
– কিচ্ছু হবে না দেখিস, তুই আল্লাহ এর কাছে চা। উনি ই পারবেন তোর ধারাকে ফিরিয়ে দিতে।
সুভাসিনী বেগমের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইন করে দেয় অনল। ওটি তে অপারেশন শুরু হয়। প্রতিটা মূহুর্ত যেনো এক এক ক্রোশ সময় লাগছে অনলের কাছে। নামাযের পাটিতে বসে পাগলের মতো সে বাচ্চাটি এবং ধারার জন্য। অনলের যে দুজনকেই চাই। চারঘন্টা পর ডা.ইশরাত ওটি থেকে বের হয়। উদ্বিগ্ন হয়ে তার দিকে এগিয়ে যায় অনল। তখন ডা.ইশরাত বলেন…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি