কাঞ্চাসোনা_২ পর্ব-১৯

0
200

#কাঞ্চাসোনা_২
#পর্ব_১৯
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

ফজরের নামায পড়ে মিতু আল্লাহর কাছে সামিরের সুস্থতা কামনার জন্য কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করে।এই মূহুর্তে সামিরের সুস্থতাই যেনো তাকে সস্থি দিতে পারবে।সাতটা পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে জায়নামাযে বসে থাকে।বাহির থেকে সবার টুকটাক কথা বার্তা,ধ্রুবর অফিসে গমন সব ব্যাপারে তীক্ষ খেয়াল রাখে।সকাল এসে নাস্তা খাওয়ার জন্য ডেকে যায়,মিতু শুনেও কথা বলেনি,কারো সাথে কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছে না তাছাড়া নাস্তা তার গলা দিয়ে নামবে না।সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে সে আয়নায় গিয়ে নিজের চেহারা দেখে।সারা রাত না ঘুমিয়ে কান্নাকাটি করার ফলস্বরূপ দুই চোখের পাতা ফুলে আছে।এই চোখ দেখলে যে কেউ বুঝবে যে মিতু প্রচুর কেঁদেছে।সে তার দুর্বলতা কাউকে দেখাতে চাচ্ছে না আর না কারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চাচ্ছে।ব্যাগে বই নিয়ে ড্রয়ার থেকে কিছু ভারতি টাকা নেয়;তারপর দ্রুত পায়ে মেইন দরজা পর্যন্ত গিয়ে জোড় গলায় বললো,
“আম্মা আমি ভার্সিটি যাচ্ছি।”

মনোয়ারা রান্নাঘর থেকেই বলে,
“খেয়ে যা!”

মিতু পায়ে জুতা পরে দরজা আটকাতে আটকাতে বললো,
“কেন্টিনে খেয়ে নেবো।আল্লাহ হাফেজ।”

মনোয়ারার হাতে কাজ ছিলো বিধায় বেশি কথা বাড়ালোনা।মিতু বের হয়ে সামিরের বাসার উদেশ্যে রওনা হলো।যাওয়ার পথে সামনের মার্কেট থেকে সামিরের জন্য জ্বরের ওষুধ কিনলো,তার মন বলছে সামির ওষুধ খায়নি,আর না কিনেছে।ওষুধ কিনা শেষে পাউরুটি,কলা,দধি,আরো কিছু ফল কিনে সামিরের বাসার সামনে আসলো।বাসার সামনে এসে বাধলো আরেক বিপত্তি দারোয়ান তার কর্তব্য পালনে বেশ কঠিন।সে কোনভাবেই ভেতরে ঢুকতে দেবে না।মিতু অনেক অনুনয় করে বললো কিন্তু দারোয়ান অনড়।ভেতরে যেতে না পারলে মিতুর কার্যসিদ্ধি হবে না।সামিরকে এক পলক চোখের দেখা দেখতে হলেও ভেতরে ঢুকা আবশ্যক।সে হুট করে এক কাজ করে বসলো,পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে দারোয়ানের হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,
“রাখেন মামা।অসুবিধা না বুঝলে চলে?”

হাতের মুঠে টাকা যেতেই দারোয়ানের গলার স্বর বদলে গেলো।হাতটা পেন্টের পকেটে ডুকিয়ে নরম গলায় বললো,
“তোমারে আমার বইনের মতো লাগে বইলা ডুকতে দিলাম যাও।”

মিতু সামনে পা বাড়িয়ে মনে মনে ভাবে’সালা,ঘুষখোর;টাকা পেয়ে বইন হয়ে গেছি‌!’

মিতু দ্রুত পায়ে সামিরের ফ্লোরে উঠে আসে।ধুকপুক বুকে কলিংবেল দেয় কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই।মিতু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দরজার নব ঘুরিয়ে দেখে দরজা খুলা।তার ভ্রু দুটো কুঁচকে যায়।হাতের ব্যাগ নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়।তারপর ডাকে,
“সামির ভাই!সামির ভাই!”

খালি বাসায় তার ডাক প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে।সে মাথা ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকায়।মিতু মনে মনে ভাবছে”সামির কি বাসায় নেই?এতো জ্বর নিয়ে কোথায় যাবে?দরজা খোলা কেনো?আর বাসায় থাকলে সাড়া দিচ্ছে না কেনো?”
মনে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে মিতু সামনে এগিয়ে যায়।রুমের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে সিঙ্গেল খাটে সামির কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।সামিরকে এই অবস্থায় দেখে মিতুর বুকে ব্যাথার আনাগোনা হয়।এগিয়ে গিয়ে সামিরের কপালে হাত রাখে;মিতুর চোখ ভরে জ্বল আসে,এই ছেলের কপাল যে পুড়ে যাচ্ছে!এমন নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে কিভাবে?মিতু হলে নির্ঘাত কান্নাকাটি করে একাকার হয়ে যেতো কিন্তু সামির কাঁদবে কার কাছে?সামির যে এতিম!সামিরের কষ্টে মিতু শব্দ করে ডুকরে কেঁদে দেয়।শক্ত মনের পুরুষটাকে চোখ ভরে দেখে।জ্বরের কারণেই মুখটা কেমন র/ক্তশূন্য লাগছে,ঠোঁট শুকিয়ে রুক্ষ হয়ে আছে।মিতু সাহস করে সামিরের গালে হাত রাখে।সে ভেবেছিলো সামির জেগে তাকে ধমকে দেবে কিন্তু তখনো সামির নিশ্চুপ।মিতুর কষ্টে মনটা কুকড়ে যায়,জড়ানো গলায় ডাকে,
“এই!শুনেন না।সামির!”

সামিরের নিশ্চুপতা তাকে আরো কষ্ট দেয়,শুকনো মুখ মিতুর হৃদয়ে বি/ষাক্ত দুঃখে ভরে দেয়।সামিরের কাছে বসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে ডাকে,
“সামির!”

সামির নড়েচড়ে উঠে।বহু কষ্টে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়।মিতুকে দেখে রেগে যায় না বরং ঠোঁটের কোলে একটু হাসি ফুঁটে উঠে,আলগোছে জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়,তারপর আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে।

মিতু আস্তে করে বললো,
“খুব কষ্ট হচ্ছে?”

সামির চোখ বন্ধ রেখেই মাথা নাড়ে।তার মানে তার কষ্ট হচ্ছে না।মিতু সামিরের কপালের উপর থেকে অগোছালো চুল সরিয়ে বললো,
“মিথ্যা বলেন কেনো?আমি জানি কষ্ট হচ্ছে।”

সামির কিছু বলে না অপলক মিতুকে দেখতে থাকে।মিতু সামিরের চোখে চোখ রেখে বললো,
“নাস্তা করেছেন?”

“না।”

“কেনো?”

সামির কিছু বলে না মুচকি হাসে।মিতু অসুস্থ ছেলেটার দিকেও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে,অসুস্থ অবস্থায়ও কতো সুন্দর লাগছে!মিতু সামিরের মুখে হাসি দেখে সাহস পেলো।সামিরের উতপ্ত হাত আঁকড়ে ধরে বললো,
“কি দেখেন?”

সামির চোখ ফিরিয়ে নেয়।মিতু আবার বললো,
“ওষুধ এনেছেন?”

সামির চোখে হেসে বললো,
“না।”

মিতু কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
“কেনো?এতো জ্বর ওষুধ আনা দরকার ছিলো না?”

সামির কোনো রাখঢাক না রেখে সোজা গলায় বললো,
“টাকা নেই।”

মিতু আর কোনো কথা বললো না তার আনা ব্যাগ থেকে সব বের করে বললো,
“উঠুন।নাস্তা করে ওষুধ খাবেন।”

সামির গো ধরে বললো,
“না।ভালো লাগছে না।”

মিতু সামিরের দিকে একপলক তাকায় তারপর নরম গলায় বললো,
“বেশী খারাপ লাগছে?”

সামির কম্বল সরিয়ে হাতটা বুকে রেখে বললো,
“কালকে তুমি দেখা করোনি,এইখানে এখনো কষ্ট হচ্ছে।য/ন্ত্রনায় সারারাত ঘুমোতে পারিনি।”

কি সহযভাবে ছেলেটা অভিমান প্রকাশ করছে।হয়তো জ্বরে কাবু হয়ে আছে বলেই নিজের শক্ত খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছে।মিতু অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে।সামিরের বলা কথা তার কানে বাজছে,সে বিশ্বাস করতে পারছে না।মিতু আস্তে করে বললো,
“আমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন?”

সামির কম্বলে নাক অবধি ঢেকে চোখ খুলে রাখে।মিতুর চোখে চোখ রেখে বললো,
“হ্যাঁ।জ্বরে বেশী খারাপ লাগছিলো তাই ভাবলাম আমার শান্তির অরন্যে একটু ঘুরে আসি কিন্তু অরন্য তো দেখাই দিলো না।”

সামিরের কথায় মিতু ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।এসব কথার মানে কি?সামিরও তাকে ভালোবাসে?মিতুর কেমন ঠান্ডা অনুভূতি হচ্ছে।সামির অপলক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে।জ্বরে তার বেহাল দশা বিছানা থেকে উঠার শক্তি নেই সকালে রুমমেট যখন অফিসে যাওয়ার আগে বলে গেলো দরজা লক করতে সে করবে বলেও উঠেনি আর দরজাও লক করা হয়নি তাইতো মিতু ঢুকতে পেরেছে।সামির নিজেও মিতুর সানিধ্য চাইছিলো,প্রেয়সীর কাজলকালো চোখে ডুবতে ইচ্ছে করছিলো।কালকে দেখতে যেয়েও তো দেখা করতে পারেনি মেয়েটা অভিমানে আছে কিনা!সামির মিতুর দিকে তাকিয়ে হাসে।কাঁদার কি আছে?সামির দুর্বল গলায় বললো,
“কাঁদো কেনো?”

মিতু হাতের তালু দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো,
“ভালোবাসেন আমাকে?”

সামির বুঝলো আজকে একটু বেশীই নিজেকে প্রকাশ করে ফেলেছে।সে শক্ত হতে মিতুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
“না।সেটা অসম্ভব?”

মিতু অবাক হয়ে বললো,
“তাহলে এসব বললেন কেনো?”

সামির কঠিন গলায় বললো,
“তোমাকে সব এক্সপ্লেইন করতে হবে?”

“করতে হবে না?”

সামির মাথা নেড়ে বললো,
“না।”

মিতুর বুকে শক্ত হাতুড়ির আ/ঘাত লাগে।চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ে।উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে পা বাড়ায়।সামির বিছানা থেকেই হাত টেনে মিতুকে আবারো বিছানাত বসে।মিতু মাথা নেড়ে বললো,
“থাকবো না এখানে আর চলে যাবো।ছাড়েন।”

সামির কিছুক্ষণ মিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর আচমকা মিতুকে টেনে নিজের পাশে নিয়ে আসে মিতু কিছু বুঝার আগেই নিজের কম্বল দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।মিতু স্তব্ধ হয়ে সামিরের দিকে তাকিয়ে আছে।সামিরের এমন কাজে সে হতবাক।সামিরের গায়ের উচ্চ তাপমাত্রায় সে কেঁপে উঠে।কিছু বলার কিংবা সামিরকে আঁকড়ে ধরার কোনো শক্তিই তার অবশিষ্ট নেই।হাত পা মনে হয় জমে শক্ত হয়ে গেছে।
সামির চুপচাপ মিতুর প্রতিক্রিয়া দেখলো।আজকে কেনো জানি নিজেকে ঢেকে রাখা যাচ্ছে না,প্রেমে পাগল হতে ইচ্ছে করছে।সে মিতুর কানে তার ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বিরবির করে বললো,
“তুমিই তো আমার জ্বরের প্রধান ওষুধ।যেতে দেই কি করে?”

মিতু সামুরের দিকে তাকায়।সামিরের গরম পুরুষালি হাত তখন তার পেটের উপরে পড়ে আছে।মিতুর কেমন পাগল লাগে।ক্ষনে ক্ষনে শরীরে অনুভূতির প্রকাশ টের পাচ্ছে।প্রণয় পুরুষের এমন আত্মসমর্পণ মিতুকে আনন্দ দেয়,বুকের র/ক্ত ছলাৎ ছলাৎ করে উঠে।সামিরের মতোই ফিসফিস করে বললো,
“ভালোবাসেন আমায়?”

সামিরের হাত ততক্ষণে মিতুকে তার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছে।গরম হাতে মিতুর গালে হাত ভুলাচ্ছে।মিতুর কথায় কোনো উত্তর দেয় না কিন্তু এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো।কাজলচোখের কন্যার নরম,কোমল ঠোঁটে তার জ্বরে পুড়া উতপ্ত ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দেয়;ছুঁয়ে মিতুর দিকে তাকায় তারপর পাগলপ্রেমিক রূপ ধারন করে মিতুকে নিজের উতপ্ত পরশে আয়ত্ব আনতে চায়।মিতু কিছুক্ষণ পাথরের মতো পড়ে থাকলো কিন্তু সামিরের জন্য কাতর মেয়েটা খুব সহযেই সামিরের আয়ত্বে চলে আসে।ভালোবাসার আলোড়নে সাড়া দেয়।আঁকড়ে ধরে প্রণয়পুরুষের চুল।সামির আজকে নিজেকে কোনোভাবেই থামাতে পারছেনা,মন শরীর উভয়ই উচ্চস্বরে ঘোষনা করছে মিতু তার একমাত্র তার,মিতুকে পাগলের মতো ভালোবাসার অধিকার শুধু তার।এমন কথায় শরীরের প্রতিটা রক্তকনা তাদের সাথে আরেকটা কনিকার দ্রুত ছুটে চলা লক্ষ করে।আজকে জ্বরের তোপেই কিনা সামির একদম নিজের নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে যায়।
সবসময় ভালো না বাসা সামিরের যখন এমন পাগ/লামো তখন মিতু খুশী হবে নাকি দুঃ/খ পাবে বুঝতে পারছেনা তার এক এজানা অনুভূতি হচ্ছে।সামির যখন আরো গভীরে যেতে চাইছে মিতু কেঁপে উঠে।ফিসফিস করে বললো,
“না।এটা ঠিক না তো।”

সামির মাথা তুলে মিতুর দিকে তাকায়।জ্বরে লাল হওয়া চোখে তখন অন্য নেশা।জড়ানো গলায় বললো,
“কেনো এসেছো?যানো না আমি বাসায় একা?হু”

মিতু সামিরের বুকে হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে চায়।
“আমিতো যত্ন করতে এসেছিলাম।”

সামিরের হাত ততক্ষণে লাগামহীন।পাগল ব্যক্তি কাজলচোখের মেয়েকেও পাগল বানাতে ব্যস্ত।নিভু গলায় ফিসফিস করে বললো,
“লোহা আর চুম্বক যদি কাছে আসে।চুম্বক ঠিক লোহাকে কাছে টানবেই।এটা চুম্বকের ধর্ম।আমার কাছে আসা একদম ঠিক হয়নি মিতু একদম ঠিক হয়নি।”

মিতু চোখ আবেশে বুজে আসে।বুকের হৃদপিণ্ড কাঁপছে অস্বাভাবিক গতিতে।কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“ভুল হয়েছে আমার ভিষণ ভুল হয়ে গেছে।”

সামির গভীর চোখে তাকিয়ে বললো,
“এখন ভুলের মাসুল দাও।”

চলবে—-