#কাঞ্চাসোনা_২
#পর্ব_২১
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
রাতের নিস্তব্ধতায় এক বিবাহিত রমনী একলা বসে আছে।শুধু বিবাহিত বললে ভুল হবে,সে যে সদ্য বিবাহিত মেয়ে।আজকে এই পূর্নিমার রাতে ভরা জ্যোৎস্না গায়ে মেখে বাবার বাড়িতেই স্বামীহীনা রাত যাপন করছে।অথচ তার থাকার কথা ছিলো স্বামীর বাহুডোরে,একান্ত ভালোবাসায়।যেই পুরুষকে সবসময় চেয়ে এসেছে সেই আজকে স্ব-ইচ্ছায় তার ডোরে ধরা দিয়েছে,খাতা কলমে নিজেকে মিতুর বলে লিখে দিয়েছে,তাকে পেয়েও কিনা প্রথম রাতেই এমন একলা একা কাটাতে হবে?মিতু যে তাকে খুব করে চায় সেই নি/ষ্ঠুর পুরুষ কি বুঝে?কই বুঝলো!সে তো একবারও খবর নিলো না,অব্যক্ত কথা বুঝলো না।সারাদিনে মিতু সামিরকে কয়েকবার ফোন দিয়েছে কিন্তু বন্ধ।সন্ধ্যা থেকে আর কোনো ফোন দেয়নি,অভিমানে গাল ভারী করে বারান্দায় চুল ছেড়ে দুঃখী-দুঃখী মুখে বসে আছে।কিন্তু রাত যতো বাড়ছে তার তৃষ্ণা ততো বাড়ছে।আবার ফোন দিতে হাতটা নিসপিস করছে।আচ্ছা সামির এমন কেনো?রোবট নাকি?খুব তো রিক্সায় বলছিলো তার বউ হয়!তো বউ হলে একবারও ফোন দেয়া যায় না,বউ যে কাতর পাখির মতো বসে আছে সে খবর কি সামির নামের লোকটার আছে?সকালে তো খুব আদর করা হচ্ছিলো!এখন!
মিতু ফোন না দিয়ে বেশীক্ষণ থাকতে পারলো না,সামিরের সাথে অভিমান যেমন হচ্ছিলো তেমনি তার জ্বর কমেছে কিনা সেই ব্যাপারেও চিন্তা হচ্ছিলো।গোপনে শ্বাস নিতে নিতে সামিরের নাম্বারে ডায়াল করে মিতু ধরে নিয়েছে এবারেও বন্ধ পাবে কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে রিং হলো সে অধীর আগ্রহে রিসিভ হওয়ার অপেক্ষায় ফোনটা কানে ধরে বসে রইল।
সামিরের জ্বর সারেনি কিন্তু এই প্রচন্ড জ্বরের মাঝেও তার অদ্ভুত রকমের শান্তি লাগছে এই শান্তি লাগার কারনটা যে স্বয়ং মিতু তা বেশ বুঝতে পারছে।মিতু যখন থেকে তাকে পছন্দ করে তার দিকে অন্যরকম চোখে তাকায় তখন সামির পাত্তা না দিলেও আস্তে আস্তে কাজল চোখের মায়ায় জড়িয়ে যায় আর পরে খেয়াল করে দেখে সে একটু না বরং নিজের সর্বসত্তা নিয়েই ডুবেছে,কিন্তু সে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে নারাজ,বাবা মা হীন,চাকরি হীন কোনো ছেলের কাছে মেয়ে দেবে কে?শুধু শুধু মেয়েটাকে নিজের সাথে জড়িয়েই না কি লাভ হবে?কিন্তু আজকাল মিতুকে অগ্রাহ্য করা একপ্রকার দুঃস্বাধ্য ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে সামিরও ক্লান্ত হয়ে গেছে তারও ইচ্ছে করেনা মিতুকে আর কষ্ট দিতে।আজ সকালে যে টুকুই হয়ে গেছে ভুল হয়েছে;সামির যদি চাইতো নর নারীর সম্পূর্ণ মিলনই সম্ভব হতো কেননা মিতু তার জন্য যে পরিমান পাগল তাকে না করার কোনো প্রশ্নই আসে না।তাইতো বেশী বাড়াবাড়ি হওয়ার আগে সামির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই করে ফেলেছে সে জানে ভুল করেছে কিন্তু উপায় কি?তার মাথায় শুধু ঘুরছে ধ্রুব শুনলে কি বলবে।সারাদিন ইচ্ছে করেই সে মিতুকে ফোন দেয়নি।ফ্লাইট মোড করে মোবাইলটা পাশে ফেলে রেখেছে।সে জানে মিতুর করা এখনের কথা কিংবা আবদার হবে বেশামাল,সে যে এখন তার স্ত্রী।সামির মোবাইলটা হাতে নিয়ে নরমাল মুড করে।সাথে সাথেই মিতুর ফোন থেকে কল আসে,তার ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি ফুটে উঠে।মেয়েটা কি তার মতোই ছটফট করছে?কাছে পাওয়ার ব্যাকুল তৃষ্ণায় মন কেমনের ঝড় বইছে?রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরে,
“হ্যালো…”
মিতুর বুকের খাঁচা নড়ে উঠে।মিহি গলায় বললো,
“আপনার ফোন বন্ধ কেনো?”
“এমনি।”
“জ্বর কমেছে?”
সামির কপালে হাত দিয়ে দেখে এখনো জ্বর বিদ্যমান কিন্তু মিতুকে মিথ্যা মিথ্যা বললো,
“কমেছে।”
মিতু চুপ থেকে বললো,
“তো আর কি খবর?”
সামির বললো,
“ভালো।”
মিতু উশখুশ করছে,বরের মুখ থেকে মিষ্টি কথা শুনতে মন আনচান করছে।সে বললো,
“আর কিছু বলবেন না?”
সামির নির্লিপ্ত গলায় বললো,
“না।অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও।”
সামিরের এমন নির্লিপ্ত গলা শুনে মিতুর অভিমান তড়তড়িয়ে বাড়ে কান্নাভেজা গলায় বললো,
“অনেক রাত মানে!আজকের রাতটা কি ভুলে গেছেন?আপনি এতো খারাপ?পাষাণ মানুষ।”
মিতুর কান্না শুনে সামির উঠে বসে।পাশের বেডে আব্দুলাহ শুয়ে আছে এখানে বেশী কথা বলা সম্ভব না তাই উঠে বাহিরের দিকে পা বাড়ায়।কান্নাগুলো তার বুকে লাগছে।মেয়েটা এতো কাঁদে কেনো?
“এই,কাঁদো কেনো?”
মিতু ফুপিয়ে বললো,
“আপনি পা/ষাণ।ইচ্ছে করেই এমন করছেন।”
“কি করেছি।”
মিতু কোনো কথা বলেনা।সামির চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
“কাঁদলে কিন্তু ফোন রেখে দেবো।”
সাথে সাথেই ওপাশ থেকে মিতুর গলার স্বর ভেসে এলো,
“কাঁদছি না তো,ফোন রাখবেন না।”
সামির মিতুকে স্বাভাবিক করতে বললো,
“আমাকে মিস করছো?”
সামিরের একটু ভালো কথায় মিতুর মন ভালো হয়ে গেলো,অভিমান হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো গলে গেলো।ছোট করে উত্তর দিলো,
“হুহ।”
সামির নিজেও মিতুকে অসম্ভব মিস করছে কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না।গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“ঘুমাও না,রাত হয়েছে তো।”
মিতু আহ্লাদী গলায় বললো,
“ঘুম আসেনা।”
সামির তার বউকে আশকারা দিলো মিহি গলায় বললো,
“কেনো আসেনা?”
মিতু লজ্জিত্ব গলায় বললো,
“আজকে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ রাত। ভুলে গেছেন?”
সামির মুচকি হাসে।হিসেব অনুযায়ী আজকে তাদের বাসর রাত।বাসর রাত!সামির মনে মনে কথাটা কয়েকবার আউরে বললো,
“আজকের রাত কি বিশেষ নাকি?”
মিতু রাগ রাগ গলায় বললো,
“আপনি ইচ্ছে করেই এমন করছেন তাই না?মনে হয় জানেন না।”
সামিরের দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।ফ্লোরে বসে বললো,
“তুমি জানাও তাহলেই হলো।”
মিতু আস্তে করে বললো,
“আজকে আমাদের বাসর না?”
সামির চুপ থেকে বললো,
“বাসর।”
“হুম।”
সামির আস্তে করে বললো,
“তো আপনার কি ইচ্ছে করছে?”
মিতু আস্তে করে বললো,
“দেখা করবো।”
“এখন?”
“ইচ্ছে করছে।”
সামির আস্তে করে বললো,
“আমি যেদিন তোমার কাছে থাকবো সেদিনই আমাদের বাসর হবে।অকে?”
মিতু সুখী সুখী গলায় বললো,
“হুম।”
সামির মাথা নেড়ে বললো,
“মিতু;তোমার মন খারাপ হচ্ছে?”
মিতুর সত্যিই মন খারাপ হচ্ছে।সামিরকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।সে ভিষণ কাতর গলায় বললো,
“আই লাভ ইউ।”
মিতুর কথায় সামির হাসে।ফিসফিস করে বললো,
“আমিও তোমাকে ভালোবাসি সোনা;ভিষণ ভালোবাসি।”
কাক ডাকা ভোরে সকালের ঘুম ভাঙে।পিঠে কারো গরম নিঃশ্বাস পড়ছে সে ঘাড় বেকিয়ে পেছনের মানুষটাকে দেখে।ধ্রুব!তার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ।তাকে নতুন রূপে পৃথিবীর সুখ দেয়ার পুরুষ!সে ঝপাৎ করে আবারো চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে,এই মানুষটার দিকে তাকালেই রাতের কিছু মধুর স্মৃতি মনের পর্দায় এলোমেলো ছুটে চলে,কানে বাজে ধ্রুবর আদুরে কথা,মৃদু হাসি। সকালের মুখটা আবারো লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠে।জলদি বিছানা থেকে উঠতে চায়।তখনি শরীরে নাড়া দেয় নতুন ব্যাথা,নতুন যন্ত্রণা।সকাল ব্যাথাটাকে পাত্তা দিলো না পাত্তা দিলে আবার লজ্জায় পড়তে হবে তাই জলদি করে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে সকাল ওরনায় মুখ ঢেকে ফেললো।
ধ্রুব বিছানায় বসে সকালের জন্যই অপেক্ষা করছিলো।আজকের সকালটা তার জন্য সুখের কেননা সবকিছুই কেমন ভালো লাগছে।বাথরুমের দরজা খুলার শব্দে সেদিকে ফিরে তাকায়।সকাল ওরনায় মুখ লুকিয়ে আছে।ধ্রুব কিছু না বলে সেও মুচকি হাসে।সকাল আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।তার মুখে মুচকি হাসি।ধ্রুব বিছানায় বসে বললো,
“কি ব্যাপার সকাল!ভালো আছো?”
সকাল কথা বলেনা।লাজুক চোখে আয়নায় ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।
ধ্রুব বিছানা থেকে নেমে সকালকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমার সোনাপাখি কথা বলেনা কেনো?সে কি আবারো আমাকে কাছে পেতে চাইছে?”
সকাল মাথা নেড়ে না জানায়।ধ্রুব ফিসফিস করে বললো,
“কোনো সমস্যা?অসস্থি?”
সকাল মাথা নিচু করে বললো,
“না।আমি ঠিক আছি।”
ধ্রুব দুষ্টু হেসে বললো,
“তাহলে আরে…..”
ধ্রুবর কথা শেষ হওয়ার আগেই সকাল ছটফট করে ধ্রুবর থেকে দূরে গিয়ে বললো,
“না না।সাড়ে আটটা বাজে আপনার অফিসের দেরী হচ্ছে না!যান”
এটা বলে সকাল বেরিয়ে যায়।ধ্রুব চুপচাপ ফ্রেস হয়ে ড্রয়িংরুমে যায়।বারে বারে আড়চোখে সকালকে দেখছে।সকাল ধ্রুবর চোখের দৃষ্টি দেখে আরো বেশী লজ্জা পাচ্ছে।তার মনে হচ্ছে ধ্রুব আর তার ভালোবাসার কথা সবাই জেনে গেছে,তার গায়ে ধ্রুবর প্রেমের ছোঁয়া সবাই দেখতে পাচ্ছে তাইতো কখনো গলায় কাপড় টানছে কখনো ওরনা টানছে।মনোয়ারা ধ্রুবকে তাড়া দিয়ে বললো,
“কি বাচ্চাদের মতো মিনমিন করে খাবার খাচ্ছিস?তাড়াতাড়ি খা,দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
ধ্রুব হাই তুলতে তুলতে বললো,
“শরীর ভালো না আম্মা।আজকে যাবো না লিভ নিয়েছি।”
মনোয়ারা ব্যস্ত হয়ে ছেলের কাছে গেলো আর সকাল দৌড়ে রুমের দিকে গেলো।দুষ্ট মানুষের মতলব বুঝতে তার বেগ পেতে হয়নি।ধ্রুব নাস্তা করে রুমে এসে বিছানায় বসে দেখে একটা কাগজ রাখা;সেখানে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা,
“আপনি যদি অফিসে না যান তাহলে আজকে আমি সারাদিন মিতুর রুমে থাকবো।ভুলেও অফিস বন্ধ করবেন না,তাহলে মে/রে ফেলবো।খারাপ মানুষ!”
ধ্রুব অবাক হয়ে বিছানায় বসে থাকে।এই-জন্যই মানুষ বাচ্চা কাচ্চা বিয়ে করেনা এমন দিনে জামাইকে ছেড়ে ননদের রুমে গিয়ে কেউ বসে থাকে?ধ্রুব মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়।মিতুর রুমে গিয়ে ঢুকে দেখে মিতু আর সকাল বিছানায় বসে আছে।ধ্রুব মিতুর বিছানায় বসে বললো,
“মিতু যা আম্মার রুমে যা,আজকের জন্য তোর রুম আমার।”
মিতু মুচকি হেসে চলে গেলে সকাল রাগী চোখে ধ্রুবর দিকে তাকায়।ধ্রুব সকালের চুল হাতে পেচিয়ে বললো,
“এবার কোথায় পালাবে সুন্দরী?”
চলবে….