কারণে অকারণে সে পর্ব-১৫

0
612

#কারণে_অকারণে_সে
#পর্ব:১৫
#লেখক:রিয়ান আহমেদ (ছদ্মনাম)
;
সবকিছু অনেক তাড়াতাড়ি ঘটে যাচ্ছে।এই তো সেদিনের কথা আরশি আর সাভাশের আকদ সম্পন্ন হলো আর আজই আরশির গায়ে হলুদ।
দেখতে দিনগুলো ধীরে ধীরে অতিবাহিত হয়ে গেল।আরশি আয়নায় নিজেকে দেখে।কাঁচা ফুলের গয়নায় আজ সে সজ্জিত।আরশির নিজেকে দেখে ফুলের দোকান মনে হচ্ছে।আরশি বিরক্ত ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে বলে,
“হোয়াট দ্যা হেল,,এতো ফুল দেওয়ার কি দরকার ছিল।”
আরশি ফুলগুলোর উৎসের কথা মনে আছে করতেই এক রাশ ভালো লাগা মনে এসে ভীর করে তার মনে।সাভাশের বাসা থেকে এই ফুলের গহনা পাঠানো হয়েছে।সাভাশ গহনাগুলোর সঙ্গে একটা চিরকুটে লিখেছিল,
“এই ফুলগুলো আমার বাগানে আমি এক মাস যাবত অতি যত্নে বড় করেছে।নিজের হাতে ফুলগুলো কেঁটে তোমার জন্য এই গহনাগুলো বানাতে দিয়েছে।পারলে আমি নিজেই বানাতাম কিন্তু ঐ যে পারি না।তুমি নিজেকে এই ফুলের সাজে সজ্জিত করো ।”
আরশি বুঝতে পারে না সাভাশ এতো ভালোবাসে কেন তাকে।এক মাসের দেখায় এতোটা ভালোবাসা কি কখনো কাউকে সম্ভব?
‘কারণে অকারণে সে’ ভালোবাসে।

ভালোবাসার গভীরতা সময় দিয়ে মাপতে চাওয়া নিতান্তই ভুল চেষ্টা।কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসার জন্য কয়েক মিনিটই যথেষ্ট।

আরশির চোখের কোনে হঠাৎ পানি চলে আসে।সে কান্না আটকাতে পারে না।তীব্র!এই মানুষটাকে নিয়েই একসময় হাজারো স্বপ্ন বুকে বেঁধেছিল সে।আজ বাদে কাল সে অন্যের স্ত্রী হবে তবুও মনের কোথাও না কোথাও এখনো তীব্র আছে।আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে,
“সব অনুভূতি শুরুটা সুন্দর হলেও শেষটা সুন্দর হয় না।তীব্র ভাইকে নিয়ে আমার যত কল্পনা যল্পনা ছিল তা নিতান্তই এক পাক্ষিক।সেই প্রথম দিন তাকে নিয়ে অন্যরকম কিছু না ভাবলেই ভালো হতো।সে তো শুধুমাত্র আমাকে বোন ভেবে প্রোটেক্ট করেছিল আমি কেন অতো কিছু ভাবতে গেলাম?,,,যাইহোক আমি সাভাশের সঙ্গে কখনোই অন্যায় করবো না।আমি তার ভালোবাসাটা গভীরভাবে অনুভব করেছি।এই ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ আল্লাহ্ আমাকে পৃথিবীতেই দিয়েছে এটাই আমার সৌভাগ্য।কোনো ভাগ্যবান নারীই এই ভালোবাসা পেতে পারে।সাভাশকে আমি পছন্দ করতে শুরু করেছি হয়তো তার মায়ায় পড়ে গেছি।ইনশাল্লাহ তাকে ভালোবাসতেও শুরু করবো খুব তাড়াতাড়ি।”

আরশির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়।একমাত্র মেয়ের বিয়েতে রিজা আহসান কোনো কমতি রাখেন নি।আরহাম এদিক ওদিক ছুটছে এই কাজ ঐ কাজে কারো নিঃশ্বাস নেয়ার সময় নেই।সাভাশের বাড়ি থেকে মানুষ এসেছে আরশিকে হলুদ দিতে।আরিয়ানা স্টেজে উঠে আসে তার সঙ্গে একজন বোরকা পরিহিত মহিলা।আরিয়ানা আরশিকে হলুদ লাগিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
“তোমাকে অসাধারণ লাগছে কিউটি।সাভাশ তো একটা মিষ্টি পরীকে বিয়ে করছে।”
বোরকা পড়া মহিলাটা গলা খাকাড়ি দেয়।আরশি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।আরশির কাছে একজন মহিলা হিসেবে মানুষটার গলার শব্দ বেশ অদ্ভুত মনে হলো।আরশি পা থেকে মাথা পর্যন্ত মহিলাটিকে স্কেন করলো।এতো লম্বা!এতো লম্বা আর স্বাস্থ্যবান নারী আরশি খুব কমই দেখেছে।মহিলাটার পুরো মুখ ঢাকা শুধু চোখ দুটো খোলা।আরশির মনে হচ্ছে এই চোখ সে আগেও দেখেছে।খুবই চেনাজানা চোখ জোড়া।আরিয়ানা মহিলাটির দিকে একবার তাকিয়ে আবার আরশির দিকে তাকিয়ে।সে হাসার চেষ্টা করে বলে,
“ইনি তো,,তোমার খালা শাশুড়ি হন।মানে সাভাশের খালামনি।,,খালামনি এই হচ্ছে আপনার অতি আদরের,ভালোবাসার মানুষ।”
আরিয়ানা কথাটা বলে তুতলিয়ে বলতে শুরু করে,
“মানে অতি আদরের ভালোবাসার ছেলে সাভাশের হবু বউ আরশি।”
আরিয়ানা উঠে গিয়ে মহিলাটিকে বসার জায়গা করে দেয় আরশির পাশে।মহিলাটি কিছু বলে না শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।আরশির বেশ অস্বস্তি হয়।হৃদপিন্ড জোরে জোরে স্পন্দিত হতে থাকে।আরশি এই চাহুনি চিনে ফেলে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট শব্দ বের হয়,
“সাভাশ।”
হ্যা মহিলাটি আর কেউ নয় সাভাশ।সে নিজের প্রেয়সীকে ফুলের সাজে সরাসরি দেখার লোভ সামলাতে না পেরে ছদ্মবেশে এই ভরা বিয়ে বাড়িতে এসেছে।
সাভাশ চমকে তাকায় আরশির দিকে।আরশি কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এরপর মনে মনে বলে,
“বাহ্ সাভাশ বাহ্!এই সাজে আপনি এখানে আসবেন তা আমি কল্পনা করি নি।এখন যখন এসেই পড়েছেন তখন আপনাকে একটু আরশির অপ্রত্যাশিত কথা সহ্য তো করতেই হবে।”
আরশি মুচকি হাসি দিয়ে মিষ্টি নিয়ে সাভাশের মুখের সামনে ধরে বলে,
“খালামনি একটু মুখোশটা উপরে উঠান আমি আপনাকে মিষ্টি খাওয়াতে চাই।”
সাভাশ মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে চিকন কন্ঠে ‘না’
আরশি মিষ্টিটা রেখে দিয়ে বলে,
“আপনার চোখগুলো একদম সাভাশের মতো।আপনি সাভাশ নন তো?”
সাভাশ ভড়কে গিয়ে দুই দিকে মাথা নাড়ায়।আরিয়ানা দ্রুত বলে,
“না না উনি সাভাশ হতে যাবেন কেন?”
আরশি হেসে বলল,
“আম জাস্ট কিডিং।উনি সাভাশ হতে যাবেন কেন?যাইহোক খালামনি আপনি কিন্তু ভালোই লম্বা একদম সেম সাভাশের হাইট।”

সাভাশ বুঝতে আরশি বুঝে ফেলেছে বোরকার আড়ালে কোনো নারী না বরং আরশির হবু স্বামী সাভাশ আছে।এখন যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে হবে তাকে না হলে মান ইজ্জত যাবে।সাভাশ উঠে দাঁড়াতেই আরশি হাত টান দিয়ে পাশে বসিয়ে দিয়ে বলে,
“খালামনি কোথায় যাচ্ছেন একটু বসুন আমরা দুজন কথা বলি।সবাই তো আরো অনেকটা সময় থাকবে।”
সাভাশ চোখের ইশারায় আরিয়ানাকে বোঝায় এখান থেকে বের হতে তাকে সাহায্য করতে।আরিয়ানা সাভাশকে বাঁচাতে বলে,
“আরশি আমাদের আজ যেতে হবে।খালামনি একটু অসুস্থ উনি বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না।ছেদ করে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন না হলে তো আমরা আনতামই না।”
“কি হয়েছে ওনার?বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না কেন?”
আরিয়ানা ভেবে পায় না কি বলবে তাই মাথায় যা আসে তাই ফটাফট বলে ফেলে,
“ওনার পাইলস এর অপারেশন হয়েছে তাই বসতে পারছেন না।”
সাভাশ চোখ বড় বড় করে তাকায়।এমন কথা শুনে তার কাশি উঠে যায়।আরিয়ানা সাভাশের পিঠে হাত দিয়ে বলে,
“দেখলে আবার সাথে যক্ষ্মা হয়েছে।”
আরশি দুঃখি দুঃখি মুখ করে বলে,
“আহারে,,থাক খালামনি আজকে আর আপনার সঙ্গে কথা বলা হলো না অন্য একদিন কথা বলবো ঠিকাছে।”
সাভাশ মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।সাভাশের অবস্থা এতক্ষণ এমন ছিল যে “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।”
সাভাশ নেমে যায় স্টেজ থেকে।এরপর বাইরের দিকে যেতে যেতে মনে মনে বলে,
“আল্লাহ্ আমার বউ এর চোখে চশমা আজকে নেই তো কি হয়েছে একেবারে চিনে ফেলল।বাহ্ সাভাশ চৌধুরির বউ তার মতোই গোয়েন্দা চোখের অধিকারী।”
সাভাশ যেতেই আরশি ফিক করে হেসে দিল।

আরিয়ানা চেয়ারে বসে আছে।সবাই খাবার খেতে ব্যস্ত।আরহাম বলে সবাইকে জিজ্ঞেস করছে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না কারো।আরিয়ানাকে দেখে আরহাম বলল,
“আপনার কোনো কিছু লাগলে অবশ্যই বলবেন লজ্জা পাবেন না।,,বাই দ্যা ওয়ে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে এই নীল শাড়িতে।”
আরিয়ানা একজন সুদর্শন পুরুষের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলে,
“ধন্যবাদ আপনাকেও এই লাল পাঞ্জাবিতে অসাধারণ লাগছে।”
আরহাম কিছু বলে না সে নিজের কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আরশি ওয়াশরুমে যাবে বলে স্টেজ নেমে বাড়ির ভেতরে যায়।বাড়িতে এই মুহূর্তে তেমন কোনো মানুষ নেই। কয়েকজন যারা আছে তারা ঘুমিয়ে পড়েছে।আরশি ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখে তীব্র দাঁড়িয়ে আছে।আরশি ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“আপনি এখানে কি করেন?আর বোনের বিয়েতে এতোদিন আপনার যা দায়িত্ব ছিল তা পালন না করে আপনি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন?”
তীব্রর চোখ লাল।সে করুন গলায় বলে,
“বোন!আরশি তুই সেই ব্যক্তি যে এক মাস আগে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলি।এমন কি মদ খেয়ে সবার সামনে নিজের তামাশাও বানিয়েছিলি।আর আজ সেই তুই নিজেকে আমার বোন বলছিস!হাউ ফানি।”

আরশি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“আপনিই তো বলেছিলেন আপনাকে ভুলে নতুন কিছু নিয়ে ভাবতে তাহলে এখন কেন এরকম অদ্ভুত কথা বলছেন?,,আমাকে কি আপনার রোবট মনে হয় যখন যা বলবেন তাই করবো?”
আরশি প্রথম কথাগুলো শান্ত ভঙ্গিতে বললেও শেষে যথেষ্ট চেঁচিয়ে উঠলো।
তীব্র কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
“আরশি আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।আমি জানি তোর চাইতে বেশি আমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না।”
আরশি শান্ত গলায় বলল,
“আর আমি জানি সাভাশের চেয়ে বেশি আমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না।তার ভালোবাসার এতোটাই জোর যে এই কয়েকদিনেই সে আমাকে নিজের সঙ্গে একটা অবিচ্ছেদ্য মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে।,,আমি তো চিরকাল স্বার্থপর ছিলাম তাই আজও আমি স্বার্থপরের মতো নিজের জন্য ভালো কাউকেই বেছে নেব।”
তীব্র ক্ষুব্ধ হয়।সে আরশির কাছে দ্বিতীয়বার কখনোই আসতো না কিন্তু পরিস্থিতিটা এমন যে আরশিই এখন তার কাছে শেষ চয়েস।এলাকায় সবাই জেনে গেছে যে নেহা তীব্রর সঙ্গে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে।কিন্তু সবার মনে প্রশ্ন বিয়ে কেন ভাঙলো মেয়েটা?ছেলেটা তো দেখতে শুনতে যথেষ্ট ভালো তাহলে কি কারণ?এখন একেক জন বলে একেক কথা কেউ বলে,”তীব্র নেশা টেশা করে বোধহয় তাই মেয়ে ছেড়ে দিয়েছে।”
আবার কেউ বলে,”তীব্রর কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা আছে বোধহয় তাই মেয়ে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছেড়ে দিয়েছে।”
এমন সব কথাবার্তা ভিত্তিহীন হলেও সবাই এগুলোতে বিশ্বাস করছে।আর তীব্রর জন্য কোনো মেয়ে দেখা হলে মেয়েরা এলাকার মানুষ থেকে এসব শুনে মানা করে দেয়।

তীব্র রেগে আরশির হাত চেপে ধরে বলে,
“এই তোর ভালোবাসা!আমি তোকে কি ভাবলাম আর তুই কি।”
আরশি তীব্র থেকে ঝামটা হাত সরিয়ে নিয়ে বলে,
“আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছিলাম আর তার চেয়েও বড় ভুল আপনাকে ভালোবেসেছিলাম।,,,”
;
#চলবে!