কারণে অকারণে সে পর্ব-১৬

0
632

#কারণে_অকারণে_সে
#পর্ব:১৬
#লেখক:রিয়ান আহমেদ(ছদ্মনাম)
;
“আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছিলাম আর আমার সবচেয়ে বড় ভুল আমি আপনাকে ভালোবেসেছিলাম।আমি সাভাশকে ঠকাতে পারবো না ।আপনাকে বিয়ে করলে আমার আপনার দুজনের লাইফ শেষ হয়ে যাবে।কারণ আপনি শুধুমাত্র কোনো উপায় না পেয়ে এই রকম সিদ্ধান্তে এসেছেন। আর কখনো আমার সঙ্গে এসব কথা বলতে আসবেন না।এখন প্লিজ এখান থেকে যান।”
তীব্রর রাগে ফেটে পড়ার মতো অবস্থা।তীব্র চিৎকার করে বলল,
“এতো দেমাগ!তা তুই আমাকে ভালোবেসে সাভাশকে বিয়ে করে কি ওকে ঠকাচ্ছিস না?তুই তো নিজেকেও সারাজীবন ঠকাবি।”
আরশি খানিক হেসে জবাব দেয়,
“আই রিপিট আমি আপনাকে ভালোবেসেছিলাম বলেছি।আমি এখনো আপনাকে ভালোবাসি সেটা একবারও বলি নি।আর কথা রইলো সাভাশকে ঠকানোর,,আমি তাকে ঠকাচ্ছি না কারণ আমিও তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি আর বিয়ের পর আমাদের মাঝে ভালোবাসা অবশ্যই তৈরি হবে।এমন হাজারো দম্পতি আছে যাদের মাঝে ভালোবাসা বিয়ের পর তৈরি হয় এর মানে এই না তারা একে অপরকে ঠকিয়ে এসেছে।এখন প্লিজ যান এখান থেকে না হলে আমি ভাইকে ডাকতে বাধ্য হবো।”

তীব্র আর কিছু না বলে হন হন করে সেখান থেকে চলে যায়।আরশি ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে।আরশি মনে মনে বলে,
“তীব্র ভাই আমি কখনোই চাই নি আপনার জীবনের এমন করুন একটি সময় আসুক।কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসতাম।ভালোবাসার মানুষের খারাপ কেউ কখনো চায় না।আমি সত্যিই ভাবতে পারি নি নেহা আপু আপনার সঙ্গে এমনটা করবে।,,,আপনি তো আগে এমন ছিলেন না।সেই সেন্সিটিভ,ভদ্র তীব্রটা কোথায় হারিয়ে গেল?,,আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবো আপনার জীবনটা যেন তিনি গুছিয়ে দেন।আপনার অগোছালো জীবনে কাউকে সত্যিই চাই যাকে আপনি ভালোবাসতে পারবেন।,,,আমাকে আপনি কখনোই ভালোবাসতে পারবেন না এটা আমি জানি।সত্যি বলতে সবার পছন্দ আলাদা হয় আর আপনার পছন্দ আমি না আমার চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত কেউ।ভালো থাকবেন।আজ থেকে আপনার কথা ভাবা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম।,,আশা নতুন করে কেউ আসবে আপনার কথা ভাবার জন্য।”

আরশি আবার চলে যায় শত মানুষের মাঝে।যেখানে তার বিয়ের উৎসবের আনন্দে চারপাশের পরিবেশ গমগম করছে।আরশি নিজের সামনের টেবিলের মিষ্টির দিকে তাকায়।আরশির বমি পাচ্ছে আজ মিষ্টি দেখে।সে সবার প্রতি বিরক্ত।এতো মিষ্টি খাওয়ানোর কি দরকার ছিল এর চারপাশে তো ফল,কেক ইত্যাদি আরো কতো কিছুই আছে।কিন্তু নাহ্ সবাই মিষ্টি খাওয়াবেই খাওয়াবে।

আরশি বিড়বিড় করে বলে,
“এরা আমার প্রিয় খাবারটার প্রতি ঘৃণা বানিয়ে দেবে বোধহয়।উফফ আগামী ছয়মাস আর মিষ্টির দিকে ফিরে তাকানোই যাবে না দেখছি।”

আরশির আবার রাগ লাগছে কয়েকজনের কাহিনী দেখে।তার মুখের সামনে খাবার নিয়ে এই পাবলিকেরা নিজেদের মুখে দিয়ে দেয়।আর এই দৃশ্য দেখে অনেকে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খায়।
আরশির মামাতো বোন এই কাহিনী করতেই আরশি ঠান্ডা ভাষায় হুমকি দেয়,
“তুই আমার সঙ্গে যেই কাজটা করলি না এর ফল তুই আগামীকাল পাবি।হতে পারে তোর বিয়েতে পড়া পোশাকে কেউ চুলকানির ওষুধ দিয়ে দিয়েছে।আবার হতে পারে একটু পর তুই যেই ঘরে গিয়ে থাকবি সেখানে দশটা বাচ্চা থাকবে যারা সারা রাত কান্না করবে আর তুই ঘুমাতে পর্যন্ত পারবি না।”
আরশির মামাতো বোনের মুখ কথাগুলো শুনে থমথমে হয়ে যায় সে অতি বিনীত গলায় বলল,
“বোইন মাফ করে দে আর কোনোদিন তোকে আমি এভাবে জ্বালাবো না।”
“ওকে মাফ করলাম।কিন্তু সবাইকে এখন থেকে সাবধান করে দিবি তারা যেন আমার সঙ্গে এই কাহিনী না করে।”
মেয়েটা লক্ষ্মী মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে আরশির বলে দেওয়া কাজ অতি গোপনে করতে থাকে।

আরশি দেখে আরহাম কোকের বোল নিয়ে যাচ্ছে।আরশি ডাক দিয়ে বলে,
“ভাই এদিকে একটু আসো।”
আরহাম বোনের কাছে এসে বলে,
“কি হয়েছে?কোনো সমস্যা?”
আরশি ক্লান্ত স্বরে বলে,
“আমি ঘরে যাবো আমার শরীর ক্লান্ত লাগছে এইসব পড়ে।”
আরহাম ঠোঁট কামড়ে বলল,
“আচ্ছা তাহলে তুই চলে যা ঘরে আমি ইরিনাকে ডেকে দিচ্ছি।”
“ভাই একটা কথা বলি?”
“বল।”
আরশি মুখে একটা শয়তানি হাসি এনে বলে,
“ভাই আরিয়ানা আপুর সাথে এতো কিসের কথা?আমি কিন্তু সব দেখছিলাম এখানে বসে বসে।”
আরহাম তুতলিয়ে বলে,
“ক,,কি বলছিস এইসব?আত্মীয় হতে চলেছেন ওনারা তাই একটু কথা বলছিলাম।”
“হুম হুম সব বুঝি।”
আরহাম ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ কর।ছোট মানুষ বড় বড় কথা বলবি না।”

আরশি অবাক হওয়ার মতো করে বলল,
“আমি ছোট!হাউ ফানি আগামীকাল আমার বিয়ে আর তুমি আমাকে ছোট বলো।”
আরহাম ভেবে পায় না কি বলবে।সে দ্রুত আরশিকে রুমে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে।
;
;
;
আরশির মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গে।তার মুখের উপর মনে হচ্ছে কেউ একটা বাঁশ রেখে দিয়েছে।আরশি হাত দিয়ে ধরে বুঝতে পারলো এটা কারো পা।এই এক সমস্যা বিয়ে বাড়িতে শান্তিতে ঘুমানো তো দূরের কথা বসাও যায় না।
আরশি কোনো মতে বসে অন্ধকারে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়।দশজনের মতো এই রুমে ঘুমিয়ে আছে।আরশি চোখ কচলে বলে,
“আহ আমার ঘুমটা ভেঙ্গে দিল এরা এখন আমি কিভাবে ঘুমাবো।”
আরশি ডিম লাইট জ্বালায় এরপর কোনোমতে সেই আলোয় নিজের চশমাটা খুঁজে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ঘর থেকে বের হয়।

আরশি জানে এখন তার হাজার চেষ্টা করলেও ঘুম আসবে না তাই মা বাবার ঘরে চলে যায়।আজই তো তার এই বাড়িতে সাধারণ সদস্য হিসেবে তার শেষ রাত।এরপর সে হয়ে যাবে এই বাড়ির মেহমান।

আরশি মা বাবার ঘরের সামনে দাড়িয়ে দেখতে পায় তাদের রুমের বাতি এখনো জ্বালানো।মানে তারা জেগে আছে।আরশি ভেতরে ঢুকে দেখে তার মা বসে বসে কান্না করছে।আরশি বলল,
“আম্মাজান কান্না করছো কেন?”
আয়েশা বেগম কান্নার গতি বাড়িয়ে দিয়ে হাতের ইশারায় কাছে ডাকেন।আরশি এগিয়ে যায়।আয়েশা বেগম আরশিকে বিছানায় নিজের পাশে বসিয়ে হাত ধরে বলে,
“মা আগামীকাল তোর বিয়ে আমি তোকে সেই উপলক্ষে কিছু দিতে চাই।”
আরশি হাত পেতে বলে,
“দেও তাহলে।”
আয়েশা বেগম হেসে দেন মেয়ের কথায়।তার মনে হচ্ছে ছোট্ট আরশি তার কাছে পুরস্কার হিসেবে চকলেটের জন্য হাত পাতছে।আর বলছে,”দেও তাহলে চকলেট।” আয়েশা বেগমের এখন বেশ আফসোস হচ্ছে।মেয়েটাকে আর কয়েকটা বছর পর বিয়ে দিলে ভালো হতো।এতো দ্রুত মেয়েটা চলে যাবে পরের ঘরে!আর তো কেউ থাকবে না তাকে জ্বালানোর জন্য।সকাল বিকাল কার সঙ্গে সে রাগারাগি করবে? আয়েশা বেগম নিজেকে শান্তনা দেন এই বলে যে,”মেয়ে হলে তো পরের ঘরে যেতেই হবে।”

আয়েশা বেগম চোখের কোনের পানি মুছে উঠে দাঁড়ান।আলমারি থেকে একটা বক্স বের করে তিনি আরশির হাতে দেন।আরশিকে বলেন,
“এটা আমার আর তোমার বাবার তরফ থেকে।তুমি যখন বারো বছরের ছিলে তখন তোমার বাবা সৌদি আরবে ওমরা করতে গিয়ে এইগুলো নিয়ে এসেছিল তোমার জন্য।”
আরশি বক্স খুলে দেখে গয়নার সেট।আরশির এসবে ইন্টারেস্ট নেই সে বক্সটা পাশে রেখে বলে,
“মা এটা অনেক সুন্দর আর তুমি আর বাবাই তার থেকেও বেশি সুন্দর।”
আরশি মাকে জড়িয়ে ধরে।আয়েশা বেগম নিজেও মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন।মা মেয়ে নিজেদের চোখের পানা ছেড়ে দেয়।কিছুক্ষণ পর আরশির মা বলেন,
“মা শোন তুই সাভাশের বাড়ির সকলের সঙ্গে একটু মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করিস।তারা সবাই অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ তাই তাদের মনে কখনো আঘাত দিস না।,,,যদি তোকে কেউ কোনো বাজে কথা কখনো বলে তাহলে ঠান্ডা ভাষায় এর প্রতিবাদ করবি কখনো মাথা গরম করবি না।”
আরশি নাক টেনে বলে,
“ঠিকাছে।,,বাবা কোথায়?”
আয়েশা বেগম হেসে বলেন,
“তোর বাবা স্টাডি রুমে বসে আছেন।”
“ওহ আমি যাই।”

আরশি স্টাডি রুমে গিয়ে দেখে তার বাবা তার ছোটবেলার ভিডিও দেখছে।আরশি নিঃশব্দে গিয়ে বাবার পাশে বসে।বাবার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে ভিডিওতে চোখ রাখে।রিজা আহসান মেয়ের উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন,
“এতো রাত হয়ে গেছে তুমি এখনো ঘুমাও নি মা?”
“ঘুম ভেঙ্গে গেছে।,,তুমিও তো ঘুমাও নি।”
“ঘুম আসছিল না।”

দুজনে আবার ভিডিওতে নজর রাখে।

ছয় বছরের আরশি নৌকায় বসে নদীতে বরশি দিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে।আরহাম ভিডিও করছে।আরহাম বলে,”আরু কি করছিস তুই?”
আরশি স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলল,
“আমি বরশি দিয়ে মাছ ধরছি বাবাই ইলিশ মাছ পছন্দ করে তো তার জন্য নিয়ে যাব।”

আরশি রিজা আহসান দুজনেই হেসে দেয়।রিজা আহসান ভিডিও অফ করে।আরশি হঠাৎ বাবার কোলে মাথা রেখে ডিভানে শুয়ে পড়ে।রিজা আহসান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে শুরু করেন,
“বিশ বছর কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে তোমার জন্মের দিনটির কথা।বিকালের পশ্চিম আকাশের সূর্য ডুববে এমন সময় আমার হাতে নার্স একটা ছোট্ট পরী দিয়ে গেল।ছোট ছোট হাত ছোট ছোট পা,,মায়াবী চেহারা।আমার চোখে পানি চলে এলো।এরপর দিন কাটতে লাগলো তুমিও ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠলে।সেই দিনগুলোর স্মৃতি আমি কখনো ভুলবো না।সাভাশ অনেক ভালো একজন মানুষ।আমি আশা করছি সাভাশ তোমাকে ভালো রাখবে।বাকিটা আল্লাহর উপরে তবে তোমাকেও অবশ্যই তার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।দুজনের কঠোর প্রচেষ্টায় একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়।”

আরশি কান্না করে দেয় বাবার কথা শুনে।সে বুঝতে পারছে না তার আজ এতো কান্না পাচ্ছে কেন?আরশি বলে,
“বাবা আমি সাভাশকে বিয়ে করবো না আমি তোমাদের সাথেই থাকতে চাই।”
“তা বললে কি হয় মা।,,আচ্ছা এখন যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”
আরশি উঠে বসে বলল,
“আমি তোমার আর আম্মুর সঙ্গে ঘুমাবো।”
আরশি বাবা মায়ের ঘরে চলে যায়।
;
;
;
“ভাইয়া তোমার সমস্যা কি?আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছো না কেন?”
আভাস বিরক্ত হয়ে কথাটা বলল।সাভাশ সারা রাত খাটে উলোট পালোট করছে যার কারণে আভাস ঘুমাতে পারছে না ঠিকমতো।

সাভাশ রাগী গলায় বলল,
“আমার ঘরে এসে আমার সঙ্গেই বাহাদুরি!এতোই যখন সমস্যা ফ্লোরে গিয়ে ঘুমা।”
আভাস বলে,
“বেশি ভাব নিও না বুঝলা।তোমার বিয়ের জন্য আত্মীয় স্বজনদের জায়গা দিতে গিয়ে আমাকে নিজের ঘর ছাড়তে হয়েছে।”
“তো আমি কি করবো।চুপ করে ঘুমা আমি তোর কারণে ঘুমাতে পারছি না।”
আভাস মজা করে বলে,
“হ্যা হ্যা আজকে রাতে ঘুম আসবে কেন?ভাবী সাহেবাকে দেখে এডভোকেট সাহেবের ঘুম উড়ে গেছে।”
সাভাশ চোখ গরম করে তাকায় কিন্তু সেটা আভাসের চোখে পড়ে না।
সাভাশ কিছুক্ষণ পর নিজের রুমের বিশেষ জানালাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় এরপর বলতে থাকে,
“সত্যিই আমার ঘুম তোমাকে দেখেই উড়ে গেছে।কাল থেকে তুমি আমার এই কথাটা ভাবলেই বুকটা আমার ভীষণ ভাবে লাফায়।এতো অস্থিরতা আমার শুধু তোমায় ঘিরে মাই কিউটি।”
সাভাশ বুকের বা পাশে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
;
#চলবে!