কারনে অকারনে ভালোবাসি পর্ব-০১

0
1977

#কারনে_অকারনে_ভালোবাসি
#পর্ব:1
#সুরাইয়া_আয়াত

” ওড়না যখন ছেলেদের ঘড়িতে আটকানোর জন্য তখন তা শরীরে রেখে কি লাভ, ফেলে দাও ?”

কথাটা বলে গা থেকে ওড়নাটা এক টানে খুলে নিয়ে হাতটা বেধে দিলেন আরিশ ভাইয়া তারপর সকলের সামনে দিয়ে হাত ধরে টানতে টানতে লাইব্রেরি রুমের ভিতর টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন ৷ ভয়ে বুকের ভিতর দুরুদুরু করছে ৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে সবাই ৷

দরজাটা খট করে বন্ধ করে চোখ মুখ খিঁচে পা দিয়ে একটা ধুলো মাখা কাঠের চেয়ারটা ঠেলে বলল
” বসো ‌৷”

আরু খানিকটা ভয়ে চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলল
” ধুলো ৷”

” নো মোর ওয়ার্ডস সিট ডাউন ৷”

ওনার এমন রুক্ষ কন্ঠের কথা শুনে কলিজা শুকিয়ে এলো ৷আর বেশি কিছু না বলে আরু, চুপচাপ বসে গেল ৷ আরিশ ওর সামনে একটা চেয়ার টেনে নিল তাতেও ধুলো,চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে আরুর হাত থেকে ওড়নাটা খুলে নিয়ে চেয়ারটা ঝেড়ে নিলো ৷ আরু সাথেসাথে হাত দিয়ে শরীরটাকে ঢাকার চেষ্টা করতেই আরিশ বলল
” এখন কি স্লীলতাহানির অপরাধ দেবে আরূপাখি ? আর হাত দিয়ে শরীর ঢেকে কি হবে, অর্ধেক বিয়ে তো হয়েই গেছে পুরো বিয়ে হলো সবকিছু তো আমিই দেখবো ৷”
আরিশের মুখের এই সমস্ত লাগামছাড়া কথা শুনে শরীরের ভিতর একপ্রকার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো আরু , রাগ হচ্ছে আমার বস্তবাতাটাও হৃদয়ে কড়া নাড়ছে ৷
আরু কিছু বলতে যাবে তখনই আরিশ ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলো
” কি ? কি বোঝাতে চাইছো? কিছু ভুল বললাম?”

আরূ একটু খানিকটা কঠোর হওয়ার চেষ্টা করে বলল
” আপনি কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করছেন ৷ এগুলো কিন্তু আমাদের শর্তের মাঝে ছিলো না ৷”

আরিশ এবার পায়ের ওপর পা তুলে শার্টের একটা বোতাম খুলে মাথার চুলগুলো অগোছালো করে দিয়ে মুখের চাপ দাঁড়িতে আলতো করতে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলল
” ঠিক কোন শর্তটা আরুপাখি? ইউ ক্যান রিমাইন্ড মি ৷”
আরু এবার ফটাফট বলে উঠলো যেন ঠোঁটে কথাটা লেগে ছিলো ৷
” আমাদের মাঝে শর্ত বা চুক্তি যেটাই বলুন না কেন সেটাই,,,,,কথা হয়েছিলো তে আমি যতখন ভার্সিটি তে থাকবো ততখন আপনি আপনার মতো আর আমি আমার মতো , আপনি আমার ভার্সিটি লাইফের স্বধীনতাতে কোন হস্তক্ষেপ করবেন না ৷”

কথাটা বলে থেমে গেল আরু ৷ আরিশ গালে হাত দিয়ে আরুর দিকে তাকিয়ে বলল
” আর ?”

আরু খানিকটা রেগে বলল
” আর কি ! বাকিটুকু তো আপনি জানেন সেটা আবার আমাকে কেন বলতে বলেছেন?”
আরিশ মুচকি হেসে বলল
” বাকিটুকু সময় যে আমার সেটা মেনে নিতে কি খুব কষ্ট হয় আরুপাখি ?”

আরু চুপ হয়ে গেল, দেওয়াল আলমারির তাকে থাকা বইগুলোকে দেখতে লাগলো ৷ আরিশ ক্রমশ পলক না ফেলে আরুর দিকে তাকিয়ে বলল
” আমি কোন শর্ত ভঙ্গ করিনি, আমার যা করা উচিত ছিলো তাই করেছি ৷ আর তোমার সাহস কি করে হয় অন্য ছেলের ঘড়িতে ওড়না বাধানোর ৷ আর যদি কখনো এমন কিছু দেখেছি তো সেদিনই বিয়ে ৷”

আরু আরিশের দিকে এগিয়ে আরিশের নাকে টোকা দিয়ে বলল
” ভার্সিটিতে আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করবো,বলেছি না আপনি কিছু বলতে আসবেন না ৷”

আরিশ ওর চেয়ারটা আরুর দিকে টেনে বলল
“কথাটা যখন বলেই ফেলেছো তখন আমিও এখন লুচ্ছামি করলে কেমন হয় ?”

আরুর কথাটা শুনে লজ্জা আর রাগ দুটোই হলো, আরিশ যেন. আদতেও তেমন কিছু না করে তাই উঠে গিয়ে শেল্ফ থেকে একটা বই হাতে তুলে একটু ঘেটে ঘেটে দেখতে লাগলো ৷ আরিশ গিয়ে আরুর পাশে দাঁড়িয়ে ওর টি শার্টের ওপর পরে থাকা সাদা এপ্রোনটা খুলে আরুর গায়ে পরিয়ে দিলো ৷
আরু আরিশের দিকে তাকালো ৷ তারপর হাতে থাকা সাইকোলজির বইটার একটা পাতা খুলে বিড়বিড়িয়ে বলল
” There is no specific source of love in this world, because love goes without reason Which is called …..”(এই পৃথিবীতে ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোন সূত্র নেই, কারনে অকারনেও ভালোবাসা যাই ৷ যেটাকে বলে…..)”

আরুর কথাটা শেষ না করেই আয়াশ বলে উঠলো
” Love for no reason…..কারনে অকারনে ভালোবাসি ৷”

আরু আরিশের দিকে তাকালো,,আরিশের চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আরুর নেই ৷ চোখ নামিয়ে নিলো আরু ৷
বইটা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল আরু ৷ আরিশ বইটা হাতে নিয়ে ঘাটতে লাগলো ৷

হনহনিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে আরু, আজকে ওর বান্ধবীগুলোর খবর আছে ৷ ওদের দেওয়া ডেয়ারটা কমপ্লিট করতে গিয়ে ওর এই হেনতেন অবস্থা ৷ আরু খানিকটা ছুটে গেল কিন্তু গিয়ে দেখলো সানা ছাড়া কেউ নেই সবকটা পালিয়েছে ৷ ইচ্ছা করে ওরা ডেয়ারটা দিয়েছিলো ৷ সানার কাছে গিয়ে বেশ জোরে বলে উঠলো
” ওই ডাফার গুলোর জন্য উনি সবার সামনে দিয়ে আমাকে কোলে তুলে নেওয়ার সুযোগ পেলো নাহলে…”

” নাহলে কি ? শোন ভাইয়ার সুযোগের দরকার নেই, চাইলেই সুযোগ করে নিতে পারে কিন্তু সুযোগ খোঁজেনা কখনো তাই তুই পার পেয়ে যাস আরু ৷ আর ভাইয়া এখন কিছু বলেনি কিন্তু বাসায় গিয়ে তো এত সাহস ফুস হয়ে যাই তখন ভাইয়া তো আলাদাই ক্লাস নিবে দেখিস ৷”
আরুকে শুনিয়ে কথাগুলো বলল সানা ৷
আরু শুকনো ঢোক গিললো ৷ সারাদিন ভার্সিটিতে হল্লা দিলেও , টইটই করে ঘুরলেও আরিশ কিছু বলেননা কারন সেক্ষেত্রে আরুর ছাড় কিন্তু বাসায় ফিরলে শুরু হয় আরিশের প্যারা ৷
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দুজনে রাস্তার ধারে চলে এলো, রিকশা নেবে এখান থেকে ৷ বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে আরু, 5টার আগেই বাসায় ফিরতে হবে, আরিশ পড়াতে আসে 6টার সময় এখন বাজে 4.45 আর এতটুকু সময়ের মাঝে ওকে বাসায় ফিরে খাওয়া ছাড়া বাকি কাজ গুলো করে নিতে হয় ৷”

রিকশার জন্য আরু আর সানা অপেক্ষা করতে করতে আরিশ ওদের সামনে দিয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেলো ৷
আরিশ চলে যেতেই সানাকে প্রশ্ন করে উঠলো
” আচ্ছা তোরা দুজন ভাই বোন, একই বাসাতে থাকিস তবুও দুজন একসাথে বাসায় ফিরিস না কেন? নাকি উনি আমাকে পাহারা দিতে বলেছে তোকে কোনটা ?”

সানা ভ্রু কুঁচকে বহল
” স্টুপিড, পাহারা দিতে কেন বলবে আর পাহারা দেওয়ার হলে ভাইয়া তোকে বাসায় দিয়ে আসতো তোকে নিজে যেতে হতো না ৷ বুঝলি? ভাইয়া তো বাসাতেই যাই 5.39টাই ৷”

আরু অবাক হয়ে বলল
” আর এতটুকু সময় উনি কোথায় থাকে?”

” জানিনা আমি , আম্মু জানে আর আমি কখনো জিজ্ঞাসা করিনি ৷”

কথায় কথায় রিকশা এলো ৷ দুজনে রিকশয় বসলো ৷ রোজ রিকশায় উঠলেই পিছন থেকে আরুকে সাবধান করতে রাস্তার কেউ না কেউ বলে
” আফা আপনার ওড়না ঠিক করেন ৷”
কিন্তু আজকে কথাটা শুনতে হলো না কারন গায়ে ওড়না নেই, আরিশের কেমিস্ট্রি ল্যাবের সাদা এপ্রোনটা রয়েছে ৷
কথা গুলো ভাবলো আর মুচকি হাসলো আরু , যে করেই হোক আজকে আরিশকে বাসায় আসতে দেওয়া যাবে না, নাহলে আরিশের কাছে আজ প্রচুর ঝাড়ি খাবে ৷

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এদিক ওদিক পাইচারি করছে আরু,,6.30টা বাজে এখনো আরিশ এলো না, আরিশের হাতে গোনা কয়েকটা দিন দেরি হয় নাহলে তাড়াতাড়িই চলে আসে ৷ , ভার্সিটিতে থাকলে আরিশকে ও ভয় পায় না কিন্তু বাসায় থাকলে আরিশকে প্রচন্ড রকম ভয় পাই কারন সেটুকু সময় আরিশের ৷
আরুকে পাইচারি করতে দেখে ওর মা ভ্রু কুঁচকে বলল
” কি হয়েছে, এমন করছিস কেন শরীর খারাপ ?”

শরীর খারাপ কাথাটা শুনেই আরুর মাথায় বুদ্ধি এলো তারপর ভাবলো যে আরিশ আসলেও যাতে আজকে ওর সাথে দেখা করার সুযোগ না পাই সেই কাজটা পাকাপোক্ত করতে হবে ৷
হঠাৎ করে পেটে হাত দিয়ে বলে উঠলো

” উউউউউমমমমমা গো, উইইইমা !”

ওর এমন বেসুরে আর্দনাত শুনে আরুর মা চমকে আরুর দিকে তাকালেন তারপর বললেন
” কি হয়েছে এভাবে চেচাচ্ছিস কেন?”

আরু পেটে হাত দিয়ে বিছানায় বসে বললো
” উইইইইমা গো, মরে গেলাম গো,,, উইইইই !”

আরুর মা রেগে ধমক দিয়ে বললেন
” কি হয়েছে কি ! বলবি তো , না বলে এমন চেচাচ্ছিস কেন ?”

আরু এবার বসা থেকে শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে বলল
” কি পেট ব্যাথা গো, শেষ হয়ে গেলাম গো, ও মা গো ৷ আজকে ওনার পড়া করতে পারবো না গো ৷”

উনি ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললেন
” কেন কি হলো হঠাৎ ?”

আরু বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে আর উইইইমা বলতে বলতে বলে উঠলো
” আর বলোনা আম্মু, ভার্সিটির ক্যানটিনের পচা আর বাসী খাবার খেয়ে এই অবস্থা ৷ আগে জানলে কখনো খেতাম না ৷ উইইইমা গো মরে গেলাম গো ৷”

উনি আরুর পাশে বসে আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
” কতোবার বলেছি ওসব খাবার খাবি না বাসা থেকে নিয়ে যাবি কিন্তু তা তো শুনবি এখন ডাক্তারকে কল দিই আগে ৷”

আরু হঠাৎ সুস্থ মানুষের মতো ঝাড়ি দিয়ে বলল
” এই আম্মু তুমি কেমন মানুষ গো, দেখছো তোমার মেয়েটা ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছে আগে ওনাকে কল করে আসতে বারন করো তারপর ডাক্টর কে কল করবা ৷ উনি এতোদূর এসে আবার ফিরে যাবেন ওনার কষ্ট হবে না ৷ আআআআ….মা গো ৷”

আবার নাটক শুরু করে দিলো ৷ আরুর কথাতে উনি কনিফিউশানে যে কি করবেন ,তাই আগে ডক্টর কে কল করতে নিলেই ফোনে ফোন এলো ৷ উনি আরিশের ফোন এসেছে দেখে বললেন
” এই দেখ আরিশের ফোন ৷”

আরু রেগে বরল
” ধরো আর বলো আরু অসুস্থ খুব তাই আজ আরিশকে আসতে হবে না ৷”

উনি ফোনটা ধরতেই অপর পাশ থেকে আরিশের মা অনিকা খান বলে উঠলো
” ভাবী আজকে আরিশ যাবে না গো ৷ ওর আসলে ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে ছোট এক্সিডেন্ট হয়েছে ৷”
পাশ থেকে আরিশ বলল
” আম্মু আমি বললাম তো যাবো ৷”

আরুর মা কথাটা শুনে বললেন
” কেন কিভাবে হলো ?”

আর বলোনা রাস্তায় বাইকের সামনে একটা বাচ্চা চলে এসেছিলো তাই ৷”

” ওহহ তা আরিশ এখন কেমন আছে ৷ আর আরুও তো অসুস্থ ৷”

আরু ফোনের ওপাশের কথা কিছু না শুনরেও ও মা যে বলেছে ও অসুস্থ সেটা শুনে মনে লাড্ডু ফুটছে ৷

” আরিশ ঠিকই আছে মঝটামুটি , তবে হালকা জ্বর আসছে ইনজেকশান দেওয়াতে ৷ আর আরুর কি হলো ৷”

” আর বলোনা অনিকা ভার্সিটির ক্যান্টিনের খাবার খেয়ে অসুস্থ ৷”

ফোনটা লাউডে থাকার দরুন কথাগুলো আরিশের কানে গেল ৷ আরিশ ভার্সিটিতে ঢুকেছে লাঞ্চ টাইমের পর তাই আরুর এই খবরটা রাখতে পারেনি ৷
কথাটা শুনে চুপ করে রইলো ৷

” আচ্ছা তাহলে আমরা কি আরিশকে দেখতে যাবো ?”

আরু পাশ থেকে বলল
” এই আম্মু আমরা যাবো কেন, ওনাকে আসতে না করো শুধু ,আর বলো আরুর অসুস্থতা 2 দিনের মধ্যে ঠিক হবে না ৷”

আরুর মা ধমক দিতেই আরু চুপ হয়ে গেল ৷

” না না আসতে হবে না,,, ”

আর কিছু বলতে যাবে তখনই আরিশ বললো
” তোমাদের আসতে হবে না আমি আসছি !’

কথাটা বলে ফোনটা রেখে দিলো ৷ আরুর মা আরুর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল ৷ আরু তো মনে মনে নাগিন ডান্স দিলো
” ওই হোই মেরি দিমাগ কি বাত্তি খুল গায়া ৷ উইইইমা টুইটুই !”

চলবে।