কুঁড়েঘর পর্ব-১১

0
537

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ১১ ।

টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরতেই জোতি ফোন করে জানায় একটু পর শাড়ি কিনতে শপিং এ যাবে। জোতি এসে নিয়ে যাবে তাকে। রিধিশা চিন্তায় পড়ে গেলো, কি করবে এখন?
রিধিশা ড্রয়ার থেকে টাকা বের করে দেখে পুরো মাস চলার মতো টাকাই নেই তার। আজই যেই একজনের টিউশনির বেতন বাকি ছিলো সেটা দিয়েছে।

রিধিশা মুখ শুকিয়ে বিড়বিড় করে বললো
” এখন শাড়ি কিনলেও তো কম টাকা লাগবে না। মায়ের টাকা গুলো যাও বাঁচিয়ে রেখেছিলাম তাও খরচ হয়ে যাবে আজ। আবার ভার্সিটি ফিস দিতে হবে কয়েকদিন পর ”
রিধিশা নিশ্বাস ফেলে ৪ হাজার টাকা বের করে নেয়।
তৈরি হতে হতে জোতি এসে পড়ে। আসার আগে এড্রেস দিয়েছিলো জোতিকে। আজকে রিধিশার সাথেই থাকবে তারপর সকালে দুজন একসাথে যাবে বলে ঠিক করেছে জোতি।

জোতি রুমে ঢুকে পুরো রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখে বললো
” তোর অসুবিধা হয়না এখানে থাকতে?”
রিধিশা মলিন হেসে বললো
” একটা মাথা গুজার ঠায় পেয়ে বেঁচে আছি এটাই তো অনেক। অসুবিধা আবার কিসের?” জোতি ভ্রু কুঁচকে বললো
” এই তোর একটা স্বভাব। কথায় কথায় এসব উল্টো পাল্টা কথা বলিস। ইচ্ছে করে মেরে ফেলি তোকে।”

রিধিশা শব্দহীন ভাবে হাসলো। কিছুক্ষণ বসে জোতি আর রিধিশা বেরিয়ে গেলো। বাসা থেকে বের হতেই সাজেদা বেগমকে দেখতে পেয়ে রিধিশা জোতিকে সাজেদা বেগমের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় আর তাকে বলে বেরিয়ে যায়।
রিধিশা জোতির সাথে নিশাদের বাসার সামনে দিয়ে চলে যায়।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো নিশাদ। দুজনকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো
” আরে, এটা ওই রিধিশা আর জোতির মতো দেখতে না? এই মেয়ে দেখি মারাত্মক বেয়াদব। কালকে একা বের হতে না করেছি তাই আজ বান্ধবীকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
নিশাদ রুমে এসে জ্যাকেট পড়ে নেয়। সাদি, সূর্য, রেহান ড্রইংরুমে বসে মুভি দেখছিলো। নিশাদকে দেখে সূর্য বললো
” কিরে এখন কই যাস?”
নিশাদ চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
” কালকের ঘটনার পরও মেয়েটা এই রাতে বেরিয়েছে। আজকে দুটো থাপ্পড় না দিয়ে ছাড়ছি না।”

সাদি ভ্রু নাচিয়ে বললো
” মেয়েটাকে নিয়ে তোর এতো চিন্তা কিসের? তোর কথা না শুনে আবার বেড়িয়েছে। এখন কোনো বিপদ হলে নিজেই বুঝবে। তুই ভাবিস কেনো এতো ওকে নিয়ে?”
” আমি কেনো ভাববো! আমি ভাবি না ওকে নিয়ে। আচ্ছা আমি দেখে আসি কালকের ছেলে গুলো আজ আছে কিনা।” নিশাদ দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো।
অনেকটা দৌঁড়ে তারপর দুজনকে ধরতে পারলো নিশাদ।

জোতি একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। নিশাদও রিকশা নিয়ে নেয়।
” মনে হচ্ছে অন্য কাজে যাচ্ছে। আমার আসার দরকার ছিলো না। এসেই যখন পরেছি দেখে আসি কোথায় যায়।”

রিধিশা জোতির দিকে তাকিয়ে বললো
” সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে এখন শপিং মলে গেলে বাসায় ফিরতে কতোক্ষণ লাগবে বলতো!”
” তো কি করবো? কালকেই তো নবীন বরণ। আর গতকাল তো অসুস্থই ছিলাম। এখন না কিনলে তো কালকে আর পড়তেই পাড়বো না।”
রিধিশা বিরক্ত হয়ে বললো
” কালকে শাড়িই পড়তে হবে এমন কোনো কথা আছে? অন্য ড্রেস পারলেও তো হবে।”

” আরে সবাই শাড়ি পড়বে আমরা না পড়লে কেমন দেখায় না!” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” কেমন দেখায় আবার কি? শাড়ি নেই তো পড়িনি এতে কেমন লাগার কি আছে?”
জোতি রাগি গলায় বললো
” তুই চুপ করতো! বেশি কথা বলিস। আমি যা বলবো তাই করবি নাহলে আর কখনো কথা বলবো না আমি।” রিধিশা মুখ কুঁচকে বসে থাকে।

শপিং মলের সামনে দুজন গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ে। নিশাদও রিকশা থেকে নেমে মাস্ক পড়ে নিজের চেহারা ঢেকে নেয়।
রিধিশা মলের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতুকি করতে থাকে। রিধিশা জিজ্ঞেস করলো
” তুই ভেতর না ঢুকে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? তাড়াতাড়ি চল তো!”
জোতি রিধিশাকে ইশারায় সামনে তাকাতে বললো। রিধিশা সামনে তাকিয়ে চমকে যায় জোয়ানকে দেখে। জোয়ান হাসিমুখে এগিয়ে আসে দুজনের কাছে।

রিধিশা বিস্ময়ের স্বরে বললো
” ভাইয়া! ভাইয়া কোথা থেকে এসেছে?” জোতি মিটমিট করে হেসে বললো
” কোথায় আবার বাড়ি থেকে এসেছে।” রিধিশা অবাক চোখে জোয়ানের দিকে তাকালো আবারও।
জোয়ান শব্দ করে হেসে বললো
” কিরে তুই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? দেখে মনে হচ্ছে আমাকে দেখে চোখ বের করর ফেলবি।”
জোতিও জোয়ানেত যাথে তাল মিলিয়ে হাসলো। রিধিশা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।
রিধিশা গলা ঝেড়ে বললো
” তুমি আসবে আমি জানতাম না। আমাকে তোমরা দুজন কেউই জানাওনি!”

জোয়ান হেসে বললো
” আমিই জোতিকে জানাতে না করেছিলাম। তোকে সারপ্রাইজ দেবো বলে।”
” আমাকে সারপ্রাইজ দেবে? সারপ্রাইজ তো জোতিকে দেওয়া দরকার ছিলো।” জোয়ান মাথা নেড়ে বললো
” ঠিক বলেছিস। কিন্তু আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম আজকে আসবো তাই সারপ্রাইজ দেয়া হয়নি পড়ে ভাবলাম তুই জানিস না যখন তোকেই সারপ্রাইজ দেই।” রিধিশা আলতো হাসলো। জোতি দুজনকে ভেতরে যাওয়ার জন্য তাড়া দেয়।

এদিকে নিশাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে এতোক্ষণ সব পর্যবেক্ষণ করেছে। নিশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” এই ছেলের সাথে দেখা করতে এসেছে তাহলে! আমিও দেখবো কে এই ছেলে।” নিশাদ হনহন পায়ে মলের ভেতরে ঢুকে গেলো। রিধিশাদের পেছন পেছন, যদিও তাদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব রয়েছে।

জোতি শাড়ির দোকানে ঢুকে বসে পড়লো। রিধিশা আর জোয়ানও গিয়ে বসলো। জোতি বিভিন্ন শাড়ি
দেখতে থাকে। রিধিশা চুপচাপ বসে আছে। তার এসব দেখতে ইচ্ছে করছে না। তার মাথায় তো অন্যসব কথা ঘুরছে। জোয়ান একটা শাড়ি নিয়ে বললো
” তুই চুপচাপ বসে আছিস কেনো? নে, শাড়ি দেখ।”
রিধিশা মাথা নেড়ে শাড়ি হাতে নেয়।

নিশাদ ভ্রু কুঁচকে রিধিশার দিকে তাকালো। মেয়েটার মধ্যে কোনো ভাবগতি দেখতে পাচ্ছে না সে। জোতির ভেতর যতোটা উৎসাহ দেখতে পাচ্ছে তার এক ফোটাও রিধিশার মাঝে নেই। নিশাদ ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বললো
” মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেনো?”
রিধিশা শুধু দেখেই চলছে মুখ দিয়ে কথা নেই তার।
জোতি দেখতে দেখতে প্রায় তিনটা পছন্দ করলো। এরমধ্যে থেকে একটা নিবে সে।
রিধিশা জোতির তিনটা শাড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়। কেনার ইচ্ছেই তো নেই পছন্দ তো দূড়।

জোয়ান জোতিকে একটা শাড়ি পছন্দ করতে বলে, রিধিশাকে বলল
” তুই কি বসেই থাকবি? একটা তো শাড়ি দেখবি! নাকি আজ বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই?”
রিধিশা এদিক ওদিক তাকিয়ে আরো শাড়ি দেখা বললো। নিশাদ গিয়ে বসে কয়েকটা শাড়ি হাতে নিয়ে দেখতে থাকে। সে তো কখনো মেয়েদের জন্য কিছু কিনেইনি তাই বুঝতে পারছে না কিছু।

ভেতর থেকে একটা লেভেন্ডার কালার শাড়ি খুঁজে বের করলো নিশাদ। চোখে লাগার মতো একটা শাড়ি। নিশাদ হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে রিধিশার সেটার উপর চোখ পড়ে। রিধিশা শাড়িটার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো
” এটা একটু দেখতে পারি?” নিশাদ মাস্কের আড়ালে আলতো হাসলো। রিধিশার দিকেও তাকালো না। শাড়িটা রিধিশার দিকে ছুড়ে দিয়ে উঠে গেলো।
রিধিশা বোকার মতো তাকিয়ে রইলো নিশাদের যাওয়ার পানে।

জোতি অবাক হয়ে বললো
” কেমন লোক রে বাবা, একটু দেখবে বলেছে তাতেই রাগ দেখিয়ে চলে গেলো!”
রিধিশা বিড়বিড় করে বললো
” লোকটার ব্যাবহার মনে হচ্ছে একদমই বজ্জাত নিশাদের মতো।”
জোয়ান জোতিকে বললো
” রাগ দেখাবে কেনো? হয়তো পছন্দ হয়নি। এতো বেশি ভাবিস কেনো তুই?”

রিধিশা শাড়িটা খুলে দেখতে থাকে। শাড়িটা চোখে লেগে থাকার মতো সুন্দর। রিধিশা মুচকি হাসলো শাড়িটা দেখে। দোকানের লোকটা শাড়িটা নিয়ে বকবক জরে যাচ্ছে। রিধিশা প্রাইজ জিজ্ঞেস করতেই ৫হাজার টাকা বললো।
রিধিশা শাড়িটা রেখে দিলো পাশে। জোতি মাথায় হাত দিয়ে বললো
” এই যে মজা করছেন? এই শাড়িটা তো আমি অনলাইনেই আরো কম প্রাইজে অর্ডার দিয়েছি আর আপনি বলেন ৫ হাজার? মানে আমাদের দেখে গাধা মনে হয়? প্রাইজ কি জানি না নাকি?”

রিধিশা চোখ বড়বড় করে তাকালো জোতির দিকে। জোয়ান মুখে চেপে হেসে যাচ্ছে। জোতি দোকানদারের সাথে দামাদামি করতে থাকে। রিধিশা জোতিকে টেনে এনে বললো
” তুই কি শুরু করলি? দামাদামি করে লাভ কি? এতো টাকা দিয়ে আমি শাড়ি কিনতে পারবো না। দরকার পড়লে আমার জন্য অন্য শাড়ি দেখছি চল তুই।”
জোতি থামিয়ে বললো
” তুই থাম, কিছু তো বুঝিস না। এতো বছর তো খালামনির আচল ধরে ঘুরেছিস আর নেচেছিস।
শপিং তো করিস নাই। খালামনিই সব করতো। শপিং এর কি বুঝিস তুই? তুই শুধু দেখতে থাক।”
জোতি গিয়ে আবারও দোকানদারের সাথে দামাদামিতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

রিধিশা একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জোয়ান এসে বললো
” রিধু! চল আমরা চলে যাই। মনে হচ্ছে এখানে থাকলে জোতির জন্য মান-সম্মান যাবে আজ।”
রিধিশা হেসে দিলো জোয়ানের কথায়।
জোয়ান কিছুক্ষণ রিধিশার দিকে তাকিয়ে বললো
” তুই সব সময় এভাবে হাসিস না কেনো? আগে সবাই তোর বেশি হাসার কারণে সবাই বলতো তুই খুব হাসিস আর এখন সেই হাসিটাই বিলীন।”
রিধিশা জোয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। নিচু স্বরে বললো
” অন্যের হাসি বা সুখ দেখলে অনেক মানুষের বুকের আগুন ধরে। সেই আগুন নেভাতে গিয়েই হয়তো আজকে আমার মুখের হাসি নেই।”

রিধিশার কথায় জোয়ান হাসলো আর বললো
” আজকাল তোর কথা শুনলে তোকে খুব বড় মনে হয়।” রিধিশা হেসে বললো
” হুম বড়ই তো। ছোটদের ছোট থাকা হয় না সারাজীবন। সময় আর পরিস্থিতি মানুষকে বড় করে দেয়।” জোয়ান রিধিশার দিকে তাকিয়ে থাকে।
জোয়ান আর রিধিশা কথাগুলো নিশাদ তাদের কাছে দাঁড়িয়েই শুনলো। রিধিশার পেছনেই পিঠ ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিলো নিশাদ। রিধিশার কথা শুনে নিশাদের মনে হাজারটা প্রশ্নের ডানা সৃষ্টি হয়েছে।

এরমাঝে জোতি এসে বড় একটা হাসি দিয়ে বলল
” বান্ধুপ্পী! তোর শাড়ি কেনা হয়ে গিয়েছে। চল দুজনেরটা নিয়ে আসি।”
জোতি রিধিশাকে টেনে নিয়ে গেলো। রিধিশা আর জোতির সামনে শপিং ব্যাগ দেয়।
দোকানদার রিধিশাকে বললো দুই হাজার টাকা দিতে। রিধিশা হা করে জোতির দিকে তাকালো। জোতি বড় একটা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। ৫হাজার টাকার শাড়ি ২হাজারে এনে ঠেকিয়েছে এই মেয়ে।

২হাজার টাকাও অনেক বেশি রিধিশার জন্য কিন্তু এখন আর কিছি করার নেই। রিধিশা তার টাকা জোতির হাতে দেয়। জোতি নিজের আর রিধিশার পেমেন্ট করে বেরিয়ে গেলো শাড়ির দোকান থেকে।

চলবে……