কুঁড়েঘর পর্ব-১০

0
495

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ১০ ।

নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” কি চাই তোদের?” নিশাদের উচ্চারণ শব্দ গুলো রিধিশার জন্য যেমন স্বস্তির ছিলো তেমনই সেই ছেলেদের জন্য খুব ভয়ঙ্কর ছিলো।
ছেলেদের মধ্যে একজন বললো
” কিছু না ভাই। একটু জিজ্ঞেস করছিলাম কোথায় থাকে।”

নিশাদ চোয়াল শক্ত করে ছেলেটাকে শক্তপোক্ত হাতে থাপ্পড় দিয়ে বসলো। হুংকার দিয়ে বললো
” শু*** বাচ্চা, আমাকে এতো বোকা মনে হয়? আমার এলাকায় কে কি করে আমি কি জানি না? ওর পথ আটকেছিস কেনো? বল, এখন আমার সামনে ওকে কি বলার বল। নাহলে আজকে এখনেই সব কয়টাকে মেরে রাস্তায় কবর দিয়ে দেখবো।”
নিশাদ শার্টের হাতা উঠাতে উঠাতে ছেলেগুলোর দিকে এগিয়ে যায়।

“ভাই মেয়েটা’কে আগে দেখিনি তাই নাম জিজ্ঞেস করছিলাম আর কিছুই না। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন ভাই।”
নিশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” আমার কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। আমাকে খুব ভালো করে চিনিস তোরা। কিছু করলে ভাবিস না এমনি এমনি ছাড় পেয়ে যাবি।
ছেলে গুলো ঢোক গিলে সেখান থেকে চলে গেলো।
.

নিশাদ রিধিশার হাত ধরে সেই জায়গা থেকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে আসে। নিজের বাসার সামনে এসে রিধিশার হাত ছেড়ে রাগি চোখে তাকিয়ে বললো
” এতো রাত এখানে কি করো তুমি? ভয়ডর কিছু আছে নাকি ভাবো তোমার ভাব দেখে এমনি ছেড়ে দেবে ওরা তোমাকে?”
রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” আপনি এখনও কথায় কথায় আমাকে ভাব নেই বলে খোঁটা দেন কেনো? কি ভাব দেখিয়েছি আমি?”

নিশাদ দাঁত কিড়মিড় করে বললো
” প্রথম দিন থেকে তো কম ভাব দেখাওনি। এখনও তো মনে হচ্ছে না কোনো ভয় পেয়েছো। আমি না আসলে কি হতো ভাবো তো একবার!”
রিধিশা ঢোক গিললো নিশাদের কথায়। ছেলেগুলোকে দেখেই তার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো আর এরপরে তো কিছুই ভাবতে পারছে না। ভাবলেই হয়তো হার্ট এটাক হবে।

নিশাদ নিশ্বাস ফেলে বললো
” এতো রাতে এখানে কি করছো তুমি?”
রিধিশা নিচু স্বরে বললো
” এখানে আমি নতুন এসেছি। টিউশনি শেষ করতে রাত হয়েছে।”
নিশাদ কিছুট অবাক হয় এরপর এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা ঝেড়ে বললো
” এখানে নতুন? তা কোন বাসায় উঠেছো?”
রিধিশা নিশাদের দিকে একবার তাকিয়ে বললো
” আপনাকে কেনো বলবো? আপনি নিজে এখানে কি করছিলেন?”

নিশাদ দাঁত কেলিয়ে হেসে তার পেছনের বিল্ডিং দেখিয়ে বললো
” এটা আমার বাসা। শোনো এবার থেকে রেডি থেকো সুযোগ পেলেই তোমাকে পানিতে চুবাবো।”
রিধিশা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আবার মুখ বাঁকিয়ে বললো
” আপনার কি পানিতে জন্ম হয়েছিলো? কথায় কথায় পানিতে চুবান।”
” তোমার এতো ভেবে কাজ নেই। যাও সোজা তোমার বাসায় যাও। আর টিউশনি বা যতো কাজই থাকুক না কেনো সন্ধ্যার পর একা একা একদমই বের হবে না। দরকার পড়লে টিউশনি সকালে পড়িয়ে নেবে। আমি তো আর বারবার তোমাকে বাঁচাতে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো না। আমারও কাজ আছে।”

রিধিশা মাথা নেড়ে বাধ্য মেয়ের মতো দ্রুত পা চালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।
নিশাদ সাদিকে ফোন করে বললো
” হকিস্টিক গুলো নিয়ে একটু নিচে আয় তো। অনেকদিন হলো খেলা হয় না। মরিচা পড়ে যাবে ওগুলোতে।”
সাদি বিরক্ত হয়ে বললো
” এতো রাতে খেলবি? ধুর আগে বললে আরো মানুষ এরেঞ্জ করে লাইটিং করে সব রেডি করে রাখতাম।”
নিশাদ রেগে বললো
” শা*লা সবই আছে তুই হকিস্টিক, রেহান আর সূর্যকে নিয়ে শুধু নিচে আয়।”
.

পিঠের মধ্যে সজোরে আঘাত করতে ছেলেটা চেঁচিয়ে পিচ ঢাকা রাস্তায় চিত হয়ে পড়লো। বাকি ছেলে গুলো ভয় পেয়ে পেছন ঘুরে নিশাদদের দেখেই উল্টো পাল্টা দৌঁড় লাগায় কিন্তু কেউই পালাতে পারেনা। নিশাদরা চারজন মিলেই সব গুলোকে ধরে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। নিশাদ একজনকে মারতে মারতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” মেয়ে দেখলেই জিভ দিয়ে পানি পড়ে তাই না? ওই মেয়ের দিকে আর কোনো দিন চোখ তুলে তাকালো তোদের চোখ তুলে অন্ধ মানুষকে দান করবো আমি।”
নিশাদ আর সূর্যরা সব গুলোকে মারতে থাকে।

_______

রিধিশা নিজের বাসায় ঢুকেই বড় একটা নিশ্বাস নিলো। হঠাৎ করে দরজায় বারি পড়লো আবার। রিধিশা ভয় পেয়ে যায় শব্দ শুনে। খাটের উপর ব্যাগ রেখে এসে দরজা খুলে দেয়। সাজেদা আন্টিকে দেখতে পায়। রিধিশা আলতো হেসে ভেতরে আসতে বলে তাকে। সাজেদা বেগম ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে চিন্তিত হয়ে বললো
” তোমার চিন্তায় আমি দুবার এসে ঘুরে গিয়েছি। এতো রাতে বাসায় ফিরলে কিভাবে হবে? তুমি একা থাকো তার উপর এখন দিনকাল ভালো না। তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবে বাড়িতে বুঝেছো, মা?”

রিধিশা ঠোঁট কামড়ে বললো
” আন্টি টিউশনি করে ফিরতে লেট হয়ে যায় প্রতিদিন। আগেও এই সময়েই ফিরতাম বাসায়।”
সাজেদা বেগম রিধিশার হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিয়ে বললো
” শোনো মা। আগের যেখানে থাকতে সেখানে তো সবাই তোমাকে চিন্তো কিন্তু এখানে তুমি নতুন। আর সত্যি বলতে এই এলাকার কিছু ছেলে আছে যারা একটু উশৃঙ্খল। এলাকায় মানুষদের সাথে কিছু করতে পারে না তারা কিন্তু তুমি তো নতুন তাই একটু সাবধানে চলবে। প্রথম দিন তো তাই চিন্তা হচ্ছিলো তোমার জন্য।” রিধিশা আলতো হেসে মাথা নাড়ালো।

সাজেদা বেগমকে বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে গিয়ে চা’য়ের জন্য পানি বসিয়ে তার সাথে কথা বলতে থাকে।
সাজেদা বেগমের স্বামী গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছে। বাড়িতে তার শশুড়, ছেলে,বউ আর নাতি রয়েছে। ছেলে চাকরি করে আর ছেলের বউও চাকরি করে শখের বসে। এসব নিয়ে গল্প করতে থাকে।

রাতে আলিফ, তানহার মার সাথে কথা বলে তাদের পড়ার টাইম আরো এগিয়ে নিয়ে আসে। দুজন একই স্কুলে পড়ে তাই তাদের স্কুলের যাওয়ার আগে রিধিশা ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে দুজনকে সকালে পড়িয়ে যাবে। বাকি দুটো ভার্সিটি থেকে আসার পথে পড়িয়ে আসবে। সব শেষ করে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসতে পারবে।
রাতের খাবার না খেয়ে রিধিশা তার পড়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে।

★★

ভার্সিটিতে এসে দেখে সবার মুখে নবীন বরণের উৎসব নিয়ে গল্প চলছে। কে কি পরবে না পরবে এসব নিয়ে। রিধিশা ক্লাসে ঢুকে দেখে জোতি এক কোণায় বসে কথা বলতে ব্যস্ত। রিধিশা জোতিকে ঠেলেঠুলে ওর পাশে বসে পড়ে। জোতির ফিসফিস কথা শুনে বুঝতে পারে রেহানের সাথে কথা বলছে।
রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বই বের করে পড়তে থাকে তার মতো।

আজ নিশাদদের পরীক্ষা চলছে। নিশাদ মন প্রাণ মিলিয়ে পরীক্ষা দিয়েই চলছে। পরীক্ষা বলে গতকাল সারারাত পড়েছে। কালকে আবার নবীন বরণের জন্য পরীক্ষা নেই কোনো। পরীক্ষার মাঝে নবীন বরণের উৎসব ফেলায় তাদের ক্লাসের অনেক স্টুডেন্টের মন খারাপ। কারো কারো মা, বাবা নাকি পরীক্ষার সময় অনুষ্ঠানে আসতেই দেবে না আবার অনেকেই সারাদিন পড়বে বলে ঠিক করেছে।
.

জোতি ফোন রাখতেই রিধিধা ভ্রু কুঁচকে বললো
” আজকে না মাস্টার্সের এক্সাম চলছে? কথা বললি কিভাবে?” জোতি হেসে বলে
” আরে আজকে ওদের পরীক্ষা তবে অন্য ডিপার্টমেন্টের আর কি। রেহানদের পরশুদিন পরীক্ষা। আচ্ছা কালকের জন্য কি ভেবেছিস কি করবি?” রিধিশা মেকি হেসে বললো
” আমি কাল আসবো না।” জোতি কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো
” কি! তুই না আসলে আমি একা একা কি করবো? তুই আমার আনন্দটা এভাবে মাটি করে দিতে চাস? এই তোর বন্ধুত্ব? আমাকে একটুও ভালোবাসিস না।”
রিধিশা মুখ লটকিয়ে রাখে। জোতি ইমোশনাল ড্রামা
শুরু করেছে।
.

রিধিশা কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছের নিচে বসে বসে কাঠগোলাপ গাছিটাকে পরখ করছে। আজকে গাছটার মধ্যে একটা ফুলও দেখা যাচ্ছে না। রিধিশা মন খারাপ করে কৃষ্ণচূড়া ফুল কুড়িয়ে নেয়। একটা ফুল কানের পিঠে গুঁজে দেয়।
রিধিশা দূড়ের খোলা আকাশের দিকে তাকালো। আকাশটা মেঘলা দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু জায়গায়। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আকাশটাকে। হালকা ঠান্ডা বাতাসও রয়েছে, বৃষ্টি পড়বে হয়তো আজকে।
রিধিশা ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
রিধিশা আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে বড় একটা নিশ্বাস নিলো।

নিশাদ শব্দহীন পায়ে রিধিশার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। রিধিশার মুখের দিকে তাকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো। নিশাদ রিধিশার কানের পিঠে থাকা ফুলটা হাতে নিয়ে নিলো। রিধিশা ভাবলো কান থেকে ফুল পড়ে গিয়েছে তাই কানে হাত দিয়ে পেছনে তাকাতে যায়। পাশে নিশাদকে দেখে চমকে ভ্রু কুঁচকে ক্ষিপ্ত স্বরে বললো
” আপনি এখানে কি করছেন?”

নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” আমি এখানে কি করছি তোমাকে বলতে যাবো কেনো?” রিধিশা নিশাদের হাত থেকে ফুলটা নিতে চাইলে নিশাদ হাত সরিয়ে নিয়ে বললো
” এটা এখন আমার ফুল। ধরলে খবর আছে।”
“অদ্ভুত তো! আমার কান থেকে ফুল নিয়ে বলছেন খবর আছে! বজ্জাত ছেলে ফুল দিন আমার।”
নিশাদ মুখ বাঁকিয়ে বললো
” দেবো না কি করবে তুমি? দেখাও তো আমাকে।”
রিধিশা আর কিছু বলতে গিয়েও নিশাদের কপালের একপাশে ব্যান্ডেজ থেকে চমকে বললো
” আপনার মাথায় কি হয়েছে?”

নিশাদ এদিক ওদিক তাকালো। কালকে ছেলেদের মারার সময় বেখেয়ালি হয়ে যাওয়ায় নিজেই নিজের লাঠি দিয়ে ব্যাথা পেয়েছে খেয়ালই করেনি। বাসায় যাওয়ার পর সূর্য ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।
নিশাদ চোখ ছোট করে বললো
” আমার মাথায় যাই হোক তোমার কি? তোমার নিজের মাথায়ই তো এখনও ঠিক হয়নি আবার আমার কথা বলো। এতো কিপ্টামো করো কেনো? মাথায় তো ঔষধ দাও বলে মনে হয় না। মাথায় দাগ পরে গিয়েছে দেখেছো?”

রিধিশা রেগে উঠে গেলো
” আমার মাথায় দাগ পড়ুক বা ময়লা পড়ুক আপনার দেখতে হবে না। নিজের মাথা নিয়ে ভাবুন। শান্তিময় সময়টা অশান্তিপূর্ণ করে দিলো।”
নিশাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো
” বলেছিলাম না এখন সুযোগ পেলেই তোমাকে পানিতে চুবাবো! আমি দয়ালু মানুষ তাই একটু জ্বালিয়ে ছেড়ে দিলাম।” রিধিশা চলে যেতে নিলেই নিশাদ রিধিশার হাত ধরে আটকালো। গাছের ডাল টেনে একটা ফুল ছিড়ে রিধিশার কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বললো
” নাও তোমার ফুল। আমি কারো ধার রাখি না। বাই দ্যা ওয়ে, কালকে কি পড়ে আসবে?”

রিধিশা কোণা চোখে তাকিয়ে বললো
” কলা পাতা পড়ে আসবো।” নিশাদ অবাক হয়ে বললো
” কলা পাতা? ওয়াও ইন্টারেস্টিং। তা কলা পাতার শাড়ি পড়বে নাকি ওই জঙ্গলিদের মতো করে পড়বে?”
” আপনার মাথার মতো করে পড়বো।”
রিধিশা মুখ ফুলিয়ে নিশাদকে বকতে বকতে চলে গেলো।

চলবে…….