কুঁড়েঘর পর্ব-১৫

0
513

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ১৫ ।

ভার্সিটির বট গাছে নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে নিশাদ,
সূর্য আর কিছু ছেলে। রিধিশা সেদিক দিয়ে যাওয়ার সময় নিশাদের দিকে চোখ পড়ে। রিধিশা তাকিয়ে তাকিয়ে চলে গেলো কিন্তু নিশাদ তাকিয়ে আছে এখনও। নিশাদ উঠে দাঁড়াতেই সূর্য বলে উঠে
” কিরে কোথায় যাস?”
” একটু কাজ আছে, আসছি আমি।” নিশাদ রিধিশার পেছন গেলো।
রিধিশা হোস্টেলে ঢুকতে যাচ্ছিলো তখন মিলি এসে সামনে পড়লো।

মিলি রিধিশাকে দেখেই অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়। রিধিশা শক্ত চোখে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই মিলি ডেকে উঠলো তাকে। রিধিশা মিলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিলি তাচ্ছিল্য হেসে বললো
” তোমাদের মতো মেয়ে তো ভালো করেই ছেলেদের নিজেদের পেছনে ঘুরাতে পারো। তা নিশাদ ছাড়া কি আরো ছেলে আছে নাকি নিশাদকেই প্রথম শিকার বানিয়েছো!” রিধিশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” সবাইকে নিজের মতো মনে করো নাকি?” মিলি হেসে বললো
” আমি তোমার মতো না যে, তোমাকে নিজের মতো মনে করবো। কি কি করো সবই আমার খবরই আমার কাছে আসে।” রিধিশা শান্ত গলায় বললো
” যেখান থেকে খবর গুলো আসছে সেখানে গিয়ে আগে Identified করর দেখুন সঠিক খবর দিচ্ছে নাকি ভুল খবর দিচ্ছে। আমি কাউকে নিজের পেছনে ঘুরাচ্ছি না।”
” ঘুরাচ্ছো না তাহলে নিশাদের থেকে দূড়ে যাচ্ছো না কেনো?” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন। আমার পিছু ছাড়ছে না কেনো তিনি।”

রিধিশা তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো। মিলি পেছনে তাকাতেই নিশাদকে দেখতে পায়। নিশাদ কাউকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকেই আসছে। মিলি নিশাদের কাছে যেতেই নিশাদ রাগি চাহনি দিলো। মিলি মন খারাপের চেহারা বানিয়ে বললো
” সরি, নিশাদ। আমার গতকাল রিধিশার সাথে এরকম বিহেভিয়ার করা ঠিক হয়নি। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না প্লিজ!” নিশাদের মন গললো না মিলির কথায় তাও মিলিকে বললো
” it’s okey but next time তোমাকে রিধিশার পাশে আমি দেখতে চাই না। কাউকে কিছু বলার আগে ভেবে বলবে আর না পারলে কথা বলারই দরকার নেই তোমার।”

মিলি মাথা নাড়ায়। নিশাদ আবার ফিরে আসে বটগাছের কাছে। রিধিশাকে পায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছিলো কিন্তু তাকে তো পেলোই না। মিলিও নিশাদের সাথে যেতে যেতে বললো
” আচ্ছা তোমার আর রিধিশার মধ্যে কি কোনো রিলেশন রয়েছে?” নিশাদ হাটা থামিয়ে মিলির দিকে তাকালো। মিলি আমতা আমতা করে বললো
” মানে ক্যাম্পাসের অনেকেই জিজ্ঞেস করে আমাকে তাই জানতে চাইছিলাম আর কি।”
নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” ক্যাম্পাসের কারোর আমার লাইফে মাথা ঘামানোর দরকার নেই তুমি বলে দিও এটা আর তুমি নিজেও মাথায় ঢুকিয়ে নিও। প্রথমত আমি তোমাকে জাস্ট ফ্রেন্ড ছাড়া কিছু মনে করি না। আমাকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখার দুঃসাহস না করা বেটার।”

মিলি কাঁদোকাঁদো গলায় বললো
” But nishad i love you and i want you in my life.”
” মিলি, চাইলেই যদি সব পাওয়া যেতো তাহলে মানুষের জীবনের দুঃখ নামক কিছু থাকতো না। আমি প্রথম থেকে বলে আসছি আমাকে ফ্রেন্ড এর থেকে বেশি অন্য কিছু ভাব্বে না তুমি। দ্বিতীয়ত রিধিশা বা আমি মেলামেশা করছি ভেবে বারবার রিধিশাকে হ্যারাস করছো সেটাও বন্ধ করো। কারণ আমার লাইফ এটা। কখন, কি, কেনো কিছু করবো সব তোমাকে বলবো না আর তোমার কথায়ও করবো না। আমাকে কিছুটা হলেও চিনেছো এতোদিনে।”
মিলি নিশাদের কথা কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বললো
” তারমানে তুমি আমাকে না রিধিশাকে ভালোবাসো?”
মিলির প্রশ্নের উত্তরে না বলতে গিয়েও গলায় আটকে গেলো সেটা। নিশাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
” জানি না তবে এইটুকু জানি তোমাকে ভালোবাসি না আর ভালোবাসা সম্ভবও না।”
নিশাদ হনহন পায়ে বটগাছের নিচে সূর্যদের কাছে গিয়ে বসে পড়লো। মিলি কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলো ভার্সিটি থেকে।

রিধিশা জোতির সাথে মজা করে যাচ্ছে। রিধিশা হাসতে হাসতে বললো
” জোতি! ভাইয়াকে ফোন করে বলে দেই যে, তার বোনকে যতোটা ছোট ভাবছে সে এতো ছোট না। প্রেম করে বেড়াচ্ছে তোমার বোন।” জোতি কাঁদোকাঁদো চেহারা বানিয়ে বললো
” তুই আমাকে এতোবড় বিপদে ফেলবি? তুই না আমার জানু? ভাইয়াকে বললে কি হবে জানিস না? তোকে একটু খেয়াল রাখতে বলেছে বলে কি সত্যি এসব কথা জানাতে হবে?”
রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” না এসব অজুহাত আমাকে দিস না। খেয়াল রাখার দায়িত্ব যখন দিয়েছে তখন রাখতেই হবে। বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে চাই না পরে দেখা যাবে ভাইয়া আমার উপর রেগে গিয়েছে। আমি তো আজ বা কাল বলবোই।”

রিধিশার কথা শুনে জোতি কেঁদে দিলো। রিধিশা সশব্দে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে বললো
” আরে মজা করেছি আমি। ভাইয়া আমাকে কিছু বলেনি।” জোতি কান্না বন্ধ করে মুখ ফুলিয়ে রাখে।
রিধিশার দিকে চোখ পড়তেই ব্যান্ডেজ দেখে আঁতকে বলে উঠে
” কিরে তোর পায়ে গি হয়েছে?” রিধিশা সকালের কথা বললো।
জোতি অবাক হয়ে বললো
” দেখেছিস নিশাদ ভাইয়া কতো ভালো একটা মানুষ? কিন্তু তুই তো সব সময় ঝগড়া করিস ভাইয়ার সাথে।”

রিধিশা মুখ লটকিয়ে বললো
” তো আর কি করবো? উনার জন্য বারবার আমি অপমানিত হই আর উনি নিজেও এসে ঝগড়া করে আমার সাথে।” জোতি বিরক্ত গলায় বললো
” ছাড় ওই মিলির কথা। ওইটা তো আস্ত পাগল একটা মেয়ে। প্রেমের পাগল হলেও এতোটুকু বোঝা উচিত জোড় করে সব পাওয়া যায় না। যাই হোক চল ক্লাসে চল।” রিধিশা আর জোতি ক্লাসের জন্য চলে গেলো।
.
ভার্সিটি ছুটি হওয়ায় রিধিশা প্রতিদিনকার মতো সেই লেকে এসে বসলো। কয়েকটা ফুল এনে পানির কাছে বসে খেলতে থাকে। আজকে আবার কৃষ্ণচূড়া ফুল হয়েছে গাছে তবে অন্য গাছটা খালি। রিধিশা কাঠগোলাপ ফুল গুলো মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে।
খেলতে খেলতে হঠাৎ পানিতে নিশাদের প্রতিচ্ছবি দেখে রিধিশা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে যায়।
নিশাদ চোখ বড় বড় করে বললো
” কি হলো? কি দেখে ভয় পাচ্ছো?” রিধিশা বুকে থু থু দিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বললো
” কি দেখে আবার আপনাকে দেখে! হুট করে ভূতের মতো পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন।”
নিশাদ হা হা করে হেসে বলে উঠে
” আমাকে দেখার জন্য মেয়েরা লাইন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর এই মেয়ে নাকি আমাকে দেখে ভয় পেয়েছে।” রিধিশা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো
” কোথায় আমি তো একদিনও আপনার বাড়ির সামনে লাইন দেখলাম না কখনো।”

নিশাদ তার ঘন কালো চুলে হাত বুলিয়ে বলল
” যেইসেই মেয়েদের নিশাদ পাত্তা দেয় না বুঝেছো? তাই সবাই নিজেদের সম্মান বজায় রাখতে ফোনে চুপি চুপি প্রপোজ করে।” রিধিশা তাচ্ছিল্য ভাবে হাসলো। নিশাদ ভেংচি কেটে বললো
” শোনো তোমাকে এতোকিছু বলার সময় আমার নেই। একদিন প্রমাণ সহ দেখিয়ে দেবো তখন বুঝবে। আচ্ছা বলো পায়ের ব্যাথা কমেছে?” রিধিশা আড়চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো
” কিছুটা কমেছে।” নিশাদ মাথা নেড়ে বললো
” ওকে,খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নেবে তাহলে কমে যাবে।”
রিধিশা চুপ করে বসে রইলো আবার।
নিশাদ মনোযোগ সহকারে রিধিশার দিকে তাকালো। শুকনো শরীরটা আগের তুলনায় আরো শুকনো মনে হলো নিশাদের কাছে। আগে এতো পর্যবেক্ষণ না করলেও রিধিশার মাঝে কিছুটা পার্থক্য এসেছে বোঝা যায়।

নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” শোনো মেয়ে, বেশি বেশি খাবে। তোমাকে দেখলে মনে হয় একটু বাতাস আসলেই উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আর আমার কাছে তো একটা বাচ্চা মেয়ে তুমি। আমার হাতের সাথেই হালকা ধাক্কা লাগলে এই পানিতে পড়ে ডুবাডুবি খেতে থাকবে।” রিধিশা রেগে তাকায় নিশাদের দিকে। রাগি গলায় বললো
” আমি অনেক ভালো সাতার জানি ঠিকাছে? তাই ডুবাডুবি খাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না।”
নিশাদ চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে চলে গেলো।
রিধিশা কিছুক্ষণ পর হা, পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়। টিউশনিতে যেতে হবে আবার সময় হয়ে যাচ্ছে।

____________

সন্ধ্যার পর বাসায় এসেই গোসল করে রান্না বসায় রিধিশা। ঘর ঝাড়ু দিতে দিতে ফোন বেজে উঠে। রিধিশা মায়ের ফোন দেখে রিসিভ করে
” আসসালাম ওয়ালাইকুম, আম্মু। কেমন আছো?”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো তুই কেমন আছিস?”
” আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে।”
লিমা বেগম রেগে বলে উঠলো
” রিধু! প্রতিদিন তোর মুখে এই কথা শুনতে ভালো লাগে না।” রিধিশা হেসে বললো
” আরে রাগ কেনো সত্যি কথাই তো বলি। আচ্ছা কি করো?” লিমা বেগম গলার স্বরে নামিয়ে বললো
” কিছু না। তোকে কিছু বলার ছিলো।”

” হ্যা, বলো!” লিমা বেগম নিচু স্বরে বললো
” তোর বাবা আবারও পাগল হয়ে উঠেছে তোর বিয়ের জন্য। একটা পাত্র ঠিক করেছে। তারা তোকে সামনা সামনি দেখতে চেয়েছে। তোর বাবা তোকে আনতে পারবে না তাই তোর ভার্সিটির ঠিকানা দিয়ে বলেছে তোর সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে।” রিধিশা অবাক গলায় বললো
” আবার? কিন্তু আমার ভার্সিটির ঠিকানা কিভাবে পেলো? তুমি আর খালামনিরা ছাড়া তো কেউ জানে না। কোথায় থাকি বা কোথায় পড়ি আমি।”
লিমা বেগম হতাশ গলায় বললো
” আমার ভুলের জন্যই জেনেছে। তোর বাবা একদিন তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলো আমিও খুশি হয়ে কথায় কথায় ভার্সিটির নাম বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম না তোর বাবা এসবের জন্য জানতে চেয়েছিলো।”

রিধিশা জড়ানো গলায় বললো
” কি করলে তুমি আম্মু? এখন কি করবো আমি যদি লোকটা ভার্সিটিতে এসে আমাকে খোঁজে?”
” দেখ মা কথা হলো তোর বাবা ছেলের বাড়ির লোককে অনেক কিছু বলেছে। তোকে সামনা সামনি দেখতে না পেয়ে অনেক প্রশ্ন করেছে তোর বাবাকে। তোর বাবাও বলেছে তুই পড়াশোনার চাপে একদিনের ভেতর গ্রামে আসতে পারিসনি। তোর বাবা বলেছে তার মান-সম্মান জড়িয়ে আছে এখনও তাই তুই যেনো কোনো উল্টো পাল্টা পদক্ষেপ না নিস।”
রিধিশা বিরক্ত গলায় বললো
” আর কিসের উল্টো পাল্টা? বাবার কি হয়েছে?
ঠিকাছে আমি দেখা করবো তবে বাকিটা আমি জানি না। তবে তুমি বললে আমি না দেখে বিয়েও করে নেবো।”

লিমা বেগম আলতো হেসে বললো
” না আমি চাই না এসব। তোর যদি সেই ছেলেকে
দুজনের একে অপরের যোগ্য মনে হয় তবেই বিয়ে হবে। তোর বাবা তোর স্বাধীনতা কেড়ে নিলেও তোকে আমি স্বাধীনতা দিয়েছি। শুধু ভুল পদক্ষেপ নিস না তাহলে সারাজীবন সেই ভুলের বোঝা টানতে হবে আমাকে। যেমনটা এখন তোর বাবার ভুলের মাশুল টানছি।” রিধিশা অবাক হয়ে বললো
” বাবার ভুলের মাশুল মানে?” লিমা বেগম ঠান্ডা গলায় বললো
” কিছু না। রাতে খেয়ে ঘুমাস। জোয়ান আমাকে ফোন করে বলেছে তুই নাকি কয়েকদিনে শুকিয়ে গিয়েছিস।”
রিধিশা হেসে দেয় জোয়ানের নাম শুনে।
” ভাইয়া তোমাকে ফোন করে আমি শুকিয়ে গিয়েছি বলে?”
” ওমা বলবে না? বেচারা তোর জন্য কতো চিন্তা করে জানিস?”
” হুম তাই মনে হয়।”

চলবে……..