কুয়াশায় ঘেরা পর্ব-০৮

0
133

#কুয়াশায়_ঘেরা
#পর্ব_০৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

আকাশ দেখে বোঝার উপায় নেই সকাল না-কি সন্ধ্যা! ঘন কৃষ্ণ আবর পুরো আকাশ দখলে নিয়েছে। খোলা জানালায় মৃদু বাতাসের ছাঁট এসে ঝুলন্ত পর্দা দুলিয়ে দিচ্ছে।
অফিসে বসেই একে একে চার্ট তৈরি করলো ইলান। কে*স কতটা এগিয়েছে? কোনটা কোনটার সাথে সম্পৃক্ত?

প্রথমত তুর্শির খু*ন। এরপর তার বান্ধবী মনি উধাও। প্রভাতির জঙ্গলে যাওয়া, মনিকে খু*ন হতে দেখা। তুর্শি, মনি দুজনের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে খু*নি একজন ব্যক্তি বলে ধারণা করা হলেও তুর্শি নন-ভার্জিন। মানে দাঁড়ায় এটা খু*নি*র কাজ নয়। এটা তার কাজ হলে দুজন মেয়েকেই সে ইউজ করতো।

তুর্শির রুমে প্রোটেকশন পাওয়া, বিন্দু বিন্দু র*ক্ত। স্বপন মির্জা তুর্শির চাচা, তাহলে ফরহাদ তার চাচাতো ভাই। যেহেতু শারিরীকভাবে অপদস্ত করা মা*র্ডারারের কাজ নয় এবং জাকিয়ার কথায় এটাই প্রমাণ হয় যে, ফরহাদই তুর্শির সাথে ফিজিক্যাল রিলেশনে ছিলো। সন্দেহের তালিকায় তাকে রাখা যায়। এরমধ্যে একজন কালপ্রিট পাওয়া গেলো, সে হচ্ছে ফরহাদ।

দ্বিতীয়ত মাহিনের হুট করেই বাড়ি ফেরা, প্রভাতিকে নিজ থেকেই অফিসে নিয়ে আসতে চাওয়া, শপিংমলে প্রভাতির ওপর আক্র*মণ, মিহানের ঘরে পাসপোর্ট পাওয়া। ভিসা,পাসপোর্টের জন্য এতটাকা পরিবার ছাড়া সে কোথায় পেয়েছে? তার ফোনে “F” অক্ষরে সেইভ করা নাম্বার থেকে কল আসা। সেদিন ইলান ফোন রিসিভ করার পর অপর পাশ থেকে শব্দগুচ্ছ ভেসে আসলো।

-“প্রভাতি মেয়েটার কাজ ক্লোজ। আমাদের সবার ইন্ডিয়া যাওয়ার সব ঠিকঠাক। সবাই মিলে পূর্বের জায়গায় একত্র হবো। তারপর বিডি টু ইন্ডিয়া। ততদিনে কে*স ক্লোজ হয়ে যাবে। এরপর দেশে ফিরবো। আমি সিমটা এখনই ফেলে দেবো। আমাদের বাড়ির সারভেন্ট জাকিয়া মেয়েটাকে বিশ্বাস নেই। যখন-তখন আমার নাম বলে দিতে পারে।”

-“জাকিয়ার আগে তুমিই আমাকে সব ইনফরমেশন দিয়ে দিলে।”

ইলানের কন্ঠস্বর ঠিক চিনে উঠতে পারলোনা ফরহাদ। ফিরতি প্রশ্ন করলো,
-“এই কে আপনি? মাহিনের ফোন আপনার কাছে কেনো?”

-“দুনিয়াকে অল্প সময়ের জন্য ভালোভাবে দেখে নাও।”

ইলানের কথায় কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে ফরহাদ। হুট করে কল ডিসকানেক্ট করে দিলো।

ফরহাদ সিমটি যে তখনি ফেলে দিয়েছে তাতে ইলানের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। জাকিয়া মেয়েটাকেও কল করবেনা। এখন একমাত্র মাহিনই ফরহাদের খোঁজ দিতে পারবে।
তাই মাহিনকেই কব্জা করলো। কলেজ থাকাকালীন একটা ইভটিজিং কে*সে জড়িয়ে পড়ায় ইলান কোনোভাবে মাহিনকে বাঁচিয়ে তার ভার্সিটির উছিলায় দূরে পাঠিয়েছে। দূরে পাঠিয়ে লাভ হয়নি, বরং ক্ষতিই হয়েছে। যা এখন স্বচক্ষে দেখতেও পাচ্ছে ইলান।
বর্তমান কে*সটিতে মনে হচ্ছে মাহিন, ফরহাদ ছাড়াও অন্যকেউ জড়িত আছে।

মাহিনের ব্যাপারে ইলান ছাড়া এখনো কেউ অবগত হয়নি। ব্যাপারটা একা হাতে হ্যান্ডেল করতে হচ্ছে বাবা মায়ের কথা চিন্তা করে। সবাই জানে মাহিন একেবারেই ইন্ডিয়া চলে গিয়েছে। ছেলে অপ*কর্মের সাথে জড়িত জানলে মা নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করে মা*রা যাবে। বাবা হয়তো লজ্জায় বের হতেও ভ*য় পাবেন। অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লো ইলান। যেখানে মাহিনকে রেখেছে সেখানে উপস্থিত হলো। গতকাল থেকে খাবার দূরে থাক, একফোঁটা পানিও দেয়নি মাহিনকে। যে পর্যন্ত মুখ না খুলবে সে পর্যন্ত কিছুই দেবেনা। মাহিনকে চোখ বুজে থাকতে দেখে বোঝা গেলো ঘুমাচ্ছে। যেহেতু মাহিনের কাছ থেকে কথা বের করতে সময় লাগবে তাই কফির ব্যবস্হা করেছে ইলান। হাতের গরম কফি ছুঁ*ড়ে মারলো মাহিনের পিঠে। ধড়ফড় করে উঠতে চাইলো মাহিন, কিন্তু পারলোনা। উপুড় করে তাকে বেঁ*ধে রাখা হয়েছে। পিঠ জ্বলে ছাঁই হয়ে যাচ্ছে। ইলান পাশ থেকে রড হাতে নিলো। একনাগাড়ে রডের আ*ঘাতে আ*ঘাতে র*ক্তা*ক্ত করে নিলো। মাহিনের চিৎকারে কান ভারী হলো ইলানের। ভাইকে মা*রছে বলে কষ্ট তার হচ্ছেনা এমন নয়। কিন্তু অন্যায়ের সাথে আপোস সে করবেনা।
মাহিন এবার নিজের জান ভিক্ষা চাইলো,

-“তোমার পায়ে পড়ি ভাই। আমি সারাজীবন তোমার গোলামি করতে রাজি আছি। আমি বাঁচতে চাই। বলছি আমি ফরহাদ কোথায় আছে।”

হাত থেমে গেলো ইলানের। চেয়ার টে*নে বসলো। মাহিনকে মা*র*তে গিয়ে তার শরীরের ঘাম ছুটেছে। ঘাম ঝেড়ে মাহিনের মুখোমুখি হলো। মাহিন বলা শুরু করলো,

-“বিশ্বাস করো ভাই, মেয়েটার খু*ন আমি করিনি। খু*নের ব্যাপারে ফরহাদ জানে। আমাকে পাঠানো হয়েছে প্রভাতিকে হ্যান্ডেল করার জন্য। আমার কাজ ছিলো প্রভাতিকে নিয়ে যাওয়া, আর তারা আক্রমণ করবে। ঠিক হলোও তাই। প্রভাতি যাতে কোনো ধরনের স্টেটমেন্ট দিতে না পারে সেজন্য ওর গলায় আ*ঘাত করা হয়। ফরহাদ আর আমার সাথের আরেকজন ছিলো তুলন। তারা দুজন সব জানে। খু*নের ব্যাপারে কথা বলতে আমি কিছু কথা শুনে ফেলি। সেখান থেকেই আমি তাদের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে যাই। আমার ইন্ডিয়া যাওয়ার শখ অনেকদিনের, সেটা তুমি জানো। তারা আমাকে বলেছে আমি যাতে তাদের ব্যাপারে মাথা না ঘামাই আর প্রভাতিকে হ্যান্ডেল করি। আমাকে ইন্ডিয়া যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেবে। এর বেশি আমি কিছুই জানিনা।”

ইলান সবকিছু শুনে শান্ত রইলো। কিছু একটা মনে পড়তেই বলল,
-“ফরহাদ এখন কোথায় আছে? আর কোথায় একত্র হওয়ার কথা বলেছে?”

মাহিন বলল,
-“আমি জানিনা ওরা এখন কোথায় আছে? শুধু সবাই ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে ধানমন্ডি একত্র হওয়ার কথা।”

ইলান বলল,
-“ঠিক আছে। ফরহাদ আর তুলনকে না পাওয়া পর্যন্ত তুই এখানেই থাকবি।”

করুন চাহনিতে তাকিয়ে রইলো মাহিন। এতে ইলানের বেশ একটা ভাবাবেগ হলোনা। বেরিয়ে পড়লো নিজ গন্তব্যে। টার্গেট ফরহাদ আর তুলন।

—————————

পড়ন্ত বিকেলের সোনারঙা রোদ্দুরে আটপৌরে শাড়ি শরীরে জড়িয়ে ছাদের এককোনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো প্রভাতি। লালাভ আভায় আকাশের সৌন্দর্য নজর কাড়লো। হুট করেই আজ একটা শাড়ি পড়তে মন চাইলো। ইচ্ছেকে কোনো কালেই দমিয়ে রাখার মেয়ে না ও। মনটা ভার ভার লাগছে। ভাইয়া ইলানের উপর অযাচিত কারণে রে*গে আছে। কথা বলতে পারছেনা বলে ভাইয়াকে বোঝাতেও পারছেনা। আজ নিজেকে সত্যিই ভীষণ অসহায় লাগছে। যারা জন্ম থেকেই কথা বলতে পারেনা, তাদের জীবনটা আজ উপলব্ধি করতে পারছে প্রভাতি। মায়ের মাথা ঠান্ডা হয়েছে। ভাইয়া আজই ভাবীকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। নিজের অসুস্থতা আর ভুলের জন্য মা নিজ থেকেই অনুতপ্ত। মাঝে একবার কেঁদে ফেলে বললেন,
-“আমার মতো ঝা*মেলাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসলেই হয়। শুধু আমার মেয়েটাকে দেখে রাখিস।”

আশরাফুল তখন একহাতে প্রভাতিকে অপর হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
-” তুমি যেমনই হও, তুমি আমার মা। আমাকে জন্ম দিয়েছো। আর এই প্রভা বুড়িটা আমার কলিজার একাংশ। ওর কথা তোমায় বলতে হবেনা।”

এসব কথা মনে করেই প্রভাতির মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। সত্যি সে ভীষণ সৌভাগ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছে। নয়তো ভাই-ভাবীর এমন ভালোবাসা ক’জনে পায়?

প্রভাতির ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে পাশে শব্দ করে দাঁড়ালো ইলান। মলিন হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেমন আছো?”

প্রভাতি মসৃণ হাসলো। মাথা দুপাশে দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। মানে সে ভালো আছে।

-“আমি দুঃখিত! আমার জন্যই হয়তো তোমার সাথে এমন হয়েছে। এরপর আর তুমি না চাইলে কখনোই আমি তোমাকে সঙ্গ দেবোনা।”

ইলানের কথায় হাসিহাসি মুখটি মলিন হয়ে গেলো প্রভাতির। সেদিনের দু*র্ঘটনার পর থেকেই ইলান তাদের বাসায় কম আসছে, কথা কম বলছে। অভিমান থেকেই কি তার কথাগুলো দীর্ঘশ্বাসে রূপ নিয়েছে? প্রভাতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ফেলে হাত নাড়িয়ে বোঝাতে চাইলো “কেনো সঙ্গ দেবেননা?”

ইলান ব্যথিত হৃদয়ে হাসলো।
-“কারণ তুমি আমার সঙ্গ চাও না।”

মাথানিচু করে নিলো প্রভাতি। এবার আর নিজের অনুভূতিগুলো হাতের ইশারায় ব্যক্ত করতে পারলোনা। শুধু চেয়ে রইলো ফ্যালফ্যাল করে। ইলান তার চোখের ভাষা কতটা বুঝতে পেরেছে জানা নেই। এর বেশি বোঝানোর সাধ্য আপাতত তার নেই।

———————

হসপিটাল থেকে ফোন পেয়ে ইলানের বাসায় ছুটে আসলো প্রভাতি। চোখদুটো পানিতে টইটম্বুর। হসপিটাল থেকে ফোন পেয়ে ফিরতি কোনো উত্তর দিতে পারেনি। মাকে ব্যাপারটা জানানোর ক্ষমতা এই মুহূর্তে তার নেই। সেজন্য বাকশক্তি প্রয়োজন। ইলান বাসাতেই ছিলো। বিকেলের পর এখন বের হওয়ার উদ্দেশ্যে দরজা পর্যন্ত এগিয়েছে। প্রভাতিকে হাঁপাতে দেখে ইলান বিচলিত হলো। তীব্র উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে তোমার?”

প্রভাতি কান্নার দমকে কিছু বোঝাতেও পারছেনা। শেষে নোটপ্যাডে টাইপ করে কিছু একটা লিখে ইলানকে দেখালো। চমকে উঠলো ইলান। তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে প্রভাতি ওর শার্ট আঁকড়ে ধরলো। বোঝালো আমিও যাবো। ইলান দ্বিমত করলোনা। প্রভাতির নরম হাতখানা নিজের শক্ত হাতের ভাঁজে নিয়ে ছুটলো। উদ্দেশ্য হসপিটাল।

পথ যেনো শেষ হওয়ার নয়। বি*প*দের সময় কাছের পথও দূরে মনে হয়। প্রভাতি পুরোটা রাস্তা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে গিয়েছে।
হসপিটালে পৌঁছে রিসিপশন ডেস্কে বসা লোকটি থেকে কেবিন নাম্বার জিজ্ঞেস করে প্রভাতিকে সেদিকে নিয়ে গেলো ইলান। কাঙ্ক্ষিত কেবিনের সামনে এসে পা জোড়া থমকে গেলো। হতবিহ্বল চাহনিতে দুর্বল চিত্তে তাকিয়ে রইলো প্রভাতি।

কপালে, হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আশরাফুল। দাঁড়িয়ে রইলো বললে ভুল হবে। প্রচন্ড অস্থিরতা নিয়ে পায়চারি করছে। শরীরের কিছু অংশ ছিলে গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি আ*ঘাত পেয়েছে সাইফা। তার অবস্থা ক্রিটিকাল। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এক্সি*ডেন্ট। এখন পর্যন্ত তার চিকিৎসা চলছে। ভেতরে কি হচ্ছে কিছুই জানা নেই আশরাফুলের। আল্লাহর কাছে এই মুহূর্তে একটাই প্রার্থনা, ‘এই যাত্রায় যেনো তার স্ত্রী-সন্তান বেঁচে যায়’।

#চলবে……