কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা পর্ব-০৬

0
325

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [০৬]
লাবিবা ওয়াহিদ

—————————–
নতুন এক দিনের সূচনা ঘটলো। বেলা গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁইছুঁই। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো নিথি। হাই তুলতে তুলতে আদনকে হাঁক ছাড়লো। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে আদনের কোনো সাড়া শব্দ নেই। নিথি ভ্রু কুচকে রইলো। আদন কী শুনেও না শোনার ভান ধরছে নাকি? বিষয়টা মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হতেই নিথির মুখমন্ডলে রাগী ভাব ফুটে ওঠে। কোনরকমে চুল গুলো খোপা করলো সে। গাল পর্যন্ত চুলগুলো গালের দু’পাশে অবস্থান করছে। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে আসলো। আদনকে হাঁক ছাড়তে ছাড়তে আদনের রুমে ঢুকে পরলো। যেহেতু আজ ছুটির দিন সেহেতু আজ আদন ফ্রী-ই আছে। কিন্তু এভাবে ঢুকে পরাটা যেন নিথির সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিলো। রায়িন বসে আদনকে পড়াচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে নিথির চোখ জোড়া অদ্ভুত ভাবে বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। রায়িন এতক্ষণ আদনকে পড়ার জন্যে বকছিলো। নিথিকে এই বেশে নজরে আসতেই তার কথা থেমে যায়। থমকে নিথির দিকে তাকায় সে। আদন মুখটা ভার করে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে ফিরলো।

এরকম ফ’কি’ন্নি বেশে রায়িনের সামনে এসেছে নিথি? নিথি একবার নিজের দিকে চোখ বুলিয়ে আরেকবার রায়িনের দিকে তাকালো। রায়িনের বেকুব চাহনি তার উপর নিবদ্ধ। নিথির মুহূর্তে-ই চোখ – মুখ লাল হয়ে এলো। সময় ব্যয় না করে এক ছুটে বেরিয়ে এলো। কী লজ্জা, কী লজ্জা। রুমে এসে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজায় পিঠ ঠেকালো নিথি। বুক কাঁপছে তার। ফোঁস ফোঁস করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে সে। গাল জোড়া লাল হয়ে আছে। আবারও উদ্ভট ঘটনা ঘটে গেলো। নিথি দরজায় পিঠ লেপ্টেই ধপ করে বসে পরলো। ভাগ্য এত নিষ্ঠুর কেন? কেন সব আজব আর অনৈতিক ঘটনা প্রিয় পুরুষটির সামনেই হয়? এসবে এই ছেলে পটবে তো দূর, উল্টো এক ছুটে পালাবে। কেমন কান্না কান্না পাচ্ছে তার। নিথি এক দৌড়ে ওয়াশরুমে গেলো নাইট ড্রেস চেঞ্জ করতে। নাইট ড্রেস বলতে হাঁটু অবধি টি-শার্ট এবং প্লাজো। গরমের দিন এগুলোতেই কম্ফোর্ট ফিল করে নিথি।

মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। দরজা অতিক্রম করতেই নিথির শ্রবণ প্রিয় পুরুষটির শক্ত কন্ঠস্বর।
–“আজ যে পড়াগুলো দিলাম সেগুলো ঠিকভাবে কমপ্লিট করে নিবে। সামনে পরীক্ষা আসছে তোমার। এতো অনীহা হলে চলে না আদন। আমি আসছি!”

পায়ের শব্দ কিছু সময় শোনা গেলে আর শোনা যায় না। নিথির বুঝতে বাকি নেই রায়িন বেরিয়ে পরেছে। নিথি দেরী না করে দ্রুত ছুটলো বেলকনিতে। বেলকনির গ্রিলে হাত দিয়ে রায়িনের বের হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। আজ নিথিকে রায়িন পড়াবে না, সে সম্পর্কে তার জানা আছে। কিন্তু আজ হঠাৎ আদনকে কেন পড়াতে এলো তাও সকালবেলা? নিথির ভাবনার মাঝেই রায়িন কানে ফোন লাগিয়ে বেশ ভাবের সাথে বের হলো। নিথি সঙ্গে সঙ্গে বুকের বা পাশে হাত রাখলো,
–“আহ, কিলার লুক! পিছে থেকেই এতটা চমৎকার লাগছে না জানি ইন করা লোকটাকে সামনে থেকে কতটা সুন্দর লাগবে?”

নিথি গভীর দৃষ্টিতে রায়িনের দিকে তাকালো। সোনালী রোদ্দুরে তার গাল আর নাক কেমন গ্লো করছে। রোদে ঠিক ভাবে তাকাতে পারছে না, তাইতো চোখ এবং ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুচকানো।
–“আজ হিরো কী সানগ্লাস আনতে ভুলে গেছে নাকি?”

এর মাঝে রায়িন কথা বলতে বলতে নিথির বারান্দায় তাকায়। নিথি এতে অপ্রস্তুত, বিমূঢ় হয়। ক্ষণিকের জন্যে ভুলে যায় লুকানোর কথা। যখন সম্বিৎ ফিরে তখন নিথি লুকাতে গেলে রায়িন চোখ নামিয়ে হেঁটে চলে যায়। রায়িনের অস্তিত্ব যতক্ষণ না বিলীন হচ্ছে ততক্ষণ নিথি সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়। তবে নিথির মুখশ্রী জুবুথুবু। কেন বারংবার এই একটা মানুষের সামনে নিজেকে সর্বোচ্চ বোকা প্রমাণ করে সে?

নিথি লিভিংরুমে আসলো। আদন তখন আরামসে শারমিন আক্তারের ফোনে গেম খেলছে। নিথি কোনো বাক্য ছাড়াই আদনের মাথায় গাট্টা মারলো। আদন মুখ কুচকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো।
–“কী সমস্যা?”
–“স্যার যে আসবে আগে বললি না কেন?”
–“আমিও জানতাম নাকি আসবে? আম্মু সকালে ঘুম থেকে তুলে বলে স্যার আসবে! পরে স্যার-ই বললো একদিন গ্যাপ দেয়ায় আজকে সেই দিন উশুল করে নিলো!”
–“স্যার তোকে এতো বকে তুই রাগিস না?”
–“স্যার আমাকে একদিন বকলে বাকি তিনশো চৌষট্টি দিন ঠিকই ভালোবাসে। আমি তোমাদের মতো মেয়ে স্বভাবের নই যে একদিনের জন্যে বাকি দিনগুলার কথা ভুলে যাবো!”
–“কী বললি তুই?”

নিথি চোখ রাঙিয়ে কথাটি বলেই আদনের পিঠে এক ঘা বসালো। আদন আর্তনাদ করে দ্রুত সরে যায় এবং পিঠে হাত দিয়ে বলে,
–“আমি গেম খেলি দেখো না? তোমার জন্য আমি ম্যাচ হেরে গেলে তোমার মাথায় পানি ঢালবো! নয়তো স্যারের কাছে বিচার দিবো!”
–“আমিও আম্মুর কাছে বিচার দিবো!”

–“আহ! এই বেলায় কী শুরু করলি তোরা দু’জন?”
নিথি অভিযোগ দিতে মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলো মায়ের চোখ লাল। আদনও লক্ষ্য করলো। মুহূর্তে-ই দু’জন শান্ত-শিষ্ট রূপ নিলো। নিথি করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মায়ের পানে। শারমিন আক্তার ছেলে-মেয়ের হঠাৎ থেমে যাওয়া দেখে দ্রুত নিজেকে সামলালেন। চোখে-মুখে রাগি ভাব এনে বলে,
–“এই, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে তুই নাস্তা খাবি না? আর আদন? তোমাকে বারণ করেছি না যখন তখন গেমস খেলবে না? ফোনটা হ্যাঙ মারে জানোই তো! ফোন রাখো বলছি, নয়তো তোমার গেম আমি ডিলিট করে দিবো!”

আদন ভদ্র ছেলের মতো গেম থেকে বের হয়ে ফোন রেখে দিলো। নিথিও বিনা-বাক্যে খেতে চলে গেলো। মাঝখান দিয়ে শারমিন আক্তারই থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে মনে ভাবলেন, মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া প্রয়োজন।

নিথি রুটিতে কামড় বসাচ্ছে। তার চোখে ভাসছে কিছু সুখকর এবং বিষাক্ত স্মৃতি। হৃধির মনে আছে সে তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। একদিন তার বাবা ম/দ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরেছিলো, তার মা রাগ দেখাতেই খুব মারধর করে। মায়ের হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলো সে। মাকে দেখেছে হসপিটালের বেডে সপ্তাহ খানেক কাঁতরাতে। সময়গুলো নিথি এবং তার ভাইয়ের জন্যে খুবই কঠিন ছিলো। আদন ছিলো সবে দুই বছরের শিশু। সেই দুই বছরের শিশুকে নিথি একা হাতে সামলিয়েছে। আর নিথিকে সামলিয়েছে নিথির দাদীমা। দাদী নিজেই চেয়েছিলো তার ছেলেকে জেলে দিতে। ছেলেকে পাপাচার, জু/ য়া খেলা থেকে বাঁচাতেই মূলত জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, হয়তো ছেলেটা এবার শুধরাবে। ঠিকই শুধরে ছিলো। কয়েকটা বছর বেশ হাসি-খুশিই কেটেছে সব। নিথি এলো তাদের ঘর আলো করে, বছর দশেক পর আদন। হঠাৎ-ই যেন জামাল সাহেব বদলে যেতে লাগলেন। বাড়ি ঠিকমতো আসেন না, শারমিন আক্তারকে পাত্তা দেন না, এমন অহরহ ঘটনা যা বিয়ের আগে ঘটতো। পরবর্তীতে শোনা যায় তিনি পরকিয়াতে লিপ্ত। এখন অবশ্য তিনি নিখোঁজ! কোথায় আছে, কী করছে সে খবর কেউ-ই জানে না। খোঁজ নেই তার দুই সন্তানের। শারমিন সেই থেকে নিজে সংসারের হাল ধরেছে। তখন তাদের এদিকে বেশ ভালো মানের গার্মেন্টস খুলেছিলো, নতুন। শারমিন আক্তার পড়াশোনা জানেন দেখে সেখানেই ঢুকে পরেন। এছাড়াও ওদের পরিবারে ঢাল হয়ে আছে নিথির চাচা এবং মামা’রা!

তাদের পরিবারে একমাত্র নিথির বাবাটা খারাপ হলেও পরিবারটা ভিষণ আদুরে। দাদীমা গত হয়েছেন দু’বছর হলো। বিষাক্ত অতীত ঘাটতে গিয়ে নিথির গলায় খাবার আটকে গেলো। কিছুতেই খাবার গলা দিয়ে নামছে না তার। মা কী করে তার পড়াশোনার খরচ, সংসারের খরচ আবার রায়িন স্যারের খরচ বহন করে? এছাড়া নিথি যে অন্যের দয়ায় চলতে পারে না। তার যে বড্ড আত্মসম্মানবোধ। নিথি খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাকে এখনই বলতে হবে তার জন্যে রায়িনকে রাখার প্রয়োজন নেই। সে নিজেও এখন থেকে টিউশনি করাবে।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।