কৃষ্ণাবতী পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
1980

#কৃষ্ণাবতী
#২৪তম_পর্ব

হঠাৎ মনে হলো দুজন ছেলে তার পিছু নিয়েছে। অন্না সেদিকে যাচ্ছে ছেলেদুটো সেদিকে যাচ্ছে। ছেলেদুটো অন্নার খুব কাছে চলে আসলেই অন্না হাটার গতি বাড়ায়। কিন্তু মরার শাড়ি পড়ে দ্রুত হাটাও যাচ্ছে না। এদিকে ছেলেগুলো ও নিজেদের গতি বাড়ায়। অন্নার বুকে একরাশ ভয় ভিড় করে। আরো দ্রুত হাটতে গেলে শাড়িতে পা টা আটকে যায়। আর অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়তে নেয় অন্না। ভেবেছিলো নাক মুখ বোধহয় গেলো, কিন্তু তখনই একজোড়া বলিষ্ট হাত থাকে শক্ত করে ধরে ফেলে। সেকেন্ড পনেরো ব্যাথার অনুভূতি না হলে চোখ পিটপিট করে খোলে অন্না। না হাত মুখ কিছুই ভাঙ্গে নি, বরং খানিকটা শূন্যে ভেসে রয়েছে সে। মাথাটা তুলতেই মনে শীতল প্রবাহ বয়ে যায় অন্নার। আকাশের শুভ্র চাঁদ হাতে পাবার মতো আনন্দ হচ্ছিলো অন্নার। তার মনমন্দিরের ভগবান যেনো পায়ে হেটে তার কাছে এসেছে। এই একটা সপ্তাহ মানুষটাকে একনজর দেখার জন্য মনটা ঝুকে ছিলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ নয় বরং তার একান্ত প্রিয় ব্যাক্তি, অর্জুন দা। কালো একটি টিশার্ট, কালো থ্রি- কোয়ার্টার প্যান্ট এবং পায়ে বার্মিজের চটি পড়ে রয়েছে সে। হয়তো পাড়ায় কোনো কাজে বেড়িয়েছিলো। চুল গুলো কপালে এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে। অন্য সময় বেশ কায়দা করে চুলগুলো গুছিয়ে রাখে সে। কিন্তু আজ বড্ড এলোমেলো হয়ে রয়েছে চুল, অবশ্য তাতেও যে কারোর বুকের স্পন্দন বাড়াতে যথেষ্ট। অর্জুন পেছনের উপস্থিত ছেলেগুলোর দিকে কড়া অগ্নিদৃষ্টি প্রয়োগ করলো। এই দৃষ্টিটি অর্জুনদার ব্রহ্মাশ্র। যে কেউ দেখলেই গলা শুকিয়ে ফেলবে। ছেলেগুলোর ও একই অবস্থা হলো। ভো দৌড় দিলো তারা। এতক্ষণ অন্না তার বাহুর আলিঙ্গনে ছিলো। ছেলেগুলো চলে যাবার পর খানিকটা ধাক্কা দিয়েই অন্নাকে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো। যেনো কোনো আবর্জনা তার গায়ে লেপ্টে আছে। খুব বিতৃষ্ণার দৃষ্টি প্রয়োগ করে গটগট করে হাটা দেয়। অন্নার মনটা যত তাড়াতাড়ি উচ্ছ্বাসিত হয়েছিলো তত তাড়াতাড়ি মিয়ে গেলো। লোকটা এমন ব্যাবহারটুকু না করলেও পারতো। অন্না তো তার অপরিচিত মানুষ নয়। নিজের উপর ও বেশ রাগ হলো অন্নার। এতো বেহায়া কেনো সে! যে মানুষটার তার অস্তিত্বে কিছুই যায় আসে না। সেই মানুষটাকে নিয়ে সে কাতর হয় কেনো? কেনো এতো ব্যাকুল হয়ে উঠে তার একদর্শনের জন্য! অর্জুন হঠাৎ থেমে ঘাড়টা কাত করে মলিন কন্ঠে বলে,
– নৌকাডুবিতে কবি রমেশের জন্য হেমনলিনীকে অপেক্ষারত রেখেছিলেন। কমলার সাথে বিয়োগের পর ও হেমনলিনীকে রমেশ পেয়েছিলো। কিন্তু আমার জন্য ভগবাণ কোনো হেমনলিনীকে বরাদ্ধ রাখেন নি! তাই আমার যন্ত্রণা কমবার নয়।

বলেই গটগট করে হাটা দেয় অর্জুন। অর্জুনের কথাটা শুনে অন্নার একটা কথাই বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো,
“হেমনলিনী এখনো অপেক্ষারত রয়েছে। কিন্তু আফসোস রমেশের সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই”

চোখগুলো জ্বলছে অন্নার। বোকা মনটা কাঁদতে চাইছে, কেনো! এতো কিসের কষ্ট তার। সে তো আগ থেকেই জানতো এই মানুষটাকে যতই পুজো করো, মানুষটার মনে তার কোনো ঠায় হবে না। তাহলে কেনো! অন্না করুণ চোখে অর্জুনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যতক্ষণ তার অবয়ব দেখা যায় ততক্ষণ। ঐ যে বেহায়া মন!!!

পার্কের বেঞ্চিতে বসে রয়েছে কৃষ্ণা এবং দেবব্রত। পড়ন্ত বিকেলের মৃদু কিরণ আছড়ে পড়ছে কৃষ্ণার মুখে। এই সময়টাকে গোধুলি বলে আক্ষ্যায়িত করা হয়। এই কিরণে সামান্য ধুলিকণাকেও নাকি কাচের কণার মতো লাগে। দেবব্রতের পাশে তো জীবন্ত প্রতিমা বসা। তাকে কোনো অপ্সরার চেয়ে কম লাগছে না। আজকাল দেবব্রতের শুধু কৃষ্ণাকে দেখতে মন চায়। যতই দেখুক না কেনো আরোও দেখতে মনে চায়। কৃষ্ণা আগ্রহী চোখে সামনের উপস্থিত বাচ্চাদের খেলা দেখছে। তার চোখ জোড়া চিকচিক করছে। আর দেবব্রতের চোখ শুধু কৃষ্ণার দিকে। হঠাৎ একটা ছোট মেয়ে এসে বলে,
– সাহেব মালা নিবেন? বেলীফুলের মালা, অনেক গন্ধ
– না নিবো না।
– নেন না সাহেব

দেবব্রত খানিকটা বিরক্ত হলো। তার ফুলের গন্ধে এলার্জি। একদম নিতে পারে না। একটু কড়া কন্ঠে বললো,
– আমাদের লাগবে না, বললাম তো

মেয়েটির মুখটা কালো হয়ে গেলো। কৃষ্ণারও খুব ইচ্ছে ছিলো বেলীফুলের মালা কেনার। তাই ধীর কন্ঠে বললো,
– একটা মালা কিনে নিবেন?
– তোর ভালো লাগে মালাটালা?
– হ্যা, বেলীফুলের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে।

কৃষ্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না দেবব্রত। মেয়েটির হাতে একশত টাকার একখানা নোট ধরিয়ে একটা মালা কিনলো সে। কৃষ্ণা মালাটা হাতে নিয়ে পরম আনন্দে তার গন্ধ নিলো। তার খুব ইচ্ছে ছিলো দেবব্রতের হাতে খোপায় মালাটা পড়বে। কিন্তু তার আগেই দেবব্রত বললো,
– কৃষ্ণা, মালাটা কি ব্যাগে রাখবি একটু। আমার মাথা ব্যাথা করছে। আসলে আমার ফুলের গন্ধে এলার্জি।

দেবব্রতের চোখ লাল হয়ে এসেছে। তার যে খারাপ লাগছে এটা বুঝতে দেরি হলো না কৃষ্ণার। তাই মনের সাধ থাকা স্বত্তেও কোনো কথা বলতে পারে নি সে। মনের কোথাও না কোথাও একটা খারাপ লাগা কাজ কর‍তে লাগলো। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলো না কৃষ্ণা। কৃষ্ণার এই একটা গুণ যা তাকে অনেকের কাছ থেকে তাকে আলাদা করেছে। সে কখনোই নিজের মনের অনুভূতি মুখে প্রকাশ হতে দেয় না। তাই দেবব্রত পাশে থাকা স্বত্তেও বুঝলো না তার কিশোরী বউ এর মনে অজান্তেই খানিকটা চির ধরিয়েছে। জানবেই বা কি করে, এর আগে কখনো প্রেমিকার জন্য বেলীফুলের মালা কিংবা রেশমি চুড়ি কেনা পড়ে নি তার। সৌদামিনীর চাহিদাগুলো এতোটা সাধারণ ছিলো না, এটাই হয়তো ব্যাক্তি বিশেষের পার্থক্য। সূর্যাস্ত হচ্ছে, লাল রক্তিম সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে। দেবব্রতের হাতের মুঠোয় কৃষ্ণার ছোট্ট হাতটি। দেবব্রত আগলে রেখেছে হাতটা। কৃষ্ণার ঠোঁটে মায়াবী হাসি। এই হাসি যেনো দেবব্রতের হৃদয়ের তীরের মতো যেয়ে লাগে। সময়টা থেমে গেলে হয়তো মন্দ হতো না।

রাত ৮টা,
ভট্টাচার্য মঞ্জিল,
নারায়ন বাবু তার কাজের টেবিলে বসে রয়েছে। তিনি বেশ বিরক্তির সাথে কাগজ পত্র ঘাটছেন। আজকাল বাসায় সোমনাথের মেয়েকে যে আদিক্ষেতা শুরু হয়েছে সেটা তার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু তিনি বলবেন ই বা কাকে! নিজের স্ত্রীকে, বাবাকে নাকি নিজের ছেলেকে। সে তো আবার সেই মেয়েকে সমাজের সামনে দ্বিতীয়বার মেয়েটিকে বিয়ে করবে। তার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বন্ধুদের সামনে নিজের বড়াই করার জায়গাটুকু তিনি খোয়াতে বসেছেন। কি বলবেন তার ছেলের বউ এর না আছে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা আর না আছে কোনো অভিজাত্য বংশ পরিচয়। তিনি তাই আজ ছেলেকে ডেকে পাঠিয়েছেন। দেবব্রতের সাথে সামনাসামনি কথা বলাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ দরজায় কড়া পড়লে ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে নারায়ন বাবুর। তখন শুনতে পান
– বাবা আসবো?

দেবব্রতের প্রশ্নে গলা খাকারি দিয়ে তিনি বলেন,
– আসো, বসো
– আমাকে ডেকেছিলেন? খুব জরুরি কিছু কি?
– শুনলাম তুমি নাকি কৃষ্ণাকে পুনরায় বিয়ে করবে?
– জ্বী ঠিক শুনেছেন। এক বছর পর ও অনার্সে ভর্তি হবে। ভেবেছি এর পর ই বিয়ের আয়োজনটা করবো।
– তুমি কি মেয়েটাকে নিজ স্ত্রী হিসেবে মেনে নিচ্ছো?

নারায়ন বাবুর কথায় খানিকটা নড়ে চড়ে বসে দেব। তার বুঝতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছে বাবার কথার অন্তমর্ম। তাই নম্র কন্ঠে বলে,
– বাবা একটু খোলসা করবেন কি?
– আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিবে কি? একটা গেয়ো মেয়ে কি সত্যি তোমার পাশে যায় দেবব্রত? যদি কেউ কখনো তার বংশ পরিচয় কিংবা বাবা-মার পরিচয় বিয়ে প্রশ্ন করে উত্তর দিতে পারবে তো? এই প্রশ্নের সম্মুখীন তোমাকে বহুবার হতে হবে। তোমার মতো উচ্চশিক্ষিত ছেলের সাথে বা আমাদের পরিবারের সাথে মেয়েটা কি আদৌ ও যায়?

নারায়ন বাবুর প্রশ্নে দেবব্রতের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে যায়। তারপর……..

চলবে

#কৃষ্ণাবতী
#২৫তম_পর্ব

নারায়ন বাবুর প্রশ্নে দেবব্রতের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে যায়। তারপর সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিজের বাবার চিন্তা ভাবনা এতোটা নিচ সেটা আজ অনুভব করতে পারছে। ঠোঁটের কোনে মলিন হাসি একে ধীর কন্ঠে বলে,
– বাবা, আপনি ঠিক বলেছেন কৃষ্ণার জন্মপরিচয় বেশ ধোঁয়াশা। সে গ্রামে মানুষ, তার বাবা কোথায় কিংবা কে এই বিষয়টা কৃষ্ণা নিজেও জানে না। ভাট্টাচার্য পরিবারে সে আসলেই বেশ বেমানান। আমি আপনার সাথে একমত।

দেবব্রতের কথাশুনে নারায়ন বাবুর মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠে। ছেলেকে শুধু যে দু তিন বাক্যে এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়ে পারবেন ব্যাপারটা ভেবে বেশ মনে আত্নতৃপ্তি হচ্ছে। কিন্তু সেই আত্নতৃপ্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে নি। পরমূহুর্তেই ছেলের মুখে এমন একটি প্রশ্ন শুনতে পায় যা তার ভেতরের কাপুরুষটাকে আয়না দেখাতে সক্ষম ছিলো। দেবব্রত কোনোদিন বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করে নি। তাই আজও পারলো না। তবে নম্র ভাবে কথাটা না বলেও থাকতে পারলো না সে,
– তবে বাবা, আজ কৃষ্ণার এই পরিস্থিতির জন্য কি আমরা দায়ী নই? আজ কেনো তার বাবা থাকা স্বত্তেও তার বাবা তার কাছে নেই, তিনি কোথায় সে আছে তার কোনো খোঁজ আমাদের কাছে নেই এই সকল কিছুর জন্য কি এই ভট্টাচার্য মঞ্জিল দায়ী নয়! আমি যদি কখনো জানতাম সে আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য সোমনাথ কাকাকে এতো বড় বলিদান দিতে হবে আমি সত্যি ই বাঁচতে চাইতাম না। আপনাকে আমি খুব সম্মান করতাম, ভাবতাম আপনি একজন আদর্শ পিতা, আদর্শ স্বামী হবার সাথে সাথে একজন আদর্শ মানুষ। তবে আজ আমার ধারণা পুরোপুরি ভেঙ্গে গিয়েছে। আপনি নিতান্ত স্বার্থপর, কাপুরুষ প্রজাতির মানুষ। আজ আমার জীবন্ত থাকার জন্য আমার আফসোস হচ্ছে। আজ আমার বাবার স্বার্থপরতার জন্য এক নিষ্পাপ ফুল তার পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি হয়তো কৃষ্ণার পরিচয় পেয়ে খানিকটা হলেও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাবেন, কিন্তু ব্যাপারটা তেমন ঘটলো না। আমার আর এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। শ্বাসে বিঘ্ন হচ্ছে।

বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে নেয় দেবব্রত। নারায়ন বাবু তখন ও মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছেন। তার ছেলের মুখে এরুপ আচারণ যেনো তার কখনোই কাম্য ছিলো না। কাঁপা কন্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলেন,
– তুমি জানো?

তার প্রশ্নে দেবব্রতের পা জোড়া থেমে যায়। নারায়ন বাবুর দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
– আমার স্ত্রীর অতীতের বিষয়ে জানাটা স্বামী হিসেবে আমার কর্তব্য ছিলো। কিন্তু কখনোই আপনাকে সেটা বুঝতে দেয় নি। কারণ আমি চাই নি আপনার মনে কোনো রকম গ্লানি তৈরি হোক। চিন্তা করবেন না কৃষ্ণাও তার অতীত সম্পর্কে জানে না। আমি চাই না, তার সামনে আপনি মাথা নিচু করে বাস করেন। যতই হোক বাবা আপনি আমার। আর একটা কথা, একদিন কৃষ্ণাকে নিয়ে আপনার গর্ভ হবে। এই কথাটা আমি দাবি করে বলে গেলাম। তাকে আমি এমনভাবেই গড়বো যাতে কেউ তার অতীত ঘাটবে না। এতে অবশ্য আপনারই লাভ হবে। যদি আমার কোনো কথায় আপনার মনে চোট লাগে তাহলে ক্ষমা করবেন।

বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে দেবব্রত। বাবার আচরণে আজ মনটা বেশ ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়েছে। পা জোড়া চলতে চাইছে না। রুমে যেয়েই দেখে বই খাতা নিয়ে তার কিশোরী বউ খাটের উপর বসে রয়েছে। তাকে দেখতেই তার কাছে এগিয়ে আসে। দেবব্রতের মুখখানা বেশ মলিন ঠেকলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনার কি খারাপ লাগছে।
– নাহ, একটু টায়ার্ড লাগছে

ম্লান হাসি দিয়ে দেবব্রত কথাটা বলে। দেবব্রতের কথা শুনে কৃষ্ণা কিছু একটা ভাবে। তারপর ধীর কন্ঠে বলে,
– তাহলে আমি যাই, আপনি আরাম করুন

বলেই বই খাতা গুছাতে লাগে কৃষ্ণা। কৃষ্ণার হন্তদন্ত হয়ে বই খাতা গুছাতে দেখে দেবব্রত কৌতুহলী কন্ঠে বলে,
– কোথায় যাচ্ছিস?
– রুমে, আসলে ক্যামিস্ট্রি বুঝতে এসেছিলাম। অধ্যায়টা খুব কঠিন। তাই আসা, সমস্যা নেই পরে বুঝে নিবো।

কথাটা বলেই বইখাতা নিয়ে চলে যেতে নেয় কৃষ্ণা। তখনই দেবব্রত নির্বিকারভাবেই বলে উঠে,
– এই রুমে থাকা যায় না?

কথাটা শুনেই পা জোড়া আটকে যায় কৃষ্ণার। এই চারমাসে প্রথম দেবব্রত তাকে এই রুমে থাকতে বলছে। ব্যাপারটা তার কাছে খুব অবাককর। হা করে দেবব্রতের দিকে তাকিয়ে থাকলে দেবব্রত একটু এগিয়ে তার কাছে আসে। ধীর কন্ঠে বলে,
– আজ থেকে আমার কাছে থেকে যা। এক মূহুর্ত শত বছরের লাগে আমার কাছে।
– হঠাৎ, এমনটা তো কথা ছিলো না।
– জানি কিন্তু একটা বছর যে আমার কাছে অনেক। আজ অপেক্ষার বাধ আমি ভেঙ্গে ফেলতে চাই।

দু হাতে কৃষ্ণার মুখটা আদলে ধরে দেবব্রত। কৃষ্ণার চোখজোড়া ছলছল করছে। অবশেষে স্বামীর ঘরে তার ঠায় হলো। দেবব্রত তার মুখটা টেনে চোখ জোড়ায় উষ্ণ ঠোঁট ছুয়ে দেয়। কৃষ্ণার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
– আমাকে ক্ষমা করে দিস, এতোটা মাস তোকে অপেক্ষা করিয়েছি৷ তোর চলার পথটা কঠিন জেনেও তোর পাশে ছিলাম না। তবে কথা দিচ্ছি, তোর চলার পথে আমাকে চিরকাল পাবি তুই৷ বন্ধু হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে, স্বামী হিসেবে

কৃষ্ণা দেবব্রতের হাতটা ধরে তাকে বিছানায় বসায়। দেবব্রত তখন অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কৃষ্ণা তার মুখটা তার কোমল হাতে আলতো করে ধরে। শান্ত কন্ঠে বলে,
– বাবামশাই বুঝি কিছু বলেছে?
– তুই জানলি কিভাবে?
– অর্ধাঙ্গিনী হয়ে এটুকু জানবো না? আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে এ বাড়ির প্রতিটি মানুষের মনোইচ্ছা পূরণ করবো। কথা দিলাম

দেবব্রত কোনো কথা না বলে কৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরলো। কৃষ্ণার বুকে মুখ গুজে ধীর কন্ঠে বললো,
– তোকে একটা কথা জানানোর ছিলো। এমন হতেই পারে কথাটা শোনার পর আমাকে তোর দোষী মনে হবে। আমার পরিবারকে অপরাধী। তবে কথাটা আমার বুকে কাটার মতো বিধে আছে।
– আমাকে কোনো কথা বলতে বুঝি ইতস্তত বোধ হয় আপনার?

দেবব্রত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই দীর্ঘশ্বাসে তার বুকের আক্ষেপের উপস্থিতি স্পষ্ট। কৃষ্ণাকে তার পাসে বসিয়ে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে৷ অতীতের কণ্টককীর্ণ সত্যি গুলো ধীরে ধীরে কৃষ্ণার সামনে তুলে ধরে। যখন দেবব্রতের কথা শেষ হয় তখন কৃষ্ণার দিকে খেয়াল করলে দেখে কৃষ্ণা স্তব্ধ। কৃষ্ণার মুখে কোনো কথা নেই। শুধু চোখজোড়া ভিজে আছে। অস্পষ্ট স্বরে শুধু একটা কথাই বলে,
– আমার বাবা আমাদের ফেলে যান নি।

দেবব্রত ও চুপ করে বসে থাকে। ঘরে পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ভাঙ্গলেই বুঝি আতর্নাদের গুঞ্জন শুনবে দেয়ালগুলো। সেই অপেক্ষায় আছে ঘরের দেয়ালগুলো____________

২০.
কলেজ গেটের বটতলায় বসে রয়েছে অর্জুন। প্রথম সেমিষ্টারের পরীক্ষা সামনে, বহুদিন প্রেমে ছ্যাকা খাওয়া দেবদাসের মতো বাড়ি পড়েছিলো। কিন্তু আর সেই বাহানা দিলে চলবে না। সামনে সদূর ভবিষ্যত পড়ে রয়েছে তার। সুতরাং এখন কৃষ্ণার বেদনায় রাত্রী যাপন করলে চলবে না। এই বটতলা তার আড্ডার জায়গা। বন্ধু, জুনিয়র এখানেই আড্ডা দেয়। আজ একমাস পর অর্জুন এসেছে কলেজে। তাই তাকে ঘিরেই আড্ডার আসর বসেছে। অর্জুনের ছ্যাকা খাবার কথা সবার অবগত। তাই সেই বিষয় এড়িয়েই সবাই কথা বলছে। হাতে ধোয়া উঠা চা, যদিও ফাগুনের মাস তবুও ঠান্ডার কিছুটা আভা আছেই। অর্জুন বিশেষ চাখোরদের একজন। প্রেমে বিরহের পর তা দ্বিগুন হয়ে গেছে। এই নিতে চার নম্বর কাপ তার। হঠাৎ খেয়াল করলো কলেজ গেট দিয়ে অন্না এবং কৃষ্ণা প্রবেশ করছে। কৃষ্ণাকে দেখে বুকে যেনো রক্তক্ষরণ শুরু হলো অর্জুনের৷ সে জানে আপাতত দেড়টা বছর এই কষ্ট তাকে তাড়া করে বেড়োবে৷ মাস্টার্সটা শেষ হলে হয়তো কখনোই কৃষ্ণার মুখটা দেখতে হবে না। চোখ জোড়া সরিয়ে নিলো সে। তার মনোযোগ এখন চায়ের কাপে। অন্যের বউকে দেখে হৃদয় কাঁদিয়ে কি লাভ!! হঠাৎ পাশে থাকা অর্জুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয়ন্ত বলে উঠলো,
– যাই বল তাই বল, আজকাল অন্নাকে আমার আর ছোট টি লাগে না। ফাগুনের দিন কি অপূর্ব না লাগছিলো। মেয়েটিকে
দেখে মনেই হচ্ছিলো সে ওই দুপাশে ঝুটি করা চশমা পড়া বাচ্চা মেয়ে। আমার তো আজকাল অন্নাকে দেখলে প্রেম প্রেম পায়। বয়স তো কম হলো না। এবার নাহয় প্রেম টা করেই ফেলি। কি বল?
– একদম ঠিক দাদা

সব জুনিয়ররা সম্মতি পোষন করলো। অর্জুনের মেজাজটা হুট করেই খারাপ হয়ে গেলো। কড়া কন্ঠে বলে উঠলো,
– থামবি তোরা? আজাইরা কথা সারাক্ষণ

বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। সবাই তাকে বাধা দিতে চাইলেও কিছুই হলো না। গটগট করে হেটে জায়গাটা প্রস্থান করলো সে। সবাই ভাবলো হয়তো ক্ষত জায়গায় আঘাত লেগেছে। ভাবছে প্রেম নামক শব্দে বিরক্ত লেগে গেছে তার। লাইব্রেরিতে এসেও রাগ কমলো না অর্জুনের। অর্জুন নিজেও জানে না তার কেনো বিরক্ত লাগলো। অন্নাকে নিয়ে জয়ন্তের উক্তি তার পছন্দ হয় নি। যদিও অন্নাকে সেদিন সত্যি অনেক সুন্দর লাগছিলো। মেয়েটাকে নারী নারী লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো কোনো উপন্যাসের নারী চরিত্র। কিন্তু তবুও মেয়েটির সাথে জয়ন্তকে তার ভালো লাগছে না। মেজাজটা অন্নার ও খুব খারাপ হচ্ছে অর্জুনের, কি দরকার ছিলো এতো সেজেগুজে কলেজে আসার৷ আজ কি সুন্দর একটা লাল পাঞ্জাবী এবং জিন্স পড়ে এসেছে, চুলগুলো দুপাশে ঝুটি করা৷ কি সুন্দর কিশোরী লাগছে। গালটা টেনে দিলেও খারাপ হতো না। এই বাচ্চা মেয়েটাকে বাচ্চাই বাচ্চাই ভালো লাগে৷ হঠাৎ অর্জুনের ভাবনার ছেদ পড়ে। সে বিগত ঘন্টাখানিক যাবৎ এক নাগারে শুধু অন্নাকে নিয়েই ভেবেছে। যে ভাবনার মাঝে শুধু অন্নাই ছিলো। তার সামনে বই রয়েছে, তবুও তার চিন্তা বই এ নেই। নিজেকে বেশ কড়া করে শাসন করলো অর্জুন। সেদিনের পর থেকে অন্নাকে কেনো যেনো আর আগের মতো লাগছে না অর্জুনের কাছে। ব্যাপারটা বিরক্তিকর। খুবই বিরক্তিকর। বইটা বন্ধ করে বুকসেল্ফের কাছে গেলো অর্জুন। বিষয় বদলালে হয়তো চিন্তাটা বদলাবে। হঠাৎ………

চলবে

#কৃষ্ণাবতী
#২৬তম_পর্ব

সেদিনের পর থেকে অন্নাকে কেনো যেনো আর আগের মতো লাগছে না অর্জুনের কাছে। ব্যাপারটা বিরক্তিকর। খুবই বিরক্তিকর। বইটা বন্ধ করে বুকসেল্ফের কাছে গেলো অর্জুন। বিষয় বদলালে হয়তো চিন্তাটা বদলাবে। হঠাৎ কারোর সাথে ধাক্কা লাগলে অর্জুনের হাতে থাকা বই টি পড়ে যায়। সামনের মানুষের হাতেও কিছু বই ছিলো। সেগুলো পড়ে গেলো। তুলে দিতে গিয়ে খেয়াল করলো সামনে থাকা মানুষটি অন্য কেউ নয় বরং তার হৃদয়ের ক্ষত কৃষ্ণাবতী। সেদিনের পর থেকে কৃষ্ণাকে অনেকটা এড়িয়ে চলছিলো সে। কিন্তু এভাবে সামনে এসে উপস্থিত হবে বুঝে উঠতে পারে নি। বই গুলো কোশনো মতে তার হাতে ধরিয়ে উঠে চলে যেতে নিলে পিছু ডাকে কৃষ্ণা।
– অর্জুন দা?

কৃষ্ণার ডাকে অর্জুনের পা জোড়া থেমে যায়। জোর পূর্বক মুখে হাসি টেনে পেছনে ফিরে বলে,
– কিছু বলবে?
– আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো
– বলো
– আপনি আমায় ক্ষমা করেছেন তো?

কৃষ্ণার নম্র স্বরে করা প্রশ্নটি অর্জুনের হৃদয়ে তীরের মতো লাগে। কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলো না। বুক থেকে অচিরেই একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অর্জুনের চোখ কৃষ্ণার দিকে, মেয়েটিকে দোষারোপ করাটা তার জন্য নিতান্ত বোকামি হবে। সে তো ইচ্ছে করে তাকে ঠকায় নি। শুধু ভাগ্য তার জন্য এই মেয়েটিকে বরাদ্ধ করে রাখে নি। কৃষ্ণার অপরাধী মুখটা তার দেখতে ভালো লাগছে না। মুখটা ফিরিয়ে শক্ত গলায় বললো,
– যা আমার নয় তা নিয়ে আক্ষেপ করাটা আমার স্বভাবে নেই। ভালোবেসেছিলাম এটা ঠিক, কিন্তু তা কেবল এক পাক্ষিক। তুমি চিন্তা করো না। একটা সময় ঠিক সামলে নিতে পারবো। আর ক্ষমা, তোমার উপর তো আমার রাগ ছিলো না। তাহলে ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কোথায়! অহেতুক ব্যাপারগুলো নিয়ে চিন্তা করো না।
– শুনে ভালো লাগলো, আমিও চাই আপনি সামলে নেন। আর একটা কথা, আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। এমন অনেকে আছে যাদের চিন্তাধারা আপনাকে কেন্দ্র করে ঘুরে। অবহেলায় তাদের হারাবেন না। আসি অর্জুনদা৷

কৃষ্ণা বই গুলো শক্ত হাতে ধরে তার গন্তব্যের দিকে হাটা ধরলো। অর্জুন তার যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। শুভাকাঙ্ক্ষী বলতে কাকে বুঝিয়েছে কৃষ্ণা? যাওতার আগের কথাগুলো বেশ ভাবাচ্ছে অর্জুনকে। ভাবনার ফাকে একটি নাম মস্তিষ্ক লাল অক্ষরে বড় করে দেখাতে লাগলো। “অন্না”। অর্জুনের শুভাকাঙ্ক্ষী কি হবে অন্না! কৃষ্ণা কি তাকে অবহেলায় না হারানোর কথা বলে গেলো! কে জানে!

২১.
সময় বহমান, সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। জুলাই এর প্রথম সপ্তাহ। বৃষ্টির মৌশুম শুরু হয়েছে। একবার বর্ষণ শুরু হলে আর থামতে চায় না। যেমন এখনো একাধারে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণা। শাড়ির আঁচল গড়াচ্ছে। বৃষ্টির ঝাপটা চোখে মুখে পড়ছে তার। অতীতের স্মৃতি চোখে ভাসছে কৃষ্ণার। দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর কেটে গেছে। কৃষ্ণা এবং অন্না এখন অনার্সের ছাত্রী। বিগত পাঁচ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে ভট্টাচার্য মঞ্জিলে। প্রদীপ বাবু পরলোকগমন করেছেন। নারায়ন বাবুর কৃষ্ণার প্রতি চিন্তাধারাটা অনেক বদলেছে। কৃষ্ণার সাথে তিনি খারাপ ব্যবহার করেন না। কৃষ্ণাও তার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই আচারণ করে। যাতে তিনি কোনোভাবেই অপ্রস্তুত না হয়। এখন নারায়ন বাবুর তার পুত্রবধুকে তিনি গর্ব ও হয়। কৃষ্ণা তার মেধার দ্বারা খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলো উচ্চ মাধ্যমিকে। এখনো তার রেজাল্ট বেশ ভালোই রয়েছে। দেবব্রতের ইচ্ছে তার কৃষ্ণাকে উচ্চ শিক্ষিত করতে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে সকলভাবে সহায়তা করছে সে। দেবব্রত না থাকলে হয়তো এই পর্যন্ত আসাই হতো না কৃষ্ণার। ভাবতেই অবাক লাগে কৃষ্ণার, এই ভট্টাচার্য মঞ্জিলে দেখতে দেখতে তার সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেছে। বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছর। সময়টা কম নয়, তবে কিছু জিনিস চাইলেও বদলাতে পারছে না কৃষ্ণা। বিয়ের এতোটা বছর হয়ে যাবার পরও তার কোলে এখনো কোনো বাচ্চা আসে নি। অবন্তীকা দেবীর আক্ষেপের শেষ নেই৷ এই তো সেদিন তার প্রতিবেশী দু-তিন জন মহিলা বাসায় এসেছিলো। তাদের আদর যত্নের কোনো কমতি রাখে নি কৃষ্ণা। কিন্তু কথায় কথায় তারা অবন্তীকা দেবীকে বলেন,
– বৌদি কোনো সুখবর কি আছে?
– সুখবর বলতে?
– ছেলের বিয়ে তো কম বছর হলো না। ছেলের বয়স এখন একত্রিশে পড়েছে। এখন বাচ্চা না নিলে হবে কিভাবে?
– আসলে কৃষ্ণা তো এখন পড়াশুনা করছে তাই আর কি!
– আরে বৌদি রাখেন তো, মেয়ে মানুষের এতো পড়াশোনা দিয়ে কি হবে? ছেলেতো কম কামাই করে না। সে তো আর বাহিরে কামাবে না। তাহলে! নাকি বউ মা আপনার বাচ্চা দেবার ই ক্ষমতা নেই!

বলেই তারা টিটকারিমূলক হাসাহাসি শুরু করলেন। সেদিন অবন্তীকা দেবী কোনো কথা বলতে পারেন নি। এরপর থেকেই কৃষ্ণার উপর খানিকটা গোসা তিনি। তারও বয়স হয়েছে৷ নাতি-নাতনিদের মুখ তার ও দেখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু দেবব্রতের সামনে কিছুই বলতে পারেন না। তার যা রাগ। তাই কৃষ্ণার সাথেই তার যত চোটপাট। যখন তখন কৃষ্ণার সাথে চেচামেচি করবেন। নয়তো তার সাথে কোনো কথাই বলবেন না। এই বছরের শেষে কৃষ্ণার অনার্সও শেষ হবে। তাহলে এখন বাচ্চা নিতে কি সমস্যা। কৃষ্ণার শাশুড়ী মায়ের এরুপ বিরুপ আচারণের কারণটা যে অজানা তা কিন্তু নয়। অথচ তার কিছুই করার নেই৷ বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছর হলেও তাদের মাঝে এখনো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা সকল স্বামী স্ত্রীর মতো নয়। দেবব্রত কৃষ্ণার পুরোপুরি গড়ে ওঠার অপেক্ষায় নিজেকে অনেক সংযত করে রেখেছে। বাচ্চাকাচ্চা এখন অহেতুক লাগছে তার কাছে। কৃষ্ণার মনোযোগ যেনো শুধুমাত্র লেখাপড়ায় থাকে সেটাই তার ইচ্ছে। মুখফুটে কৃষ্ণাও কিছু বলতে পারে না। মেয়েমানুষ কি মুখ ফুটে বলাটা শোভা পায়! বৃষ্টি হচ্ছে, কৃষ্ণা হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি ছোয়ার তালে আছে। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরেছে। পেছনে না ফিরেও বলতে পারবে লোকটি কে। দেবব্রত তার কোমড় জড়িয়ে মাথায় মুখ ঠেকালো। ধীর কন্ঠে বললো,
– কি হইছে? বৃষ্টিবিলাশ করা হচ্ছে বুঝি?
– বৃষ্টিবিলাশ বললে ভুল হবে, আকাশের সাথে কথা ভাগ করে নিচ্ছিলাম
– আমাকে বলা যাবে না সেসব কথা?
– তোমার কি সে সময়টা হবে?
– একিরকম কথা? আমার কিশোরী বউটির জন্যই তো আমার সারাটা সময়।

টাইটা ঢিলে করতে করতে দেবব্রত বললো। দেবব্রতের কথা শুনে ম্লান হাসি হাসে কৃষ্ণা।
– কফি খাবে?
– উহু তুই যাস না, ফ্রেশ হয়ে আমি করে আনছি। তুই আমার পাশে বয়।
– আমি এখন পড়তে বসবো না, ভালো লাগছে না এখন।
– আমি বুঝি তোকে শুধু পড়াবার সময় পাশে বসাই!
– ভুল তো কিছু বলি নি।

কৃষ্ণার নির্লিপ্তভাবে বলা কথায় দেবব্রত কোনো উত্তর দিতে পারে নি। এটাই যে সত্যি। কিন্তু দেবব্রত যে নিরুপায়। বাবার সাথে দেওয়া বাজিতে যে তার জিততে হবে। সে কৃষ্ণাবতীকে এমন পর্যায়ে দেখতে চায় যেখানে তার জন্মপরিচয় কিংবা পিতৃপরিচয় নিয়ে কেউ কোনো কথা না বলতে পারে। সেও চায় বাকি দম্পতির মতো স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটাতে কিন্তু এখন যে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। কৃষ্ণার রেজাল্ট খুব ভালো, তার স্কোলারশিপ পাবার সম্ভাবনা অনেক। সুতরাং এখন কোনোভাবেই লক্ষ্যচ্যুত হওয়া চলবে না কৃষ্ণার। বুকে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে দেবব্রতের। ধীর কন্ঠে বলে,
– কারণটা তো তোর অজানা নয়। আচ্ছা মা কি আজকেও কোনো কান্ড করেছেন?
– না, আজকাল তিনি আমার সাথে কথা বলেন না। আচ্ছা মাষ্টারমশাই আমরা কি একটা বাচ্চা নেবার কথা ভাবতে পারি না?

কৃষ্ণার আকুতিময় কন্ঠ দেবব্রতের ভেতরটাকে ঝাঝরা করে ফেলছে। কিন্তু তার কিছু করার নেই। উঠে দাঁড়িয়ে কড়া কন্ঠে বলে,
– প্রতিদিন এক ঘ্যানঘ্যান আমার ভালো লাগে না কৃষ্ণা। তুই বাচ্চা নস, প্রতিদিন কেনো এক কথা বুঝানো লাগে তোকে। আমি এখন কোনো বাচ্চা চাচ্ছি না। বাচ্চা নেবার সময় কি শেষ হয়ে যাচ্ছে? এই বাচ্চামি গুলো আমার কিন্তু বিতৃষ্ণা লাগে।

বলেই গটগট করে হেটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো দেবব্রত। পেছনে ফিরলে হয়তো দেখতে পেতো তার কিশোরী বউটির চোখ ছলছল করছে। কৃষ্ণা সেই ছলছল নয়নেই দেবব্রতের দিকে তাকিয়ে থাকলো, লোকটার কাছে তার চাহিদাগুলো কেবলই বাচ্চামি মনে হয়। কৃষ্ণার চোখ থেকে অশ্রুগুলো মুক্তি পেলো আক্ষেপের রুপে______

বৃষ্টির মাঝে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে অন্না। অপেক্ষার প্রহর মোটেই কাটতে চাচ্ছে না তার৷ এই একটা মানুষের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত সে। পায়জামার নিচ অবধি ভিজে গেছে। প্রায় ঘন্টা হতে গেলো সে অপেক্ষা করে রয়েছে। আজকাল তার জীবনেও কেউ এসেছে তার জন্য তার রাতগুলো স্বপ্নবহর হয়। অতীতের বেদনা গুলো সব ভুলে গিয়েছে এই পাঁচটা বছরে। কিশোরী মনের সেই ভালোবাসাটাকে তার কিশোরী মনের আবেগ বলে মনে হয়। সেই সব স্মৃতি এখন কেবলই স্মৃতি। তার জীবনের বর্তমান লোকটি অতীতের সকল কন্টকময় স্মৃতিগুলোকে স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ রেখেছে। অন্নার বর্তমানটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে সে। অন্নার চিন্তাধারায় এখন আর অতীতের অর্জুনদা নেই। এসব শুধু সেই লোকের অবদান। এখনো লোকটা আসে নি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অন্না। তখনই একটি বাইক এসে তার সামনে ব্রেক মারলো। বাইকে একজন লোক কালো হেলমেট এবং রেইনকোট পড়া। অন্না চোখ কুচকে তাকিয়ে আছে। এরপর সামনে হাটা ধরলো। বাইকের লোকটি বাইক নিয়ে তার পেছন পেছন ছুটলো। অন্না এবার থেমে বললো,
– কি সমস্যা?
– কোনো সমস্যা নেই
– তবে?
– রোডে চলা কি অপরাধ?
– তা অপরাধ নয়, কিন্তু আমার পিছু নেওয়া অপরাধ। আমার পিছু নিচ্ছেন কেনো?

এবার লোকটা তার হেলমেট খুললো। মুখে সেই ভুবন ভুলানো হাসি, সে হাসি অন্নার বুকে তীরে মত লাগে। এই হাসিতে সে সব কিছু বাজি দিতে রাজি। লোকটি তখন বলে,
…………

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি