#কৃষ্ণাবতী
#৩০তম_পর্ব
দেবব্রত শুধু অবাক নয়নে তার কিশোরী বউকে দেখে যাচ্ছে। কি অপরুপ না লাগছে, একেবারে গিন্নি গিন্নি। এই রুপে দেবব্রত হাজারোবার মরতে রাজী। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে দেবব্রতের, ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই চোখজোড়া অবাক হয়ে যায়। স্ক্রিনের নাম্বারটি যে তার পরিচিত, ফোনটা রিসিভ করতেই চিরচেনা কন্ঠটি কানে এলো,
– কেমন আছিস দেব?
দেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, পাঁচটা বছর পর তার কান্র এই কন্ঠটি এলো। হ্যা, সৌদামিনী ফোন করেছে। সৌদামিনী বিদেশ যাবার পর থেকে এক বারো যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি দেবব্রতের সাথে। আজ এতোদিন পর, আর ফোনটি এসেছে সৌদামিনীর বাংলাদেশের নাম্বার থেকে। তাহলে দামিনী কি দেশে? চোখ বুঝে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো দেবব্রত। শান্ত গলায় বললো,
– মা দূর্গার কৃপায় ভালো আছি, কতোদিন পর তোর সাথে কথা বলছি। তোর খবর বল?
– ভালোই আছি, কেমন চলে দিনকাল?
– এইতো চলছে, আজ অন্নার আশীর্বাদ। তুই ভালো দিনে ফোন দিয়েছিস। তা দেশে কবে ফিরলি?
– ফিরেছি সপ্তাহ হয়েছে। আমার দেশে আসা উপলক্ষে আগামী শুক্রবার সারা, রবিনদের নিয়ে একটা হ্যাংআউট করতে চাচ্ছিলাম। সময় হবে?
– আমার তো হবে, তা আমার বউ কি এল্যাউড?
– হুম সবাই তাদের পার্টনারের সাথেই আসবে। তুই ও ব্যাতিক্রম নস৷ শুক্রবার দেখা হচ্ছে তাহলে৷ রাখছি
বলেই ফোনটা খট করে কেটেদিলো দামিনী। দেবব্রত ফোনের স্ক্রিনের দিকে নিরব দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো। পাঁচ বছরে অনেক বদলে গিয়েছে হয়তো দামিনী। তাই তো এতো দূরত্ব রেখে কথা বললো। বন্ধুত্বের বাঁধনটা এখন শুধু একটা তীক্ষ্ণ সুতোয় ঝুলছে। সুতোটা এতোটা সরু যে, দেবব্রত চাইলেই এই বাঁধনটা আগের ন্যায় পুরু করতে পারবে না। মেয়েটার জীবনের গতি তার জন্য ঘুরে গেছে। দোষটা তার ছিলো। খুব জানতে ইচ্ছে করছে দামিনীর জীবনে কি কেউ এসেছে কি না! জানতে পারলে মন্দ হবে না।
– কি ভাবছো?
কৃষ্ণার ডাকে ভাবনার অথৈ জগৎ থেকে বের হয় দেবব্রত৷ মাঝায় আঁচলটা গুজে রয়েছে, বা হাত দিয়ে খোপা থেকে খোলা চুলগুলো কানের পাশে সরিয়ে দিতে দিতে কথাটা বললো কৃষ্ণা। কাজ করতে করতে বেশ ঘেমে গেছে। জুলাই এর ভ্যাবসা গরমে তার চুল থেকে ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়ছে। কোনো সাজ নেই মুখে শুধু ঠোটে হালকা লিপস্টিক তবুও কি অপরুপ লাগছে। মুচকি হাসি দিয়ে কৃষ্ণার মাজা চেপে ধরলো দেবব্রত। লজ্জায় রাঙ্গা কৃষ্ণার চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেলো। আশে পাশে দেখে মৃদু স্বরে বললো,
– ছাড়ো, মানুষ দেখলে বেহায়া বলবে
– মানুষের বউকে তো জড়িয়ে ধরি নি, আমার বউকে ধরেছি।
বলেই কৃষ্ণার কপালের চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলো। কৃষ্ণা চোখ জোড়া বুঝে মাথা নিচু করে বললো,
– মা ডাকছেন, চলো
– ছেড়ে দিবো তাহলে?
কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো কৃষ্ণা। লোকটার আশেপাশে আসলেই কেমন মাতাল মাতাল হয়ে যায় কৃষ্ণা। কথাগুলো সব গবলেট হয়ে যায়। যতদিন যাচ্ছে তত যেনো আর বেশি ভালোবেসে ফেলছে সে দেবব্রতকে। দেবব্রত ধীর কন্ঠে বললো,
– শুক্রবার কিন্তু একটু বের হবো
– কোথায় যাবো?
– দামিনী এসেছে
কথাটা শুনতেই বুকে কামড় পরে কৃষ্ণার। কেনো যেনো পাঁচ বছর পুরোনো ভয়গুলো বুকের মাঝে জড়ো হয়। তখন বয়সটা খুব ছোট ছিলো তাই এই আবেগগুলো তার কাছে অজানা ছিলো, কিন্তু এখন বয়সটা আগের মতো নয়। সম্পর্কগুলোর অন্তর্গত অর্থ সে আজ বুঝতে পেরেছে৷ দেবব্রতের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ না হলেও একটা অদৃশ্য দেয়াল রয়েই গেছে। যে দেয়ালটা সে ভেদ করতে অপারগ। এর মাঝে দামিনীর আগমণ কোনো অশুভ বার্তা বয়ে আনবে নাতো তাদের মাঝে! কৃষ্ণার কপালে চিন্তার ছাপটা বুঝতে বাকি রইলো দেবব্রতের। মলিন হাসি হেসে বললো,
– ভালোবাসি
ছোট একটা কথা, খুব ছোট। তবুও কথাটা মনের মাঝে একটা শান্তির বন্যা বয়ে দিলো কৃষ্ণার। অবাক চোখে দেবব্রতের দিকে তাকালো সে। দুজন নির্বাক, চোখের চাহনী একে অপরের চোখে স্থির। একটা শব্দ উচ্চারণ না করেও নিজেদের মাঝে নীরব কথোপকথন হলো তাদের_______
২৪.
আকাশে অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছে, পূর্ণিমা বলে কথা। শীতল ঠান্ডা বাতাস বইছে, কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ এখন ফকফকা, তাই চাঁদের আলোটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে অন্না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সে। কানে মুঠোফোন, অপরপাশে অর্জুন। কিছুদিন পর বিয়ের তারিখ পড়েছে। ভাদ্র মাসের চৌদ্দ তারিখ তাদের বিয়ে। ব্যাপারটা ভাবতেই অবাক লাগছে অন্নার। অন্না তার ভাবনায় ব্যাস্ত বিধায় অর্জুন অপরপাশ থেকে বলে,
– কি হলো চুপ করে আছো যে?
– ভাবছি
– কি ভাবছো?
– এই যে, ভগবান সত্যি সত্যি তোমাকে আমার ভাগ্যে রেখেছে।
– এখনো অবিশ্বাস লাগছে?
– লাগবে না বলো? কখনো ভেবেছিলাম এই উদাসীন লোকটা আমাতে মত্ত হবে
– কিন্তু হয়েছি তো, শুধু মত্ত নই। একেবারে ডুবেছি। ওই যে একটা গাণ আছে না,
” তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না”
“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না”।
ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় আর পাবো না
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়
আর পাবো না না না না, আর পাবো না।
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না”
অর্জুনের গানটা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে অন্না। অন্নার হাসিটা যেনো অর্জুনের বুকের মাঝে তীরের মতো লাগছে। হাসি থামিয়ে অন্না বলে,
– চাঁদ দেখছো?
– হু, তুমি?
– আমিও। আজ চাঁদটা যেনো আরো বেশি সুন্দর লাগছে।
– আমার চাঁদের কাছে ওই চাঁদ কোনো পাত্তাই পাবে না!
– তাই বুঝি, তো তোমার চাঁদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিবে?
– দিবো, ভাদ্র মাসের ১৪তারিখ তার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিবো।
– অর্জুন?
এই প্রথম অন্না অর্জুন এর নাম ধরে ডাকলো। ডাকটা শুনে কিছু মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো অর্জুন। শান্ত গলায় বললো,
– বলো?
– কিছু না, ডাকতে ইচ্ছে হলো। আর কিছুদিন পর এই নামটা আর ডাকতে পারবো না।
– কেনো?
– ওমা জানো না, স্বামীর নাম মেয়েদের মুখে নিতে হয় না।
– এসব আদিম থিওরি ওফ রিলেটিভিটি আমার সাথে চলবে না কিন্তু। তোমার মুখে নিজের নামটা আমার কাছে অমৃতের মতো। মনের মাঝে শীতল ঢেউ খেলে যায়। কতোটা ব্যাকুল ছিলাম আমি জানো, কবে অর্জুনদায়ের বদলে অর্জুন বলে ডাকবে আমায়। এখন এসব বললে হবে না। আচ্ছা শোনো
– বলো
– আজ তোমায় একেবারে বউ বউ লাগছিলো। পারলে আজ ই সাত পাক ঘুরে নিতাম। কিন্তু ওই পন্ডিত কোনো লগ্ন পেলোই না। কি রাগ হচ্ছিলো আমার জানো, শুধু পিছাচ্ছিলো, আর পিছাচ্ছিলো। আমার বাড়ি হলে
– কি করতে?
– মেরে দিতাম, দক্ষিণাও দিতুম না।
– ইশশশ
– সত্যি, রাত বারোটায় লগ্ন কেউ ফেলে
– আমাদের পঞ্জিকা না মিললে তার কি দোষ
– সব ওই ব্যাটার ই দোষ। আমার জন্য তুমি একেবারে পরোটার উপরের মাখন। বললেই হলো পঞ্জিকা মিলবে না।
অর্জুনের কথায় অন্না আবারো খিলখিল করে হেসে উঠলো। তখন অর্জুন বুকে হাত রেখে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
– উফফফফ, এই হাসি, এই হাসি পাগল করে ছাড়বে।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়লে অন্না বলে,
– হয়েছে হয়েছে। এই শুনো, এখন রাখছি। মা এসেছে বোধ হয়।
– আচ্ছা, গুড নাইট।
অর্জুনের ফোনটা রেখে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে কৃষ্ণা ভেতরে ঢুকে। কৃষ্ণার মুখে একপ্রকার ভয়৷ অন্না কিছু জিজ্ঞেস করতেই, একটা প্রেগ্ন্যাসি কিট এগিয়ে দেয় সে। কিটের দিকে নজর দিতেই..…….
চলবে
#কৃষ্ণাবতী
#৩১তম_পর্ব
অর্জুনের ফোনটা রেখে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে কৃষ্ণা ভেতরে ঢুকে। কৃষ্ণার মুখে একপ্রকার ভয়৷ অন্না কিছু জিজ্ঞেস করতেই, একটা প্রেগ্ন্যাসি কিট এগিয়ে দেয় সে। কিটের দিকে নজর দিতেই অন্না দেখলো তাতে দুটো দাগ স্পষ্ট। অন্নার চোখ চিকচিক করছে, সে কৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– তুই তো আমাকে ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলি, আমি ভাবলুম কি না কি, এতো খুশির খবর। নতুন অতিথি আসছে। আমি পিসি হতে চলেছি। আর তুই মা। কংগ্রেচুলেশনস
অন্নার খুশি যেনো ধরছে না। এদিকে অন্নার কথাগুলো কিছুই যেনো কর্নপাত হচ্ছে না কৃষ্ণার। সে সত্যি ই মা হতে চললো, তার ভেতরে তার এবং দেবব্রতের ভালোবাসার অংশ গড়ে উঠছে। এ যেনো তার জীবনের সবথেকে আনন্দের মূহুর্ত। অথচ সে খুশি হতে পারছে না। তার মনে একরাশ ভয় জড় হয়েছে। দেবব্রত কি এই সংবাদে খুশি হবে! সে তো বাচ্চার নাম শুনলেই ক্ষেপে উঠে। সে যদি জানতে পারে কৃষ্ণা কনসিভ করেছে তাহলে না জানি কি কুরুক্ষেত্র বাধাবে!
– কি হলো কি ভাবছিস? তুই খুশি নস?
– আচ্ছা, কিটে ঝামেলাও তো হতে পারে তাই না?
কৃষ্ণার নির্বিকার প্রশ্নে অন্না অবাক হয়ে যায়। কৃষ্ণার চোখে মুখে খুশি থেকে ভয়ের ছাপ বেশি। শান্ত গলায় অন্না বলে,
– কয়বার পরীক্ষা করেছিস?
– দু বার
– দুবার ই পজেটিভ?
– হুম
– তাহলে কোনো কিটে কোনো ঝামেলা নেই৷ আচ্ছা তুই তোর শরীরের অবস্থা কি রকম? মাথা ঘুরানো, বমি? কিছু হচ্ছে না?
– শরীরটা দূর্বল, মাথা ঘুরায়, মাসিক হচ্ছে না। সব সিম্পটম আছে আমি জানি। তুই না তোর দাদাভাইকে কিছু বলিস না। আমি একেবারে টেস্ট করিয়ে শিওর হতে চাই।
– কৃষ্ণা কি সমস্যা হচ্ছে? তুই কি বাচ্চাটা চাচ্ছিস না?
অন্নার প্রশ্নে কৃষ্ণা নিশ্চুপ হয়ে যায়৷ কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে বাচ্চাটা চায়, সে একটা সুন্দর পরিবার চায় যেখানে তাদের ভালোবাসার অংশ থাকবে, নিজ হাতে নিজের বাচ্চাকে বড় করবে কৃষ্ণা, দেবব্রতের কাধে মাথা রেখে বৃদ্ধ হবে। কৃষ্ণা একটা সম্পূর্ণ পরিবার চায়। চোখ থেকে নোনাজল গাল বেয়ে পড়ছে। এই নোনা জলে রয়েছে একরাশ অভিমান। অভিমানটা কার উপর বুঝে উঠতে পারছে না। কৃষ্ণার চোখের জল দেখে অন্না কিছু বললো না, শুধু অপেক্ষা করলো কৃষ্ণার প্রতিউত্তরের_______
২৫.
রিপোর্ট হাতে বসে রয়েছে কৃষ্ণা। তার পাশে অন্না বসা। সাধারণত এই সিটে স্বামী বসে থাকে। অন্যান্য নারীর মতো কৃষ্ণাও চেয়েছিলো দেবব্রত তার পাশে থাকুক। কিন্তু দেবব্রতকে সত্যিটা বলার সাহস হয়ে উঠছে না। শ্বাশুড়ি বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ তো করেছে, এখন সামনে কিভাবে কি করবে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। অন্না কৃষ্ণার কম্পনরত হাতটাকে শক্তকরে ধরে রয়েছে। এতে কৃষ্ণা খানিকটা সাহস পায়। সামনে তার ডাক্তার ডা. নিশাত জাহাত বসা। ডা.নিশাত ধীর কন্ঠে বললো,
– ফিটাসের বয়স তো খুবই কম, এখন খুবই আনস্টেবল, যদি বাচ্চাটা রাখতে চাও তবে এখন থেকে ছয় সপ্তাহ খুব কেয়ারে থাকতে হবে। তোমার শরীরের যা অবস্থা। এখন মিসক্যারেজের সম্ভাবনা অনেক।
– আর যদি এবোর্শন করাতে চাই?
কৃষ্ণার কথাটায় ডা. নিশাত খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর ধীর কন্ঠে বলে,
– সেটা করাতেই পারো। এটা তোমার হেলথের জন্য ভালো হবে বরং। কারণ তোমার ফিটাসের অবস্থা বেশি ভালো নয়। আর বাচ্চাটা তোমার জন্য ক্যারি করাটা লাইফ থ্রেটনিং হবে। এজ এটা তোমার ফাস্ট কনসিভ নয়। তাই আমি কথাটা বলতে চাই নি।
– ফাস্ট কন্সিভ নয় মানে?
অন্না অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে৷ একটু থেমে ডা. নিশাত বলেন,
– এর আগেও কৃষ্ণার দুবার কন্সিভ করেছিলো। কিন্তু ফিটাস দু সপ্তাহের বেশি তার গর্ভে স্টে করে নি। প্রথমটা সে বুঝতে পারে নি, ওভার পিল নেওয়ার কারণে এক সপ্তাহের মাঝেই মিসক্যারেজ হয়ে যায়। কিন্তু সেকেন্ডবার কন্সিভ করবার পর মি. দেবব্রত নিজ থেকে এবোর্শনের কথা বলতে এসেছিলেন। তার প্রয়োজন হয় নি, প্রেগন্যান্সির ডিফিকাল্টির জন্য দু সপ্তাহ পর ই কৃষ্ণার মিসক্যারেজ হয়ে যায়। আমার অনেস্ট অপিনিয়ন নিতে চাইলে আমি বলবো, বাচ্চাটা না রাখাই বেটার। এখন কৃষ্ণার ডিসিশন। তবে এটা অনেকটা লস লস ডিল। এবার যদি এবোর্শন করে তবে আর কখনো মা হতে পারবে কি না এটা নিয়ে আমি সন্দিহান। আর যদি বাচ্চাটা রাখতে চায় তবে কৃষ্ণার জন্য এটা খুব মারাত্নক ক্ষতি বয়ে আনবে।
অন্না কোনো কথা বলে না, নিজের দাদার উপর মারাত্নক মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তার বুঝতে বাকি নেই কেনো কৃষ্ণা বারবার এবোর্শনের কথাটা বলছিলো। কৃষ্ণার বুকের কষ্টগুলো অনুমান করতে পারছে অন্না। একজন মেয়ের দু দু বার মিসক্যারেজ হয়েছে। অথচ সে কাউকেই বলতে পারে নি। এদিনে অবন্তীকা দেবী বাচ্চা বাচ্চা করে তার কান ঝালিয়ে দিয়েছে। সে বলতেও পারে নি, সে ও মা হতে পারে। কিন্তু ভগবান দুবার ক্ষনিকের জন্য এই সুখ তার ভাগ্যে রেখে পুনরায় কেড়ে নিয়েছে৷ ডাক্তারের কেবিনের থেকে বেড়িয়ে অন্না তাকে জিজ্ঞেস করে,
– কি করবি তুই? আমার মনে হয়….
– আমি বাচ্চাটাকে রাখবো অন্না।
কৃষ্ণার অনুনয়ের স্বরে বলা কথাটা শুনে অন্না কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কৃষ্ণার জীবনের ঝুকি জেনেও এই ডিসিশনটা সে নিতে চাইছে। কারণ সে তার মাতৃত্বের সাধ পেতে চায়। জীবনটা কি অদ্ভুত না। সব কিছুতেই কিছু না কিছু হারানোর সম্ভাবনা থেকেই যায়।
বিকেল ৫টা,
কপালে হাত রেখে কৃষ্ণা শুয়ে আছে। শরীরটা যেনো খারাপ লাগছে। আসার পর থেকে দু তিন বার বমি করেছে সে। আজ অন্নার সাথে ঘুরার বাহানা দিয়ে কলেজে ফাকি দিয়েছে। নয়তো হাসপাতালে যাওয়াটা হতো না। সাহস করে বলে তো দিয়েছে সে বাচ্চাটা রাখবে কিন্তু দেবব্রতকে সত্যটা জানাবার পর কি হবে এটা তার অজানা। আজ খুব ভাপসা গরম পড়েছে। মাথার উপরের ফ্যানটাও যেনো ঘুরতে চাইছে না। হঠাৎ দরজা ঠেলার আওয়াজে চোখ মেলে তাকায় কৃষ্ণা। দেবব্রত ঘামার্ত, ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। কৃষ্ণাকে দেখেই ব্যাগটা রেখে মুচকি হাসি হাসে। কৃষ্ণাকে সাধারণত অসময়ে শুয়ে থাকতে সে কখনো দেখে নি। তাই অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– শরীরটা কি ভালো না?
– কেনো বলোতো?
– এই অবেলায় শুয়ে আছিস তাই বললাম
– শরীরের কি দোষ, আজ যা গরম পড়েছে।
– তাও ঠিক, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। তোর সাথে জরুরি কথা আছে।
হাতে টাওয়াল এবং ট্রাওজার নিতে নিতে কথাটা বলে দেবব্রত। দেবব্রতের কথা শুনে উঠে বসে কৃষ্ণা। অবাক কন্ঠে বলে,
– কি কথা?
– আসছি, এসে বলছি।
বলেই ওয়াশরুমে চলে যায় দেবব্রত। মিনিট বিশেক পর ফ্রেশ হয়ে এসে কিছু কাগজপত্র নিয়ে কৃষ্ণার সামনে বসে দেবব্রত। কাগজগুলো বেশ অচেনা লাগছে কৃষ্ণার কাছে। অবাক চোখে তার দিকে তাকালে দেবব্রত বলে,
– এগুলো তোর বাহিরে যাবার কাগজ।
– বাহিরে বলতে?
– মনে আছে তুই কিছু পরীক্ষা দিয়েছিলি কয়েকমাস আগে?
– হু,
– ভালো রেজাল্ট করেছিস। এখন ফাইনালটায় ভালো রেজাল্ট করলেই তোর বাহিরে যাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।
– ওগুলো কিসের পরীক্ষা ছিলো মাষ্টারমশাই?
কৃষ্ণা নির্লিপ্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় দেবব্রতের দিকে। কিছু মাস আগে দেবব্রত তাকে অনেকগুলো পরীক্ষায় অংশ নিতে বলেছিলো। কিন্তু কৃষ্ণার অজানা ছিলো সেগুলো তার বাহিরে যাবার একেকটা ধাপ ছিলো। দেবব্রত শান্ত গলায় বললো,
– তোকে সত্যিটা বললে তুই কখনো রাজী হতি না
– তাই বলে মিথ্যে বলবে?
– আমি যা করেছি, তোর ভালোর জন্য। তুই বুঝতে পারছিস? তোকে জাপানে তোর থিসিস পেপার রিচার্সের জন্য স্কোলারশিপ দিচ্ছে। তুই সেখানে ফারদার স্টাডি ও করতে পারবি! তুই বুঝতে পারছিস এটা কতো বড় সুযোগ? এই কাগজগুলো সেগুলোই। তুই ফিল করে দিলে আমি সাবমিট করে দিবো।
– কত বছরের জন্য?
– তিন বছর, অনলি তিন বছর।
– তোমার কাছে এটা অনলি হতে পারে আমার জন্য নয়। আমি কোথাও যেতে চাই না মাষ্টারমশাই।
– জিদ করছিস কেনো কৃষ্ণা? তুই কি জানিস না এটা আমার কতো বছরের স্বপ্ন। আমি তোর জন্য কত স্বপ্ন দেখেছি। এখন তুই বলছিস তুই যাবি না, এতো বড় সুযোগ কে হাতছাড়া করে।
দেবব্রত খানিকটা চিৎকার করে উঠে। তার রাগ হচ্ছে কৃষ্ণার প্রতি। এতোবছরে ইচ্ছে আজ পূরণ হচ্ছে তার মনটা এতোক্ষণ খুশিতে আটখানা ছিলো। কিন্তু কৃষ্ণা আবারো জিদ করছে। দেবব্রতের ধমকে কেঁপে উঠে কৃষ্ণা। চোখগুলো আপনাআপনি ভিজে যায়। কিন্তু নিজেকে শক্ত রেখে বলে,
– আমি যাব না মাষ্টারমশাই, আসলে আমি যেতে পারবো না।
– কেনো?
– কারণ আমি প্রেগন্যান্ট।
কথাটা শোনা মাত্র দেবব্রত যেনো আকাশ থেকে পড়ে। নিমিষেই…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি