#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_08
#Writer_NOVA
টেবিলের সামনে এসে হারিকেনের আলোটা কমিয়ে দিলো। নিঃশব্দে চেয়ারে বসে খাতা-কলম নিয়ে চিঠি লেখা শুরু করলো। বাইরে পোকামাকড়ের শব্দ ভেসে আসছে। নিকেষ কালো আঁধারে স্তব্ধ হয়ে আছে চারিপাশ। মাঝে মাঝে বাদুড়ের ডাক ভেসে আসছে। থমথমে পরিবেশে তার পাশে এসে দাঁড়ালো কলি বেগম। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি করো?’
‘চিঠি লিখি।’
‘কারে? ফুলের কাছে?’
‘হ্যাঁ, মেয়েটার কতদিন ধরে খবর নেই।’
‘গিয়া একবার দেইখা আইবেন?’
‘মন চাইছিলো একবার গিয়ে দেখে আসতে। কিন্তু কিভাবে যাই বলো? বহু বছর ধরে যেই বাড়িতে পা রাখি না হুট করে কিভাবে যাই?’
‘তোমার মাইয়া তুমি দেখতে যাইবা, সমস্যা কি?’
দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মনোয়ার সর্দার বললো,
‘আমারো মন কাঁদে ওর জন্য। বড় আদরের মেয়ে। কতদিন ধরে দেখি না।’
কলি বেগম কথা বাড়ালেন না। চুপচাপ স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনোয়ার হাত চালিয়ে মেয়ের কাছে চিঠি লিখলেন। বাড়ির পাশের নারিকেল গাছে বসে একটা পেঁচা একঘেয়ে সুরে ডাকছে। রাতের নিস্তব্ধতা চিড়তে তার ডাকই যথেষ্ট। অল্প আলোয় স্বামীর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। যৌবনে বেশ শক্ত, সামর্থ্য ছিলেন।বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার পর কম ঝড়-ঝাপটা যায়নি। তবুও কলি বেগমের হাত ছাড়েনি। বিশাল ঘর ছেড়ে বেছে নিয়েছেন সাধারণ জীবন যাপন। প্রতিটা প্রতিকূল অবস্থায় স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে ছিলেন।
‘যাও গিয়ে ঘুমিয়ে থাকো।’
‘তুমি ঘুমাইবা না?’
‘লেখা শেষ করি।’
‘আমিও তাইলে থাকি।’
‘পাপড়ি, বৃন্ত কি ঘুমিয়েছে?’
‘হো।’
‘তাহলে তুমি ঘুমাও গিয়ে।’
কলি বেগম সরলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে চিঠি লেখা দেখতে লাগলো। যদিও সে কিছু বুঝতে পারছিলো না।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে হাতের বাম দিকে হাঁটতে লাগলো ফুল। পূর্ব পাশের কামরায় গেলো। হাতে থাকা খামটা আনোয়ার সর্দারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘চাচা নাও তোমার চিঠি।’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকিয়ে হাতে থাকা বইটা উল্টে বললো,
‘কার চিঠি?’
‘অভি ভাইয়ের।’
‘অভি চিঠি পাডাইছে?’
‘হুম অনেক আগে পাঠিয়েছিলো। আমার তোমাকে দিতে মন নেই।’
‘আইচ্ছা রাখ। আর ঝুমুররে দিয়া এক কাপ চা পাডায় দিছ। মাথাটা ঝিম মা’ইরা রইছে।’
‘আজকে ইউনিয়ন পরিষদে যাবা না?’
‘না তেমন কাম নাই। যাইয়া লাভ নাই।’
ফুল দৃষ্টি নামিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি বই পড়ো তুমি?’
‘সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী উপন্যাস।’
‘আমাকে একদিন দিয়ো তো। পড়ে দেখবোনি।’
‘তুই বই পড়োস?’
‘না পড়া হয় না। প্রচ্ছেদটা দেখে ভালো লাগলো।’
‘আমার তাঁকেই তো থাকে। নিয়া পড়তে পারোস না?’
‘সময় হয় না।’
আনোয়ার সর্দার বই সোজা করে পড়ায় মন দিলো। ফুল কিছু দূর গিয়ে আবার ফেরত এলো। ফুলকে ফেরত আসতে দেখে আনোয়ার সর্দার বললো,
‘কিছু কবি?’
‘হ্যাঁ, চাচী আর দাদী দু’জন বাড়িতে নেই আজকে।’
আনোয়ার সর্দার ভ্রু কুঁচকে ফুলের দিকে তাকালো। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কই গেছে?’
‘চাচীর বাপের বাড়ি। আপনের কোন শালার বউ নাকি অসুস্থ তারে দেখতে।’
বিকেলের আলোয় চেয়ারম্যান বাড়িটাকে অন্য রকম লাগে। মনে হয় সব জায়গায় হলুদাভ আলো জ্বালিয়ে রেখেছে কেউ। বাড়ির উত্তর পাশে ছোট খুপরির মতো একটা ঘর আছে। সেখানে রান্নার কাঠ, পাতা, পাটকাঠির স্তুপ। ফুল, ঝুমুর ওড়নায় বেধে সেখান থেকে চেলাকাঠ বের করতে লেগে পরলো।
‘এত্তগুলা নিতে পারবা না। কম কইরা নাও ফুল।’
‘আরে পারবো সমস্যা নেই।’
‘সাবধানে নিয়ো। চলার (চেলাকাঠ) খোঁচা খাইবা।’
‘তুমি বেশি ভাবছো। কিছু হবে না।’
কাঠের খোঁচায় হাত-পায়ে ব্যাথা না পেলেও ফুলের জামার সাথে বেধে চিড়চিড় শব্দ করে এক কোণা ছিঁড়ে গেলো।
‘আমার নতুন জামা! দুদিন পরলাম মাত্র!’
চিৎকার করে উঠলো ফুল। জামার অংশটা হাতে নিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে ঝুমুরের দিকে তাকালো।
‘আমি আগেই কইলাম। এহন সরো। আর কাম করতে হইবো না তোমার।’
‘ধূর, মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।’
কামরার সামনের বারান্দায় দাঁড়ালে উত্তরের ঘরের সবকিছু দৃষ্টি গোচর হয়। আনোয়ার সর্দার সেখানে দাঁড়িয়ে ভাতিজি সকল কথাই শুনলেন ও দেখলেন।
সন্ধ্যার পর শুভ যখন বাড়ি ফিরলো তখন আনোয়ার সর্দার ফুল, ঝুমুরের সাথে বসে পুরনো দিনের কথার ঝুলি খুলে বসেছে। সাথে চা-বিস্কুট তো আছেই। বাবাকে দেখে শুভ দাঁড়ালো না। ধুপধাপ পা ফেলে নিজের কামরায় চলে গেলো। কামরায় এসে ধুপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো শুভ। মাথাটা ভার হয়ে আছে। এই ভাড় হওয়া কিসের লক্ষ্মণ তা শুভ জানে। ঠান্ডা বাবাজী দরজায় কড়া নাড়ছে। যেকোনো সময় এসে হাজির হবে।
‘তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।’
বাবার কন্ঠস্বর শুনে মাথা হালকা উঁচিয়ে কপাল কুঁচকে তাকালো শুভ। গলা ঝেড়ে বললো,
‘স্বয়ং চেয়ারম্যান সাহেব আমার কামরায়। কাহিনি কি?’
শুভর কথায় রুষ্ট হলেন আনোয়ার সর্দার। তবে মুখে প্রকাশ করলেন না। থমথমে মুখ করে বললো,
‘মুখে লাগাম দে।’
‘লাগাম আমার কোন কালে ছিলো না। তাই নতুন করে দিতে পারবো না।’
আনোয়ার সর্দার ধমকে উঠল,
‘শুভ!’
শুভ আগের ন্যায় মাথা বালিশে হেলিয়ে বললো,
‘কন, হুনতাছি।’
‘আমি তোর লগে ঝামেলা করতে আহি নাই।’
‘আমিও ঝামেলার মুডে নাই।’
আনোয়ার সর্দার দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। ছোট ছেলেটা তার বখে গেছে। কোন কথা শুনে না। শাসন করলে উল্টো বেশি ত্যাড়ামি করে। বাপ-ছেলের সম্পর্ক ভালো ছিলো না কখনো। বড় হওয়ার সাথে সাথে যতটুকু অবশিষ্ট ছিলো তাতেও ফাটল ধরেছে বহু আগে। তার ছেলেটা বেপরোয়া হয়ে গেছেন। কারো কথা শুনে না। এতে আনোয়ার সর্দারের আফসোসের শেষ নেই।
‘কি কইবেন জলদী কন।’
‘ফুলরে নিয়া একটু বাজারে যাইস তো।’
শুভ উঠে বসে কপাল ভাজ করে ফেললো। গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কেন?’
‘ওর দুইডা সেলোয়ার-কামিজ কিইন্না দিবি।’
‘আজকে যাইতে পারমু না। কালকে যামুনে।’
‘তোর যহন মন চাই যাইস।’
আনোয়ার সর্দার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে টাকা বের করে শুভর দিকে এগিয়ে দিলো। টাকা দেখে শুভ চোখের পাতা নাচিয়ে বললো,
‘টেকা কেন?’
‘ওরে জামা-কাপড় কিইন্না দিবি টেকা লাগবো না?’
শুভ স্মিত হেসে তাচ্ছিল্যের সুর টেনে বললো,
‘শুভর দিনকাল এতো খারাপ হই নাই যে আপনের থিকা টেকা নিতে হইবো।’
ছেলের কটাক্ষে মাথাটা দপ করে ধরে গেলো। পকেটে টাকাটা রেখে হনহনিয়ে ছেলের কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো।
‘আয় তিতি, আয়! সন্ধ্যা হইয়া গেলো। খোয়ারে ডুকোস না কেন তোরা?’
ঝুমুর বিরক্তি প্রকাশ করলো। ফুল বারান্দায় বসে ঝুমুরের কান্ড দেখে হাসছে।
‘তোমাকে দেখে আজ মুরগী পালিয়েছে ঝুমুর আপা।’
‘হেইডাই দেখতাছি। আমার লগে শয়তানি শুরু করছে। একটু পর আজান দিবো। দেহো তো কেমন শুরু করছে।’
‘তুমি ঐদিক দিয়ে তাড়া দাও। আমি এদিক দিয়ে দেখছি।’
সিমেন্টের বেদি থেকে উঠে বাইরের দিকে যাওয়ার পথ ধরতেই পেছন থেকে শুভ ডাকলো।
‘কইতরির মা!’
ফুল শুভর দিকে ঘুরে বললো,
‘হুম বলো।’
‘একটু এদিকে আয় তো।’
ফুল বাইরের দিকে তাকিয়ে জোরে চেচিয়ে ঝুমুরকে বললো,
‘তুমি মুরগীগুলোকে খোয়ারে ঢুকাও ঝুমুর আপা। আমি একটু পর আসছি।’
শুভ হাত মুঠ করে চুলগুলোকে টেনে ধরলো। মাথাটা জব্বর ধরেছে। ফুলকে খেঁকিয়ে বললো,
‘কিছু কইছি আমি।’
‘হুম চলো।’
শুভর পিছু পিছু ফুল হাঁটা ধরলো। নিজের কামরায় গিয়ে শুভ খাটের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলো। শুভর কান্ড না বুঝে ফুল চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
‘দাঁড়ায় রইছোত কেন? এদিকে আয়।’
চেচিয়ে বললো শুভ। ফুল গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে শিউরের পাশে দাঁড়ালো। এক চোখ খুলে শুভ বললো,
‘আমার মাথাটা একটু টিপে দে তো। অনেক ধরছে।’
শুভর কথায় ফুল ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কি করবে তার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কিছু বলার আগে শুভ আবারো ধমকে উঠলো।
#চলবে
#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_09
#Writer_NOVA
ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। নদীর পাশে থাকা কাশফুলগুলো হেলেদুলে তার জানান দিচ্ছে। দু-চারটা সাদা ফুল ফুটেছে। নদীতে দুটো পানকৌড়ি খেলা করছে।একটা ডুব দিচ্ছে তো আরেকটা উঠছে। লুকোচুরি খেলায় আজ কে জিতবে তার প্রতিযোগিতা। ক্ষেতের আইল বেয়ে উঠে মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে ফুল। একটা পানকৌড়ি ডানা মেলে ছোট গুল্মলতার ডালে বসলো। ফুলের কাছে মনে হলো পাখিটা কাঁপছে। তবুও সে কিন্তু তার সঙ্গী ছেড়ে গেলো না। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করলো যতক্ষণ না অপর পাখিটা ফিরে আসে।
‘কিরে কি দেহোস? ধেন্দির মতো খাঁড়ায় রইছে। কহন থিকা ডাকতাছি হুনেও না।’
শুভর ধমকে চমকে তাকালো ফুল৷ শুভর চোখে, মুখে স্পষ্ট বিরক্তি জানিয়ে দিচ্ছে সে আসলেই ফুলকে অনেকবার ডেকেছে। কিন্তু ফুল পানকৌড়ি দেখতে এতই মুগ্ধ ছিলো যে কোনদিকে ধ্যান ছিলো না।
‘আবারো খাঁড়ায় রইলো। বিকাল শেষ হইলে কি গঞ্জে যাবি? তোর লিগা বেডারা দোকান খুইলা রাখবো?’
‘এতো ধমক দিচ্ছো কেনো?’
শুভ কোমড়ে এক হাত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
‘ধমকের কাম করলে তোমারে কাঁধে তুইল্লা হাটমু।’
‘হাঁটতে মন চাইলে কাঁধে নিতে পারো।আমি কিছু মনে করবো না। এমনিতেও পা দুটো ব্যাথা করছে।’
‘ওরে আমার নবাবজাদি! এতডু হাইটা উনার পাও ব্যাথা করতাছে।’
‘তোমার বটবটি তো আনতে পারতা শুভ ভাই।’
খিলখিল করে হেসে উঠলো ফুল। শুভ চোখ রাঙানিকে সে পাত্তা দিলো না। শুভ দাঁত কটমট করে বললো,
‘আমার মোটর সাইকেলরে বটবটি কবি না কইতরির মা।’
‘একশবার বলবো। কি বলবে তুমি?’
শুভ আবারো চোখ রাঙাতেই ফুল উচ্চস্বরে হাসলো। সেই হাসির শব্দ নদীর ওপাড়ে গিয়েও বারি খেলো। ফাঁকা জায়গায় বাতাসে বারবার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। শুভর বিরক্তিগুলো সব ঠুস করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। এই কারণে সে মোটরসাইকেল আনেনি। মাটির কাঁচা রাস্তা হলে এতক্ষণে বাজারে পৌঁছে যেতো তারা। কিন্তু শুভ তা চায়নি। যত বেশি সময় ফুলের সাথে থাকা যায় সেই বন্দবস্ত করেছে। মেয়েটার সাথে থাকলে সব দুঃখ যেনো তার থেকে ছুটি নিয়ে কোথাও পালিয়ে যায়।
শুভকে গভীর চিন্তায় মগ্ন দেখে ফুলের কপাল কুঁচকে গেলো।শুভকে রাগাতে তার বেশ লাগে। অল্পতেই লুচির মতো ফুলেফেঁপে উঠে। তবে ভয়ংকর রেগে গেলে সর্বনাশ! তাই ফুল বোঝার চেষ্টা করলো শুভর মতিগতি কেমন!
‘শুভ ভাই!’
‘হু ক।’
‘দাড়িয়ে আছো কেন? যাবে না?’
‘হো লো (চল)।’
শুভ আগে আগে চলতে লাগলো। পিছনে ফুল পানকৌড়ির মতো হাত মেলে বড় করে মুক্ত বাতাস নিলো। নির্ভেজাল অক্সিজেন। বাড়িতে থাকতে থাকতে দমবন্ধ লাগে তার। কতদিন পর বাসা থেকে বের হয়েছে সে। ইচ্ছে করছে তা ধিন ধিন করে নাচতে। শুভ তাকে নিয়ে যাচ্ছে সেলোয়ার-কামিজ কিনে দিতে। সোজা রাস্তা ছেড়ে এই ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে কেনো নিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না ফুল। পিছনে পরতেই এক দৌড় লাগালো সে। তার দৌড়ে ক্ষেতে থাকা সাদা বকগুলো ভয় পেয়ে আকাশে উড়াল দিলো।
‘তুমি এদিক দিয়ে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?’
‘তোরে মা’ইরা নদীতে ফালায় দিমু।’
‘যাঃ আজাইরা কথা!’
ফুলের কথা শুনে শুভ হো হো হেসে উঠলো। ফুল মুখ ভোঁতা করে ফেললো। ছেলেটার হয়েছে কি? অকারণে এমন হাসে কেন?
মোড়ায় বসে পান সাজাতে সাজাতে কূটনামি বুদ্ধিটাও সাজিয়ে ফেললেন সুফিয়া বিবি। পান মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বড় বউকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘আমি আগেই কইছিলাম এই মাইয়া আইছে আমগো নাতিরে কব্জা করতে। এহন তোর বিশ্বাস হইলো?’
‘আপনের পোলায় কি হেইডা হুনে? আমার কলিজা ভাজা ভাজা করতাছে। কত বড় সাহস দেহেন আম্মা। আমার পোলারে নিয়া বাজারে গেছে। আপনার পেলায় ঐ মাইয়ারে লাই(সাহস) দিয়া মাথায় তুলতাছে। আমারে বনবাসে পাডানোর ব্যবস্থা করে।’
সোহেলী বেগমের কন্ঠে তীব্র রাগ। এই মুহূর্তে ফুলকে হাতের কাছে পেলে হয়তো গালে কষিয়ে চড় মেরে বলতো, ‘এত শখ কেন আমার পোলার লগে বাজারে যাওনের?’ শুধু নেই বলে বেঁচে গেলো। হাতটা নিশপিশ করছে ভীষণ। ঝুমুর একবার দরজা দিয়ে সাবধানী দৃষ্টি দিয়ে কচ্ছপের মতো মাথাটা ভেতরে নিয়ে গেলো। সোহেলী বেগমোর মেজাজ যে আকাশে উঠে আছে তা বুঝে সে এদিকে ভিড়লো না। তাড়াতাড়ি করে নিচে নেমে হাঁস-মুরগির খাবার নিয়ে খোয়ারের দিকে চলে গেলো।
‘সব দোষ তো আমার পোলার না! তুই খালি আনোয়াররে টানোস? ঐ মাইয়া কি কম ছলনা জানে? কেমনে কারো হাত কইরা রাখতে হয় তা ওর আয়ত্ত্বে ভালাই আছে।’
‘মান-সম্মান খাইতে আইছে। বুঝছেন আম্মা? চেয়ারম্যান বাড়ির যতুডু মান-ইজ্জ্বত বাকি আছে ঐডুও ধুলার লগে মিশাইবো। আহুক আজকে। আমার পোলার লগে বাজারে ঘুরোন ছুটামুনে।’
‘তোর পোলাও কি কম যায় নাকি? জীবনে দাদী, মায়েরে নিয়া কোনহানে গেলো না। অথচ ঐ ছেমরিরে নিয়া ডেং ডেং কইরা আমার সামনে দিয়া হাইটা গেলো। একবার কইলোও না যে দাদী বাজারে যাই।’
সোহেলী বেগম উত্তর দিলেন না। তার শরীর রাগে কাঁপছে। সুফিয়া বিবি চুপ হয়ে মনে মনে হাসলেন। ফুল, শুভর বিরুদ্ধে যতটা উসকে দিয়েছেন আজকের জন্য এতটুকু যথেষ্ট। দুজনের কি অবস্থা হবে তা ভেবে মনে মনে খুশির পরিমাণটা বেড়ে গেলো।
‘ফুল কই ঝুমুর আপা? ওরে দুদিন ধইরা দেহি না। ও কি বাড়িগে গেছে?’
ময়নার কথা শুনে পেছনে ঘুরে তাকালো ঝুমুর। হাতে মুরগীর খাবার বাটিটা মাটিতে রেখে ময়নার বাহু ধরে আড়ালে টেনে নিয়ে গেলো। ফিসফিস করে বললো,
‘আস্তে কথা কও। বাড়ির পরিস্থিতি ভালা না। আমার ডর করতাছে জানোস?’
ময়না চোখ কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললো,
‘কেন?’
‘আরে ছোট ভাই ফুলরে নিয়া গঞ্জে গেছে। হের লিগা চাচী তো রাইগা আগুন। এহন ফুল বাড়িতে আইলে খবর কইরা ফালাইবো।’
‘কও কি!’
চাপা আর্তনাদ করে উঠলো ময়না। ঝুমুরের চোখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেলো। ময়নার বুক চিরে বেরিয়ে গেলো দীর্ঘ শ্বাস। যা ঝুমুরের কানে বিকট শব্দ মনে হলো।
‘ওর লিগা চিন্তা হইতাছে আমার ময়না৷ তুই তো জানোস এই বাড়ির মানুষ কেমন! মাইয়াডা সারাদিন সংসারে বান্দীর মতো খাটে। তাও একটু কিছু হইলে বাপ-মা তুইল্লা কথা কয়। আজকে তো বোধহয় চুলের মুঠি ধইরা ঘুরাইবো।’
ময়না আশ্বাসের বুলি আওড়ে বললো,
‘চিন্তা কইরো না, আল্লাহ আছে। দেইখো ফুল সব ঠিক করে নিবো। তয় লগে শুভ ভাই থাকলে ভালা হইবো। কেউ কিছু কওনের সাহস পাইবো না।’
ময়নার আশ্বস্ত বাণীতে ঝুমুর খুশি হতে পারলো না। মনের ভেতর দমকা হাওয়া বইছে। মন বলছে আজ কোন ঝড় অবশ্যই আসবে।
মাগরিবের আজানের বেশি সময় নেই। ঠান্ডা বাতাস বইছে। আকাশটাও হঠাৎ করে ভার হয়ে গেলো। কালো মেঘে সারা আকাশ ছেয়ে গেছে। বৃষ্টি হবে হবে ভাব। আনোয়ার সর্দার রমিজ মিয়াকে তাড়া দিয়ে বললেন,
‘তাত্তাড়ি (তাড়াতাড়ি) পা চালা রমিজ। আকাশের অবস্থা ভালো না।’
‘তাইতো দেখতাছি চেয়রাম্যান সাব।’
‘বৃষ্টিতে নাগাল পাইবো নাকি আমগো?’
‘কইতে পারি না। আল্লাহর ইচ্ছা।’
‘একটু আগেও সব ঠিক আছিলো। আজানের আগে বাড়িত যাইতে হইবো।’
দ্রুত গতিতে পা চালাচ্ছেন আনোয়ার সর্দার। সাথে ছাতা নেই। অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজলে পাক্কা এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগতে হবে। চেয়ারম্যানের সাথে পা মিলাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হোচট খেলেন রমিজ মিয়া। সেটা খেয়াল করে আনোয়ার সর্দার বললেন,
‘আস্তে হাট, এই বয়সে পইরা মাজা(কোমড়) ভাঙবিনি?’
রমিজ মিয়া বেআক্কলের মতো হাসলো৷ আনোয়ার সর্দার কথা না বাড়িয়ে হাঁটার গতি বাড়ালেন। কথায় আছে না যখন তুমি তাড়াতাড়ি করতে যাবে তখুনি তোমার বেশি দেরী হবে। তেমনি ঘটলো আনোয়ার সর্দারের ক্ষেত্রে। দক্ষিণের গ্রামের মেম্বার কালাম ব্যাপারি এই রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। চেয়ারম্যানকে দেখে হাঁকডাক শুরু করলেন।
‘ও চেয়ারম্যান সাব, এট্টু দাড়ান। আপনের লগে অনেক জরুলি (জরুরি) কথা আছে।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আনোয়ার সর্দারকে দাঁড়াতে হলো। তার কাজই গ্রাম ও গ্রামের মানুষের উন্নয়ন করা।সেখানে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলে তো চলবে না।
ফুল বাসায় ফিরলো আজন দিবে দিবে এমন মুহুর্তে। শুভ ফুলকে বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আজ তার ক্লাবে বাজি খেলা আছে৷ সেখানে তার থাকতেই হবে। এর জন্য দেরী করলো না। ফুল হাতে থাকা ব্যাগটা বুকের সাথে জাপ্টে ধরে ধীর পায়ে নিজের কামরায় চলে গেলো। কামটায় ঢুকে আশেপাশে ঝুমুরকে দেখতে পেলো না। ভেতরে ঢুকে খাটে বসে বড় করে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। চাচীর সামনে পরলে নির্ঘাত তোপের মুখে পরতে হতো।
হাতের ব্যাগটা উপুড় করে ঢালতেই দুই সেট সেলোয়ার-কামিজ ও এক মুঠ নীল রঙের কাচের চুড়ি বের হলো। কাচের চুড়ির মুঠ সে নিজের টাকা দিয়ে কিনছে ছোট বোনের জন্য। কাচের চুড়ি দেখলে ও অনেক খুশি হবে। শুভর কাছে বললো শুভ কিনে দিতো। তাহলে নিজের জমানো টাকা দিয়ে প্রিয়জনের মুখের হাসিটা দেখা হতো না। মাঝে মাঝে ফুলের চাচা যে টাকা দেয় তা ফুল জমিয়ে রাখে। সেই টাকা দিয়ে বাড়িতে লেইস ফিতা ওয়ালা এলে লুকিয়ে একটু একটু করে অনেক কিছু কিনে রাখে। বাড়ি ফেরার সময় ছোট বোনটার জন্য নিয়ে যাবে বলে। চুড়ির মুঠটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগো। ততক্ষণাৎ সোহেলী বেগম ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে মেঝেতে আছাড় মেরে চেচিয়ে বললো,
‘আমার পোলার টেকা দিয়া এই কাম করোস? তোর মায় আমার দেওরে বশ করছে। তুই আইছোত আমার পোলারে করতে।’
ফুলের কানে চাচীর কথা ঢুকলো না। সে এক দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠায় বসে কাচের চুড়িগুলো রিনঝিন শব্দ করে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে দেখলো। চুড়িগুলো নয়, যেনো ফুলের উৎফুল্ল হৃদয়টা ভেঙে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেলো। সাথে ছোট বোনের তৃপ্তির হাসিটাও এক ঝটকায় মিলিয়ে গেলো।
#চলবে