গোধূলির রাঙা আলোয় পর্ব – ০৫

0
370

#গোধূলির রাঙা আলোয়
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৫

তুই না থাকলে জানি না কোথায় যেতাম আমি।

এভাবে বলিস না তিয়াসা, তুই আমার একমাত্র বেস্টফেন্ড। তোর পাশে দাঁড়াতে পেরে নিজেরই ভালো লাগছে রে।

এখন একটা জবের ব্যবস্থা করতে হবে তাড়াতাড়ি।

তোর অভিজ্ঞতা আছে, পেয়ে যাবি প্রবলেম হবে না আর যতদিন না পাচ্ছিস আমি তো আছি।

তিয়াসা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো তোরার দিকে। তোরা তিয়াসার বেস্টফেন্ড। সেদিন রাতে মুগ্ধর অপমান সহ্য করতে না পেরে তোরাকেই কল দিয়েছিলো তিয়াসা। একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিলো। তোরা মেয়েটা অনেকটা ছেলেদের স্বভাবের। নিজের ইচ্ছে মতো চলতে পছন্দ করে, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি করা, আড্ডা দেওয়া, মারামারি করা এসবই পছন্দ তার। এজন্য তার মেয়ে বন্ধু নেই খুব একটা। তোরা তিয়াসাকে একদিন বাঁচিয়েছিল বখাটেদের থেকে। তারপর থেকেই তিয়াসার সাথে তোরার বন্ধুত্ব। পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ হওয়ায় অনার্স শেষ করে উঠতে পারেনি এখনো। হোস্টেলে থাকা তার জন্য সম্ভব না তাই একটা ফ্ল্যাটে থাকে একাই। তিয়াসাকে নিয়ে সেখানেই যাচ্ছে।

তোরা হঠাৎ বললো, আমরা আগামীকাল সাজেক যাচ্ছি ট্যুরে, পাঁচদিনের ট্যুর।

তিয়াসা বললো, আমি কোথাও যাবো না রে।

তোর কাছে জানতে চাইনি যাবি কিনা। আমি তোর জন্য টাকা দিয়ে দিয়েছি এখন আর ফেরত নেওয়া যাবে না। আর আমি চলে গেলে একা থাকবি কী করে ? তাই কোনো কথা হবে না, তুইও যাচ্ছিস৷ তোর মনটাও একটু ভালো হবে। আমি দু’জনের জন্য মার্কেটও করে ফেলেছি।

তিয়াসা আর কিছু বললো না, চুপ করে তোরার কথা শুনলো। তোরা একবার যেহেতু বলেছে এখন আর হাজার বার না করলেও কাজ হবে না। একটু আগে তোরাই তাকে নিয়ে এসেছে মুগ্ধর বাড়ির সামনে থেকে। তিয়াসা নিজের জিনিসপত্র আগেই তোরার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। এখন তোরার বাইকের পেছনে বসে আছে তিয়াসা। মেয়েটা ভালো বাইক চালাতে পারে। মাঝে মাঝে শুধু বাইক নিয়েও ট্যুরে চলে যায়। তিয়াসা ভেবে পায় না একটা মেয়ের এতো সাহস হয় কী করে ? তিয়াসা হঠাৎ খেয়াল করলো তোরা বাসার রাস্তায় না গিয়ে অন্য রাস্তায় যাচ্ছে।

কী রে এদিকে কোথায় যাচ্ছিস ?

তোরা বললো, বাসায় রান্না করিনি কিছু আর তুইও কিছু খাওয়ার অফার করলি না। যতই হোক পার্টি ছিলো মুগ্ধ ভাইয়ের বাড়িতে। এখন দিকে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানে যাবো ডিনার করতে।

তিয়াসা কিছু না বলে চুপ করে গেলো। মুগ্ধর কথা খুব মনে পরছে। হয়তো ঘন্টা খানিক হবে তাকে দেখেছিলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কতদিন হয়ে গেছে দেখে না। সারাজীবন না থেকে কীভাবে কাটাবে সেটা ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে।

তিয়াসা আনমনে বললো, একই শহরে থেকে পারবো তো নিজেকে তার থেকে দূরে রাখতে ?

নিজেকে করা এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তিয়াসার।

তোরা আর তিয়াসা ডিনার করে বাসায় চলে গেলো। যদিও তিয়াসার গলা দিয়ে খাবার নামেনি। তোরা সেটা খেয়াল করেও বেশি কিছু বলেনি৷ বাসায় এসে তোরা তিয়াসাকে ওর রুম দেখিয়ে দিলো। ফ্ল্যাটে দুটো বেডরুমের সাথে এটাচ ওয়াশরুম, একটা ড্রয়িংরুম, একটা কিচেন আর একটা ছোট রুম আছে সেটা তোরা স্টোররুম হিসাবে ব্যবহার করে। তিয়াসা আগেও এখানে এসেছে তাই তাকে দেখানো রুমে চলে গেলো। জামাকাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে গেলো আর শাওয়ার নিতে লাগলো। পানির সাথে চোখের নোনাজল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কান্নার কোনো শব্দ হচ্ছে না তবে চোখের ঝর্ণা বয়ে চলেছে অবিরাম।

কান্নাভেজা গলায় বললো, এবার আপনি খুশি তো মুগ্ধ ? একই শহরে থেকেও আজ আমি আপনার থেকে অনেক দূরে। আর কখনো আপনার সামনে যাবো না।

৫.
ভালোবাসা উপলব্ধি করার জন্য হলেও দুরত্ব প্রয়োজন। এই দেখো না, তুমি যখন আমার পাশে ছিলে বুঝতেই পারিনি এতোটা ভালোবাসি তোমাকে। আজ মাত্র দুদিন হলো তুমি আমার কাছে নেই কিন্তু মনে হচ্ছে যেনো কত যুগ পেরিয়ে গেছে তোমাকে দেখি না।

তিয়াসার ছবির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে মুগ্ধ। মেয়েটা কখনো জানতেই পারলো না অপর পাশের মানুষটাও তাকে এতোটা ভালোবাসে। সেই রাতে শুদ্ধ মুগ্ধকে নিয়ে শহরের প্রতিটা অলিগলি খুঁজেও তিয়াসার খোঁজ পায়নি৷ শহর থেকে বাইরে যাওয়ার বাস, ট্রেন, লঞ্চ এমনকি এয়ারপোর্টেও খোঁজ নিয়েছে। কোথাও পায়নি তাকে, মুগ্ধ ভেঙে পড়েছে একদম। আনোয়ারা বেগমের আদেশে মুগ্ধ তিয়াসাকে একটা ফোন কিনে দিয়েছিলো সেটাও রেখে গেছে, তাই ফোনেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে পারেনি। শুদ্ধ নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাল ছাড়েনি। মুগ্ধ যেমন হাসিখুশি তেমনি ইমোশনাল। একটুতেই অনেক ভেঙে পরে। শুদ্ধ সবদিক সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। উৎসা শুদ্ধের এমন দ্বায়িত্বশীলতা দেখে বারবার তার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধর কথায় তামান্না আর উৎসা হোস্টেলে যায়নি। বাড়ির অবস্থা ভালো নয় তাই ওরাও থেকে গেছে।

শুদ্ধ নক না করেই মুগ্ধর রুমে ঢুকে পরলো মুগ্ধকে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, খাবি চল।

ক্ষিদে নেই।

মা বললো দুপুরেও কিছু খাসনি, অফিসেও যাচ্ছিস না দুদিন ধরে।

ভালো লাগছে না কিছু।

আমি তো বলেছি তিয়াসাকে খোঁজে দিবো, আমাকে একটু সময় দে।

দুদিন কেটে গেছে এখনো কিছুই জানতে পারিসনি তুই।

নিজের ইচ্ছেতে যে হারিয়ে যায় তাকে খোঁজ পাওয়া সহজ নয় মুগ্ধ। তবু আমি যখন কথা দিয়েছি সেই কথা আমি যেভাবেই হোক রাখবো।

মুগ্ধ কিছু না বলে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো শুদ্ধর দিকে। মুগ্ধ ঠিক যতটা ইমোশনাল শুদ্ধ ঠিক ততটাই শক্ত মনের মানুষ। সে একা হাতে পরিবারটা সামলে রেখেছে এই অবস্থায়। মিশু আর আনোয়ারা বেগম তিয়াসাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলো তাই তারাও ভেঙে পরেছে, আনোয়ারা বেগম একটু বেশি। ছেলেমেয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে বৌমাকে পেয়ে তার একাকিত্ব দূর হয়েছিলো। বড্ড নির্ভরশীল হয়ে পরেছিলো মেয়েটার উপর। তার কখন কী চাই সেটা না বলতেই বুঝে যেত মেয়েটা।

আনোয়ারা বেগম গম্ভীর মুখে বসে আছে ডিনার টেবিলে শুদ্ধ এক প্রকার জোর করেই মুদ্ধকে সাথে নিয়ে এলো। কাজের লোকের রান্না খেতে পছন্দ করে না এ পরিবারের কেউ, তাই আজকের রান্না উৎসা করেছে। উৎসা আর তামান্না মিলে খাবার সাজিয়ে নিচ্ছিলো তখনই শুদ্ধ মুগ্ধকে নিয়ে টেবিলে এলো। উৎসা বেশ অবাক হলো কারণ দুপুরে সবাই অনেক চেষ্টা করেও মুগ্ধকে খাওয়াতে পারেনি। দুই ভাইয়ের ভালোবাসা দেখে আবারও মুগ্ধ হলো উৎসা। এমন একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখতো সবসময় কিন্তু তার ভাগ্যে সেটা মেলেনি।

আনমনে খাবার মুখে দিয়ে হঠাৎ আনোয়ারা বেগম বলে উঠলো, বৌমা তুমি জানো না আমি বেশি মসলার খাবার খাই না।

সবাই কেবল খাওয়া শুরু করেছিলো আনোয়ারা বেগমের কথায় সবাই থম মেরে গেলো। এদিকে উৎসা অস্বস্তিতে পরে গেলো।

আমতা আমতা করে বললো, আসলে আন্টি আমি জানতাম না আপনার কী পছন্দ।

আনোয়ারা বেগমের হুঁশ ফিরলো এবার। টলমলে চোখে তাকালো উৎসার দিকে।

ভেজা গলায় বললো, মেয়েটা যদি চলেই যাবে তবে এতো বদঅভ্যেস কেনো বানিয়ে দিয়ে গেলো, এতো মায়ায় কেনো জড়িয়ে দিয়ে গেলো ?

মুগ্ধ মাথা নিচু করে বললো, সব আমার জন্য হয়েছে মা। সবকিছুর জন্য আমি দ্বায়ী। বুঝতে পারিনি এভাবে চলে যাবে।

আনোয়ারা বেগম তাকালেন ছেলের দিকে। দুদিনে কী হাল হয়েছে চেহারার।

তুই কী সত্যি ভালোবাসতি না তিয়াসাকে ?

বাসতাম।

আনোয়ারা বেগম এবার অবাক হয়ে বললো, তাহলে এসবের মানে কী ?

চলবে,,