গোধূলির রাঙা আলোয় পর্ব – ১১

0
315

#গোধূলির রাঙা আলোয়
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১১

“যেদিকে কান পাতি কেবল হৃদয় ভাঙার শব্দ দূষণ
হারানোর যন্ত্রণায় নাক জ্বালানো হৃদয় পোড়া গন্ধ বাতাসে
চোখ দেখে চারদিকে শুধুই প্রিয়জনের শূন্যতা
স্বপ্নের শহর জুড়ে আজ কেবলই তিক্ততা”

কেটে গেছে আরো কিছু মাস। ভার্সিটির ক্যাম্পাসে একটা গাছের নিচে বসে আছে উৎসা আর তামান্না। তামান্নার মুখখানা কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। উৎসার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে রহস্যময় হাসির রেখা।

উৎসা হাসিটা বজায় রেখেই বললো, আমার প্রাপ্তির খাতা বরাবরের মতোই শূন্য পড়ে রইলো রে তাম্বু।

তামান্না অসহায় দৃষ্টিতে উৎসার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি তোকে মানা করেছিলাম উৎসা।

মানা কেনো করেছিলিস বল তো ? তুই জানতিস না নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষন বেশি মানব জাতির।

তামান্না বললো, তুই কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রাম ফিরে যা। সব মিটে গেলে আবার ফিরে আসিস আর এবার আমরা হোস্টেলেই উঠে যাবো কারো কথা শুনবো না।

উৎসা তামান্নার দিকে তাকিয়ে বললো, কার কাছে যাবো বলতো ? মায়ের কাছে নাকি বাবার কাছে ? তোর কী মনে হয় তাদের কাছে গিয়ে আমার কষ্ট কমবে নাকি বাড়বে ? তাদের নতুন জীবনে, নতুন সংসারে আমি তো আগাছা মাত্র।

তামান্না অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো উৎসার দিকে। উৎসার কেমন লাগছে জানে না তামান্না, তবে তামান্নার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সেই নার্সারি থেকে উৎসার সাথে আছে তামান্না। তার জীবনের প্রতিটা বিষাক্ত অধ্যায় তার জানা। এতো কষ্ট তার বুকে চাপা থাকলে হয়তো দম বন্ধ হয়ে মারা যেতো। তামান্নার হঠাৎ করেই উৎসাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে তুই বেঁচে আছিস কী করে ?

তবে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মুখে বললো, চল বাসায় যেতে হবে। ক্লাস শেষ হয়েছে সেই কখন।

উৎসা বললো, যেতে ইচ্ছে করছে না।

তবু তো যেতে হবেই।

তামান্না উঠে দাঁড়ালো আর উৎসাও দাঁড়ালো। কয়েক কদম এগিয়ে গেলো, তামান্নার ঠিক পেছনেই উৎসা। হঠাৎ উৎসার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলে দাঁড়িয়ে গেলো উৎসা। নিজেকে সামলে নিলো দ্রুত। নাকের কাছে ভেজা অনুভব হতেই হাত রেখে সামনে এনে দেখলো লাল টকটকে রক্ত। চমকে উঠলো উৎসা তবে তাড়াতাড়ি মুছে নিলো যাতে তামান্না দেখতে না পায়।

পেছনে উৎসা নেই বুঝতে পেরে তামান্না পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো, কী রে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ?

উৎসা কাঁপা গলায় বললো, আসছি।

বাসায় গিয়ে বুঝতে পারলো অনুষ্ঠানের আমেজ। আজ সন্ধ্যায় এরিশা আর শুদ্ধর এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান।

আনোয়ারা বেগম দু’জনকে দেখে বললো, তোদের আজ একটু তাড়াতাড়ি আসতে বলেছি আজই তোরা দেরি করে এসেছিস।

তামান্না আমতা আমতা করে বললো, আজ এক্সট্রা ক্লাস ছিলো তাই লেট হয়ে গেছে।

আনোয়ারা বেগম তাড়া দিয়ে বললো, এখন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে আমাকে সাহায্য কর। তিয়াসার এই অবস্থায় নিজের চলাফেরা কষ্ট ও কিছু করতে পারছে না।

তামান্না মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে উৎসার সাথে রুমে চলে গেলো। তিয়াসা আট মাসের প্রেগনেন্ট। এরিশারা আজই দেশে ফিরছে আর আজই এনগেজমেন্ট ঠিক করা হয়েছে।

চেম্বারে চেয়ারে মাথা হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে শুদ্ধ। সবার কাছে নিজের অনুভূতিগুলো আড়াল করে রাখলেও নিজের কাছে কীভাবে আড়াল করে রাখবে। এতদিন নিজেকে মিথ্যা বুঝিয়ে এসেছে উৎসাকে সে ভালোবাসে না। উৎসার প্রতি তার একটা মায়া কাজ করে শুধু এটুকুই। কিন্তু আজ যখন আনোয়ারা বেগম এরিশার সাথে এনগেজমেন্টের কথা জানালো তখন থেকে ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বারবার উৎসার মুচকি হাসি লেগে থাকা মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। শুদ্ধ অসুস্থতার কথা বলে হসপিটাল থেকে আগে বের হয়ে গেলো। বাসায় না গিয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা চলে গেলো পার্কে। নিরিবিলি জায়গা দেখে একটা বেঞ্চে বসে পড়লো।

সকালে বের হওয়ার আগে আনোয়ারা বেগম তাকে থামিয়ে বললো, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে শুদ্ধ।

শুদ্ধ দাঁড়িয়ে গেলো মায়ের কথা শুনে, হ্যাঁ বলো।

সন্ধ্যায় বাসায় পার্টি আছে। তোমার বাবা আজ ফিরছে আর এরিশারাও। আমি চাইছি আজই তোমাদের এনগেজমেন্ট সেরে ফেলতে। ওরা সবটা গুছিয়ে উঠলে সামনের মাসে তোমাদের বিয়ে হয়ে যাবে।

শুদ্ধ চকিত গলায় বললো, এনগেজমেন্ট ?

এভাবে অবাক হওয়ার কী আছে ? তোমাদের আগেই জানানো হয়েছিলো এরিশা আর এরিনার সাথে তোমাদের বিয়ের কথা। মুগ্ধর ক্ষেত্রে আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। তবে তুমি আমাকে নিরাশ করবে না সেই বিশ্বাস আমার আছে।

শুদ্ধ বললো, মা সেটা কেবলই মজার ছলে বলেছিলে।

আনোয়ারা বেগম গম্ভীর গলায় বললো, তোমাদের সামনে মজার ছলে উপস্থাপন করা হলেও আমরা বিষয়টা নিয়ে আগে থেকেই সিরিয়াস ছিলাম। কিন্তু এখন তোমার প্রবলেম কোথায় সেটা বুঝতে পারছি না। এরিশা সুন্দরী, ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করেছে, ভালো ফ্যামিলির মেয়ে তাহলে প্রবেলম কোথায় হচ্ছে ?

শুদ্ধ বললো, মা চাইলেই এভাবে হুট করে বিয়ে করা যায় না। এরিশাকে আমি হাতে গোনা কয়েকবার দেখেছি মাত্র। চিনি না জানি না এভাবে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না। এটা উনবিংশ শতাব্দী নয় মা।

আনোয়ারা বেগম রাগী গলায় বললো, এখনই তো বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে না, শুধু এনগেজমেন্ট হচ্ছে। দু’জন দু’জনকে জানার জন্য একমাস সময় পাচ্ছো তো তোমরা। শুদ্ধ তুমিও যদি মুগ্ধর মতো আমাকে সবার সামনে ছোট করো সেটা আমি কিছুতেই মানতে পারবো না। হসপিটাল থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসো।

শুদ্ধ আর কিছু না বলে সকালে বের হয়ে এসেছিলো বাসা থেকে। শুদ্ধ ডাক্তারি শেষ করে দেশে ফেরার পর বাসায় পার্টি দেওয়া হয়েছিলো। প্রায় সব আত্নীয় স্বজনরা এসেছিলো আর এরিশারাও ছিলো। তখনই গল্পের মাঝে এরিশার সাথে শুদ্ধর আর এরিনার সাথে মুগ্ধর বিয়ে কথা হয়। তবে সেটা সেই পার্টি পর্যন্তই ছিলো তারপর আর এ নিয়ে কথা হয়নি কখনো। সেসব শুদ্ধ ভুলে গেছে সেই কবে। এখন কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। মাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে তাকে কষ্ট দিতে পারবে না। অন্যদিকে উৎসা, সে তো আগে থেকেই কষ্টের সাগরে ডুবে আছে। তাকে সেখানে থেকে টেনে তুলার বদলে আরো ডুবিয়ে দিতে পারবে না। উৎসার সম্পর্কে সবই জানা হয়ে গেছে শুদ্ধর। প্রকাশ না করলেও শুদ্ধ জানে উৎসা তাকে কতটা ভালোবাসে, তবু কখনো প্রশ্রয় দেয়নি। শুদ্ধ নিজের চুল আঁকড়ে ধরলো দু’হাতে। কী করবে সে বুঝতে পারছে না। সব দিকের রাস্তা বন্ধ হয়ে আসছে তার।

১৬.
রাত প্রায় ন’টা বাজতে চললো শুদ্ধর দেখা নেই এখনো। এরিশা আর তার পরিবার সাতটার দিকে চলে এসেছে৷ শুদ্ধর বাবাও চলে এসেছে তাদের এক ঘণ্টা পর। সবাই উপস্থিত হয়ে গেলেও আসল মানুষের খোঁজ নেই এখনো। উৎসা হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই নিজের রুমে শুয়ে আছে। মাথা ব্যাথার সাথে জ্বরের আগমন ঘটেছে আবার। ইচ্ছে না থাকলেও তামান্না সেজেগুজে নিচে দাঁড়িয়ে আছে মিশুর সাথে। মিশু অবশ্য তাকে ফেলে নতুন ভাবীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকলেও এবার সবার মধ্যে কানাকানি শুরু হয়ে গেলো শুদ্ধকে নিয়ে।

এরিশার মা দিলারা আনোয়ারা বেগমের কাছে গিয়ে বললো, আনু তোর ছেলে কোথায় ?

আনোয়ারা বেগম জোরপূর্বক হেসে বললো, মনে হয় কোনো ইমার্জেন্সিতে আটকে গেছে। চলে আসবে চিন্তা করিস না।

আনোয়ারার কথা বিশ্বাস করে অন্যদিকে চলে গেলো দিলারা। দিলারাকে চিন্তা করতে মানা করে আনোয়ারা বেগম নিজেই চিন্তায় শ্বাস নিতে পারছে না। তবে কী এই ছেলেও তার মানসম্মান ডুবিয়ে ছাড়বে ?

শুদ্ধর বাবা মাঈনুল সাদিক স্ত্রীর কাছে গিয়ে বললো, শুদ্ধ কোথায় আনু ?

আনোয়ারা বেগম অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, জানি না গো ?

মাঈনুল সাহেব সন্দেহাতীত ভাবে তাকিয়ে বললো, এসব করার আগে ছেলের মত নিয়েছিলে তো ?

আনোয়ারা বেগম কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মাঈনুল সাহেব সারাজীবন ব্যবসা বানিজ্য করে কাটিয়ে দিয়েছে। সংসারের সবদিক আনোয়ারা বেগমই সামলে নেয়। তাই কখনো তাকে নাক গলাতে হয়নি৷ ছেলেদের জীবনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তও সেই নিয়েছে, তবে তা কখনো ছেলেদের জন্য ভুল প্রমাণিত হয়নি। তবে কী আনোয়ারা বেগম প্রথমবারের মতো ছেলের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নিলেন।

উৎসা বেডে শুয়ে উপরের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। আত্নহত্যা মহাপাপ না হলে হয়তো সে অনেক আগেই আত্নহত্যা করতো। ইহকালের কষ্ট থেকে পালাতে আত্নহত্যা করতে পারলেও পরকালের কষ্ট থেকে পালাবে কী করে। ইহকালে কষ্টের আগুনে পুড়ছে আর আত্মহত্যা করলে যে পরকালে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে। তাইতো দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে বেঁচে আছে।

উৎসা কষ্ট করে বেড থেকে উঠলো। ধীর পায়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। এখানে দাড়িয়েই তো সে রাতের পর রাত শুদ্ধর সাথে গল্প করে কাটিয়েছে। যে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ তার সাথে কথা বলেছে সেই বেলকনিতে দাঁড়িয়েই কিছুদিন পর হয়তো এরিশার সাথে চন্দ্রবিলাস করবে, আর ভাবতে পারলো না উৎসা। মাথার ভেতরে প্রচন্ড ব্যাথা করে উঠলো। চোখ বন্ধ করে ব্যাথাটা সহ্য করার প্রয়াস করতে লাগলো। আবারো নাকের কাছে ভেজা অনুভব হলে হাত দিয়ে হাতটা সামনে এনে আবছা আলোয় দেখলো রক্তের চিহ্ন। হঠাৎ এমন কেনো হচ্ছে বুঝতে পারছে না উৎসা। সে মাথা ব্যাথায় ভুগছে তা কয়েকবছর হতে চললো, তবে কখনো তো এমন হয়নি। ইদানীং মাথা ব্যাথা করলে সহ্য করা কষ্টকর হয়ে উঠে তার জন্য, সাথে মাঝে মাঝেই জ্বর, ঠান্ডা, বমি বমি ভাব। দূর্বলতা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছে তবে এখন সেটা মনে হচ্ছে না। আজ আবার নাক দিয়ে রক্ত আসছে। একবার ভাবলো ডাক্তারের কাছে যাবে।

পরক্ষণে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, এতো মূল্যবান জীবনটা কার জন্য যত্নে রাখবি, তোর পথ চেয়ে কেউ বসে নেই উৎসা। এই পৃথিবীর বুকে তুই একটা আগাছা। আগাছা নির্মূল হওয়াই শ্রেয়।

গাড়ির হর্ণ কানে যেতেই নিচে তাকালো। শুদ্ধর গাড়ি ঢুকছে গেইট দিয়ে। গাড়িটা দেখে মুচকি হাসলো উৎসা।

বিড়বিড় করে বললো, এতো দেরি করলেন কেনো ডাক্তার সাহেব। আপনার জন্য যে কতগুলো মানুষ অপেক্ষায় বসে আছে। সে খবর কী আছে আপনার কাছে ? আচ্ছা আপনি কী একটুও ভালোবাসেননি আমাকে ? এতোটা অবুঝ তো নন আপনি, একটা মেয়ে আপনাকে ভালোবাসে আর সেটা আপনি বুঝতেই পারবেন না। মুখে না বললেও আপনাকে আমি কতটা ভালোবাসি সেটা প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে গেছি। আপনি সেটা না কখনো গ্রহণ করেছেন আর না করেছেন প্রত্যাখ্যান, কিন্তু কেন ?

চলবে,,,,