গোধূলির শেষ আলো পর্ব ৩৩+৩৪

0
900

৩৩+৩৪ শেষ
গোধূলির শেষ আলো?
পর্ব ৩৩
Writer Tanishq Sheikh Tani

আয়নার সামনে থেকে সরে এসে খাটে মাথা নত করে বসে নিরবে কাঁদছিলাম।তখনি আপা ঘরে ঢুকলো,
“- এই তানি! ফ্রেশ হয়েছিস?
দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে তানি বললো
“- হ্যাঁ! আপা।
“- কিছু হয়েছে? মন খারাপ কেন তোর?
“- আরে না! তেমন কিছুই না।কি বলতে এসেছ বলো?
“-সত্যি তো! খাবার বেড়েছি খেতে আয়।
“- হ্যাঁ! তুমি যাও আমি কাপড়টা পাল্টে আসছি।
“- আচ্ছা! মুনিয়া নিচে নেমে গেলো।তানি ওয়ারড্রোব খুলে একটা হালকা ধূসর রঙের ছাপার সুতি শাড়ি বের করে পড়ে নিল।তানির জন্য এই ঘরটা বরাদ্দ করে রেখেছে মুনিয়া।১বছর হলো মিরপুর ১ এ একটা ফ্লাট কিনেছে তানি।তার আগে এখানেই থাকতো।এই ঘরের সব জিনিস মুনিয়া তানির পছন্দের সাথে মিল রেখে তৈরি করেছে।বড় আপন এই ঘর তানির কাছে।তানি শাড়িটার আঁচল ঠিক করতে করতে ১৫ বছর আগের সেই দিনে ফিরে যায়।তানি নদীতে ডুবে মরার জন্যে নদীর পারে গিয়েও মরে নি তাজের কথা শুনে।তাজ এতোকিছুর পরেও তানিকেই চাই।একথা শোনামাত্র তানির মস্তিষ্কে তড়িৎ গতিতে একটা বিষয়েই খেলা করলো।” প্রতিশোধ নে তানি,প্রতিশোধ! তোর তো সব শেষই। মৃত্যু দুয়ারে এসে দাড়িয়েছিস।এমন কলঙ্কিত মৃত্যু আগে আল্লাহ তোকে এই পশুকে বধ করার মোক্ষম সুযোগ করে দিয়েছে।ছাড়িস না! ওকে।তানি নিশ্চুপ রয়ে গেলো।বুঝলো না কি করবে।তাজ জোর করে টানতে টানতে যখন কাজি অফিস নিয়ে যাচ্ছিল তানির একবার মনে হলো চিৎকার করে গায়ের লোকজন এক করে বলি এই সেই শয়তান! যে আমার স্বর্বস্ব লুটে নিয়েছে।আমার নাড়ি ছেড়া বুকের ধনকে নিষ্ঠুর ভাবে মেরেছে।” কিন্তু না! এতো সহজ শাস্তি দিলে তো হবে না।তাজকে যে উচিত জবাব দিতে হ্যাঁ উচিত জবাব।যে জবাবে তাজের মতো পশুদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হবে।এমন জবাব যেখানে তাজ মর্মে মর্মে বুঝবে অন্যায় করে কেউ বাঁচতে পারে না।তানি তখনি মনে মনে পরিকল্পনা করে এই ভাঙাচোরা শরীর আর জীবনটাকে নিয়ে শেষ খেলা খেলবে।সাপুড়ে যেমন বিন বাজিয়ে হাঁটুর নাচনে তাল মিলিয়ে সাপকে নাচিয়ে বশে আনে। তারপর ভেঙে দেয় বিষ দাঁত। তানিও তাজের বিষ দাঁত ভাঙবে।বিষ দাঁত ছাড়া সাপ যেমন তুচ্ছ তাজেও শক্তি ক্ষমতা হারিয়ে এ সমাজে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভোগ করবে।তবেই না শাস্তি পাবে।একবারে মেরে নয় তিলে তিলে মারবে তাজকে।সেই মতেই সব কষ্ট বুকে চেপে তাজের সামনে পাগলি বেশ ধারণ করেছে যদিও পাগলের চেয়ে কম ছিল না তানি।কি ছিল স্বাভাবিক থাকার মতো? অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গিয়েছিল। পুষ্পা বান্ধবীর দুঃসময়ে ছুটে আসে।তানি যে এতো নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হচ্ছে তা পুষ্পা আগেই আন্দাজ করেছিল কিন্তু তানি পুষ্পার কাছে নিজের কষ্ট দুঃখের কথা চেপে গিয়েছিল।যদিও শেষ সময়ে প্রিয় বান্ধবীকে নিজের বেহাল দশার কথা বলে আর তখনই পুষ্পা তানিকে বাবার বাড়ি কিছুদিন থেকে আসার পরামর্শ দেয়।কিন্তু তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে গেলো।পুষ্পা কেঁদে ভাসিয়েছিল বান্ধবীর এমন করুন অবস্থা দেখে।কিন্তু চাইলেও পাশে থাকতে পারে নি। কারন সেও অন্য বাড়ির বউ।তাজ কে বিয়ে করার পর তানির খোঁজ কেউ না নিলেও পুষ্পা নিয়েছিল।পুষ্পাকে তানি সব বলে দিলে পুষ্পাই তানিকে তাজকে শাস্তির দেওয়ার সঠিক অস্ত্র খুঁজে দেয়। ধুতরা ফুলের রসে যে বিষ থাকে তা তানি জানতো না।পুষ্পাই বলে দেয় এর রস অতিমাত্রায় সেবনে মানুষের প্রাণনাশের কারন হতে পারে।তবে তানি তাজকে মারতে রাজি নয়।শয়তান মেরে তার পাপের শাস্তি তানি নিতে চাই না।শুধু শয়তানকে তার পাপের শাস্তি দিতে চাই।তখন পুষ্পা বলে এর রসে মস্তিষ্কের বিকৃতি ও অন্ধ হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।তাজকেও অন্ধ করে দিক তানি।তানির এই কথাটা পছন্দ হয়।তাজের জন্য উচিত শাস্তি এটাই হবে।এই পৃথিবীর আলো কোনোদিন স্বাভাবিক ভাবে দেখতে পাবে না।একটু আলোর জন্য ছটফট করবে।পাগলের ন্যায় বেঁচে থাকবে।আব্বাস জোয়ার্দারের সামনেই সমস্ত কিছু করতো কিন্তু বেচারার বলার ক্ষমতাটুকুও ছিল না।যে ছেলেকে খারাপ পথে টেনেছে আজ তার পরিনতিও যে তাকেই স্বচক্ষে দেখতে হবে।তাজের শাস্তি প্রাপ্তির সাথে সাথে তানির জীবন সেই নদীর পাড়েই এসে থামলো।গলায় কলসী বেঁধে নেমে পড়লে কলঙ্কিত জীবনের পরিসমাপ্তির জন্য। কি লাভ এ জীবন রেখে? মূল্য কি এ জীবনের? সব তো শেষ সব!কি আঁকড়ে বাঁচবে তানি? নিজেকে স্বর্বস্বান্ত জ্ঞান করে বুক সমান পানিতে নেমে পড়ে ভর পূর্ণিমার রাতে।চাঁদের আলোয় তানি জলের ছায়ায় শেষবাবের মতো আবছা আলোতে নিজেকে দেখে ডুব দিতেই তখনই কেউ টেনে হেচরে উপরে তুলে আনে।
“- এই তানি! এ কি করছিলি তুই? পাথরের মূর্তির মতো গলায় কলসি বাঁধা তানি দাড়িয়ে থাকে।পুষ্পার কোনো কথায় যেন কানে ঢোকে নি।আদিল তাড়াতাড়ি গলা থেকে কলসী নামিয়ে নেয়।
“-পুষ্পা শব্দ করো না।লোকজন জেনে যাবে।তুমি ওর বান্ধবী তাই শেষবারের মতো দেখিয়ে নিলাম।আজকের পর এই গায়ে এই পরিবেশ ওর পা পড়বে না যদি আল্লাহ চাই।
“- আপা! ওরে আপনি আগের মতো করে দেন।আমি কাওরে কিছু কবান না।ওর ছায়ারও খোজ দিবান না কাওরে।আমার তানিরে বাঁচান আপা! পুষ্পা হুহু করে শাড়ির আঁচল চেপে কেঁদে ওঠে।
“- তুমি বাড়ি ফিরে যাও।নয়তো তোমাকে বাড়ি না পেয়ে তোমার স্বামী আবার আরেক কান্ড ঘটাবে।আমরা চলি!পরে তোমার সাথে যোগাযোগ করবো।
আদিলের সহযোগিতায় মুনিয়া তানিকে গাড়িতে উঠিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।পুষ্পা অশ্রুসজল চোখে গাড়িকে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখে নিজেও বাড়ির পথে হাটতে থাকে।মুনিয়ার জেরার মুখে পুষ্পা যখন কিছুই বলে না তখন মুনিয়া তানির দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।তানিকে সুন্দর জীবন দেওয়ার কথা বলতেই পুষ্পা কাঁদতে কাঁদতে সবটা খুলে বলে।মুনিয়া কোনো আশ্রমে রাখার চিন্তায় কথাটা বললেও কিছুদিন ধরে গোপনে তানিকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই মেয়েটার প্রতি টান অনুভব করে।এমন ধৈর্য কয়টা মেয়ের আছে এ সমাজে।এতো নির্যাতনের পরও মুখ থুবড়ে পড়ে নি।নিজের বিচার নিজেই করেছে। এতেও তো সাহস লাগে।যা মুনিয়া দ্বারাও হয়তো সম্ভব নয়।তানিকে কলসী সহ নদীতে আসতে দেখে মুনিয়ার গুপ্তচর মোবাইল করে সবটা জানাতেই মুনিয়া ছুটে আসে রাতের অন্ধকার উপেক্ষা করে।আদিল,পুষ্পাকেও ডেকে আনে গোপনে।তানিকে পৈতৃক নিবাসে নিয়ে এসে কিছুটা সুস্থ করে।স্বাভাবিক হতেই তানি দেয়ালে মাথা কোটে।পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদে। মুনিয়ার বাবা মাহমুদ সাহেবও এই অচেনা মেয়ের দুঃখে কাঁদে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।ঘুমের ওষুধ খেয়ে যেটুকু শান্ত থাকে তারপর আবার কান্না, চুল টেনে ছেড়া,আত্মহত্যার চেষ্টা সব করে।মুনিয়াও পড়েছে বিপদে।একদিকে অফিস অন্য দিকে এই মেয়ে।তার উপর আদিলের প্রতি না চাইতেও মনটা দূর্বল হয়ে যাওয়া।মেজাজ চড়ে গেলো অফিস থেকে বাসায় এসে তানির আত্মহত্যার চেষ্টা দেখে।রাগে ইউনিফর্মের বেল্ট দিয়ে দুটো বাড়ি দিয়ে মুখ চেপে ধরলো,
“- এই মেয়ে! এই এমন করিস কেন? কেন শান্তি দিস না।
“- আমাকে যেতে দেন।আমাকে মরতে দেন।কি জন্যি রাখেছেন? ছাড়ে দেন আমারে।
“- ছেড়ে দিলে কি করবি? বল! মরবি? এতো মরার শখ কেন তোর? তানির গালে কষে একটা চড় লাগিয়ে দেয়।
মাহমুদ সাহেব নিজের মেয়ের রাগ কে যথেষ্ট ভয় পাই।রাগলে ধারের কাছেও যান তিনি।কিন্তু আজ এলেন।
“- ও আম্মাজান! মেয়েটা অবুঝ। এমন করে মেরো না ওরে।
“- কিসের অবুঝ! ভং করে। ভং।আমারি ভুল হয়েছে ওরে এখানে নিয়ে এসেছি।মরতো ঐ জলে ডুবে।চল তোকে আবার দিয়ে আসি।চল! চল!
“- আম্মাজান থাক! থাক! ছাড়েন ওরে।ব্যথা পাইছে দেহেন ঠোঁট কেটে গেছে।
“- আব্বু! সামনে আসবে না তুমি?সরো! ওর মরার শখ আজ মিটিয়ে দিবো জন্মের মতোন।ওঠ! উঠিস না কেন? ওঠ তুই।তানির হাত ধরে টানতে থাকে।তানি খাট শক্ত করে ধরে বসে থাকে।মুনিয়ার এই রূপ দেখে মরার কথা ভুলে যায়।ভয়ে কাঁপতে থাকে।
“- কি রে! যাবি না মরতে? তোর মরার শখ আজ মিটিয়ে নিয়ে আসি চল!তোদের মতো মেয়ের মরাই উচিত? ইজ্জত গেছে তো সব গেছে।বাচলেই নাক কাটা যাবে।তোর জীবন কি ঐ স্বামী সন্তান ইজ্জতের উপর টিকে ছিল।নিজের বলতে কি কিছুই না তুই!তোর অস্তিত্ব কি!জন্মের পর কি অস্তিত্ব ছিল?তুই কি শুধুই অন্যের জন্য বাচবি? তুই তো তবুও নিজের অপরাধীর শাস্তি দিয়েছিস অন্যরা সেটাও পারছে না।কিছুটা শান্ত হয়ে বসে বলে,”-তানি জীবন কখনও একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে থেমে থাকে না।জীবনে বহু চড়াই উৎরাই আসে। তার মাঝেই বাচা শিখতে হয়।তোকে আল্লাহ বার বার মৃত্যু দুয়ার থেকে ঠেলে ফিরিয়ে দিচ্ছে। কেন সাইন বুজচ্ছিস না।সৃষ্টিকর্তা চাই না তুই পাপী হয়ে মরিস।সে তোর কাছে তার এই মজলুম বাদীর কাছে আরও কিছু প্রত্যাশা করে।এতো অবুঝ কেন হচ্ছিস বল? আবেগকে একপাশে রেখে বাস্তবতার মুখোমুখি হ।ঘুরে দাড়া। দেখিয়ে দে এই সমাজকে নারী আমি! দুঃখের মেঘ সরিয়ে নতুন সূর্য রশ্মি আনতে পারি।পারবি এমন হতে? বল!
“- আম্মা! থাক চুপ কর।ভয় পাইছে মেয়েটা।তানির কাছে গিয়ে তানির মাথায় হাত দিয়ে বলে মাহমুদ সাহেব,
“- মাগো! জীবনে এমন জটিল সময় বহু আসবে।তাই বলে নিজ হাতে জীবন নাশ করার কথা ভাববি? জীবন দেওয়া নেওয়ার মালিক তো উপরওয়ালা। তার হাতেই ছেড়ে দে জীবনটা।তার জন্যই না হয় বাকিটা জীবন বেঁচে থাক।তোর মেয়েটার কথা ভাব? সে কি তার মাকে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে দেখে শান্তি পাবে? মা রে! শয়তান আমাদের কতোভাবে জাহান্নামে নিতে চাইবে তাতে সায় দিবি তুই? ঐ মালিকের কি তোর প্রতি কোনো অধিকার নেই।যে এই জীবন দিলো তার প্রতি কি কোনো কৃতজ্ঞতা নেই তোর? ধৈর্য ধর মা! সে উত্তম প্রতিদানকারী! তোকে নিরাশ করবে না।যা নিয়েছে তার দ্বিগুন দেবে।শুধু তার উপর ঈমান রাখ।শয়তানের প্ররোচনায় তাকে দুঃখ দিস না।মানুষের জন্য তো কতোই বাচলি? কি পেলি বল? তারচেয়ে তার দেখানো পথে চল।নিজেকে শক্ত কর।পায়ের নিচের মাটি মজবুত কর।দেখবি এই দুঃখের ঘোর কেটে যাবে।বাবার কথা শোনার পরও তানিকে একদৃষ্টিতে ফ্লোরে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুনিয়া আবার হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,
“- আব্বু সরো! ওরে বুঝিয়ে লাভ নাই।ওর মতো অশিক্ষিত কোনোদিন বুঝবে না জীবন মানে কি?এই তুই ফাঁসি দে যা।দাড়া আমিই রশি টানিয়ে সেট করে দিচ্ছি। মুনিয়া ফ্যানের সাথে ওড়না বেঁধে ফাসির রশি ঠিক করতে লাগলো।
“- আপা! আমি মরবো না আপা!আমি বাঁচবো। আমার জন্য বাঁচবো। আমার অস্তিত্ব তৈরি করবো আপা! আমি আমার জন্য বাঁচবো আপা! তানি কান্নায় ভেঙে পড়ে।মুনিয়ার রাগ মাটি হয়ে যায় তানির আহাজারিতে।তানিকে জড়িয়ে মুনিয়াও কাঁদে। রক্তের কেউ না হয়েও তানি মুনিয়ার পরম আত্মীয় হয়ে ওঠে।তানিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়।সবাইকে অবাক করিয়ে দিনরাত এক করে সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়ে আসে।স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ তারপর ভার্সিটি শিক্ষাজীবন শেষ করে।কঠোর অধ্যাবসায় আর পরিশ্রমের কারনে জীবনের প্রথম বিসিএসেই উত্তীর্ণ হয়ে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়।আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি তানিকে।আল্লাহ ঠিকই তার এই বাদীর ধৈর্য্যের ফল দেয়।সম্মান, মর্যাদা, অর্থ কোনোকিছুর অভাব রাখে না।একটা সুন্দর জীবন উপহার দেয়।যদিও তানির কাছে এখনও এ জীবন ধূসর।তবুও বেঁচে আছে সব ভুলে এই বা কম কিসের?
তানির ভাবনায় ছেদ পড়ে মুনিয়ার ডাকে।ভাবনার ছাপ মুখশ্রী থেকে সরিয়ে নিচে নেমে আসে।আদিলের সাথে মুনিয়ার সম্পর্ক স্বামী স্ত্রী তে গড়াই তানির মধ্যস্থতায়।আদিল প্রায় আসতো তানিকে দেখতে।এই আসা যাওয়ার কারন যে শুধু তানি নয় তা তানি সহ বাকিরা বুঝলেও চুপ ছিল।কিন্তু তানি চুপ থাকতে পারে নি।মাহমুদ সাহেব তানিকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন।ছোট মেয়ে ভাবতেন।এমনকি মৃত্যুর আগে তানিকে নিজের সম্পদের অংশীদারও করে গেছেন তিনি।তানি প্রচন্ড শ্রদ্ধা করতেন এই মানুষটাকে।ভালোবাসে তানিও আব্বু বলে ডাকতো।তানি সেই আব্বুর সাথে পরামর্শ করেই মুনিয়ার সাথে আদিলের বিয়ে দেয়।মুনিয়া প্রথমে রাজি ছিল না কারন আদিলের বাবা মা এ বিয়েতে একচুল মত দেয় নি।আদিলকে ত্যাজ্য করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে যদি সে এই ডিভোর্সী, নিজের চেয়ে ৩ বছরের বড় মেয়েকে বিয়ে করে।কিন্তু আদিল হার মানে নি।পিতা মাতাকেও পর করে নি।ভালোবাসা পাওয়ার এমন সুযোগ হাতছাড়া করে নি।মুনিয়াকে রাজি হতে হয় আদিলের পাগলামীর কাছে হার মেনে।ভালোবাসা প্রাপ্তির খুশিতে সেদিন তানিকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিল মুনিয়া।আদিল এখানে থাকলেও মাসের একটা সময় পিতার মাতার কাছে গিয়ে থেকে আসে।আজও তারা মুনিয়াকে মেনে নেয় নি।ছেলের শ্বশুর বাড়ি একবারও পা দেয় নি।তবে নাতী নাতনি কে খুব আদর করে।তানি খাবার খেতে খেতে মুনিয়া আদিলের ভালোবাসার খুনশুটি দেখে পুরোনো কথা মনে করে মৃদু হাসে।তানির চোখে দেখা আদর্শ স্বামী এই আদিল।যার সব কিছু মুনিয়াকে কেন্দ্র করে।রাগ অভিমান,ভালোবাসা সব।খাবার শেষ হতেই মুনিয়ার মেয়ে আমাইরা স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে প্রিয় আন্টিকে দেখে জড়িয়ে ধরে।বিকেল পর্যন্ত চলে খালা ভাগ্নির আলাপন।তানিকে এ কদিনের সব কথা বলতে থাকে আমাইরা।তানি আমাইরার চুলে বিলি কাটতে কাটতে মনোযোগের সাথে শোনে সব কথা।ওদের আলাপের ব্যঘাত ঘটিয়ে মুনিয়া এসে আমাইরাকে ওর ঘরে পাঠিয়ে দেয়। আমাইরা যেতে না চাইলেও জোর করে বের করে দরজা লক করে দেয়।
তারপর চুপচাপ এসে তানির পাশে বসে,
“- কিছু বলবে আপা!
“- কি করে বুঝলি?
“- এই যে আমু কে জোর করে ঠেলে বের করে দিলে।
“- ওহ হ্যাঁ! পুষ্পা মোবাইল করেছিল কাল।
“- তাই! কেমন আছে ও? আমাকে আজ কথা বলিয়ে দাও না আপা? কতোদিন কথা হয় না ওর সাথে।
“- দেবো আজ নয় পরশু।আজ সজিব বাড়ি আছে।তোর খবর কেউ জানুক তা আমি বা পুষ্পা চাই না।তোর এই সাজানো জীবনে আবার ঐ ঝড় আসতে আমরা দেবো না।
“- হুমম।
“- তাজ নাকি পরশু মারা গেছে।রাস্তায় ওর লাশ পড়ে ছিল।সারাদিন তো বাজারের বট গাছের নিচেই পড়ে থাকতো কুকুর বেড়ালের সাথে।রাতও ওখানেই কাটতো।কাল কুকুর গুলোকে জোরে জোরে ডাকতে দেখে সবাই এগিয়ে গেলেই দেখে মরে পড়ে আছে।
“- ওহ! এটা জানাতে এসেছিলে বুঝি? ওর বাঁচা মরা নিয়ে জানার আমার কোনো আগ্রহ নেই আপা!
“- আসলে!!মুনিয়াকে আমতা আমতা করতে দেখে কেন যেন তানির হৃদপিণ্ডে কাঁপন ধরলো।চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো পরের কথা গুলো শোনার আশায়
“- কি আপা! বলো
“- খালিদ! খালিদ নামটা শুনে বুকের ভেতরের কাঁপন ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভাঙতে লাগলো সব।
“- কি হয়েছে ওনার! আপা বলো!
“- খালিদ ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে কাল।ডাক্তার নাকি বলেছে ওর কন্ডিশন বেশি সুবিধার না।তানি বর্তমান অতীত সব ভুলে যায়।সেই ১৫ বছর আগের তানির মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে মুনিয়ার হাত ধরে।
“- আপা আমাকে নিয়ে চলো আপা! আমার সব থেকেও কিছু নেই।সে ছাড়া আমি রিক্ত শূন্য আপা! একটিবার তাকে চোখের দেখা দেখবো আপা! নিয়ে চলো না।তানির কান্না শুনে বাড়ির সবাই উপরে এসে দরজা ধাক্কাতে লাগে।মুনিয়া দরজা খুলে দিলে আমাইরা ঘরে ঢুকে তানিকে কাঁদতে দেখে মাকে ইচ্ছামতো রাগ দেখায় আন্টিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে।তানির কান্না দেখে অনিচ্ছা স্বত্বেও খালিদকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি দেয় মুনিয়া।আদিল আমাইরাকে বুঝিয়ে বাড়ি রেখে তানিকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।পথে আদিল মুনিয়া অনেক বুঝিয়ে শান্ত করে তানিকে।তানি দৌড়ে খালিদের বেডের দরজার সামনে এসে থামে।ভেতরে ঢুকতে এতো সংকোচ হচ্ছে কেন তানি জানে না?এই মানুষটাকে একবার দেখতে চোখ দুটো অতৃপ্ত হয়ে আছে।আজ এতো কাছে তবুও তার কাছে যেতে এ কেমন জড়তা!এ কেমন দ্বিধা দন্দ্ব! তানি চোয়াল শক্ত করে লম্বা শ্বাস নিয়ে সাদা পর্দা সরিয়ে ভেতরে যেতেই বিস্মিত হয়।আধাপাকা মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ি মুখে,পুরোনো পাঞ্জাবি পড়া শুকনো শরীরটা নিয়ে সামনের বেডে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে খালিদ।সব কিছু অচেনা হলেও খালিদ কোনোদিন তানির কাছে অচেনা হবে না।উসকোখুসকো এলোমেলো চুলে আর মুখ ভর্তি দাড়িতে বয়স ৬০ এর কাছাকাছি লাগছে।কি করুন চেহারা হয়েছে মানুষটার।একসময় এই মানুষটার জন্য পাগল ছিল গায়ের মেয়েরা।কি সুপুরুষই না ছিলেন? তানি নিজেকে সংযত করতে চেয়েও পারলো না।খালিদের এমন দুরবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো।মেয়েলি স্বরের কান্নার আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলে তাকালো খালিদ।তারপর যা দেখলো তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।খালিদ হয়তো তানির মতোই অতীত বর্তমান ভুলে বসেছিল।তাইতো লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে অর্ধেক অকেজো শরীর নিয়ে মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে গেলো।তানি কান্না থামিয়ে থমকে গেলো।এ কি দেখছে! নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে খালিদকে একপাশে হেচড়াতে হেচড়াতে এগিয়ে আসতে দেখে। মুনিয়া আদিল তাড়াতাড়ি খালিদকে ওয়ার্ড বয়ের সাহায্যে বেডে শুইয়ে দেয়।খালিদ তখনও কেঁদে যাচ্ছে তানির দিকে হাত বাড়িয়ে।তানি দূরে সরে বাইরে মুখ করে চোখের জল লুকাতে থাকলো।

চলবে,,গোধূলির শেষ আলো?
পর্ব ৩৪(অন্তিম পর্ব)
Writer Tanishq Sheikh Tani

তানি জানালার বাইরে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে কোনাকুনি। চোখে শ্রাবনের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিধারা।দৃষ্টি ভিন্ন দিকে রইলেও মন খালিদের প্রতিটি কথার মাঝে হারাচ্ছে। আদিল সবটা খুলে বলে তানির ব্যাপারে।খালিদ দৃষ্টি অনড় রেখে সামনে দাড়িয়ে থাকা তানিকে দেখছে।ধূসররঙের জামদানি শাড়ির উপর হিজাব বাঁধা রমণীটাই যে একসময় খালিদের পরম আপন কেউ ছিল।আজ দুজনের মাঝে অসম দূরত্ব। তানির বদলে যাওয়ার কথা শুনে খালিদ মন থেকে খুশি হয়।মনে মনে নিজেকে তৈরি করে তানির থেকে দুরত্বে থাকার।খালিদ চাই না আবার তানির জীবনে কষ্টের দিন ফিরে আসুক।তানি সুখী হোক।তানির সুখের মাঝেই খালিদ নিজেকে সুখী ভাববে।নিজে নিজেই ভাবে সে কোনোদিন তানির যোগ্য ছিল না।কোনোদিন হবেও না।দাড়ি ভর্তি মুখে শুকনো ঠোঁটে এক চিলতে হাসি এনে তানিকে প্রাণ ভরে দেখে।এখন খালিদের মরেও শান্তি। আদিলকে কানে কানে কিছু বলতেই আদিল সংকোচে কিছুক্ষণ বসে তারপর উঠে তানির পাশে দাড়িয়ে তানিকে মৃদু স্বরে কিছু বলে।তানি তৎক্ষনাৎ উত্তর না দেওয়ায় খালিদের বুকটা ধড়ফড় করে।কিন্তু খালিদের খুশি তখনই দ্বিগুণ হয় তানির মাথা নাড়িয়ে সম্মতি সূচক ভঙ্গি দেখে।আদিল মুনিয়া বেড থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পুরো রুম টাতে নিরবতা নেমে আসে।খালিদের প্রতিক্ষার প্রহর তানি বাড়াতেই থাকে।খালিদ নিরবে শুধু দৃষ্টি মেলে প্রিয়ার প্রতিক্ষায় চাতকের মতো বসে থাকে।একসময় প্রতিক্ষার সমাপ্তি টেনে তানি খালিদের মুখোমুখি কিছুটা দূরে পায়ের কাছে মাথা নত করে বসে।খালিদ দুচোখ ভরে দেখে।এতোদিন মনের এককোনে যে অবাস্তব আশা নিয়ে ছিল তা বাস্তবে রূপ নেবে এ খালিদ স্বপ্নেও ভাবে নি।তাজ অন্ধ ও আধপাগল হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর তাজের বাবা মারা যায় শয্যাগত অবস্থায়।তখনই তানির নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টা পুরো গ্রামের সামনে আসে।তানির পরিবার কষ্ট পেলেও স্বান্তনা এটুকুই ছিল তাদের মেয়ে কলঙ্কের জীবনাবসান ঘটিয়েছে। মেয়ের শোক ভুলতে না পেরে পরের বছর তানির মা ব্রেন স্ট্রোক করে মারা যায়।তমিজ মিয়া এখনও বেচে আছে।ফয়েজ আর্মির কর্পোরাল পদে আছে।কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্টে আছে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে।তমিজ মিয়াও সেখানে থাকে। খালিদ তানির স্মৃতি বিজড়িত বাড়িতে থাকতে পারে নি।কাওকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।নতুন চেয়ারম্যান মকবুলের বাড়িতে টুকিটাকি কাজ করে মাথাগোজার একটু স্থান করে নিয়েছিল দু বেলা অন্ন সহ।এতোবছর সেখানেই ছিল খালিদ।তানির নিখোঁজ হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি প্রভাব যার উপর পড়েছিল সে হলো খালিদ।ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল।যতোদূর শরীরে কুলায় তার চেয়ে বেশি চেষ্টা করেছে তানির খোঁজ পাওয়ার জন্য। পুষ্পার বাড়িও কতো ধর্ণা দিয়েছিল কিন্তু সেও কিছু বলে নি।জোর করে একবেলা খাইয়ে হতাশ করে ফিরিয়ে দিয়েছিল।তানিকে খুঁজতে গিয়েই শরীর বেশি ভেঙেছে খালিদের।দিনরাত তানিকে খুঁজে পাওয়ার আশায় থাকতো।সবাই বলেছে হয়তো মরে গেছে।খালিদের বিশ্বাস হয়েও হতো না।মনে হতো আরেকটু খুঁজলেই সে তানিকে পাবে।জীবন কারো পরিশ্রম বৃথা যেতে দেয় না।খালিদের পরিশ্রম আজ সার্থক।সে তার তানিকে পেয়েছে।এই যে সামনে বসা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রমণীই তার তানি।খালিদ গলা ঝেড়ে নিজেকে শক্ত রেখে শতশহস্র জড়তা উপেক্ষা করে প্রিয়ার সাথে কথা বললো,
“- কেমন আছ তানি? তানি অনেক সময় নিয়ে উত্তর দিলো। খালিদ এই বিরতির মাঝে একটা কথাও বলে নি শুধু তানির চোখ, নাক,ঠোঁটের চিত্র একেছে মনের ক্যানভাসে।
“-আলহামদুলিল্লাহ! আপনি?
“- এখন আলহামদুলিল্লাহ। এখন আলহামদুলিল্লাহ কথাটা শুনে তানি ভ্রুকুচকে সামনে তাকালো।একদম চোখে চোখ রাখলো। তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে আগুন ঝরিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো খালিদকে,
“-নাটক করেন!তা আপনার ঘরনী কই! ডাকুন তাকে।
তানির রাগ দেখে খালিদ মৃদু হেসে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলো,
“- কেন! বিচার দিবা?আমি চরিত্রহীন,দায়িত্বজ্ঞানহীন এসব বলবে!
“- সবসময়ই বেশি বোঝেন আপনি।কথা কম বলেন।আপনার সাথে কোনো কথা নাই।তারে ডাকেন!
“- কাকে?
“- কাকে মানে? আপনার সহধর্মিণীকে ডাকুন! কেমন মেয়ে লোক স্বামীর এ হাল করে রেখেছে? ডাকুন তো তাকে।
“- নাই!
“- আনেন নি সাথে? তাহলে কে ভর্তি করালো?
“- মকবুল চাচা! সকালেই বিশেষ জরুরি কাজে বাড়ি চলে গেছেন।
“- তাহলে মোবাইল নাম্বার টা দিন।
“- কার নাম্বার দেবো?
“- আজব লোক তো আপনি? কার কি? আপনার স্ত্রীর!
“- তার নাম্বার তো জানি না।সে যে এখন আমার নেই। পেয়েও তাকে হারিয়ে ফেলেছি জনমের তরে।
“-মানে!
“- আমি বিয়ে করিনি আর তানি! তুমিই আমার প্রথম তুমিই শেষ।তোমার পর শুধু মৃত্যুই আমার সাথী।
তানি খালিদের কথা শুনে নার্ভাস হয়ে পড়ে।এতোক্ষনের গলার জোর এক নিমিষেই উবে যায়।গলা শুকিয়ে গলনালিতে কম্পন শুরু হয়।জিহ্বা আড়ষ্ট হতে থাকে।তানিকে নার্ভাস হতে দেখে খালিদ কথা পাল্টে অন্য কথা বলে।
“- তোমার কথা বলো? সাহেব কি করেন? বাচ্চা কাচ্চা কেমন আছে?
খালিদের এমন কথায় তানি মুহুর্তে ঘায়েল বাঘিনী হয়ে ওঠে। সব ভুলে খালিদের দুর্বল বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। খামচে ধরে বুকের চামড়া বুকের পশম সহ। খালিদের ব্যথা লাগলেও উহু! শব্দ করে না।
“-ডং করেন! ডং।আপনি ছাড়া আমি কিছু না জেনেও এসব বলতে পারলেন? কেঁদে একাকার করে ফেলে তানি।খালিদের মনে হয় এই তো তার অবুঝ যুবতী বউ।খালিদের বুকভাঙা কান্নার জোয়ার আসে চোখের কোনে।তানিকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছা করে আমিও আবার তোমার সাথে নদীর পাড়ে বসতে, তোমার হাতের ভাতমাখা খেতে চাই।কিন্তু পারে না বলতে।আবেগটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তানির চোখের জল মুছিয়ে দিতেই তানি খালিদের হাত ধরে সরিয়ে দেয়।
“- একদম আদর দেখাতে আসবেন না।আপনি এখন কেউ না আমার।দূরে সরুন।
“- আমি কি করলাম! আমি অচল মানুষ।তোমার কাছে যাওয়া কি এখন আর সাজে আমার?
খালিদের কথা শুনে তানি মাথা নিচু করে খালিদের বুকের উপর থেকে সরে আসে।
“- ভালোই ফটরফটর করতে পারেন।আমি কি রাণী ভিক্টোরিয়া নাকি যে এমন ভাবে বললেন?
“- কম কিসের? খালিদ মৃদু হেসে জবাব দিলো।
“- হু! হয়েছে। এখন বলুন মা কেমন আছে?
“- জানি না! তবে শুনেছি বেঁচে নেই।
“- মানে!
“- আমি তোমার শোকে ঐ বাড়িতে থাকতে পারিনি।সব জায়গায় তোমার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠতো।নিজের ভুলে শেষ হওয়া জ্বলন্ত ধ্বংস স্তুপে থাকতে পারি নি।বেড়িয়ে এসেছিলাম ঐ বাড়ি থেকে।মা তোমার উপর খুব অন্যায় করেছিল যা শোনার পর আমি মাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারিনি।অনেকবার আমাকে দেখার জন্য খবর পাঠিয়েছিল কিন্তু আমি যাই নি।কি করে যাবো? আমার যাওয়ার মতো পরিস্থিতিই ছিল না।এ গ্রাম ও গ্রাম শুধু পাগলের মতো তোমাকে খুঁজে ফিরেছি।যখন ফিরলাম মা মারা গেছে।আমার অসুস্থতা,ঘৃণা,ছন্নছাড়া জীবন তাকে অসুস্থ করে দেয়।মৃত্যুর আগে নাকি তোমার মায়ের হাত ধরে সব পাপ কবুল করে গেছেন।নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি শান্তি পান নি তানি।হয়তো পরকালেও আল্লাহ তাকে তোমাকে ব্যথা দেওয়ার দোষে কাঠগড়ায় তুলবেন।আমি সব দিক দিয়েই অর্কমা।না পারলাম তোমাকে সুখ দিতে না পারলাম নিজের মায়ের সুখের মৃত্যুর কারন হতে।কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বুক চেপে ধরে।চোখ মুখ কুঁচকে ব্যথায় নীল হয়ে ওঠে।তানি অজানা ভয়ে আৎকে ওঠে।খালিদের ব্যথা তানি নিজেও অনুভব করে পাগলের মতো কাঁদতে থাকে।
“- কি হলো আপনার? কষ্ট হচ্ছে? আদিল ভাই।তানি চিৎকার করে কেদে উঠতেই আদিল দৌড়ে ঢুকে দেখে খালিদ জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানছে।আদিল ডাক্তার কে ডাকার জন্য ছুটে গেলো।
“- তানি! আমার বুকের পাজর ভেঙে চুড়ে যাচ্ছে। তানি বুকটা একটু ডলে দাও না।নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তানি।মন ভরে তোমাকে দেখার সাধ আমার মিটবে না বুঝি আর।
“- থামুন আপনি! চুপ করুন।কিছুই হবে না আপনার।তানির খুব ইচ্ছা ছিল খালিদকে বলতে।আপনি আমাকে গ্রহন করবেন খালিদ?আপনার বুকে মাথা রাখার অধিকার দেবেন? কিন্তু সময় তানিকে বলার সুযোগ দিলো না।তানি কেঁদে কেঁদে খালিদের বুকে মালিশ করতে থাকে।তানির মনের ঘরে ঝড় উঠেছে।সব আশার প্রদীপ আজ নিভে যাবে।হারিয়ে যাবে চিরতরে। তবুও আশায় বুক বাঁধে। যদি ফিরে পাওয়া যায় তারে!
“- মিথ্যা স্বান্তনা দিও না তানি! আমি আমার অন্তিম সময়ে এসে পৌঁছেছি।তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সাধ টুকু পূরণ করে দাও।আমি তোমার হাত দুটো বুকের উপর জড়িয়ে রেখে মরতে চাই তানি।একটিবার এ সুযোগ দাও।ঐ দেখ আমার আকাশে গোধূলির শেষ আলো ক্রমশ নিভে যাচ্ছে।অন্ধকার নেমে আসছে।ঘোর অন্ধকার! আমার এ মরণ সুখের করে দাও তানি।তোমার হাতদুটো বক্ষে আমার রাখো।আমি সেই হাতখানি জড়িয়ে আমার অনন্ত সুখের নীড় বাঁধি।পরকালেও তোমায় যেন চেয়ে নিতে পারি।এবার দিয়েছি পরকালে না দেবো দহন জ্বালা।দাও তো সুখের বিদায় প্রিয়া এবার আমার যাবার পালা।আল্লাহ! সাক্ষী তুমি সে আমার।শুধুই আমার।তানির শত বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে খালিদ তানিকে মনের শেষ কথা বলে চলে গেল। অস্তমিত হলো গোধূলির শেষ আলো?

????সমাপ্ত???