#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৭
“কিন্তু তার সাথে এভাবে লুকোচুরি খেলে কি হাসিল করতে চাইছো তুমি, বিগ ব্রাদার?”
নির্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে হতাশা। মুখটা কেমন জানি ভার হয়ে যায়। গাম্ভীর্যের সাথে বলে ওঠে,
“আমার মনে হচ্ছে আমি বড় কোন ভুল করে ফেলেছি। তার মতো মেয়েকে আমি সন্দেহ করেছি। আমি মনে করেছি সে টে’রোরিস্ট টিমের সাথে যুক্ত। ট্রেনে থাকা সেই আই উইকনেসের স্কেচ অনুযায়ী তাকে সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু রাগিনী তাজরীন নামক মেয়েটিকে যত কাছ থেকে দেখেছি ততই অবাক হয়েছি। সে কখনো কারো প্রাণ নেওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। সে মানুষের জীবন বাঁচায়। এমন কি সে ছোট্ট একটা প্রাণীর জীবনও বাঁচাতে অস্থির হয়ে ওঠে। সে কখনো মানুষের চোখে ভয় দেখতে এমনটা করবে না।”
“তাহলে এখনো তুমি কি কারণে নিজেকে তার সামনে নিয়ে আসো নি? আমি কিন্তু অন্য কিছুর ইঙ্গিত পাচ্ছি।”
কথাটুকু বলেই সন্দেহের নজরে তাকালো নয়নতাঁরা। নির্জন চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। নয়ন জোর করে নির্জনের চিবুক ধরে তার দৃষ্টি নিজের সামনাসামনি করে। নির্জন যেন নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,
“কারণ পুলিশের প্রমাণ দরকার। আমরা প্রমাণে বিশ্বাসী। আমার বিশ্বাস বা ধারণাই কেউ বিশ্বাসী নয়। উই নিড প্রুফ।”
চোখ জোড়া সরু হয়ে আসে নয়নতাঁরার। ঠোঁট কামড়ে হেসে তার ভাইয়ের খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গাল দুটো টেনে বলে ওঠে,
“তোমার বাহানা তুমি নিজের কাছে রাখো। সামান্য আমার ধাক্কায় তুমি যেভাবে তাকে হাত দিয়ে আগলে ধরেছিলে সেটাও কি শুধুই তদন্ত সংক্রান্ত কারণে? এখন অন্তত এই কথা বলো না। তাহলে কিন্তু তদন্ত নামক শব্দটি লজ্জা পাবে।”
“বড্ড বেশি কথা বলতে শিখে গেছো তুমি, নয়ন। দেখি সরো। আমার কাজ আছে।”
বলেই নির্জন প্রসঙ্গ পাল্টাতে নয়নকে জোর করে তুলে দেয়। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নির্জন চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
“যেন আস্ত একটা আলুর বস্তা কোলে বসেছিল। পা দুটো একেবারে অবশ হয়ে গেছে।”
এবার অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় নয়নতাঁরা। সে না হয় দেখতে একটু গোলুমোলু। একটু গোলগাল। তাই বলে কি তার ভাই এভাবে কথা শোনাবে? এটা মানা যায় না। নয়ন তড়তড় করে বলে ওঠে,
“নিজেকে একবার দেখেছো? মনে তো হচ্ছে সুন্দরী মেয়েটার সেবা পেয়ে কয়েক বছর ধরে জিম করো না। ভুঁড়ি বাড়তে শুরু করেছে। দৈত্য, ডেভিল একটা।”
কথাটা শুনে নির্জন চটে গিয়ে নয়নের দিকে তেড়ে যেতেই দরজায় আবারও টোকা পড়ে। নির্জন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“ভেতরে এসো।”
মেহরাজ ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো। তার চোখ নয়নতাঁরার দিকে পড়া মাত্রই সে কিছুটা চমকে বলে উঠলো,
“মিস. আহমেদ! স্যারের প্ল্যানটা তাহলে কাজ করেছে।”
নয়নতা্ঁরা মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি চুপ করুন। আপনাকে যতবারই ফোন করেছি কোন কাজের কাজই হয়নি।”
“আমাকে বলে কী লাভ? স্যার আপনাকে ইচ্ছে করে কল ব্যাক করতেন না।”
নয়নতাঁরা বাঁকা হাসল এবার। সামনের ছোট ছোট চুলগুলোতে ফুঁ দিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বলল,
“তাতে কি এমন লাভ হয়েছে? আমাকে কী আঁটকাতে পেরেছে? সি! আমি দেশে এসে পড়েছি।”
মেহরাজ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ, যেমন বোন তার তেমন ভাই! কেউ কারোর থেকে কম যায় না।”
“কথা কম কাজ বেশি। আমি তোমাকে যা যা বলেছিলাম সেসব কি কালেক্ট করেছো?”
এবার নিরবতা ভেঙে মেহরাজের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে উঠল নির্জন। মেহরাজ একটা পেনড্রাইভ এগিয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গেই। আর এক নিঃশ্বাসে বলে,
“ইয়েস স্যার। এটা এয়ারপোর্ট আর তার আশেপাশের ক্যামেরাগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ।”
নির্জন পেনড্রাইভ হাতে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টি দিয়ে তার ল্যাপটপ খুঁজতে থাকে। বেডের বালিশের উপর ল্যাপটপের দিকে চোখ পড়তেই ইশারায় সেটা দেখিয়ে নয়নতাঁরাকে ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“ল্যাপটপ নিয়ে এসো।”
নয়ন ছুটে গিয়েই ল্যাপটপ নিয়ে আসে বেশ আগ্রহের সাথে। তার এসব তদন্ত দেখতে দারুণ লাগে। কেমন একটা উত্তেজনা কাজ করে। নির্জন এবার গিয়ে ঘরের উত্তর দিকের টেবিলটার উপর ল্যাপটপ রেখে চেয়ার টেনে বসে। জড়ো হয় মেহরাজ ও নয়নতাঁরা। পেনড্রাইভ কানেক্ট করে একের পর এক ফুটেজ বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখেও কোনোরকম সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না নির্জন বা মেহরাজের। আচমকায় চেঁচিয়ে উঠল নয়নতাঁরা। লাফিয়ে বলল,
“এই সিনটাতে স্টপ করো!”
তাড়াহুড়ো করে সিনটা স্টপ করল নির্জন। সিনটায় দেখার চেষ্টা করল আশেপাশে কিছু সন্দেহজনক আছে নাকি! কিছুই চোখে না পড়ায় ঘাড় বাঁকিয়ে নয়নের দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টির ধরণ দেখে বুঝতে সময় লাগলো না সে রায়ানের জন্য সিনটাকে স্টপ করতে বলেছে। সোজা হয়ে নির্জন আবারও স্টার্ট করতেই মুখটা ভার হয় নয়নতাঁরার। নির্জন ফুটেজ দেখতে দেখতে বলে,
“দ্যা গ্রেট ইন্সপেক্টর রায়ানকে দেখার সময় আমার। মুখটা বন্ধ রাখবে নয়ত নিজের ঘরে যাও। অনেকদিন নিজের রুমকে দর্শন দাওনি। রুমটা শান্তিতে আছে। রুমটাকে অশান্তি দিয়ে এসো।”
“ধুর! তুমি সবসময় এমন করো কেন বলো তো? জন্মের সময় মা তোমার মুখে মধু দেয়নি তাই না? মনে হয় নিমের রস দিয়ে গিয়েছিল। কি কিউট লোকটা! একবার মনোযোগ দিয়ে দেখো তুমিও প্রেমে পড়ে যাবা।”
ফুটেজ আবারও স্টপ করে নির্জন। থম মেরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। কঠিন সুরে বলে,
“আমি ছেলে, নয়ন।”
নির্জনের কন্ঠসুর আর কথা শুনে ঢক গিলে নয়নতাঁরা। তাই তো! তার ভাই তো ছেলে! ছেলে হয়ে ছেলের প্রেমে পড়লে ব্যাপারটা কেমন লাগে? ছিঃ ছিঃ! সে নিচু সুরে জবাব দেয়,
“আর একটাও কথা বলব না। প্রমিস!”
নির্জন এবার নিজের কাজে মন দেয়। একটা জায়গায় সিন স্টপ করে সে। তার তীক্ষ্ণ নজর পড়ে অভিরূপকে নিয়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে। তার গাড়ির সামনে হঠাৎ করেই একটা বাচ্চা ছেলের আগমন ঘটল। আর একটা মেয়ে তাকে খপ করে ধরল। সেখানে স্টপ করল সে। সিনটা বেশ দূরের। তাই মেয়েটার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। বেশ অস্পষ্ট! মুখটা অর্ধেক ঢাকা। দূর থেকেই অস্পষ্ট মুখটা দেখেই কেমন যেন অদ্ভুত লাগলো নির্জনের। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। কেমন চোখের ধরণটা চেহারা। আবারও ফুটেজ স্টার্ট করতেই এবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মেয়েটির মুখের কাপড় যখন নেমে গেল তখন চমকে উঠল নির্জন। সারা অঙ্গ কেঁপে উঠল। দ্রুত জুম করল মুখটার উপর। কাঁপতে থাকল টেবিলের উপর রাখা হাত। ঘেমে একাকার হলো এতটুকু সময়ের মাঝেই। মেহরাজ হতবাক হয়ে বলল,
“আরে ইনি তো রাগিনী তাজরীন!”
নয়নতাঁরা কিছুক্ষণ ড্যাপড্যাপ করে চেয়ে থাকে ফুটেজের দিকে। অতঃপর সেও জোরে বলল,
“হ্যাঁ। তাই তো। এটা তো সে! রাগিনী…”
“এটা অসম্ভব! এটা হয় না। রাগিনী এখানে উপস্থিত থাকতে পারে না।”
কাঠকাঠ গলায় বলল নির্জন। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। মুখটা এখনো অস্পষ্ট হলেও রাগিনীর মুখশ্রী সকলের কমবেশি চেনা। বিশেষ করে নির্জনের। যে ক্ষণে ক্ষণে রাগিনীর দিকে কতবার যে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকেছে তার ঠিক নেই। তাই রাগিনীর সঙ্গে অন্য কোনো মেয়েকে গুলিয়ে ফেলার সম্ভবনা নেই। মেহরাজ নিজেও অবিশ্বাস্য হয়ে জবাব দেয়,
“স্যার, কেন হতে পারে না? চোখের সামনে এই ফুটেজ কি মিথ্যে? এটা রিয়েল ফুটেজ।”
“হোক রিয়েল ফুটেজ। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এটা রাগিনী তাজরীন নয়। কারণ তাকে আমি সবসময় নজরে রেখেছি। এসময় সে একটা বাচ্চা ছেলেকে হসপিটালে ভর্তি করতে ব্যস্ত ছিলো। তার এখানে আসার সময় কোথায়? তার ফোনের লোকেশন এয়ারপোর্টের ধারের কাছেও নেই। আর মেয়েটার পোশাকে এতোটা ভিন্নতা। রাগিনী এমন পোশাক পড়েনি।”
“তাহলে এটা কে স্যার? রাগিনীর মতো কেন দেখতে? আমার তো মাথা আর কাজ করছে না।”
নয়নতাঁরা এতোক্ষণ চুপচাপ তাদের কথোপকথন শুনছিল। এবার যেন কথা বলার জন্য মনটা আকুপাকু করতে থাকল। ফট করে সে বলেই ফেলল,
“আরে ভুলে যাচ্ছো কেন? পৃথিবীতে জমজ শব্দটাও এক্সিস্ট করে।”
নয়নতাঁরার কথাগুলো অযৌক্তিক হলেও এবার টনক নড়ে নির্জনের। গভীর ভাবনায় ডুব দেয়। হাতটা মুঠো করে থুতনির কাছে রেখে চোখজোড়া স্থির রাখে ল্যাপটপে। একে একে মিলাতে থাকে সব হিসেব। যদিও বা রাগিনীর মতো আরেকজন থাকে তাহলে সে-ই কি রায়ানের গাড়ির ব্লা’স্ট ঘটিয়েছে? রায়ানের কথা অনুযায়ী সেও রাগিনীর মতোই দেখতে। একটু একটু করে হিসেব মিলিয়ে চলেছে নির্জন। ঘরে বিরাজমান পিনপতন নীরবতা। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নির্জন উঠে দাঁড়াল। চেয়ার ছেড়ে একটু দূরে পায়চারি করতে করতে বলল,
“যদি রাগিনীর মতো অন্য একজন মেয়ে এক্সিস্ট করে থাকে আর সে যদি রাগিনীর বোন হয় তাহলে প্রশ্ন অনেকগুলো বেরিয়ে আসছে। প্রথম প্রশ্ন, রাগিনীর জমজ বোন থাকলে রাগিনীদের সঙ্গে থাকে না কেন? দ্বিতীয়ত, ট্রেনে দুটো রাগিনী তাজরীন নামে টিকিট কাটা হয়েছিল। একজন রাগিনী আর অন্যজন রাগিনীর বোন হলে সে কেন রাগিনীর নামটা ইউজ করবে? আর দ্যা গ্রেট সাইকোলজিস্ট শাহ্ রাশেদের মেয়ে হয়ে সে কেন এই পুরো টে’রোরিস্ট চক্রের সাথে যুক্ত হবে? আর ফুটেজ দেখে যদি বিচার করি তাহলে মনে হচ্ছে মেয়েটা এখানে অভিরূপের গাড়ি থামানোর জন্য এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। হিসেব আরো গোলমেলে হয়ে গেল!”
মেহরাজের মাথা এবার ভনভন করে ঘুরছে। আর একটু হলেই যেন জ্ঞান হারাবে। নিজের মাথাটা ধরে নিয়ে একটু ঝাঁকুনি দেয় সে। নির্জন এবার থেমে থেমে বলে,
“মেহরাজ! একটা কাজ করে। শাহ্ রাশেদ সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ড সার্চ করো। বিশেষ করে উনার স্ত্রী যখন প্রেগন্যান্ট ছিলেন তখনকার সময়টা আমার জানা প্রয়োজন। আদেও কি দুটো জমজ মেয়ের জন্ম হয়েছিল?”
মেহরাজ মাথা নাড়ায়। রুম থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায়। নয়নতাঁরা চুপ করে তার ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া দেখে কিছুক্ষণ। নির্জন ধীর পায়ে বেডের দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মুখ নিচু করে বসে। দৃঢ় ও সুগভীর চোখটা নিমিষে বন্ধ করে। নয়নতাঁরা বুঝেছে এবার তার ভাইয়ের মনে এই মূহুর্তে কি চলছে। সে পা টিপে টিপে গিয়ে নির্জনের সাথে গা ঘেঁষে বসে। খপ করে নির্জনের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে বলে,
“কী ভাবছো এতো?”
“উফফ…নয়ন, এখনো আর উল্টাপাল্টা কোনো কথা বলতে এসো না প্লিজ!”
বিরক্ত হয়ে বলে নির্জন। নয়নতাঁরার কোনো হেলদোল হয় না। সে আগের মতোই থেকে বলে,
“তুমি তাকে নিয়ে ভাবছো তাই না? গিল্টি ফিল করছো?”
চোখ মেলে তাকায় নির্জন। দৃঢ় সুরে বলে,
“গিল্টি ফিল করার কী আছে?”
“তুমি বুকে হাত রেখে বলতে পারবে? যে সেই রাগিনী তাজরীনের দিকে তুমি কখনো মুগ্ধ হয়ে তাকাও নি? এটা তুমি জোর দিয়ে বলতে পারবে? যে তার প্রতি তোমার একটুও টান নেই? এটা তুমি কঠিন সুরে বলতে পারবে যে তাকে তুমি তোমার ভাবনায় কখনোই নিয়ে আসো নি? এটা বলতে পারবে, যে সে তোমার কাছে অন্য সব মেয়েদের মতোই? এটা বলতে কি তোমার কণ্ঠস্বর কাঁপবে না? যে তার সামান্য আঘাতে তোমার কিছুই যায় আসে না?”
“আমি বলতে পারবো না কখনোই যে তার প্রতি আমি মুগ্ধ ছিলাম না। সে সম্পূর্ণটাই মুগ্ধতায় ঘেরা আমার কাছে। আমি তার নিকটে গেলেই দুর্বল হয়ে পড়ি। হৃদয় কম্পন ধরে যায়। সে আমার সামনে থাকুক বা না থাকুক আমার ভাবনায় সবসময় তারই বিচরণ। সে আমার কাছে অন্য কোনো মেয়ের মতো নয়। তাকে আমার নিজের একান্ত জীবন্ত কাঠগোলাপ মনে হয়। যে আমার নিজস্ব। তার সামান্য আঘাতে না চাইতেও এই অবাধ্য মনে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এক গোধূলি বেলায় এসে এমন অঘটন কেন ঘটালো মেয়েটা?”
নয়নতাঁরা ঠোঁট টিপে হাসলো। তবে হাসিটা লুকিয়ে কিছুটা নরম গলায় বলল,
“তার আর কী দোষ বলো? সব দোষ তোমার মনের। অযথা তাকে দোষারোপ করছো কেন?”
এতক্ষণ যেন অন্য ঘোরের মধ্যে ভেসে ছিল নির্জন। নিজের ভাবনা ভাঙতেই মনে হলো সে বেশ কিছুটা দেরি করে ফেলেছে। গড়গড় করে এই বাচাল মেয়েটাকে অনেক কথা বলে ফেলেছে। মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। চোখে মুখে কঠিন ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে সে বলল,
“সরো তো। তোমার সাথে বকবক করে অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি।”
বলে নির্জন উঠে দাঁড়ায়। পা বাড়ায় বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পিছু ডাকে নয়নতাঁরা। মলিন সুরে বলে ওঠে,
“কেন যে ওমন সুইট একটা মেয়েকে সন্দেহ করলে কে জানে!”
“সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ ছিল। পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। এডিশনাল এসপি স্যারের বাড়ি যখন ব্লা’স্ট হয়। সেদিন রাতে রাগিনীর ফোনের লোকেশন স্যারের বাড়ির আশেপাশে ছিল। ফ্যাক্টরিতে ব্লাস্ট হওয়ার রাতেও তার লোকেশন ফ্যাক্টরির আশেপাশেই ছিল। আমি নিজের সন্দেহ দমিয়ে রাখতে পারিনি।”
“আজকে যখন প্রমাণ পেয়ে গিয়েছো তখন বলে দাও তোমার পরিচয় তাকে। বলে দাও তোমার উদ্দেশ্য কী ছিল। বলে দাও তুমি তা নও সে যেটা ভাবছে।”
“তার বিশ্বাস যে ভেঙে যাবে, নয়ন। আজকে সে আমায় বলেছিল, তার বিশ্বাস কখনোই না ভাঙতে। তাহলে সেও ভেঙে যাবে। সে তো আর আমাকে বিশ্বাস করবে না।”
নির্জনের কন্ঠে মলিনতা। যেন সে নিরুপায়। নয়নতাঁরা দমে না। আবারও বলে,
“হোক যা হওয়ার। সত্যিটা চাপা থাকে না। সে অন্য কোনোভাবে জানার আগে তুমি জানিয়ে দাও। বুঝিয়ে বলো।”
“বুঝবে না। তখন আমার প্রতি তার মনে ঘৃণা জাগবে।”
নয়নতাঁরার মুখটাও কালো হয় এবার। মিনমিন করে বলে,
“যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। শেষে তোমাকে পস্তাতে না হয়।”
রাতটা বেড়েছে। রাগিনীর ঘরে টিমটিম করে ল্যাপশিটের আলো জ্বলছে এখনো। উর্মিলার দেওয়া পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের পেশেন্ট সম্মন্ধে সব তথ্য ঘেঁটে দেখছে বেশ মনোযোগ দিয়ে। নিঝুম রাতে সে একা জেগে নেই অবশ্য। সঙ্গে রয়েছে তার ছোট্ট রিও। চুপটি করে রাগিনীর পাশে একমনে বসে রয়েছে লেট গুটিয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাগিনীর দিকে তাকাচ্ছে আর রাগিনীর কাজকর্ম দেখছে। যেন প্রতিজ্ঞা করেছে রাগিনী না ঘুমোলে সেও ঘুমোবে না। বিগত দুই ঘন্টা ধরে সব তথ্য জানার পর ক্লান্ত চোখে রিও এর দিকে তাকালো রাগিনী। তার ছোট্ট লোম ভর্তি মাথায় আলতো করে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,
“চোখে ঘুম নেই কেন সুইটি? অনেক বেজে গিয়েছে!”
রিও রাগিনীর দিকে একটু নিষ্পাপ চাহনি দিয়ে নিজের গা চুলকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাগিনী মুচকি হেঁসে তার পুরো শরীর বুলিয়ে দিতেই রিও উঠে এসে তার হাতের সাথে শরীর ঘষতে থাকলো। এবার বোধহয় ছোট্ট মহারাজের ঘুম পেয়েছে। রাগিনী তাকে কোলে নিয়ে আস্তে করে যত্নের সাথে সারা শরীর বুলিয়ে দিতে আরম্ভ করল। শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে ফাইল আর ল্যাপটপের দিকে খেয়াল করল। হাসতে চাইতেও মনটায় কেন যেন বিষণ্ণতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। কোহিনূর নামক ব্যক্তিটাকে এবার সন্দেহের নজরে দেখছে। তার বিশ্বাসের পরিণাম কি তবে বিষাক্ত হয়ে উঠবে? চোখমুখ জড়িয়ে আসে রাগিনীর। সৃষ্টি হয় মনের মাঝে অজানা এক ভয়ের। আঁতকে ওঠে। সে যে চায় না মানুষটা ভুল প্রমাণিত হক!
“কোহিনূর! আপনি কি নিজে ধরা দিচ্ছেন নাকি ভুল করে ধরা দিয়ে ফেলছেন নিজেকে? আপনি নাকি এক্সিডেন্ট করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাহলে তো নরমালি যানবাহন দেখে ভয় পাওয়া উচিত আপনার। কারণ যেখান থেকে পেশেন্টদের অসুস্থতার সৃষ্টি হয় সেটাই পেশেন্ট ভয় পায়। অথচ আপনি সেদিন গাড়ি সামলে নিলেন খুব সহজে। আপনার কথায় আমি সেই বাচ্চামো আর দেখতে পাই না। এসব কীসের ইঙ্গিত?”
কথাগুলো আনমনে আওড়াতে আওড়াতে রাগিনী দেখে রিও ঘুমিয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। সে খুব সাবধানে রিও কে বেডে রেখে হালকা করে গায়ের উপর চাদর তুলে দেয়। রিমোট দিয়ে এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে তার করা কোহিনূরের স্কেচের সামনে আসে। ল্যাম্পশিটের হালকা আলোয় জ্বলজ্বল করছে স্কেচ। সে একহাতে স্কেচটা স্পর্শ করে বলে,
“আপনাকে সন্দেহ করতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করে না। কিন্তু আপনার ব্যবহার আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। আপনি স্বাভাবিক মানুষ হলে অস্বাভাবিক পরিবেশে কেন এসেছেন? কী উদ্দেশ্য আপনার? নাকি বরাবরের মতো সব আমার হ্যালুসিনেশন? আমিই কি কোনো ট্রমার মাঝে আটকা পড়েছি? আবারও বলছি, কোহিনূর সাহেব! বিশ্বাসটাকে বিষে পরিণত করবেন না।”
রাত হলো। নিস্তব্ধতা বাড়লো। রাগিনীর ভাবনা কমলো না। ঘুম সহজে এলো না। একদিকে রাজ্য জুড়ে থাকলো কোহিনূর এবং বিশ্বাস। অন্যদিকে অবিশ্বাসের বীজ বুনে গেল তার মনের অভ্যন্তরে।
সকালবেলা। বদ্ধ ঘরে এসি চলছে। ঘরের ভেতর থাকা বিছানায় ঘুমন্ত নোমান ও অভিরূপ। নোমানের ঘুমও যা জেগে থাকাও তা। কারণটা হচ্ছে অভিরূপ। তার সাথে ঘুমানো বেশ মুশকিল ব্যাপার স্যাপার। বর্তমানে বিছানার ছোট্ট এক জায়গায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে নোমান। এসিতে ঠান্ডা লাগছে। উপায় নেই তবুও। ব্ল্যাঙ্কেট পুরোটা অভিরূপের কাছে। মাঝরাতে দুজন ব্ল্যাঙ্কেট নিয়ে তৃতীয় বি’শ্বযুদ্ধ লেগে অভিরূপ জিতে গিয়ে পুরোটা নিয়ে নিয়েছিল। নোমান অন্য কোনো ব্ল্যাঙ্কেট আনায় নি আর। সে জানে সেটাও অভিরূপের দখলেই যাবে। অভিরূপের ঘুমানোর স্টাইলটাও দেখার মতোই। হাত-পা ছড়িয়ে মাথা নোমানের পেটে উপর রেখে দেদারসে ঘুমাচ্ছে।
দরজায় টোকা পড়ল। নড়েচড়ে উঠল ঘুমন্ত দুজনই। নোমানের ঘুমটা বেশ হালকা হলো। পেটে ভারি কিছু অনুভব করল। বুঝতে সময় লাগলো না এটা অভিরূপের মাথা। পা উপরে তুলে অভিরূপকে পা দিয়ে হালকা লা’ত্থি মে’রে ঠেলে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টায় থাকলো সে। দরজায় আবারও টোকা পড়ল। নোমানের ঘুমটা এবার পুরোপুরি ভাঙলো। পাশ ফিরে দরজার দিকে তাকালো। অভিরূপ তখনো ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে ঘুমে আধম’রা। হঠাৎ ঘুমের মাঝেই চেঁচিয়ে সে গেয়ে উঠল,
“ও ক্রিং ক্রিং বাজে রে এই মনের কলিংবেল!”
নোমান উঠে বসলো এবার। অভিরূপকে পা দিয়ে আবারও জোরে ঠেলা মে’রে বলল,
“তোর মনে না। দরজায় কেউ বাজাচ্ছে।”
এবার জোরে জোরে দরজায় টোকা পড়ায় নোমান বিরক্ত হয়ে উঠে গেল দরজা খুলতে। সকাল সকাল সার্ভেন্ট গুলো রুম পরিষ্কার করতে চলে আসে। আর কোনো কাজ নেই বোধহয়। দরজাটা খুলেই না খেয়াল করেই নোমান অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে,
“এখনি আপনাদের রুম পরিষ্কার…. ”
কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায় এক অর্ধবয়স্ক লোককে দেখে। নোমান লোকটির আপাদমস্তক দেখে নেয়। পরনে ভেতরের সাদা শার্ট ইন করা। উপরে এ্যাশ কালার কোট। পায়ে দামি জুতো। হাতে দামি ঘড়ি। দেখেই মনে হচ্ছে ভদ্রলোক। নোমান বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,
“সরি। আমি ভেবেছিলাম…! যাই হোক। আপনাকে তো চিনলাম না আঙ্কেল।”
“হ্যালো ইয়াং ম্যান। আই এম শাহ্ রাশেদ। এটা অভিরূপের রুম না?”
চলবে…
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৮
“হ্যাঁ, এটা তো অভিরূপের রুম। বাট আপনাকে তো চিনলাম না আঙ্কেল।”
রাশেদ সাহেব প্রশস্ত হাসেন। ভরাট গলায় বলে উঠলেন,
“তুমি নোমান তাইতো? অভিরূপের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু?”
নোমান কিছুটা হতবাক হলো। সে আবারও রাশেদ সাহেবকে মনোযোগের সহিত দেখে নিল। সে তো চেনে না লোকটাকে। তবে লোকটা বেশ স্মার্ট। কথাবার্তা এখনো বেশ স্পষ্ট আর অন্যরকম ঝাঁঝ রয়েছে। রাশেদ সাহেব নোমানের দৃষ্টি দেখে বুঝে নিলেন সে কী ভাবছে। তিনি তৎক্ষনাৎ আগের সুরেই বললেন,
“আমি অভিরূপের বাবার বন্ধু। আমাকে দেখে কি সন্দেহ করছো? আবার নতুন বিপদের আগমন নিয়ে আসা ব্যক্তি ভাবছো?”
নোমানের স্মরণে এলো এবার। গতকাল নাদিম সাহেবের সাথে তার কথা হয়েছিল। তিনি রাশেদ সাহেবের কথা বলেছিলেন। নোমান ঘুমের ঘোরে তা ভুলে গিয়েছে। দ্রুত দরজার সাইডে দাঁড়ালো সে। পথ ছাড়লো। সৌজন্যমূলক হাসি হেঁসে বলে উঠলো,
“সরি আঙ্কেল। আমার আসলে খেয়াল ছিল না। এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ভেতরে আসুন, প্লিজ।”
রাশেদ সাহেব ভেতরে প্রবেশ করলেন। নরম সুরে বললেন,
“ইটস ওকে। এমনিতে যত বড় ঝড় তোমাদের উপর দিয়ে গিয়েছে এমন সতর্ক থাকা ভালো। আমি বোধহয় সকাল সকাল এসে পড়েছি।”
“না, না আঙ্কেল। আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন।”
“সেটা তোমার মুখ দেখেই বোঝা গিয়েছে। আর ঘুমন্ত অভিরূপকে দেখেও বুঝতে পারছি।”
নোমানের চোখ এবার চলে যায় অভিরূপের দিকে। ছেলেটা এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। কোনোরকম হুঁশ নেই তার। নোমান নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলো,
“আপনি বসুন। আমি ওকে উঠাচ্ছি। ও একটু অলস ধরনের। তার উপর সারাদিন জার্নি। তাই এখনো ঘুমাচ্ছে।”
রাশেদ সাহেব মাথা নাড়িয়ে বসেন। নোমান বিছানার দিকে ধাবিত হয়। হাত দিয়ে অভিরূপকে ঠেলে বলে ওঠে,
“এই অভি! সকাল হয়েছে উঠে পড়। রাশেদ আঙ্কেল এসেছেন।”
অভিরূপ হাত দুটো ছড়িয়ে শরীর টানা দিয়ে নোমানের কথায় কোনোরূপ পাত্তা না দিয়ে অন্যদিক ফিরে আবারও নিদ্রায় আচ্ছন্ন হতে থাকল। এই ছেলের ঘুম ভাঙ্গানো বেশ দায়ের। আবার ঘুমের মাঝে নিজের আর নোমানের ইজ্জতের ফালুদা না করে দেয়। নোমান একটু ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বলে,
“অভি! একটু চোখ মেলে দেখ। আঙ্কেল এসেছে। রাশেদ আঙ্কেল তোর সাথে দেখা করতে এসেছে। আর তুই পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস।”
অভিরূপ এবার সোজা হয়ে ফিরে। স্ট্রেইট শুয়ে আলতো করে চোখ মেলে। নোমান স্বস্তি ছাড়ে এই ভেবে এট লাস্ট ছেলেটা কোনোরকম কান্ড না করে ঘুম ভাঙ্গানো গেল। সে সরে আসার আগেই ফট করেই তার গাল চেপে ধরল অভিরূপ। থতমত খেলো নোমান। চোখটা কপালে উঠে গেল। অভিরূপের চেহারায় কেমন যেন অন্যরকম ভাবসাব। একদম সুবিধার নয়। সে আবার চোখ বুঁজেছে। কেমন যেন মিটিমিটি হাসছে। নোমানকে আরেক দফা চমকে দিয়ে অভিরূপ বেশ মুগ্ধতার সাথে বলল,
“সেই চোখ! সেই লুকিয়ে রাখা মুখ। মুগ্ধতায় ঘেরা।”
ঢক গিলে নেয় নোমান। কীসব বলছে এই ছেলে? মাথায় তো কাজ করছে না নোমানের। কার কথা বলছে? অভিরূপ থামে না। আবারও ঘুম জড়ানো কন্ঠেই বলে,
“তুমিই বলো! এটা কি লাভ এট ফার্স্ট সাইট? তুমি কি এসবে বিশ্বাস করো? আমি কিন্তু করি না। তাহলে এটা কি লাভ না অ্যাট্রাকশন?”
নোমান চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে। লজ্জায় পড়ে গেছে। উপর থেকে দড়ি পড়ে না কেন? আর এজগতে থাকতে মন চাইছে না। এই চোখ দিয়ে আর রাশেদ সাহেবের দিকে তাকাতেও পারবে না। ঠোঁট কামড়ে নিজের রাগ আর লজ্জা দুটোই লুকানোর চেষ্টা করে। অলরেডি ইজ্জতের দফারফা শেষ। নিশ্চয় আঙ্কেল ভাবছে, যে ছেলে ছেলের প্রতি লাভ বা এট্র্যাকশন কি করে হয়? কী বিশ্রী কান্ড! সঙ্গে সঙ্গে কোনোরকম ভাবনাচিন্তা ছাড়াই নোমান তাড়াহুড়ো করে এক থাবা মেরে সরে গিয়ে জোরে বলে ওঠে,
“এই শালা লাভ অ্যাট্রাকশনের বাচ্চা কী শুরু করেছিস কাল থেকে আমার সাথে? চোখ মেলে একবার তাকা। আমি তোর লাভ না অ্যাট্রাকশন বুঝতে পারবি।”
এতো জোরালো কন্ঠ শুনে আর ঘুমে মগ্ন থাকা হয়ে উঠল না। চোখ মেলতে অভিরূপের চোখের সামনে থেকে যেন সেই সাহসী দৃষ্টি হারিয়ে গেল। সেই লুকিয়ে রাখা অপরূপ চেহারাটি কোথাও গা ঢাকা দিল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে কিছু বুঝতে না পেরে তাল না পেয়ে বলল,
“লাভ অ্যাট্রাকশন? কোথায় লাভ অ্যাটেনশন?”
এবার নোমানের ইচ্ছে করে নিজের কপাল ঠুকতে। দাঁতের কিড়মিড় করে ইশারায় দেখিয়ে দেয়,
“ওই যে তোর লাভ অ্যাট্রাকশন।”
চোখ দুহাতে ডলে সামনে তাকায় অভিরূপ। সোফায় বসে থাকা অর্ধবয়স্ক লোককে দেখে মুখ ফসকে বলে ফেলে,
“আরে এটা কেমন লাভ অ্যাট্রাকশন। দেখে তো মনে হচ্ছে উনি লাভ অ্যাট্রাকশনের শ্বশুর।”
কথাটা নোমানের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র দ্রুত অভিরূপের মুখ চেপে ধরে। চাপা সুরে বলে ওঠে,
“চুপ, চুপ। মাথাটা কি তোর একেবারেই গিয়েছে?”
নোমান নিজের দৃষ্টি রাশেদ সাহেবের দিকে আনার চেষ্টা করলে রাশেদ সাহেব তাদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হেঁসে বলে ওঠেন,
“ইয়াং ম্যান, কোনো স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি? নিশ্চয়ই নোমান ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে তোমার স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে?”
অভিরূপ এবার ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলো। রাশেদ সাহেবকে চেনার চেষ্টা করল। মস্তিষ্কে কিছুটা চাপ পড়তেই তার মনে পড়লো। অনেক আগে একবার রাশেদ সাহেবকে দেখেছিল সে ভিডিও কলে। চেহারা তার এখনো মনে রয়েছে। অভিরূপ দেরি না করে তাড়াতাড়ি ব্ল্যাঙ্কেট রেখে দাঁড়িয়ে নিজের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“আই এম এক্সট্রিমলি সরি, আঙ্কেল। কী বলতে কী বলে ফেলেছি কিছু মনে করবেন না। আই নো, আপনি কিছু মনে করতেই পারেন না। দরকার হলে ভেবে নেবেন আপনার কাছে প্রতিদিন যত মানসিক রোগী আসে আমিও ঠিক তেমনি একটা রোগী।”
রাশেদ সাহেব এবার শব্দ করে হেঁসে উঠলেন। অভিরূপের এবার ভালো লাগছে। অন্তত প্রসঙ্গ ঘুরাতে সক্ষম হয়েছে। হাসতে হাসতে রাশেদ সাহেব জবাব দিলেন,
“তুমি ঠিক আগের মতোই আছো। নো চেঞ্জ।”
অতঃপর তিনি নিজের পাশে বসালেন অভিরূপ এবং নোমানকে। গল্পে মেতে উঠলেন।
আজকের আকাশটা মেঘলা। সাদা আকাশে কালো রঙের এক ধরনের স্নিগ্ধ মেঘের আনাগোনা। আকাশটা থম মে’রে আছে। কখন যেন ঝুম বৃষ্টি নামবে। হঠাৎ করেই বয়ে যাচ্ছে দমকা হাওয়া। জানালার পাশে থাকা চারকোনা টেবিল থেকে সাদা রংয়ের স্বচ্ছ কাগজটি নিচে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ বিরক্তি জমা হলো কোহিনূর ওরফে নির্জনের মুখে। নিজের ঝুঁকে কাগজটি তুলে নিয়ে হাতে কলম নিয়ে বসলো। প্রায় আধঘন্টা ধরে কালো মেয়ের কালি সে স্বচ্ছ কাগজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে মনে আসছে না শব্দ। হাতে পাচ্ছে না জোর। এই পরিকল্পনাটি নয়নতাঁরার। মেয়েটা ছোট হয়ে স্পষ্ট নির্দেশ করেছে যেভাবেই হোক রাগিনীকে সবটা জানাতে। কিন্তু মুখে বলতে গেলে এ জীবনে হয়তো কখনোই তা বলে উঠতে পারবে না কোহিনূর। তাই নয়নতাঁরার বুদ্ধি অনুযায়ী একটা পৃষ্ঠা এবং কলম নিয়ে বসেছে। মেয়েটা মাথামোটা হলেও একটু তো বুদ্ধি বের করতে পেরেছে এটা ভেবেই কোহিনূর আপ্লুত। অনেক ভেবে কলমটা পৃষ্ঠায় ঠেকিয়ে লিখতে শুরু করল কোহিনূর।
‘হয়তো আমি তোমার বিশ্বাসের যোগ্য নই। আমি মানুষটা খুব একটা সুবিধার নই। এই অসুবিধাজনক মানুষ ভয়া’বহ অন্যায় করে ফেলেছে তোমার সাথে। তবে আমার উদ্দেশ্য তোমাকে ঠকানো ছিল না। বিলিভ অর নট! আমি চেয়েছিলাম…”
হাতটা থেমে গেল। অনবরত কাঁপতে থাকলো। কোথাও একটা তোলপাড় সৃষ্টি হলো। মনে হলো এই সামান্য চিঠি দূরত্বের মতো ভয়া’বহ অ’স্ত্র দ্বারা ক্ষ’তবি’ক্ষত করে দেবে এই সুন্দর সময়গুলোকে। বিলীন করবে তার জীবন্ত কাঠগোলাপের হাসিমাখা মুখটাকে।
“কী করছেন আপনি ওখানে সকাল সকাল, কোহিনূর সাহেব?”
বিদ্যুৎপৃষ্ঠের ন্যায় চমকে উঠল কোহিনূর। সর্বাঙ্গে যেন তড়িৎ বয়ে গেল। কাগজে নিজের ছোট ছোট লেখাগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। রাগিনীর কাছে এগিয়ে আসার শব্দ তীব্র হচ্ছে। মূহুর্তেই হাতে দুমড়েমুচড়ে ফেলল কাগজটি কোহিনূর। রাগিনী ততক্ষণে টেবিলের বেশ নিকটে। কোহিনূরের এমন কাজে সে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কী করছেন? কী আছে কাগজে?”
চোর চুরি করতে ধরা পড়লে যেমন মুখের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ঠিক তেমনই এক প্রতিক্রিয়ার ছাপ পড়লো কোহিনূরের মুখে। ভয়ার্ত স্বরে বলল,
“কিছু না। তুমি এতো সকাল সকাল?”
“সকাল সকাল কোথায়? আমি তো এই সময়েই আসি। আপনার হাতে কীসের কাগজ?”
“বললাম তো তেমন কিছু না।”
রাগিনীর মনের খচখচানিটা কমে না। কোহিনূরের চোখমুখে স্পষ্ট এক সংকোচবোধ। সে দেখাতে চাইছে না। তবে রাগিনী দেখবে। দ্রুততার সাথে সে কোহিনূরের হাতের মুঠো থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। ফলাফল শূন্য। কোহিনূর নিজেকে সামলাতে না পেরে আবারও ধপ করে বসে পড়ে। হাতটা জোরে মুঠো করে থাকলো। কন্ঠে কাঠিন্য এনে বলল,
“এতো জেদি কেন তুমি, রাগিনী?”
“আশ্চর্য! জেদ আপনি করছেন আর আমাকে বলছেন আমি জেদ করছি। কী এমন আছে কাগজে?”
জেদি সুরে বলে উঠল রাগিনী। নিজের চোখটাও সুদৃঢ় ভাবে রাঙালো। মূহুর্তেই দারুণ লাগলো কোহিনূরের কাছে সেই চাহনি। তবে রাগিনীর এতো সময় নেই। সে জোর কদমে ছাড়িয়ে চলেছে কোহিনূরের হাতের মুঠো। কাগজটা দেখতে হবে মানে দেখতেই হবে। তবে কোহিনূরের সামান্য এক হাতের জোরে কি রাগিনী পারে? পুরুষ মানুষের হাতের জোর সবসময়ই বেশি। অস্বাভাবিক কিছু না। ইতিমধ্যে বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সূচনা হয়েছে। কোহিনূর হাতটা আরো শক্ত করে মুঠো করতেই ক্লান্ত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রাগিনী। কোহিনূর মৃদু হেঁসে বলে,
“এতো আগ্রহ কেন তোমার?”
“আপনার চোখে ভয় দেখেছি তাই।”
রাগিনীর অকপটে উত্তর। কোহিনূর হাসি প্রসারিত করে নিচু সুরে বলে,
“এটা প্রেম ভয়, মিস. রাগিনী!”
রাগিনীর চোখমুখ কুঁচকে যায়। কথাটা প্রথমেই বোধগম্য হয় না তার। পরক্ষণেই চোখেমুখে নেমে আসে কিছু লজ্জার আঁধার। কেমন যেন থম মেরে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“প্রেম ভয়? মানে?”
“এই কাগজ পড়লে আমার সর্ব’নাশ হয়ে যাবে।”
“কেন?”
“কারণ এখানে জম্পেশ একটা প্রেমপত্র লিখেছি।”
বেশ উৎসুক হয়ে উত্তরে বলল কোহিনূর। আগ্রহী হলো রাগিনীর প্রতিক্রিয়া জানতে। রাগিনীর মুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ কঠিন ভাবনায় ডুবেছে। মুখটায় তাজ্জব ব্যাপারটা এসেছে। কিছুক্ষণ সে মৌনতা অবলম্বন করার পর বলল,
“আপনার প্রেমিকা ছিল বুঝি?”
রাগিনীর ব্যথিত সুর। কোহিনূর যেন আরো দ্বিগুন ব্যথিত সুরে বলল,
“ছিল না। আছে বর্তমানে। খুব নিষ্ঠুর সে। একেবারে হৃদয়হীনা।”
“হৃদয়হীনা কেন?”
কিছুটা মলিনতা কণ্ঠে থাকলেও যোগ হলো বিস্ময়। কোহিনূর কিছু বলতে চাইতেই রাগিনী আগেই দম ফেলে বলে দিল,
“থাক। শুনবো না আর। আপনার প্রেমিকার কথা প্রাইভেট রাখুন।”
“কেন কেন? এক্ষুনি তো শুনতে চাইছিলে।”
রাগিনীর মলিনতায় পরিপূর্ণ মুখটার দিকে একনজরে চেয়ে জিজ্ঞেস করল কোহিনূর। রাগিনী কিছুটা তেতে জবাব দিল,
“অন্যের প্রেমিকার কথা শোনার ইচ্ছে নেই।”
বৃষ্টিটার গতি জোরালো হয়েছে। এই ভ্যাপসা গরমে হুটহাট বৃষ্টি একটু হলেও মনে শান্তি জাগায়। বর্ষার সময় অথচ বৃষ্টির নামগন্ধও ছিল না এতোদিন। এখন বৃষ্টি পেয়ে যেন আনন্দে মেতেছে প্রকৃতি। তৃষ্ণার্ত শহর ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার এক নামি-দামি দালানকোঠার এক ছোট্ট ঘরে বসে থাকা নারীটির মনের আকাশেও নেমে এসেছে কালো রঙয়ের মেঘ। সেই মেঘের প্রতিটি অণুতে সৃষ্টি হয়েছে এক অদ্ভুত অভিমানের। যার কোনো অর্থ নেই। কিছু জিনিস অর্থহীন তবুও মনের মাঝে জমে থেকে যায়।
কোহিনূর হাতের মুঠো আস্তে আস্তে করে খুলল কাগজটার অবস্থা করুণ। তবে এখনো ছিঁড়ে যায়নি। রাগিনীর আর হেলদোল নেই কাগজের প্রতি। সে বিছানায় বসেছে স্থির হয়ে। জানালায় তাকিয়ে আছে তো আছেই। অন্যকোনো দিকে তার ধ্যান নেই। মুখে নেই উচ্ছ্বাস। কোহিনূর আর কিছু না ভেবেই জানালার দিকে ছুঁড়ে মা’রল কাগজটি। নিশ্চয় বৃষ্টিতে কাগজটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!
রাগিনীকে উঠে দাঁড়াতে দেখে চকিতে তাকায় কোহিনূর। বরাবরের মতো টিফিনবক্স এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর সুরে বলে,
“খেয়ে নিন। চিন্তা করবেন না আজকে দশ পদের খাবার নিয়ে আসিনি।”
রাগিনী বাহিরের দিকে পা বাড়ায়। কোহিনূর পিছু ডেকে অস্থিরতার সাথে বলে,
“কোথায় যাচ্ছো? বাহিরে তো বৃষ্টি।”
“বৃষ্টি দেখতেই তো যাচ্ছি। বৃষ্টি নাকি সবকিছু মুছে দেয়। নিশ্চয় অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলোও মুছে দিতে পারবে।”
আর বিলম্ব করলো না রাগিনী। প্রস্থান ঘটল তার। তার আক্রোশ ভরা কন্ঠ অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিয়ে গেল কোহিনূরকে। মেয়েটা এমন করলো কেন? ‘প্রেমিকা আর প্রেমপত্র’ এই দুটো শব্দটিতে বুঝি তার অভিমানের সৃষ্টি হয়েছে? হলেও বা কেন হলো? কিছুক্ষণ নিরব থেকে স্মিত হাসলো কোহিনূর।
“এতো কীসের অভিমান আমার উপর তোমার মিস. রাগিনী? দিন দিন বড্ড অভিমানিনী হয়ে চলেছো তুমি। অভিমান ভাঙানোর দায়িত্ব বুঝি একান্ত আমায় দিয়ে রেখেছো?”
চায়ের টঙ এর সামনের ছাউনির একটা ছোট্ট সিটে বসে রয়েছে রাগিনী। চাওয়ালা চা বসিয়েছে। রাগিনী ছাড়া বর্তমানে কোনো কাস্টমার নেই। কানে ভেসে আসছে বৃষ্টির পড়ন্ত শব্দ। ভুবন জুড়ে যেন শীতলতার ছায়া। রাস্তাটা জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। হুটহাট করে বড় বাস বা ট্রাক চলে যাচ্ছে শাঁই শাঁই করে। রাগিনী নিরব রাস্তায় পানে চেয়ে। মনে লেগেছে বিষণ্ণতার ছোঁয়া। সেই বিষণ্ণতা কাটানোর মতো নয়। চির বিষণ্ণতা যেন কাটে না। কারণ এই মূহুর্তে তার কোনোরকম প্রতিষেধক তৈরি হয়নি। হয়তবা হবারও নয়। চাওয়ালার কন্ঠে ধ্যান ভাঙে রাগিনী। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
“চা কি এখনি দিমু?”
“হ্যাঁ দেন।”
বলেই আবারও মৌনতা রাগিনীর। কোন যেন বইয়ে পড়েছিল বৃষ্টিভেজা দিনে এক চায়ের টঙে বসে মাটির চায়ের ভাঁড়ে বসে হালকা চায়ের চুমুক এবং পাশে প্রিয় মানুষ থাকা মানে এক অদ্ভুত সুখানুভূতি। রাগিনীর কাছে সবটাই উপস্থিত। শুধুমাত্র প্রিয় মানুষটি বাদে।
রাগিনীর পাশে চায়ের ভাঁড় রেখে গেল চাওয়ালা। রাগিনীর হেলদোল হলো না। মুখে এসে বৃষ্টির পানির ছিটা লাগতেই চোখমুখ বন্ধ করে নিল সে। মুখে ভরে গেল বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটায়। চোখ খুলে চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিল সযত্নে। হঠাৎই ঘটল এক আগন্তুকের আগমন। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছুটে এসে রাগিনীর পাশ ঘেঁষে বসল সেই আগন্তুকটি। আধভেজা বাহুর ছোঁয়া লাগতেই হকচকিয়ে উঠল রাগিনী। মূহুর্তেই তার হাত থেকে ছোঁ মে’রে কেঁড়ে নিল চায়ের ভাঁড়। দেরি না করে চটপট নিজের ঠোঁট লাগলো চায়ের সেই ভাঁড়ে। সেই চেনা আগন্তুকটির হাত থেকে চায়ের ভাঁড় তড়িঘড়ি করে নিলো রাগিনী। এক নিঃশ্বাসে বলল,
“কী করছেন? আমি মুখ লাগিয়েছিলাম এতে।”
মানুষটি বিস্তর হেঁসে জবাব দিল,
“ওহ হো! সেকারণেই বোধহয় চায়ে বেশি মিষ্টি লাগলো। আমার ডায়বেটিস হওয়ানোর পরিকল্পনাও করে ফেলেছো তুমি? কী ভয়ানক!”
চলবে…