গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব-৫০ এবং শেষ পর্ব

0
660

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫০ [অন্তিম পর্বের প্রথমাংশ]

রাগিনী বড়ো শপিংমলের এত এত মানুষের মাঝে যেন সম্পূর্ণ একা। এত কোলাহলে একটা যান্ত্রিক রোবট লাগছে নিজেকে। যে যেভাবে পারছে পরিচালনা করে চলে যাচ্ছে। মিথ্যে অভিনয় সাজিয়ে তাকে উপহার দিয়ে চলেছে। আর সে আপনমনে সেসব গ্রহণ করে যাচ্ছে। তবুও কোনো অদ্ভুত জোরের কারণে মনে আকাঙ্ক্ষা জাগল মানুষটার সঙ্গে মেয়েটির ঠিক কেমন সম্পর্ক সেটা জানতে এবং হাতেনাতে তাকে ধরে সাবধান করে দিয়ে আসতে। অনেক হয়েছে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এবার থেকে যদি মানুষটি তার কাছে আসে তবে খুব খা’রাপ হয়ে যাবে! সেটাই রাগিনী আর বুঝিয়ে দেবে কোহিনূরকে। এসব ভেবে নিজের উপর জোর খাটিয়ে এগোতে থাকে রাগিনী। কিন্তু সে মানুষটিকে হারিয়ে ফেলেছে। এত লোকজনের মাঝে খুঁজে পেল না চেনা ব্যক্তিত্বকে। কোথায় গেল সে? হাঁটতে হাঁটতে সামনে থাকা রেলিং ধরে দাঁড়াল রাগিনী। নিচটা দেখতে থাকল বেশ মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎই চোখে পড়ল কোহিনূরকে। ওইতো নিচে নেমে পার্কিং এর দিকে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটার সাথে। রাগিনী ঝটপট করে লিফটের কাছে গেল। তবে এতটা ভীরের মধ্যে লিফটে যেতে টাইম লাগবে বলে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামল সে। পার্কিং এর দিকে যেতেই রাগিনী খেয়াল করল কোহিনূর আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে থাকা মেয়েটি কোহিনূরের হাত জড়িয়ে ধরে আইসক্রিম কেনার পাগলামি জুড়ে বসেছে। রাগিনী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মেয়েটা নিশ্চয় কোহিনূরের বেশ কাছের কেউ। কৌতূহল বাড়ল মনে। সরগমের মাঝে মানুষজনের মধ্যে সূক্ষ্ম দৃষ্টি দ্বারা তাদের প্রতিটা পদক্ষেপকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

“মাই ডিয়ার ব্রাদার! তুমি ভাবির পছন্দের খেয়াল রাখতে রাখতে আমার পছন্দ ভুলতে বসেছ! আমি স্ট্রবেরি ফ্লেবার পছন্দ করি।”

ভ্রু কুঁচকে ক্ষীণ গলায় নির্জনের উদ্দেশ্যে কথাটা বলল নয়নতাঁরা। ফোনে ব্যস্ত থাকা নির্জন খুব একটা পাত্তা না দিয়ে দোকানদারের উদ্দেশ্যে বলল,
“তাকে একটা স্ট্রবেরি ফ্লেবারের আইসক্রিম দেন।”

মেহরাজের সঙ্গে কিছু ডিটেইলস নিয়ে কথা বলছিল নির্জন হোয়াটসঅ্যাপে। চোখমুখ হালকা কুঁচকানো। মেহরাজ একটা ছবি পাঠিয়েছে তাকে। ছবিতে একটা ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বয়সের একটা লোক। ডান ভ্রু এর মাঝে কাটা। শ্যামলা দেখতে। নকল রাগিনীকে রাগিনীর মতো বানাতে এই লোকটাই সমস্ত ডিটেইলস আর টাকাপয়সা দিয়েছিল। নির্জনের কাছে চেনা চেনা লাগল এই মুুখটা। তবে মনে এলো না। যেই ডক্টরের কাছে নকল রাগিনীকে নেওয়া হয়েছিল তার ভাষ্যমতে তখন নকল রাগিনীর অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। চোখমুখ প্রায় ঝ’লসে গিয়েছিল তার। নির্জন এটা এখনো বুঝতে পারেনি রাগিনীর চেহারা অবিকল তৈরির জন্যই কি তার চেহারা ঝ’লসে দেওয়া হয়েছিল নাকি এটা এক্সি’ডেন্ট ছিল? তবে ছবিতে থাকা এই লোকটা তখন হসপিটালের পেপারে নওশাদ খান লিখে সাইন করেছিল বলে জানা যায়। নির্জন এটা নিশ্চিত যে ওটা তার আসল নাম ছিলই না। এসব কিছুর মাঝে নির্জনের অন্যহাতে টান পড়ায় কিছুটা হকচকিয়ে নিচু হয়ে তাকায় সে। একটা ছোট্ট মেয়ে। কৃষ্ণবর্ণ তার গায়ের রং। বয়সটা দশ বছরের বেশি হবার কথা নয়। হাতে ফুলের গাজরা। নির্জন ঝুঁকে নিচু হতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করল,
“ফুলের মালা লইবেন? মাত্র ত্রিশ টাকা।”

“নাম কী তোমার?”

“দিয়া।”

“বেশ সুন্দর নাম। তা দিয়া! আমি ফুলের গাজরা নিয়ে কাকে পড়াব বলো তো? আমার তো কেউ নেই পড়ানোর মতো।”

দিয়া মাথা চুলকালো। মূহুর্তেই দিয়ার পেট থেকে উদ্ভট আওয়াজ আসতেই নির্জন বুঝল মেয়েটি না খাওয়া। তৎক্ষনাৎ সে প্রশ্ন করল,
“আইসক্রিম খাবে?”

দিয়া মাথা নাড়াল আর মিনমিন করে বলল,
“আমার ফুলের মালা কিনে টাকা দেন তাইলেই হইব। আবার এইডা বসরে জমা দিতে হইব। তারপর তার মধ্যে থেকে যা পামু ওইডা নিয়া আমি আর আমার কানা ভাই মিলে ভাগ করে খামু।”

নির্জন ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বস মানে সে বোঝেনি। সে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
“বস মানে? আর তোমার ভাই আছে?”

“এত শুইনা কী করবেন? মালা না কিনলে কন চইলা যাই।”

এবার মেয়েটির কণ্ঠস্বরে জড়তা খুঁজে পেল নির্জন। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। শহরে ছোটো ছেলেমেয়েদের ভিক্ষা করতে বসিয়ে দেওয়া বা তাদের রোজগার করতে লাগিয়ে দেওয়ার অনেক চক্র কাজ করে। এর আগেও নির্জন এমন কয়েকটা কেস সলভ করেছে। এটাও হয়ত তেমনই কিছু। নির্জন শ্বাস নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ভয় পাচ্ছো কেন? আমাকে বলতে পারো। ভয় পেও না।”

“আপনের লগে বেশি কথা কইলে বস আমারেও ভাইয়ের মতো কানা কইরা দিয়া চোখ বেইচা দিবে। আমি গেলুম।”

ছোটো মানুষ! পেটে কথা থাকে না। শেষ কথাতে নির্জন বুঝতে পারল সে যা ভেবেছিল তাই। মেয়েটি চলে গেলেও নির্জন তাকে চক্ষু আড়াল করল না। কিছুদূর না যেতেই বেশ লোকজনের মাঝে মলের বাহিরে দাঁড়াতেই সেই ছোট্ট মুখে ঠাস করে চ’ড় দিয়ে বসল একটা লোক। নির্জন বেশ ভালোভাবেই দেখে নিলো সেটা। বেশ ভালো করে খেয়াল করতেই তার চক্ষু চড়কগাছ হলো। এটা তো সেই লোকটা! যার ছবি মেহরাজ হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে! একে যদি ধরতে পারা যায় তবে অনেক ইনফরমেশন বেরিয়ে আসবে। নির্জন যেন হাতের শপিংব্যাগগুলো নয়নের হাতে দেওয়ারও সময় পেল না। সেগুলো সেখানেই ফেলে দিয়ে ভীর ঠেলে যেতেই নয়নের বিরক্তি ভরা কণ্ঠ শুনল,
“মহা বিপদ তো! তোমার সঙ্গে শপিং এ এসেও শান্তি নেই। আমি গাড়ির কাছে ওয়েট করব। লোকটাকে উ’দুম কে’লানি দেওয়া শেষ চলে এসো। বেশি লেট করাবে না বলে দিলাম।”

নয়নের জোর দিয়ে বলা কথায় নির্জনের এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো আসলেই সে একটা পা’গলকে বড়ো করছে। একের পর এক লোকজনের পাশ কাটাতে কাটাতে যখন সেই নওশাদ খানের মুখটা বেশি স্পষ্ট হলো তৎক্ষনাৎ চিনে উঠতে পারল নির্জন। এটা তো সেই ক্রি’মিনাল যার সঙ্গে ওই নকল রাগিনী মিলে মেন্টাল হসপিটালে তাকে মা’রতে এসেছিল! সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল সে এবং হসপিটালের সকল পেশেন্ট। সেদিনের ব্যর্থতার ক্ষো’ভ মাথায় চেপে বসল এবার তার। আজ তার পরিচয় জনসম্মুখে এলেও নির্জন ওই নওশাদকে ধরার প্রতিজ্ঞা নিলো। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একের পর এক পড়তে থাকা ছোট্ট মেয়েটির গায়ে মা’র যেন নির্জনের শরীরেও লাগল। তার প্রলম্বিত নিঃশেষ নিঃশ্বাস আর অগ্নি প্রবাহের ন্যায় দৃষ্টির সম্মুখীন হলেও যেন কেঁপে উঠবে শত্রুপক্ষ।

দিয়ার ঠোঁট ফে’টে র’ক্ত বেরিয়েছে পাশ দিয়ে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে গিয়েও থমকে থমকে যাচ্ছে মেয়েটা। লোচন ভর্তি আতঙ্কের ছড়াছড়ি সেই সঙ্গে টলটল করছে পানি। কবির জলন্ত সিগারেটটা বেশ ক্ষিপ্র হয়ে মুখে ধরে রেখেছে। এতক্ষণে একটা রোজগারও করতে পারেনি মেয়েটা। এদের বাঁচিয়ে কী লাভ? অবশ্য ডার্ক ম্যাক্স আদেশ দিয়ে দিয়েছে এই মেয়েটার কিডনি নিয়ে একটা কেমি’ক্যাল জাতীয় কিছু দিয়ে খতম করে দিতে। কাজটা আজকের মধ্যেই সারতে হবে। এসব ভাবনার মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিয়া আধো গলায় বলল,
“মাফ কইরা দেন। আমারে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় দেন। আমি যা পামু সব দিয়া দিমু। একটু খাইতে দিয়েন আমারে আর ভাইডারে। তাইলেই হইব।”

কবিরের বাসনা জাগল রেগে এবার দিয়ার ছোট্ট গলাটাই চে’পে ধরতে। হাতটা মুঠো করে ফেলল সে। ধ’মক দিতে উদ্যত হলো। সেই মূহুর্তে তার ঘাড়ে হাত রাখল কেউ। প্রশস্ত হাতের জোর এবং শক্ত করে চেপে ধরায় যেন কাঁধের হাড্ডি ভে’ঙে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না। কিছু বলার আগেই শুনতে পেল এক পুরুষালী কণ্ঠ।
“কতকাল আর কাপুরুষের মতো বাচ্চাদের ইনকাম খাবি? এরচেয়ে জেলে গেলে কোনোরকম পরিশ্রম ছাড়া দুইবেলা রুটি আর একবেলা ভাত জুটে যাবে।”

এমন কথায় চরম রেগে গেল কবির। কার এত বড়ো সাহস? তাকে জেলের হু’মকি দেয়? কবির দ্রুত ক্ষিপ্ত হয়ে তার কাঁধ থেকে আগন্তুকের হাতটা সরিয়ে নিতেই মূহুর্তের মাঝেই কিছু বুঝের ওঠার আগেই ছিটকে পড়ে সে মাটিতে। কানের নিচের জায়গাটা টনটন করে ব্যথা করে ওঠে। হাতটা না চাইতেও চলে যায় সেই গালের জায়গাটিতে। আঙ্গুলে এসে ঠেকে তরল আর হালকা গরম এক পদার্থ। কাঁপা হাতে কবির গাল থেকে হাত সরিয়ে চোখের সামনে ধরতেই কনিষ্ঠা আঙ্গুলের মাথায় তাজা র’ক্ত দেখতে পেতেই চোখ তুলে তাকায় হাত চালানো সেই ব্যক্তির দিকে। নির্জনকে চিনতে খুব একটা ভুল হয় না কবিরের। কাঁপুনি বাড়ে তার। আজ সে কোনো দলবল নিয়ে আসেনি। সে ধরা পড়তে চায় না পুলিশের কাছে। কবির পিছিয়ে এলো। নির্জন এগিয়ে এসে তার পায়ের উপর পা তুলে দিতেই ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সে। নিজের সমস্ত ক্রো’ধ অর্পন করতে ব্যস্ত নির্জন। আশেপাশে জমা হয়েছে ভীর। ভীরের মাঝে তাকে তার প্রিয় দুটো চোখও পর্যবেক্ষণ করছে সেটা নির্জনের অজানা। নির্জন হিসহিসিয়ে কবিরকে টেনে তোলে। কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“জানো’য়ার একটা! লজ্জা লাগে না তাই না? বাচ্চাদের সাথে জঘ’ন্য কাজ করতে? লজ্জার বলিদান দিয়ে দিস নাকি তোরা?”

“ভালো হচ্ছে না অফিসার। পরিণাম ভালো হবে না। ছেড়ে দে আমায়! নয়ত আমার কাছে থাকা রি’ভলবার দিয়ে যে কারোর প্রা’ণ চলে যাবে।”

কবিরের বলা ঠুনকো হু’মকি বিন্দু মাত্র ভয় ধরাতে পারল না নির্জনের মনে। থমথমে সুরে জবাব দিল,
“রি’ভলবার চালাতে হাত লাগে। আর সেই হাত তুই কাজে পারবি না।”

নির্জন মুচড়ে ধরে কবিরের হাত। আর্তনাদে কেঁপে ওঠে আশপাশ। সকলে দূর থেকে হতবাক হয়ে চেয়ে দেখছে। কেউ কেউ কাছে এগিয়ে আসছে জানার জন্য। তবে তার আগেই কোনোমতে নির্জনকে ধা’ক্কা দিয়ে পালায় কবির। সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে শুরু করে নির্জন। মেইন রাস্তার জ্যামের মাঝে গাড়ির ফাঁক দিয়ে দুজনই দৌড়াচ্ছে। নির্জন ছোটার গতি বাড়াল। কবির প্রাণপণে চেষ্টা করছে কোনোরকমে বাঁচার। শেষ রক্ষা বুঝি হলো না। তার মাথাটুকু নির্জনের হাতের কবলে আসতেই সঙ্গে সঙ্গে সে ফে’লে দিতেই কবিরের মাথা গিয়ে লাগে বাসে। চারিপাশ অন্ধকার দেখতে পায় কবির। এরইমধ্যে বুকে অনুভব করে তীব্র ব্য’থা। বুকে হাত দিয়ে চিত হয়ে পড়ে যায় সে। নির্জন স্থির হয়ে দাঁড়ায়। বাসের থাকা সকলে, যানবাহনে থাকা যাত্রীরা বিস্ময়ে দেখে চলেছে দৃশ্য। নির্জন কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের ঘাড়ের একপাশ ধরে ঘাড় কাত করে দেখতে থাকল আ’হত কবিরকে। সময় নষ্ট করা যাবে না। কবিরকে দ্রুত ঘাড় ধরে তুলে অন্যহাতে দুটো হাত মু’চড়ে ধরল সে। এখন এর থেকেই হয়ত পাওয়া যাবে পরের কোনো অজানা তথ্য!

কবিরকে গাড়িতে তুলে হুড়মুড়িয়ে গাড়ির দরজাটা লক করল নির্জন। নয়নতাঁরা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আশ্চর্য! এই আঁটকুড়ে লোকটাকে গাড়িতে তুললে কেন? ওর সঙ্গে গাড়ি শেয়ার করে কী করে যাব?”

“তোমায় এত কষ্ট করে এই ক্রি’মিনালের সঙ্গে গাড়ি শেয়ার করতে হবে না। তুমি রিকশা বা অটোতে করে বাড়ি এসো।”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় নয়নতাঁরা নির্জনের কথায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে জেদ ধরে বলল,
“মানছি না, মানব না। তুমি গাড়িতে এই ক্রিমি’নালটাকে এসি গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছো আর আমি কিনা গরমে অটোতে যাব? নেভার এভার!”

নির্জন গাড়িটা স্টার্ট দিল। সামনে থাকা সানগ্লাস চোখে দিয়ে ফিচেল হেঁসে বলল,
“তাহলে অনশন শুরু করতে পারো নো প্রবলেম।”

ব্যস…আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা করল না নির্জন। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। পায়ের ধাপটা বিরক্তি নিয়ে জোরে ফেলে মুখটা জড়িয়ে ফেলল নয়ন। এখন কিনা অটোতে বাড়ি ফিরতে হবে?

পুলিশ স্টেশনের সামনে রাগিনীর গাড়িটা থামল। এখানেই তো থেমেছে কোহিনূরের গাড়ি। সে সচক্ষে দেখেছে। গাড়িটা তো বাহিরেই রয়েছে এখনো অবধি। রাগিনী তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নামল। নিজেকে এবার কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে তার। কোহিনূরের সঙ্গে এই জায়গাটির সম্পর্ক কোনোমতে বুঝে উঠতে পারল না। অতিরিক্ত ভাবনায় বুকটা ধড়ফড় করছে। মনে মনে একটা কথা জেগে উঠল বারংবার! মানুষটিকে তবে শুধু শুধু ভুল বুঝে এলো নাকি সে? রাগিনী ভেতরে ঢোকার আগেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াল দুটো কনস্টেবল। একজন শুধালো,
“কমপ্লেন বা জিডি করাতে এসেছেন নাকি?”

রাগিনী বুঝে উত্তর দিল,
“না। কোনো কমপ্লেন নেই।”

“তবে কেন এসেছেন? কোনো কমপ্লেন থাকলে ওই বিল্ডিং-এ যান। এইদিকে যাওয়া যাবে না। বড়ো স্যার ছোটোখাটো বিষয়ে দেখেন না। ব্যস্ত আছেন।”

রাগিনী শুধু হেলেদুলে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল। তবে কোনোমতেই পেরে উঠলো না সে। আগ্রহ নিয়ে তাদের দুজনকে বলল,
“আচ্ছা, এখানে একজন লোক ঢুকলো। একজন আ’হত লোককে নিয়ে। ব্লু কোট পড়া ছিল। উনি কে?”

কনস্টেবল দুজন এবার বড়োই বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটির এত কৌতূহল তাদের ভালো মনে ঠেকল না। শক্ত গলায় বলল,
“আপনার কি কোনো কাজ আছে এখানে? থাকলে বলেন। আমাদের বিষয়ে আপনাকে কেন কৈফিয়ত দেব? আপনি যান তো! আপনাকে তো সুবিধাজনক লাগছে না।”

রাগিনী কোনোমতেই বোঝাতে পারল না তাদেরকে। বরং যেন তারাই উল্টো চোখে তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। রাগিনীর অতিরিক্ত উত্তেজনার চোটে কান্নাও পেয়ে যাচ্ছে। সে হতাশ হয়ে পেছন ফিরে কয়েক ধাপ হেঁটে বাহিরে এলো। দৃঢ় নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ির দিকে ধাবিত হলেও সবশেষে শোনা গেল এক কাঙ্ক্ষিত ব্যস্ততায় ভরা কণ্ঠ। রাগিনী ফিরে তাকাল তৎক্ষনাৎ। ফ্যাকাশে চোখেমুখে তখন অদম্য আগ্রহ। ফোনে কথা বলতে বলতে একমনে হেঁটে বাহিরে আসছে কোহিনূর। হাঁটাচলা, পোশাকে-আশাকে একটা চটপটে, দক্ষ, সাহেব রকমের হাবভাব। রাগিনী সবচেয়ে বেশি অবাক হলো তখন যখন দেখল দুটো কনস্টেবল তাকে স্যালুট করল। কোথাও একটা উত্তেজনা তড়তড় করে বাড়ল। নিঃশ্বাসের মাত্রা ঘন হয়ে এলো। কর্ণগোচর হলো মানুষটির উতলা কণ্ঠ।
“শোনো, ওখানে আমার মনে হয় অনেক বাচ্চা আছে যাদেরকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। যাদের শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ বি’ক্রি করা হয়। আর কবির স্বীকার করেছে ইতিমধ্যে এক থেকে দেড় বছরের বাচ্চাদের কোলে নিয়ে কিছু মহিলা যে ভিক্ষা করে বেড়ায় তারাও একটা চক্র। সবটাই টেরো’রিস্টের মাস্টারমাইন্ডের খেল! ওদের রেসকিউ করার ব্যবস্থা করো। এজ স্যুন এজ পসিবল, আন্ডারস্ট্যান্ড মেহরাজ?”

অপরপাশে কী বলা হলো তা শুনতে পেল না রাগিনী। শুনতে চাইলও না। এলোমেলো পায়ে এসে কোহিনূরের সামনে পড়ল সে। ফোন কাটতেই সামনে এসে পড়া হৃদয় জুড়ে থাকা নিজের প্রিয়তমার এমন মুখটা দেখে থমকালো কোহিনূর। ফোনটা কোনোরকমে পকেটে রেখে নিজেকে শান্ত রেখে জিজ্ঞেস করল,
“রাগিনী! তুমি এখানে হঠাৎ?”

রাগিনীর কানে যেন পৌঁছালোই না কথাটা। তার মাথাটা ঘুরছে এবার। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে গমগমে আওয়াজে বলল,
“কে আপনি?”

কোহিনূর নিজেও থতমত খেয়ে গেল! কী বলছে মেয়েটা? এই সময় এসে কীসব প্রশ্ন করছে? সে কি মজা করছে? কোহিনূর কিছু না বুঝে অসাময়িক হেঁসে বলল,
“তোমার অপ্রিয়তম ব্যক্তি!”

“সেটা জানতে চাইনি। আপনার পরিচয় কী? আপনি কী করেন?”

“সেকী! শাহ্ রাশেদ স্যার কিছু বলেনি তোমায়? তোমায় যেদিন আমি তোমার বাড়ির পেছনের চিলেকোঠা থেকে রেসকিউ করি সেদিন তো উনাকে সব বলেছিলাম। আমি কে! কেন আমি তোমার বাবার হসপিটালে পেশেন্টের বেশে ছিলাম! কেনই বা আমাকে শত শত মিথ্যে বলতে হয়েছে। সব বলেছি। তোমায় উনি কিছু জানান নি?”

রাগিনী মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তার বাবা তাকে শুধু বলেছিল, এই মানুষটিকে ভুলে যেতে। দ্রুত রাগিনী মাথা নাড়ায়। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“কেউ কিছু বলেনি আমায়। আপনার রুমে আমি রি’ভলবার পেয়েছিলাম। আপনার শতশত মিথ্যের মাঝে আপনাকে শুধু আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে অপ্রিয় চরিত্র মনে হয়েছে। কিন্তু কেন করেছিলেন ছলনা? আপনি টেরো’রিস্ট নন?

কোহিনূর হতাশ ভঙ্গিতে তাকায়। সত্যিই মেয়েটা জানে না সে আসলে কে? কেন বলেছিল এত মিথ্যা? সে নির্লিপ্তে স্বীকার করে বসল,
” আমি কেন টেরো’রিস্ট হতে যাব? যাদেরকে ধরতে আমি মিশনে নেমেছি তাদের জন্যই আমার এত ছলনা।”

কোহিনূর থামল। ঢক গিলে বলল,
” রাগিনী, আমি নির্জন আহমেদ কোহিনূর। দ্যা লিডার ওফ সিক্রেট টিম পুলিশ ডিপার্টমেন্ট।”

চলবে…

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫০ [অন্তিম পর্বের শেষাংশ]

কিছুক্ষণ পূর্বে বলা কোহিনূরের কথাটা রাগিনীর কর্ণগোচর হলেও নিজের শ্রবণশক্তিকে আর বিশ্বাস করে উঠতে পারল না সে। যেন আবারও ভুল শুনছে, আবারও হ্যালুসিনেট করছে। আস্তে করে হাত উঠিয়ে নিজের ডান কানে হাত রাখল সে। মাথা উচিয়ে উচ্ছ্বাস এবং স্তম্ভিত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল সামনে থাকা গম্ভীর রূপ ধারণ করা মানুষটির উপর। নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে বলল,
“তাহলে ওই রিভ’লবার…”

“ওটা আমার। উপরমহল থেকে পারমিশন নিয়ে ইউজ করা রিভ’লবার। ওটা তোমার চোখে পড়ত না যদি হসপিটালে অ্যা’টাক না হতো।”

রাগিনীর নয়ন বৃহৎ আকার ধারণ করে। অস্ফুটস্বরে বলে,
“অ্যা’টাক?”

“তুমি কি সত্যিই কিছু জানো না? শাহ্ রাশেদ স্যার তোমায় কিছুই বলেন নি আমার সম্মন্ধে? আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার সবটা জেনে আমার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইছিলে।”

রাগিনী মাথা নুইয়ে ফেলল। কোহিনূরও মুখটা অন্যদিক ফিরিয়ে রেখেছে। দুজনের মাঝে নীরবতা। রাগিনীর রাগ হলো নিজের প্রতি। সবই অতিরিক্ত চিন্তাভাবনার ফলাফল! সামনে থাকা মানুষটাকে ভুল বুঝতে বুঝতে নিজেই বোকামীর সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। নিজেই নিজের প্রতি বিরক্ত হলো। তার চুপ থাকা দেখে কোহিনূর নিজে থেকে বলল,
“লেট ইট গো! কোথা থেকে এলে এখানে?”

“শ…শপিং মলে আপনাকে ওই মেয়েটার সঙ্গে দেখেছিলাম সেখান থেকে…”

রাগিনী মিনমিন করে পুরো কথাটা বলতে পারে না। থেমে যায় পুরোটা বলার মাঝেই। কোহিনূর পকেটে হাত গুঁজে গাম্ভীর্য ধারণ করে বলে,
“ফলো করেছো?”

রাগিনী মৌনতা অবলম্বন করল। তার নীরব থাকা কোহিনূরের কাছে এক একটা প্রশ্নের উত্তর ঠিকই মিলিয়ে দিচ্ছে। কোহিনূর হাতটা তুলে সময় দেখে। দুপুর হয়ে এসেছে। আকাশের মাঝে তেজ ছড়ানো সূর্যের রশ্মি প্রগাঢ় হয়ে চলেছে। কোহিনূর নিজ থেকে বলে,
“যাকে শপিংমলে দেখেছিলে ও আমার বোন হয়। নিজের ছোটো বোন। তুমি তাকে আগেও দেখেছো। তবে সেদিন আমি ওকে চিনতে অস্বীকার করেছিলাম তোমার সামনে। তার জন্য সরি। বাই দ্যা ওয়ে, গাড়ি নিয়ে এসেছো না? বাড়ি যাও তবে। আমারও কিছু কাজ আছে।”

কোহিনূরের দায়সারা এবং গম্ভীর হয়ে বলা কথাগুলো শুনে রাগিনীর মনে হলো লোকটি রাগ করেছে কিংবা অভিমান! নয়তবা সে এভাবে কথা বলে না। যখন লোকটির ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস এলো রাগিনী বুঝল মানুষটি কোনো কারণে কি কষ্ট পেয়েছে ভীষণ? কোহিনূর তার পাশ কাটিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যেতেই তার হাতটুকু আলতো করে ধরে রাগিনী। সংকোচ কাটিয়ে বলে ফেলে,
“সবটা না বলে কোথায় চলে যাচ্ছেন? আমি সবটা জানতে চাই, অফিসার সাহেব।”

দুজন দুদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। রাগিনীর হাতে কোহিনূরের হাতটা আলতো করে বাঁধা। কোহিনূর চাইলেই তা ছাড়াতে পারে। তবে এই তুলোর ন্যায় স্পর্শ ছাড়াতে মন চাইল না। সে সেভাবেই দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“আর কী জানতে চাও?”

“সব জানতে চাই!”

কোহিনূরের অফিসের কেবিনে বসে রয়েছে রাগিনী। চেয়ারে বসে আশেপাশে ভালো করে দেখে নিলো সে। বেশ ছিমছাম করে সাজানো। ডানদিকে বড়ো ঘড়িটা বেশ পুরোনো। টেবিলে একগাদা ফাইলপত্র পড়ে রয়েছে। সবই কেসের ফাইল। বামদিকে তাকাতেই লাল রঙের নোটিশ বোর্ড চোখে পড়ল তার। সেখানে বেশ কয়েকজনের ছবি টাঙানো। আশ্চর্যের বিষয় হলো রাগিনীর ছবিটাও রয়েছে সবকিছুর মাঝে। রাগিনীর জানামতে নোটিশবোর্ডে সব আ’সামী আর সন্দেহভাজন ক্রি’মিনালের ছবি রাখা হয়। তবে তার ছবি সেখানে কী করছে? হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল রাগিনী। দ্রুত পায়ে গিয়ে দাঁড়াল বোর্ডের সামনে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। দরজা খুলে কারোর পায়ের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে কোহিনূরকে ব্যস্ত পায়ে প্রবেশ করতে দেখল সে। একবার রাগিনীর দিকে চেয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে পড়ল লোকটা। রাগিনীও ফিরে এসে তার বিপরীতে বসল। আগ্রহ দমাতে না পেরে প্রশ্ন করে ফেলল,
“ওখানে আ…আমার ছবি…”

“তুমি নামক য’ন্ত্রণা থেকেই তো ঘটনার শুরু রাগিনী। তাই তোমার ছবি নোটিশ বোর্ডে থাকবে না তা কি হয়?”

“মানে?”

কোহিনূরের গলা শুঁকিয়ে গিয়েছে। সে টেবিলে থাকা পানি খেয়ে এবার একনাগাড়ে বলা শুরু করল,
“তুমি হয়ত জানো ঢাকায় বর্তমানে টে’রোরিস্ট টিমের বিশাল হা’মলার মুখে। তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে জায়গাটাকে নিঃস্ব করে দিতে। আর এই কেসের দায়িত্ব আমার হাতেই এসে পড়ে। আমি কাজে লেগে পড়ি। জানা যায় চট্টগ্রামে তারা ধ্বংসলীলা চালিয়ে এখন ঢাকার উপর নজর পড়েছে। আমি সব ইনফরমেশন কালেক্ট করি। একজন আই উইটনেসের বর্ণনা অনুযায়ী রাগিনী তাজরীনের দিকে আঙ্গুল ওঠে। অর্থাৎ তোমার দিকে। তোমার নামে সবটা জেনে নিলাম। তুমিও চট্টগ্রামেই ছিলে। আমার সন্দেহের তীর তোমার উপরে গিয়ে পড়ল। কিন্তু একটা কথা মাথায় আসছিল না একটা মেয়ে যার কোনো অভাব নেই। যার বাবা একজন নামি-দামি সাইকোলজিস্ট তার মেয়ে কেন এই পথে হাঁটবে? তবুও আমি তোমাকে সন্দেহের বাহিরে রাখতে পারিনি। তাই আমি পেশেন্ট হয়ে আসি তোমার জীবনে। যতটা পেরেছি ততটা তোমার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তোমার সম্পর্কে জানা। মনে আছে? তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরের দিন ভোরে আমি তোমার বাড়িতে যাই? তোমার ঘরে যাওয়ার বায়না ধরেছিলাম। সেটা এমনি এমনি ছিল না। তোমার ঘর সার্চ করেছিলাম সেদিন। তারপর আমাকে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলে সেখানে তোমার উপর ওই অ্যা’টাক…”

রাগিনী কোহিনূরের কথার মাঝপথে থামিয়ে থমথমে গলায় বলল,
“আপনি করিয়েছিলেন?”

কোহিনূর নির্লিপ্তে মাথা ঝাঁকাল। রাগিনী মনটা বিষিয়ে উঠল মূহুর্তেই। ইচ্ছে করল সামনের মানুষটাকে ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে দিতে। আর কেঁদে উঠে জিজ্ঞেস করতে, ‘এমনটা করতে পারলেন আপনি?’ তবে রাগিনী নিজেকে সামলায়। ঢক গিলে বলে,
“তারপর বলুন!”

“আমি যা আশা করেছিলাম তুমি তার উল্টো বের হলে। আস্ত একটা ভীতুর ডিম। যার কিনা এসবে ভয় কাজ করে। জ্বর আসে। আমার বিষয়টা অদ্ভুত লেগেছিল। আমি শুধু পাগল হয়ে গিয়েছিলাম এটা ভাবতে ভাবতে যে তুমি কী করে এসব করতে পারো?”

রাগিনী চুপ করে রইল। মাথা নিচু করল। চোখের টলটলে পানি সে দেখাতে রাজি নয়। মনে বার বার একটা প্রশ্ন ধা’ক্কা দিতে থাকল। সব অনুভূতি মিথ্যে ছিল? মানুষটির চোখে বসন্তময় প্রেমের জোয়ার ভুল ছিল? মানবটির সুন্দরতম স্পর্শের পেছনেও স্বার্থ ছিল? ছিল বুঝি কোনো বড়ো উদ্দেশ্য? তাদের মাঝে ছিল না কোনো প্রণয়ী মাখা মূহুর্ত? কর্ণকুহরে ভেসে এলো কোহিনূরের শান্ত কণ্ঠ,
“তবে সেই নম্রতার স্পর্শ আমায় চিনিয়ে দিয়েছিল যে সে নম্রতার রানি। তার কোমলতা আমায় গ্রাস করেছিল। এই দক্ষ অফিসারের সন্দেহের চাহনিকে ভুল প্রমাণ করে নিজের সুন্দর চাহনিকে জিতিয়ে দিলো।”

রাগিনীর প্রতিক্রিয়া নেই। সে মাথা নুইয়ে একভাবে বসে। চোখ দুটো বন্ধ। মাঝে মাঝে মৃদু কেঁপে উঠছে। তা কোহিনূর লক্ষ্য করলেও সে থামল না।
“আমার সারা শরীরে অসংখ্য যেই দাগ দেখেছিলে সেটা আমার এই ভয়া’নক জবের কারণেই। যেই কয়টা বছর এখানে কাজ করেছি আর কেস সলভ করতে হয়েছে আর শত্রুপক্ষের সামনে পড়তে হয়েছে এবং তাদের করা আ’ঘাত শরীরে বহন করতে হয়েছে। কখনো বু’লেট শরীরে গেঁথে গিয়েছে আবার কারো ছু’রির আ’ঘাতে র’ক্তাক্ত হতে হয়েছে। আমার গালে আর কপালেও বেশ কিছু এক রয়েছে। গালের দাগ ঢাকা থাকে দাড়িতে আর কপালেরটা চুলের কারণে দেখতে পাওয়া যায় না। আরো একটা কারণ আছে। আমার বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। সেই সুবাদে শ’ত্রুপক্ষের ক্ষো’ভের স্বীকার হতে হয়েছিল। পুরো পরিবারকে আ’গুনে পু’ড়িয়ে মা’রার চেষ্টা! তারপর আমি আর আমার বোন নয়নতাঁরা বেঁচে গেলাম! কিন্তু আ’গুনে পুড়ে যাওয়ার দাগটা এখনো আছে।”

অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল রাগিনী। চমকে উঠল কোহিনূর। কী হলো মেয়েটার? কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাগিনী ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“এখনো কি সন্দেহ করেন আমি এই কাজে যুক্ত?”

এবার বুঝে উঠতে পারল রাগিনীর এমন অশ্রু ভরা পানির কারণ। সে নিজের চেয়ার থেকে উঠে রাগিনীর নিকট এসে দাঁড়াল। রাগিনীর হাতটা আস্তে করে ছুঁয়ে বলল,
“আপনি তো তার থেকেও বড়ো অপ’রাধী বের হলেন ফিউচার সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম! এই সিক্রেট অফিসারের কঠিন মনটাকে নিজের আওতায় করে ফেললেন নিজের ছলনায়।”

অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল রাগিনী। আজ এতবার চমকাচ্ছে কেন সে? ইচ্ছে করল নিজেকে চিমটি কাটতে। সে স্বপ্ন দেখছে নাকি সব সত্যি? উৎসুক পানে সে চেয়ে রইল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষটির দিকে। কোহিনূর তার দৃষ্টিতে থাকা অজস্র প্রশ্ন বুঝে তাকে টেনে চেয়ার থেকে উঠিয়ে দাঁড় করালো। মুখের সামনে থাকা চুলগুলো ঠিকঠাক করে কিছু চুল কানের পিঠে কিছুটা উপরে ঠেলে দিয়ে স্নিগ্ধতায় মোড়ানো মুখটা বের করে বলল,
“আমি জানি তুমি রাগ করেছো। ভীষণ রেগে আছো। বাট ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মাই সাইড প্লিজ ম্যাডাম! আচ্ছা, ইমাজিন করো এই কোহিনূরের মতো আরো একজন কোহিনূর আছে। মানে শরীরটা আলাদা কিন্তু চেহারা হুবহু এক। তবে তুমি কি কনফিউজড হবে না?”

কপাল কুঁচকে গেল রাগিনীর। কোহিনূরের কথা বোধগম্য হলো না তার। বলল,
“মানে?”

“তোমার মতো দেখতে আরো একজন এক্সিস্ট করে সেটা কি তুমি জানো?”

চোখ দুটো এবার কপালে উঠে গেল রাগিনীর। নিজের উত্তেজনা দমাতে না পেরে জোরে বলে উঠল,
“কী? মানেটা কী?”

কোহিনূর রাগিনীর মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“রিল্যাক্স। সব বলছি তো!”

কোহিনূর একে একে সবটা খোলাসা করল রাগিনীর সামনে। রাগিনী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুখে এলো না কোনোরকম কথা। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। তার অগোচরে এতকিছু ঘটেছে? তারই চেহারা নিয়ে কেউ একজন ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। সহ্য হলো না রাগিনীর। চরম রাগ হলো সেই মেয়েটির প্রতি। কেন তারই চেহারা বাছতে হলো তাকে? অন্যকেউ ছিল না? হিসাব মিলল একে একে। অভিরূপের বলা প্রতিটা কথা এবার মিলে যেতে শুরু করল। সেদিন হসপিটালের কথা থেকে শুরু করে আজকের যেই ছবি ভাইরাল হয়েছিল সেটা অবধি মিলে গেল রাগিনীর কাছে। সবটা ভেবে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল রাগিনীর। মাথা চেপে ধরল একহাতে। সব বলা শেষে কোহিনূর ঠাণ্ডা মাথায় রাগিনীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“এখন বলো! আমার সন্দেহ করা কি অযৌক্তিক ছিল?”

রাগিনী থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল আনমনা হয়ে। মাথাভর্তি চিন্তা। বাবা তাকে এতকিছু জানালেন না কেন? হয়তো রাগিনী ডিপ্রেশনে আগে থেকেই ভুগছিল সেকারণে সবই আড়াল করে নিজে একাই সব চিন্তা মাথায় করে নিয়ে হার্ট অ্যা’টাক করে বসেছিলেন! মানুষটা এত চাপা কেন? মিনমিন করে রাগিনী উত্তর দিলো,
“ছিল না অযৌক্তিক। আপনি আপনার জায়গায় ঠিক রয়েছেন এবং আছেন। তার মানে এসবকিছু করার পেছনে আপনার একটা উদ্দেশ্য ছিল! আমার কাছাকাছি আসা! আমার কাছে কাছে থাকা সবটা আপনি অহেতুক বা নিজ ইচ্ছাতে করেন নি তাই না?”

কোহিনূরকে বেশ ভাবালো রাগিনীর এই প্রশ্ন। এটা তো সঠিক যে প্রথম প্রথম সে মোটেও নিজ ইচ্ছেতে রাগিনীর কাছে থাকেনি। সবকিছু করেছিল বাধ্য হয়ে তবে এখন তো সেই বাধ্যবাধকতা নেই। সেটা মিশে গিয়েছে মাটির সঙ্গে কবেই। উদ্ভব ঘটেছে নাম না জানা সম্পর্কের। তবুও সে রাগিনীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য নির্লিপ্তে বলল,
“না করিনি। বাধ্য হয়েই করেছিলাম।”

রাগিনী দাঁত কিড়মিড় করে তাকালেও কণ্ঠস্বর শান্ত রাখল নিজের। শরীরটা রা’গে, দুঃখে জ্বলে যাচ্ছে এবার। ফট করে জিজ্ঞেস করল,
“আর সেদিন রাতে ওই চুমু? সেটা ঠিক কি কারণে খেয়েছিলেন শুনি? স্পর্শ করেছিলেন কেন আমাকে?”

রাগিনী ফট করে এমন চটে যাওয়া দেখে থতমত খেয়ে যায় কোহিনূর। নিজেকে ধাতস্থ করে মুচকি হেসে দেয় সে রাগিনীর আড়ালে। অতঃপর জবাবে বলে,
“তোমায় চুমু খেতে মিষ্টি, ঝাল নাকি টক সেটা ট্রাই করছিলাম।”

রাগিনীর মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল এবার। একে তো কোহিনূর নিজের পরিচয় সঠিক সময় জানায় নি। প্রচণ্ড দেরি করে ফেলেছে। এতোটাই দেরি করেছে যে এখন সবটা হাতের বাহিরে। অভিরূপের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হয়েছে একপ্রকার জেদ করে এবং কোহিনূরের উপর অভিমান করেই। এখন কী হবে? কোহিনূরকে মৃদু ধা’ক্কা দিয়ে নিজেই সরে এলো রাগিনী। চিল্লিয়ে বলল,
“চরিত্রহীন পুরুষ! অসভ্য লোক। দূরে থাকুন।”

এতদিন পর নিজের ধানিলঙ্কাকে দেখতে পেয়ে মনটা যেন নেচে উঠল কোহিনূরের। এ যেন জলন্ত আ’গুন জ্বলে উঠেছে দাবানল হয়ে। গালে দেখা গেল রক্তিম আভায় জর্জরিত। নাক ফুলিয়ে সাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করছে সে। কোহিনূরের মনে পড়ল মেহরাজের বলা একসময়ের কথা। একদা সে বলেছিল, ‘প্রতিটি নারীর মাঝে একটা গুপ্ত নাগিন লুকায়িত থাকে। সময় পেলেই তা জেগে ওঠে।’
আজ যেন সেই গুপ্ত নাগিনকেই দেখতে পাচ্ছে কোহিনূর। রাগিনী হিসহিসিয়ে বলে,
“আমিই বোকা! আমি মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম আপনি আমাকে ভালোবাসেন। ভেবেছিলাম আমার সঙ্গে হাতে হাত রেখে বাকি জীবন কাটানোর আবদার করবেন কোনো এক সময়! কিন্তু আমি ভুল। সবটা ভুল। সবকিছু ভুল।”

রাগিনী তড়িঘড়ি করে ব্যাগটা ভালোমতো কাঁধে নিয়ে নিলো। কোনোরকম কথা বলল না আর। এখানে আর এক মূহুর্ত থাকবে না। যাওয়ার পথ ধরলেই দ্রুততার সঙ্গে তার হাতটা এবার চেপে ধরে কোহিনূর। নিজের সঙ্গে তাকে মিশিয়ে নিতেই শুরু হলো রাগিনীর ছটফটানি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টায় ব্যর্থ হলে কোহিনূর তার দাড়িভর্তি গাল রাগিনীর নরম গালে লাগিয়ে বলল,
“এইযে বোকা মেয়ে! একটু শান্ত হও। একটা গল্প শোনাই! এক অফিসারের প্রেমে লুটিয়ে পড়ার গল্প একটু শুনে যাও।”

“শুনব না আমি। ছাড়ুন। নয়ত চিৎকার করব আমি।”

“করো! যত খুশি করো। আমার লোকজন এসে দেখুক আমি কীভাবে তোমায় সামলাচ্ছি।”

রাগিনী দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল এবার। কোহিনূর বলল,
“গোধূলি এক বেলায় এক পুরুষের দৃঢ় নজর পড়েছিল এক কোমল নারীর দিকে। পুরুষটি ভেবেছিল সে এই কোমল নারীকে ধ্বংস করবে। তবে হলো ঠিক বিপরীত কান্ড। ঘটল অঘটন। সেই কোমলতায় ধ্বংস হতে চলল সেই পুরুষ। এক ধারালো ছুরির মতো নারীটি প্রবেশ করল তার হৃদয়ে। পুরুষটি বলে উঠল…”

রাগিনী কৌতূহলী হয়ে শুধালো,
“কী বলে উঠল?”

“গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে। আমার হৃদয়ে জোরপূর্বক প্রবেশ করেছিলে। খুব কি দরকার ছিল এই অঘটন ঘটানোর?”

রাগিনী শিথিল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোহিনূর তার দুহাতের উপর হাত রেখে বলল,
“ভালোবাসি তো, মিস. সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম!”

রাগিনী খুশির জোয়ারে ভাসবে নাকি রেগে মানুষটিকে দূরে সরিয়ে রাখবে বুঝল না। দিশেহারা হয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়ল। ঠোঁট কামড়ে নিজের সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়া ঢাকার চেষ্টা করল। অস্পষ্ট সুরে বলল,
“মিথ্যে!”

“ডাহা সত্যি! ভালোবাসলে কি ভালোবাসি বলতেই হবে? সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম কি আমার চোখ পড়তে অক্ষম হয়েছে? ভালোবাসি বললেই বুঝি ভালোবাসা হয়?”

রাগিনী এবার রাশভারী গলায় বলল,
“তবে আমার বাবাকে জানান নি কেন? বলেন নি কেন আমাদের কথা?”

“স্যার বলতে দিলেন কোথায়? বলার সুযোগ দেওয়ার আগেই সুন্দর করে প্রত্যাখান করে দিলেন আমায়।”

রাগিনী ঘুরে দাঁড়াল এবার। কোহিনূরের চোখে চোখ রেখে বলল,
“কেন?”

কোহিনূর মলিন হাসে। গাম্ভীর্যের সাথে বলে,
“পুলিশ ডিপার্টমেন্টের জব! নিরাপত্তা নেই। প্রতিটা মা-বাবা চায় তার সন্তান নিরাপদে জীবনযাপন করুক। যদি তোমার কিছু হয়ে যায় আর আমি তোমায় নিরাপত্তা প্রদান না করতে পারি তবে সবটা শেষ হয়ে যাবে যে। আর তোমার আর আমার বিয়ের পর যদি কখনো আমার কিছু হয়ে যায় তবে তুমি যে ভেঙে পড়বে! তাই উনি আমাকে প্রত্যাখান করলেন।”

“আপনি আর কিছু বলেন নি বাবাকে?”

কোহিনূর মৃদু সুরে বলল,
“কী বলব?”

রাগিনীর আরেক দফা রাগ হলো। লোকটা সব তো রাগার মতোই ভুলভাল কাজ করেছে। সবটা কি সহ্য করা যায়? সে আবারও দূরে ছিটকে গিয়ে তার ব্যাগ হাতে নিয়ে সেটা দিয়ে কোহিনূরের বুকে অনবরত মা’রতে মা’রতে বলল,
“ঠিকই তো! তা বলবেন কেন! আমার কাছ থেকে ছাড়া পেতে চাইছেন তাই না?”

রাগিনীর হাতটা ধরল কোহিনূর। মেয়েটা মে’রেই চলেছে। হাফ ছেড়ে বলল,
“এখান থেকে ছাড়া পেতে হলে মৃ’ত্যু ছাড়া আর কোনো পথ তো দেখতে পাচ্ছি না রাগের রানি!”

রাগিনীর রাগ কমল না। চোখ ভর্তি অশ্রু নামলো। আজ তার এঙ্গেজমেন্ট। কী করবে ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়ল। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলল,
“মিথ্যুক! আমি চলে গেলেই তো আপনার ভালো। আপনি বরং এখানে বসে বসে আপনার কেস সলভ করুন এবং আমার আর অভিরূপের এঙ্গেজমেন্টের লাইভ টেলিকাস্ট দেখুন।”

রাগিনীর শেষ কথার আগামাথা বুঝে উঠতে পারল না কোহিনূর। হা করে চেয়ে রইল। রাগিনী হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতেই সেই মূহুর্তে মেহরাজ এসে প্রবেশ করল। তাকে দেখেই চক্ষু চড়কগাছ হলো রাগিনীর। মেহরাজ চোখমুখ খিঁচে নিজের মুখটা ঢাকতে গিয়েও লাভ হলো না।
“এই আপনি! এখানে কী করছেন?”

আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল রাগিনী। মেহরাজ বুঝল আর লাভ নেই। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“হ্যালো, রাগিনী ম্যাডাম। আমি স্যারের এসিস্ট্যান্ট অফিসার!”

“আপনারা সবগুলো ঠক! আপনাদের সকলের বিরুদ্ধে আমি কেস করব। মিথ্যেবাদী একেকটা।”

রাগিনী দ্রুত পায়ে চলে গেল। কোহিনূর থমকে দাঁড়িয়ে রইল কিছুটা সময়। একটা সময় বিড়বিড় করে বলল,
“অভিরূপ আর রাগিনী এঙ্গেজমেন্টের লাইভ টেলিকাস্ট মানে?”

মেহরাজের কানে এলো সেটা। দ্রুতই সে এগিয়ে এসে বলল,
“স্যার, স্যার! এখন নিউজ চ্যানেলে হেডলাইন বেরিয়েছে। সিঙ্গার অভিরূপ চৌধুরীর সাথে রাগিনী তাজরীনের এঙ্গেজমেন্ট। আজ ঠিক সন্ধ্যে সাতটায়।”

কোহিনূরের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো পরমুহূর্তেই। দরদর করে ঘামতে শুরু করল। গভীর ভাবনায় মত্ত হলো। ফের স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“হবে না এঙ্গেজমেন্ট!”

“আপনি কী করে জানলেন স্যার? যেখানে মিডিয়া একশো পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিচ্ছে?”

কোহিনূর স্মিত হাসল। প্যান্টের পকেটে নিজের হাতটা গুঁজে বলল,
“আমি জানি বলেই বলছি। রাগিনীর উপর এই বিশ্বাসটা আমার আছে। আর সে আমার বিশ্বাস ভাঙবে না কখনোই।”

অনেক আয়োজনের মাঝে নিজের ঘরে বসে ডায়েরী ঘাঁটাঘাঁটি করতে ব্যস্ত রাশেদ সাহেব। তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছেন ডায়েরীর প্রতিটা পাতা। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি। ফলে কপালে পড়েছে প্রগাঢ় ভাঁজ। একহাতে ফোন। ফোনে ডায়াল স্ক্রিন অন করা। ডায়েরীতে খুঁজে না পেয়ে ডায়েরী বন্ধ করলেন তিনি। বিরক্তি নিয়ে ছুটলেন আলমারির দিকে। আলমারি ঘেঁটে টেনে বের করলেন একটা ফাইল। লাল রঙের এই ফাইলটা উনার অতি অপ্রিয় হলেও কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণে তিনি এটা বছরের পর বছর যত্নে রেখে দিয়েছিলেন। ফাইল খুলে বের করলেন একটা নম্বর। দ্রুত ফোনে নম্বর তুলতেই ঘরে চা নিয়ে প্রবেশ করল সৈয়দ। রাশেদ সাহেব ভ্রুক্ষেপ না করে নিজ কাজে ব্যস্ত হলেন। নম্বরটা বন্ধ। রাশেদ সাহেব রাগ হলেন ভীষণ। ধপ করে বসলেন বিছানায়। অস্থির হয়ে পড়লেন। বুকে হাত রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ এগিয়ে এসে চিন্তিত গলায় বলল,
“স্যার, ঠিক আছেন?”

“ঠিক আছি আমি। কিন্তু কতক্ষণ ঠিক থাকব জানি না।”

“এমন কথা বলতেছেন কেন?”

রাশেদ সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,
“সেটা তোমার জানা কথা সৈয়দ। কেন আমার এত অস্থিরতা! ওইদিন ওই হসপিটালে ওই মেয়েটিকে দেখে আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারছি না।”

সৈয়দ উনাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“এই বিষয়টা নিয়া তো আপনে নিশ্চিত না। বিষয়টা কাকতালীয় হতে পারে। এসব নিয়ে মাথা ঘামায়ে শরীর খারাপ না করে আমাদের রাগিনী মায়ের বিয়েতে আনন্দ করেন।”

“কিন্তু ওই ছয়টা আঙ্গুল আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না সৈয়দ!”

“কইলাম তো! কাকতালীয় হতে পারে। মনটা ভালা রাখেন। মেয়েটাকে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতাছেন। এইডাই তো খুশি। আপনের জামাই তার মা-বাবা নিয়া আসলো বলে। তাড়াতাড়ি আসেন নিচে।”
সৈয়দ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তবে চিন্তা কমে না রাশেদ সাহেবের। বরং বাড়তে থাকে।

সন্ধ্যের আগমূহুর্ত। আকাশে অন্ধকার নেমে আসছে। দেখা যাচ্ছে চাঁদের সৌন্দর্য। কোহিনূর আজ দ্রুতই বাড়ি ফিরেছে। বেশ তাড়াহুড়ো লেগে আছে বাড়ি ফেরার পর থেকে। সে আবার কোথাও বের হবে। রাগিনীর ফোনের লোকেশন বর্তমানে তার বাড়িতে নয় অন্য কোথাও দেখাচ্ছে। এতে কোহিনূর নিশ্চিত রাগিনী এঙ্গেজমেন্টের ভয়েই বাড়ি যাচ্ছে না। সে আসার পরপরই ওয়াশরুমে ঢুকে গিয়েছে ফ্রেশ হতে।

দরজাটা হালকা ফাঁক করে ঘরের ভেতরটা ভালো করে দেখে নেয় নয়নতাঁরা। ঘরটা একদম ফাঁকা। বেডে চোখ পড়তেই দেখল সেখানে অগোছালো হয়ে পড়ে আছে কোহিনূরের পরনে সব পোশাক। ওয়াশরুম থেকে আসছে পানি পড়ার শব্দ। পা টিপে টিপে কোহিনূরের ঘরে প্রবেশ করল নয়ন। চারিপাশে খুঁজতে থাকল কোহিনূরের ফোনটা। খুঁজে পেল না! তারপর বেডের কাছে গিয়ে তার ভাইয়ের একেকটা জামা সরাতেই বেরিয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি। এইতো তার ভাইয়ের ফোন। দ্রুত ফোন নিয়ে ফোনের স্ক্রিন অন করল নয়ন। দৃশ্যমান হলো রাগিনীর মিষ্টি হাসির একটা ছবি। তৎক্ষনাৎ দাঁত কেলিয়ে হাসল নয়নতাঁরা! তার ভাইটা কবে থেকে এত রোমান্টিক হলো? ভালোবেসে প্রেমে পড়লে বুঝি সব হয়!

নিজের ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে দ্রুত নিজের ফোনটাও প্যান্টের পকেট থেকে বের করল নয়ন। ওয়াশরুমের দিকে একবার তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে কোহিনূরের ফোনের ফোন নম্বর অপশনে গেল সে। নয়ন জানে তার ভাই কখনোই ফোনে পিন বা পাসওয়ার্ড কিছুই দেয় না। এতেই অবশ্য তার সুবিধা হয়েছে। দ্রুত স্ক্রল করে করে ইন্সপেক্টর রায়ান নামে সেভ করা নম্বরে এসে থামল সে। মুখে ফুটে উঠল বিশ্ব জয়ের হাসি। নিজের ফোনে তুলে নিলো নম্বরটা। তারপর কোহিনূরের ফোনটা নিজের জায়গায় রেখে দিয়ে বেরিয়ে এলো নয়নতাঁরা।

নিজের ঘরটাতে এসে দরজা লক করে বেডের উপর উঠে খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে বসল নয়ন। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রায়ানের নম্বরটা ডায়াল করেই কল করে বসল সে। বুকটা দুরুদুরু করছে তার। সে জানে না মানুষটা কল রিসিভ করলে কী বলে কথা শুরু করবে! তবে তাকে কথা বলতে হবে। একবার কল দিলে কল রিসিভ না করলেও পরবর্তীতে কল রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে রায়ানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর!
“হ্যালো! ইন্সপেক্টর রায়ান সিকান্দার বলছি!”

নয়নতাঁরার কণ্ঠস্বর এমনিতেই আঁটকে গেল তখন। কিছু বলার চেষ্টায় থেকেও পারল না। রায়ান জবাব না পেয়ে এবার জোর দিয়ে বলল,
“হ্যালো! কে বলছেন?”

নয়নতাঁরা এবার ঘনঘন শ্বাস ফেলে কণ্ঠস্বর চিকন করে বলল,
“আমি একটা মেয়ে বলছিলাম।”

“মেয়ে বলছেন সেটা বুঝতে পেরেছি। তবে নামটা কী? আর কল করেছেন কেন? এনি প্রবলেম?”

নয়নতাঁরা এবারও আটকালো। কী বলবে খুঁজে পেল না। সেই লজ্জাজনক ঘটনার পর আরো লজ্জা লাগছে তার কথা বলতে। এবার রায়ানের কথায় তাজ্জব বনে গেল নয়নতাঁরা।
“মিস. নয়নতাঁরা! কিছু বলবে?”

নয়নতাঁরার বুকে যেন অনবরত ঢোল পে’টাতে শুরু করল। এভাবে কেউ সম্মোধন করে নাকি কাউকে? যে কেউ স্ট্রো’ক করে ফেলতে পারে। নয়নতাঁরা মিনমিন করে বলল,
“আপনি জানলেন কী করে এটা আমি?”

“যেদিন আমার কাছে ফোন ফেলে গিয়েছিলে সেদিন আমি বুঝিনি এটা কার ফোন। তাছাড়া আমার ছবি দেখে কিছুটা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ফলস্বরূপ আমাকে চেক করতে হয়েছিল তোমার নম্বর। তাই আমি জানি এটা তোমার নম্বর। আর কিছু?”

নয়নতাঁরা মাথা চুলকায়। লোকটার ভারি বুদ্ধি। সেই বুদ্ধির সামনে নয়ন ছোট্ট একটা পিঁপড়ে মাত্র। সে মুখ ফস্কে বলে ফেলে,
“থ্যাংকস।”

রায়ান কিছুটা কনফিউজড হয়ে বলে,
“থ্যাংকস কেন হঠাৎ?”

“আমার ফোনটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।”

“এতগুলো দিন পর আমাকে থ্যাংকস বলার জন্য মনে পড়ল?”

নয়নতাঁরা বিরবির করে বলে উঠল,
“মনে তো সবসময় পড়ে। আপনার মতো নিরামিষ মানুষের বোঝার ক্ষমতা নেই। বুঝতে হলে নয়নতাঁরার ক্লাস করতে হবে অনেক অনেক।”

রায়ান ফোনের ওপাশ থেকে খুব একটা শুনতে পেল না। তাই জিজ্ঞেসা করল,
“কিছু বললে?”

নয়নতাঁরা হকচকিয়ে বলল,
“না না। কিছু না। বলছিলাম আপনার নম্বর পাইনি তাই থ্যাংকস জানানো হয়নি।”

“এনিথিং এলস্? আসলে আমি অফিসে এখনো। একটু বিজি।”

নয়নতাঁরা এবার আবদার করে বসল,
“লাস্টবার যখন আমার বাড়িতে এলেন তখন তো আপনাকে বাড়ির ভেতরে বসতেও দিতে পারিনি। চলে গেলেন। তাই বলছিলাম সেই ভুল শুধরে নিতে আপনাকে আমার বাড়িতে ইনভাইট করলাম।”

রায়ান কিছুটা থেমে থেমে বলে,
“কিন্তু এসবের তো দরকার নেই। আমাকে বাড়িতে বসতে দিতে হবে এটা কে বলেছে?”

“আমি বলেছি। ফ্রি আছেন কবে?”

“তা জেনে তুমি কী করবে?”

নয়নতাঁরা এবার কিছুটা রাগের রেশ ধরে বলল,
“পাল্টা প্রশ্ন না করে সঠিক জবাবটা দিন না!”

“শনিবার বাদে ফ্রি নেই আমি।”

“তবে শনিবারে সন্ধ্যা ছয়টায় আমি আপনার জন্য শেরাটন রেস্টুরেন্টে ওয়েট করব।”

রায়ান আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেলেও নয়নতাঁরার কথার চাপে বলাটা আর হয়ে উঠল না।
“মনে থাকে যেন ঠিক সন্ধ্যে ছয়টায়।”

ব্যস…কল কেটে গেল। রায়ানের বিনয়ের সাথে প্রস্তাবটা প্রত্যাখান করা আর হলো না। সে ফোনের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। মেয়েটা মাথাতে নিশ্চিত কোনো সমস্যা রয়েছে। ভাবনার জোয়ারে না ভেসে ফোনটা টেবিলে রাখল সে। না চাইতেও আনমনে আওড়ালো,
“যেমন ভাই তার তেমন বোন! আর আমি বারবারই তাদের মাঝে ফেঁ’সে যাই! উফফ…!”

সন্ধ্যে তখন ঠিক সাড়ে ছয়টা। খুব একটা লোকজনের সমাগম না করলেও রাশেদ সাহেব বাড়ি সাজানো নিয়ে কোনোরকম ত্রুটি রাখেন নি। চারিপাশটা সাদা রঙের আলোয় ঝকঝক করছে। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। সিঁড়ির রেলিংয়ে মোড়ানো সাদা ফেইরি লাইট। রাগিনীর সাদা রঙটা বেশ পছন্দ! তাই রাশেদ সাহেব আজকের সাজসজ্জা সবটা সাদা রঙ দিয়েই করেছেন। সাদা ফেইরি লাইটের মাঝে সাদা রঙের ফুলগুলোও দৃশ্যমান। নাদিম সাহেব অর্থাৎ অভিরূপের বাবা তার পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন। সেই সঙ্গে বন্ধুর সঙ্গে গড়ে উঠতে চলেছে নতুন সম্পর্ক! এতে আরো আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়েছেন তিনি। খুশির আমেজের যেন শেষ নেই। অপরদিকে রাশেদ সাহেব চিন্তার মাঝেও নিজের খুশি বজায় রাখতে ব্যস্ত। চিন্তাটুকু জুড়ে রয়েছেন উনার মেয়ে রাগিনী। মেয়েটা এখনো অবধি বাড়ি ফিরেনি। অথচ কিছুক্ষণ কর অনুষ্ঠান শুরু হবে। বুকটা ধড়ফড় করছে উনার। মেয়েটার কিছু হলো না তো আবার? বেশ কয়েকবার কল করেছেন ইতিমধ্যে তবে রাগিনী ফোন তোলেনি। বিষয়টা আরো বিষাদের হয়ে দাঁড়িয়েছে উনার কাছে। অভিরূপ নিজের ঘরে নোমানের সঙ্গে তৈরি হতে শুরু করেছে। বেশিক্ষণ লাগবে না তার। ছেলেমানুষের তৈরি হতে খুব একটা সময় লাগে না। কিন্তু রাগিনী কোথায়? কিছুক্ষণের মাঝে যখন প্রশ্ন উঠবে কী জবাব দেবেন?

হলরুমের বড়ো সোফায় বসে বেশ আড্ডা চলছিল বয়স্কদের মাঝে। ছিলেন নোমানের বাবাও। কথায় কথায় ছোট্ট রিও রাজা বেশে নিচে নেমে বেশ আয়েশ করে হেলেদুলে এসে লাফ দিয়ে উঠে রাশেদ সাহেবের পাশে গা এলিয়ে দিলো। সকলে কিছুটা চমকে তাকাল তার দিকে। রিও কেও আজ জামা পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাথায় সুন্দর টুপি। এটা নোমানের কাজ। নোমানও বিড়াল বেশ পছন্দ করে। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো রিও রাগিনীর পর নোমানের সঙ্গে সখ্যতা গড়েছে। রিও এর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এখানে তারই আধিপত্য। বিড়াল ছানাকে দেখে অভিরূপের মা মিসেস. সুরভী জিজ্ঞেস করলেন,
“এটা কার? বাড়ির ছোট্ট মেম্বার নাকি?”

“রাগিনীর এটা। রাস্তা থেকে রেসকিউ করে নিয়ে এসেছে। প্রচন্ড দেমাগ তার।”

বলেই রাশেদ সাহেব হাসার চেষ্টা করেন। রাগিনীর প্রসঙ্গ ওঠায় সঙ্গে সঙ্গে সুরভী বলে বসেন,
“ভালো কথা! রাগিনী কোথায়? যার জন্য এত আয়োজন তার দেখা পেলাম না আসার পর থেকে।”

রাশেদ সাহেব থতমত খেলেন। একটা বাহানায় সেখান থেকে উঠে এলেন। কল করলেন মেয়েকে বারংবার।

অভিরূপ বেশ যত্নসহকারে নিজের চুল ঠিকঠাক করছে। নিজের কোটের কলারে বার বার হাত দিয়ে দেখছে ঠিক আছে কিনা। মনে মনে যে উল্লাস তা চেপে রাখা যাচ্ছে না। এই প্রথম সে কাউকে ভালোবেসে আর কোনোরকম জটিলতা ছাড়াই নিজের স্বপ্নে দেখা প্রেমিকাকে পাওয়া একপ্রকার চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। নোমান ওয়াশরুমে। নিজের ব্র্যান্ডের পারফিউমটা নিয়ে কোটের উপর ছড়াতেই তার ফোনে টুং করে মেসেজ বেজে উঠল। প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরবর্তীতে আবারও শব্দ হওয়ায় কপাল কুঁচকে ফোনটা হাতে নিলো সে। রাগিনীর নামটা স্ক্রিনে ভেসে ওঠায় অপেক্ষা না করে ফোনের লক খুলতেই একটা ভয়েস মেসেজের দেখা পেল। আর নিচে ছোট্ট করে লেখা, ‘কথাগুলো আপনি একা শুনবেন প্লিজ’। অভিরূপ অবাক না হয়ে পারল না। আশেপাশে কেউ নেই দেখেই ভয়েজ মেসেজ অন করতেই রাগিনীর সুমিষ্ট কণ্ঠে কেমন থমথমে ভাবটা পাওয়া গেল।
‘প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে আপনার কাছ থেকে এবং আপনার মা-বাবার কাছ থেকে। এই বিয়েটায় আমি জেদের বশে রাজি হয়েছিলাম। কখনোই মন থেকে মানি নি। আর আজ সবটা জানার পর বিয়েটা করা আমার কাছে নিজের গলায় ফাঁ’স দেওয়ার মতো। আর জেদের কারণটা ছিল আমার ব্যক্তিগত একজন মানুষ। আমার জীবনে অন্য এক পুরুষ রয়েছে। তার জায়গা অন্য কোনো পুুরুষ নিতে পারবে না। আর এক্ষেত্রে আমি স্বার্থপর। যদি মানুষটিকে নাও পাই তবুও অন্য কারোর হাত ধরা সম্ভব হবে না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা আপনিও কখনো রাগিনী তাজরীনকে ভালোবাসতে পারেন নি। সাইকোলজি বলে, একটা মানুষ যখন চেহারা দেখে মুগ্ধ হয় তখন সে তার প্রেমে পড়ে। আর যখন কারোর ব্যক্তিত্ব দেখে মুগ্ধ হয় তবে সে তাকে ভালোবাসে। আর আপনি কারোর ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছেন। ব্যক্তিত্ব রাগিনীর ছিল না কখনো। আমার মতো দেখতে আরো একটা মেয়ে এক্সিস্ট করে। যার সঙ্গে আপনার সকল একান্ত মূহুর্ত কেটেছে। শুনতে উদ্ভট এবং বানানো কথা হলেও এটা চরম সত্য ছিল। হসপিটালের ছাঁদে আপনার সঙ্গে একান্ত মূহুর্ত কাটিয়েছে ওই মেয়ে, তার সাহসী দৃষ্টিতে মত্ত হয়েছেন আপনি, তার সঙ্গে রিকশা এবং নৌকা ভ্রমণ করেছেন আপনি। আপনার জীবনে আমার কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। আর এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি ভুল মানুষের প্রতি নিজের ভালোবাসা উজাড় করেছেন। মেয়েটির চেহারা নকল! সে একজন টেরো’রিস্ট টিমের মেম্বার। আর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি একজন মুগ্ধকর মানুষ। একজন আনন্দের জাদুকর। তবে ভালোবাসা সকলের জন্য নয়, অভিরূপ। আমি এখন বাড়ি ফিরতে পারব না। বাবার সামনে দাঁড়াতে পারব না। পরিস্থিতি বুঝে আমি ঠিক বাড়ি ফিরব। আই এম সরি!”

নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অভিরূপ। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করল। রাগের সবুজ রগ ফুটে উঠল তার। চোয়াল শক্ত হলো। নোমান সবে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে ঘটল আকস্মিক ঘটনা। তার সামনে অভিরূপের দামি ফোনটা গিয়ে পড়ল ড্রেসিং টেবিলের কাঁচে। বিকট শব্দে চারিদিক কেঁপে উঠল। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রইল আয়নার কাঁচ এবং ফোনের বিভিন্ন অংশ।

ঘড়ির কাঁটা সাতটায় গিয়ে ঠেকেছে। নোমান অভিরূপের ঘরের দরজা ধা’ক্কা দিয়ে যাচ্ছে। অভিরূপের সাড়াশব্দ না পেয়ে সকলে আতঙ্কে জর্জরিত। মিসেস. সুরভী কেঁদেই দিয়েছেন। অনবরত কেঁদে চলেছেন। ছেলেটা সন্ধ্যায় হুট করেই বলল বিয়েটা সে করতে চায় না। এমনটা বলার কারণ না বলেই সে হনহনিয়ে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। নোমান অবশ্য জানে কারণটা। সে অভিরূপের ফোনটা উঠিয়ে ঠিকঠাক করে তার অপ্রত্যাশিত ক্রো’ধের কারণ জানতে ফোন অন করেছিল আর রাগিনীর সমস্ত কথা শুনেছে। সে নিজেও বিষয়টাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে সে জানে অভিরূপ উল্টাপাল্টা কিছু করার ছেলে মোটেও নেই। শেষমেশ নোমান বিক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“অভি! দরজা খোল। আন্টি ভেঙ্গে পড়েছেন। অসুস্থ হয়ে পড়বেন এবার।”

তবুও দরজা খোলে না। নোমান দরজায় লা’থি দেয়। আর চিল্লিয়ে বলে,
“দরজা খুলবি না ভাঙব?”

রাশেদ সাহেব দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কোনদিকে যাবেন কী করবেন বুঝতে পারছেন না। এরই মাঝে দরজা খুলল অভিরূপ। তার বিষণ্ণ চেহারা এবং ফ্যাকাশে মুখের বর্ণ সকলের প্রতিক্রিয়া পাল্টালো। নিজের ফোলা চোখের চাহনি নোমানের দিকে নিক্ষেপ করে সে বলল,
“আমি শুধু নোমানের সঙ্গে কথা বলতে চাই। অন্যকেউ আমার ঘরে আসবে না। বাবা কিংবা মাও না।”

নোমান সবার দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিলো। তারপর ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করল। পুনরায় শব্দ করে দরজা আঁটকে দিল অভিরূপ। মিসেস. সুরভীর অশান্ত মন মানছে না। তবুও কিছু করার নেই।

ঘরটা অন্ধকার করে রেখেছে অভিরূপ। তার গায়ে আর কোট নেই। সেটা টেনে ফেলে দিয়েছে বেশ অযত্নের সঙ্গে ফ্লোরে। আয়নার কাঁচগুলো একভাবে পড়ে আছে। অভিরূপের পরনে সাদা শার্টের অবস্থাও নাজেহাল। ঘেমে একাকার অভিরূপ। এসি থাকা সত্ত্বেও এসি অন করেনি অভিরূপ। শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খুলে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ল সে। নোমান তার পাশে বসে এসির রিমোট হাতিয়ে বলল,
“গরম লাগছে না তোর?”

“না।”

অভিরূপের ভার কণ্ঠ। নোমান ধম’কের সুরে বলল,
“ঘেমে তোর শার্ট ভিজে গিয়েছে আর বলছিস গরম নেই?”

বলেই এসির পাওয়ার অন করতে গেল নোমান। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত চেপে উঠে বসল অভি। নোমান হকচকিয়ে গেল। তাকে আরেক দফা চমকে দিয়ে অভিরূপ তাকে জড়িয়ে ধরল। নোমান হতভম্ব। কর্ণকুহরে এলো অভিরূপের বলা কণ্ঠস্বর।
“আমি কি ভুল মানুষকে ভালোবাসলাম? কেন ভালোবাসলাম? যদি সে সত্যি টেরো’রিস্ট হয় তাহলে সেও সকলের সঙ্গে আমায় শে’ষ করতে চেয়েছিল?”

নোমান নীরব। মুখে কোনো কথা আসছে না। অভিরূপ ফের বলল,
“যে আমার মৃ’ত্যু কামনা করে তার সঙ্গে সারাজীবন চলার স্বপ্নে আমি দিনরাত মত্ত থাকি! ভালোবাসা কি এমনই হয়?”

ভালোবাসা নামক চার শব্দটির ব্যাখ্যা একেক জনের কাছে একেকরকম। প্রতিটি মানুষ ভালোবাসার কাঙাল হয়ে থাকে। এর জন্য কেউ ধুঁকে ধুঁকে ম’রে এক মুঠো ছাইয়ে পরিণত হচ্ছে আবার কেউ নতুন করে সজীব পাতার ন্যায় জীবিত হচ্ছে। কে হবে ভবিষ্যতে এই সুন্দর সজীব পাতা? আর কে হবে এক মুঠো ছাই?

[১ম খণ্ডের সমাপ্তি]

[বি.দ্র. অনেকে ভাবতে পারেন এটা কেমন ইন্ডিং! এটা কোনো সমাপ্তি নয় গল্পের। এটা শুধুমাত্র প্রথম খণ্ডের সমাপ্তি। শুধুমাত্র পরীক্ষার জন্য আমায় কয়েকদিন ব্রেক নিতে হচ্ছে। যার কারণে গল্পকে দুই খণ্ডে ভাগ করার সিধান্ত। আগেই কেউ ক্ষুদ্ধ হবেন না এটা সমাপ্ত কল্পনা করে। দ্বিতীয় খণ্ড ঠিক এখান থেকেই শুরু হবে। আর সেখানেই দেখা পাবেন আবার সকল চরিত্রের। এই কয়দিন অনিয়মিত হবার বেশ দাম দিতে হয়েছ আমায়। কমেন্টবক্সে অনেকের অনেকরকম কথা শুনেছি। কান দিই নি। কারণ আমি জানি আমি কী সমস্যায় ভুগছি এবং ভুগে চলেছি। কয়েকদিনের জন্য এই অনিয়মিত লেখিকা বিদায় জানাল। দ্রুত ফিরবে ইনশাআল্লাহ। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]