#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৯
“আমি তো আপনাকে আগ বাড়িয়ে চা খেতে বলিনি। আপনি স্বেচ্ছায় আমার মুখে দেওয়া এঁটো চায়ের ভাঁড়ে মুখ দিলেন।”
কোনমতে রাগটা দমিয়ে গমগমে সুরে বলে উঠলো রাগিনী। তার কথার ধরন বেশ ঝাঁঝালো বুঝে কোহিনূর মুচকি হাসলো। এত রাগ কেন করছে মেয়েটা? নাকি এটা অভিমানের প্রতিচ্ছবি? যদি তাই হয় মেয়েটিকে তো আরো বেশি করে অভিমানিনী করতে হবে। তারপরে ঝট করে ভেঙে দেবে সেই অভিমান। হুট করে বরফের ন্যায় গলে যাবে সেই পাহাড় সমান অভিমান। বিষন্ন মুখশ্রীতে যখন ফুটে উঠবে আকাশ সমান বিস্ময়। কোহিনূরের কাছে অসামান্য এবং অষ্টম আশ্চর্যের মতো লাগবে দৃশ্যটি। বিমোহিত হয়ে চেয়ে থাকবে সেই মুখের দিকে। বৃষ্টির ঝাপটা আবারও ছুঁয়ে গেল রাগিনীকে। সামান্যতম হেলদোল হলো না তার। কোহিনূর ঠেস মেরে বলল,
“এত সুন্দর চায়ের লোভ সামলাতে পারিনি। কে জানতো তুমি আমাকে ডায়াবেটিস ধরানোর প্ল্যানিং করে রেখেছো!”
“আজেবাজে বকবেন না। আপনাকে এখানে আসতে কে বলেছে?”
“কেউ আসতে না বললে বুঝি আসতে পারব না?”
রাগিনীর গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবার কোহিনূরের প্রতিটা কথা। কাঁটার মতো এসে খোঁচাচ্ছে কথাগুলো। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায় সে। চাপা রাগি সুরে বলে ওঠে,
“কেন পারবেন না? তবে আমার পাশ ঘেঁষে বসবেন না খবরদার। থাকুন আপনি। এখানেই বসে থাকুন। আমার পিছু পিছু আসবেন না বলে দিচ্ছি।”
কথাটুকু বলে আর দেরি করলো না রাগিনী। হনহনিয়ে এই ঝুম বৃষ্টির মাঝেই অগ্রসর হলো সে। কোহিনূর কোনোরূপ অস্থিরতা না দেখিয়ে বড্ড শান্ত গলায় বলে উঠলো,
“চা কি আমার জন্য দিয়ে গেলে? নো প্রবলেম, এই মিষ্টিটা আমার পছন্দ হয়েছে।”
ঘাড় ঘুরিয়ে ঝাঁঝালো দৃষ্টিতে তাকালো রাগিনী। তখনই পিছে ফিরে এসে কোহিনূরের হাত থেকে চায়ের ভাঁড় একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“লজ্জা করে না অন্য মেয়ের এঁটো জিনিস খেতে?”
“ওমা লজ্জা করবে কেন? এমনিতে ছেলেদের লজ্জা একটু কমই হয়। উপরন্ত কোহিনূর সাহেবের লজ্জা আরো কম।”
“আসলেই আপনি একটা লজ্জাহীন মানুষ। তার সাথে ঠকবাজও। একে তো এখানে আমার চায়ের এঁটো খাচ্ছেন তার উপর আপনার প্রেমিকাকে প্রেমপত্র লিখছেন।”
কোহিনূর কোনোমতে নিজের হাসি চেপে রাখলো। ঠোঁট টিপে বাধ্য ছেলের মত কথাগুলো শুনলো। রাগিনী আবারো কড়া কন্ঠে ঝেড়ে উঠলো,
“আপনি অন্য মেয়ের পাশ ঘেঁষে বসছেন। তার মুখ লাগানো খাবার খাচ্ছেন এটা জানলে আপনার প্রেমিকার খারাপ লাগবে না?”
নিরব রইলো কোহিনূর। বৃষ্টির ঝাপ্টা ছুঁয়ে গেল দুজনকেই। কোহিনূর নিজের হাত দুটো আড়ষ্ট করে বলল,
“অবশ্যই খারাপ লাগবে। কিন্তু যেই নারীর চায়ের চুমুকে আমি চুমুক দিয়েছি সে-ই নারীই যদি কাঙ্ক্ষিত প্রেমিকা হয় তবে আমার মনে হয় তার থেকে দ্বিগুন ভালো লাগবে।”
রাগিনী সরু চোখে তাকালো। কথাটা যেন মাথায় উপর দিয়ে গেল। প্রথমেই বোধগম্য হলো না। কিছুটা সময় নিয়ে ভাবতেই যেন রাগিনীর মাথা থেকে পা অবধি এক অসামান্য তরঙ্গ বয়ে গেল। তার কান কি ভুল শুনেছে? নাকি সে আবারও হ্যালুসিনেট করছে? তার চোখের একদম কাছে হাতের চুটকি বাজতেই হকচকিয়ে উঠলো রাগিনী। কোহিনূর ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার থরথর করে কেঁপে ওঠে রাগিনী। মানুষটির চোখের দিকে তাকানো মুশকিল হয়ে যায়। সামান্য কিছু কথা! সামান্য কয়েকটা শব্দ তার মনের সব রাগ-ক্ষোভ, অভিমানের পাহাড় মূহুর্তেই লজ্জার এক পুরো শহরে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। তবে কি এই মানুষটাও তাকে নিয়ে ভাবে? মানুষটার মনের মধ্যে বিচরণ করতে সক্ষম হয়েছে? তবে তার রূপ নিয়ে যে সন্দেহ? সেটার কী হবে? সন্দেহ করা কি বৃথা? সে কি ভয়ানক ভুল করছে? হতে কি পারে না সামান্য ট্রিটমেন্ট আর মেডিটেশনে ইমপ্রুভ? উহ্, না। রাগিনী যে ফাইলে পড়েছিল এমন পেশেন্টদের সুস্থতা অনেকটা পরের কথা!
“ওহ হ্যালো ম্যাডাম! এতোক্ষণ রেগেমেগে মুখে যা আসছিল তাই তো বলে যাচ্ছিলেন। এখন একদম সাইলেন্ট মুডে চলে গেলেন? আর শুধু শুধু বেচারা চায়ের ভাঁড়টা হাতে ধরে রেখেছেন। খাবেন না তো আমার হাত থেকে নেওয়ার কী দরকার ছিল? দেখিই আমি খেয়ে উদ্ধার করে ফেলি!”
বলেই চায়ের ভাঁড় আবারও ছোঁ মে’রে নিয়ে নিলো কোহিনূর নিজের কবলে। এতটুকু সময়ের এই ঠান্ডা মরশুমের দৌলতে চা প্রায় ঠান্ডা। মুখে দিয়ে এক ঢকে চা শেষ করল কোহিনূর। রাগিনী তখনও নিরব। সামান্য কিছু কথা যে একটা অগ্নিকান্ডকে এভাবে বরফের ন্যায় শীতল করে তুলবে সেটা ভাবনায় আসেনি কোহিনূরের। হঠাৎই নিরবতা ভেঙে তাকে চমকে দিয়ে রাগিনী বলল,
“একটু আগে যা যা বলেছিলেন সেটা কি আপনি ভুল বলেছেন? নাকি আমি ভুল শুনেছি?”
নিজের ছোট দাড়িভর্তি গালে হাত রেখে রাগিনীর সমান হতে একটু নিচু হয়ে বলল,
“আপনি তো ঠিক কথা বলেছি। তুমি কানে ভুল শুনেছো কিনা সেটা তো আমি জানি না।”
“আপনি মানুষটা বড্ড হেয়ালি করেন? এতো হেয়ালি কীসের?”
“তোমার কি মনে হয়? আমার মতো এতো জটিল, কঠিন, অসহ্য লোক যে অন্যকে জ্বালাতে এক ইঞ্চিও ছাড় দেয় না তাকেও কেউ ভালোবাসতে পারে? তারও কোনো প্রেমিকা থাকতে পারে?”
“সে যদি চায় তাহলে থাকতেই পারে। কোনো উদ্ভট মেয়ে তার প্রতি মুগ্ধ হতেই পারে। হতেও তো পারে এই জ্বালিয়ে রাখা আচরণটাই সেই মেয়েটির বড্ড প্রিয়!”
কোহিনূর সোজা হয়ে দাঁড়াল। তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। নিচু সুরে জবাব দিল,
“কেন? এটাও বুঝি কারোর পছন্দ হতে পারে? তোমার বিরক্ত লাগে না? অসহ্য লাগে না আমায়? কখনো মনে হয় না? যে তোমার মতো হুবহু দেখতে কেউ থাকলে তাকে তোমার জায়গায় আমায় সামলাতে পাঠিয়ে দিতে?”
শেষ কথাগুলো অদ্ভুত লাগলো রাগিনীর কাছে। বৃষ্টির থামাথামি নেই। ইতিমধ্যে সে কাকভেজা। নিজের ক্রোধে নিজেই ডুবে বৃষ্টিতে ভিজেছে। কোহিনূর চেয়ে রয়েছে তার উত্তর পেতে চাতক পাখির মতো। সে যে কৌশলে রাগিনীর জমজ কোনো বোনের কথা জানতে চাইছে সেটা রাগিনী বুঝেছে কিনা সেটা বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাগিনীর অদ্ভুত লাগলেও খুব একটা বেশি গভীরে নিয়ে গেল না ব্যাপারটাকে। কারণ মানুষটার অদ্ভুত সব প্রশ্নের সম্মুখীন তো প্রথমবার হয়নি। নিজেকে ধাতস্থ করে কিছুটা শক্ত গলায় বলল,
“আপনি রাগিনী তাজরীনকে আপনার সামনে দেখতে চান? নাকি রাগিনী তাজরীনের মতো যে কাউকে?”
রাগিনীর কাছে পাল্টা প্রশ্ন শুনে হতাশা নিয়ে তাকিয়ে রইল কোহিনূর স্থিরভাবে। মেয়েটার মুখে যেন সোজা কোনো কথা আসেই না। তবে উত্তর দিতে দেরি করল না কোহিনূর। অনর্গলভাবে বলে ওঠে,
“রাগিনী তাজরীন তো আর পৃথিবীতে দুটো নেই। সে একজনই। তার এই কোমল চোখের দেখা অন্য কোনো নারীর চোখে মিলবে না। তার অন্তরে থাকা সেই নম্র মন আমার কাছে এতোটাই মূল্যবান যে তার কাছে সব ফিকে পড়ে যায়। তার সেই ফিক করে হাসিটাও যেন সমস্ত অপরূপ গোলাপের মাঝে থাকা এক অপরূপা গোলাপ। যেটা মেলে ফুটলে নেত্রপল্লব সেখানেই স্থির হয়ে যায়।”
বলে কথার মাঝে থামে কোহিনূর। একটা বড় শ্বাস নিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে। এতোক্ষণ বিমোহিত হয়ে কথাগুলো শুনলেও কোহিনূরের এমন দুষ্টু মাখা হাসিতে চোখ ছোট করে তাকায় রাগিনী। কোহিনূর আবারও বলে ওঠে,
“সবথেকে বড় ব্যাপার যেটা রাগিনী তাজরীন ছাড়া অন্য কারোর মধ্যে থাকতেই পারে না। সেটা হচ্ছে, কাউকে সুনিপুণ এবং যত্নসহকারে খাইয়ে মা’রার পরিকল্পনা। যেটা রাগিনী তাজরীনের মাথা ছাড়া অন্য কারোর মাথায় এই জটিল বুদ্ধি আসতেই পারে না।”
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো রাগিনী। আর কত খোঁটা দেবে এই পাঁজি লোক? ভয়ানক এক চোখ রাঙানি দিয়ে খানিকটা তেড়েফুঁড়ে যেতেই কোহিনূর আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ঝুম বৃষ্টির মাঝেই ছুট লাগালো মাঝ রাস্তায়। রাগিনীও কম যায় কীসে? সে চিল্লিয়ে বলে উঠল,
“দাঁড়ান বলছি! ওখানেই দাঁড়ান! ভালো হবে না কিন্তু।”
কে শোনো কার কথা। বৃষ্টিতে দুজনেই ছুটছে। কোহিনূর আগে নিজেকে চোখ রাঙানি থেকে বাঁচতে ছুটছে আর রাগিনী রেগেমেগে তার পেছন পেছন। এদিকে কংক্রিটের বানানো রাস্তা নেই। রাস্তা হয়েছে কাঁদায় পরিপূর্ণ। বেশি জোরে ছুটতে গিয়ে একসময় ধপাস করেই আলুথালু হয়ে পড়ল কোহিনূর। কাদায় মাখামাখি হলো তার শরীর। এখনি পড়তে হলো তাকে? একরাশ বিরক্তি নিয়ে যখন উঠতে যাবে তখন তার কর্ণকুহরে ভেসে এলো যেন মোহনীয় হাসির সুর। মাথা উঁচু করতেই নেত্রপল্লবের মণি নামক অংশে যেন আঁটকে গেল সেই হাসির সুর সৃষ্টি করা মানবী। খিলখিল করে হাসছে রাগিনী। তার কাছে মনে হচ্ছে যেন কোনো আট-দশ বছরের বাচ্চা খেলতে গিয়ে লাফিয়ে কাঁদায় পড়েছে। কোহিনূরের মুখে না চাইতেও হাসি চলে আসে। জোর করে ঠোঁট যেন আপনমনে প্রসারিত হয়। বৃষ্টিতে ছিপছিপে গড়নের মেয়েটির গায়ে জামা লেগে গেলেও নিজেকে বেশ সামলে রেখেছে সে। ওড়না দিয়ে নিজেকে বেশ পেঁচিয়ে রেখেছে। লম্বা চুলগুলো চারিপাশে এলোমেলো হয়ে টপটপ করে পড়ছে চুলের আগা দিয়ে পানি। চিকন ঠোঁটে টপটপ করে পানি পড়তেই যেমন মনে হচ্ছে গোলাপি রঙের পদ্মফুলে পানির ছিটা এসে পড়ছে। এ যে কোহিনূরের কাছে নেশার চেয়েও ভয়ঙ্কর। এ নেশা কাটার নয়। এই নেশা দিন যাবে আরো আঁকড়ে ধরবে কোহিনূরকে। তিলে তিলে প্রগাঢ় হয়ে উঠবে।
“তাহলে? আমার বাড়িতে তোমরা দুজন যাচ্ছো ইটস ফাইনাল!”
চকিতে একে অপরের দিকে তাকায় নোমান এবং অভিরূপ। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। মুখচোখ ফুলে আছে নিশ্চিত। দুজনেই চোখ ঢলতে থাকল। অভিরূপ জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
“এতো কষ্টের কী দরকার বলুন তো আঙ্কেল। আমরা আছি এখানে ভালোই। দরকার হলে প্রতিদিন আপনার সঙ্গে একবার করে দেখা করে আসবো। কিন্তু আপনাকে এতো কষ্টে ফেলতে চাই না।”
রাশেদ সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুচকি হাসেন। উনি বেশ বুঝতে পারছেন অভিরূপ যেতে চাইছে না। তার মূল কারণ হতে পারে ঘোরাফেরা! অভিরূপ ছেলেটা নিজের মতো চলছে স্বাচ্ছন্দ্যবোদ করে সেটা উনি তার বন্ধু নাদিমের থেকে শুনেছে। অভিরূপ হয়ত ভাবছে রাশেদ সাহেবের বাড়িতে গেলে ইচ্ছেমতো যখন তখন বের হতে পারবে না। রাশেদ সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
“আমার কষ্ট আর কীসে? আমি ব্যস্ত মানুষ। তোমাদের সঙ্গে সময় কাটানো হবেই মাত্র রাতের সময় আর সকালটা।”
“তাহলে আমরা দুজন গিয়ে একা একা আপনার বাড়িতে আঙ্কেল সারাদিন? তাছাড়া আপনি একা একটা মানুষ। আমরা গেলে আপনার প্রেশার পড়ে যাবে। তাই না?”
রাশেদ সাহেব থেমে থেমে বললেন,
“আমি একা আর কোথায়? তোমাদের সঙ্গী দেওয়ার জন্য আমার মেয়ে রাগিনীও আছে। ও থাকলে আমার কষ্ট কীসে?”
থমকে গেল অভিরূপ। কপাল কুঁচকে গেল। বোঝার চেষ্টা করলো সে সঠিক শুনলো নাকি ভুল? ‘রাগিনী’ নামটি বুঝি তার মনেই গেঁথে গিয়েছে? যে এখন রাশেদ সাহেবের মুখ থেকেও রাগিনী নামটি শুনতে পাচ্ছে? সে নিশ্চিত হবার জন্য আরো উৎসুক হয়ে বলল,
“আপনার মেয়ে রাগিনী?”
“হ্যাঁ। তুমি হয়ত ভুলেই গেছো। এমনিতেও আমাদের খোঁজখবর রাখো না। আমার মেয়ে তো আছেই। যদিও আর কয়েকদিনের জন্য। পরিক্ষার পর ছুটি পেয়ে বাবার কাছে চলে এসেছে। এখন তো বাড়িতেই আছে রাগিনী।”
মাথা টলমল করে ঘুরে উঠল অভিরূপের। মনে বাগড়া দিল টান টান উত্তেজনা। তৎক্ষনাৎ নোমানের দিকে হেলে পড়লো সে। ফিসফিস করে বলল,
“এই আমাকে একটু ভালোবেসে চিমটি কাট তো।”
নোমান আঁড়চোখে তাকায়। মাঝে মাঝে ছেলেটার ভাবভঙ্গি বোধগম্য হয় না। অভিরূপের হাত বাড়ানো দেখে সেও সুযোগ বুঝে জোরে দিয়ে ওঠে এক চিমটি। চোখমুখ জড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে হাত টেনে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে অভিরূপ বলে,
“তোর ভালোবাসা এতো কঠিন কেন ভাই? মেয়ে জুটবে না তোর কপালে। মিলিয়ে নিস।”
“তখন তোর বউকে নিজের বউ বানিয়ে নেবো। নো প্রবলেম।”
সহজভাবে উত্তর দিয়ে সোজা হয়ে বসে নোমান। বিস্ফোরিত নয়নে অভিরূপ তাকাতেই রাশেদ সাহেবের কথায় তড়িঘড়ি করে নিজেকে সামলে সামনে তাকায় সে।
“তোমরা আমার বাড়িতে না গেলে আমার কাছে বিষয়টা অনেক দুঃখজনক হয়ে দাঁড়াবে। অনেক আশা নিয়ে এসেছি আজ।”
নোমান বাঁকা চোখে অভিরূপের দিকে তাকালো। সে তো প্রথম থেকেই যাবে না যাবে না করছে। নিশ্চয় ছেলেটা যাবেই না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো রাশেদ সাহেবকে ভালো করে বোঝাবে। তাই নিজের ভাবনা মতো কিছু বলতে উদ্যত হতেই অভিরূপ তড়িঘড়ি করে একপ্রকার উল্লাস নিয়ে বলে ওঠে,
“আপনি আমার বাবার মতো হন। আপনাকে আশাহত কিছুতেই করতে পারি না আঙ্কেল। তাই আমরা অবশ্যই যাব। আপনার কথা ফেলতেই পারি না।”
নোমান হতবিহ্বল। মুখে কোনো ভাষা নেই। এই অভি কতবার নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টাবে? অভিরূপ আবারও বলল,
“তবে হ্যাঁ। আমরা রাতে যাব। একটু ঘোরাফেরা মানে বুঝছেন তো আঙ্কেল…”
বলেই ঠোঁট প্রসারিত করে হেঁসে বলল অভিরূপ। রাশেদ সাহেব মাথা নাড়িয়ে বলল,
“সবই বুঝলাম। বাট সাবধানে বাহিরে ঘোরাফেরা করো। এমনিতেই যা গেল তোমাদের উপর দিয়ে। আমি আসি। অলরেডি আই এম লেট। আপনাকে চেম্বারে যেতে হবে।”
কোনোরকমে নিজের উল্লাসটা চেপে রেখে রাশেদ সাহেবকে বিদায় জানালো অভিরূপ। দরজাটা লাগাতেই দৌড়ে এলো সে নোমানের দিকে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকাতেই নোমানের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো অভিরূপ। নোমানের গালটা ধরে একটা চুমু খেয়ে লাফিয়ে বলে উঠল,
“সুইটহার্ট, প্রে ফর মি! যেন সে-ই মেয়েটাই হয়।”
নোমান চোখমুখ জড়িয়ে তাকালো। হাতের কনুই দিয়ে অভিরূপকে গুঁতো মে’রে সরিয়ে নিজের গালটা সযত্নে দুহাতে মুছে বলল,
“অসভ্য! একে তো ব্রাশ করিস নি সেই মুখ আমার গালে লাগাস। ছি! কী গন্ধ! আমার বউ এসব শুনলে জীবনেও আর চুমু খাবে?”
নিজের আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে নোমানকে আবারও ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে মা’রল অভিরূপ। আর আনন্দিত হয়ে বলল,
“ওটা ভালোবাসার গন্ধ মনে করে নে।”
নোমান ফুঁসে উঠে জিজ্ঞেস করল,
“আর কোন মেয়ের কথা শুনে মনে গিটার বাজছে তোর? মানুষ থেকে বাঁদরও হয়ে গেছিস একেবারে।”
অভিরূপ বেশ ভাবুক সুরে উত্তর দিল,
“সেই মেয়ে! সেই চমৎকার সাহসী চাহনির মালকিন!”
চলবে…
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০
চারিপাশ বিরাজ করছে নিরবতা। লোকজন থাকা সত্ত্বেও সকলে গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে রয়েছে সোজা হয়ে। জায়গাটা পুলিশ হেডকোয়ার্টার। নির্জন ওরফে কোহিনূরও সেখানে উপস্থিত। গায়ে জড়ানো বরাবরের ন্যায় কালো ইউনিফর্ম। চুলটা এখনো ভেজা। কপালে নেতিয়ে কপাল নামক অঙ্গটি পুরোটাই ঢেকে দিয়েছে। মাঝে মাঝে নাক ঘষছে। এই ঘষাঘষির ফলে লাল টকটকে হয়েছে নাক। চোখ দুটো আগের থেকেই লাল। বদ্ধ ঘরে এসির ঠান্ডা বাতাস সহ্য হচ্ছে না। শুষ্ক ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে। হাত দুটো মুঠো করে কোটের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে। বড়সড় এই হলরুমে সকলের মুখে জড়তা। নির্জন খুব একটা এদিকটা আসে না। কিন্তু আজকে গোল টেবিল বৈঠক। সকল বড় বড় পুলিশ অফিসার থেকে শুরু করে সকলকেই ডাকা হয়েছে। নির্জনও তার মাঝে একজন। তার মাঝে নয়। সে-ই তো এখন এখানকার মূল আকর্ষণ। কারণ যে কেস নিয়ে বৈঠক হবে সেটা তো নির্জনের হাতেই রয়েছে। সকলের গাম্ভীর্যের সাথে তাল মিলিয়ে নির্জন নিজেও চুপচাপ থাকার চেষ্টা করলেও তা আর হয়ে উঠল না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরেও উচ্চস্বরে হাঁচি দিয়ে উঠল সে। নাকের ভেতর যেন মনে হচ্ছে কেউ সুড়সুড়ি দিয়ে চলেছে। হাঁচি দিয়েই চোখ মেলতেই নির্জন দেখলো বর্তমানে সকলের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়েছে সে। ঘাড় ঘুড়িয়ে সকলের দৃষ্টি নির্জনের দিকে স্থির। ঢক গিলে জোরপূর্বক হাসি দিতেই হলরুমের শেষ প্রান্তের দরজা খুলে প্রবেশ করল কেউ। সকলের দৃষ্টি তখনি সরলো নির্জনের থেকে। নির্জন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। তবে যে এসেছে তাকে ধন্যবাদ দিলে মন্দ হয় না। এই কড়া কড়া দৃষ্টি থেকে বাঁচার আনন্দে ধন্যবাদ দেওয়াই যায়। সেও এবার সকলের মতো দেখতে দরজার পানে তাকালো কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখতে। দেখেই কপালে পড়ল পরপর তিনটে ভাঁজ। চোখ সরিয়ে হতাশা নিয়ে বিরবির করে বলল,
“তাকে আর ধন্যবাদ? ইম্পসিবল!”
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করতেই এসির ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা গায়ে লাগে রায়ানের। তার বাম হাতটা তার শেখর এসিস্ট্যান্ট অফিসার শেখর ধরে রেখেছে। রায়ানের পায়ের ক্ষতটা এখনো অনেকটাই তাজা। হাঁটতে গেলেই যেন একটা করে অভাবনীয় যন্ত্র’ণার শিকার হতে হচ্ছে তাকে। তবুও দরকারি মিটিং! এখানে তাকে আসতেই হবে। এসপি স্যার নিজে কল করেছিলেন। তবে এটাও বলেছিলেন বেশি সমস্যা হলে আসতে হবে না। কিন্তু কেসটার সঙ্গে সে নিজেও জুড়ে আছে। তাই জোর করেই এসেছে একপ্রকার রায়ান। তাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে রাখা নির্জনের পাশেই খালি চেয়ারে আস্তে করে বসিয়ে দেয় শেখর। ভালোমতো বসে রায়ান শেখরের উদ্দেশ্যে বলে,
“এখন যাও তুমি। আমার কোনো সমস্যা হবে না।”
শেখর সম্মতি জানিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে। আস্তে আস্তে করে রায়ানের পাশ ফিরে তাকায় নির্জন। চোখটা বড় করে রায়ানের পা থেকে মাথা পর্যবেক্ষণ করে কিছুটা খোঁচা মে’রে বলে,
“আপনি কাজকে ছাড়লেও কাজটা যেন কিছুতেই আপনাকে ছাড়তে চায় না ইন্সপেক্টর রায়ান।”
রায়ান স্মিত হাসে। নির্জনের কোনো কথা আর তেমন গায়ে লাগে না তার। অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। ছেলেটা যেন এমনই। রায়ান হাসিমুখেই উত্তর দেয়,
“কী করবো বলুন? কাজের সাথে আমার গভীর কানেকশন আছে। যেমন আপনার সঙ্গে গভীর রাতের কানেকশন আছে ঠিক সেইরকম।”
টনক নড়ে নির্জনের। ভ্রু কুটি কুঁচকে যায়। বেশ উৎকন্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন?”
“মানেটা খুব সিম্পল! আপনি কি গভীর রাত ছাড়া অন্যসময় হসপিটালে আমাকে দেখতে আসতে পারেন না? আমি যখন ঘুমে মগ্ন তখন আপনার আবির্ভাব ঘটে। চোরের মতো উঁকি দিয়ে দেখেন আমার কেবিনে। অন্যসময় কি হসপিটাল নামক জিনিসটার সঙ্গে আপনার এলার্জি আছে?”
তব্দা লেগে হা হয়ে যায় নির্জনের মুখ। বাকহারা হয়ে নিষ্পলক চোখে চেয়ে থাকে রায়ানের দিকে। পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলেও বিস্ময় কমে না তার। আশ্চর্য তো! রায়ান কী করে জানলো এইসব কথা? কী করে জানলো সে তাকে রাতে দেখতে যায়? সে যাতে না জানতে পারে সেকারণেই তো এমন চোরের ভঙ্গিমায় রাতে দেখতে যাওয়া। সে-ই কিনা ধরে ফেলল? এটা কি ঠিক হলো? মুখটা কাঁচুমাচু করে নির্জন কিছু না জানার ভঙ্গি ধরে উত্তর করে,
“রিয়েলি! আপনি দিন দিন ইনভেস্টিগেট করতে করতে নিজে গল্পও বানাতে শিখে গিয়েছেন। আই থিংক আপনার রাইটার হওয়ার উচিত ইন্সপেক্টর রায়ান!”
বলেই হু হা করে হাসার চেষ্টা করে সে। রায়ান মাথা ঝাঁকিয়ে নিচু সুরে বলল,
“সেটাই হবে। আমার সঙ্গে ডক্টর নিজেও গল্প বানায় রাইট অফিসার? ডক্টরের কল্পনাতেও আপনি আসেন। এসে তার থেকে আমার এই পায়ের সিচুয়েশনের ডিটেইল নিতে নিতে একেবারে তাকে অসহায় বানিয়ে ফেলেন। নিশ্চয় ডক্টর হ্যালুসিনেট করে এসব আমায় বলেছে।”
কথাটা শোনামাত্রই কিছু একটা বিরবির করে চোখ বুঁজে ফেলে নির্জন। চোখেমুখে দেখা দিল যেন চুরি করার পর ধরা খাওয়ার পরের প্রতিক্রিয়া। মাথা নিচু করে বিরবির করে বলল,
“ইডিয়ট ডক্টর!”
“কিছু বললেন?”
রায়ানের প্রশ্নে চোখ মেলে না চাইতেও একটা হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায় নির্জন। ডিআইজি মারুফ হোসেন এবার মুখ খোলেন। বেশ গাম্ভীর্যের সাথেই বলেন,
“তাহলে শুরু করা যাক? যেহেতু যার অপেক্ষা ছিল আই মিন ইন্সপেক্টর রায়ান, সে তো এসেই গেছে। দেরি করে লাভ কী?”
আইজিপি অফিসার নীলয় সম্মতি জানিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, দেরি যত করা হবে ততই ক্ষতি।”
কথাটা শেষ করার মাঝে থামলেন উনি। নির্জনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এবার এবং বলে উঠলেন,
“অফিসার নির্জন!”
না চাইতেও উঠে দাঁড়াল নির্জন। বৃষ্টির মধ্যে কাঁদায় পড়ে নাকানিচুবানি খেয়ে সেই বেশরমের মতো হাসার ফলাফল পাচ্ছে বর্তমানে। হাঁটতে গেলে পায়ে লাগছে কিছুটা। তবুও স্বাভাবিকভাবে হেঁটে গিয়ে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বড় দম নিয়ে বলল,
“আই এম অফিসার নির্জন। দ্যা হেড ওফ সিক্রেট টিম। যার দায়িত্বে বর্তমানের সবথেকে বড় আ’তঙ্কজনিত কেস রয়েছে। একটা টেরো’রিস্ট টিম যেটা কিনা চট্টগ্রাম নামক বড় শহরে আ’তঙ্ক ছড়িয়ে সবাইকে সংকেত দিয়ে এসেছে এবার তারা ঢাকায় আসছে। এসেছেও পড়েছে তারা। একের পর এক ধ্বং’সলীলা শুরু করে দিয়েছে। যার প্রথম টার্গেট ছিল এডিশনাল এসপি স্যার। তারা সক্ষম হয়েছে। তাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির উপর দিয়ে আমরা যেতে পারিনি।”
অনর্গল কথা বলে এবার থেমে বড় শ্বাস নিলো নির্জন। টেবিলে পড়ে থাকা প্রজেক্টরের রিমোট হাতে নিয়ে পাওয়ার অন করতেই দেখা গেল একটা সিসিটিভি ফুটেজের ক্লিপ। সকলে দেখলো কিছুটা অস্পষ্ট দৃশ্য। এডিশনাল এসপি সাহেবের বাড়িতে একটা টুপি পড়া লোক ঢুকছে। গায়ে ডেলিভারি ম্যানের পোশাক। নির্জন সেটা দেখিয়ে বলা শুরু করে,
“আমরা যতদূর জানতাম খু’নিরা খুব কৌশলে বাড়ির সব অংশ শেষ করে দেওয়ায় কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে পাশের বিল্ডিং থেকে এই ফুটেজ পাওয়া গেলেও এই ছেলেটা কে তা জানা যায়নি।”
মারুফ হোসেন কিছুটা চিন্তিত মুখ দিয়ে হতাশার সাথে বললেন,
“যা জানা গিয়েছে সেটাই বলো। যেটা জানা যায়নি সেটা বলে লাভ নেই। তুমি জানো না আমরা একেবারে বাঘের মুখে পড়েছি। মিডিয়া প্রশ্ন তুলছে! তার উপর অভিরূপ চৌধুরীর অসময়ে আগমন। সব ঘেঁটে দিল একেবারে।”
উনি থামতেই এসপি সাহেব বলে উঠলেন,
“আমি শুনেছিলাম একটা মেয়ে নাকি এমন কান্ড ঘটাচ্ছে? নাম কী যেন! রাগিনী তাজরীন। কথাটুকুর কতটা সত্যতা বের করতে পেরেছো?”
“স্যার, আই উইকনেসের স্কেচ অনুযায়ী আর বাকি যেদিন এসব ঘটনা ঘটেছিল সেসব দেখে মনে হয়েছিল হ্যাঁ সত্যিই সেই মেয়েটার যোগসূত্র থাকতে পারে। ফোনের লোকেশনটা সবসময় নজরে রাখা হচ্ছিল। কিন্তু দিন যায় ধারণা পাল্টায়।”
নির্জনের কথায় ভ্রু কুঁচকে আসে রায়ানের। সে নিজেও রাগিনীর মতোই হুবহু কাউকে দেখেছে। তাই সন্দেহ সেও উড়িয়ে দিতে পারছে না। সে কৌতূহল নিয়ে বলল,
“ধারণা পাল্টানোর কারণ?”
নির্জন বাঁকা হাসে। বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,
“রাগিনী তাজরীনের হেমোফোবিয়া আছে। যার মানে র’ক্তে ফোবিয়া। সেই সঙ্গে অ্যাকোস্টিকোফোবিয়াও রয়েছে। এরমানে অতিরিক্ত শব্দে ফোবিয়া। তাহলে এটা তো ধরে নেওয়ায় যায় যেই মেয়ে এতোটা ভীতু সে কী করে পরপর এতো কান্ড ঘটাবে?”
নির্জন থামে এবার। হাঁচি আসছে আবার। নিজেকে সংযত করে আবারও বলে,
“ইন্সপেক্টর রায়ানকে যেদিন টার্গেট করা হয় সেদিন ছিল অভিরূপ চৌধুরী আসার ঠিক আগের দিন। হয়ত টেরো’রিস্ট টিম কোনো না কোনোভাবে জেনেছিল যে ইন্সপেক্টর রায়ান অভিরূপ চৌধুরীর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু তারা সফল হয়নি। ইন্সপেক্টর রায়ানের ভাষ্যমতে সেদিন উনি নিজের গাড়ির কাছে একটা মেয়েকে দেখেছিলেন। যে মাস্ক পরিহিত থাকলেও তার অনেকাংশ রাগিনী তাজরীনের সাথে মিলে যায়। কিন্তু ওইদিনই ওই সময় রাগিনীর লোকেশন ছিলোই না সেই এরিয়ায়। আর রাগিনীর সঙ্গে সেই মেয়েটির পোশাকের ধরনে ছিল আকাশ-পাতাল তফাৎ।”
সকলের মুখে ছেয়ে যায় কৌতূহলে। কানাকানি চলতে থাকে। ফিসফিস কথা শুরু হয়। আইজিপি সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠেন,
“তাহলে রাগিনীর মতো আরো কেউ আছে বলতে চাইছো?”
“প্রশ্নটা আমারও সেখানে। আমার সন্দেহ আরো তীব্র হয় এয়ারপোর্টে সেই হা’মলার সময়। তবে ভাগ্যটা ভালো ছিল। ইন্সপেক্টর রায়ানের বুদ্ধিমত্তায় অভিরূপ চৌধুরীর কোনো ক্ষতি হয়নি। উনি কৌশলে গাড়ির নম্বর চেঞ্জ করে দেন। ফলে বিভ্রান্ত হয় আত’ঙ্কবাদী। নিঃসন্দেহে ইন্সপেক্টর রায়ান ভালো কাজ করেছেন।”
এবার সকলের দৃষ্টি গেলো রায়ানের উপর। উসখুস করে নির্জনের দিকে তাকালো রায়ান। সে ভালোমতো বুঝেছে নির্জন ইচ্ছে করে এমন বলছে। নির্জন এবার রিমোটের অন্যজায়গায় চাপতেই সিন পাল্টে যায়। দৃশ্যমান হয় এয়ারপোর্টের বাহিরে অভিরূপের গাড়ির সামনে থাকা সেই মেয়েটির মুখশ্রী। অস্পষ্ট হলেও সকলে বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটিকে। পাশাপাশি দৃশ্যমান হয় রাগিনী তাজরীনের স্পষ্ট ছবিও। নির্জন দুটো ছবিই দেখিয়ে বলে,
“ছবিটা মিলিয়ে দেখুন কাইন্ডলি।”
“আরে এরা তো একই দেখতে।”
ডিআইজি সাহেব তড়িঘড়ি করে নিজেকে সামলাতে না পেরে বললেন। নির্জন সম্মতি জানিয়ে বললেন,
“একই দেখতে তবে দুটোই আলাদা দেহ। এয়ারপোর্টের যেই রাগিনী তাজরীনকে দেখছেন সে এইসময় এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকলেও একই সময়ে অন্য রাগিনী তাজরীন সিটি হসপিটালে উপস্থিত ছিল। একটা বাচ্চা ছেলেকে রেসকিউ করে তার সেফটি দিয়ে ব্যস্ত ছিল।”
বলেই আবারও রিমোট দিয়ে সিন পাল্টালো নির্জন। দেখা গেল হসপিটালের সিন। সেখানেও রাগিনীকেই দেখা যাচ্ছে। তার চিন্তায় ভরা মুখটা স্পষ্ট। নির্জন শক্ত গলায় বলে,
“এটা ঠিক ওইসময়েরই ফুটেজ যখন এয়ারপোর্টে এই রাগিনী তাজরীনকে দেখা গিয়েছিল।”
সকলে এবার স্তব্ধ। মাথাটা যেন ভনভন করে ঘুরছে সকলেরই। এসপি সাহেব হাফ ছেড়ে বললেন,
“তাহলে রাগিনী তাজরীনের মতো আরেকজনও এক্সিস্ট করে? তাহলে তার পরিচয় কী? সে কি রাগিনীর জমজ?”
“রাশেদ সাহেবের ডিটেইলস ঘেঁটে দেখা হয়েছে। উনার স্ত্রীর প্রেগ্ন্যাসির সময়কার ডিটেইলসও যোগাড় করা হচ্ছে। তবে জমজ বলতে এখনো কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি।”
সকলে পড়েছে এবার গোলকধাঁধায়। কোনটার সঙ্গে কোনটা জুড়ে আছে সেটা কারোরই মাথায় আসছে না। সবাই চোখাচোখি করছে। উত্তর খোঁজার চেষ্টায় মগ্ন। কবে পাবে সেসব উত্তর?
রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। ফাঁকা রাস্তা। ঢাকা শহরের রাস্তা যতই রাত হক ফাঁকা হতে চায় না। তবে এটা ওফসাইডের রাস্তা। চারিপাশে কিছুটা জঙ্গলের উপস্থিতিও রয়েছে। আবার মনে হচ্ছে কোথাও পরিত্যক্ত কবরস্থান! মাঝ দিয়ে প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে দুটো গাড়ি চলছে। একটার রঙ সাদা আরেকটা গাড়ির রঙ কালো। একটা গাড়ি আরেকটা গাড়িকে টক্কর দিচ্ছে বলা চলে। দুটোই চলছে হাই স্পিডে। কালো গাড়ি ড্রাইভ করছে স্বয়ং অভিরূপ। আর সাদা গাড়ির মধ্যে নোমান। অভিরূপের শখ হয়েছে এদেশে একটু রেসিং করার। নোমানকে জোরজবরদস্তি করেই নিজের সাথে এই রেসে নামিয়েছে সে। অভিরূপের কানে ব্লুটুথ। সে নোমানের ব্লুটুথে কানেক্ট করে বলল,
“গেট রেডি মাই ডিয়ার। তুই হারবি।”
“রিয়েলি? লেটস সি!”
বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠল নোমান। অভিরূপ তার এতো আত্মবিশ্বাসের কারণ খুঁজে পেলো না। কারণ তার গাড়িটাই আগে চলছে। তাই সে ব্যঙ্গ করে প্রতিত্তোর করল,
“ফাঁকা কলসি বাজে বেশি। নোমানও বাজছে ঠকঠক!”
নোমান উচ্চস্বরে হেঁসে উঠতেই অভিরূপ নিজের গাড়িতে একটা অদ্ভুত সমস্যা লক্ষ্য করল। গাড়িটার স্পিড কমাতেই নোমানের গাড়ি তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। গাড়িটা আস্তে করে ব্রেক কষলো অভিরূপ। গাড়ি থামলো। জানালা খুলে একটু উঁচু হয়ে মাথা বের করে গাড়ির নিচে উঁকি দিতেই দেখলো গাড়ির টায়ারে হাওয়া নেই। এবার বুঝতে বাকি রইলো না তার। দাঁত চেপে চিল্লিয়ে নোমানের উদ্দেশ্যে বলল,
“চিটিংবাজ!”
নোমান জোরে হেঁসে বলল,
“বাই বাই! তুই পরে আয়। আমি রাস্তা ঘুরে তোকে পিকআপ করব। ওকে মাই ডিয়ার?”
বলেই কল কাটলো নোমান। যেচে রেসিং করতে গিয়ে হেরে যাবার রাগটা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মুখটা বেলুনের ন্যায় ফুলিয়ে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করল অভিরূপ। গাড়ির এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিয়ে বেশ আয়েশে বসে সামনে তাকাতেই একটা অবয়বকে গাড়ির কিছুটা সামনে দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যেতে দেখলো। চোখ কচলে ভালো করে সোজা হয়ে বসলো তৎক্ষনাৎ অভিরূপ। সে কি ভুল দেখলো? যখন আরো একদল ছেলেকে ছুটে জঙ্গলের ভেতরেই ঢুকতে দেখলো তখন অভিরূপের মনে হলো এটা ভুল নয়। মেয়েটির বিপদের আশঙ্কা!
চলবে…