#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৭
“এটা কেমন ধরনের প্রশ্ন ইন্সপেক্টর? আমার কয়টা সন্তান এই ব্যাপারে নিশ্চিত হবো না কেন আমি? আপনি আমাকে এসব অদ্ভুত প্রশ্ন করে বিব্রত করছেন।”
রাশেদ সাহেবের চটপটে কন্ঠ। বোঝাই যাচ্ছে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছেন উনি। সারা শরীরে অস্থিরতা স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে। রায়ান উনাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“রিল্যাক্স, স্যার। আপনি আমার কথা অন্যভাবে নিয়ে নিচ্ছেন। এমন অনেক ঘটনা ঘটে আজকাল। দুটো বেবি হয় আর একজনের প্রবলেমের কারণে মা’রাও যায়। তাই আমি জিজ্ঞেসা করছি। আপনার জীবনে কি এমন কোনো ঘটনা আছে?”
“না নেই। আমার একমাত্র সন্তান রাগিনী। তার জন্মের সময় কোনো কমপ্লিকেশনস্ ছিল না। সে সুস্থ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।”
রায়ান এবার রাশেদ সাহেবের উত্তরে এক গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হলো। বৃদ্ধি আঙ্গুল দিয়ে কপালের ধার বুলাতে বুলাতে ভাবতে থাকল লোকটি আসলেই সত্যি কথা বলছে? নাকি সম্পূর্ণটাই মিথ্যে? আবার এমন নয় তো? যে নিজের অন্য মেয়েকে বাঁচাতে উনি নিজেও এসবে শামিল? মাথা ঝাঁকুনি দিল একবার রায়ান। কীসব উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা। তার সামনের মানুষটা তো যেমন তেমন মানুষ নয় যে অ’পরাধে জড়িয়ে যাবে আর নিজের মেয়েকেও সেই পথে চালনা করবে। উনি শাহ্ রাশেদ। ঢাকার কয়েকজন বিখ্যাত সাইকোলজিস্টের কথা বললে সর্বপ্রথম উনার নামই ওঠে। এমন মানুষের কী প্রয়োজন এমন ক্রা’ইমে জড়ানোর? রাশেদ সাহেবের কন্ঠে একটা একটা করে ভাবনার সুতো কেটে যায় রায়ানের।
“কিন্তু এমন উইয়ার্ড কুয়েশ্চন করার রিজন আমি জানতে পারি?”
রায়ান তপ্ত শ্বাস ফেলে জবাবে বলে,
“বিষয়টা অনেক জটিল। ঢাকায় যেই টে’রো’রিস্ট টিমের থা’বা পড়েছে সেটা সবাই জানে। আই গেস, আপনিও জানেন।”
“তার সঙ্গে এই প্রশ্নের কী সম্পর্ক ইন্সপেক্টর?”
রায়ান এবার তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শেখরকে ইশারা করতেই শেখর তার দিকে একটা মোটা কাগজ এগিয়ে দেয়। রায়ান সেটা নিয়ে টেবিলে মেলে ধরতেই দৃশ্যমান হয় রাগিনীর আঁকা স্কেচ। তা দেখে নড়েচড়ে চশমা ঠিক করে বসেন রাশেদ সাহেব।
“এটা তো আমার মেয়ে।”
“আপনি সিউর? এটা আপনার মেয়ে?”
“আশ্চর্য! আমি সিউর হবো না কেন? আমার র’ক্তকে চিনতে আমার ভুল হবে কেন? আমি ওকে নিজের বুকের পাঁজরে রেখে বড় করেছি। আপনার কথাবার্তায় আর বিব্রত করবেন না আমায়।”
আবারও উত্তেজিত রাশেদ সাহেবকে রায়ান ঠান্ডা গলায় বলল,
“আপনি কি জানেন? এই স্কেচের মেয়েটার ব্যাগে বো’ম বানানোর মেটেরিয়ালস্ আর রি’ভলবা’র পাওয়া গিয়েছে?”
বিস্ময়ের সীমানা রইল না রাশেদ সাহেবের। মাথাটা কেমন যেন ভমভন করছে উনার। কথাগুলো যেন নেওয়া যাচ্ছে না আর। কন্ঠস্বর মিইয়ে গিয়েছে। তবুও বললেন,
“হোয়াট? কী বলছেন?”
“ঠিক বলছি। আপনার মেয়ে রাগিনী তাজরীন যেদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাতে ব্যাক করে সেদিন আপনার মেয়ের পরিচয়েই আরেকজন আপনার মেয়ের মতোই দেখতে হুবহু একজন ওই ট্রেনেই ছিল। আর সে টেরো’রিস্ট টিমেরই একজন।”
কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না রাশেদ সাহেব। সবটাই যেন একটা অবিশ্বাস্য কান্ড। যেটা বিশ্বাস করতে না পারলেও সত্য। পুলিশের লোক নিশ্চয় মিথ্যে বলবে না। মাথাটা ঠান্ডা করতে চাইলেন নিজের। কারণ এই বিষয়ে এখন খোলাখুলি আলোচনা করা প্রয়োজন। এটা উনার মেয়েকে নিয়ে প্রশ্ন। যাকে সবসময় উনি আগলে রেখেছেন। রাগিনী হলো উনার সাত রাজার ধন। তাকে হারাতে দেবেন না কিছুতেই। তাই নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলেন,
“তার মানে আপনারা বলতে চাইছেন রাগিনীকে ফাঁসানো হচ্ছে?”
“ঠিক সেটাই। আসলে আমরা প্রথমে সন্দেহ করি আপনার মেয়েকেই। সেটা ধরে এগোতে থাকি। তাকে সরাসরি গিয়ে ধরতে পারছিলাম না উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ না পেয়ে আমরা হতাশ হই। পরে আস্তে আস্তে ধরা পরে আপনার মেয়ের মতোই অন্য একজন। যার সত্ত্বা ভিন্ন তবে চেহারা এক।”
“কিন্তু এটা কীভাবে পসিবল? আমার জমজ মেয়ে ছিল না। আমার আজও স্পষ্ট সেইদিনের কথা মনে আছে। আমার রাগিনীর জন্ম হলো। আমি খুশি ছিলাম। সেই খুশি ভাষায় প্রকাশ করার মতো ছিল না। ডক্টর কখনো আমাকে জমজ বেবির কথা বলেনি। আর রিপোর্টেও যতবার দেখেছি একটাই মেয়ে বাচ্চার কথা উল্লেখ ছিল।”
বলেই থামেন রাশেদ সাহেব। ঠোঁট চেপে কিছু একটা ভাবেন। আশেপাশে তাকান। অন্য একটা কথা হুট করেই মাথায় খেলে যেতেই তিনি বিদ্যুতের গতিতে বলে উঠলেন,
“ওয়েট ইন্সপেক্টর! এটা ইম্পসিবল না। প্লাস্টিক সার্জারি বলেও একটা শব্দ আছে। এটা অসম্ভব কিছু না এখন। আর আমি শুনেছিলাম বিদেশ থেকে এখন নামি-দামি সার্জন আনা হয়। এরা খুব নিখুঁতভাবে চেহারা গড়িয়ে দিতে পারে।”
রায়ানের চোখমুখের ভাবমূর্তি এমন হলো যেন সে সোনার খনি খুঁজে পেয়েছে। হাত দুটো মুঠো করে কাঁপতে থাকল সে। উত্তেজনা চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করে একটা বড় শ্বাস নিয়ে হেঁসে বলল,
“ব্রিলিয়ান্ট! এটা তো মাথাতেই আসেনি। ইউ আর রিয়েলি অ্যা ব্রিলিয়ান্ট স্যার।”
সিসিটিভিতে নিষ্পলক হয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রতিটা দৃশ্য দেখছে নির্জন। রাশেদ সাহেবের প্রতিটা প্রতিক্রিয়াও তার চোখ এড়াতে দেয়নি। স্পিকার থেকে প্রতিটা শব্দ শুনেছে। একটাও মিস করেনি। আর শেষের কথোপকথনে এবার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছে তার। কোথাও একটা থমকে গিয়েছে। থরথর করে কাঁপছে তার দুটো হাত। পাশেই মেহরাজও সব শুনেছে দেখেছে। সেও হতবিহ্বল হয়ে নীরবতা অবলম্বন করেছে। ব্যাপারটা এভাবে ঘুরে যাবে সে ভাবতেই পারেনি। গলা খাঁকারি দিয়ে নির্জনের মনোযোগ নিতে চাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো মেহরাজ। মিনমিন করে ডেকে উঠল,
“স্যার!”
“বাঁচার জন্য মানুষ কত ফন্দিই না করে। কিন্তু নকল সোনাকে নির্জন আহমেদ হাতের মুঠোয় দুমড়েমুচড়ে শে’ষ করে দেবে। অনেক হয়েছে লুকোচুরি খেলা। এবার সামনে আসতে হবে।”
মেহরাজ উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
“কীভাবে স্যার?”
“খুবই সহজ মেহরাজ। সেদিন ওই মেয়েটা আমাকে দেখেছে হসপিটালের বাহিরে। সে যেহেতু রাগিনীর দিকে সবসময় নজর রাখে তাই সে আমাকে চিনতো এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সেদিনের পর সে জেনে গিয়েছে আমি পুলিশের লোক। আর ইনভেস্টিগেশন করছি। তাই ইন্সপেক্টর রায়ানের মতো আমাকেও তাদের রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করা হবে এটাতেও আমি নিশ্চিত। আশা করছি খুব কম সময়ের মধ্যেই নকল রাগিনী তাজরীন ধরা দেবে। আই এম ওয়েটিং।”
সকাল সকাল সারা শরীরের ভীষণ ব্যথায় একপাশ হয়ে আধশোয়া হয়ে রয়েছে ছিপছিপে গড়নের নারী। পা দুটো মাঝে মাঝে দুলছে। মুখ দিয়ে চুইংগাম চিবিয়ে মাঝে মাঝে বেলুন ফুলাচ্ছে। ঘাড়ে হাতটা রেখে বুলিয়ে বেশ আক্রোশের সাথে বলে উঠল,
“হারা’মজা’দা গুলো যদি একা থাকত আর আমার হাতে ওই পি’স্তল! তাহলে বুঝতো রূপা কী জিনিস! শুধুমাত্র ওই অভিরূপের জন্য আমাকে ওদের শুধু কয়েকটা মে’রেই নিজের মনকে শান্তনা দিতে হলো।”
বলেই থামল সে। পরক্ষণেই ভেবে বলল,
“না। তার জন্য না। সে আমাকে হেল্প করেছে। জীবনে প্রথম যখন ভয় নামক শব্দটা উপলব্ধি করেছিলাম লোকটা যেন ম্যাজিকের মতো সামনে এলো। আর আমাকে…”
বলেই থামল রূপাঞ্জনা। উঠে বসল তড়িঘড়ি করে। নিজের হাত, বাহু, কোমড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। এখানেই তো অভিরূপ ছুঁয়েছিল তাকে। কোলে তুলে নিয়ে সে কী দৌড়! দৌড়াতে পারে না পিছলে পিছলে যায় তবুও থামে না। ভাবলেই হাসি পায় রূপাঞ্জনার। আবার মনের দ্বারে অদ্ভুত একটা নতুনত্ব খুঁজে পায়। তাকে জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষ এভাবে রক্ষা করার স্বার্থে ছুঁয়েছে। সেই ছোঁয়ায় আ’ঘাত ছিল না। একটা আগলে রাখার মতো স্পর্শ ছিল। ডার্ক ম্যাক্সও তার হাত ছুঁয়েছে, গাল ছুঁয়েছে। কিন্তু এভাবে আগলে রাখার জন্য নয়। আ’ঘাত দেওয়ার স্বার্থে। যন্ত্রণা দেওয়ার চেষ্টায়। ঠিক একারণেই বোধহয় মনের মধ্যে নতুন অনুভূতি উদ্ভব হয়েছে। কারণ যাই হোক না কেন মানুষটা তাকে বাঁচিয়েছে। দরজায় টোকা পড়ল। ভাবনার মাঝে ডুবে থাকা রূপাঞ্জনার ভাবান্তর হলো না। সে জানে দরজার ওপাশে কে। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল কবির। হাতে একটা টিফিনবক্স। রূপাঞ্জনা একবার কবিরের দিকে চাইতেই কবির মুখ খুলে বলল,
“বস! সব রেডি।”
“দ্যাটস গুড। এখন যা। আমি রেডি হবো।”
কবির মাথা ঝাঁকিয়ে বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই রূপাঞ্জনা তাকে পিছু ডেকে বলে,
“কবির শোন!”
“ইয়েস, বস!”
“ধর কেউ কখনো যদি তোকে একটা বড়সড় বিপদ থেকে বাঁচায়, তারপর তুই জানতে পারলি যে তোকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে তাকেই তোকে মা’রতে হবে। অর্থাৎ, যে তোর জীবন বাঁচিয়েছে তার জীবনটাই তার থেকে আলাদা করতে হবে। তখন কও তাকে মা’রতে তোর হাত কাঁপবে?”
কবির প্রশ্নটা শুনে মাথা চুলকায়। কী অদ্ভুত প্রশ্ন! এর উত্তর যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। দিশেহারা হয়ে উত্তরে বলে,
“কিন্তু বস আমাকে শ’ত্রুপক্ষ কেন বাঁচাতে যাবে? আর আমাদের তো এটা ছোটকাল থেকে শেখানো হইছে যে যেমনই হক যদি তাকে শে’ষ করা একমাত্র লক্ষ্য হয় তাহলে তাকে শেষ করা উচিত। আপনেই তো এটা বলছিলেন আমাদের।”
রূপাঞ্জনার মুখশ্রী যেন বেলুনের মতো চুপসে যায়। থতমত খেয়ে কোনোরকমে জবাব দিল,
“তুই এখন যা তো। আমার কাজ আছে।”
তার এমন ধমকানি খেয়ে ভ্যাবাচেকা খেল কবির। এক্ষুনি তো বস নিজেই তাকে দাঁড়াতে বলল। আবার হঠাৎ করেই ধমকে বলছে বেরিয়ে যেতে। কী আজব! মুখটা ভার করে বেরিয়ে যায় কবির। সে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে শপিং ব্যাগ থেকে একটা সালোয়ার কামিজ বের করল রূপাঞ্জনা। এমন ধরনের পোশাক পড়ার অভ্যেস নেই তার। ওড়না সামলে উঠতে হিমশিম খায় সে। ছোট্ট একটা স্কার্ফই তার থেকে বেশ সহজ সামলানো। কিন্তু কী আর করার। এটাই করতে হবে। রাগিনী তাজরীন হয়ে নাকি উঠতে হবে! নিজের আসল পরিচয় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। হাতে ওড়না ধরল রূপাঞ্জনা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজের কন্ঠ শক্ত করে বলল,
“ঠিকই তো। এতো নি’ষ্ঠুর রূপার হাত কেন কাঁপবে কাউকে মা’রতে? কাঁপা তো উচিত নয়। কাঁপবে না তার হাত। আবার মেতে উঠবে ম’রণ খেলায়।”
সকাল থেকে একবার ঘরের জানালার কাছে যাচ্ছে তো একবার দরজার কাছে আসছে কোহিনূর ওরফে নির্জন। পা দুটোকে যেন শান্তি দিচ্ছে না। কখন যেন পা দুটোও অতিষ্ট হয়ে বলে উঠবে,’থাম ভাই। আমাদের আর এতো জ্বালাস না। তোর মনের আগুন ঠান্ডা করতে গিয়ে আমাদের অবস্থা খারাপ করে দিচ্ছিস কেন?’
কিন্তু কোহিনূর যে শান্তি পাচ্ছে না সেটা তো দুটো পা বুঝতে চাইছে না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কোহিনূর আপনমনে বিরবির করে ওঠে,
“মেয়েটা কালও এলো না। আজও এখনো আসছে না। ঠিক আছে তো? সে কি বোঝে না একবারও আমার মনের অবস্থা?”
আবারও চুপ থাকে কোহিনূর। হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে উঁকি দেয় মেইন দরজার দিকে। মনে তীব্র আশা বেঁধে রয়েছে। মনে হচ্ছে এইতো রাগিনী এলো! এইতো দরজায় ঠেলে হাতে টিফিবক্স নিয়ে ভিতরে ঢুকল। তবে তেমনটা তো হলো না। এবার মুখ ভার করে বিছানায় গিয়ে বসল কোহিনূর। আপনমনে আওড়াল,
“সে যদি একবার জানতো সে আমার কাছে শীতল বর্ষণের মতো। যেই বর্ষণ না পেলে মনের রাজ্যে দুর্ভিক্ষ লেগে যায়। তাহলে হয়ত সে বর্ষণ কন্যা হয়ে সবসময় আমার সংলগ্নে উপস্থিত থাকতো।”
ফোনের ভাইব্রেশন উপলব্ধি করল কোহিনূর। নড়েচড়ে উঠে পকেট থেকে ফোনটা বের করল সে। মেহরাজ কল করেছে। নিশ্চয় কোনো জরুরি খবর! আর সেটা যদি না হয় তবে এবার আজেবাজে কথা বলার দরুন নিশ্চিত তার একমাসের জন্য হসপিটালে থাকা পাকা করে দেবে কোহিনূর। তবে এখানে কথা বলা যাবে না। যেকোনো মূহুর্তে রাগিনী এলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই ভেবে ফোন রিসিভ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
ঘরে ফিরে এলো কোহিনূর ঠিক মিনিট দশেক পর। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই যে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার সাক্ষাৎ পাবে এবং প্রথমেই দৃষ্টি তার দিকে পড়বে ভাবতে পারেনি সে। আনন্দের জোয়ারে যেন ভেসে গেল মনের রাজ্য। উতলা হয়ে উঠল তার নিকটে যেতে। রাগিনী বিছানায় বসে একমনে টিফিনবক্স খুলছে আর খাবার বের করছে। কোহিনূরকে খেয়াল করেনি এখনো অবধি। পা টিপে টিপে গিয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কোহিনূর। কিছুটা ঝুঁকে পড়তেই যখন তার গরম নিশ্বাস আঁচড়ে পড়ল রাগিনীর কাঁধে তৎক্ষনাৎ চমকে উঠে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল রাগিনী। অতঃপর অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল,
“আপনি? আমাকে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলেন।”
“তাই? তোমাকে তো ভয় পাওয়াতে ভালো লাগে আমার। ভীতু চোখমুখ দেখতে অসাধারণ লাগে।”
রাগিনী ব্যস্ত কন্ঠে জবাব দিল,
“তাই না? সব উদ্ভট জিনিসের ভালো লাগা আপনার।”
“কী করব বলো? আমি মানুষটাই তো উদ্ভট ভয়ানক।”
“এখন খেতে বসুন তো তাড়াতাড়ি। সময় নেই হাতে।”
বলেই কোহিনূরের হাতটা ধরতেই তীক্ষ্ণ চোখে রাগিনীর ধরা হাতের দিকেই তাকায় কোহিনূর। ফিচেল হাসি দিয়ে হাত মুঠো করে রাগিনীর সামনে বসে। রাগিনী খাবার এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নিন। আজকের খাবারটা আমি বানিয়েছি। খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে।”
কোহিনূর হাতে খাবারের বাটি নিয়ে প্রথমে গন্ধ নিয়ে প্রশান্তির সুরে বলে,
“গন্ধই বলে দিচ্ছে তুমি আমাকে মা’রার প্ল্যানিং করে রেখেছো মিস.।”
রাগিনী যেন থতমত খায়। মুখের বর্ণ বিবর্ণ হয়। ধূসর এক আবরণে মাখিয়ে যায় মুখশ্রী। ভীত সুরে বলে,
“মা…মানে?”
“আরে বাবা এতো সুন্দর স্মেল বের হচ্ছে খাবার থেকে যেন অমৃত। খেয়ে স্বাদের চোটে ম’রে টরে না যাই।”
বলেই হেসে দিল কোহিনূর। রাগিনীর মধ্যের প্রতিক্রিয়া অদ্ভুত মিশ্র। সেও হাসছে। তবে মন খুলে নয়। কোহিনূর এবার খাবারটা মুখে দিতে গেলেই হাত থেকে বাটি ফসকে খাবার সহ বাটি সবটা পড়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে রাগিনী। মুখটা কুঁচকে যায়। ফুঁসে বলে ওঠে,
“এটা কী হলো?”
“আই এম সরি রাগিনী। আমি তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে…”
রাগিনী দম ফেলে রেগেমেগে তাকে থামিয়ে বলল,
“থাক আমি বুঝেছি। সব ভেস্তে দিলেন আপনি, সব।”
বলেই ঝুঁকে বাটিটা তুলতে গেল রাগিনী। কোহিনূর ঘাড় কাঁত করে রাগিনীকে পর্যবেক্ষণ করা মাত্রই মুখভঙ্গি কঠিন হলো তার। চোয়াল শক্ত করে হাওয়ার বেগে তার পেছনে গিয়ে সরাসরি রাগিনীর গলায় হাত চেপে অন্যহাতটা রাগিনীর দুটো হাত আবদ্ধ করল সে। মূহুর্তেই মধ্যেই ব্যাপারটা মাথায় উপর দিয়ে গেল রাগিনীর। গলায় চাপ লাগায় কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও চোখ বড় বড় করে বলল,
“আবার পাগলামি শুরু করেছেন আপনি?”
“স্টপ ইউর লেইম ড্রামা। আমাকে মা’রার সব প্ল্যান ভেস্তে গেল তাই না নকল রাগিনী তাজরীন?”
ফ্যাকাশে হলো রূপাঞ্জনার মুখশ্রী। ধরা দিল মুখে ভয়। ছটফটিয়ে উঠল ছাড়া পাওয়ার জন্য। তখনি আরো জোরে মুচড়ে ধরল কোহিনূর। রূপাঞ্জনা আর্তনাদ করে উঠল। তবুও দম কমলো না তার। শাসিয়ে বলে উঠল,
“আমাকে ছেড়ে দে। নয়ত ফল ভালো হবে না।”
“আমি ভয় পাই না তোমার এই সামান্য শাসিয়ে বলা কথায়। অবাক হচ্ছো না? যে তোমাকে চিনলাম কী করে? এতো ঘটা করে রাগিনীর মতো সাজ দিয়ে এসেছো। চুলগুলোও বেঁধে এসেছো। তবুও ধরা খেলে সো স্যাড!”
রূপাঞ্জনা এবার প্রতিত্তোর দেয় না। চিৎকার দিয়ে ওঠে জোরেসোরে। তার চিৎকারে যেন কেঁপে ওঠে ঘর। এমনটা করার কারণ খুঁজে না পেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃশ্যমান হলো বিষয়টা। দরজার কাছে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসা হলো আজিম আর পলাশকে। তাদেরকে দেখামাত্র হতবাক হলো কোহিনূর। ওদের তো আজ ছুটি দেওয়া হয়েছিল। তবে ওরা এখানে কী করে এলো? এমনকি এই হসপিটালের প্রতিটা পেশেন্টকে এতোক্ষণে পুলিশ টিমের সকলে সেফ প্লেসে নিয়ে যাওয়ার কথা পেছনের গেট দিয়ে। সেটাতেও কি ওরা সক্ষম হয়নি? প্রতিটা পেশেন্টকে এতোক্ষণে তার মানে এদের যতটা বোকা কোহিনূর ভাবছে ততটা বোকা তারা নয়। আটঘাট বেঁধে নেমেছে। রূপাঞ্জনার বাঁধন আলগা হয়ে আসতেই কোহিনূরকে ধা’ক্কা দিয়ে সরে আসে সে। কোহিনূর নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পকেট থেকে রি’ভলবার বের করে রূপাঞ্জনার দিকে তাক করল সে। রূপাঞ্জনা পেছনে ফিরেই ব্যাগ থেকে নিজের রি’ভলবার বের করে আজিম আর পলাশের তাক করল। সঙ্গে সঙ্গে জড়ো হলো পুলিশের লোকেরাও। তারাও প্রস্তুত হলো। তবে রূপাঞ্জনা বলে উঠল,
“আমাদের দিকে গু’লি চালিয়ে লাভ নেই। আমাদের এতোজনের প্রাণ গেলে এই দুইটা আর ওদিকে কতোগুলো মেন্টাল পেশেন্টদেরও প্রাণ চলে যাবে। যেখানে এতো প্ল্যানিং করে পেছনের গেট দিয়ে তাদের সেফ প্লেসে পাঠানোর চেষ্টা করছিলে সেই পেছনের গেট উল্টোদিক থেকে তালা মে’রে দেওয়া। এখন বিনাদোষে তাদের জীবনটা চলে গেলে বিষয়টা খুব খারাপ দেখাবে তাই না?”
“এটা করতে পারো না তুমি।”
মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কোহিনূর। রূপাঞ্জনা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“আমি সব পারি। এখনি ওদের রি’ভলবার ওদের পকেটে রাখতে বল আর নিজেরটা নিচে ফেলে দে। নয়ত কেউ বাঁচবে না।”
কোহিনূর বুঝল আর উপায় নেই। সে সবাইকে ইশারা করল রি’ভলবার নামাতে। সঙ্গে সঙ্গেই সবাই নামিয়ে নিল সেটা। কোহিনূর নিজেরটা নিচে রেখে দিল। কোহিনূর এবার ধীর গলায় বলল,
“ওদের দুজনকে ছেড়ে দাও এখন। আর পেশেন্ট, ডক্টরস্ ওদেরকেও ছেড়ে দাও।”
“আগে আমাদেরকে যেতে দাও। এই পুলিশদের সরতে বলো।”
কোহিনূর আবারও তাদের ইশারা করে সরতে বলে। প্রথমে কেউ সরতে চায় না দরজা থেকে। লক্ষ্যের এতো কাছে এসেও সরে যেতে মন চায়? তবুও বাধ্য হয়ে সরে দাঁড়াল সবাই। রূপাঞ্জনার কড়া দৃষ্টিতে আজিম আর পলাশকে ধা’ক্কা মে’রে ফেলে দিয়ে চলে যাওয়া ধরল তারা। হাতে রি’ভলাবার দিয়ে সবাইকে তাক করে রেখেছে এখনো। কোহিনূর আর কিছু বলল না। তারা বিদায় নিতেই কাছে থাকা চেয়ারে জোরে একটা লা’থি মে’রে হুংকার দিয়ে উঠল। ভয়ংকর রেগে উঠেছে আজ কোহিনূর। সকলের দৃষ্টি হয়েছে নত। কোহিনূর চিল্লিয়ে বলে,
“এই প্রথম লক্ষ্যের এতো কাছে থেকেও দূরে সরে আসতে হলো।”
বলেই দেয়ালে থাবা মা’রল কোহিনূর। তারপর বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকল। গলা বেয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে ঘাম। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো জড়ো হয়ে টুপ করে থুঁতনিতে এসে থামল। নিজের রাগ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অতঃপর। হাফ ছেড়ে কোনোরকমে রাগ সংবরণ করে বলল,
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায় এখানে টেরো’রিস্ট অ্যা’টাক হয়েছিল। কেউ না মানে কেউ না। কোনো ডক্টরও না। আর স্পেশালি একটা মাথায় রাখো আজিম আর পলাশ! আমি যে সিক্রেট অফিসার এটা যেন কারোর কানে না যায়। আমরা নিজেদের পরিচয় কারণ ছাড়া প্রকাশ করি না। তাই এটা যেন জানতেও না পারে। ডক্টররা বা বাকিরা কিছু জানতে চাইলে বলে দেবে পুলিশ ধারণা করেছিল এখানে টেরো’রিস্ট অ্যা’টাক করবে। তাই তাদের সেফ প্লেসে পাঠানোর চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল।”
কোহিনূরের কথায় আজিম আর পলাশ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত মাথা দুলায়। তাছাড়া আর উপায় কী? এখন পুলিশের লোক যা বলবে সেটাই করতে হবে।
চোয়াল শক্ত করে টেবিলে হাত রেখে সেই হাত মুখ দিয়ে ঢেকে রেখেছে কোহিনূর। রাগটা সংবরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কেমন যেন আগুনের লাভার মতো উতলে উতলে উঠছে। আর ইচ্ছে করছে হাতের কাছে যা আছে সব ভেঙ্গেচুরে একাকার করতে। কিন্তু এখানে এসব করা যাবে না। ঘটনাটির এক ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে তবুও নকল রাগিনীকে হাতছাড়া করার বিষয়টা মাথা থেকে যাচ্ছে না তার। ক্রোধ নিবারণ না করেই হাত মুঠো করে শক্ত একটা আ’ঘাত করে বসল টেবিলে। নিজের হাতে ব্যথা পেল কিনা সেটা জানে না কোহিনূর। তবে হাতটা চিনচিন করছে। রায়ানকে ছু’রির আ’ঘাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে তার হাতের যেই করুণ দশা হয়েছিল সেই কা’টা জায়গা সবেমাত্র শুকাতে শুরু করেছিল। আবারও যেন তা তাজা হয়ে উঠল। কিন্তু সেদিকে তো তার ধ্যান নেই।
“আর একটু ভালো প্ল্যানিং করতে পারলেই ওকে ধরতে পারতাম। আরো বুদ্ধি খাটাতে হতো আমায়। কিন্তু কে জানত আজকেই এতো দ্রুত সে আমাকে আ’ক্রমণ করতে আসবে!”
কথাগুলো আওড়ে নিজের হাত দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে নেয় কোহিনূর। হাত দিয়ে উপরে ঠেলে দিতেই ফ্লোরে পড়ে থাকা তার রি’ভল’বার চোখে পড়তেই উঠে যায় সেটা তার নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে। এতোকিছুর মাঝে এটার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। যদি কারোর চোখে পড়ে হয়ত পজিটিভ ভাববে নয়ত নেগেটিভ। নেগেটিভ ভাবারই সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। এটা ভাবতে ভাবতেই রি’ভলবার হাতে নিতে নিতে দরজা খোলার ক্যাচক্যাচ শব্দে সেটা হাত ফসকে পড়ে যায়। একটা অদ্ভুত শব্দের সৃষ্টি হওয়ার আগেই দ্রুত পা দিয়ে বেডের নিচে ঠেলে দেয় সেটা। রাগিনীকে দেখে নিশ্বাসটুকু ঘন হয়ে আসে। তড়তড়িয়ে চলতে থাকে হৃদকম্পন। আর একটু হলে কী হতে যাচ্ছিল? এবার বোধহয় লুকোচুরি খেলা ঠিক হচ্ছে না। কোহিনূর কী তবে জানাবে? এখনি জানাবে? ভাবতেই শরীরে কম্পন সৃষ্টি হলো। গলার স্বরে দলা পাকালো তখনি। এভাবে চললে জীবনেও সে সক্ষম হবে না। রাগিনীর রিনরিনে কন্ঠে নড়েচড়ে তাকাল কোহিনূর।
“রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছেন যে!”
“ভাবছিলাম মহারাণীর এতো সময় পর ইচ্ছে করল তার প্রজাকে দর্শন দিতে।”
কোহিনূরের এহেন কথায় রাগিনীর খুব হাসি পায়। ঠোঁট টিপে চোখ ছোট করে কোহিনূরের পানে চেয়ে নিঃশব্দে হাসতে থাকে সে। তার এমন নীরব হাসিতেই যেন লুকিয়ে ছিল কোহিনূরের অমূল্য প্রাণ। এই হাসিতেই যেন আঁটকে ছিল তার আঁটকে যাওয়া নিশ্বাস। সে বড় একটা শ্বাস নিল রাগিনীর দিকে অপলক চেয়ে। মনে মনে বলে ফেলল,’চেহারা না হয় নকল করেই ফেলল। তবে সেই হাসি, সেই সরল দৃষ্টি সারাজীবন তপস্যা করলেও নকল করা সম্ভব নয়। সে আমার জীবন্ত কাঠগোলাপ যার শীতলতা ভরা আলাদা ঘ্রাণ আমি সবসময় নিতে পারি আমার সংলগ্নে থাকলেই। ভুল হবে না কখনো তাকে চোখ বুঁজেও চিনত।’
হঠাৎ করেই রাগিনী কেশে উঠল। তারপর বলল,
“কাল আসতে পারিনি। যা অবস্থা হয়েছিল সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার পর। তাই বাড়ির লোক আসতে দেয়নি।”
রাগিনীর কন্ঠ এখনো কিছুটা দুর্বল। কথা শেষ করে আবারও কাশছে সে। তা দেখে এগিয়ে এসে রাগিনীর কপালে হাত ছোঁয়াল কোহিনূর। অতঃপর নির্বিঘ্নে বলল,
“জ্বর তো এখনো আছে। তোমায় এই শরীর নিয়ে আসতে কে বলেছে?”
রাগিনী নীরব রইল কিছু সময়। তারপর হাসিমুখে জবাব দিল,
“আপনিই তো আমাকে মহারাণী বলে সম্মোধন করলেন। আর মহারাণী প্রজাদের কথা সবসময় ভাবে।”
কোহিনূর বুঝে গেল এই মেয়েটার সঙ্গে কখনোই পেরে উঠবে না সে। না কথার ক্ষেত্রে আর না মনের যু’দ্ধে। তার থেকে আগে থেকেই আত্মসমর্পণ করা ভালো হবে। কিছু বলতে উদ্যত হয় কোহিনূর। ফোনের ভাইব্রেশন অনুভূত করে থমকে যায় সে। ফোন ধরতে ইচ্ছে করে না। তবুও যদি জরুরি কোনো বিষয় হয়? তাই সে খাবারের দিকে তাকিয়ে ফট করে বলল,
“আমি এখনো ফ্রেশ হইনি। একটু ওয়েট করো।”
বিলম্ব না করে বাহিরে চলে যায় কোহিনূর। রাগিনী বিছানায় এগিয়ে এসে টিফিনবক্স খুলতে শুরু করে। আজকে সে খিচুড়ি এনেছে। যদিও নিজহাতে রান্না করা নয়। খাবার বের করে চামচ ব্যাগ থেকে বের করতে গিয়ে হাতের নাগালে আসে না তার। না পেরে ব্যাগটা ঝাড়তে গিয়েই চামচ টং শব্দ করে নিচে পড়ে যায় বিছানার কিছুটা নিচে। বিরক্তির শব্দ করে নিচে বসে সেটা হাত দিয়ে তুলতেই চোখে আটকায় চকচকে কোনো বস্তু। বিছানার অনেকটাই নিচে আছে তবুও দিনের আলোয় কিছুটা চকচক করছে। ভ্রু কুঁচকে কৌতূহলবশত সেখানে হাতাতেই শক্ত একটা জিনিস হাতে আবিষ্কার করে সে। টেনে বের করে ফেলতেই সেটা আপনাআপনি হাত থেকে বের যায়। পেছনে কিছুটা দূরে সরে যায় হাওয়ার বেগে। নিজের চোখ কচলে আবারও দেখার চেষ্টা করে। নাহ, সে ভুল দেখছে না। ক্ষণে ক্ষণে বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। মাথা ঘুরে উঠেছে। গলা দিয়ে ঢক গিলতে গিয়েও আঁটকে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে যে কাউকে প্রতিহত করার সবচেয়ে ভয়া’নক অ’স্ত্র। সে অস্ফুটস্বরে বলল,
“রি’ভলবার।”
চলবে…
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৮
ভয়ে শিথিল হয়ে রয়েছে রাগিনী। ফ্লোরে গুটিশুটি হয়ে নিজের ওড়না চেপে ধরে ভীতু নজরে বার বার তাকাচ্ছে সেই প্রা’ণঘাতী অ’স্ত্রের দিকে। সারা অঙ্গ জুড়ে ছেয়ে গিয়েছে এক উত্তেজনা। ক্ষণে ক্ষণে সৃষ্টি হচ্ছে কম্পন। মনে হচ্ছে যেন তার সামনে একটা বাঘ নয়ত সিংহ দাঁড়িয়ে যেটা যেকোনো মূহুর্তে আ’ক্রমণ করে বসতে পারে। না চাইতেও অবাধ্য মস্তিষ্ক জানান দিল উর্মিলার কথা সেদিনের কথাগুলো। সেই কথাগুলোর রেশ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ল রাগিনীর মনের অভ্যন্তরে। বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভূত করল সে। সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে এসেছে। না চাইতেও নিজের হাতের কম্পন থামানোর চেষ্টা করে দূর থেকে হাত বাড়াল সেই রি’ভলবারের দিকে। যদি জিনিসটা মিথ্যা হয়? শুকনো গলায় ঢক গিলে জিনিসটাকে ছোঁ মে’রে দ্রুত নিজের কাছে নিয়ে এসে নেড়েচেড়ে দেখল। কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ আসছে সেটা থেকে। তাহলে সেটা কি গান পাউডার? তাহলে এটা সত্যিই রি’ভলবার? সর্বাঙ্গ জুড়ে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল রাগিনীর তৎক্ষনাৎ সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেডের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াল।
দরজার কাছে ছুটে গিয়ে দরজা ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আবারও বেডের নিচটায় চোখ গেল তার। কানে যেন হাওয়ার তালে ভেসে আসছে, ‘আচ্ছা! সে যদি সুস্থ হয় আর এমন ভান করে থাকে তাহলে নিশ্চয় তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে? এখন তো কয়েকদিন ধরে টে’রোরিস্ট হাম’লার বিষয়টা চলছেই। এমন নয় তো? যে ওই কোহিনূর কোনোভাবে টে’রোরিস্ট টিমের সাথে যুক্ত?’
এই কথা স্মরণে আসার পর দাঁড়ানোরও শক্তি পাচ্ছে না রাগিনী। দরজা ধরে রেখেছে। ভেতরে ভেতরে যেন ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে নিজের তৈরি কিছু আপন অনুভূতি। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে সে আবার ভুল ভাবছে না তো? কিন্তু ধারণা তখনই পাল্টে যাচ্ছে। এখানে সবটা পরিষ্কার। আরো পরিষ্কার করতে কোহিনূরের সাথে দেখা হবার পর একটার পর একটা ঘটা অদ্ভুত ঘটনার হিসাব মিলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাগিনী। প্রথমে কোহিনূরের হুট করেই আগমন। তার পাগলামির মাধ্যমে রাগিনীকে ধরে রাখা, আস্তে আস্তে তার আসল সত্ত্বা প্রকাশ পাওয়া, হসপিটালে বাচ্চা ছেলেটাকে দেখতে যাওয়ার সময় অন্য একটা মেয়ে তাকে আরেক নামে সম্মোধন করা, একদিন ঘুরতে বের হওয়ায় রাগিনীর উপর একদল লোক গু’লি চালানো, কোহিনূরের এক্সি’ডেন্টে ক্ষতি হয়েছে বলা সত্ত্বেও তার যানবাহনে ভয় না পাওয়া, দক্ষতার সাথে গাড়ি ড্রাইভ করতে জানা! এবার সবটাই যেন আপনা-আপনি বোধগম্য হয় রাগিনীর। ভাবনায় নিমগ্ন রাগিনীর দুচোখ ভর্তি পানির উদ্ভব যে কখন ঘটেছে সেটা টের পায়নি রাগিনী নিজেই। অস্ফুটস্বরে কোনোমতে ভাঙ্গা গলায় বলল,
“এটাই তাহলে উদ্দেশ্য। আপনাকে যা ভেবেছিলাম আপনি তাহলে সেটা নয়। আপনাকে যা কখনোই ভাবিনি আপনি সেটাই।”
রাগিনী বুঝে উঠতে পারল না কোহিনূরের জন্য সে অপেক্ষা করবে কিনা! তাকে কিছু বলা উচিত কিনা! বললে যদি আবার তাকেই কিছু করে বসে? মানুষটা তো নিষ্ঠুর। তার প্রতি কি দয়া দেখাবে? না হয়ত। তারা তো স্বার্থপর হয়। যার প্রতি কোমল অনুভূতি ছিল একরাশ। সেই কোমল অনুভূতিগুলো ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়ে পাল্টে গেল এক ঘৃণ্য অনুভূতিতে। এখানে আর এক মূহুর্তও দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না রাগিনীর। ঠোঁট কামড়ে চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসা পানিকে বাঁধা দিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
“ওরাই কি তাহলে ফিরে এসেছে?”
রাগিনীর ভেতরটা জ্বলছে। মনে হচ্ছে আগুনের তাপে জ্বলে ছারখার হয়ে যাবে সব। ঝলসে যাবে মনের দুয়ার। এই ঘরটায় আর থাকা সম্ভব নয়। দরজা ঠেলে বাহিরে চলে আসে সে এলোমেলো পায়ে।
ফোনে কথা বলে কোহিনূর ঘরে প্রবেশ করল কিছুটা বিক্ষিপ্ত হয়েই। এর থেকে যেন ফোনটা না ধরাই ভালো ছিল। শুধু শুধু আবারও তাদের ব্যর্থতার গল্প শুনতে হলো। নকল রাগিনীর ট্রেস আর পাওয়া যায়নি। জানা নেই কোন প্রান্তে গিয়ে লুকিয়েছে। এসব কথা শুনে মেহরাজকে ধম’ক দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে কোহিনূর। তারপর জোর পায়ে হাঁটা ধরেছিল নিজের অশান্ত, বিক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধ মনটাকে শান্ত করার প্রতিষেধক নেওয়ার জন্য। সেই প্রতিষেধক একটাই রাগিনী! যাকে দেখলে এই আগুন ধরানো মনটা নিমিষে বরফগলা এক রাজ্যে পাল্টে যেতে বাধ্য। তবে মনের বাসনা আর পূর্ণতা পেল না। রাগিনীর দেখা পেল না দুটো নেত্রপল্লব। ঘরটা খালি। আশেপাশে তাকাল কোহিনূর। আসলেই সে নেই। বিছানায় পড়ে রয়েছে একভাবেই খাবারগুলো। সেসব রেখে রাগিনী কোথায় চলে গেল? ঘরে এসে জানালার কাছে গেল কোহিনূর। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল রাগিনীকে গার্ডেনে দেখা যাচ্ছে কিনা। সেটাতেও ব্যর্থ হলো সে। আগে তো মেয়েটা খাবার রেখে এভাবে কোথাও চলে যায় না। তার কাশি আসতেই স্মরণ হলো রাগিনী তো অসুস্থ ছিল। অসুস্থতা কি বাড়লো তবে? কী করে খোঁজ নেবে?
“আমার মনটাকে অতৃপ্ত করেই বিদায় নিলে রাগের রানী? অতৃপ্ত মনটাকে বোঝাই কী করে বলো?”
ঘরে আসার পর দরজা বন্ধ করে রেখেছে রাগিনী। খোলেনি এখনো অবধি। দুপুরের খাবার খায়নি। সৈয়দ তাকে ডাকতে এসেছিল একবার। রাগিনী বলেছে খিদে নেই। আসলেও নেই খিদে। গলা দিয়ে খাবার নামবে না। নিজের বেডে গুটিশুটি হয়ে বালিশ চেপে ধরে বসে আছে। জানালার পাশে থাকা পর্দা হঠাৎ উড়ে উঠতেই ধড়ফড়িয়ে উঠল সে। মনে হলো যেন কেউ তাকে ধরতে আসছে। চিল্লিয়ে বলল,
“আমি কিছু করিনি।”
পর্দা চোখে পড়তেই শান্ত হলো দেহ। স্থির হলো দৃষ্টি। কোহিনূরের কথা স্মরণে আসতেই গুটিয়ে নিল নিজেকে। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“যার কাছে নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ভেবেছিলাম সে-ই হয়ে উঠল আমার নীরবঘাতক।”
কথার মাঝে থামল রাগিনী। চোখের সামনে যেন স্বপ্নের ন্যায় ভেসে উঠল অতীতের সবথেকে অবহেলিত, অযত্নে রাখা এক পাতা। যেই পাতার ঘটনা ভুলেও যে স্মরণ করতে চায় না। তবে আজকের ঘটনা যেন সেই ঘটনার সাথেই সংযুক্ত।
“ও…ওরা চলে এসেছে এখান অবধি। আমার পি…পিছু কেন ছাড়েনি এ…এখনো। আমি তাদের থেকে মুক্তি চাই।”
বালিশে মুখ চেপে ধরে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে রাগিনী। ভয় শুধু হাতছানি দিচ্ছে তাকে। তীব্র কোনো কিছুর আশঙ্কায় সারা গায়ের লোম শিউরে উঠেছে। কানে বাজছে সেদিনের বলা সেসব কথা। কত সুন্দর মূহুর্ত ছিল সেদিন। কতটা আপন ভেবে বলেছিল কোহিনূরের উদ্দেশ্যে সেসব কথা। কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল লোকটার সাথে। নিজের বলা কথাগুলোই তার কানে বারংবার ধা’ক্কা খায় এবার।
‘পৃথিবীতে দুটো পুরুষের কাছে নিজেকে সবথেকে নিরাপদ মনে করি আমি। প্রথমজন আমার বাবা। দ্বিতীয়জন কোহিনূর সাহেব।’
কর্ণকুহরে ভেসে আসা সেই কথা আর শুনতে চায় না রাগিনী। কানটা চেপে ধরে দুহাতে। দাঁত চেপে বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। চোখ খুলে পিছু ফিরতেই দেয়ালের সঙ্গে টানানো কোহিনূরের স্কেচটা যেন জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে। কোহিনূরের হাসোজ্জ্বল সেই মুখশ্রী ছিল রাগিনীর অদ্ভূত শান্তির কারণ সেই হাসিটা দেখে ভয় করতে শুরু করল তার। সেভাবেই শক্ত গলায় বলে ওঠে,
“আপনাকে বলেছিলাম, আমার বিশ্বাস ভাঙ্গবেন না প্লিজ। আপনি সেটাই করে খুব আনন্দ পেলেন।”
রাগিনীর এরূপ কথায় যেন হাসিটা আরো গাঢ় হলো স্কেচে থাকা কোহিনূরের। অথচ স্কেচে থাকা কোহিনূরের প্রাণ নেই। হাসিটাও আগের মতোই স্থির। তবুও রাগিনীর এমনটা মনে হচ্ছে। পুরো শরীর রি রি করছে। বালিশটা ফেলে দিয়ে রাগিনী দ্রুত ধাবিত হলো কোহিনূরের ঝুলিয়ে রাখা সেই স্কেচের দিকে। হাতের নখ দিয়ে আঁচড় দিতে ইচ্ছে করল তার। তবে পারল না। মানুষটির চোখের দিকে তাকিয়েই পড়ল গভীর ভাবনায়। না চাইতেও ছুঁয়ে দিতে বাধ্য হলো আদুরে স্পর্শে সেই আঁকা চোখ। এই চোখটা সে কত অনুভূতি মিশিয়ে এঁকেছিল। তবে তার জানা নেই কতটা গভীরতা দিতে সক্ষম হয়েছিল। আসল নেত্র তো আরো গভীরতম ছিল। তবে সেটাও কি মিথ্যে ছিল? ছলনা ছিল? দুর্বল কন্ঠে রাগিনী বলল,
“আপনাকে অবিশ্বাস করতে আমার ইচ্ছে করছে না। মনের মাঝে ঘৃণ্য বর্বরোচিত মানুষদের তালিকার মাঝে আপনি নামক মানুষটাকে ফেলতে ইচ্ছে করছে না। আপনি আমার কাছে সবসময়ের জন্য এক মোহনীয় মানুষ। তবে আমায় ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন আজ। আমার সন্দেহকে জিতিয়ে দিয়েছেন। আপনি বড়ই নিষ্ঠুর!”
রাগিনীর বলা কথাগুলো যেন নিজেরই সহ্য হচ্ছিল না তার। কথা শেষ করার সাথে সাথে সরে এলো। তার উচিত মানুষটাকে ঘৃণা করা। সে ঘৃণা করে কথাও তো বলতে পারছে না। দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ফিরে গিয়ে ধপ করে সে বসে পড়ল নিজের বিছানায়। নিজের চোখের কোণে লেগে থাকা একটুখানি অশ্রু মুছে নিল হাতের পিঠ দিয়ে। কী করা উচিত কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। কাকে জানাবে সে কথাটা? কেউ কি তাকে বিশ্বাস করবে? এসব আগপাছ ভাবতে ভাবতে আবারও চোখ ভর্তি পানি জমা হলো। তার পায়ে লাগল কারো আলতো ছোঁয়া। মাথা নিচু করে সেই স্পর্শ করার মালিককে দেখে মন শান্ত হলো কিছুটা। রিও মিউ শব্দ করে নিজে থেকে রাগিনীর কোলের উপরে উঠে বসে মাথা উঁচিয়ে রাগিনীর মুখশ্রীর দিকে অসহায় পানে তাকায়। যেন সেও বুঝেছে কিছু একটা। বুঝে নিয়েছে তাকে অতি যত্নে রেখেছে যেই নারী তার আজকে মন খারাপের দিন। রাগিনী পরম যত্নে তাকে দুহাত দিয়ে উঁচিয়ে ধরল। রিও সঙ্গে সঙ্গেই তার সামনের দুটো পা দিয়ে রাগিনীর গলা জড়িয়ে ধরে মিউ মিউ শব্দ করে উঠল। রাগিনীর বুঝতে সময় লাগল না রিও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মন খারাপ করেছে। ভেজা কন্ঠে বলল,
“আজকে খুব অসহায় লাগছে নিজেকে। এতো এতো মিথ্যে অনুভূতির মাঝে একমাত্র তোমার অনুভূতিই সত্যি মনে হচ্ছে। মানুষ হিংস্র, মিথ্যের পাহাড় গড়তে পারে। তোমাদের সরল অনুভূতির সামনে তারা বোধহয় তুচ্ছ।”
অনেক ভেবে উর্মিলার কথা মাথায় এলো রাগিনীর। যাকে এই মূহুর্তে সব ভরসা করে বলা সম্ভব। এই কথাগুলো কাউকে না কাউকে তো বলাই যায়। অন্তত এখন কী করা উচিত সেটা সম্পর্কে যদি সাজেশন পাওয়া যায় ক্ষতির কিছু নেই। আর যাই হক সে চায় না তার বাবার হসপিটালের এতো বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাক। ভাবতে ভাবতে নিজের ফোনটা হাতে নিল রাগিনী। মলিন মুখে ফোন স্ক্রল করে নম্বর খুঁজে বের করে উর্মিলাকে কল লাগালো। কিছুক্ষণ রিং হতেই ওপরপানে থেকে উর্মিলার চিকন গলার সুর শোনা গেল।
“হ্যালো মামা।”
“আমি তোর মামা নই। আমি রাগিনী।”
উর্মিলা তড়িঘড়ি উত্তরে বলে,
“সরি সরি। জানিস তো আমি এখনো চশমা কিনি নি। তাই ঠিকঠাক দেখতে পাইনি তোর নাম। মার্কেটে গিয়েছিলাম আমার ওই কিউট ব্লু কালার ফ্রেমের চশমা খুঁজেই পাইনি। একজনের কাছে নাকি ছিল সেটাও নাকি কোন যেন ছেলে নিয়ে চলে গিয়েছে। ছেলেগুলো আস্ত একেকটা আপদ। একটা ছেলে আমার চশমা ভাঙ্গল আরেকটা ছেলে আমি কেনার আগে চশমাটা কিনে নিয়ে চলে গেল। শোন রাগিনী, একটা এডভাইজ দিচ্ছি, জীবনে আর যাই হক কোনো ছেলের পাল্লায় পড়বি না। তারা দেখবি তোর জীবনে বিপদ আর বিপদই ডেকে আনবে।”
না চাইতেও যেন রাগিনীর মুখ থেকে ফস্কে বেরিয়ে গেল,
“ঠিকই বলেছিস। অলরেডি হয়ত ডেকে এনেছে।”
“কী ডেকে এনেছে? আর তোর গলা এমন লাগছে কেন? কেমন যেন থমথমে। মন খারাপ নাকি তোর?”
“তুই যা বলেছিস সব মিলে গেছে রে উর্মিলা!”
উর্মিলা একটু নীরব রইল। ভাবার চেষ্টা করল তার কোন কথাটা মিলেছে। বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
“আই নো উর্মিলার কথা দেরিতে হলেও সঠিক হয়। বাট কোন কথাটার কথা বলছিস বল তো?”
রাগিনী জোর গলায় কোহিনূরের নামটা। কিন্তু গলায় সমস্ত কথা দলা পাকিয়ে আসছে। ঢক গিলে অস্পষ্ট সুরে বলে ওঠে,
“কো…কোহিনূর! তুই ঠিকই বলেছিলি। উনার উদ্দেশ্য ভালো নয়।”
“কেন, কেন? কী করেছে তোর সাথে? তুই ঠিক আছিস তো?”
“আমার সাথে কিছুই করেন নি। কিন্তু আজকে উনার বেডের নিচে আমি রি’ভলবার পেয়েছি।”
বলেই ঠোঁট কামড়ে ধরল রাগিনী। দম বন্ধ লাগছে এবার। ওপরপাশ থেকে উর্মিলা আঁতকে উঠে বলল,
“কী বলছিস? ঘটনা সত্য? আমি তোকে বলেছিলাম ওর উপর নজর রাখতে। ওর উদ্দেশ্য ভালো নয়। এখন বোঝ। জাতে মাতাল, তালে একেবারে শয়’তান। ও যদি ভালো হয় ওর কাছে এতো বড় মা’রাত্মক অ’স্ত্র কী করে আসবে? নিজের আর ওই হসপিটালের ভালো চাইলে এখনি পুলিশের কাছে যা। সব জানিয়ে দে।”
রাগিনীর মাথায় পুলিশের কথা মাথায় আসেনি সেটা নয়। এসেছে কয়েকবার। তবে সাহস হয়নি। আবার সেই মানুষটার বিরুদ্ধে যেতে মস্তিষ্ক থেকে পা অবধি বারণ করছে। শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারছে না যে। উর্মিলা রাগিনীর প্রতিত্তোর না পেয়ে আবারও শক্ত কন্ঠে বলল,
“শুনতে পাচ্ছিস কী বলছি? রক্ষা পেতে হলে দেরি করিস না। যত দেরি করবি তত রিস্ক বাড়বে। আর…”
রাগিনীর যেন আর শুনতে ইচ্ছে করল না উর্মিলার বলা কথাগুলো। আস্তে আস্তে ফোনটা কানের পাশ থেকে নামিয়ে নিয়ে কেটে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ আগেও সে কোহিনূর নামক ঘোরে মত্ত ছিল। সেই ঘোর কাটিয়ে ওঠা কি এতোই সোজা?
দরজায় কেউ নক করল আবার। পলক ফেলে দরজার দিকে চাইলো রাগিনী। আবার নিশ্চয় সৈয়দ কাকা এসেছে। মানুষটা ভীষণ চিন্তা করে তাকে নিয়ে। সে ঠিকমতো খেলো কিনা, কী খেলো সব দেখাশোনা করে। রাগিনী রিওকে নামিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। দরজার লক খুলতে খুলতে গলা খাদে নামিয়ে বলল,
“বললাম তো চাচা। আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আমার দরকার পড়লে খেয়ে নেব।”
“আমার চাচা হওয়ার বয়স এখনো হয়নি। অথচ তুমি আমাকে বার বার চাচা বানিয়ে দাও। দ্যাটস নট ফেয়ার।”
চকিতে তাকায় রাগিনী অভিরূপকে দেখে। ছেলেটা ঠোঁট উল্টিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগিনী নিচু সুরে বলল,
“আপনি? কোনো দরকার?”
“দরকারটা আমার না। তোমার দরকার।”
কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে কপাল কুচকালো রাগিনী। অভিরূপের দিকে চেয়ে রইল শূন্য দৃষ্টিতে। অভিরূপ একগাল হেঁসে বলল,
“বলছিলাম খাবার না খেয়ে কি অনশন শুরু করেছো?”
এবার রাগিনী বুঝল আসল বিষয়টা। মিইয়ে যাওয়া গলায় উত্তরে বলল,
“অনশন শুরু করব কেন? সবার রুচি তো সবসময় এক থাকে না। আপনারা লাঞ্চ করে নিন। আমার খিদে পেলে আমিও করে নেব।”
“তুমি হয়ত অনশন শুরু করো নি। তোমার পেট নিশ্চয় অনশন শুরু করে দিয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখো। নিশ্চয় এতক্ষণে বলতে শুরু করে দিয়েছে, ‘chahiye naan ya roti, chahiye raan ya boti, mangalo ram kasam, kasht ho jayee…’
শত বিরহের মাঝেও অভিরূপের সুর করে বলা গানটি কানে পৌঁছাতেই মলিন হাসলো রাগিনী। রাগিনীর হাসি দেখে অভিরূপও বিজয়ের হাসি দিল। যেন তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। অতঃপর আবারও হাসি বজায় রেখেই অভিরূপ বলল,
“তাহলে এভাবে পেট যেন আর অনশন না করে তার সমাধান করতে খাওয়া দরকার কী বলো?”
“আপনি কী করে বুঝলেন যে আমার পেট অনশন করছে?”
“গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। ডিল করবে? যদি পেট অনশন করে তাহলে তুমি আমায় ঘুরতে নিয়ে যাবে। আর যদি অনশন না করে তাহলে আমি তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব! ডিল?”
রাগিনী আবারও নীরবতা অবলম্বন করল। গোল গোল চোখে চেয়ে রইল। তার ভাবমূর্তি কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অভিরূপ। আবারও যদি মেয়েটার অগ্নিমূর্তি বেরিয়ে আসে আর এমন ইচ্ছের বিরুদ্ধে খেতে বলায় যদি ঠাস ঠাস করে কয়েকটা লাগিয়ে দেয় তবে? ভেবেই গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তার। পলাতক হওয়া বেটার মনে হচ্ছে। তাই সে পেছন ফিরে দীর্ঘশ্বাস দিয়ে হাঁটা ধরে বলে,
“ভাবলাম তোমায় নিয়ে গেলে আঙ্কেল খুশি হবেন। আঙ্কেল খুব আশায় আছেন তুমি গিয়ে উনার সঙ্গে বসে খাবে। আশাটা বোধহয় পূর্ণ হলো না।”
রাগিনীর টনক নড়ে এবার। ফট করে জিজ্ঞেস করে,
“বাবা এসেছে?”
“হ্যাঁ শুনলাম ছুটি নিয়ে এসেছে। স্পেশালি আমাদের সাথে লাঞ্চ করার জন্য।”
রাগিনী এবার কিছু না বলেই তড়িঘড়ি পায়ে অভিরূপের পাশ কাটিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল। অভিরূপ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। তারপর নিজে নিজে বলল,
“যাহ্ বাবা। আঙ্কেলের কথা শুনে মেয়েটা সাইক্লোনের গতিতে নামবে জানলে এতো বকবক না করে আঙ্কেলের কথায় আগে বলতাম।”
খাবার টেবিলে খেতে বসেছে সকলে। সৈয়দ আর সাহানা দুজন খাবার পরিবেশন করছেন খুশিমনে। রাগিনী মুখ নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। মুখে বিষণ্নতা। সারা মুখমন্ডল জুড়ে এক ফ্যাকাশে ধূসর বর্ণের আনাগোনা। সেটা চোখ এড়ালো না রাশেদ সাহেবের। তবে উনি প্রথমেই কিছু বললেন না। আগে অভিরূপ আর নোমানকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তা বাবা! তোমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? আনকমফোর্টেবল ফিল করছো না তো?”
“না আঙ্কেল একদমই না। নিজের বাড়ির চেয়ে কম কিছু মনে হচ্ছে না। আগে জানলে তো প্রথমেই এখানে এসে উঠতাম। আপনি না চাইলেও জোর করে এখানে থাকতাম।”
অভিরূপের কথায় খেতে খেতে নিঃশব্দে হাসেন রাশেদ সাহেব। অভিরূপ আঁড়চোখে রাগিনীর দিকে তাকায়। তৎক্ষনাৎ নোমান নিজের হাতের কনুই দিয়ে গুঁতো দেয় অভিরূপকে। অভিরূপ ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নোমানের পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে বলে,
“শরীরে ধার বেশি হয়েছে নাকি তোর? ষাঁড়ের মতো গুঁতোচ্ছিস কেন?”
“চোখটা খুলে পড়ে যাওয়ার আগে বাঁচিয়ে নিলাম। থ্যাংকস দে। পায়ের উপর থেকে পা সরা। নয়ত আমারও পা আছে।”
অভিরূপ ঢক গিলে পা সরিয়ে খেতে ব্যস্ত হলো। রাশেদ সাহেব এবার রাগিনীকে বললেন,
“রাগিনী, তোমার শরীর কি খারাপ এখনো?”
উটকো ভাবনায় বিভোর রাগিনী চমকে নড়েচড়ে তাকাল। মেয়েটাকে আনমনা দেখে কিছুটা চিন্তিত হলেন রাশেদ সাহেব। রাগিনী কোনোরকমে উত্তর দিল,
“না বাবা। আমি ঠিক আছি।”
রাগিনী তার বাবাকে জানাতে চাইছে কথাগুলো। পারছে না। সম্ভব নয়। মানুষটার বুকে ব্যথা উঠেছিল গতকাল রাতে। ডক্টর বলেছে বেশি টেনশন উনাকে না দিতে। তাই এই কথা বলে টেনশন বাড়ানোর কথা ভাবতে পারে না রাগিনী। রাশেদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“তাহলে খেতে আসছিলে না যে? সৈয়দ বলল আমাকে। কী হয়েছে?”
“বাবা একটু দুর্বল লাগছে। বেশি কিছু না।”
রাশেদ সাহেব এবার বড় শ্বাস ফেলে গাম্ভীর্যের সাথে বললেন,
“একটা কথা বলার ছিল তোমায়। তোমাকে বাড়ি থেকে বেশি বের হতে হবে না। চেষ্টা করো বাড়িতে থাকার। বাহিরে এখন অনেক কান্ড ঘটছে।”
রাগিনী মাথা উঁচিয়ে তাকাল বাবার দিকে। রাশেদ সাহেবও রাগিনীর মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছেন। উনি মেয়ের নিরাপত্তা নিয়েই আগে ভাবছেন। যেহেতু এতো বড় ক্রা’ইমের একটা তীর রাগিনী নিজে তাই নিজের মেয়েকে নিয়ে বিপদ বাড়াতে চান না উনি। এরপর আবারও তিনি বলেন,
“আর কোহিনূরকে নিয়ে চিন্তা করলে বলে দিই, প্রতিদিন তার কাছে খাবার পৌঁছে যাবে। চিন্তা করো না। ব্যাস… আমি এটাই চাই তুমি একা একা বাড়ি থেকে বের হবে না।”
রাগিনী মাথা নাড়াতেই অভিরূপ হতাশ হয়ে বলল,
“তাহলে অনশনের হারজিতের পর ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যানিং ক্যান্সেল!”
“কীসের প্ল্যানিং?”
উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন রাশেদ সাহেব। অভিরূপ বলল,
“রাগিনী আর আমার মধ্যে একটা ডিল হয়েছিল। যে হারবে সে ঘুরতে নিয়ে যাবে। সেটার কথাই বলছিলাম।”
রাশেদ সাহেব চুপ করে রইলেন এবার। খেতে খেতে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটার মনমরা চাহনি ভালো লাগছে না। ঘুরতে গেলে ঠিক হতে পারে। আর অভিরূপ তো আছে। তাই সাহস নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে বললেন,
“সবাই মিলে গেলে কোনো সমস্যা নেই। তুমি, নোমান আর রাগিনী যেতেই পারো। আর রাগিনীর ইচ্ছে হলে কোনো ফ্রেন্ড ডেকে নিতে পারো।”
অভিরূপের হাসি গাঢ় হলো। রাগিনীর দিকে চেয়ে উৎসাহ নিয়ে বলল,
“তাহলে হারল কে রাগিনী?”
রাগিনীর যেতে ইচ্ছে করল না বাহিরে। তবুও কথাগুলো ফেলতে পারল না। জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
“আমি হার স্বীকার করছি। আমি আপনাদের ঘুরতে নিয়ে যাব। আপনারা তো শহর চিনেন না। তাই দায়িত্বটা আমি নিলাম।”
ফোনের রিংটোনটা এবার পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তকর শব্দে পরিণত হলো ঘুমন্ত রূপাঞ্জনার কাছে। চেহারা জড়িয়ে গেল বিরক্তিতে। জোর করে আঁখি দুটো খোলার চেষ্টা করল। একহাত বাড়িয়ে চারিপাশে ফোনটা খুঁজতে চাইল। কোহিনূরের কবল থেকে পালিয়ে কোনোরকমে ক্লান্ত ভঙ্গিতে গা ঢাকা দিয়েছিল সে। ফোনটা হাতে পেয়ে চোখ বুঁজেই রিসিভ করে কানে ধরে বলল,
“হ্যালো।”
“অনেক তো ঘুমিয়ে নিলি। এবার জাগার সময় হয়েছে। আসল কাজের সময় হয়েছে।”
শান্ত সুরের মাঝে হিংস্রতা অনুভব করে চোখটা থেকে ঘুম উড়ে গেল এবার রূপার। ভালোমতো জাগতেই মনে হলো আজকের মিশনে আনসাকসেসফুল হয়েছে সে। কোহিনূরকে মা’রতে পারেনি। তার এই অসফলতার কারণে নিশ্চয় রেগে আছে ডার্ক ম্যাক্স। অস্ফুটস্বরে সে বলল,
“আই এম সরি ডার্ক ম্যাক্স!”
“তোর সরি শুনতে শুনতে কান পঁচানোর ইচ্ছে আমার নেই। আমার ক্রোধের স্বীকার হতে না চাইলে দ্রুত তৈরি কর নিজেকে। পরের মিশন আজকেই শুরু হবে। আর ভুলিস না! প্রথম মিশন কমপ্লিট করতে পারিসনি। তাই এই মিশনটাও কমপ্লিট না হলে ফল খুব একটা ভালো হবে না।”
রূপাঞ্জনা উঠে বসে এবার। শুঁকনো গলায় জানতে চায়,
“পরের মিশন অবশ্যই কমপ্লিট হবে ডার্ক ম্যাক্স। কী পরের মিশন?”
“অভিরূপকে শে’ষ করে পুরো দেশে আ’তংক সৃষ্টি করা। আজ বিকেলে রাগিনীর সঙ্গে বের হবে অভিরূপ। কিন্তু আসল রাগিনী নয় রাগিনী রূপি রূপাঞ্জনার সাথে যেন ফেমাস সিঙ্গার অভিরূপের শেষ যাত্রা হয়।”
ভেতরটা নড়ে ওঠে রূপার। সময়টা বুঝি এসেই গেল এবার। এখন তার রক্ষককেই উপড়ে ফেলতে হবে বুঝি। রূপা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আপনি কী করে জানলেন ডার্ক ম্যাক্স? যে আজ ওরা বের হবে?”
ডার্ক হেঁসে জবাব দেয়,
“ডার্ককে বোকা মনে করিস তুই? ডার্ক সব জানে। নিজেকে তৈরি কর রাগিনী রূপে। ‘দ্যা ফেমাস সিঙ্গার অভিরূপ চৌধুরী বাংলাদেশে ঘুরতে এসে অকালেই টেরো’রিস্টের হা’মলার শিকার হয়ে মৃ’ত্যু হয়ে গেল’। হেডলাইনটা অনেক সুন্দর হবে তাই না?”
রূপাঞ্জনা কিছু বলে না। সে দরদর করে ঘামছে। ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে যায়। রূপার নিশ্বাস ওঠানামা করে। নিজের অস্থিরতা যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বাঙ্গ। আগে তো এতোটা উতলা হয়নি মন। তবে কি প্রথমবার তার হাত কাঁপবে কাউকে মা’রতে?
চলবে…