#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-১২|
সাদিব ফ্লোরে বসে বিছানার উপর মাথা দিয়ে রেখেছে।মাথার উপর দুহাত দিয়ে চেপে ধরে আছে।
মাথার ভেতরটা পুরো ফাকা লাগছে।কিছুই কাজ করছেনা।মনে হচ্ছে মাথার ভেতরের কাজ করার যন্ত্রটাই হারিয়ে গেছে।
সাদিব কিছুই বুঝতে পারছেনা।অবচেতন মন রীতিকে বিশ্বাস করার কথা বলছে কিন্তু পরক্ষণেই মনে হচ্ছে রীতি মিথ্যে বলছে।
কিন্তু রীতির কথাও উড়িয়ে দিতে পারছেনা।মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেনা।সাদিব বুকের মধ্যে ভয়ংকর ব্যথা অনুভব করতে পারছে।প্রিয় মানুষের কাছ থেকে প্রতারিত হওয়ার ব্যথা।
তবে সাদিব সেদিন খুব হার্ট হয়েছে।সেদিনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেনা।
.
সাদিব সাবিহার রুমের দিকে যাচ্ছে।রুমের দরজা খোলা।সাদিব দরজায় দাড়িয়ে রুমের ভেতরে চোখ রাখলো।সাবিহা পড়ার টেবিলে।
সাদিব দরজায় নক না করেই ঢুকে পড়লো।কারো আসার শব্দে সাবিহা পেছনে ঘুরে।সাদিবকে দেখে চমকে যায়।
ওর ভাই হটাৎ ওর রুমে কেনো?কি বলতে এসেছে?রীতি সব বলে দিয়েছে কিনা এসব ভাবনা মনের মাঝে জড়ো হচ্ছে।
সাবিহা জোর পূর্বক হাসি দিয়ে বললো,
—-“ভাইয়া তুমি? কোনো দরকার?”
সাদিব টেবিলের উপরে রাখা বইখানা নিখুত ভাবে দেখছে।সাবিহার হাতে কলম।বই খোলা খাতায় অর্ধেক অংক করা।
—-“না দেখতে এসেছিলাম পড়াশোনা ঠিক করে করছিস কিনা।কি করছিস?”
সাবিহা খাতা দেখিয়ে বললো,
—-“এই তো অংকগুলো করছি।”
সাদিব রীতির হাত থেকে খাতা নিয়ে অংক দেখছে।তারপর ওর চোখ টেবিলে সাবিহার ফোন খোজছে।
সাদিব খাতাপত্র রেখে বললো,
—-“তোর মোবাইল কই?”
মোবাইলের কথা শুনে সাবিহার ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা।তবুও ঢোক গিলে বললো,
—-“ফোন তো চার্জে বসিয়েছি।কেন?”
—-“না এমনি।পড়ার সময় যেনো মোবাইল আশেপাশে না থাকে।মন দিয়ে পড়।সামনে এইচএসসি পরীক্ষা।”
—-“হ্যা ভাইয়া আমি মন দিয়েই পড়ছি।তুমি চাইলে কোচিং-এ খোজ নিয়ে দেখতে পারো।কোনো রিপোর্ট পাবেনা।”
—-“হুম,,পড় তাহলে।”
সাদিব চলে যেতেই সাবিহা হাফ ছেড়ে বাচলো।এতোক্ষণ ওর শ্বাস আটকে ছিলো।
সাবিহা সবে মাত্র মোবাইল চার্জে বসিয়ে পড়তে বসেছে আর তখনই সাদিব রুমে আসে।সাবিহা মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিচ্ছে।আর কিছুক্ষণ আগে আসলে ওর হাতে মোবাইল দেখতো।
সাবিহা পড়া রেখে উঠে গিয়ে মোবাইলটা আনলো।কোনো রিক্স নিতে চায়না।
রিজভীর নাম্বার,মেসেজ সব ডিলিট করে দিলো।কল লিস্ট থেকে রিজভীর নাম্বার ডিলিট করে দিলো।গ্যালারিতে থেকে সব পিক মেমোরিতে ট্রান্সফার করে মেমোরি কার্ড খোলে রেখে দিলো।ফেসবুক মেসেঞ্জার লগ আউট করে রাখলো।
কিছুদিন সাবধানে থাকতে হবে।
.
রীতি সাদিবের এমন আচরণ মেনে নিতে পারছেনা।সাদিব ওকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলো।যাচাই করার প্রয়োজন মনে করলো না।রীতি যতই চাইছে এসব ভাববে না ততই মাথায় জেকে বসছে।
রীতি রাগে বইখাতা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।ওর বাবা হটাৎ এর রুমে এলো।সামনে পরীক্ষা মেয়ে কি করছে।খোজ খবর নিতে এসেছে।
ভেতরে এসে দেখলো রীতি বিছানায় বসে আছে আর বই পত্র এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে।
রীতির বাবা চিন্তিত ভংগীতে বললো,
—-“কি হয়েছে মা?বইখাতার এই অবস্থা কেনো?”
রীতি বাবাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
রীতি নিজেকে সামলে বললো,
—-“আসলে বাবা মাথাটা হ্যাং হয়ে গেছে।তাই কেমন জানি রাগ হচ্ছে।সরি বাবা সরি।”
রীতির বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
—-“ইটস ওকে।এক্সাম টাইম এমন একটু হয় ই।কোনো ব্যাপার না।এতো চাপ নেওয়ার দরকার নেই।আয় বাইরে আয়।সবার সাথে কথা বলো।রিলেক্স হ।ভালো লাগবে।”
রীতি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।
—-“তুমি যাও আমি আসছি।”
—-“আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয়।আমি নিজ হাতে তোর জন্য স্পেশাল কফি বানাবো।”
রীতি মুচকি হাসি দিলো।
রীতির বাবা যেতেই রীতি বইপত্র একসাথে গুছিয়ে নিলো।আর মনে মনে নিজেকে বকছে।
“ছিহ! এটা আমি কি করলাম?বইকে অসম্মান করলাম?ওই একটা ছেলের জন্য এতো বড় অন্যায় করতে পারলাম?আমি ঠিক করিনি।একদম ঠিক করিনি।”
রীতি সিদ্ধান্ত নিলো যতদূর সম্ভব সাদিবকে এড়িয়ে চলবে।রীতি বিকেলে ছাদে যেতেই দেখে সাদিব আর দিয়া আড্ডা দিচ্ছে।রীতি দেখেও না দেখার ভান করলো।যেনো ওর জন্য সাদিব এক্সিটই করে না।
কিন্তু কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছে দিয়া আর সাদিব একে অপরের সাথে একটু বেশিই মিশছে।সাদিবকে দেখে কিছু বুঝতে না পারলেও দিয়াকে দেখে রীতির সন্দেহ হচ্ছে।
কেনো জানি মনে হচ্ছে দিয়া সাদিবকে পছন্দ করে।ভয়ংকর পছন্দ।
রীতি যথারীতি ছাদে বসে পড়ছে।ওর পরীক্ষার কিছুদিন মাত্র বাকি।তাই পুরো মনোযোগ পড়ায়।
সাদিব সাবিহা দুজনকেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে।কিন্তু দিয়া সেটা হতে দিলোনা।
দিয়া রীতির পাশে এসে বসলো।
রীতি দিয়াকে দেখে পড়া রেখে দিয়ার দিকে তাকালো।
দিয়া মুচকি হেসে বললো,
—-“রীতি আপু তোমাকে বিরক্ত করলাম না তো?”
—-“না।তুমি তো আমাকে ভুলেই গেছো?”
—-“আসলে আপু তোমার সামনে পরীক্ষা।আমি তো জানি তুমি পড়াশোনার ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস।তাই আমি তোমার সাথে আড্ডা দিতে আসিনা।”
—-“কিন্তু ছাদে তো প্রতিদিন আসো।শুধু আমার কাছেই আসোনা।”
সাবিহা রীতির কথা শুনে আমতা আমতা করে বললো,
—-“হ্যা আসি কিন্তু তোমার যদি ডিস্টার্ব হয় সেটা ভেবে আর তোমার কাছে আসিনা।”
—-“তাহলে আজ কেনো এসেছো?বাড়িওয়ালার ছেলে নেই তাই?ঠিক বললাম তো?”
দিয়া রীতির কথা শুনে দমে গেলো।
দিয়া তো আসলে এই জন্যই এসেছে।ছাদে কেউ নেই।রীতিকে দেখে ওর সাথে কথা বলতে এসেছে।
—-“না মানে আসলে আপু।একা একা বোর হচ্ছিলাম।তাই ছাদে এসেছি।ছাদেও কেউ নেই।তোমাকে দেখে ভাবলাম কতদিন কথা হয়না।তাই একটু কথা বলি।”
—-“আচ্ছা ভালো।তা কি খবর তোমার?নিউ কিছু চলছে তোমার লাইফে?”
—-“নিউ? হ্যা আমার লাইফে তো প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিউ ঘটনা ঘটে।তা সাবিহার সাথে কথা হয় তোমার? ”
সাবিহার নাম শুনে রীতির মাথায় যেনো ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।
—-“দিয়া সাবিহার ব্যাপারে আ’ম নট ইন্টারেস্ট।ওর টপিক নিয়ে কোনো কথা আমি শুনতে চাইনা।”
—-“আচ্ছা আচ্ছা রাগ করোনা।ওর কথা বলবোনা।জানো আপু আমার সাথে সাদিব ভাইয়ের ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়েছে।”(লজ্জা মাখা মুখে)
সাবিহার লজ্জা মাখা মুখ দেখে রীতির বুক ধক করে উঠলো।কি যেনো হারিয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে রীতি অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে।ওই লজ্জা মাখা মুখে হাজারো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে।রীতির মনে ঝড় উঠছে।
যাকে নিয়ে আর ভাববে না তার জন্য কেনো এমন অস্থির লাগছে? কেনো ঝড় উঠছে?
—-“আমি যাচ্ছি দিয়া।আমার কাজ আছে।”(ব্যস্ততা দেখিয়ে)
রীতি তাড়াতাড়ি চলে গেলো।নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো।কেনো জানি প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।
.
রাতের আকাশে বৃত্ত কার চাদ উঠেছে।ঝলমলিয়ে উঠছে চারপাশ।রীতি বারান্দার লাইট অফ করে ফেললো।চাদের জোৎস্না গায়ে মাখছে।কালো একটা বাইক বাড়িতে ঢুকলো।বাইকের শব্দে রীতি নিচের দিকে তাকালো।সাদিব এসেছে।
রীতির সাদিবকে দেখে পুরনো ব্যথা জেগে উঠলো।
কেনো জানি মনের অজান্তেই চোখে পানি চলে এলো।
“গোধূলি নির্জন সময় দেয় পাহারা
একাকীত্ব পেরোয় গন্ডি
তুমি আমি দুজন দু’প্রান্তে
রাতের তারা আজ আমাদের সঙ্গী।”
–রাকিব
সাদিব সাবিহার কোচিংএ গিয়েছে।সাবিহার পড়াশোনার খোজ নিতে।সেখানে কোনো রিপোর্ট পায়নি।সাবিহা রেগুলার স্টুডেন্ট এবং রেগুলার পড়া দেয়।
সাদিব ভাবছে একদিন সাবিহার কলেজে যাবে।সেখানে গিয়ে ওর খোজ খবর নিবে।
সাবিহা কোচিং ক্লাস মিস করে আজ রিজভীর সাথে ঘুরতে যাচ্ছে।এই প্রথম বার কোচিং মিস দিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে।সাবিহার কেমন ভয় ভয় লাগছে।যেতে চায়নি কিন্তু রিজভীর ইমোশনাল কথা বার্তা শুনে যেতে রাজি হয়েছে।
রিজভী বাইক চালাচ্ছে আর লুকিং গ্লাসে সাবিহার মুখটা দেখবে।
—-“সাবু মুখটা এমন করে রেখেছো কেনো?”
—-“রিজভী আমার ভয় লাগছে।এভাবে কোচিং ক্লাস মিস দিয়ে ঘুরতে যাচ্ছি।যদি কেউ জেনে যায়?”
—-“আরে কিছু হবেনা।চিন্তা করোনা।আমরা তাড়াতাড়ি চলে আসবো।আর এসব লুকোচুরি বেশীদিন চলবে না।তোমার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হোক তারপর আমরা বিয়ে করে নেবো।ওকে সাবু?”
বিয়ের কথা শুনে সাবিহা লজ্জা পেয়ে গেলো।
—-“তুমি যা ভালো মনে করো।আমারও এসব লুকোচুরি ভালো লাগে না।বাকি পড়াশোনা নাহয় বিয়ের পরেই করবো।”
—-“অবশ্যই আমি তোমাকে কোনো কিছুতে বাধা দেবোনা।কখনোই না।”
সাবিহার অনেক ভালো লাগছে এটা ভেবে কত ভালো একজন লাইফ পার্টনার পেতে যাচ্ছে।
সাদিব সাবিহার কোচিং-এ গিয়ে সাবিহার খোজ করছে।কিন্তু সাবিহা নাকি আজ আসেনি।
সাদিব কোচিংয়ে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চলে এলো।তারপর বাইরে বেড়িয়ে বাড়িতে ফোন করলো ওর মায়ের কাছে।
—-“হ্যালো মা, সাবিহা কোথায় ওকে একটু দরকার ছিলো।”
—-“ও তো কোচিং-এ।এখনো বাড়িতে আসেনি।ওর নাম্বারে ফোন করে দেখ।”
—-“ওহ আচ্ছা।ঠিক আছে।”
সাদিব পকেটে ফোন রেখে ঘামছে।সাবিহা কোথায় গেলো কোচিং ক্লাস এর কথা বলে?তাহলে কি রীতির কথাই ঠিক? ও কি তাহলে ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে গিয়েছে?
চলবে…..