গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-০৯

0
267

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_৯

মিসবাহ শরীফ। পরিবারের বড়ো ছেলেরা যেমন হওয়া উচিত, তেমনই। ভাইবোনদের ভালোবাসেন। মায়ের আদেশ নিষেধ মেনে চলেন। মিসবাহ শরীফের বাবা জামিল শরীফও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। রাতদিন দোকানেই পড়ে থাকতেন। নিজের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। আর ছিলেন ভোজনরসিক। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকার পরও সাবধান হননি। ফলাফল কিডনি ড্যামেজ!

ডায়ালাইসিস যাদের করতে হয় একমাত্র তারাই বলতে পারেন কী পরিমাণ শারীরিক ও আর্থিক কষ্ট আসে নিয়মিত সপ্তাহে দুইদিন বা তিনদিন ডায়ালাইসিস করতে করতে। জামিল শরীফ সাহেবের ক্রিয়েটিনিন বেড়ে গিয়েছিল, ডায়ালাইসিস করতে হতো সপ্তাহে তিনদিন। প্রথম দিকে টানা অনেকদিন কিডনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেই সময় মিসবাহর বাকি ভাইবোনেরা ছোটো। মাকে সাথে নিয়ে বাবার জন্য সমস্ত ছোটাছুটি মিসবাহ একাই করেছেন। চিকিৎসার পেছনে জলের মতো টাকা খরচ হয়েছে। নিয়মিত ডায়লাইসিস করা স্বচ্ছল পরিবারের জন্যও সহজ না।
সংসার, ব্যবসা, বাবা সবকিছুর হাল ধরতে হয় তাই মিসবাহকেই। এবং ধরতে পারেনও। ভাইবোনদের কাছে ধীরে ধীরে বাবার জায়গাতেই বসেন। বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার অসমাপ্ত দায়িত্বগুলোও নিজের কাঁধে তুলে নেন। দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ভাইকে পড়িয়েছেন। মেজো ভাই হামিদকে টাকাপয়সা দিয়ে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ছোটো ভাই হাসানকেও চেষ্টা করছেন ভালো কোথাও চাকরিতে ঢুকিয়ে দিতে। বসুন্ধরার এই দোকান নিজের চেষ্টায় দাঁড় করিয়েছেন মিসবাহ। আকারে ছোটো হলেও আয় বেশ ভালো। বাবার পুরানো ব্যবসা দেনায় জর্জরিত ছিল। তা বিক্রি করে সামান্য কিছু পুঁজি নিয়ে শুরু করা মিসবাহর ব্যবসা লাভের মুখ দেখেছে। কামরাঙ্গিচরে নিজেদের পৈতৃক দোতলা বাড়িতেই থাকে মিসবাহর পুরো পরিবার। মায়ের ইচ্ছায় একান্নবর্তী পরিবার ধরে রেখেছে সবাই।

দোকান বন্ধ করে হিসেবনিকেশ করে বাসায় আসতে আসতে রাত এগারোটার বেশি বাজে মিসবাহর। মা জাহানারা সুস্থ থাকার সময় মিসবাহর জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকতেন। এখন নিয়মিত পারেন না। রাত জাগলে প্রেশার বাড়ে। আর মেয়ে পলিনও জেগে থাকে দাদী জেগে থাকলে। তখন সকালে স্কুলে নিতে সমস্যা হয়।তাই মিসবাহই বলেছে খাওয়া নিয়ে বসে থাকতে না। হটবক্সে খাবার রেখে দিতে। খাবার গরমও থাকবে, ও নিজে নিয়ে খেয়েও নিতে পারবে।

হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে মিসবাহ। আজ রান্না হয়েছে ব্রয়লার মুরগী ভুনা, ফুলকপি ভাজি, আর মসুরের ডাল। ব্রয়লার মুরগী মিসবাহর পছন্দ না। কিন্তু বাচ্চারা পছন্দ করে, তাছাড়া বড়ো সংসারে দেশি মুরগী কিনতে হলে অনেকগুলো করে কিনতে হবে। বাচ্চারা আর মা ঝাল কম খেতে পারে বলে ঝালও কম দেওয়া।। ঝাল ভুনা হলে তাও ভালো লাগতো। ঝাল কমের, কয়েক জ্বাল পড়া বাসি মুরগী তাই খেতে ইচ্ছে করে না। সবজি আর ডাল মেখেই খেতে থাকে মিসবাহ। জাহানারা বেগম উঠে আসেন। ছেলের সাথে নিরিবিলি একটু কথা বলবেন। সকাল হলেই তো হইচই।

“আম্মা, ঘুমান নাই?”

“খালি ডাইল আর সবজি দিয়া খাইতাছস! মেজো বৌরে কইলাম একটা ডিম একটু ভুনা কইরা রাখতে। তুই মুরগী খাবি না জানে তো। ডাকতাছি আমি। কিছু কইলেই তো একশোখান বাহানা দিবো। একটা ডিম ভুনা করতে এমন কী কষ্ট! দুপুরেই কইছি মিসবাহ মুরগী খাইবো না। একটু মাছ কইরো। তখন কইলো রাতে ডিম কইরা দিবো। সেটাও না দিয়া যাইয়া শুইছে। আমি রেহানারে এখনি ডাকতাছি।”

“থাক আম্মা। বাদ দেন। এত মানুষের রান্নাবান্না করে। নিজের বাচ্চা ছোট। পলিন ছোট। সবাইরে দেখাশোনা করে। সবার পছন্দ মতো রাঁধবো এত সময় কই। খাইতাছি, এত কিছু লাগে না রাতে। এমনিও দোকানে ভাজাপোড়া খাওয়া হয় বেশি। রাতে হালকা খাওয়াই ভালো।”

“হালকা খানা, আর আরাম কইরা না খাইতে পারার মাঝে পার্থক্য আছে। আমার বয়স হইছে। শরীরে বল নাই। তোর দেখাশোনা, পলিনের দেখাশোনা। কিছুই আমি আর করতে পারি নারে বাপ।”

“যা করেন তাই যথেষ্ট আম্মা। পলিন ঘুমাইছে না। রাত দশটার পর আর টেলিভিশন, ফোন দিয়েন না। রাত জাগে আর সকালে স্কুলে যাইতে চায় না।”

“এইগুলা বাপ মায়েরে দেখতে হয়। দাদা দাদী আদর করে। শাসন করলে নাতি নাতনি কদ্দুর মানে!”

“আমি শাসন করতে গেলে তো অভিমান করে। সারাদিন থাকি ব্যস্ত। শাসন করতে গেলে গুছিয়ে কথা বলতে পারি না আম্মা। ছয় বছরের মেয়ে, কিন্তু কথা বলে কেমন পাকনা পাকনা দেখেন না আম্মা। আপনারাও যদি ওরে না দেখেন নষ্ট হয়ে যাবে।”

“নষ্ট হওয়া রক্তে থাকলে এমনিই নষ্ট হইবো।”

“আম্মা, পলিনের শরীরে আমার রক্ত।”

“তার মায়ের রক্তও আছে। মার গুণে কন্যার পরিচয়। বাদ দে এসব কথা তুলতে চাই না। যা বলতে বসছি তা বলি। তোর বিয়া দিতে চাই। তোর যত্নের প্রয়োজন। পলিনের মায়ের আদর শাসন প্রয়োজন। অনেক না না করছস। আমি না থাকলে তুই কামাই করে ঘরে আনবি, কিন্তু খাবি বাসি, পাতিলের তলারটা। পুরুষের যত্ন করতে ঘরের মহিলা লাগে। শুধু কামাই করলে হয় না। আর পলিনরে কে দেখবো? ওরে গড়ে পিঠে নিতে মা দরকার।”

“নতুন মা এসে পলিনকেই যদি শত্রু ভাবে আগে? পলিনকে কষ্ট দেয়! এই ভয়েই আর আগাতে ইচ্ছে করে না আম্মা। একজন তো আমার মানসম্মান সব শেষ করে দিয়ে চলে গেল।”

“সব তো একরকম না। দেখেশুনে আনবো। একটু কম বয়সী অসহায় ঘরের মাইয়া আনলে নরম হইয়া থাকবো।”

মিসবাহ হেসে দেয়। “আম্মা, পায়রাও কিন্তু কমবয়সী মেয়ে ছিল। তখনও আপনি বলেছেন কমবয়সী অল্প শিক্ষিত মেয়ে নরম সরম হয়ে থাকবে। থাকছে?”

“ওর তো চরিত্র খারাপ আছিল।”

“সেটাই চরিত্র ভালো খারাপ হইতে কম বয়সী, বেশি বয়সী, কম শিক্ষিত, বেশি শিক্ষিত এসব ব্যাপার না। পায়রা কোনদিন সংসারে মন দেয় নাই। আমার কথা বাদ দেন, আমি না হয় বয়সে তার চেয়ে বেশি বড়ো ছিলাম, আমাকে তার পছন্দ হয়তো হয় নাই। টান হয় নাই। কিন্তু বিয়ের তিন বছর পর একবছর বয়সী মেয়েকে রেখে কিভাবে পুরানে প্রেমিকের হাত ধরে চলে গেল! এসব মনে হলে আর বিয়েশাদি করতে মন চায় না।”

“ঠিক আছে। একটু বয়সী কারও সাথে বিয়া দি তোর বাপ। কিন্তু বয়স্ক মাইয়ার চেহারা ভাইঙ্গা যায়। আর বাইচ্চা কাইচ্চা হয় না যদি। একটা পোলার মুখ দেখবি না?”

“চল্লিশ বছর বয়স চলে। এখন আর এত রূপবতীর শখ নাই। আর কে বললো চেহারা ভাঙে! এগুলো মনের ভাবনা। আজ আমি একটা মেয়ে দেখছি। আমার দোকানে কাজ করে যে ছেলে আশিক। তার বোন আতিয়া। চৌত্রিশ, পঁয়ত্রিশ বছর বয়স। বিধবা। দেখতে শুনতে ভালো আছে। এমন কেউ হইলে চিন্তা করে দেখবো।”

“কই দেখলি? দোকানে আসছিল? বিধবা বিয়া করবি? বাচ্চা কাচ্চা আছে? অপয়া হয় যদি।”

“না ছেলেমেয়ে নাই। আর পয়া, অপয়া কী আম্মা! আব্বা মারা যাওয়ায় কী আপনি অপয়া হয়ে গিয়েছেন! আব্বার কিডনি নষ্ট হয়েছে, মারা গিয়েছেন। এই মেয়ের স্বামী এক্সিডেন্ট করে মারা গিয়েছে। কোনটাতেই কারও হাত নাই।”

জাহনারা বেগম চুপ করে যান। আগে কখনো মিসবাহ এভাবে বলে নাই। তবে মিসবাহর এই তুলনা ওনার ভালো লাগে না। কোন মেয়ে খোঁজ খবর নিতে হবে ভাবেন তিনি।

পলিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। মেয়েটার সাথে দিনদিন দূরত্ব হচ্ছে। পলিন দাদীর সাথেই ঘুমায় বেশিরভাগ সময়। যেদিন মিসবাহ বাসায় থাকেন, সেদিন নিজের কাছে নিয়ে আসেন। প্রায় এটা সেটা হাতে করে কিনে আনেন। রুম ভর্তি খেলনা। কিন্তু পলিন এক খেলনা দিয়ে বেশিদিন খেলতে চায় না। আবার নতুন বায়না করে। মিসবাহও আব্দার মেনে নেন। মেয়ের সাথে গল্প করা, সময় দেওয়া এই জিনিসগুলো হয় না বলে, তার ঘাটতি খেলনা দিয়ে মেটানোর চেষ্টা করেন। এই বয়সী বাবা মেয়ের সম্পর্ক কত নির্মল হওয়ার কথা।।অথচ কেমন একটা বাধো বাধো। হয়তো পায়রার কথা মনে পড়ে বলে। কিছুদিন আগে পায়রাকে দেখেছিলেন বসুন্ধরা শপিং মলে। পায়রা বলেছিল সে সুখে আছে। কেননা যেখানে সে আছে সেখানে তার ভালোবাসা আছে। মিসবাহর কাছে নাকে সেই ভালোবাসা পায়রা কোনদিনও পায়নি। মিসবাহ নাকি পরিবারের বড়ো ভাই, আর মায়ের ছেলেই হয়ে ছিলেন। কোনদিন পায়রার ছিল না!

পায়রা কি সত্য বলছে! আজ যেভাবে সে মাকে পয়া অপয়ার ব্যাখ্যা দিলো। এই ঘটনা জীবনে প্রথম। আসলেই তো মা পায়রাকে শাসনে যখন রাখতেন, তখন তা তার কাছে অস্বাভাবিক লাগেনি। এটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছে। মিসবাহর সাথে তিন বছরে তিনদিনও পায়রা ঘুরতে যেতে পারেনি। বারো বছর বয়সের পার্থক্যটা কাটানোর জন্য হয়তো যে সময় দেওয়ার দরকার ছিল। তার কিছুই দিতে পারেননি। ব্যবসা গোছানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বাড়িতে কী হচ্ছে খবর রাখেননি। রাতে নিয়ম করে পায়রাকে কাছে টেনেছেন। আর এটাই যথেষ্ট ভেবেছেন। কোনদিন পায়রাকে নিয়ে একটা সন্ধ্যা কাটানো হয়নি। তাই হয়তো পায়রা বলেছে মিসবাহর সাথে কখনো কোন মনের টান অনুভব করেনি! যদি জীবন আরেকবার গোছানোর সুযোগ পান, পুরনো ভুলগুলো আর করবেন না। তাই ভাবে মিসবাহ।

(চলবে)