গোধূলি_বেলায়_প্রেম পর্ব-৩০

0
3390

#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৩০|

রীতি নিজের মুঠোফোন নিয়ে দিয়ার সামনে বারবার নাড়াচাড়া করছে।আর মুচকি মুচকি হাসছে।দিয়া রীতির কাহিনী কিছুই বুঝতে পারছেনা।
তাই জিজ্ঞেস করলো,
—-“রীতিপু তোমার কাহিনি কি বলো তো?হাসছো কেনো এভাবে?পাগল-টাগল হলে নাকি।”

রীতি হাতের ফোনটা রেখে বললো,
—-“পাগল হইনি।তবে টাগল হয়েছি।”

দিয়া চোখ বড়বড় করে বললো,
—-“টাগল আবার কি?”

—-“সেটা তো তুমিই ভালো জানো।কারণ তোমার মুখ থেকেই শব্দটা শুনেছি।”

—-“দূর আমি তো এমনিতেই বলেছি।এখন বলো ঘটনা কি?”

রীতি ফোনের গ্যালারি থেকে একটা ছেলের পিক দেখিয়ে বললো,
—-“দেখতে কেমন?”

দিয়া ছেলেটাকে এক পলক দেখে বললো,
—-“রীতি আপু এই ছেলে আবার কে?সাদিব ভাইকে ধোকা দিচ্ছোনা তো?”

রীতি দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-“ওর নাম আদনান।আমার ক্লাসমেট।প্রেমিক নয়।এখন বলো দেখতে কেমন?ওর জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করেছি।ঘটকালি করবো।”

দিয়া ছেলেটাকে ভালো করে দেখে নিলো।ছেলেটা দেখতে একদম প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো।
দিয়া নিচু গলায় বললো,
—-“হুম ভালো।কার জন্য ঘটকালি করবে?”

রীতি চট করে বললো,
—-“আমার ননদিনীর জন্য।”
তারপর আলতো হাসলো।

দিয়া মিনমিন করে বলছে,”সবার কপালই ভালো।আমারটা ছাড়া।আমার হচ্ছে ফাটা কপাল।পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কপাল।”
দিয়া দুম করে উঠে গেলো।

.

রাতে বৃষ্টি হয়েছে।রাস্তাঘাটের গর্ত জায়গায় পানি জমে আছে।এছাড়াও কাদার ছড়াছড়ি।রীতি প্লাজু দুহাতে ধরে একটু উচু করে পা টিপে টিপে কাদা দিয়ে অতি সাবধানে হাটছে।যাতে প্লাজুতে কিংবা পায়ে কাদা না লাগে।সাদিব দাড়িয়ে যাওয়ায় রীতি সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নিজেই থমকে যায়।তারপর সাদিবের দিকে তাকায়।সাদিবের ঠোঁটের কোনে হাসি।

সাদিব হাসি মিশ্রিত মুখে বললো,
—-“চলে এসেছি মাই কুইন আমাদের রাজ-প্রাসাদে।”

রীতি সাদিবের কথা শুনে মুচকি হাসলো।রীতি বড় বড় গাথনী গাথা একটা নির্মাণাধীন ভবনের সামনে দাড়িয়ে আছে।মূলত রীতি আর সাদিব দুজনে সাদিবদের নতুন বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে।পিলার গাথা হয়েছে।সেখানে কাজ চলছে।
সাদিব রীতিকে নিজেদের নতুন বাড়ি দেখাতে নিয়ে এসেছে।
সাদিব আর রীতি ভেতরের দিকে গেলো।গাথনি অনুযায়ী সাদিব রীতিকে সব দেখাচ্ছে।ভেতরে ঢুকতেই সাদিব বললো,
—-“এটা ড্রয়িংরুম।এ পাশে সোফা রাখা হবে।আর ওপাশের দেয়ালে টিভি।”
পাশেই একটা রুম দেখিয়ে বললো,
—-“এটা কিচেন।আর পাশে ওয়াশরুম।উচু জায়গায় ডাইনিং টেবিল রাখা হবে।আর ডান পাশে গেস্ট রুম।”

সাদিব তারপর যেখানে দোতলায় উঠার সিড়ি হবে সেখানটা দেখিয়ে বললো,
—–“এখানে উপরে উঠার সিড়ি হবে।উপরে ৫টা বেডরুম হবে।”

তারপর সাদিব রীতিকে বাইরে দেখিয়ে বললো,
—-“ডান পাশে বেলীফুলের বাগান হবে।আর বিল্ডিংয়ের বাইরে ঘেঁষে অর্কিড থাকবে।আর বাগানের অন্য জায়গায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ধরনের ফুলগাছ থাকবে।বাগানের বিভিন্ন জায়গায় ফলের গাছ লাগানো হবে।আর ওই জায়গায় একটা কৃত্রিম ঝর্ণা থাকবে।এই বার বলো কেমন হবে?”

রীতি মুচকি হেসে বললো,
—-“ভালো খুব ভালো।অনেক সুন্দর হবে।”
তারপর কিছু একটা ভেবে রীতির মন খারাপ হয়ে গেলো।কিন্তু সাদিবকে বুঝতে দিলোনা।আর সাদিবও বুঝতে পারলোনা।

রীতি পুরো রাস্তা শুধু একটা কথাই ভেবেছে রীতির ফ্যামিলি রাজি হয়ে গেলেও সাদিবের ফ্যামিলি রাজি হবে তো।অদূর ভবিষ্যতের কথা ভেবে রীতির ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

.

ছাদে আজ বড়রাও হাজির হয়েছে।কারেন্ট নেই কয়েক ঘন্টা যাবত।তাই বিকেল বেলায় ছাদে এসেছে একটু হাওয়া লাগাতে।গল্পের এক ফাকে সাদিবের মা রীতির মাকে বললো,
—-“ভাবী রীতির বিয়ের কথা কিছু ভাবছেন?আমার কাছে ভালো একটা ছেলে আছে।”
সাদিব রীতির চেয়ে কিছুটা দূরে থাকলেও মায়ের কথা স্পষ্ট শুনতে পেলো।সাদিব কানখাড়া করে রেখেছে।ওর মা কি ওর বিয়ের কথা ভাবছে?ভাবলে তো জানতে পারতো।তাহলে?

রীতির মা মৃদুভাবে হেসে বললো,
—-“না ভাবী।আমার মেয়ে এখনো ছোট।পড়াশোনা এখনো শেষ হয়নি।”

সাদিবের মা প্রতিউত্তরে বললো,
—-“কি যে বলেন ভাবী!কই ছোট? আপনার মেয়ে মাশাল্লাহ অনেক বড় হয়েছে।কতদিন আগেই তো শুনলাম ২১তম জন্মদিন পালন করলো।মায়েদের কাছে ছেলেমেয়েরা সব সময় ছোট থাকে।আমার বান্ধবীর বোনের ছেলে।দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ।ইঞ্জিনিয়ার।উত্তরায় নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে।ফ্যামিলিও ছোট।আপার এক মেয়ে,এক ছেলে।মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।ছেলেই আছে।ওর জন্য ভালো একটা মেয়ে খোজছে।আপনারা রাজি থাকলে আমি রীতির কথা বলতে পারি।”

সাবিহা মায়ের কথা শুনে ভাইয়ের দিকে তাকালো।সাদিবের যেনো হার্ট এটাকের অবস্থা।
সাবিহা দ্রুত বললো,
—-“মা কি যে বলো! ওই ভাইয়ার তো প্রেমিক আছে।তাকেই বিয়ে করবে।এসবের মধ্যে রীতি আপুকে কেনো টানছো?”

সাবিহার কথা শুনে সাবিহার মা অবাক হয়ে বললো,
—-“কি বলিস?তাই নাকি?আমি তো জানতাম না।অবশ্য আজকালকার ছেলে-মেয়েরা নিজেরাই পছন্দ করে বিয়ে করে।এসব কোনো ম্যাটার না।কি বলেন ভাবী?(রীতির মাকে উদ্দেশ্য করে বললো।)”

রীতির মা তাল মিলিয়ে বললো,
—-“হ্যা হ্যা ভাবী।ঠিক বলেছেন।”

সাদিব রীতির দিকে তাকালো।রীতি মুচকি হাসছে।সাদিবের গা জ্বলছে রীতির হাসি দেখে।ওর মা নাকি ওর বউকে ওর কোন এক খালাতো ভাইয়ের বউ বানাতে চায়।কি একটা অবস্থা!

.

দিয়া পড়াশোনায় ব্যস্ত।রীতি দিয়াকে এর আগে এতো মনোযোগ দিয়ে পড়তে দেখেনি।
রীতি দিয়ার সামনে গিয়ে বললো,
—-“কিরে দিয়া,টিয়া! আজ এতো পড়াশোনা কিসের?”

দিয়া বই থেকে চোখ তুলে বললো,
—-“পড়াশোনা ছাড়া গতি নেই।আজ পড়াশোনা করিনা বলে একটা ভালো বয়ফ্রেন্ড নেই।পড়াশোনা করবো আর ফার্স্টক্লাস একটা বয়ফ্রেন্ডও বানাবো।”

রীতি দিয়ার কথা শুনে বললো,
—-“তা তো তোমাকে করতেই হবে।”

দিয়া প্রশ্নবোধক চাহনি দিলো।রীতি বললো,
—–“গতকাল আমার এক ক্লাসমেটের কথা বলেছিলাম মনে আছে?আদনান?ও খুব ভালো স্টুডেন্ট।প্রচুর পড়াশোনা করে।নম্র,ভদ্র সব দিক দিয়ে ভালো।উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ওর।”

দিয়া গাল ফুলিয়ে বললো,
—-“আমাকে কেনো শোনাচ্ছো?সাবিহাকে গিয়ে শোনাও।আমারও একদিন এমন বয়ফ্রেন্ড হবে।দেখে নিও।”

—–“সে দিন এসে গেছে।”

দিয়া বই রেখে বললো,
—-“মানে??”

রীতি ভাব নিয়ে বললো,
—–“কিছু না।তার আগে বলো তুমি সাবিহার কথা কেনো বললে?”

সাবিহা স্বাভাবিকভাবেই বললো,
—-“কারণ তুমি সাবিহার জন্য ঘটকালি করছো তাই।”

রীতি চোখ বড়বড় করে বললো,
—-“আমি সাবিহা না তোমার জন্য ঘটকালি করছি মাথা মোটা।”

রীতির কথা শুনে দিয়ার হাত থেকে বই মেঝেতে পড়ে গেলো।দিয়া চোখের পলক ফেলছে না এতটাই অবাক হয়েছে রীতির কথা শুনে।থ মেরে আছে।নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছেনা।
দিয়া নরমাল হয়ে কাপা কাপা গলায় বললো,
—-“কি বললে তুমি?”

~ফ্ল্যাশব্যাক~
গতকাল যখন ভার্সিটিতে গিয়েছিলো তখন আদনানের সাথে দেখা।আদনান রীতির সামনে দাড়িয়ে আমতা আমতা করছে।রীতির রাগ হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছেনা।
তারপর আদনান জড়তা কাটিয়ে বললো,
—–“দিয়ার কি কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?”

রীতি চট করে বললো,
—-“না।”
তারপর রীতির মাথায় অন্য ভাবনা এলো।তাই আবারো প্রশ্ন করলো,
—-“কেনো?তা দিয়ে তোমার কি?”

আদনান বললো,
—-“না মানে আসলে,,,”

—-“আমতা আমতা না করে বলে ফেলো।না মানে আসলে কি?”

আদনান নার্ভাস ভাবে রীতির দিকে তাকালো তারপর বললো,
—–“আমি দিয়াকে পছন্দ করি।ইনফেক্ট পছন্দ না ভালোবাসি।”

রীতি আদনানের কথা শুনে হা করে রইলো।তারপর নিজেকে দমিয়ে বললো,
—-“কেনো ভালোবাসো?”

আদনান রীতির প্রশ্ন শুনে চমকে গেলো।তারপর বললো,
—-“কেনো ভালোবাসি এটা কেমন প্রশ্ন রীতি?ভালোবাসায় কোনো কারণ লাগে না।কোনো কারণে কাউকে ভালোবাসলে সেটা ভালোবাসা না সেটা মোহ।আমি দিয়াকে ভালোবাসি।আমি জানি ও আমার টাইপ না।পড়াশোনা একদমই করেনা।আর আমার মতো শান্তও নয়।খুবই চঞ্চল একটা মেয়ে।এক কথায় ও আমার বিপরীত।আমি কারণ খোজতে গেলে দিয়ার মধ্যে আমার মধ্যে বিদ্যমান গুণগুলো নেই।কিন্তু তবুও আমি ওকে ভালোবাসি।আমার জন্য এটাই যথেষ্ট।আর তুমি আমাকে জানো আমি কেমন।দিয়া যদি না চায় তাহলে আমার কিছুই করার নেই।তবে চেষ্টা চালিয়ে যাবো। ভালোবাসি এটা না জানানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না।কিন্তু যদি হ্যা বলে তবে কোনো দিন অভিযোগ করার সুযোগ দেবোনা।ভালোবেসে ভালো রাখবো।”

রীতি দিয়াকে যখন সব খোলে বলে দিয়ার চোখ থেকে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
দিয়া হালকা হেসে বললো,
—–“ভালোবাসি তো অনেকেই বলেছে কিন্তু কেউ এভাবে বলে নি।”

রীতি দিয়ার গাল টেনে বললো,
—-“তবুও মাই ডিয়ার।বুঝে শুনে ডিসিশন নিও।তবে আদনান ছেলে ভালো যতটুকু দেখেছি ওকে।তবুও ভেবে চিন্তে ডিসিশন নিও।”
দিয়া ভাবার জন্য সময় নিলো।আদনান সম্পর্কে একটু খোজ খবর নেওয়া প্রয়োজন।হুট করে কোনো সম্পর্কে জড়ানো ঠিক না।

.

পরের দিন সন্ধ্যা বেলা-
রীতিকে সাদিব ফোন করে জ্বালিয়ে মারছে।রীতি মাত্রই ঘরে এলো ছাদ থেকে বই পত্র নিয়ে।
রীতি ফোন রিসিভ করতেই সাদিব ওপাশ থেকে বললো,
—–“বেবি একটু ছাদে আসবে?”

সাদিবের মুখে বেবি শুনে রীতি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
—-“কিসের বেবি?আমি কি ফিটার খাই?এসব কথা আপনাকে কে শেখালো?”

সাদিব বললো,
—-“ওহ শিট! ভুলেই গিয়েছি রীতি বেবি এখন নিজেই একটা বেবি পয়দা করতে পারবে।সে কি করে বেবি হতে পারে?”

রীতির সাদিবের কথা শুনে কান জ্বলে যাচ্ছে।
—-“দূরর! আপনার সাথে কথাই বললো না।আপনি খুব বাজে।”

—-“এই এই লাজুক লতা রীতিকা ফোন রেখো না।একটু ছাদে এসো না?সারাদিন তোমাকে দেখিনি।”

—-“আপনার দেখতে হবেনা।আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ।ব্যস্ত থাকুন।আমাকে না দেখলে কি হবে?”
রীতি অভিমান নিয়ে কথা গুলো বললো।

সাদিব রীতির অভিমান বুঝতে পেরে বললো,
—-“আহারে,রাগ করে না।আমার কাজ ছিলো।আমার কি ইচ্ছে করে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে? তোমার রাগ ভাঙাতে তোমার জন্য বই এনেছি।চলে এসো।”

রীতি ফোন রেখে ছাদের জন্য পা বাড়ালো।
ছাদে গিয়ে দেখে কেউ নেই।ছাদ ফাকা।রীতি সাদিবকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে সাদিব কোথায়।সাদিব উত্তরে জানায় খোজে নিতে।
রীতি চিলেকোঠার ঘরের দরজা খোলে দেখে সাদিব শুয়ে শুয়ে পা নাড়াচ্ছে।সাদিব রীতিকে দেখে উঠে বসে।
রীতি বললো,
—–“ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে ছিলেন? এখন বাইরে চলুন।কেউ এখানে দেখলে খারাপ ভাববে।”

রীতি বাইরে গিয়ে দাড়ালো।সাদিব রীতির জন্য আনা বইগুলো রীতির দিকে বারিয়ে দিয়ে কান ধরে বললো,
—-“সরি।কাজ ছিলো তো।”

রীতি অভিমান নিয়ে বললো,
—-“আপনি জানেন আমি সারাদিন কি পরিমাণ ছটফট করেছি?

—-“হুম জানি তো।কারণ আমিও যে ছটফট করেছি।তোমাকে না দেখলে আমারো দম বন্ধ হয়ে যায়।কিন্তু কি করবো?বাড়ির কাজের দায়িত্ব বাবা আমাকে দিয়েছে।করতেই হবে।”

চলছে তাদের মান-অভিমানের পালা।সাদিব রীতির হাত জোর করে ধরে অভিমান ভাঙানোর চেষ্টায় আছে।

চলবে….!