গোধূলী শেষে তুমি আমি পর্ব-১০

0
270

#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১০

জীবনের গতি কোথায় এগিয়ে যায়,তা আমরা কেউ জানি না। সুখ কখন আসবে বা দুঃখ কখন ধরা দেবে তা-ও জানি না। তবুও মানুষ বাঁচতে চায়। সুখ-দুঃখ নিয়েই তাঁরা বাঁচতে চায়। জীবনের পায়ে কোন চাকা নেই! তবুও দেখ সে গরগর করতে করতে গড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রজনীও হয়তো জানে না,তাঁর জীবনের চাকার মোড়টা অন্যদিকে ঘুরে গেছে। সে আজও মনে করে,হয়তো হুট করে মঈনুল আসবে,তাঁর গলায় ছুরি ধরে তাঁকে মেরে চলে যাবে। এই একটা ভয়ে সে বারবার গুটিয়ে নেয় নিজেকে। ভোর বেলার পাখির কলরব গুলো বড্ড সিগ্ধ। থেমে থেমে আসা দক্ষিণা বাতাস ছুঁয়ে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় শরীর। সর্দ ফোঁটা ফুল থেকে ভেসে আসা মিষ্টি গন্ধ মনকে এক নিমেষেই ভালো করে দেয়। রাতের তিমির কাটিয়ে যখন সূর্যের রশ্মি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে,তখন পুরো পৃথিবী নতুন রূপে সেজে ওঠে। বাগানের এক কোণে শিউলি গাছের ফুলগুলো বাতাসে দুলছে। সেদিকে তাকিয়ে রজনী মুচকি হাসলো ছোটবেলার কথা ভেবে। মক্তবে যাওয়ার জন্য মা ডেকে ডেকে প্রায় গলা ভেঙে দিতো! কিন্তু রজনীর ঘুম পরিরা যেতে নারাজ। কিন্তু যখন শিউলি বকুল ফুলের সময় আসতো! তখন ঘুম পরিদের রজনী তাড়িয়ে দিতো। কড়া সুরে বলতো! এই ক’মাস তোরা আমার থেকে দূরে থাকবি,না হলে কিন্তু আমি অনশন ডাকবো। তোদের নামে বিচার দিবো তোদের রাজার কাছে। আর রজনীর কথা শুনে ঘুম পরিবার বলতো– আজ্ঞে মহারাণী। রজনী এই কথা শুনে খিলখিল করে হাসতো। সেই হাসি দেখে তাঁর মা বলতো– কিরে পাগল হয়ে গেলি নাকি। মায়ের গলা জড়িয়ে বলতো– হ্যা মা আমি পাগল হয়ে গেছি। ওই শিউলি, বকুল আমায় পাগল করে দিয়েছে। আচ্ছা মা ওদের নামে যদি নালিশ করতে চাই! কোথাও পাবো সেই রাজাকে। মা তখন রজনীর কানটা চেপে ধরে বলতো– রাজপুত্র আসবে আমার রাজকন্যার জন্য! তাঁকেই না-হয় করে দিস নালিশ। সে ঠিক শিউলি, বকুলের বিচার করবে। আর মায়ের এমন কথা শুনে ওতোটুকু রজনী লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলতো। মা সেটা দেখে আরো একটু লজ্জা দিতে বলতো– রাজপুত্র যদি সেই শিউলি বকুলের মালা দিয়ে আমার মেয়ের সাথে মালাবদল করতে চায়! আমি কিন্তু কিছু মনে করবো না। আর এই কথাগুলো শুনে রজনী দৌড়ে ঘরে চলে আসতো। আজ সব অতীত। নিজের অতীতের কথা চিন্তা করতেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো রজনীর ঠোঁটে। আর সেই হাসি দেখেই কেউ পাগল হয়ে গেলো,তা হয়তো রজনী খেয়াল করলো না। খেয়াল হলো,যখন তাঁর পাশে কারো উপস্থিত টের পেলো। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই পল্লবকে চোখে পরলো। পল্লবকে দেখতেই রজনীর ভেতরে অস্বস্তি হচ্ছে। কালকে এতোগুলা মিথ্যা বলার পর যেন রজনীর দম বন্ধ হয়ে আসছিলো! তাঁকে আরো একটু কষ্ট বাড়াতেই হয়তো পল্লব হাত সরিয়ে নিয়েছিলো,যে হাত দিয়ে রজনীকে সে আগলে ধরেছিলো। রজনীর নিজের উপর তখন অনেক রাগ হচ্ছিলো। তাঁর জীবনটা কেন এমন হলো! বাকি পাঁচটা মেয়ের মতো কেন নয়? পরে অবশ্য পল্লব জানিয়েছে সে কেন তখন হাতটা সরিয়ে নিয়েছে। পল্লবের হাত সরিয়ে নেওয়ার কথা শোনার পর এখন যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। এতোগুলা মিথ্যা বলে লাভ হলো কী? যদি সত্যিটাই লুকিয়ে রাখতে না পারলো। এই একটা কথা ভাবলেই লজ্জাটা আরো দ্বিগুণ হচ্ছে। কিন্তু রজনীর এমন লজ্জা দূর করতেই খুব স্বাভাবিক ভাবে পল্লব বললো–

_ আজ আপনার হাতে ড্রেসিং করতে হবে! পুরোপুরি শীত আসার আগেই ক্ষতটা সেরে গেলে ভালো। তা নয়তো আপনাকে অনেক ভুগতে হবে। আর ঘাড়ের ক্ষতটা কি অবস্থা এখন।

এতটা স্বাভাবিক পল্লবকে দেখে রজনী অবাক হলো। অবশ্য অবাক হওয়ারি কথা। এতগুলো মিথ্যা বলার পর অন্য কেউ হলে! হয়তো বাড়ি থেকেই বের করে দিতো। আর তিনি কতটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে যেন কিছু হয়নি। রজনী নিজের ভেতরের অনুশোচনা দমিয়ে রাখতে পারলো না। তাই হুটকরে পল্লবের হাতটা ধরে বললো–

_ আসলে আমি মিথ্যা বলতে চাইনি,কিন্তু ভয় হয় যদি সবাই আবার আমাকে ধর্ষিতার অপবাদ দেয়। আমার খুব কষ্ট হয় তখন। মনে হয় মৃত্যুটা দূরে কেন কাছে আসুক। আমি জানি মৃত্যু কামনা করা ঠিক না। তবুও মানুষ তো, ভুল আমার হয়েই যায়। প্লিজ আমায় মাফ করবেন! আর এই কথাগুলো আন্টিকে বলবেন না।

রজনী কথাগুলো শেষ করে নিরবে চোখের জল বিসর্জন দিলো। আর তা সযত্নে মুছে দিয়ে পল্লব রজনীর ধরে রাখা হাতের উপর নিজের আরেকটা হাত দিয়ে চেপে ধরলো। আর বললো–

_ মা সবটা জানে,আপনার বাবা শুরুতেই সবটা জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি আমার সামনে সেটা প্রকাশ করতে চাননি। রাতে মায়ের সাথে কথা বলতেই তিনি বললেন,তিনি সবটা আগে থেকেই জানেন। তাই কোন ভয় নেই। আর এই কথা বলার মতো বাড়িতে কেউ নেই বা খোঁটা দেওয়ার মতো কাউকে দেখছি না। আজ অবশ্য বাবা আসবে,কিন্তু তিনি সাংসারিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমিও ঘামাই না, কিন্তু কীভাবে যেন আপনার বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে নিলাম। সে যাইহোক, চলুন ঘুরে আসি।

_ কোথায়

_ আমাদের এলাকায়, এসেছেন ধরে তো ঘরেই আছেন।

_ আমি কোথাও যাবো না।

_ আরে চলুন ভালো লাগবে। এখন মাত্র পৌঁনে ছয়টা বাজে! সাত টার মাঝেই চলে আসবো।

একপ্রকার টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলো রজনীকে। রজনীর কিছুই করার নেই এখানে। রজনী আর পল্লব পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। কিছু মর্নিং ওর্য়াকের মানুষ ছাড়া কাউকে তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। ছোট ছোট বাচ্চারা নিজেদের স্কুল গাড়ির কাছে জমা হচ্ছে। বিষয়টা খুব সুন্দর। একজন আরেকজনের জন্য কি নির্দ্বিধায় অপেক্ষা করছে। ছোটবেলার এই অপেক্ষাটা দীর্ঘ হলেও বড় হলে তা হারিয়ে যায় দূর অজানায়। সেও তো তাঁর বান্ধবীদের জন্য অপেক্ষা করতো। কখনো মিনিট কখনো ঘন্টা। তবুও সেই অপেক্ষার মাঝে শান্তি ছিলো। সেই শান্তির বিশ্লেষণ করা যাবে না।

_ পিঠা খাবেন রজনী, ভাপা বা চিতই।

হঠাৎ পল্লবের কথায় রজনীর চিন্তায় বাঁধা পড়লো।

_ জ্বি

_ পিঠা খাবেন

_ না

_ আরে খেয়ে দেখেন। আমাদের এই শহরের পিঠাগুলো অনেক বিখ্যাত।

_ না,আপনি খান আমি আছি।

_ আরে আপনিও খেয়ে দেখুন কেমন লাগে। চলুন, চলুন

তারপর ওরা দু’জন পিঠা ওয়ালা কাকির নিকটে দাঁড়ালো।

_ কাকি চিতই পিঠা দিন, সাথে মরিচ ভর্তা।

_ আচ্ছা

_ গরম গরম পিঠার সাথে মরিচ ভর্তা কি যে মজা রজনী আপনি জানেন না। আমি প্রায় এসব খেয়ে থাকি। আজ আপনিও ট্রাই করুন।

_ এই নাও বাবা

ধোঁয়া উঠা গরম গরম পিঠা তুলে দিলো পল্লবের হাতে। পল্লব হাতে নিয়ে একটা পিঠা রজনীর দিকে এগিয়ে দিলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতে পিঠা তুলে নিলো রজনী। কাগজে রাখা মরিচের ভর্তা মাখিয়ে দু’জনেই মুখে পুরলো। বাহ মজাই তো? হাতের পিঠা শেষ হতেই রজনী পল্লবের দিকে তাকালো। পল্লবের দিকে চোখ পড়তেই রজনী চোখ বড়বড় করে তাকালো। কারণ পল্লবের চোখে পানি টলটল করছে! নাকের সাথে ঠোঁট প্রচুর লাল। তারমানে পল্লবের ঝাল লেগেছে। রজনী পল্লবের হাত থেকে মরিচের কাগজ ফেলে দিয়ে বললো–

_ আপনার ঝাল লেগেছে, তাহলে আপনি খাচ্ছেন কেন?

রজনীর কথায় চোখ তুলে তাকালো পল্লব। আর তখনই টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। তা দেখে রজনী খুব অবাক হলো। এইমাত্র না মানুষটা বললো! সে প্রায় এসব খায় তাহলে? হঠাৎ মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ জানান দিলো পল্লব রজনীর মন ভালো করতেই এই মিথ্যাটা বলেছে। নিজের কষ্ট হবে জেনেও মানুষটা তাঁর মন খারাপ দূর করতে এসব করলো।আসলেই রজনী খুব বোকা। পাশে দাঁড়িয়ে থেকেও বুঝতে পারলো না মানুষটার কষ্ট হচ্ছে। রজনী জলদি একটা ভাপাপিঠা চাইলো কাকির কাছে, সাথে একটা পানির বোতল। হাতে নিয়ে সেগুলো পল্লবের দিকে এগিয়ে দিলো।

_ এক কামড় পিঠা আর এক ঢোক পানি পান করুন ঝাল কমে যাবে।

এতো কষ্টের মাঝেও পল্লব হেঁসে দিলো রজনীর এই অস্থিরতা দেখে। সে আসলেও ভাবতে পারেনি এতো ঝাল হবে ঝাল ভর্তটা। আবার পরক্ষণেই ভাবলো! ঝাল ভর্তা ঝাল তো হবেই। অবশেষে রজনীর কথামতো পিঠা আর পানি খেতেই কিছুটা ঝাল কমলো। পিঠা ওয়ালা কাকিকে টাকা পরিশোধ করে তাঁরা বাড়ির দিকে রওনা হলো। আসার পথে কিছু কড়া কথা শুনাতেও ছাড়লো না রজনী পল্লবকে। আর রজনীর সেই কড়া কথা গুলোর মাঝে আনন্দ খুঁজে নিলো পল্লব। তাহলে এভাবেই কি শুরু তাঁদের নতুন জীবনের সূচনা।

চলবে,,,