#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২৮
স্টেশনে এসেই অবাক হয়েছিলো সৌমিক, রবির সঙ্গে মিতা দাঁড়িয়ে আছে! মুহূর্তে সৌমিকের মুখে অস্বস্তির ছাপ পড়েছিলো, একে ও অফিসের কাজের নাম করে এসেছে মাকে মিথ্যে বলে, সেখানে পরে যদি মা মিতার সঙ্গে থাকার কথা জানতে পারে তাহলে খুব বিরক্ত হবে। কোনো বিতর্ক যাতে তৈরি নাহয় ও সেই জন্যে অপর্ণাকেও সঙ্গে আনেনি, অথচ রবি ওকে না বলেই মিতাকে নিয়ে চলে এলো! সৌমিক এর মুখের অস্বস্তি লক্ষ্য করে রবি কিছু বলার আগেই মিতা নিজেই হাত তুলেছিলো,
রবির কোনো দোষ নেই কিন্তু, আমি নিজেই জোর করে এসেছি, বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছিলো না আর।
সৌমিক আর কথা বাড়ানোর চেষ্টা করেনি, শুধু রবি কে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করেছিলো মিতা ওদের আসার কারণ কিছু জানে কিনা। রবি জানিয়েছিল মিতা জানে রবি তার তদন্তের কাজে এসেছে, কিন্তু এর সঙ্গে অপর্ণার সম্পর্কের কথা জানে না। সৌমিক কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়েছিলো, কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রেন এসে গিয়েছিলো। ট্রেনে উঠে মুখোমুখি সিটে বসে ছিলো রবি আর মিতা, ইচ্ছে করেই রবির পাশে একটু দুরত্ব রেখেই বসে ছিলো সৌমিক।
ফাঁকা ট্রেন, মুখ নিচু করে মোবাইল দেখতে দেখতে রবি আর মিতার টুকরো টুকরো কথা সৌমিকের কানে আসছিলো, মিতা বলছিলো ও দিল্লির চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরছে, কারণ মা কলকাতায় বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছে না। রবি হাসছিলো, একটু বিদ্রুপের গলায় বলছিলো,
যাক! সুবুদ্ধি হলো তাহলে! বেটার লেট দ্যেন নেভার! তুই দিল্লি যাস এটাই তো কখনো আমার পছন্দ ছিলো না!
মিতা শক্ত মুখে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিলো, তার মুখের পরিবর্তন রবি এবং সৌমিক দুজনেরই নজরে পড়েছিলো, রবি নিজেকে সামলে নিয়ে নরম গলায় বলেছিলো,
নিজের বাড়ি থাকতে কেউ দিল্লিতে অহেতুক পড়ে থাকে! ভালো করেছিস এটা, এবার সেটেল কর নিজের মতো।
মিতা হটাৎ করেই একটু বেশি উচ্ছাস দেখিয়ে রবিকে নিজের মোবাইলের গ্যালারি থেকে কয়েকটা ছবি দেখিয়েছিলো, অনেকটা সৌমিক কে শুনিয়েই বলেছিলো,
এই ছবিগুলো দেখ! কেমন বল? ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট থেকে মা চুজ করেছে, সবই মোটামুটি দিল্লির ছেলে, ওখানেই থাকবো ভেবেছিলাম তাই! কিন্তু এখন কি হয় দেখি! হটাৎ করে চলে আসতে হলো, এখন তো মা যেতে চাইছে না! সবটা বেশ গোলমাল হয়ে গেলো বুঝলি!
সৌমিক বুঝেছিলো ওকে শুনিয়েই বলছে মিতা, তাই মোবাইল থেকে মুখ তুলে তাকায় নি, একবারও, বরং রবি হাত বাড়িয়ে মোবাইল টা নিয়েছিলো, ভালো করে দেখে বলেছিলো,
প্রোফাইল তো ভালো সবারই, তবে খবর নিয়ে এগোস!
মিতা হেসেছিলো,
তোকেই অ্যাড্রেস দেবো তো ফাইনাল করে, খবর তুই আনবি!
মোটামুটি দশটার মধ্যেই পৌঁছে গেলো রবি আর সৌমিক, মেদনীপুরের গরমে দশটায় বেলা বারোটার মতো লাগছে চারপাশ। স্টেশনের পাশেই একটা দোকানে বসে জলখাবারের পর্ব সমাধা করে দুটো রিক্সা নিয়ে তিনজনে বেরিয়ে পড়লো বাস স্ট্যান্ড এর দিকে। সমরের বাড়ি শহর থেকে অনেকটাই দূরে, নামে মেদনীপুর হলেও দুরত্ব প্রায় ঘণ্টাখানেকরও বেশি। ঠিকানা দেখে নির্দিষ্ট স্টপেজে নামিয়ে দিয়ে বাস বেরিয়ে যাওয়ার পরে সৌমিকের ইশারায় রবি মিতা কে থামালো,
তুই একটু আশেপাশে ঘুরে দেখ নিজের মতো, তোকে সঙ্গে নিয়ে গেলে আমার কাজের অসুবিধা হবে, আমরা আধ ঘন্টার মধ্যেই চলে আসবো।
রবির কাজে তুই কি করবি? তুই থাকবি তো?
সৌমিক কে জিজ্ঞেস করলো মিতা, রবি তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বললো
ও চলুক আমার সঙ্গে!
মিতা আর কথা না বাড়িয়ে ফোন কানে সরে গেলো, সৌমিক আর রবি হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে। পিচের রাস্তা জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে, চারিদিকে লাল ধুলোর আস্তরণ, সেই আস্তরণে আশে পাশের বাড়ি থেকে গাছ পালা সবই লাল হয়ে রয়েছে।
একটা মোড় ঘুরে গিয়েই একটা টিউবওয়েল, সেটাকে ঘিরে মহিলাদের ভীড়, কলসি কাঁখে এক মহিলাকে সামনে দেখে রবি এগিয়ে গেলো,
আমরা সমর চৌধুরীর বাড়ি খুঁজছি, বলতে পারবেন কোথায়?
দুজন অপরিচিত পুরুষ দেখে মহিলা নেমে যাওয়া ঘোমটা কে নতুন করে মাথায় তুলতে তুলতে থমকে দাঁড়ালেন,
সমর! জানিনি!
সৌমিক রবির হাতে চাপ দিলো,
এগিয়ে চল, এখানে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই!
দুজনে এগিয়ে যেতে শুরু করার আগেই মহিলাদের ভীড় থেকে বেশ খানিকটা দূরে গামছা পড়ে উবু হয়ে বসে বিড়ি ফুঁকতে থাকা একটা মাঝ বয়সী লোক উঠে দাঁড়ালো, বিড়িটা শেষ সুখটান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দুই হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাসলো,
চৌধুরীদের ভিটা খুঁজতে এয়েছেন, লয়? উয়ারা তো কবে সব মরে হেজে গেছে! সমর বাড়ি বেচে দিয়ে কলকাতা পালিয়েছে কবে, ও বাড়ি এখন সুদণদার ভায়রার।
রবি বিনীত হাসি হাসলো,
খুব উপকার করলেন, তবে এদ্দুর যখন কষ্ট করে এলাম তখন দেখি ওনার কলকাতার ঠিকানাটা একটু পাই নাকি!
লোকটার দেখিয়ে দেওয়া নির্দেশ মতো দু একবার পাক খেয়ে শেষে চৌধুরী বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলো রবি আর সৌমিক, অন্যান্য আশে পাশের বাড়ির তুলনায় বাড়িটা বেশ বড়সড়, দোতলার দুটো ঘরও নিচ থেকেই দেখা যাচ্ছে। একপাশে রাখা বড়ো বড়ো ধানের বস্তার ফাঁক দিয়ে বাড়ির ভেতরটা অনেকটাই দৃশ্যমান, তবে সাদা রঙের বাড়িটা অন্য সব বাড়ির মতোই রাস্তার ধুলোতে লাল হয়ে রয়েছে। রবি মুচকি হাসলো,
বেশ বড়লোক ছিলো কিন্তু তোর কম্পিটিটর, বউকে একবার সময় করে দেখিয়ে নিয়ে যাস তার হলেও হতে পারতো শ্বশুরবাড়ি!
সৌমিক হিসেব কষে বললো,
ধুস! জায়গাটা ভাব! খুব বেশি দাম পায়নি কিন্তু বাড়ির! তবে একটা খটকা লাগছে জানিস, ও যে বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছিলো এটা সম্ভবত অপর্ণা জানে না।
রবি মাথা নাড়লো,
হুঁ, সেটা বোঝাই যাচ্ছে! খুব সুবিধার ছেলে ছিলো না কিন্তু! তোকে বলা হয়নি রসূল পুরের ওসি বলছিলো ওর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে চাকরি করে দেবার নামে টাকা নেওয়ার অভিযোগ জমা পড়েছে।
সৌমিক চমকে উঠে তাকালো,
তাই নাকি! তো কি হলো সেগুলোর?
রবি হাসলো,
কি আর হবে, ব্যাটা তো মরেই গেছে! যাকগে এগুলো এক্ষুনি অপর্ণাকে বলিস না, ওর খারাপ লাগবে!
ওদের কথোপকথনের মধ্যেই একজন সাইকেল নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো, তাকে দেখেই রবি এগিয়ে গেলো,
আমরা কলকাতা থেকে আসছি, কয়েকটা কথা জানতে চাইছিলাম, এটা সমর চৌধুরীর বাড়ি তো?
লোকটা আপদ মস্তক জরিপ করলো ওদের, তারপরে গলায় বিরক্তি এনে বললো,
হ্যাঁ, কিন্তু আমরা তো অনেকদিন আগেই কিনে নিয়েছি! জানিনা বারবার ওনার সম্বন্ধে খোঁজ নিতে লোক আসছে কেনো!
লোকটার গলায় কোনো টান নেই, বোঝাই যাচ্ছিলো এখানকার মানুষ নন, তাও রবি জিজ্ঞেস করলো,
আপনারা বাইরে থেকে এসেছেন তো? কতদিন হলো কিনেছেন এটা?
লোকটা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো,
হ্যাঁ বর্ধমানে থাকতাম আগে, আমার ভায়রা ভাই বলেছিলেন এটা বিক্রি আছে, তখন কিনেছি। ওর বাড়ি এখানেই, জন্ম, কর্ম সবই এখানে।
রবি সামনে এগিয়ে এলো,
বারবার ওনার সম্বন্ধে খোঁজ নিতে লোক আসছে বলছিলেন, আমাদের আগেও কেউ এসেছিলো নাকি?
লোকটা এবার বিরক্ত হলো সত্যিই,
আপনারা কে বলুন তো, এতো কথা জানতে চাইছেন?
রবি পকেট থেকে নিজের পরিচয় পত্র বার করে এগিয়ে দিলো,
কলকাতা পুলিশ।
মুহূর্তে লোকটার শরীরী ভাষা বদলে গেলো, সে দু হাত জোড় করে রবির সামনে এগিয়ে এলো,
ঘরে এসে বসুন না স্যার, পুলিশ কেনো স্যার, আমি তো কিছু অন্যায় করিনি! রীতিমত টাকা দিয়ে কিনেছি স্যার, রেজিষ্ট্রি করে নিয়েছি। আমি তো ওনার স্ত্রী কে সমর বাবুর নতুন অ্যাড্রেস দিয়েছিলাম, আপনি চাইলে নিয়ে যান!
স্ত্রী! মনে মনে চমকে উঠে চোখাচোখি করলো সৌমিক আর রবি। রবি নিজেকে সামলে নিলো,
নাহ! আর ভেতরে বসবো না, কয়েকটা কথা জেনেই চলে যাবো। এই বাড়িটা তাহলে আপনারা সমর চৌধুরীর কাছ থেকেই কিনে ছিলেন ?
হ্যাঁ, স্যার!
টাকা কিভাবে দিয়েছিলেন?
ড্রাফট করে স্যার!
ওনার নতুন ঠিকানা আপনাকে কে দিয়েছিলো?
উনি নিজেই স্যার! বলেছিলেন এখানে আর কিছু রাখবেন না, কলকাতায় আপাতত ভাড়া থাকবেন, ওনার ব্যবসার পার্টনার এর সঙ্গে এই টাকাগুলো ইনভেস্ট করবেন, তারপরে ব্যবসা জমলে আবার নতুন করে কলকাতায় সেটেল করবেন!
কলকাতায় কোথায় ব্যবসা, কোথায় ভাড়া থাকবেন, কি ব্যবসা করবেন বলেছিলেন কিছু?
নাহ! সেসব কথা কিছু হয়নি! বলেছিলেন ওনার পার্টনার যেখানে থাকে উনি সেখানের কাছাকাছি কোথাও থাকবেন!
ওনার পার্টনার এর নাম জানেন?
না, বলেন নি! আমি তো অতোটা চিনতাম না ঠিক, ওই বাড়ি কিনতে গিয়েই আলাপ, তাই অতো কথা বলার মতো সম্পর্ক ছিলো না!
কিসের ব্যবসা ছিলো ওনার?
ট্রাভেল এজেন্সি তে কাজ করতেন আগে, নিজের ব্যবসা খুলবেন বলেছিলেন আমাকে! তবে কিসের ব্যবসা সেটা জিজ্ঞেস করিনি।
সমর বাবু কে কিভাবে চিনতেন? বাড়ির খবর কে দিয়েছিলো?
আমার ভায়রা ভাই! ও এখানে থাকে, ওর সোর্স এই পেয়েছিলাম!
শেষ কবে দেখেছিলেন?
প্রায় বছর তিন চার আগে! বাড়ি কেনার সময়!
কোন ট্রাভেল এজেন্সি তে চাকরি করতেন জানেন?
না, তবে কলকাতাতেই ছিলো সেটা!
ওনার স্ত্রীর ঠিকানা জানেন? উনি তো স্বামীর খোঁজে এসেছিলেন বললেন?
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন,
না স্যার! ভাবিনি এরকম কিছু হবে, তাই ঠিকানা তো জানতে চাইনি তখন!
দুজনে একটু হতাশ হয়েই ফেরার রাস্তায় হাঁটছিলো, রবিই প্রথম কথা বললো,
লোকটার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তো সমর ব্যবসা করবে বলে বাড়ি বিক্রি করেই দিয়েছিলো অনেক আগেই, তাহলে অপর্ণা কে এই পুরনো অ্যাড্রেসটা দিলো কেনো? রেজিষ্ট্রির আগে যদি দিয়ে থাকে তাহলে তো মাত্র বছর খানেকের ব্যাপার, কিন্তু বাড়ি তো বিক্রি হয়েছে প্রায় তিন চার বছর আগে! কেস টা কি বলতো! নাহ! ব্যাপারটা অতো টা সহজ নয় বুঝলি, কিছু গন্ডগোল তো আছে এই সমরের! আর এই বউটাই বা কোথা থেকে এলো! অপর্ণা কে এক্ষুনি কিছু বলিস না, আগে আর একটু শিওর হতে দে!
অপর্ণা কিন্তু আগে এই পার্টনারের ব্যাপারটা জানতো না বুঝলি, সেটা আগের বার গিয়ে ওই একজন দোকানির কাছে শুনেছে! ওকে সমর কিছু বলেনি!
সৌমিক এর কথায় রবি চিন্তিত হলো,
ওই যে দোকানি তার ফোন নম্বরটা পাওয়া যাবে?
সৌমিক পকেট থেকে মোবাইল বার করতে করতে বললো,
হ্যাঁ কেনো যাবে না? দাঁড়া অপর্ণার কাছ থেকে জেনে দিচ্ছি তোকে! এমনিতেও ওকে পৌঁছে ফোন করা হয়নি একবারও, বেচারা খুব টেনশনে আছে।
সৌমিক ফোন করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অপর্ণা ফোন ধরলো, সৌমিকের প্রশ্নের উত্তরে জানালো, সে একটু ব্যস্ত আছে এখন, পরে ফোন নম্বর দেবে। সৌমিক বিরক্ত হলো,
অদ্ভুত তো তুমি! তোমার কাজের জন্যেই তো ছুটে এলাম, এটা জরুরি, আগে দাও আমাকে।
অপর্ণা নিচু স্বরে, অস্বস্তির গলায় বললো,
ওসব থাক এখন! মা পড়ে গেছেন রান্নাঘরে, পায়ে প্লাস্টার করিয়ে হসপিটাল থেকে ফিরছি এখন, পরে কথা বলবো। তোমার অফিসের কাজ মিটে গেলে তাড়াতাড়ি চলে এসো।
সৌমিক চমকে উঠলো, মা পড়ে গেছে, অপর্ণার সামনেই তো বসে আছে তাহলে, তাই অপর্ণা ওভাবে কথা বলছে! ও আবার তাড়াতাড়ি ফোন করলো, মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ায় রীনা বললেন না, গম্ভীর গলায় অপর্ণা কে জানালেন ছেলে ফিরে এলে তিনি সামনে বসে কথা বলবেন। এই ঘটনার পরে আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লো ওরা, পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেলো বাড়িতে। রবি গলির মুখে নিজের বাড়ি নেমে যাওয়ার আগে বললো,
তোরা দুজনে চলে যা তাহলে!
সৌমিক ঘাড় নাড়লো,
না, আমিও এখানেই নামবো!
মিতা বিদ্রুপের হাসি হাসলো, রবির দিকে তাকিয়ে বললো,
ওর ক্ষমতা আছে নাকি আমার সঙ্গে বাড়ির সামনে নামার! এক্ষুনি ওর মা ওকে ঘর থেকে বার করে দেবে!
মায়ের পায়ের খবর শোনা ইস্তক সৌমিকের দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো, মিতার কথায় মাথাটা হটাৎ করেই গরম হয়ে গেলো, একটু কড়া করেই বললো,
সেটা যখন জানিস তাহলে আর নতুন করে বলে কি করবি? যখন তোর সত্যি প্রয়োজন ছিলো তখন তোর সঙ্গেই বাড়ির সামনে নেমে ছিলাম, কিন্তু এখন তো সত্যিই তোর সঙ্গে বেড়িয়ে নামছি দেখলে মায়ের রাগ হবেই।
সৌমিক বাড়িতে ফিরে দেখলো চারদিকে একটা থমথমে পরিবেশ, রীনা নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন, এমনকি দুপুরের খাবারও খাননি।
রত্না এদিকে তার নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলেছে, দুটো সুটকেস বসার ঘরের দরজার পাশে দাঁড় করানো, ভাই কে ঢুকতে দেখেই রত্না সামনে এগিয়ে এলো, চোখের জল মুছতে মুছতে বললো,
ভাই আমি চলে যাচ্ছি, তোদের আর ঝামেলা বাড়াবো না! মা চায় না আমি এখানে থাকি আর!
সৌমিক কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না, সে সোফায় বসে জুতো খুলতে খুলতে অবাক হয়ে উল্টোদিকের সোফায় বসে থাকা বাবার দিকে তাকালো,
কি হয়েছে দিদির, কোথায় যাচ্ছে ও? মা কোথায়?
আশুতোষ কাগজ সরিয়ে রেখে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন,
তোমার মাকেই জিজ্ঞেস করো!
বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করলেও রীনা দরজা খুললেন না, রত্নাকে জিজ্ঞেস করে সেরকম কোনো সদুত্তর না পেয়ে শেষে সৌমিক ওপরে উঠে এলো, অপর্ণা নিজের ঘরে করুন মুখে বসে ছিলো, সৌমিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
মার কি হয়েছে কে জানে! কদিন ধরে তো আমাদের ওপরে রেগে ছিলেন, আজ দেখছি দিদির ওপরেও রেগে আছেন। দিদি আমাদের সঙ্গে হাসপাতালে যেতে চেয়েছিলো তাই কতো কথা শোনালেন, বললেন রজত দার যত্ন ওকে করতে। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর তো দেখছি দরজা বন্ধ করে রেখেছেন, কথাও বলছেন না, খানও নি দুপুরে!
সারাদিন পরে বাড়ি ফিরে সৌমিকের বিরক্ত লাগছিলো, মা বরাবরের জেদী ও জানে, কিন্তু রজতদা আছে বাড়িতে, নিজে অসুস্থ হয়েছেন তার পরে এসবের কোনো মানে হয় না! একটু পরে মিনতির দিয়ে যাওয়া চা খেয়ে সৌমিক উঠে দাঁড়ালো, নিচে গিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রত্নাকে শান্ত করার পরে মায়ের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো। ছেলের কড়া গলার আওয়াজ শুনে রীনা অবশেষে দরজা খুলে দিলেন, সৌমিক ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বললো,
কি করছো এসব? রজত দা বাড়িতে আছে ভুলে গেছো নাকি? তুমিই তো ডেকে নিয়ে এসেছিলে তখন, এখন এরকম করছ কেনো?
রীনা উঠে বসলেন,
যা করি সবার ভালোর জন্যেই করি! কিন্তু তোমরা সেটা বুঝলে তো? বাড়িতে অল্প বয়সী মহিলার ভরসায় স্বামী কে রেখে উনি মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে ছুটছেন! যেদিন কিছু ঘটবে সেদিন আফসোস করবে!
সৌমিক অবাক হয়ে গেলো,
দীপা দি কে সন্দেহ করছো তুমি, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি! আমি উল্টে কতো কি ভাবছি! এসব কি মা, এই জন্যেই কি তুমি কাউকে রাখতে চাইছিলে না বাড়িতে?
রীনা গম্ভীর মুখে তাকালেন,
তুমি কি ভাবছো? ভাবছো মা জেনে গেলো নাকি যে তুমি তোমার বউকে মিতার বাবার শ্রাদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছো?
সৌমিক এর মুখ পাংশু হয়ে গেলো, মায়ের খবর দেওয়ার লোকের অভাব নেই, কেউ ওকে গলির মুখে আজ গাড়ি থেকে নামতে দেখলো না তো! মা সোজাসুজি তাকিয়ে রয়েছে, সৌমিক গলা নিচু করলো,
কি করি বলো, মিতার মা জোর করছিলো, তাও তোমাকে বলেছিলাম বলেই আমি যাইনি!
রীনার মুখে বিরক্তির ছাপ পড়লো,
নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, আমার দুঃখ কোথায় জানো, আমার ছেলে মেয়েরা কেউ সেটা বোঝে না! যাও, সারাদিন পরে বাড়িতে ফিরেছ, ওপরে গিয়ে রেস্ট মাও!
সৌমিক উঠে পড়লো, বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
অহেতুক সন্দেহ গুলো বন্ধ করো, আমরা সবাই যথেষ্ট বড়ো হয়েছি মা, নিজের ভালো মন্দ বুঝি! দিদির খারাপ লেগেছে, ওর সঙ্গে কথা বলে নাও!
ছেলের বেরিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে রীনা নিজেকে সংযত করলেন, তাঁর আসল রাগের কারণ তো অন্য! কিন্তু অপর্ণার ব্যাপারে ঋজু কে কিছু বলা যাবে না কিছুতেই। বিয়ে হয়ে গেলেও ওই ছেলেটি যখন মারা গিয়েছে তখন হিসেব মতো এই বিয়েটা বৈধই। তাই এখন এটা জানাজানি হলে যদি ছেলে বউয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরে তাহলে সেই ফাঁক দিয়ে মিতার ঢুকতে একটুও অসুবিধা হবে না। সেই ভয়ঙ্কর অশান্তি এড়াতে এই অশান্তি নিজের মনের মধ্যেই চেপে রাখার চেষ্টা করতে লাগলেন রীনা।
ক্রমশ
#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২৯
গত কয়েকদিন ধরেই শাশুড়ি তার সঙ্গে খুব বেশি কথাবার্তা বলছেন না, কারণ টা অবশ্য সেদিন রাতেই সৌমিকের কাছ থেকে জেনে গিয়েছে অপর্ণা। সৌমিক ঘরে ঢুকেই বলেছিলো মিতার বাড়ি যাবার খবর শাশুড়ির কানে পৌঁছে গিয়েছে। একটু বিরক্তি নিয়েই সৌমিক খাটে শুয়ে পড়েছি লো,
মা সব ব্যাপারে বড্ড সন্দেহ বাতিক হয়ে যাচ্ছে, এখন বুঝতে পারছি কেনো মা তখন লোক রাখতে চাইছিলো না। দিদি দীপা দি কে বাড়িতে রেখে যেতে চাইছিলো তাই দিদির ওপরে বিরক্ত হয়েছে।
অপর্ণার এসব কথা শুনতে ইচ্ছে করছিলো না, সে ওখানে কি হলো জানার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ছিলো। সৌমিক কে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলো
ছাড়ো ওসব! মায়ের সব কিছুতেই আপত্তি! একটা ভদ্র ঘরের মেয়ে, সে নিডি বলেই কি তার অন্য কোনো খারাপ মানসিকতা থাকবে? আর এই কথাটা বলে যে মা রজত দাকেও অনেক ছোটো করে ফেললেন এটাও উনি বুঝলেন না! আমার এসব কথা আলোচনা করতেও ইছে করছে না, তুমি ওখানের কথা বলো। কি হলো ওখানে? সারাদিনে একটা ফোন পর্যন্ত করতে পারোনি একবারও!
আচমকা অপর্ণা প্রসঙ্গ বদলাতে চাওয়ায় সৌমিক একটু বিপদে পড়েছিল, এই মুহূর্তে কোনো কিছু কনফার্ম না হয়ে অপর্ণাকে সমরের বিয়ের কথা বলা যাবে না। ও সমর কে এতটাই বিশ্বাস করে যে এটা ওর কাছে বিরাট ধাক্কা হবে। একটু চুপ করে থেকে সৌমিক বিরক্তির ভান করেছিলো,
ওখানে আবার কি হবে! কিছুই হলো না! বাড়িতে কেউ নেই!
অপর্ণা একটু মুষড়েই পড়েছিলো,
হুঁ! আমিও তো সেরকমই ভেবেছিলাম, ওর তো কেউ ছিলো না! বাড়িতে কেই বা থাকবে! আচ্ছা তুমি রবীন কাকুর নম্বর জানতে চাইছিলে কেনো?
সৌমিক আবার হাতে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলো,
ওই এমনই! দিও নম্বরটা একবার, যদি কিছু এগোয় তাহলে জানাবো!
অপর্ণা খাটের পাশে এসে বসে সৌমিকের কপালে হাত রেখে জানতে চেয়েছিলো,
খুব টায়ার্ড হয়ে গেছো তাই না? মিছিমিছি গেলে, আমি বলেছিলাম কিছু হবে না! তোমাকে বলা হয়নি, আজকেই রবীন কাকুর সঙ্গে হাসপাতালে দেখা হলো, ওনার বাবা ওখানে ভর্তি আছেন। আগে জানলে সরাসরি কথা বলিয়ে দিতাম। তুমি এমন সময়ে ফোন করলে তখন মা সামনে! সারাদিনে একবারও ফোন করোনি কিন্তু, আমি খুব চিন্তা করছিলাম!
সৌমিক হেসে ফেলেছিলো,
চিন্তার কি আছে, আমি কি বাচ্চা নাকি!
তাও একবারও কি ফোন করা যেতো না, তুমি তো আর সত্যি সত্যি অফিসের কাজে যাওনি!
একটু অভিমানের গলায় বলেছিলো অপর্ণা, সৌমিক হাসছিলো,
সব সময় ফোন করা যায় নাকি, গেছি তো তোমারই দরকারে! ওখানের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হলো! আর কোনো খবর থাকলে তো জানাবো!
অপর্ণা একটু লজ্জিত হয়েছিলো,
সেটা ঠিক! তবে সারাদিন একা ছিলাম তো তাই খুব মন খারাপ লাগছিলো। তখন মনে হচ্ছিলো একটু ফোন করলে ভালো লাগতো, তুমিও তো একরকম বেড়াতেই গিয়েছিলে!
অপর্ণা র এই কথায় সৌমিকের মনে পড়েছিলো মিতার কথা। সত্যি মিতার সঙ্গে থাকার জন্যে এটা অনেকটা বেড়ানোর মতোই হয়ে গিয়েছে। স্টেশনে গিয়ে যে মিতার সঙ্গে দেখা হয়েছে এটা জানার পরে অপর্ণা চিন্তিত হয়েছিলো, যদি শাশুড়ি জানতে পারেন যে মিতা সঙ্গে গিয়েছিলো তাহলে আরেক সমস্যা হবে। সৌমিক কে সেই কথা বলতেই সৌমিক হেসে বলেছিল অনেকটা মায়ের ভয়েই সে বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামেনি।
বরাবরের স্পষ্ট বাদী অপর্ণার এসব রাখঢাক পছন্দ ছিলো না, সে বিরক্ত হয়েছিলো,
বিয়ের পরে তো সব সময় বলতে তুমি কাউকে কৈফিয়ত দাও না, তাহলে এখন সারাক্ষন কেনো মাকে কৈফিয়ত দিতে হবে বলে ভয় পাও? ইদানিং দেখি তুমি লুকিয়ে রাখতে চাও অনেক কিছু! মিতাদির সঙ্গে যদি বাড়ির সামনে নামতেই তাহলে কি এমন হতো? আমার না এই জিনিসগুলো একটুও পছন্দ নয়। ওই অনুষ্ঠানে লুকিয়ে গেলাম বলেই তো এখন মায়ের রাগ সামলাতে হচ্ছে, মাঝখান থেকে তোমার জন্যে আমাকেও ঝামেলায় পড়তে হলো। আমার যেটা প্রয়োজন মনে হবে নিশ্চয়ই করবো, কিন্তু লুকিয়ে করে সমস্যা বাড়িয়ে তুলবো না!
সৌমিক চুপ করে ছিলো, সত্যি এই জিনিসটা করাতে সেও মন থেকে সায় পায়না একদম। কিন্তু মা এতো রিয়েক্ট করে এই সব নিয়ে যে ওর আর তর্ক করতে ভালো লাগে না। তার থেকে ও এইসব নিয়ে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করা বন্ধই করে দিয়েছি, যখন জানতে পারবে জানুক। কারণ জানতে পারলেই মা অশান্তি করবেই, অথচ একদম পাশাপাশি থেকে এমন অনেক কিছু করতে হয় যেগুলো ইচ্ছে না থাকলেও কোনো উপায় থাকে না। আজ যদি ও মিতাকে স্টেশনে দেখে ফিরে আসতো তাহলে সেটা ভীষণ অসভ্যতা হতো, কিন্তু মা কে বললেও মা সেটা বুঝবে না, তার থেকে এই ভালো।
সেদিনের পর থেকে রীনা প্রয়োজন ছাড়া অপর্ণার সঙ্গে একটাও কথা বলেছেন না, অপর্ণার মনে মনেই খুব দুঃখ হচ্ছিলো। একটা সামান্য মিতার বাড়িতে যাওয়ার জন্যে এতো রাগ! এই যে ও এতো কিছু এক সাথে সামলাচ্ছে, দায়িত্ব নিয়ে সব করছে এগুলোর কি কোনো মূল্য নেই। একটা সামান্য ভুল নিয়ে উনি এতদিন ধরে কথা বন্ধ রেখে দিয়েছেন! এমনকি যে ক্লাস ও কিছুতেই কামাই করতে চায় না, বাড়ির সব কিছু সামলাতে গিয়ে ইদানিং প্রায় তার দু একটা করে প্রতিদিনই মিস হয়ে যাচ্ছে! তাও ও চেষ্টা করছে, কিন্তু কতদিন! এক তরফা ভালো থাকার চেষ্টা কতদিন করা যায় আর। সৌমিক কে বলেছেও কয়েকবার, সৌমিক পাত্তা দেয়নি, তাচ্ছিল্যের গলায় বলেছে,
যদি কথা না বলে তবে ছেড়ে দাও! তুমি কি করবে আর? নিজের যেটা করার সেটা তো করছোই। তার পরেও যদি মায়ের রাগ না কমে তাহলে আর কি করতে পারো তুমি!
সেই থেকেই নিজেকে মোটামুটি গুটিয়ে নিয়েছে অপর্ণা, যা হয় হোক ও নিজে থেকে আর বেশি চেষ্টা করবে না! আজ ঘুম থেকে উঠেই অপর্ণা ঠিক করেছিলো ও ক্লাসে যাবে না, আজ মাত্র দুটো ক্লাস তার জন্যে অহেতুক অতদুরে যেতে ইচ্ছে করেনা। কদিন ধরে সকালে একটু চাপও হচ্ছে, ঋষি ফিরে এসেছে অনিন্দিতা কে রেখে, রীনা বিছানায় পায়ে প্লাস্টার নিয়ে বসে আছেন তাই দীপাকে সঙ্গে নিয়ে অপর্নাই দুবেলার রান্না সামলাচ্ছে। সেই জন্যেই ও সৌমিকের সঙ্গে আসতে যেতেও পারছে না কদিন ধরে, পরে একাই অটো নিয়ে যাতায়াত করছে। সৌমিক, ঋষি দুজনেই বেরিয়ে যাওয়ার পরে অপর্ণা শাশুড়ির খাবার দিতে ঘরে ঢুকলো, রীনা খাটে পা মেলে বসে ছিলেন, অপর্ণা কে থালা রাখতে দেখে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলেন।
এতদিন ধরে মুখ বন্ধ রাখলেও আজ অপর্ণার খুব অপমানিত লাগছিলো, এতো কিছু ও একা হাতে সামলাচ্ছে তার পরেও ওনার রাগ একটুও কমছে না! উনি সরাসরি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন! দোষ তো সৌমিকের অথচ নিজের ছেলে বলে উনি তাকে মাফ করে দিলেন, কথাও বলছেন আবার। ওর বেলাতেই যতো রাগ! স্পষ্ট বাদী অপর্ণার পক্ষে এটা সহ্য করা বেশ কষ্টের, গত দিন তিনেক ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে দেখতে আজ ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললো অপর্ণা, শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে ক্ষোভের গলায় বললো,
যার ওপরে রাগ দেখানোর কথা তার ওপরে তো দেখাচ্ছেন না, যতো দোষ আমার হলো? ওরকম রাগ দেখিয়ে লাভ কি যদি শেষে তারই সাহায্য নিতে হয়? হসপিটালে নিয়ে যাওয়া থেকে মুখের সামনে খাবার এনে ধরা সবই আমি করছি, তখন তো সেটাতে আপত্তি করছেন না, শুধু কথা না বলে রাগ দেখাচ্ছেন কেনো? বলুন যে আমার কোনো সাহায্য নেবেন না, তাহলে তো বুঝবো আপনার রাগের দাম আছে!
রীনা মুখ ফিরিয়ে তাকালেন,
দেখাতে তো ইচ্ছে করছে, মনে হচ্ছে সত্যি তোমার সাহায্য একবারের জন্যেও না নিই, কিন্তু কি করবো বলো, আমার কপাল তো সব সময় পোড়া! তাই শেষ পর্যন্ত এটাও মেনে নিতেই হচ্ছে! সারাজীবন কতো মুখ তো বন্ধ রাখলাম, কতো জনের কতো গুণ তো চেপে রাখলাম, এটাও নাহয় চেপেই থাকবো! তোমার সাহায্য নেবো না, এটা তো লোকজনকে বলতে পারবো না!
অপর্ণা অবাক হয়ে গেলো, খাটের সামনে এগিয়ে এসে বললো,
কার, কি গুণ চেপে রাখার কথা বললেন? বুঝলাম না!
রীনা শক্ত মুখে তাকালেন,
অন্যায় কখনো গোপন থাকেনা, একদিন না একদিন ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায়! অনেকের অনেক ছোটখাটো অন্যায় সারাজীবন ধরে মেনে নিয়েছি, তোমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হতো না! কিন্তু এতো বড় মিথ্যাচার মেনে নেওয়া কঠিন! কিন্তু আমার তো ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা, না পারছি গিলতে, না ওগরাতে, তাই মুখ বন্ধ করে রাখা ছাড়া উপায় কি বলো! ওই কথা বন্ধ রেখেই যত টুকু নিজের রাগ দেখাতে পারি! কাউকে তো কোনো দিনও বলতে পারবো না যে আমার ছোটো বউয়ের অন্য জায়গায় রেজিষ্ট্রির কথা লুকিয়ে তার বাবা, মা আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে! আর তার পরে যদি সেই ছেলে খুন হয়ে থাকে তাহলে তো সে আসলে বিধবা! কিন্তু এই কথাটা আমি আমার ছেলে কেও বলতে পারবো না, ও যে তোমাকে কতোটা ভালোবাসে সেটা আমি জানি! ওর ভালো থাকার জন্যেই আমাকে আমার মুখ সারাজীবন বন্ধ রাখতে হবে!
অপর্ণা ধপ করে খাটের ওপরে বসে পড়লো, বিস্ময়ের গলায় বললো,
এসব কথা কে আপনাকে বললো? রবীন কাকু?
রীনা শক্ত গলায় উত্তর দিলেন,
খুব অন্যায় করেছেন তাই না? তোমার সঙ্গে আলোচনা করে বলা উচিত ছিলো বোধহয়!
অপর্ণা শান্ত চোখে তাকালো,
অন্যায় তো করেছেন! অর্ধসত্য বলেছেন! হয়ত জানেন না, বা ইচ্ছাকৃত সেটা আমি জানিনা! তবে আমি খুশি হতাম যদি এই কথাগুলো ওনার সামনে বলতেন আপনি! তাহলে বলতাম উনি ভুল জানেন, আমি একজনকে ভালবাসতাম এটা ঠিক, তবে রেজিষ্ট্রি আমার হয়নি! এটা ওখানে ছড়িয়ে যাওয়া রিউমার! তবে রেজিষ্ট্রি হলে আমি লুকিয়ে যেতাম না, আমি মনে করিনা বিধবা হওয়া কোনো দোষের!
রীনা কড়া চোখে তাকালেন,
এখনো এতো বড়ো বড়ো কথা বলছো! এতো সাহসী, এতো সৎ যখন তখন লুকিয়ে গেলে কেনো? আর রবীন বাবুর সামনে এসব বললে তোমার সম্মান থাকতো? ওপরের দিকে থুতু ছেটালে তো নিজের গায়েই পড়ে, তোমার সম্মান যাওয়া মানেই তো আমার বাড়ির সম্মান যাওয়া!
অপর্ণা ম্লান মুখে তাকালো,
আপনি যার কথা ভেবে আমাকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন বলছেন, তাকে আগেই জানিয়েছিলাম! লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন মনে করিনি! সে কেনো আপনাকে জানায় নি সেটা সেই বলতে পারবে। যদি বিশ্বাস নাহয় ছেলে কে জিজ্ঞেস করে নেবেন। আর রবীন বাবুর মুখোমুখি হওয়া যখন আপনার পক্ষে সম্ভব নয়, তখন আমার পক্ষেও তো সত্যিটা প্রমাণ করা মুশকিল! সেক্ষেত্রে আপনি ভেবে দেখুন কি করবেন! যদি না চান তাহলে চলে যাবো নাহয়!
রীনা হাত তুলে অপর্ণা কে থামিয়ে দিয়ে শক্ত গলায় বললেন,
ছেলেকে জিজ্ঞেস করে নিজেকে ছোটো করতে পারবো না! যদি বলে থাকো ভালো, নাহলে নিজেই বিপদে পড়বে একদিন! এইসব দোষ চেপে না রেখে যদি তোমার মা আমাকে জানাতেন, তাহলে এত কিছু আর পর পর হতো না। তোমার মাই বা কেমন মানুষ, নিজেও সব চেপে রাখলেন, দেখলেন তাঁর স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাও একটা পুজো দিয়ে এসব ঠিক না করেই বিয়ের জোগাড় করতে লেগে পড়লেন? আর সব সময় চলে যাওয়ার হুমকি দিও না, সংসারে থাকতে কি করে হয় সেটা শেখো!
অপর্ণা খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
ছেলেকে যখন আপনি জিজ্ঞেস করতে পারবেন না, তখন আমিই তাকে ছুটির দিন দেখে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পাঠিয়ে দেবো নাহয়। এটুকু বলতে পারি আমার মা হয়ত আপনাকে জানাননি, কিন্তু যার জানার প্রয়োজন ছিলো সে সবই জানে! দু একজনের খারাপ কাজের জন্যে হয়ত আপনি মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন সত্যিই, সেগুলো কি সেটা আমি জানিনা, তাই তর্কে যাবো না। তবে সবাই খারাপ হয়না, দীপা দি নিডি, কিন্তু ভদ্র ঘরের মহিলা, তাকে বাড়িতে রেখে যেতে কি সমস্যা বুঝলাম না! আর মিতা একদম পাশের বাড়িতে থাকে, তার বাবার কাজে যাওয়া আমাদের উচিত, তাই গিয়েছি, এতেও আপনার আপত্তির কারণ দেখিনা কিছু!
রীনা থমথমে মুখে তাকালেন,
সবই যদি বুঝতে পারতে, তাহলে তো তুমিই আমার জায়গায় থাকতে। এই চুলগুলো তো আর এমনি এমনি পাকেনি! যাকগে এলে যখন তখন একটা দরকারি কথা বলি, মেজদি আর জামাইবাবু বিয়ের নেমন্তন্ন করতে আসবে, কাল অনিন্দিতা ফিরলে আসতে বলেছি, নাহলে তোমার চাপ হবে। তখন তো আবার তোমার মনে হবে পড়াশুনা বন্ধ করতে চাইছি! অফিস থেকে ফিরলে ঋজু কে পাঠিয়ে দিও, বাজারের কথা বলতে হবে ওকে।
অপর্ণার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে রীনা খাটের বাটামে হেলান দিলেন। যাই ঘটে থাকুক, বাড়ির বউয়ের আগে বিয়ে হয়েছিলো কিনা সেটা সর্বসমক্ষে যাচাই করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়! অপর্ণা কি সত্যি বললো আদৌ! ঋজু জানে সব, নাকি ছেলে কে জিজ্ঞেস করতে পারবেন না বুঝে সাজিয়ে মিথ্যে বলে গেলো। দেখা যাক ঋজু সত্যিই কিছু বলে কিনা! কিন্তু তাঁর তো প্রতিবাদের কোনো উপায় নেই, যেমন উপায় নেই বলার যে দীপা আর মিতাকে দেখলেই তিনি যেনো রত্না আর অপর্ণা কে নিজের জায়গায় দেখতে পান!
ক্রমশ