ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
143

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২৫
একদৃষ্টে পাশের বাড়ির খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে, নিজের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন রীনা, সকালের ঘটনার পর থেকে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সারা দুপুর ঘুম হয়নি, দু এক বার এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়েছিলেন, উবের থেকে ছেলের সঙ্গে মিতা কে নামতে দেখে দুশ্চিন্তা আরো বেড়েছে। তিনি যে ছেলেকে নামতে দেখেছেন সেটা যদিও অপর্ণাকে বুঝতে দেননি। মনে মনে অপর্ণা কেই দোষ দিচ্ছিলেন, এতো বোকা কেনো মেয়েটা! বারণ করা সত্বেও কখন যেনো ফোন নম্বর দিয়ে বসেছে মিতা কে। উল্টে আবার কথায় কথায় তর্ক করে, কি করে বোঝাবেন মিতার কাছ থেকে দূরে থাকা ওর ভালোর জন্যেই দরকার।

বড়ো ছেলেকে নিয়ে তাঁর কোনো সমস্যা কখনো হয়নি কিন্তু ছোটো ছেলেকে নিয়ে তাঁকে ছোটো থেকেই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ছোটো থেকেই প্রতিবাদী, দায়িত্ববান ছেলেকে নিয়ে তিনি যতটা গর্বিত ততটাই বিরক্ত। তাঁর জেদের কাছে তাঁকে বাধ্য হয়ে মাথা নোয়াতে হয়, কারণ তিনি জানেন যদি সত্যি ছেলে চলে যায় বাড়ি ছেড়ে তাহলে তিনি তাঁর সব হারিয়ে ফেলবেন। মিতাকেও তো তিনি সরাতে পারেন নি শেষ পর্যন্ত, আলাদা হয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ছেলে তাঁকে মানতে বাধ্য করেছিলো। কিন্তু তারপরে ওদের মধ্যে নিজস্ব কিছু সমস্যা হয়েছিলো, তিনি বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণ একবারের জন্যেও জানতে চান নি শুধু ছেলের অন্য বিয়েতে মত পাওয়ার এক মাসের মধ্যে অপর্ণার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

নিজের শাশুড়ির সঙ্গে রীনার কখনো বনিবনা ছিলো না, সারাজীবন তাঁর শাশুড়ি তাঁকে পায়ের তলায় দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন। যে শাশুড়িকে তিনি কোনোদিনও পছন্দ করেন নি, সংসার চালাতে গিয়ে কিন্তু তাঁর বেশ কিছু ট্রিককে নিজের মতো করে নিজের সংসারে ব্যবহার করেছেন বরাবর। মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে তিনি মানেন তাঁর শাশুড়ি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি ছিলেন, একজন অশিক্ষিতা মহিলার সঙ্গে থাকতে থাকতে রীনা বুঝেছিলেন ওই ভদ্রমহিলার সংসারিক শিক্ষার কাছে, তাঁর পুঁথিগত শিক্ষা নিতান্তই সামান্য। সারাজীবন নিজের ছেলেকে রীনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে গেছেন ওই মহিলা।

দূরে বাপের বাড়ি, বউকে বেশি পড়তে বা চাকরি করতে না দেওয়া এগুলো তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকেই পাওয়া শিক্ষা, তাতে বউ ঘরে থাকে। যতো বাইরের লোকের সঙ্গে মেলামেশা কম করানো যায়, যত কথায় কথায় বউয়ের বাবা, মায়ের ঢুকে পড়া দূরে রাখা যায় ততই সংসারে শান্তি থাকে। যতো বেশি বাইরের জগতে মেলামেশা ততোই কুশিক্ষা।

সেই হিসেব মেনেই তিনি দুই ছেলের বিয়ে দিয়েছেন দূরে, বেছে নিয়েছেন এমন এমন পরিবার যাঁরা নিজেরাই যথেষ্ট সমস্যায় রয়েছে। অনিন্দিতার বাবা নেই, অপর্ণার বাবা অসুস্থ, মেয়ের সংসারে নাক গলানোর ক্ষমতা তাদের মায়েদের কারোরই নেই, এগুলোই তাঁর পছন্দের। টাকা, পয়সার লোভ তাঁর নেই, নিজেরই যথেষ্ট আছে তাই ভাইদের একটু অসচ্ছল পরিবারে বিয়েতে রত্নার আপত্তি থাকলেও তিনি মেয়ের কথা কে ধর্তব্যের মধ্যেও আনেন নি। ঠিক এই কারণেই তিনি পাশের বড়লোক বাড়ির একমাত্র মেয়ে মিতাকে বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিতে চান নি। কোনো কোনো দুর্বল মুহূর্তে, মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছেন রীনা, শাশুড়ির পদাঙ্ক অনুসরণ করে আদৌ তিনি ঠিক করছেন কিনা! কারণ এই তিনি নিজেই তো এই কষ্টের ভুক্তভুগী ছিলেন একসময়, সেই একই জিনিষ বউদের সঙ্গে করা তাঁর পক্ষে ঠিক হচ্ছে কিনা। কিন্তু নিজের সপক্ষে নিজেই যুক্তি সাজিয়েছেন বারবার, মনে করেছেন তিনি শুধু নিজের মতো করে তাঁর সংসার কে ভেঙে যাওয়া থেকে আটকে রাখতে চান, তার জন্যে যদি তাঁকে কঠোর হতে হয় হোক নাহয়।

রীনা বরাবরের প্রতিবাদী ছিলেন, নিজে শাশুড়ি হয়ে তিনি অপর্ণার সঙ্গে কখনো কখনো তাঁর মিল খুঁজে পান। একটা সময় ছিলো যখন শাশুড়ি বাঁয়ে বললে তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবেই ডাঁয়ে যেতেন। কিন্তু একই জিনিস যখন অপর্ণা করে এবং ঋজু সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তাঁর ভেতরে একটা অদ্ভুত আক্রোশের সৃষ্টি হয়, মনে হয় তাঁর এই সময়গুলোতে তিনি কখনো আশুতোষ কে স্বামী হিসেবে পাশে পাননি। অপর্ণা কে তাই অনিন্দিতার থেকেও কড়া হাতে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেন তিনি।

কিন্তু তাঁর শাশুড়ি আরো একটা খেলা সারাজীবন খেলে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে, সেই খেলার ফল স্বরূপ রীনা আর আশুতোষ ক্রমশ একে অপরের থেকে দূরে সরে গিয়েছেন একসময়। একই ছাদের তলায় থেকেও ধীরে ধীরে ক্রমশ স্বামীর সঙ্গে রীনার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তিন ছেলে, মেয়েকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটিয়েছেন, তাদের লেখা পড়া, তাদের কে বড়ো করে তোলাই তাঁর জীবনের ধ্যান জ্ঞান ছিলো একসময়। শাশুড়ি বা স্বামীর সঙ্গে অশান্তি যতো বেড়েছে ততো তিনি ছেলে, মেয়েদের আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন। কিন্তু তিনি বরাবরের জেদী ছিলেন, তাঁর ভেতরের সমস্যা তিনি কখনো প্রকাশ্যে আনেন নি, বরং ধীরে ধীরে ছেলে মেয়ের বড়ো হবার সাথে সাথে একটু একটু করে পায়ের তলার জমি কে শক্ত করেছেন। তারপরে এমন একটা সময় এসেছে যখন শাশুড়ি এবং আশুতোষ কে সম্পূর্ন সরিয়ে দিয়ে তিনি এবাড়ির সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন। শাশুড়ি মারা গিয়েছেন কালের নিয়মে, যদিও শেষের দিকে নাতি, নাতনির ভয়ে তিনি বউয়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেতেন না। আশুতোষ এখনও আছেন ঠিকই তবে রীনা তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না। ছেলে মেয়েদেরও যে বাবার প্রতি খুব কিছু ভালোবাসা আছে তা নয়, কারণ তাদের ছোটবেলায় দেখা বাবার মায়ের সঙ্গে করা দুর্ব্যবহার তারা কখনো ভোলে নি। শাশুড়ির অন্য সব ট্রিকগুলোকে নিজের মতো করে দু একটা প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও তাতে তাঁর ছেলে, বউয়ের নিজস্ব সম্পর্ক কে খারাপ করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু যেই খেলাটা তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে নষ্ট করে, শাশুড়ির পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেই খেলাটা তিনি কখনো খেলতে চান না, তাই আজকের ঘটনা তাঁকে চিন্তায় ফেলেছে। তখন থেকে মনের ভেতরে উথাল পাথাল চলছে রীনার, যদি মিতা আবার ফিরে আসে ঋজুর জীবনে তাহলে অপর্ণার অবস্থাও তাঁর মতোই হবে না তো!

ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা যতো তাড়াতাড়ি এগোচ্ছিল, রীনার ধৈর্য্য ততটাই তাড়াতাড়ি কমছিলো, আরো বার দুয়েক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি বারান্দা থেকে বসার ঘরে বেরিয়ে এলেন। টেবিল থেকে রিমোট তুলে, টিভিটা কমিয়ে দিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে তাঁকে এগোতে দেখে রত্না মাকে থামালো,

দাঁড়াও না মা, ভাইকে নিচে আসতে দাও আগে, তুমি ওপরে যাচ্ছ কেন? বলেছো তো অপর্ণা কে, ভাই নিশ্চয়ই নামবে একটু পরে।

রীনার মুখে বিরক্তির ছাপ পড়লো,

তুমি সব ব্যাপারে কথা বলো কেন? দুদিনের জন্যে এসেছো নিজের মতো থাকো না! এবাড়ির ব্যাপারে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

অপমানে রত্নার মুখ কালো হয়ে গেলো, কয়েক মুহূর্ত মায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে সে ঘরে ঢুকে গেলো। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রীনার স্বামী আশুতোষের মুখ গম্ভীর হলো,

কি বললে তুমি ওকে? এতো রুঢ় কেনো তুমি, একটু ভালো করে কথা বলতে পারো না!

রীনা স্বামীর দিকে কড়া চোখে তাকালেন, আবার পর্দা সরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে হিসহিসে গলায় বললেন,

একদম চুপ! আমার সংসারে মাথা ঘামাতে এসো না! তোমারই তো ছেলে, ঠিক সময়ে না সামলে নিলে আমার মতোই পরিণতি হবে! রক্তের দোষ যাবে কোথায়!

ফুটে ওঠা মোবাইলের স্ক্রিনে রবির নামটা দেখেই মিতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো, হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে রবির উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এলো,

কি রে! এতো রেগে আছিস, যে কাকুর অসুস্থতার খবর টুকুও দিস নি?

মিতা বিরক্ত হলো,

তোর তো জানার কোনো প্রয়োজন নেই! সেই যে তোর বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে ফিরলাম তার পর থেকে তো আর একবারের জন্যেও ফোন করিস নি আমাকে! শুনলাম দিল্লি এসেছিলি তবু দেখা করার প্রয়োজন অনুভব করিস নি যখন তখন যোগাযোগ রাখতে চাস না বুঝেই গেছি। তা আজ এতো দরদ কিসের তোর?

রবি হাসলো,

তুই আর বড়ো হবি না! এতো রাগ তোর! অফিস এর কাজে গিয়েছিলাম সঙ্গে আরো দুজন ছিলো তাই দেখা করতে পারিনি। তা অপমানটা যে করলো তাকেই তো ডেকেছিস শুনলাম!

মিতা ফুঁসে উঠলো,

আর কি করবো! ইচ্ছে না থাকলেও অনেক কিছু করতে হয়! তুই নিশ্চয়ই তার কাছ থেকেই জেনেছিস?

রবি হাসতে লাগলো,

হুম্! বললো তোকে হসপিটালে নিয়ে যেতে, সে নাকি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে!

মিতার গলার কাছটা কেমন যেনো দলা পাকিয়ে উঠলো, ঋজু গেলো না ওর সঙ্গে! বদলে রবি কে সঙ্গে দিয়ে দিলো! নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

তোর আসার দরকার নেই, আমি নিজেই কথা বলে নেবো!

রবি ফোন নামিয়ে রাখতে রাখতে হাসলো,

পাগলী একটা! তৈরি হ, আসছি গাড়ি নিয়ে তোর বাড়ির সামনে!

কাঁটায় কাঁটায় আটটায় ডাক্তার এলেন, মিতা আর রবিকে জানিয়ে দিলেন যে রোগীর অবস্থা একেবারেই ভালো নয়, রাতের মধ্যেই কিছু একটা ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাদের বাড়ি ঠিক কতো দূরে, হাসপাতাল থেকে ফোন গেলে তারা কতো তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবে সবটা জেনে নেওয়ার পরে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন, মিতা ওখানেই বসে পড়লো। রবি মনস্থির করতে পারছিলো না, ঋজু কে কি একটা ফোন করা উচিৎ! নাকি শেষ পর্যন্ত কি হয় দেখা যাক!

প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে অপর্ণা আর সৌমিক নিচে নেমে এলো, অপর্ণা রুটি করতে রান্নাঘরে ঢুকে যাওয়ার পরে মায়ের মুখোমুখি হলো সৌমিক। রীনা নিজের ঘরের খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে বসেছিলেন গম্ভীর মুখে, ছেলেকে দেখে উল্টোদিকের সোফার দিকে ইশারা করলেন,

বোসো ওখানে, কথা আছে তোমার সঙ্গে!

সৌমিক সোফায় বসেই হাত তুললো,

যদি তুমি মিতার বাবার সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়া নিয়ে কিছু বলো তাহলে কিন্তু আমি শুনবো না। অন্য কিছু বলার থাকলে বলো সেটা।

রীনা ছেলের চোখের দিকে তাকালেন,

তাহলে না এলেই পারতে, তুমি তো জানতেই তোমাকে কেনো ডেকেছি!

মা প্লিজ! সব ব্যাপারে তুমি মাথা ঘামাও কেনো বলতো? আমি তো বাচ্চা নই, আমি কি করছি আমি জানি সেটা, আজ মিতার বাবার জায়গায় অন্য কেউ হলেও এটাই করতাম।

রীনা হাত তুললেন,

অন্য কেউ হলে তো বলতাম না, মিতার বাবা বলেই বলছি। ওই লোকটা তোমাকে কম অপমান করেনি, তুমি সব ভুলে গেছো!

সৌমিক ঘাড় নাড়লো,

নাহ! কিছু ভুলিনি, তুমিও ওনাকে যথেষ্ট অপমান করেছিলে, সেটাও মনে আছে!

রীনা উঠে দাঁড়ালেন,

বাহ! খুব ভালো! এরপরে তো আর তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা থাকতেই পারে না! দেখলাম তুমি মিতাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলে, সে তোমার সঙ্গে হাসপাতাল থেকে এলো না এয়ারপোর্ট থেকে আমি জানতে চাইবো না! বুঝতেই পারছি তুমি খুব বড়ো হয়ে গেছো, শুধু বলবো ওকে যেনো কখনো অপর্ণার সঙ্গে মেলামেশা করতে না দেখি। আর একটা কথা, আজ ওর বাবা অসুস্থ হয়েছে, কাল মা হবে হয়তো, ও কি তোমার ওপরেই সবটা ছেড়ে দিয়ে নিজে দিল্লিতে বসে থাকবে? এই কথাটা আমি ওকে জিজ্ঞেস করবো, সেটা তোমাকে আগেই বলে দিলাম, পরে বলো না আমি তোমাকে জানাই নি!

সৌমিক অবাক হয়ে তাকালো,

তুমি কি পাগল নাকি! তুমি এটা মিতাকে জিজ্ঞেস করবে!

রীনা পর্দা তুলে বেরিয়ে যেতে যেতে ঘুরে তাকালেন,

হ্যাঁ, তুমি বাধ্য করছো জিজ্ঞেস করতে, যদি তোমার এই যাতায়াত বন্ধ না হয়, তাহলে আমাকেই সেটা বন্ধ করতে হবে।

কি করবি তাহলে? বাড়ি যাবি তো? একটা তো স্টপেজ, দশ মিনিট লাগবে আসতে চল বাড়ি ফিরেই যাই!

রবির কথাতে মিতা উঠে পড়লো, সেই কাল রাত থেকে ধকল চলছে ওর নিজেরও শরীর খারাপ লাগছে এবার।

রবি ওকে নামিয়ে দিয়ে অনেকক্ষন আগে ফিরে গিয়েছে, কোনো রকমে একটু কিছু মুখে দিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে মিতা। পাশের ঘর থেকে একটা অস্পষ্ট চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে মাঝে মাঝে। মাকে কি স্বান্তনা দেবে, ওর নিজেরই তো খুব হতাশ লাগছে, এতো চেষ্টা করেও বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পারলো না! এতো ক্লান্তিতেও ঘুম আসছে না, কিছুক্ষন শুয়ে থেকে শেষে ছাদে উঠে এলো মিতা।

ঝকঝকে জ্যোৎস্নায় পাশের বাড়ির প্রতিটা অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ঋজুর ঘরের জানলাটা বন্ধ, ভেতর থেকে এসি চলার আওয়াজ আসছে। বুকের মধ্যে একটা জ্বালা ধরার অনুভূতি হচ্ছে, ঘরের ভেতরের দৃশ্যটা যেনো মানস চোখে দেখতে পাচ্ছে মিতা। ওই ঘরটা, ওই মানুষটা ওর হবার কথা ছিলো, কিন্তু আজ সব কিছু অপর্ণার! কয়েক মুহূর্ত দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে রেখে নিজেকে সামলালো মিতা, এসব কি ভাবছে ও! কাল রাতেই যে মেয়েটা ওর বাবার জন্যে এতো কিছু করলো আজ তাকেই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে! মিতা চোখ সরিয়ে নিলো, নাহ! ওই জানলাটা নয়, ওর প্রতিদ্বন্দ্বী তো নিচের জানলায়, যে ওকে এক মুহুর্ত ভালো থাকতে দেয়নি! আজকে যদি বাবা চলে যায় তাহলে তো ওই মহিলাই দায়ী, ওনার করা অপমানেই তো বাবার অসুস্থতার সূত্রপাত! বড্ড ছেলে ছেলে করা, ওই ছেলে কে যদি ওই মহিলার কাছ থেকে আলাদা না করতে পেরেছে তাহলে ওর নাম পারমিতা নয়! কিন্তু অপর্ণা কে বাদ দিয়ে সেটা কি করে করবে ও, ঋজুর মায়ের ওপরে শোধ নিতে গেলে তো অপর্ণাকেই ব্যবহার করতে হবে ওকে! মিতা দাঁতে দাঁত চাপলো, এতো কিছু ভাববে না ও, দরকার হলে তাই করবে, অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার!

ভোরবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই পাশের বাড়ি থেকে একটা জোরে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো, অপর্ণা সৌমিকের মুখের দিকে তাকালো। কাল রাতেই ফিরে রবি ফোন করেছিলো, বলেছিলো ডাক্তার বলে দিয়েছেন যেকোনো সময় কিছু হয়ে যেতে পারে। তাই সৌমিক সমরের কথা বলতে চাইলেও অপর্ণা ইশারায় থামিয়ে দিয়েছিলো, ওটা এমন কিছু জরুরী নয়, এই মুহূর্তে ওসব আলোচনা করার মতো অবস্থা নেই। রাতটুকু অবশ্য নির্বিঘ্নেই কেটেছে, কিন্তু ভোরের এই কান্নার আওয়াজ সব কিছু পরিষ্কার করে দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত কান্নার আওয়াজের উৎসর দিকে তাকিয়ে থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সৌমিক উঠে দাঁড়ালো, তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখেই রত্না মায়ের দিকে তাকালো। রীনা থমথমে মুখে প্রশ্ন করলেন,

আজও তারমানে অফিস যাওয়া হলো না, তাই তো?

সৌমিক কোনো উত্তর দিলো না, কিছুক্ষনের মধ্যেই সে তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো, রবির সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরোনোর আগে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো

ফিরতে দেরি হবে! আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো না!

রীনা হতাশায় হাতের মুঠো শক্ত করলেন, আজ থেকে ঠিক বছর তেত্রিশ আগের আশুতোষ কে আবার দেখতে পাচ্ছেন তিনি, কিন্তু আগের বার যা তিনি পারেন নি, এবার তাঁকে তা পারতেই হবে।
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২৬
মিতার বাবার মৃত্যুর দিন মায়ের আপত্তি সত্বেও জোর করে যাবার কারণে বেশ কয়েকদিন যাবত রীনা ছেলের সঙ্গে কথা বলেন নি। মায়ের মুখের ভাব দেখে দিন তিনেক পরে একদিন রাতে সৌমিক শেষ পর্যন্ত নিজেই গিয়ে মায়ের পাশে বসেছিলো, বেশ কিছুক্ষন চেষ্টার পরে রীনার রাগ ভেঙে ছিলো ঠিকই, কিন্তু তিনি ছেলের কাছ থেকে কথা আদায় করে ছেড়েছেন যে যেহেতু এখন সব কিছু মিটে গিয়েছে, মিতার বাবার জন্যে ছোটাছুটির আর কোনো অজুহাত নেই, তাই আর নতুন করে সে অহেতুক মিতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখবে না।

মিতাও যদিও বাবার চলে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো তাই একবারের জন্যেও সৌমিক কে ফোন করেনি। মনের মধ্যে তারও ক্ষোভ ছিল হয়তো, পরোক্ষ ভাবে সে সৌমিকের মাকেই বাবার অসুস্থতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছিলো। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিলো, এর মধ্যে সৌমিক ব্যাংকে থাকাকালীন একদিন মিতা ফোন করেছিলো, প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যে কাজ করতে করতে কোনো মতে ফোন ধরেছিলো সৌমিক, মিতা জানিয়েছিলো তিনদিন পরে ওর বাবার শ্রাদ্ধ, যেহেতু ঋজু ওর বাবার শেষ যাত্রায় সঙ্গে ছিলো, তাই মা বলেছে অবশ্যই ওকে অপর্ণা কে নিয়ে শ্রাদ্ধে আসতে হবে। সৌমিক যদিও কথা দিতে পারেনি, কারণ মায়ের কাছে করা প্রমিস তার মাথায় ঘুরছিলো। সে অজুহাত দেবার চেষ্টা করেছিলো অনেকটা বাধ্য হয়েই,

দু দিন ইতিমধ্যেই ছুটি নিয়ে নিয়েছি তো, এখন আর ছুটি পাবো না, বুঝলি! কিছু মনে করিস না, পরে সব কিছু মিটলে একদিন কাকিমার সঙ্গে কথা বলে নেবো আমি।

মিতা নিজেও একটু বিরক্ত গলায় বলেছিলো,

হ্যাঁ, আমি বুঝি সেটা! সত্যিই তো তোর অনেক ছুটি চলে গিয়েছে। তাছাড়া তুই এখানে এলে যে তোর মায়ের আপত্তি থাকবে সেটাও জানি! কিন্তু মা এগুলো বুঝবে না! এরা সব পুরনো দিনের মানুষ তো, যারা নাকি শেষ সময়ে ছিলো, তাদের শ্রাদ্ধে আসতে হয়! কি বলি বলতো! ঠিক আছে, দেখ কি করবি! যদি তুই নাও আসতে পারিস তাহলে পারলে অপর্ণা কে একটু পাঠিয়ে দিস নাহয়! ও আমার জন্যে অনেক করেছে, বাবা কে ফেরাতে পারিনি ঠিকই কিন্তু ও তো ওর মতো করে চেষ্টা করেছিলো, সেটা ভুলি কি করে!

সৌমিক ভেবে দেখবে জানিয়ে তখনকার মতো ফোন নামিয়ে রেখেছিলো। বাড়িতে ফিরে অপর্ণা কে বলেছিলো,

মা যখন চায় না, আমি যাবো না, তুমি বরং ইউনিভার্সিটিতে যাবার পথে দশ মিনিট ঘুরে যেও একটু। মাকে কিছু বলার দরকার নেই। আর আমি রবিকে বলেছি ওই ছেলেটির কথা, খোঁজ নেবে ও, তুমি ওর জন্যে একটু দাঁড়িয়ে দেখা করে ঠিকানাটা দিয়ে দিও।

সেই মতো শাশুড়ি কে কিছু না বলেই সৌমিকের সঙ্গে আজ বেরিয়ে পড়েছে অপর্ণা, কথা হয়েছে সৌমিক ওকে অনুষ্ঠান বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে। যদিও অন্য দিন ও শাড়ি পরে বেরোয় না, আজ বেরোনোর সময় ওর শাড়ি দেখে রীনা কিছু জিজ্ঞেস না করলেও অনিন্দিতা মুচকি হেসে ছিলো,

ক্লাসের নামে বরের সঙ্গে প্রেম করতে যাচ্ছিস নাকি!

অপর্ণা রহস্যের হাসি হেসেছিলো,

বলবো না!

দোতলা অনুষ্ঠান বাড়িটা থেকে খানিকটা দূরে ওকে নামিয়ে দিয়ে সৌমিক চলে যাবার পর অপর্ণা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো চারপাশটা, এর আগে ও সেই ভাবে পাড়ার মধ্যে কখনো বেরোয় নি। যেটুকু ক্লাস করতে বেরোয়, সব সময় মোটামুটি সঙ্গে সৌমিক থাকে, দু একদিন অটো করে ফিরলেও সোজা বাড়িতে ফিরে গেছে, আশেপাশের অঞ্চলে সেরকম ভাবে ঘোরা হয়নি। পর পর ব্লক নম্বর লেখা বাড়িগুলো দেখে একটু থতমত খাচ্ছিলো অপর্ণা, এখান থেকে বেরিয়ে ও ঠিক মতো ইউনিভার্সিটি পৌঁছতে পারবে তো!

সৌমিক ওকে ইচ্ছাকৃত ভাবেই একটু দূরে নামিয়েছিলো, পাছে মিতার মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে উনি ওকে জোর করে আটকে দেন তাই। সৌমিক এর বাইকটা চোখের আড়ালে চলে যাবার পরে হাতের ফুলের মালা আর মিষ্টির প্যাকেট ধরে, শাড়ি সামলাতে সামলাতে একটু হাঁটতে হাঁটতে বাড়িটার সামনে পৌঁছে গেলো অপর্ণা। সামনে একটা সাদা রঙের কাপড়ের গেট, তার পাশেই লোকজনের একটা ছোটখাটো ভীড়, একটাও পরিচিত মুখ নেই। মনে মনে একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো, সৌমিকের ওপরে একটু একটু রাগ হচ্ছে এখন। অপর্ণা একা আসতে চায়নি, ও পাড়ার কাউকেই চেনে না, কিন্তু সৌমিক ওকে অনেকটা জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছে।

এখন কিছু করার নেই ভেবে বাধ্য হয়ে গেট পেরিয়ে অনেকটা অস্বস্তি নিয়েই ভেতরে ঢুকলো অপর্ণা, সামনেই দুটো সারিতে অনেকগুলো চেয়ার পাতা, একটু দূরে শ্রাদ্ধের আয়োজন চলছে। বেলা এখনও সেরকম হয়নি, বোঝাই যাচ্ছে অনুষ্ঠান এখনও শুরু হয়নি, এদিক ওদিক তাকিয়ে মিতাকে খোঁজার ফাঁকেই মিতা নিজেই ওকে দেখে এগিয়ে এলো,

তুমি কি একা এলে? ঋজু আসেনি?

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

না গো, ওর পক্ষে সম্ভব হলো না, আমিই ক্লাসে যাওয়ার পথে একটু দেখা করে গেলাম।

মিতার মুখের কোনো পরিবর্তন হলো না, ও সম্ভবত ঋজু কে আশা করেনি সত্যিই, অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,

হ্যাঁ, ও বলেছিলো আমাকে! তবে তুমি এসেছো তাতেই আমি খুব খুশি হয়েছি। চলো মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি।

একধারে আত্মীয় স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে বসে থাকা মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে মিতা পরিচয় করিয়ে দিলো, জানালো ও না থাকলে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই সম্ভব হতো না সেদিন। মিতার মা ওর হাত ধরে ধন্যবাদ জানালেন, কিন্তু তাঁর সেই ধন্যবাদের মধ্যে খুব বেশি আন্তরিকতা ছিলো না। তাঁর পাশে বসে থাকা আত্মীয় স্বজনরা অপর্ণার দিকে তাকিয়েছিলো, তাদের চোখের দৃষ্টিতে অপর্ণা বুঝতে পারছিলো যে তারা সবাই সৌমিকের সঙ্গে মিতার সম্পর্কের কথা জানে, এবং তাকে মনে মনে সম্ভবত মিতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই ভাবছে।

দু এক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে অপর্ণা এগিয়ে গেলো, তাদের পাশ থেকে সরে গিয়ে একটু দূরের একটা চেয়ারে বসে পড়লো। মনে মনে ঠিক কিভাবে এখান থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়া যায় তার হিসেব কষতে লাগলো, যদিও রবির এখনো দেখা নেই, আর ও না আসা পর্যন্ত ওর পক্ষে বেরোনো সম্ভব নয়, যেভাবেই হোক আজ ঠিকানাটা দিয়ে যেতেই হবে। বসে থাকতে থাকতে অপর্ণা বিরক্ত হচ্ছিলো, ওকি ঠিকানাটা সৌমিক কে হোয়াটসঅ্যাপ এ পাঠিয়ে দিতে বলবে বাড়ি ফিরে, নাকি হাতে হাতে দিলে ব্যাপারটা বেশি গুরুত্ব পাবে, এমনই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। কম দিন তো হলো না, প্রায় বছর ঘুরতে চললো দেখতে দেখতে।

মিতা আজ ব্যস্ত ছিলো, তার পক্ষে অপর্ণা কে আলাদা করে সময় দেওয়া সম্ভব ছিলো না, কিন্তু সে দুর থেকে অপর্ণাকে লক্ষ্য করছিলো। তাকে একা বসে থাকতে দেখে সে একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে এলো,

দেখো তো অপর্ণা, ওনাকে চিনতে পারো কিনা!

অপর্ণা একটু অবাক হয়েই তাকালো, হালকা ক্রিম রঙের তাঁতের শাড়ি পরিহিত মধ্য বয়স্ক এক মহিলা, গলায় একটা পাতলা সোনার চেন, বিবাহিতা না অবিবাহিতা বা বিধবা কিনা বোঝা যাচ্ছে না, মিতার পাশে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে হাসছেন। এখানের কাউকে ও চেনে না, তাই ওই মহিলা কে চিনতে পারার কথা নয় ওর, কিন্তু সত্যি চেনা চেনা লাগছে! অপর্ণা একটু অস্বস্তিতে পড়লো,

হ্যাঁ, লাগছে ঠিকই কিন্তু ঠিক চিনতে পারছি না! আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো!

মিতা হেসে ফেললো,

এই রে! চিনতেই পারলে না! উনি তো রীতা পিসি, তোমার বিয়েতেও তো গিয়েছিলেন! পিসি তুমি তোমার বৌমা কে কোম্পানি দাও, আমি এলাম!

মিতা চলে গেলো, মহিলা মিটি মিটি হাসতে হাসতে অপর্ণার পাশে বসে পড়লেন,

তোমার আর দোষ কি, বিয়ে বাড়ির অতো ভীড়ে কি আলাদা করে কাউকে মনে রাখা সম্ভব! তুমি অবশ্য আমাকে বোধহয় একবারই দেখেছো, ওই যে বরণ ডালা নিয়ে তোমাকে বরণ করার জন্যে রাতে এসেছিলাম। ঋজু কে খুঁজলাম, তখন তুমিই তো বললে ও হাসপাতালে গেছে!

অপর্ণা চমকে উঠলো, লজ্জার গলায় বললো,

এমা! ঠিক বলেছেন! আমার কিন্তু সত্যি আপনাকে চেনার কথা ছিলো। একবার দেখলেও আমি ভুলি না সাধারণত, কিন্তু সেদিন ওরকম একটা ঘটনা ঘটলো তো, তাই সব গন্ডগোল হয়ে গিয়েছে।

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন, হতাশ গলায় বললেন,

সত্যি কি যে হলো সেদিন! এরকম অকাল বৃষ্টি কেউ দেখেছে নাকি কলকাতায়! তোমার শ্বশুর মশাই বয়স্ক মানুষ, তাঁর আর দোষ কি, কোথায় জল জমে আছে সেগুলো তো বাড়ির গিন্নীরই দেখার কথা! তা তোমার শাশুড়ি নিজে সেসব দেখেনি, নিজের স্বামীকে লক্ষ্য রাখার সময় কোথায় তার, উল্টে তোমাকে অপয়া বলে দোষ দিতে লাগল। ওই বৃষ্টিতে, ঠান্ডায় বাড়ির বউকে কেউ বাইরে বসিয়ে রাখে! কিন্তু কারোর তো মুখ খোলার ক্ষমতা নেই, আমি তাও একটু চেষ্টা করেছিলাম, তো সেতো শুনলাম ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছে। গেলো ঠিক আছে কিন্তু যাবার আগে বউটা কে ঘরে ঢোকানোর ব্যবস্থা টুকু তো করে দেবে অন্তত!

অপর্ণার মনের মধ্যে নতুন করে সেই রাতের ছবিটা ভেসে উঠলো, সারা জীবনেও কি ওই রাতটা কখনো ভুলতে পারবে ও! একথা তো সত্যিই, ওর কি দোষ ছিল ওখানে, এমনকি নন্দাইয়ের অসুস্থতার জন্যেও ওকেই দায়ী করছিলো শাশুড়ি সেদিন, এগুলো ভুলে কি ও কখনো ওনাকে আপন ভাবতে পারবে! কিন্তু সদ্য পরিচিত কারোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করার রুচি তার ছিলো না, তাই কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অপর্ণা প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো, ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলো,

কিন্তু বৌভাতের রাতে আপনাকে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না আর! আপনি কি চলে গিয়েছিলেন নাকি? তারপর থেকে কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো আসেন নি আর!

ভদ্রমহিলা মলিন হাসলেন,

ওই নিয়ম রক্ষার মতো গিয়েছিলাম একটু, একদম না গেলে নয় তাই। আবার পরের দিনই ফিরে এসেছি। যেতে তো ইচ্ছে করে খুব, ছেলে মেয়েগুলোর জন্যে বড্ড মন খারাপ লাগে, কিন্তু কি করে যাই বলো তো! বৌদি তো আমাকে পছন্দই করেন না, বিয়েতে নেমন্তন্ন না করলে খারাপ দেখায় তাই করেছিলো!

অপর্ণা একটু অস্বস্তিতে পড়লো, কথা ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

আপনি কি কাছেই থাকেন নাকি? মানে মিতাদি কে চেনেন দেখছি তাই বললাম আর কি!

মহিলা মাথা নাড়লেন,

নাহ! খুব কাছে থাকিনা, বেশ অনেকটা দূরেই থাকি, তবে একসময় তো তোমাদের বাড়িতেই থাকতাম তাই মিতা আমাকে চেনে।

অপর্ণা মনে মনে চমকে উঠলো, উনি এই বাড়িতেই থাকতেন! সৌমিক এর নিজের কোনো পিসি নেই, উনি তারমানে দূরসম্পর্কের কেউ হবেন, কিন্তু তাহলে উনি এই বাড়িতে থাকতেন কেনো!

ভদ্রমহিলা তাকিয়ে ছিলেন, অপর্ণার অন্য মনস্ক ভাব বোধহয় তাঁর চোখেও ধরা পড়ছিলো, নিজেই একটু হাসলেন,

তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো আমি এখানে থাকতাম কেনো? আসলে ঋজুর ঠাকুমা আর আমার মা ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন, নিজেরা সই পাতিয়ে ছিলেন। বিয়ের পরে যখন স্বামীর ঘর করতে পারলাম না, নিজের দাদারা আশ্রয় দিলো না, তখন মাসিই আমাকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। তখন রত্না ছোটো, বাকি দুজন তো জন্মায়নি পর্যন্ত, সেই থেকে তো আমিই দায়িত্ব নিয়েছিলাম বাড়ির। বৌদি আর থাকতো কতটুকু, দুদিন ছাড়া ছাড়াই বাপের বাড়ি, তাছাড়া পর পর তিনটে বাচ্চা, ওসব নিয়েই নাকানি চোবানি খেতো।

অপর্ণার নিজের যদিও শাশুড়ির প্রতি খুব বেশি ভালোবাসা ছিলো না, কিন্তু একজন বাইরের মানুষের মুখে বারবার শাশুড়ির নিন্দে শুনতে তার একটুও ভালো লাগছিলো না। সে বরাবরের স্পষ্টবাদী, আড়ালে আবডালে পরচর্চা তার পছন্দ নয়, বরং মুখের ওপর সত্যি বলতেই সে বিশ্বাস রাখে। নিজের বিরক্তি এবার আর সে গোপন রাখার চেষ্টা করলো না, নিজের অজান্তেই তার গলায় বিদ্রুপের সুর বাজলো,

বাপের বাড়ি থাকলে তো যাবেনই বলুন, এতে আর দোষের কি আছে। আর পর পর তিনটে বাচ্চা হলে তো সে বেচারা নাকানি চোবানিই খাবে, আমি বা আপনি হলেও তো খেতাম!

ভদ্রমহিলা সম্ভবত এরকম জবাব আশা করেন নি, একটু থতমত খেয়ে বললেন,

হ্যাঁ, মা সে তুমি একদম ঠিক বলেছো, তাই তো আমি যেচে সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলাম। মাসিমা তো নিজের বৌমাকে খুব ভালো বাসতেন, তাই আমার হাত ধরে বলেছিলেন, ও একা পারেনা, তুমি একটু সংসারটা দেখো। আমিও তো নিজের সংসার ভেবেই করেছিলাম, মাসিমার কথা ফেলতে পারিনি। কিন্তু দুঃখ কোথায় জানো, মাসিমা যখন অথর্ব হয়ে পড়লেন, তখন এই বৌদিই আমার ঋণ সব ভুলে গেলো, আমাকে চলে যেতে বললো বাড়ি ছেড়ে, মাসিমা কতো কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু ওনার তখন কিছু করার ছিলো না আর!

অপর্ণার এতো কিছু কথা জানা ছিলো না, একটু চুপ করে থেকে বললো,

আমি আসলে এতো কিছু জানতাম না তো, তাই হয়ত অজান্তে আপনাকে আঘাত করে ফেলেছি। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না প্লিজ! যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? আপনার চলে কিকরে এখন?

ভদ্রমহিলা ম্লান হাসলেন,

ওই কোনোভাবে চলে যায় আর কি! সে নিয়ে ভাবি না, একা মানুষের আবার খাওয়ার চিন্তা?

অপর্ণার খারাপ লাগছিলো, এর পরে আর কথোপকথন চালিয়ে নিয়ে যাবার মতো কিছু পাচ্ছিলো না ও, এর মধ্যেই দরজা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে রবি কে ঢুকতে দেখলো, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো অপর্ণা,

পরে আবার কথা হবে, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ক্লাসের,

মহিলা হাসলেন,

এসো মা! মিতার সঙ্গে এসো একদিন আমার বাড়িতে, খুব খুশি হবো।

নিশ্চয়ই আসবে জানিয়ে অপর্ণা মিতার কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে রবির দিকে এগিয়ে গেলো, রবি ঠিকানাটা হাত বাড়িয়ে দেখে নিয়ে বললো,

এতো মেদিনীপুরের ঠিকানা! এও আমার আন্ডারে নেই, দেখছি কি করা যায়। ঋজু যদ্দুর মনে পড়ছে ছেলেটা কলকাতায় থাকে বলেছিলো তখন! তাই আমি ঠিকানা চেয়েছিলাম।

হ্যাঁ, এটা তো অরিজিনাল বাড়ির ঠিকানা, ও অবশ্য কলকাতাতেই থাকতো মেসে, কিন্তু সেই ঠিকানাটা আমার কাছে নেই।

অপর্ণার উত্তরে রবি খানিকক্ষন চিন্তা করলো,

আচ্ছা! তাহলে তো একটু ঝামেলা হয়ে গেলো! ছেলেটার ফটো আছে তোমার কাছে? সেটাও লাগবে আমার,

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

নাহ! ফটো তো নেই কিছু! ঠিকানায় হবে না?

রবি হাসলো,

শুধু ঠিকানায় হয়? ছেলেটির নাম কি ছিলো? ঋজু কে জিজ্ঞেস করলাম, সেতো নামটাও জানেনি তোমার কাছ থেকে বুঝলাম!

অপর্ণা একটু অস্বস্তি নিয়েই উত্তর দিলো,

হ্যাঁ, আসলে ও কখনো তো জিজ্ঞেস করেনি, তাই আমারও বলা হয়নি আর! ওর নাম সমর, সমর চৌধুরী!

রবি হা হা করে হাসলো, মজার গলায় বললো,

স্বাভাবিক! আমি হলেও করতাম না, বউয়ের প্রেমিকের নাম আবার কে জানতে চায়! তবে ফটো তো লাগবে, দরকার হলে আমাদের আর্টিস্ট কে পাঠিয়ে দেবো নাহয়, দেখা যাক আগে শুধু অ্যাড্রেসে হয় কিনা!

অপর্ণাও হেসে ফেললো, বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে বললো,

আসছি!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২৭
অপর্ণার মিতার বাড়ির অনুষ্ঠানে যাবার খবর যথা সময়ে মিনতির কাছ থেকে রীনার কানে পৌঁছালো, মিনতি সেই খবর মিতার বাড়ির কাজের মহিলার কাছে পেয়েছিলো। রীনা যদিও এই নিয়ে মিনতির সঙ্গে কোনো আলোচনা করলেন না, মনে মনে প্রবল রাগ হলেও মুখে সেকথা প্রকাশ করলেন না। তিনি নিজে ঘর পোড়া গরু, তাই এই বিভিন্ন অজুহাতে অপর্ণা এবং সৌমিকের সঙ্গে মিতার ঘনিষ্ঠতায় মনে মনেই শঙ্কিত হচ্ছিলেন।

তিনিও তো অল্প বয়সে এতটাই মূর্খামি করেছিলেন একসময়, বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন সবাইকে, তাঁর সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে যে রীতা সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোবে এটা তাঁর কল্পনার বাইরে ছিলো। এখনো চোখ বন্ধ করলেই সেই সব ভয়ংকর দিনগুলো তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে পা দিয়েই বুঝেছিলেন এখানে তাঁর কথার কোনো দাম নেই, শাশুড়িই বাড়ির সব। শ্বশুর মশাই ছিলেন না, মা ছেলের সংসারে তাঁর ভূমিকা ছিলো অনেকটা বাড়ির কাজের লোকের মতো। মাতৃভক্ত আশুতোষ তাঁর কোনো অপমানে, আঘাতে পাশে এসে দাঁড়ান নি কখনো।

যখন খুব খারাপ লাগতো, অপমান, অত্যাচার অসহ্য হয়ে যেত তখন তিনি বাপের বাড়ি চলে যেতেন, আবার যদিও কিছুদিন পরেই ফিরতে হতো কারণ সারাজীবন মেয়েকে রেখে দেওয়ার মতো স্বচ্ছল তাঁর বাবা, মা ছিলেন না। বউ শ্বশুর বাড়িতে থাকতে চায় না, সংসারে দেখার কেউ নেই, এই অজুহাতে যখন তাঁর শাশুড়ি রীতা কে বাড়িতে এনে আশ্রয় দিলেন তখন তিনি বোঝেন নি, যে তাঁর সংসার এবং স্বামী দুইই তাঁর হাতের বাইরে বেরিয়ে যাবে ক্রমশ। পর পর তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে যতো তিনি ব্যস্ত থাকতে লাগলেন, ততো শাশুড়ির প্রশ্রয়ে রীতা তাঁর সংসারের সর্বে সর্বা হয়ে উঠতে লাগলো।

রীতা এবং আশুতোষের কাছাকাছি আসা তাঁর চোখ এড়ায়নি, এবং তাতে তাঁর শাশুড়ির প্রবল ইন্ধন ছিলো। এই ভাবেই ছেলে, বৌমার মধ্যের সম্পর্কটা নষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। শেষের দিকে রীতার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে গেলে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আশুতোষও রীতার পাশে এসে দাঁড়াতেন, তাঁকে অপমান করতেন কথায় কথায়। ধীরে ধীরে সব কিছু ছেড়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন রীনা, মন দিয়েছিলেন ছেলে মেয়েকে মানুষ করায়। তাঁর সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোকে চোখের সামনে দেখে বড়ো হওয়া ছেলে মেয়েরা মায়ের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে একসময়, তাদের বড়ো হয়ে ওঠার পরে রীতাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন রীনা, কিন্তু আশুতোষের মনের ভেতর থেকে বার করতে পারেন নি কখনো।

আলাদা থাকলেও রীতার যাবতীয় খরচ আশুতোষই দেন, যদিও এটা রীনা অনেকটা বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছেন। এটা বন্ধ করতে গেলে যে রীতা তার সঙ্গে আশুতোষের সম্পর্কের কথা ছেলে মেয়ের কানে তুলে দিতে পারে সেই ভয় থেকেই রীনা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামান না। আশুতোষ কে মনে মনে তিনি ঘৃনা করেন, তাঁর টাকার প্রতি রীনার কোনো মোহ নেই, তাঁর মেয়ে, জামাই, ছেলে বউ নিয়ে সাজানো সংসারে আশুতোষের ভূমিকা নিতান্তই নগন্য।

মিনতি তাঁর অনেক বছরের কাজের লোক, মুখে তিনি সব কিছু আলোচনা না করলেও মিনতি তাঁর জীবনের অনেকটাই জানে। তাই সে যখন এসে জানিয়েছিল যে সে নিজের চোখে রীতাকে মিতার বাড়ির অনুষ্ঠান বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে তখন রীনা চিন্তায় পড়েছেন। মিতার সঙ্গে রীতার ঘনিষ্ঠতা অপর্ণা এবং তাঁকে একসঙ্গে বিপদে ফেলবে নাতো! রীতার সঙ্গে তাঁর বনিবনা ছিলো না বলে তিনি তাকে বাড়ি ছাড়তে বলেছিলেন এটাই তার ছেলে মেয়েরা জানে, কিন্তু রীতা যদি এই সুযোগে অপর্ণা কে কিছু বলে দেয় তাহলে তাঁর সমস্যাও বাড়বে বই কমবে না। এই বয়সে এসে তাঁকে কেউ কৃপার দৃষ্টিতে দেখবে এটা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।

সৌমিক গত কয়েকদিন ধরেই মায়ের মুখের পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলো, মনের মধ্যে আশঙ্কা কাজ করছে তার। অপর্ণার চোখেও শাশুড়ির গম্ভীর মুখ ধরা পড়েছে, গত কয়েকদিন ধরে ছেলে বউ কারোর সঙ্গেই রীনা ঠিক মতো কথা বলছেন না। অপর্ণা আগের দিন রাতেই সৌমিকের কাছে মুখে ভয় নিয়ে বলেছিলো,

জানো তো, আমার কেমন মনে হচ্ছে মা সব জেনে গেছেন! ওই জন্যে রেগে আছেন। আমি যেতে চাই নি তুমি জোর করে আমাকে পাঠালে!

সৌমিক অনেকটা নিজেকেই প্রবোধ দিয়েছিলো,

কি করে জানবে? তোমার সঙ্গে তো চেনা কারোর দেখা হয়নি! চুপ করে থাক কদিন, তারমধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে!

তাদের স্বামী, স্ত্রীর আলোচনার মধ্যেই রবি ফোন করেছিলো,

রসূল পুরের থানার অফিসার এর সঙ্গে কথা হলো বুঝলি তো! ওদের কাছে কলকাতার অ্যাড্রেস আছে, ওই দোকানদাররা দিয়েছিলো। কিন্তু ও মেসে নয়, একটা বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকতো। সেখানের মালিকের কাছে ওরা খবর দিয়ে এসেছিলো, এর বেশি আর কোনো খবর নেই!

সৌমিক হতাশ হয়েছিলো,

তাহলে?

রবি হেসেছিলো,

তাহলে আর কি! চল, তুই আর আমি একটা রবিবার দেখে মেদনীপুর ঘুরে আসি। ওখানের থানায় আমার কেউ পরিচিত নেই, তাই এটা আন অফিসিয়ালি করতে হবে।

ফোন রাখার পরে অপর্ণা হতাশ গলায় বলেছিলো,

এখন আর কিছু হবে না মনে হয়, অনেকদিন হয়ে গিয়েছে। ছেড়ে দাও, মেদনীপুর গিয়ে আর কাজ নেই। রবিবার একটা দিনই তো ছুটি, সেটাও তোমার আমার জন্যে যাবে এবার।

সৌমিক মাথা নেড়ে ছিলো,

নাহ! এটুকু দেখে আসি! তোমার জন্যে নয়, আমার জন্যেই। তুমি এই যে সারাক্ষন মনে মনে ওই ছেলেটার কথা ভাবো, এটার উত্তর না মেলা পর্যন্ত ওটা থামবে না!

সেই মতো আজ রবিবার সকালে অফিসের কাজে মেদনীপুরে যাওয়ার নাম করে রবির সঙ্গে ভোরবেলা ট্রেনে বেরিয়ে গেছে সৌমিক। যদিও কাল রাতে খেতে বসে মাকে সেকথা বলার পরে রীনা গম্ভীর হয়ে ছিলেন, তিনি কোনো কথা না বললেও রজত একটু অবাক হয়েছিলো,

রবিবারে তোমাদের মেদনীপুরের ব্রাঞ্চ খোলা থাকে নাকি! জানতাম না তো! খুব কম ব্রাঞ্চ খোলা থাকে রবিবারে, ওই সেন্ট্রাল এর দিকেও থাকে দু একটা শুনে ছিলাম। তবে এই গুলো তে কিন্তু খুব সুবিধা হয় তাই না?

মিথ্যে কথায় সৌমিক খুব বেশি পারদর্শী নয় কোনো কালেই, রীনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে মাথা নামিয়ে রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে মৃদু গলায় বলেছিলো

হুঁ!

আজ বাড়ি অনেকটাই খালি, সৌমিক ভোরে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষন পরে অনিন্দিতা বাপের বাড়ি গিয়েছে, ঋষি তাকে পৌঁছতে গিয়েছে, কাল সরাসরি অফিস করে ফিরবে। বাড়িতে লোক অনেকটাই কম। অনিন্দিতা না থাকায় রীনা নিজেই রান্নাঘরে ঢুকেছেন সকালে, দীপা আসার পরে তাকেও ডেকে নিয়েছেন। অপর্ণার দায়িত্ব রাতে, তাই সে নিজের ঘরে বই পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। বই খুলে বসলেও মনের ভেতরটা ছটফট করছে অপর্ণার, সৌমিক কে ফোন করে জানতে ইচ্ছে করছে কিছু হলো কিনা!

এই মুহূর্তে নিজের জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি নেই অপর্ণার, সৌমিক যথেষ্ট ভালো ছেলে, রীনা শাশুড়ি হিসেবে কড়া হলেও অনেকটা সৌমিকের জন্যেই তার প্রতি খুব বেশি কড়া হতে পারেন না, তাই সে নিজের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারছে। বাবাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ, তাই তাদের জন্যেও অতোটা চিন্তা আর হয়না অপর্ণার। শুধু মনের মধ্যে সব সময় একটা অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে থাকে, কোনো কোনো একলা থাকার মুহূর্তে, সমরের সঙ্গে কাটানো দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে আর বড্ড কষ্ট হয় তখন। একটা অনাথ ছেলে, যার কেউ ছিলো না, তার হত্যাকারী কে শাস্তি দিতে না পারলে মনের ভেতরে যেনো শান্তি নেই। বরাবরের জেদী, একগুঁয়ে অপর্ণার কাছে এটা যেনো একটা চ্যালেঞ্জ, যতো বার চোখের সামনে টুকরো করে কাটা বস্তায় বাঁধা শরীরটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে অপর্ণার ততবারই সেই চ্যালেঞ্জটা নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

তবে ইদানিং একটা অদ্ভুত জিনিস মনে মনেই অনুভব করে অপর্ণা, আগে যেমন চোখ বন্ধ করলেই ও মনে করতে পারতো সমর কে, আজকাল যেনো ছবিটা অনেকটা অস্পষ্ট। বন্ধ চোখের পাতায়, সমরের অস্পষ্ট মুখটাকে অবলীলায় সরিয়ে দিয়ে কেমন কেনো স্পষ্ট হয়ে ওঠে সৌমিকের মুখ, পুরনো স্মৃতি, পুরনো চেহারা বোধহয় সময়ের সাথে সাথে হালকা হয়! খাতার পাতায় আঁকি বুকি কাটতে কাটতে এসবই ভাবছিলো অপর্ণা, রবিদা যদি সত্যি আর্টিস্ট পাঠায় তাহলে ও ঠিক মতো সমর কে আঁকতে পারবে তো!

অপর্ণা চোখের ওপরে হাত রেখে শুয়ে পড়লো, পায়ের তলার খোলা জানলাটা দিয়ে রোদ আসছে, মিতাদের বাড়ির ছাদের আলসে তে রাখা গাছগুলো ঝিমিয়ে রয়েছে, কয়েকদিনের অযত্নের ফল বোঝাই যাচ্ছে। নিস্তব্ধ বাড়িটার ছাদের দরজাটা খোলা, দু একবার ভেজা জামা কাপড়ের বালতি হাতে কাজের মেয়েটিকে ঘুরে যেতে দেখলেও, মিতাকে একবারের জন্যেও দেখতে পায়নি অপর্ণা। ও কি ফিরে গেছে, নাকি আছে এখানেই! ওর মায়ের কি হবে এবার, কে দেখবে ওনাকে! এলোমেলো ভাবনাগুলো মাথায় ঘুরছিলো অপর্ণার, এমন সময় নিচের থেকে ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ এলো, সঙ্গে শাশুড়ির কাতর আর্তনাদের আওয়াজ।

অপর্ণা দৌড়ে নীচে নামলো, রান্না ঘরের জলে ভাসা মেঝেতে রীনা পা মুড়ে বসে আছেন, যন্ত্রণায় তাঁর চোখে জল এসে গেছে। দীপা আর রত্না মায়ের কাছে পৌঁছে গেছে ততক্ষনে, অপর্ণা নামতে নামতে ই মিনতি ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে এনে দাঁড়িয়েছে সামনে। ননদ এবং দীপার কথোপকথন থেকে অপর্ণা বুঝতে পারলো, হাতের জল ভর্তি গেলাস পড়ে গিয়েছিলো, সেটা তুলতে গিয়ে রীনা নিজেই তাতে স্লিপ করে পড়ে গেছেন। ফোলা গোড়ালিতে বরফ দিচ্ছিলো মিনতি, রীনা যথেষ্ট শক্ত মনের, যন্ত্রণা চেপে বসে থাকলেও তাঁর মুখে সেই যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠছিলো, কয়েক মিনিট সেটা লক্ষ্য করে অপর্ণা শাশুড়ির দিকে তাকালো,

এভাবে হবে না মা, চলুন হসপিটালে যেতে হবে!

রত্না মায়ের দিকে তাকালো,

তাহলে কি ঋষি কে ফোন করবো? নাহলে সঙ্গে যাবে কে?

রীনা যন্ত্রণা চেপে মাথা নাড়লেন,

নাহ! ওরা সবে ঘন্টাখানেক হলো বেরিয়েছে ওদের বিরক্ত কোরো না! কাউকে জানাতে হবে না, এটুকু নিজেরাই পারবো। অপর্ণা তুমি অ্যাম্বুলেন্স ডাকো!

অপর্ণা যাবার জন্যে তৈরী হয়ে ফোন করতে করতেই রত্না ছুটে নিজের ঘরে চলে গেলো, তাকেও যাবার জন্যে তৈরী দেখে রীনা বিরক্ত হলেন,

তুমি কোথায় যাচ্ছ? রজতের সঙ্গে থাকো!

রত্না মাথা নাড়লো,

না, আমি যাবো! দীপা আছে তো!

রীনা দাঁতে দাঁত চাপলেন,

দীপা আমার সঙ্গে যাবে, তুমি বাড়িতে থাকো! নিজের স্বামীর যত্ন নিজে নিতে শেখো, অন্যের ঘাড়ে দিও না!

রত্না খানিকক্ষন মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে, চোখের জল লোকাতে বাথরুমে ঢুকে গেলো, অপর্ণারও খারাপ লাগছিলো, ভদ্রমহিলা বড্ড রুড, এই অবস্থাতেও নিজের মেয়ের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করছেন।

হাসপাতালে পৌঁছে ইমারজেন্সি তে শাশুড়ির পায়ে প্লাস্টার করে ওনাকে রিসেপশনের সামনে রাখা চেয়ারে বসা দীপার পাশে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে অপর্ণা যখন ওষুধ পত্র নেবার জন্যে এগোচ্ছিল, তখন তাকে পেছন থেকে কেউ ডাকলো, চেনা গলার আওয়াজে পেছন ফিরেই অপর্ণা চমকে গেলো,

রবীন কাকু আর ওনার স্ত্রী!

রবীন বাবু সামনে এগিয়ে এলেন, জানালেন তাঁর বাবাকে এখানে ভর্তি করেছেন, তাই বেশ কয়েকদিন ধরেই তাঁরা সপরিবারে কলকাতায় হোটেলে থাকছেন। অপর্ণা তাঁদের শাশুড়ির সঙ্গে আলাপ করালো, জানালো বিয়ের পরে করা অনুষ্ঠানে ওনারাই থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

আপনারা গল্প করুন, আমি আসছি!

অপর্ণা ওষুধ আনতে চলে যাবার পরে রীনা রবীন বাবুর বাবার অসুস্থতার কথা জানতে চাইলেন, রবীন বাবু মাথা নাড়লেন,

আর বলবেন না! আর নতুন করে কি বলবো, আপনি তো সবই জানেন নিশ্চয়ই! ওই একটা ছেলে নিজে মরে সবার ক্ষতি করে গেছে! রমেন বাবু কেই দেখুন না, হবু জামাই এর মৃত্যুর খবরে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে বলার নয়। উনি তো তাও এখন অনেকটাই সুস্থ, চাকরি জয়েন করেছেন আবার কিন্তু আমার বাবা নিজেকে সামলাতে পারলেন না কিছুতেই।

রীনা মনে মনে চমকে উঠেও নিজেকে সামলে নিয়ে রবীন বাবুর দিকে তাকালেন,

ও আচ্ছা! আমি শুনেছিলাম বটে বিয়ের সময় কিন্তু অতো ডিটেলে জানতে চাইনি তখন।

রবীন বাবু ম্লান হাসলেন,

সেটাই তো স্বাভাবিক! আপনারা কলকাতার ভদ্র মানুষ, মানুষের দুঃখের জায়গায় কখনো ঘা দিতে চান না! আসলে অপর্ণার সঙ্গে যার রেজিষ্ট্রি হয়েছিলো সেই ছেলেটার কথা বলছি। ছেলেটি হটাৎ খুন হয়ে যাওয়াতে সবারই খুব অসুবিধা হয়েছে, অপর্ণার বাবা অসুস্থ হয়েছিলেন, আমার বাবারও তাই অবস্থা ছিলো। এখন তো আরো খারাপ, তবু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, ছেলে হয়ে তো আর ফেলে রাখতে পারিনা।

আরো কিছুক্ষন কথাবার্তার পরে মোটামুটি সবটা জেনে গেলেন রীনা, অপর্ণার আগে রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে হয়েছিলো এটা জানার পর তাঁর মাথা ক্রমশ আরো গরম হতে লাগলো। দীপা অবাক হয়ে শুনছিল, রবীন বাবু চলে যাবার পরে তিনি দীপার দিকে তাকালেন,

আমার বাড়িতে কাজ করার কতোগুলো নিয়ম আছে, মিনতি সেটা জানে, এখানে থাকতে গেলে তোমাকেও জানতে হবে। তুমি নিজের কাজ করবে, কোনো কথা কারোর সঙ্গে আলোচনা করার দরকার নেই। যদি শুনি তোমার মুখ থেকে কথা বেরিয়েছে তাহলে আমি তোমাকে বাড়ি চলে যেতে বলতে বাধ্য হবো।
ক্রমশ