#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৪২
রাতে রবিকে নামিয়ে দিয়ে বেশ বিরক্ত হয়েই ঘরে ঢুকেছিলো মিতা, মা দেরির কথা জিজ্ঞেস করায় বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেছিলো,
আমি কোথায় যাচ্ছি, কি করছি সব কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে নাকি?
মিতার মা অবাক হয়েছিলো,
কি হয়েছে তোর? এতো বিরক্ত হচ্ছিস কেন? কালও দেখলাম দেরিতে ফিরলি, আজও তাই, সেই জন্যেই জিজ্ঞেস করলাম। এতে এতো রাগের কি আছে?
মিতা মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো,
রবিকে বাড়িতে নামিয়ে এলাম, ওর গাড়ি ছিলো না আজ। শুনলাম কাল আমি দেরিতে ফেরায় তোমার সুবিধাই হয়েছে, অনেক প্রোফাইল দেখিয়েছো ওকে!
মিতার মা থতমত খেয়ে তাকিয়েছিলো, মা রবির ওপরে রেগে গেছে বুঝতে পেরে মিতা সামলে নিয়েছিলো,
রবির কোনো দোষ নেই, ও তোমার কথামতই বোঝাতে চেষ্টা করছে আমাকে। তোমাকে তো বলেছি বিয়ে করবো ঠিক আমি, একটু সময় দাও আমাকে। এতো তাড়াহুড়ো করছো কেনো?
মা কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে গেলো দেখে মিতা মায়ের পেছনে পেছনে ঢুকে এলো, বাবা চলে যাওয়ার পরে মাকে খুব বেশি আঘাত দিতে চায়না ও। মায়ের পাশে ঘনিষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বললো,
জাস্ট কয়েকটা দিন সময় দাও, তারপরেই সবটা বলছি তোমাকে। আর কাল আমি কোথায় গিয়েছিলাম জানতে চাইছিলে না একটু আগে? আমি রীতা পিসির বাড়ি গিয়েছিলাম, রীতা পিসি আমাকে ডেকেছিলো।
মিতার মা একটু অবাক হলো,
সেদিনই গেলি না ওর বাড়ি? আবার কাল কেনো? কিসের জন্যে ডাকছে তোকে ও বারবার?
মিতা সোফায় বসতে বসতে বললো,
রীতা পিসি খুব সমস্যায় আছে মা, সংসার নাকি চলছে না একদম! নেহাত বাড়িটা নিজের তাই, নাহলে কি যে হতো! এদিকে হেল্প নেবে না আমার কাছ থেকে, কিছু চাকরি বাকরি খুঁজে দিতে বলছে!
ও আবার কি চাকরি পাবে এই বয়সে? সেরকম কিছু পড়াশুনা জানে না তার ওপরে!
মায়ের কথায় মিতাও সায় দিলো,
হ্যাঁ মা, আমিও অনেক খুঁজছি, সেরকম সত্যি কিছু পাইনি। কি যে করি পিসির জন্যে কিছুই মাথায় আসছে না।
আমাদের পাড়ায় একটা আয়া সেন্টার আছে ওখানে কথা বলে দেখতে পারিস একবার!
হ্যাঁ, সেটা ভেবেছি একবার, কিন্তু রীতা পিসি কে আয়ার কাজ করতে বললে ওঁর আবার সম্মানে লাগবে নাতো? আমি তো ঋজু কেই বলবো ভাবছিলাম কিছু হেল্প করতে পারে কিনা। ওদের বাড়িতেই তো থাকতো, ওরও তো কিছু দায়িত্ব থাকা উচিত! রবিকেও বললাম কিছু করতে পারে যদি, রবি বললো ঋজুর সঙ্গে আলোচনা না করে ও কিছু করতে চায়না কারণ ঋজু রীতা পিসিকে পছন্দ করেনা।
ওই ছেলের ক্ষমতা আছে মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে রীতার জন্যে কিছু করার? ওকে বলেও কোনো লাভ নেই! আজ পর্যন্ত কোন কাজটা ও মায়ের অনুমতি ছাড়া করেছে? আর ঋজুর মা রীতার জন্যে ছেলেকে কিছু করতে দেবেই না! কিন্তু রীতার পয়সার সমস্যা হলো কেনো সেটাই তো বুঝতে পারছি না! এতকাল তো সব ঠিকই ছিলো।
মায়ের কথার উত্তরে মিতা জিজ্ঞেস করলো,
এতকাল রীতা পিসির কি করে চলতো মা? আমি কখনো জিজ্ঞেস করতে পারিনি লজ্জায়!
ঋজুর বাবাই তো খরচ দিতো জানতাম! এখন অসুস্থ বলে আর দেয়না হয়ত!
মিতা একটু চিন্তা করলো,
সেটা হতে পারে, তাই মনে হয় বিপদে পড়েছে! একটা কথা বলবো? তোমার তো সারাদিন সঙ্গে থাকার জন্যে কেউ হলে ভালোই হতো, আমিও অনেক চিন্তামুক্ত থাকতে পারতাম! রীতা পিসি কে তোমার দেখাশুনার জন্যে আসতে বলি, তাহলে ওঁর টাকা নিতেও অস্বস্তি হবে না আর তোমারও সুবিধা হবে!
পাগল নাকি তুই! ওর স্বভাব, চরিত্র একদম ভালো না, ওই দূরে দূরে আছে ওটাই ভালো। তাছাড়া ওর বড্ড পরের বাড়িতে গিন্নিপনার অভ্যেস আছে। শেষে আমাকেই ওর ইচ্ছে মতো চলতে হবে হয়তো!
মেয়ের কথায় তাড়াতাড়ি আপত্তি জানালো মিতার মা, মিতা অবাক হলো,
কি যে বলো! স্বভাব চরিত্র ভালো না মানে কি?
তুই এত বড়ো মেয়ে তোকে কি সব খুলে বলতে হবে? এটুকু বুদ্ধি কি তোর নেই যে কেউ কোনো তাড়িয়ে দেওয়া আশ্রিতাকে ফ্ল্যাট কিনে তার বাড়ি সাজিয়ে দেয়না! সারা জীবন তার সংসারের খরচ চালায় না! তখনই এরকম হয় যখন তাদের মধ্যে অন্য কোনো সম্পর্ক থাকে!
কি বলছো তুমি! মানে ঋজুর বাবার সঙ্গে ওর সম্পর্ক আছে! আমি তো ভাবতেও পারছি না! এগুলো ঋজু বা ওর দাদা, দিদি জানে?
জানলে তোর মনে হয় এটা এতদিন ধরে চলতো? এখন নেহাত আশুবাবু শয্যাশায়ী তাই রীতার এইরকম অবস্থা! সারাজীবন তো ফুর্তি করেই কাটিয়েছে! ওই বাইরে বাইরে যা করার কর, ওই ধরনের মহিলা কে যেচে বাড়িতে এনে তুলিস না! এরা খুব সাংঘাতিক সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোয়!
কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে মিতা বললো,
তুমি এগুলো জানতে আগেই! তাও ঋজুর সঙ্গে আমার বিয়েতে তোমার আপত্তি ছিলো না কখনো?
মিতার মা মুখ বিকৃত করলো,
ছাড় ওসব, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কি! তুই ঋজু কে বিয়ে করছিলি ওর বাবার সঙ্গে তোর কি সম্পর্ক? আর তখন মাসীমা বেঁচে ছিলেন, উনি থাকতে কি ঋজুর মায়ের কোনো কথা বলার ক্ষমতা ছিলো? রীতা ওখানে থাকলে তোর সুবিধাই হতো বরং, ঋজুর মা একদম কোণঠাসা হয়ে থাকতো তাতে।
কথাগুলো বলে মা চলে যাবার পরে মিতা চুপ করে বসে রইলো অনেকক্ষন, মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এই অনুভূতিটা অনেকটা শান্তির, শুধু ঋজুর মায়ের কথা মনে হচ্ছে! এই মহিলাকে হারানোর জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলো ও, এ তো আগেই হেরে বসে আছে! এই কথাগুলো যদি ঋজু জানতে পারে কখনো তাহলে কি ঠিক কি করবে ও! রবি এবং রীতা পিসির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ও চুপ করে থাকবে না, ওর বাবার কথাগুলো ওকে জানিয়ে দিয়ে ওর মায়ের সব বড়ো বড়ো কথা বলা বন্ধ করে দেবে। এতদিনে ও সত্যি জব্দ করতে পারবে ওই অহংকারী মহিলাকে!
আগামী সপ্তাহে একটা রবিবার দেখে রবি আর সৌমিক সমরের বাড়িওলার সঙ্গে দেখা করতে যাবে এরকমই কথা হয়েছিলো সেদিন।বেরোনোর আগে রবি দীপাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
আচ্ছা দীপা দি আপনি তো মেদনীপুরে গিয়ে সমর বাবুর নতুন বাড়ির ঠিকানা নিয়ে এসেছিলেন তাই না? ওটা একটু দেবেন তো একবার গিয়ে কথা বলবো!
দীপা ঘাড় কাত করেছিলো,
হ্যাঁ, স্যার! আমি তো গিয়েছিলাম, ওঁরাই তো খুন হওয়ার খবর আমাকে দিলেন, বললেন পুলিশ ওদের জানিয়েছে!
আজ সেই বহু প্রতীক্ষিত রবিবার, সকাল থেকে খানিকক্ষন বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে সৌমিক উঠে পড়েছিলো, রবি আর কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবে গাড়ি নিয়ে। এতো তাড়াতাড়ি রবিবারে সৌমিককে বিছানা ছাড়তে দেখে অপর্ণা অবাক হলো,
কি হলো আজ? এতো তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে?
সৌমিক হাসলো,
আজ আর আরামের সময় নেই, বউয়ের প্রেমিকের বাসস্থান খুঁজতে যেতে হবে!
অপর্ণা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
বলো নি তো আগে! কিছু এগোলো নাকি!
সৌমিক মাথা নাড়লো,
ধুস! কোনো খবর নেই! তাই জন্যেই তো পুলিশের দেওয়া ঠিকানায় ভাড়া বাড়িটা একবার ঘুরে আসি! দেখি কিছু মেলে কিনা! অন্য দিন তো রবি পারেনা, একমাত্র রবিবারই এগুলো সম্ভব হয়! ওর দিকটাও তো ভাবতে হবে!
অপর্ণা হাসলো,
রবিদা কিন্তু খুব ইন্টেলিজেন্ট! ভীষণ ম্যানেজ করে চলে সব দিক, কাউকে চটায় না! এদিকে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছে আবার মিতাদির মা নাকি ডেকেছিলো ওকে সেখানেও এসেছিলো সেদিন রাতে, মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলো দাঁড়িয়ে, আমি ওপর থেকে দেখছিলাম।
সৌমিক হাসলো,
ওর সমস্যাই সবচেয়ে বেশি! বেচারা! কোনদিকে যাবে ভেবে পায়না! সেদিন নাকি মিতার মা ওকে মিতার বিয়ের জন্যে ডেকেছিলো, কয়েকটা ছেলের খোঁজ পেয়েছে বোধহয়। বলছিলো মিতা নাকি বিয়ে করতে চাইছে না, তাই ওর মা ওকে লুকিয়ে ডেকেছে ওখানে!
অপর্ণা খাটে বসে পড়লো,
বিয়ে না করতে চাইলে খবর নিয়ে কি হবে! ওকি বাচ্চা মেয়ে নাকি, যে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে ওর?
জানিনা! জানার ইচ্ছেও নেই! রবি বলছিলো তাই শুনলাম! আসলে ওই বা কি করবে, এর গল্প ওকে করে আর ওর গল্প একে করে! ওই তুমি বলছিলে না সব দিক ম্যানেজ করে চলে তাই! ওখানে গিয়ে সমরের কথা বলে এসেছে মিতাকে! সেদিন তো সঙ্গে করে মেদনিপুরে নিয়েও চলে গেলো! বললেই বলবে মিতা কাউকে কিছু বলবে না! কি বলি বলো, ওর হেল্প তো আমিও নিচ্ছি! বলতে তো পারিনা তুই শুধু আমার সঙ্গেই বন্ধুত্ব রাখ!
অপর্ণার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো, মিতা এসব জানলে সত্যি কিছু এসে যাবে না, কিন্তু এই কথাগুলো তো বিশ্বাস করে বলেছিলো ও রবিকে! সেটুকু তো রবি দার ভাবা উচিত ছিলো অপর্ণার ভাবনার মধ্যেই ফোন করলো রবি, ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই আসছে জানিয়ে বললো,
একটা প্রবলেম হয়েছে বুঝলি, গাড়িটা কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছিলো না কাল রাতে ফেরার সময়, তাই ওটা গ্যারেজে দিয়ে আসতে হলো! রাতে মিতার গাড়িতে ফিরেছি, ভাগ্যিস ও দেরি করে অফিস থেকে বেরিয়েছিল। ও বলছিলো যদি তুই চাস তাহলে আজ ওর গাড়িটা নিয়ে বেরোনো যেতে পারে, কারণ তোর গাড়ি বার করলে তো আবার কাকিমা কিছু প্রশ্ন করবেন!
সৌমিক অপর্ণার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে বললো,
না, মিতার গাড়ি লাগবে না, চল আমরা উবের নিয়ে নেবো, তোর বাড়ির সামনে আসছি আমি!
রবি ফোন কেটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অপর্ণা বিরক্ত গলায় বললো,
মিতাটা বড্ড গায়ে পড়া তো! সব জায়গায় সঙ্গে যেতে চায় কেনো? আর রবি দাকে বলে দিও, এটা আমার ব্যাপার, আমি খুব বিরক্ত হচ্ছি মিতাকে সব কথা বলার জন্যে! তোমার ব্যাপারে ও যা খুশি বলুক, কিন্তু আমার কথা যেনো না বলে কিছু!
সৌমিক হেসে ফেললো,
মিতা আসলে একসময় আমাদের সঙ্গে সব জায়গায় যেতো, এখন না বলাটা রবির পক্ষে সমস্যা হয়ে যায়! নিজেকে ওর জায়গায় রেখে ভাবো ব্যাপারটা! সমস্যা মিতার আমার সঙ্গে হয়েছে, ও সম্পর্ক খারাপ করতে যাবে কেনো? আর উল্টোদিকের কথাটাও ভাবো, আজ যদি ও আমাকে অ্যাভয়েড করতো তাহলে কি আমি মিতার মতোই ক্ষুব্ধ হতাম না! যাকগে তোমার চিন্তা নেই, আমিই তো না বলে দিলাম ওকে, এবার এটা ওর মিতাকে জানাতে অসুবিধা হবে না! তবে তুমি এগুলো এখন বলছো কিন্তু তুমি নিজেও তো মিতা কে বলেছো অনেক কথা! আমি নাকি তোমাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাইনি!
অপর্ণা অস্বস্তিতে পড়লো,
এগুলো তোমাকে মিতা বলেছে তাই না? কখন বললো এসব? আমার খুব অদ্ভুত লাগছে মেয়েটাকে! একটা সাধারণ কথাকে কিরকম ঘুরিয়ে বলেছে দেখো! আমি ওরকম ভেবেচিন্তে কিছু বলিনি ওকে, ও জানতে চেয়েছিলো আমরা কোথায় গিয়েছিলাম হানিমুনে, তার উত্তরে এটা বলেছি!
সৌমিক হাসলো,
এতো সিরিয়াসলি নিওনা! আমারও প্রথমে খুব রাগ হচ্ছিলো তোমার ওপরে, পরে ভাবলাম কথাটার মধ্যে তো কোনো ভুল নেই! হতে পারে সময় সুযোগ হয়নি আমাদের, কিন্তু কথাটা তো মিথ্যে নয়! তবে সেটা কাউকে ক্লারীফাই করার দায় আমার নেই অন্তত! যে যাই ভাবুক না কেনো! এই কথাগুলো অবশ্য মিতা আমাকে বলেনি, রবি বললো ওকে বলেছে! রবি তো আবার বসে কথা বলতেও বলছিলো দুজনকে। বলছিলো তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক জানলে ওর নাকি জীবনে এগিয়ে যেতে সুবিধা হবে!
অপর্ণা অবাক হলো,
রবি দা আবার এর মধ্যে ঢুকতে চাইছে কেনো? ওর কিসের ইন্টারেস্ট? তুমি মিতাকে আমার সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানিয়ে দিলে ওর কি সুবিধা হবে?
সৌমিক উঠে পড়লো,
আর গল্প করার সময় নেই, দেরি হয়ে যাবে! আমার মনে হয় রবি মিতার জন্যে ছেলেগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে তো তাই। ও বলছিলো কলকাতায় ছেলে হলেই ভালো হতো!
রবির বাড়ি পর্যন্ত এসে উবের নিয়ে সমরের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ বেলা হয়ে গেলো। মালিক ভদ্রলোক বয়স্ক মানুষ, স্ত্রী কে নিয়ে দোতলায় থাকেন, নিচের তলায় সমর ভাড়া থাকতো। ওপর থেকে ফেলে দেওয়া চাবি নিয়ে দরজা খুলে ওরা ওপরে উঠে এলো, ভদ্রলোক জানালেন তাঁদের দুজনেরই হাঁটুর সমস্যা, সিঁড়ি ভাঙতে অসুবিধা হয়। কাজের মেয়েটি সব বাইরের কাজকর্ম করে দেয়, তালা খুলে ভেতরে ঢোকে এবং বন্ধ করে বেরোয়।
কতদিন এখানে ভাড়া ছিলেন সমর চৌধুরী?
অনেকদিন স্যার, প্রায় বছর তিন চারেক, নিজের বাড়ি বিক্রি করার পর পরই! বলেছিলেন আমাকে মালপত্র নিয়ে আসবেন বাড়ি থেকে!
রবির প্রশ্নে উত্তর দিলেন ভদ্রলোক।
মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন সমর বাবু?
সে আর আলাদা করে কি বলবো! আমার সঙ্গে তো বাড়িওয়ালা ভাড়াটের সম্পর্ক ছিলো। নিজের মতো থাকতেন, ওনার ব্যবসার পার্টনার ছাড়া আর খুব বেশি কেউ তো আসতো না! উনিও খুব বেশি বেরোতেন না বাড়ি থেকে! তবে আমার জন্যে যেটা জরুরি সেই ভাড়ার টাকা নিয়ে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি, নিয়মিত ভাড়া দিতেন।
ওনার মৃত্যুর পরে স্ত্রী কে ছাড়া আর কেউ এসেছিলো ওনার খবর নিতে?
মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন পরে তো পুলিশ খবর দিয়েছিলো, তার পর থেকে আর কেউ আসেনি। তবে উনি যেদিন প্রথম রাতে বাড়ি ফেরেন নি, তার পরের দিন সন্ধ্যের দিকে ওনার ঘরে একজনএসেছিলো, ঘরে ঢুকে কিছু কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলো।
ঠিক নিখোঁজ হবার পরের দিন যে ওনার ঘরে কেউ এসেছিলো সেটা আপনি নিশ্চিত করে বলছেন কি করে? আগে পরেও তো হতে পারে?
না, স্যার, আমার স্পষ্ট মনে আছে। কারণ নিচের বারান্দায় আলোটা সন্ধ্যে থেকে জ্বালা থাকে, রাতে শুতে যাবার আগে গ্রিলের গেট বন্ধ করে সেটা সমর বাবু নেভাতেন! পরের দিন ভোরে উঠে নিচের বারান্দায় আলো জ্বলতে দেখে আমি বুঝেছিলাম রাতে উনি বাড়ি ফেরেন নি। তখন অনেক কষ্ট করে নিচে গিয়ে দেখলাম তালা দেওয়া আছে ঘরে। তারপরে সম্ভবত বিকেলের পরে ওনার ঘরে ওই ভদ্রলোক এসেছিলেন, ঘরের তালা খোলা দেখে আমার কাজের মেয়ে ভেবেছিল সমর বাবু ফিরে এসেছেন নিশ্চয়ই!
আপনি ওনাকে নিজে দেখেন নি?
হ্যাঁ, দেখেছিলাম তবে তখন অন্ধকার ছিলো, আর আমি ছাদে দাঁড়িয়েছিলাম। ছাদে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে নিচে কে বেরোচ্ছে সেটা দেখার মতো চোখের জোর আমার নেই!
আপনি ওনাকে বেরোতে দেখে জিজ্ঞেস করেন নি কিছু?
হ্যাঁ করেছিলাম তো! যদিও আমি ওনাকে ঢুকতে দেখিনি প্রথমে, দুপুর বেলায় আমি খেয়ে উঠে একটু রেস্ট নি, বুঝতেই পারছেন আমাদের দুজনেরই বয়স হয়েছে! তাই উনি কখন ঢুকেছেন আমি জানিনা। আসলে তালা খুলে ঢুকেছেন তো তাই আরো আওয়াজ পাইনি! পরে বিকেলে আমার কাজের মেয়ে যখন ঢুকেছে তখন আমার গিন্নি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো সমর ফিরেছে কিনা। ও বলেছিলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো, তখন আমরা সমর ফিরেছে বলে ধরে নিয়েছিলাম।
তারপরে কি করে বুঝলেন উনি সমর নন?
ওইটুকু বুঝতে পারি স্যার! আমি আর আমার স্ত্রী চা নিয়ে ছাদের আলসেতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন উনি বেরোলেন। সমরের থেকে অনেকটাই লম্বা তাই মনেই হয়েছিলো সমর নয়। তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওপর থেকে, উনি বলেছিলেন, সমরের কিছু জিনিষ নিয়ে যেতে সমর ওনাকে পাঠিয়েছে!
আপনার কোনো সন্দেহ হয়নি?
কি করে হবে বলুন তো? উনি তো চাবি নিয়ে এসেছিলেন, তালা তো আর ভাঙেন নি, যে সন্দেহ করবো! ভেবেছিলাম সমর হয়ত সত্যিই ওনাকে পাঠিয়েছে, পরে যখন পুলিশ বললো যে ও খুন হয়েছে তখন আমার মনে হলো হয়ত কিছু গন্ডগোল আছে।
পুলিশ কে জানিয়েছিলেন এই কথাটা?
হ্যাঁ, জানিয়েছিলাম তো। কিন্তু পুলিশ বললো ও যেদিন বাড়ি ফেরেনি, সেদিনই যে ও খুন হয়েছে সেরকম প্রমাণ পুলিশের কাছে নেই, কারণ পুলিশ নাকি বেশ কয়েকদিন পরে বডি পেয়েছে সমরের। তাই ওইভাবে বলে কিছু লাভ নেই, হতেই পারে সমর কাউকে চাবি দিয়ে কিছু আনতে পাঠিয়েছিল।
সমরের পার্টনারের ছবি দেখলে চিনতে পারবেন?
হ্যাঁ, পারবো। দু একবার দেখেছি, আসতেন মাঝে মাঝে।
ঠিক আছে, আসি তাহলে। দরকারে আবার আসতে হবে হয়ত,
কথাগুলো বলে উঠে পড়লো রবি, পেছন পেছন সৌমিক। দোতলা থেকে নামতে নামতে রবি হাসলো,
রসুলপুর এর পুলিশ কোনো গুরুত্বই দেয়নি বুঝলি তো, তাহলে অন্তত কে এসেছিলো সমরের জিনিসপত্র নিতে এটুকু খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করতো। আসলে বেওয়ারিশ লাশ হলে যা হয় আর কি, কে আর যেচে ঘাড়ে ঝামেলা নিতে চায়।
সৌমিক অন্য মনস্ক গলায় বললো,
হুঁ, তবে এখন তো আর বেওয়ারিশ নয়, ওর টাকা গুলো হাতে পেতে গেলে দীপা দি কে সামনে আসতেই হবে, দরকার হলে ওকে দিয়েই নতুন করে ডায়েরি করাবো নাহয়।
ক্রমশ
#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৪৩
সোমবার অফিসে ভীষণ কাজের চাপ থাকে তাই সকাল থেকে একবারের জন্যেও মাথা তুলতে পারেনি সৌমিক। যখন একটু ফ্রি হলো তখন সাড়ে চারটে বেজে গেছে। মুখ তুলে দেওয়ালে লাগানো বড়ো ঘড়িটার দিকে তাকিয়েই অপর্ণাকে মেসেজ করে দিলো চলে যাবার জন্যে, আজ কোনো মতেই ও ঠিক সময়ে ওখানে পৌঁছতে পারবে না। আরো আধ ঘণ্টা পরে যখন ও অনেকটাই গুটিয়ে এনেছে এমন সময় বেয়ারা এসে ঢুকলো, সৌমিকের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
স্যার, একজন ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
ব্যাংকের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিলো, ওপরে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সৌমিক বিরক্ত মুখে বললো,
এখন! এখন তো আমি বেরোব, ওনাকে কাল আসতে বলো!
বেয়ারা কিছু বলার আগেই দরজা ঠেলে মিতা ভেতরে ঢুকে এলো, সৌমিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
সারপ্রাইজ! তুই তো দেখা করতে এলিনা, তাই আমিই চলে এলাম।
সৌমিক অস্বস্তিতে পড়লো, কি বলবে ঠিক করতে না পেরে নিজেই উঠে দাঁড়ালো,
ভালো করেছিস এসে, চল হয়ে গেছে আমার, বেরিয়ে পড়ি!
দ্রুত হেঁটে ব্যাংকের পেছনে এসে বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সৌমিক মিতার দিকে তাকালো,
কি বলবি বল! তোর তো গাড়ি আছে তাই না? অন্য কোথাও তো যাওয়া তাহলে সম্ভব হবে না, এখানেই বল দাঁড়িয়ে।
মিতা হাসলো,
গাড়ি নেই আজ, তোর সঙ্গে দেখা করবো বলেই নিয়ে আসিনি। যেখানে খুশি গিয়ে বসতে পারি কোনো অসুবিধা নেই।
অগত্যা সৌমিক মিতাকে বাইকের পেছনে তুলে নিয়ে অফিসের খানিকটা দূরে একটা কফি শপে ঢুকলো, টেবিলে বসে বললো,
বল কি বলবি? একটু তাড়াতাড়ি বল, কাল আবার একটু তাড়াতাড়ি অফিসে ঢুকতে হবে, বিকেলে একটু এক জায়গায় যাবার কথা আছে।
মিতা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললো,
শুনলাম রবির কাছে! সমরের পুরনো অফিসে যাবি তো? সত্যি যতো জানছি ততো অবাক হচ্ছি! তোদের স্ট্যান্ডার্ড আমি অনেক হাই ভাবতাম! এখন জানলাম তোদের বাড়ির আয়ার হাসব্যান্ড নাকি অপর্ণার এক্স বয়ফ্রেন্ড! তোর মা শুধু আমার থেকে তোকে দূরে সরাতে গিয়ে এ কি করলো?
সৌমিক এর মুখ অপমানে লাল হয়ে গেলো, মনে মনেই রবির ওপরে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলো ও। অপর্ণা ঠিকই বলেছিলো রবি যেনো সব কথা মিতাকে বলে দিচ্ছে! ওর সত্যি এর পেছনে কি ইন্টারেস্ট আছে কিছু! ইতিমধ্যে পাশের টেবিলে বসা দুজন অল্প বয়স্ক ছেলে মিতার কথা শুনতে পেয়েছিলো বোধহয়, তাদের কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে, সৌমিক নিচু গলায় বললো,
মিতা প্লিজ! আস্তে কথা বল! আমি জানি তুই এই কথাগুলো কেনো বলছিস। রবি আমাকে বলছিলো তোর সঙ্গে কথা বলার জন্যে, আমিই এইসব নিয়ে আর আলোচনা বাড়াতে চাইনি। হয়ত তুই তোর ফ্রাষ্ট্রেশন থেকে এগুলো বলে ফেলেছিস, তাই আমি কিছু মনে করছি না। প্লিজ, এই সব পুরনো কথা আর টেনে নিয়ে যাসনা, তুই নিজের জীবনটা নতুন করে শুরু কর আবার। আর একটা কথা দীপা দি আমাদের বাড়ির আয়া নন, উনি যথেষ্ট ভদ্র ফ্যামিলির মেয়ে, অবস্থার বিপাকে এই জায়গায় পৌঁছেছেন।
মিতা মাথা নাড়লো,
সেটা অবশ্য আমি জানিনা, হতেও পারে! তবে অপর্ণাদেরও তো খুব বেশি স্ট্যান্ডার্ড হাই নয়। বাড়িঘর তো নেই শুনেছি, কোয়ার্টারে থাকে নকি ওরা! শুনলাম কলকাতায় মামার বাড়ি থেকে নাকি বিয়ে দিয়েছিলো এসে। অবশ্য এটা তো তোদের বাড়িতে নর্মাল ব্যাপার শুনলাম কাল মায়ের কাছে, তোর মাও তো এরকম ফ্যামিলি থেকেই এসেছিলো তাই না? আর তোর বৌদি? ওরও তো একই অবস্থা, তাই তো? এগুলো জানতে পেরে তো অবাক হয়ে যাচ্ছি, তুই এত বছরে তো কখনো এগুলো বলিসনি আমাকে!
ইতিমধ্যেই কফি টেবিলে এসে পৌঁছেছিল, সৌমিক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে নিজেকে সংযত করে কফির কাপের দিকে ইশারা করলো,
বলার মতো কিছু ছিলো না তো এগুলো, মিছিমিছি বিতর্ক তৈরি করতে চাইছিস তুই, নে কফি খা!
মিতা কফি হাতে তুলে নিয়ে হাসলো,
শুনলাম অষ্ট মঙ্গলার পরে নাকি আর যাসনি তুই, থাকতে কি খুব অসুবিধা হয়েছিলো?
এগুলোও তোকে রবি বলেছে নাকি?
চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো সৌমিক, মিতা হাসলো,
আরে না, না, এগুলোর কোনোটাই রবি বলেনি। এগুলো তো রীতা পিসি একদিন বলছিলো মায়ের কাছে। মা শুনে বলছিলো আমি জোর বেঁচে গেছি, তোদের মতো সাব স্ট্যান্ডার্ড ফ্যামিলিতে বিয়ে না হয়ে।
সৌমিক কফির কাপটা নামিয়ে রেখে বললো,
রীতা পিসি বলেছে এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস তুই? রীতা পিসির সঙ্গে আমাদের এমন কিছু যাতায়াত নেই যে এসব কথা সে জানতে পারে। রবির সঙ্গে আমি কথা বলবো, জিজ্ঞেস করবো ওকে ও কেনো এইসব করলো। আর তোরই বা কি হয়েছে আজ, যেচে ডেকে নিয়ে এসে এসব করছিস কেনো?
মিতা সৌমিকের চোখের দিকে তাকালো,
সব ব্যাপারেই রবিকে দায়ী করিস না। ও কিছু কথা বলেছে মানেই যে সব ওই বলে এমন তো নয়। বলার লোক কম আছে নাকি? এসব গল্প তোর বাবা রীতা পিসিকে করেছে, রবি কিছু বলেনি।
সৌমিক অবাক হয়ে তাকালো,
বাবা বলেছে রীতা পিসিকে! রীতা পিসির সঙ্গে বাবার এসব কথা হলো কখন!
মিতা বিদ্রুপের হাসি হাসলো,
ওই যে তোকে একটু আগেই বলছিলাম না, তোদের সব কিছুই সাব স্ট্যান্ডার্ড! তোর বউ যেমন একজন আয়ার বরের সঙ্গে প্রেম করছিলো তেমনি তোর বাবাও রীতা পিসির মতো একজন সাব স্ট্যান্ডার্ড মহিলার সঙ্গে প্রেম করে। রীতা পিসিও তো তোদের বাড়িতে আয়ার মতোই ছিলো একসময় তাই না? নেহাত তোর বাবা ওকে তোর মায়ের সাবস্টিটিউট করে রেখেছিলো তাই ওকে আয়া বলে কেউ বুঝতে পারে নি! এতদিনেও যে তোরা কিছু বুঝিস নি সেটা জেনে আমারই অবাক লাগছে। এখন তো জানলাম ওই জন্যেই তোর মা রীতা পিসিকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলো। এমনকি তোর বাবা নাকি ওই ফ্ল্যাটটা রীতা পিসিকে গিফট করেছে, সব খরচও দেয় ওর। তোর বাবাই তো তাকে সব গোপন খবর সাপ্লাই দেয়, রীতা পিসি মায়ের সঙ্গে এসে গল্প করে, সেখান থেকেই তো আমরা জানতে পারি।
সৌমিক এর কাঁপা হাত থেকে কফি চলকে উঠে টেবিলে পড়লো, ও প্রায় চিৎকার করে বললো,
শাট আপ! বড্ড বাজে কথা বলে ফেলেছিস! মা যখন তোর সঙ্গে মেলামেশায় আপত্তি করতো তখন মায়ের ওপরে খুব রাগ হতো আমার, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মা ঠিক বলতো! আমি এখন বুঝতে পারছি তোর চাপের কাছে মাথা না নামানোর ডিসিশন নিয়ে আমি একদম ঠিক করেছিলাম। তোর যা মানসিকতা, এমনই তোর সঙ্গে সারাজীবন থাকা বোধহয় আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।
মিতা মুচকি হাসলো,
সেতো তোর মা আমাকে কখনই সহ্য করতে পারতো না, আমিও তোর মাকে পছন্দ করতাম না কখনো! সেগুলো ছেড়ে দে! আমিও তো জানতাম তোদের বাড়িতে তোর মায়ের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না কখনো। তাই যখন তুই দিল্লি আসতে চাইলি না তখনই আমি সম্পর্কটা শেষ করার কথা ভেবেই নিয়েছিলাম। তাই তুই অপর্ণাকে বিয়ে করেছিস জানতে পেরেও যে খুব খারাপ লেগেছিলো তা নয়। দেখ আমি চাকরি করি, অনেক কিছু আছে আমার জীবনে, তোকে বিয়ে না করলে যে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে এরকম কখনো মনে হয়নি। তখন যদি চাইতাম তাহলে তোকে বিয়ে করে বাধ্য করতাম যেতে আমার সঙ্গে, কিন্তু তাহলে অন্তত কদিন তো থাকতে হতো ওখানে। তাই মা, রীতা পিসি বারবার বলা সত্বেও আমি করিনি সেটা। এটাও বলতে পারিস তোর মায়েরই জিত হতো তাহলে। কিন্তু এখন বুঝলাম তোরা দুজনেই তো আসলে হেরেই বসে আছিস, আমি আবার তোদের নাকি হারিয়ে দেবার চেষ্টা করছিলাম।
সৌমিক স্তম্ভিত হয়ে মিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, মিতা একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো,
তোর মা যে নাকি সারাজীবন বরের নোংরামি সহ্য করে মুখ বন্ধ করে থেকেছে তার সঙ্গে আর কিসের কম্পিটিশন? সেতো একটা আয়ার স্ট্যান্ডার্ডের মহিলার কাছে হেরে গেছে, আর তাকে কিনা আমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছিলাম! আর তোরও তো প্রায় একই অবস্থা, সে এখন বুঝতে পারছি। তুই হয়ত ভেবেছিস আমি তোর জন্যে বিয়ে না করে আছি, কিন্তু সেটা ভুল ভেবেছিস! বিয়ে আমি অনেকদিন আগেই করে নিতাম কিন্তু তোর মাকে একটু টাইট না দেওয়া পর্যন্ত অন্য দিকে মন দিতে পারছিলাম না! সেজন্যে কতো কিছু প্ল্যানও করছিলাম! কিন্তু এখন এসব জানার পরে আর কোনো প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে নেই, তোর মাকে বলিস, আমার ওনার জন্যে করুণা হচ্ছে!
সৌমিক উঠে দাঁড়ালো, বাইরে বেরিয়ে এসে তাকে বাইক স্টার্ট করতে দেখে মিতা পেছনে পেছনে বেরিয়ে এলো,
যা শুনলি এবার মাথা ঠাণ্ডা করে চালাতে পারবি তো? নাকি উবের ডেকে পৌঁছে দেবো তোকে?
সৌমিক কোনো কথা বললো না, কিন্তু এই প্রথম বার সত্যি সত্যি হ্যান্ডেল ধরা হাতটা কাঁপছে। ঠিক মতো ব্যালেন্স করার আগেই বাইকটা খানিকটা হেলে গেলো। বাইকটা হেলে যেতেই সৌমিক আর ধরে রাখতে পারলো না, বাইকটা কাত হয়ে পড়লো সৌমিকের পায়ের ওপরে।বাইকটা বেশ ভারী, পায়ের ওপরে পড়াতে লেগেছেও বেশ,সৌমিক কে মাটিতে বসে পড়তে আশে পাশের দু একজন এগিয়ে এলো। খুব বেশি চোট না হলেও বাম পায়ের অনেকটা কেটে গিয়েছে, সেই জায়গাটা রাস্তার ধুলো আর রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। মিতা আর দাঁড়ালো না, ঘিরে ধরা লোকজনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে একটা উবের বুক করলো।
খানিকটা ধাতস্থ হয়ে সৌমিক যখন বাড়ি ফিরলো তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে, ইতিমধ্যেই অপর্ণা এবং ঋষি বাড়িতে ফিরে এসেছে। বেল বাজার আওয়াজে অপর্ণা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো, রত্না দরজা খুলে ছিঁড়ে যাওয়া প্যান্ট এবং পায়ে লেগে থাকা রক্ত দেখে চিৎকার করলো,
কি হয়েছে ভাই? বাইক অ্যাকসিডেন্ট করেছিস নাকি?
সৌমিক গম্ভীর গলায় সিড়িতে উঠতে উঠতে মাথা নাড়লো,
নাহ! সেরকম কিছু নয়, বাইকটা পায়ের ওপরে কাত হয়ে গিয়েছিলো।
ঘরের ভেতর থেকে ছেলের কথা শুনতে পেয়েছিলেন রীনা, তাই অপর্ণার দিকে ইশারা করলেন,
চা টা ওপরে নিয়ে যাও, এই পা নিয়ে এখন আর নিচে নামতে হবে না।
অপর্ণার অনেকক্ষন থেকেই যেতে ইচ্ছে করেছিলো ওপরে, ঠিক কতটা আঘাত লেগেছে জানার জন্যে মন ছটফট করছিলো, তাই শাশুড়ির কথা শোনা মাত্র রান্না ঘর থেকে চা ঢেলে নিয়ে বেরিয়ে এলো ও। অপর্ণা যখন চায়ের ট্রে হাতে দোতলার সিঁড়িতে পা রাখলো, ঠিক সেই মুহূর্তেই বেলটা বাজলো। রত্না এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই রবি হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে এলো, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,
ঋজু কেমন আছে এখন? খুব বেশি চোট লেগেছে নাকি? মিতা ফোন করে বললো আমাকে!
অপর্ণা কোনো উত্তর দেবার আগেই রত্না অবাক হয়ে রবির দিকে তাকালো,
মিতা কি করে জানলো রে রবি? ওর সঙ্গে ভাইয়ের কখন কথা হলো আবার?
রবি একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালো, নিচু গলায় বললো,
আমি ঠিক জানিনা রত্না দি, ও ফোন করেছিলো আমাকে কিন্তু আমার আর জিজ্ঞেস করা হয়নি।
বাড়ির সবার সংশয়ের দৃষ্টির সামনে রবি তাড়াতাড়ি অপর্ণা কে টপকে গিয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো। রবি কে আসতে দেখে অপর্ণা আবার রান্না ঘরে ফিরে গিয়ে আরেক কাপ চা নিয়ে এলো। চায়ের ট্রে হাতে ওপরে উঠে এসে দেখলো দরজা বন্ধ, ভেতর থেকে দুই বন্ধুর উত্তেজিত গলা ভেসে আসছে। অপর্ণা দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালো, ভেতর থেকে রবির গলা শোনা গেলো,
সব শুনেছি আমি! মিতা বলেছে আমাকে! আমারও খুব খারাপ লেগেছে ওর এই মানসিকতা, বলেছি সেটা ওকে! তবে তুই হটাৎ ওর সঙ্গে আলাদা করে কফি শপে বসতে গেলি কেনো? আমাকে ডাকতে পারতিস তো?
তোকে ডেকে কি করতাম? তাতে কি সত্যিটা আলাদা হতো কিছু?
সৌমিক মিতার সঙ্গে কফি শপে বসেছিলো! হটাৎ করেই নিজের অজান্তেই একটা খারাপ লাগা ঘিরে ধরলো অপর্ণাকে। কিন্তু কিসের সত্যির কথা সৌমিক বলছে! ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও, আড়ি পেতে শোনা যেহেতু তার স্বভাব বিরুদ্ধ তাই অপর্ণা আর দেরি না করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে এলো। ওকে দেখেই সৌমিক কথা বলা বন্ধ রেখে উঠে বসলো, হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নেওয়ার সময় অপর্ণা লক্ষ্য করলো সৌমিকের হাত কাঁপছে। অপর্ণা একটু অবাক হলো, সৌমিক সাধারণত বাইরের থেকে এসে হাত, পা না ধুয়ে বসেনা, আজ সে সেই একই রক্ত, ধুলো মাখা জামাকাপড়ে বসে ছিলো খাটে। অপর্ণা আঙুল তুলে ইশারা করে বললো,
একি! তুমি চেঞ্জ করোনি এখনো! প্যান্টে তো ধুলো, রক্তের দাগ লেগে আছে!
সৌমিক নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে কাপ নামিয়ে রেখে উঠে পড়লো, তাকে বাথরুমে ঢুকতে দেখে রবি কাপ হাতে বারান্দায় বেরিয়ে দাঁড়ালো। অপর্ণাও পিছু পিছু বেরিয়ে এলো,
রবি দা! কি হয়েছে?
রবি মাথা নাড়লো,
আমি জানিনা ঠিক! মিতা বললো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তাই এলাম!
অপর্ণা হাসলো,
তুমি আমার কথা মিতাদি কে বলে দাও, কিন্তু মিতাদির কথা আমাকে বলো না! এটা কিন্তু ঠিক নয়! বন্ধু না ভাবো, বোন তো ভাবতেই পার তাই না? আমিও জানতে চাই মিতাদির কোন মানসিকতা তোমার ভালো লাগেনি! কি সত্যি জানার কথা সৌমিক বলছে?
রবি একটু অস্বস্তিতে পড়লো, লজ্জিত গলায় বললো,
এটা কিন্তু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং অপর্ণা! আমি হয়ত মিতা কে বলে ফেলেছি সমরের কথাটা, কিন্তু সেটা খুব বড়ো ইস্যু ছিলো না। যে কথাটা তুমি আমাকে বলতে পেরেছো সেটা অন্য কেউ জানলে তোমার অসুবিধা হবার নয়, তাই না? আর পুলিশরা ও যে মানুষ সেটা তুমি জানো! তাও হয়ত বলতাম না যদি না সেই মুহূর্তে রবীন বাবুর ফোন আসতো!
অপর্ণা একটু গম্ভীর হলো,
আমিও তো তোমাদের কথা শুনেছি বলেই জানতে চেয়েছি মিতা কি বলেছে। আজ আমি জিজ্ঞেস করলাম বলে যখন সেটা কে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং বলে ঘুরিয়ে দিতে পারো, তাহলে মিতার ক্ষেত্রে সেটা পারলে না কেনো রবি দা? রবীন কাকুর ফোন কে অন্য কিছু বলে ঘুরিয়ে দেওয়া কি তোমার পুলিশি বুদ্ধির পক্ষে খুব বেশি অসম্ভব ছিলো? কিন্তু আমি জানি তুমি কেনো সেটা করোনি! ওই যে বললে না পুলিশ রাও মানুষ, সেটা একদম ঠিক বলেছো! আমার কেনো জানিনা মনে হচ্ছে বন্ধুত্বের বাইরেও তোমার মিতার প্রতি আলাদা সহানুভূতি আছে! হয়তো সৌমিকের সামনে সেটা প্রকাশ করতে তুমি লজ্জা পাও!
রবি হতচকিত মুখে অপর্ণার দিকে তাকালো, সে কিছু বলার আগেই অপর্ণা হাসলো, নিচু গলায় বললো,
তোমার বন্ধু বাথরুম থেকে বেরোনোর আগে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই রবি দা, আশাকরি এটা আমাদের দুজনের মধ্যেই থাকবে! তুমি হয়ত জানো না যে আমি জানি, সৌমিক এর সঙ্গে মিতার কি সম্পর্ক ছিলো! সেই জন্যে প্রথম থেকেই আমার কেনো জানিনা মিতার প্রতি সহানুভূতি ছিলো। মাঝে মাঝে ভেবেছি মিতা এখন সত্যি খুব একা হয়ে গেছে, ওর একজন ভালো বন্ধু দরকার, আর সেটা তোমার থেকে বেশি কেউ হতে পারে না। হয়ত তুমিও সেটা মনে মনেই ভেবেছো মুখে প্রকাশ করতে পারো নি। তাই বারবার ওদের দুজনকে মুখোমুখি বসে সবটা ক্লিয়ার করে নেবার কথা বলেছো। তবে আমার মনে হয়েছে সমরের কথা বলে দিয়ে তুমি ওর ক্লোজ হতে চাইলেও ও বোধহয় তোমাকে ব্যবহার করে আমাদের সম্পর্কের আসল সত্যি টা জেনে নিতে চেষ্টা করেছে মাত্র, ওর আসলে তোমার প্রতি সেরকম কোনো ফিলিংস নেই।
রবি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ম্লান হাসলো,
অপর্ণা! তোমার অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করতে পারছি না যদিও তবু এইটুকু বলতে পারি ব্যক্তিগত ভাবে তোমাদের দুজনের ক্ষতি হোক কখনো সেটা চাইনি! সেই টুকুই বলেছি যতটা বললে কোনো অসুবিধা না হয়, হয়ত কিছুটা স্বার্থ আমারও ছিলো। তবে আজ যা ঘটেছে সেটার পরে আমার মিতার প্রতি আর সত্যি কোনো সিম্প্যাথি নেই। তবে তুমি যতোই রিকোয়েস্ট করো এটা আমি কিছুতেই বলতে পারবো না! ঋজু সব জানে যদি বলতে চায় ওই বলবে! প্লিজ আমাকে এই বিষয়টায় জড়িয়ে ফেলো না, আমি শুধু মাত্র ঋজুর খবর পেয়ে ওকে দেখতে এসেছিলাম।
ক্রমশ