ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-৪৪+৪৫

0
120

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৪৪
গত কয়েকদিন ধরে অফিসে যাওয়া আসা বাদে নিচে নামছে না সৌমিক, তার কথায় অপর্ণা খাবার ওপরে নিয়ে আসছে। প্রথম দিন পায়ের ব্যথার কথা ভেবে রীনা আপত্তি না করলেও দ্বিতীয় দিন থেকেই যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছেন, দু একবার নিচে এসে খেতে বলার কথা বললেও সৌমিক আমল দেয়নি। অনিন্দিতা মাঝে মাঝেই রান্নার ফাঁকে ফাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছে অপর্ণাকে কিন্তু এই প্রথম অপর্ণার কাছেও এর উত্তর নেই। কিছু একটা বড়সড় ঘটনা যে ঘটেছে সেটা সেদিন রবির কথা তে বুঝতে পারলেও প্রকৃত কারণ জানা অপর্ণার পক্ষে সম্ভব হয় নি। ওও শঙ্কিত হয়েছে মনে মনে, মিতা কিভাবে সৌমিকের পড়ে যাওয়ার খবর জানতে পারলো এটা না জানা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছে না। ধৈর্য্য ধরতে না পেরে বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছে সৌমিকের কাছে কিন্তু সৌমিক নিরুত্তর থেকেছে।

বাড়িতে যে যার মতো করে সৌমিকের এই গম্ভীর থাকার কারণ ব্যাখ্যা করছে। যে রীনা বেশ কয়েকদিন যাবৎ অপর্ণা কে এড়িয়ে চলছিলেন রীতার বাড়ি যাওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই, সেই রীনাই বাধ্য হয়ে পায়ের চোটের জন্যে সৌমিক নিচে নামছে না ভেবে অপর্ণা কে ডেকে পাঠিয়েছেন রত্না কে দিয়ে, বলেছেন,

ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাও, দেখো পায়ের আসল অবস্থা কি! এরকম তো ও কখনো করেনি আজ পর্যন্ত!

অপর্ণা মাথা নেড়েছে,

জিজ্ঞেস করেছি ওকে, বলছে পা ঠিক আছে!

এই করতে করতে আজ চতুর্থ দিন, সৌমিক অফিস থেকে ফিরেই ওপরে উঠে গেছে কোনো কথা না বলেই। এই জন্যে মোটামুটি শান্ত বাড়িতে সারাক্ষন অশান্তির মেঘ, সেই অশান্তির ছায়া প্রত্যেকের মনেই পড়ছে। তারই ফল স্বরূপ মাঝে মাঝেই বিশেষ করে রীনার ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটছে। আজ রীনার প্লাস্টার কাটতে যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু বাড়ির এই পরিবেশে সঙ্গে কে যাবে সেই নিয়েই সমস্যা দেখা দিয়েছে। অপর্ণা আজ দুদিন ধরে ক্লাসে যাচ্ছে না, মনের ভেতরে প্রবল অশান্তি নিয়ে ক্লাস করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে।

কাল প্রায় মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে উঠে দেখেছিলো সৌমিক প্রায় রাত জাগা চোখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো। অপর্ণা বিরক্ত হয়েছিলো,

এই মাঝ রাতে সিগারেট খাচ্ছ? কখন উঠেছ? ঘুমাওনি নাকি?

সৌমিক দূরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,

তুমি ঘুমাও, আমার ঘুম আসছে না!

পাশে শোয়া একটা মানুষ জেগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে অন্য মানুষটার ঘুম আসে? কি হয়েছে পরিষ্কার করে বলছো না কেনো?

এতো রাতে অপর্ণার এই প্রশ্নে সৌমিক ধৈর্য্য হারিয়েছিল,

কিছু হয়নি বলেছি তো তোমাকে! বারবার জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর কিছু আলাদা হবে?

সারারাত আর কোনো কথা না বললেও অপর্ণার চোখেও ঘুম ছিলো না, তাই সৌমিক অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পরে আজ অপর্ণা ইচ্ছাকৃত ভাবেই একটু দেরি করে নিচে নেমেছিলো মনটা বিরক্তিতে ভরে ছিলো। নিচে নেমে দেখেছিলো শাশুড়ির পায়ের প্লাস্টার কাটতে যাওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ওকে দেখেই রত্না নিচু গলায় জিজ্ঞেস করেছিলো,

ভাই বেরিয়ে গেছে অফিসে? কি হয়েছে ওর বলছে কিছু?

অপর্ণা বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিয়েছিলো,

নাহ! বললে তো বলতাম তোমাদের!

অপর্ণার বিরক্ত মুখ দেখে রত্না আর ঘাঁটায় নি, মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,

তাহলে মা অপর্ণা বাড়িতে থাকুক, আমি আর দীপা তোমাকে নিয়ে যাই। রজত তো এখন সুস্থ হয়ে গেছে ওর অসুবিধা হবে না।

রীনা রাজি হওয়ায় রত্না মাকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে প্লাস্টার কাটিয়ে ফিরে এসেছিল, জানিয়েছিলো ডাক্তার খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করতে বারণ করেছেন কিছুদিন, বলেছেন ঘরের মধ্যেই চলাফেরা করতে।

মায়ের পায়ের প্লাস্টার কাটা হয়েছে বাড়ি ফিরে শোনার পরও সৌমিক নিচে নামেনি, পা কেমন আছে জানতেও চায় নি একবারও। সন্ধ্যের চায়ের আসরে আজ অনেকদিন পরে বাইরে এসে বসতে গিয়ে ছোটো ছেলেকে না দেখে রীনা ক্ষুব্ধ হলেন, অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন,

আমি কদিন অসুস্থ হয়েছি বলে কি বাড়ির নিয়ম কানুন সব নষ্ট হয়ে গেছে? ঋজু নিচে আসেনি কেনো? ওকে নিচে ডেকে নিয়ে এসো।

অপর্ণা ডাকতে গেলেও সৌমিক এলোনা, বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

নিচে যাবো না! চা ওপরে দিয়ে যাও!

অপর্ণার ডাকে সৌমিক নিচে না আসায় রীনা প্রবল বিরক্ত হলেন, বউয়ের দিকে তাকিয়ে রাগের গলায় বললেন,

এরকম তো ছিলো না ও! কদিন ধরে কি হয়েছে ওর? বাড়িতে বসে আছে, অফিস থেকে এসেও কোথাও বেরোচ্ছে না, নিচে নেমে এসে যে মায়ের পায়ের খবর টুকু নেবে সেটুকুও কি ভুলে গেছে? একবারও জিজ্ঞেস করেছে আমার পা প্লাস্টার কাটার পরে কেমন আছে?

রীনার উত্তেজিত গলার আওয়াজে সৌমিক দোতলার সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালো, কড়া গলায় মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

পা যে ভালো আছে সেতো দেখতেই পাচ্ছি, নাহলে নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এলে কি করে?

রীনা অবাক হয়ে তাকালেন,

কি রকম করে কথা বলছো তুমি! আজ কদিন ধরে কি হয়েছে তোমার? কোথায় কি করে অ্যাকসিডেন্ট করে এলে সেটুকুও ঠিক মতো বলছো না? এতো বছর ধরে আমরা এক সঙ্গে সবাই বসে খাওয়া দাওয়া করি, এগুলো তো তুমি জানো! তাহলে আজ চায়ের জন্যে তোমাকে ডাকতে হচ্ছে কেনো?

সৌমিক দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো, মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

কিসের নিয়ম কানুন? এগুলো তো সব তোমার তৈরি করা! তুমি কি তোমার কোনো কাজের জন্যে কখনো কাউকে কৈফিয়ত দিয়েছো যে আজ আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছো?

রীনা হতভম্ব হয়ে গেলেন, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রত্না এগিয়ে এলো,

কি হয়েছে তোর ভাই? এই ভাবে মায়ের সঙ্গে কথা বলছিস কেনো?

সৌমিক বিরক্ত হয়ে দিদির দিকে তাকিয়ে বললো,

তুই চুপ কর! আমি কি তোর সঙ্গে কথা বলছি? তোকে মাঝখানে ঢুকতে কে বলেছে?

রত্নার চোখে অপমানে জল এসে গেলো,

তুই এইভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছিস! তুই কি আমি এখানে আছি বলে বিরক্ত হচ্ছিস ভাই?

সৌমিক আরো দু পা সামনে এগিয়ে গেলো, দিদির দিকে তাকিয়ে বললো,

অপমান আমি তোকে করতে চাইনি, তুই যেচে হতে চেয়েছিস! আমি মায়ের সঙ্গে যখন কথা বলছি তখন তুই মন্তব্য করতে গেলি কেনো? তোর এই সব ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাওয়ার অভ্যেসটা ছাড় এবার! আগেও দেখেছি তুই সব ব্যাপারে বড্ড ইনভলভ হয়ে পড়িস!

আশুতোষ এতক্ষন চুপ করে বসে ছিলেন, এতক্ষনে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

তুই কি চাস ওরা চলে যাক! তাহলে সেটা পরিষ্কার করে বল, ওই ভাবে কথা বলছিস কেনো?

বাবার এই কথাটুকু যেনো আগুনে ঘি দিলো, সৌমিক বাবার দিকে ঘুরে বললো,

তোমাকে কেউ কথা বলতে বলেছে? এই যে তোমার মেয়ে জামাই আজ এতদিন এখানে আছে, বাবা হিসেবে তুমি ঠিক কি কি করেছো তাদের জন্যে? নিজে তো কিছু করোই নি উল্টে তোমার জন্যে একটা লোককে ব্যস্ত থাকতে হয় সব সময়। তোমার তো একটাই কাজ, শুয়ে বসে থাকা আর মাঝে মধ্যে দু একটা উস্কানি দিয়ে মন্তব্য করা! দিদি কে আমি কি একবারও চলে যেতে বলেছি যে তুমি এটা বললে! আর আমার ইচ্ছের মূল্য এই বাড়িতে আছে নাকি? যদি থাকতো তাহলে তো অনেক কিছু অন্য রকম হতো!

অপর্ণা এতক্ষন চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো, এই কথাটা শোনার পরে ওর মনের মধ্যে হটাৎ করে প্রবল কষ্ট হতে লাগলো। সৌমিক কি বলছিলো! ওর ইচ্ছে মতো কিছু হয়নি বাড়িতে! কোন ইচ্ছের কথা বলছে ও! ওকি মিতার সঙ্গে বিয়ে না হতে পারার কথা বলছে তাহলে! দুজনের কি আবার এ বিষয়ে কোনো কথা হয়েছে! সেই জন্যেই কি মিতা ওর অ্যাক্সিডেন্টের কথা জানে! অ্যাকসিডেন্ট এর সময় কি ও ও বাইকে ছিলো তাহলে!

ঘরে চলো! তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে!

হটাৎ করেই কড়া গলায় ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বললেন রীনা, সৌমিক বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালো,

কেনো? যা বলার এখানেই বলো! ঘরে যাবার কি আছে?

রীনা বিদ্রুপের দৃষ্টিতে তাকালেন,

এখানেই শুনতে চাও? পরে বলো না এগুলো আমার আলাদা করে বলা উচিত ছিলো!

কয়েক মুহূর্ত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সৌমিক ঘরে ঢুকে গেলো, রীনা পেছন পেছন ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। অপর্ণা পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে রইলো দেওয়ালে হেলান দিয়ে, শাশুড়ি যে মিতার ব্যাপারে কথা বলবেন সেটা ও বুঝতে পারছিলো। অপর্ণা কে ওই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনিন্দিতা এগিয়ে এলো, পাশে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বললো,

তুই সত্যিই জানিস না সেদিন কি করে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে ছিলো? রবি দা এসে বলছিলো মিতা নাকি ওকে জানিয়েছে! মিতা এসব জানলো কি করে রে? ওর সঙ্গে কি এখন ঋজুর আবার কথা হয়?

তুমি তো সবই জানো দিদিভাই, এখন এসব জিজ্ঞেস করছো কেনো? মিতার বাবার অসুস্থতার সময় থেকেই তো কথা হচ্ছে সৌমিকের সঙ্গে! আজ তো নতুন নয় সেটা!

বিরক্ত গলায় উত্তর দিলো অপর্ণা, অনিন্দিতা গলার স্বর আরো নামালো,

হ্যাঁ, কিন্তু সেসব তো অনেকদিন মিটে গেছে, এখন তো আর কথা বলার কোনো দরকার পড়ে না নিশ্চয়ই। তাই ভাবছিলাম মিতা কি করে জানলো এটা, ঋজু বাড়িতে কিছু না জানিয়ে ওকে হটাৎ জানাতে গেলো কেনো!

অপর্ণা আর কোনো উত্তর না দিয়ে ওপরে উঠে গেলো, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই বিভিন্ন জনের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে এখন। এমনিতেই ওর নিজের এখন কিছুই ভালো লাগছে না, তার ওপরে এতো প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে আরো বিরক্ত লাগবে।

দরজা বন্ধ করে ছেলের মুখোমুখি দাঁড়ালেন রীনা,

তুমি কদিন আগেই বলেছিলে আমাকে, তুমি মিতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছো না। তাহলে তোমার পায়ে চোট লাগার খবর ও কি করে পেলো? রবি বললো ও নাকি রবি কে খবর দিয়েছে!

সৌমিক বিদ্রুপের গলায় বললো,

ভাগ্যিস যোগাযোগ হলো! নাহলে তো জানতেই পারতাম না, যে তুমি মুখে সারাক্ষন এথিক্স এর কথা বলো সেই তুমি এতো বড়ো নোংরামি কে দিনের পর দিন প্রশ্রয় দিচ্ছ!

রীনা চমকে উঠলেন, অপর্ণার ওর বাড়ি যাওয়াতে কি রীতা সব মিতা কে বলে দিয়েছে তাহলে! তাই মিতা এগুলো ঋজু কে জানিয়েছে! তিনি ভীত মুখে তাকালেন,

কোন নোংরামির কথা বলছো? সেই খবর মিতা তোমাকে কি করে দিলো! কি জানে ও?

আমার মুখ থেকেই শুনতে চাও? আমাদের বাড়ির ব্যাপারে সব জানে ও, এমন অনেক কিছু যেগুলো আমিও জানতাম না এতদিন! এসব খবর শুনলাম ও রীতা পিসির কাছ থেকে পেয়েছে, আর রীতা পিসি যে এসব খবর পেয়েছে বাবার কাছ থেকে, এটা তুমি নিশ্চয়ই জানো! তাও আমার মুখ থেকেই শুনতে চাইছিলে যখন তখন বলে দিলাম। আরো কিছু খোলসা করে বলবো নাকি এতেই হবে?

রীনা খাটে বসে পড়লেন, তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছিলো। মাকে বসে পড়তে দেখে সৌমিক সামনে এসে দাঁড়ালো,

মিতা কি বললো জানো আমাকে? ও বললো তোমাকে জানিয়ে দিতে যে ও তোমাকে করুণা করে! ওর নাকি আর তোমার ওপরে কোনো রাগ নেই, শুধু করুণা আছে! তুমি জেনে শুনে নিজেকে এতো ছোটো কেনো করলে মা? তুমি চাইলে তো রীতা পিসির সঙ্গে বাবাকেও বাড়ি থেকে বার করে দিতে পারতে তখন, আমরা কি তোমাকে আটকাতাম?

রীনা কোনো উত্তর দিলেন না, ছেলের চোখে চোখ রাখতে না পেরে দেওয়ালের দিকে তাকালেন। মাকে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সৌমিক খাটে এসে বসলো, শক্ত গলায় বললো,

একটা কথা বলতে চাই! তখন যা হয়ে গেছে সেটা ভুলে যাও, হয়ত আমরা ছোটো ছিলাম বলে তুমি একা এই ডিসিশনটা নিতে পারোনি, কিন্তু এই নোংরামির কথা জানার পরে আমি অন্তত এক ছাদের তলায় ওই লোকটার সঙ্গে থাকতে পারবো না! আমি জানি দিদি এতে কোনো আপত্তি জানাবে না, আর দাদার তো তোমার সব ব্যাপারেই সমর্থন আছে! আমি ওদের কে জানিয়ে দিচ্ছি, আর তুমি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ওই লোকটাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলো। যদি যেতে না চায়, বলে বাড়িটা ওনার, সেক্ষেত্রে আমরা এখান থেকে কালকের মধ্যেই চলে যাবো।

রীনা অসহায় ভঙ্গিতে তাকালেন,

এতো গুলো বছর চলে গেলো এখন আর এসব করে কি হবে বলো? এই বয়সে এসে এসব জানাজানি হলে আমাদের কি হবে ভেবে দেখেছো? ঋষির শ্বশুরবাড়ি, তোমার শ্বশুরবাড়ি, রজত, কি বলবো এদের? আমাদের আর মান সম্মান বলে কিছু থাকবে না বাবা! ওদের সম্মান জ্ঞান নেই বলে কি আমাদেরও তাই? এখান থেকে গিয়ে যদি রীতার কাছে ওঠে তাহলে কি হবে ভেবে দেখেছো? গোটা পাড়ায় ছিছিক্কার পড়ে যাবে, মুখ দেখাতে পারবো না!

সৌমিক হাত তুললো,

আমার এতে কিচ্ছু যায় আসে না! এমনিতেও আজ মিতা, রবি জেনেছে কাল গোটা পাড়া জানবে! তাতে কি? আমার সম্মান অতো ঠুনকো নয় যে পাড়ার লোকের কথায় নষ্ট হবে। বরং এটা জেনেও যদি চুপ করে থাকি আর ওই নোংরা লোকটা বহাল তবিয়তে এখানে থেকে যায়, মরার পরে তাকে বাবা বলে মেনে নিয়ে তার শ্রাদ্ধ করতে হয় তাহলে আমার আরো খারাপ লাগবে। আমি আর একদিনও এর সঙ্গে থাকবো না, তুমি ওসব সম্মান চলে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার ওপরে ছেড়ে দিয়ে লোকটাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে দাও। তুমি তো বাড়িতেই থাকো, কারোর সঙ্গে দেখা হয়না, আমাদের বাইরে বেরোতে হয়, সম্মান গেলে আমাদের যাবে।

রীনা কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন, তারপরে হটাৎ ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললেন,

এই বয়সে একজন অসুস্থ মানুষকে বাড়ি থেকে বার করে দিতে পারবো না। যতোই হোক বাড়িটা তার, আর তুমি স্বীকার করো বা না করো যাকে তুমি ওই লোকটা বলছো, সেই লোকটাই এতদিন ধরে তোমাদের পড়াশুনা, খাওয়া দাওয়া, জামাকাপড়ের খরচ টেনেছে। তাকে বাবা হিসেবে সম্মান দিতে না পারলেও কৃতজ্ঞতা বোধটুকু থাকাই উচিত! আর তুমি যা জেনেছো সেটা নিজের মধ্যেই রাখো, বাকিদের জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই!

সৌমিক কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো,

তোমাকে আমি অন্য রকম ভাবতাম, আজ এই অন্যায়টাকে প্রশ্রয় দিয়ে তুমি আমার চোখে ছোটো হয়ে গেলে মা! আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাধ্য হয়েই এই নোংরামিটা মেনে নিয়ে রয়েছো এতদিন, তাই এটা বলেছিলাম। কিন্তু আজ বুঝলাম তোমারও কোনো স্বার্থ অবশ্যই আছে, যদিও সেটা কি আমি জানিনা, আর জানার ইচ্ছেও থাকলো না! তুমি যখন চাওনা তখন অন্য কেউ এটা জানবে না, তবে আমি একটা কথা বলে দিলাম এক্ষুনি, আমি কিন্তু ওই লোকটার সঙ্গে আর এক ছাদের তলায় থাকবো না।

মানে কি! তুমি এই বাড়িতে আর থাকবে না!

রীনার গলা কান্নায় বুজে এলো, সৌমিক মাথা নাড়লো,

নাহ! একটা সময় ছিলো যখন মিতা আমাকে ওর সঙ্গে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার জন্যে জেদ ধরে ছিলো, কিন্তু আমি যাইনি শুধু তোমার জন্যে। মনে হয়েছিলো তোমাকে একবার জোর করে মিতাকে বউ হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য করার পরেও যদি তোমাকে ছেড়ে আবার ওর জেদটাকেই প্রাধান্য দিই তাহলে তোমাকেই ছোটো করা হবে। ওকে বলেছিলাম, একবার যখন মা আমার কথা মেনে নিয়েছে, দ্বিতীয় বার তোকে মেনে নিতে হবে! কিন্তু ও মানে নি, তাই আমিও ওর জেদকে প্রশ্রয় দিইনি! আমার কাছে অন্যায় মানে অন্যায়, সেটা যেই করুক না কেনো! আজ তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি যাচ্ছিনা, কারণ সত্যি আমার ওই লোকটাকে বাড়ি থেকে বার করে দেবার ক্ষমতা নেই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্যায়টাকে আমি মেনে নেবো। আমার যেটুকু ক্ষমতা আছে আমি সেই টুকু করবোই, আমি আর এই বাড়িতে থাকবো না, আমি ট্রান্সফারের জন্যে চেষ্টা করবো, পরে বলো না আমি তোমাকে জানাই নি।

রীনা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন,

তোমার রাগ কমলে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো, আমি জানি তুমি বুঝবে। এগুলো তোমার রাগের কথা আসলে তুমি কখনোই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না।
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৪৫
গত মাস খানেকের প্রবল মানসিক টানা পোড়েন চলার পরে আজ কিছুটা শান্ত মন নিয়ে অফিসের কাজে মন বসিয়েছিল সৌমিক। ট্রান্সফারের অ্যাপ্লিকেশন জমা দেবার জন্যে লিখে ফেলার পর থেকেই ফেলে রাখা কাজ গুলো দ্রুত গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, যাতে রিলিজ নিতে খুব বেশি দেরি না হয়।

সেদিন সন্ধ্যে বেলা মায়ের ঘর থেকে ফিরেই মনস্থির করে নিয়েছিলো ও, আর এক বার স্থির করার পরে পেছনে ফিরে তাকানো সৌমিকের স্বভাব নয়। আজ থেকে বছর দেড়েক আগে এরকমই এক উত্তেজিত কথোপকথনের পরে মিতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ডিসিশন নিয়ে ছিলো যখন তখনও মনটা ঠিক এই রকমই শান্ত লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো প্রতিদিন চলতে থাকা এই অশান্তির থেকে সবটা পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে অদ্ভুত এক শান্তি আছে, তাতে প্রতি মুহূর্তে নিজের মনের সঙ্গে নিজে লড়াই করতে হয় না।

অপর্ণা যে ওর এই পরিবর্তনে খুব অবাক হয়েছে এবং আসল কারণ জানতে চাইছে সেটা বুঝতে পারলেও সৌমিক ধর্তব্যের মধ্যেও আনেনি, কিছু কথা থাকে যেগুলো নিয়ে বারবার আলোচনা শুধুই তিক্ততা বাড়ায়। এই এক মাসে রবি বেশ কয়েকবার ফোন করলেও ও ধরেনি, বারবার কেটে দিয়েছে। সব সময় মনে হচ্ছিলো রবির কাছ থেকে মিতা মনে হয় ওর মানসিক অবস্থাটা জানতে চাইছে। আজ নিজের মনকে শান্ত করার পরে নিজের ইচ্ছেয় রবিকে ফোন করলো সৌমিক, উল্টো দিকে রবির গলা পেয়েই হাসলো,

খুব অস্থির হয়ে গেছিস বোধহয়, বারবার জানতে চাইছিস আমি ঠিক কেমন আছি? মিতা তো তোকে খবরের জন্যে পাগল করে দিচ্ছে নিশ্চয়ই, ওকে বলে দিস এতদিনে ওর ইচ্ছে পূর্ণ হচ্ছে, আমি ট্রান্সফারের জন্যে অ্যাপ্লাই করছি।

তুই কি আমাকে মিতার চর ভাবিস? আমি শুধু দুজনের বন্ধু হতে চেয়েছিলাম, এটাই আমার ভুল ছিলো। তবে এবার একটা কথা স্পষ্ট করে মিতাকে জানিয়ে দিয়েছি ওর এই মানসিকতা জানার পরে সত্যিই ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার কোনো ইচ্ছেই আর আমার নেই। গত এক মাস ধরে আমি যে মিতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখিনি তুই জানিস সেটা? আমি তো তোকে সমরের ব্যাপারে ফোন করছিলাম এতদিন ধরে, কিন্তু তুই তো জেদ দেখিয়ে বসে ছিলি, একবারও ফোন ধরছিলি না। ওর পুরনো অফিসে ফোনে কথা হয়েছে, ওখানে আমাদের কে যেতে বলেছিলেন ওঁরা, কিন্তু তোকে কন্টাক্ট করতে পারিনি বলে যাওয়া হয়নি। ভেবেছিলাম তোর বাড়িতে যাবো, কিন্তু তুই যেখানে ফোনই ধরছিস না, সেখানে গেলে যে লাভ হবেনা সেটা জানি বলেই আর যাইনি, অপেক্ষা করছিলাম কবে তোর রাগ পড়ে দেখার জন্যে। ভালোই হয়েছে তুই নিজে থেকে ফোন করলি, যদি চাস তাহলে আজ বিকেলেই যেতে পারি, আমি ফ্রি আছি,

একটু দুঃখের গলায় বললো রবি, সৌমিক অস্বস্তিতে পড়লো,ও বোধহয় বেশি রুড ব্যবহার করে ফেলেছে রবির সঙ্গে! নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

ঠিক আছে, যাবো বিকেলে! সরি, কিছু মনে করিস না। মাথাটা খুব গরম হয়ে ছিলো এতদিন, কোনো কিছু ভালো লাগছিলো না।

রবি কোনো উত্তর না দিয়েই ফোন নামিয়ে রাখলো, ওর যে সত্যি খারাপ লেগেছে সেটা ওর বক্তব্য থেকে পরিষ্কার। কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে অপর্ণা কে ফোন করলো সৌমিক, তার ফিরতে দেরি হবে শোনার পরে অপর্ণা বললো,

আজও কি এমন কিছু কাজ আছে যার কৈফিয়ত চাওয়া যাবে না?

সৌমিক হাসলো,

নাহ! আজ একটু রবির সঙ্গে বেরোব, বন্ধুদের সঙ্গে অনেকদিন আড্ডা মারা হয়নি।

যাক! ভালো লাগলো শুনে! যা গম্ভীর মুখ করে ছিলে এতদিন ধরে, কি হয়েছিলো কে জানে! যাও, ভালো করে আনন্দ করে এসো, মন ভালো হয়ে যাবে,

খুশি খুশি গলায় বললো অপর্ণা, সৌমিক কিছু উত্তর দেবার আগেই রাজীব ঘরে ঢুকে এলেন, তাঁকে ঢুকতে দেখে সৌমিক পরে আবার কথা বলবে জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলো। রাজীব উল্টোদিকে চেয়ার টেনে বসে একটু অবাক গলায় বললেন,

শুনলাম তুমি নাকি ট্রান্সফার নিচ্ছ? কি অসুবিধা হচ্ছে তোমার এখানে, আমাকে বলো?

সৌমিক হাসলো,

আরে! না, না, অসুবিধা কিছু নয়, আমি তো আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ট্রান্সফার নিচ্ছি, বলতাম আপনাকে। এখনও ফাইনাল কিছু হয়নি!

প্রয়োজন তো কিছুদিন ছুটি নাও, কিন্তু ট্রান্সফার নিও না। তোমার মতো ছেলে চলে গেলে আমাদের ক্ষতি হবে। তোমার কতদিন ছুটি লাগবে? তুমি নিয়ে নাও, আমি এদিকটা ম্যানেজ করে নেব,

প্রায় নাছোড়বান্দা রাজীবের বারবার অনুরোধে সৌমিক একটু আতান্তরে পড়লো। কলকাতা ছেড়ে সে কেনো যেতে চায়, এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন আলোচনার পরেও রাজীব সন্তুষ্ট করতে না পেরে সৌমিক শেষ পর্যন্ত হাসলো,

আচ্ছা! আমি দেখছি ভেবে একটু! জানাবো আপনাকে পরে।

রাজীব যখন উঠলেন তখন পাঁচটা বেজে গেছে। চট করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে পড়লো সৌমিক, এবার না বেরোলে রবির ওখানে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। রবি ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিলো, আর কোনো পুরনো আলোচনা টেনে না এনে বাইকের পেছনে বসে বললো,

চল! দেখি এবার কতোটা কি জানা যায়, এমনিতেই কাজটায় তোর জেদের জন্যে প্রায় মাস খানেক পিছিয়ে গেলাম।

ধর্মতলার এই ট্রাভেল এজেন্সিটা বেশ পরিচিত, ভ্রমণ জগতে যথেষ্ট নাম ডাক আছে। খুব বেশি জিজ্ঞেস করার দরকার পড়লো না, খুব সহজেই পৌঁছে গেলো ওরা। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে সাজানো রিসেপশন, চারিদিকে ভারত তথা বিদেশের বিভিন্ন ভ্রমণ স্থানের ছবি লাগানো। কাঁচের দরজা দিয়ে একজন শাড়ি পড়া সুবেশা তরুণী কে দেখা যাচ্ছে। রবি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো, পেছন পেছন সৌমিক, ওদের দেখে তরুণী মুখ তুলে তাকালো, মিষ্টি কেজো হাসি হেসে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললো,

আসুন স্যার! পুজোর বুকিং শুরু হয়ে গেছে আমাদের। কোথায় যাবেন স্যার?

রবি টেবিলের ওপর দু হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়ালো,

আমি মাস খানেক আগে ফোন করেছিলাম সমর চৌধুরীর ব্যাপারে খোঁজ নিতে। উনি এখানেই কাজ করতেন তো?

মেয়েটি সোজা হয়ে উঠে বসলো,

হ্যাঁ স্যার মনে পড়েছে, আমিই ধরে ছিলাম ফোনটা, আপনি আসবেন বলেছিলেন। এতদিন আসেন নি দেখে ভাবলাম আর বোধহয় আসবেন না। উনি এখানেই কাজ করতেন, ছেড়ে দিয়েছেন প্রায় বছর তিন চার আগে! তবে এখন কোথায় থাকেন জানি না!

কেনো ছেড়েছিলেন?

মেয়েটা হাত তুললো, উল্টো দিকের চেয়ারে বসে থাকা বেয়ারার দিকে ইশারা করে বললো,

ত্রিদিবদা কে ডেকে দাও! বলো যাঁর কথা বলেছিলাম তিনি এসেছেন।

বেয়ারা চলে যাবার পরে মেয়েটি সামনে রাখা চেয়ারের দিকে ইশারা করলো,

বসুন স্যার, ত্রিদিবদা এক্ষুনি আসবেন, আমি ওনাকে বলে রেখেছিলাম আপনার ফোনের কথা তখন। আসলে আমি নতুন জয়েন করেছি স্যার, সমর চৌধুরীকে কখনো দেখিনি। একমাত্র ত্রিদিব দা বলতে পারবেন, উনিই সবচেয়ে বেশি দিন আছেন এখানে!

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ত্রিদিব বাবু এলেন, হাত জোড় করে জানালেন তিনি পুরনো কর্মী এবং মোটামুটি নতুন, পুরনো সবাইকেই চেনেন। সমর চৌধুরী কেও খুব ভালো করে চিনতেন, তাঁরা দুজনেই প্রায় এক সময়েই এখানে যোগ দিয়েছিলেন।

আপনি ঠিক কতো বছর আছেন ত্রিদিব বাবু?

রবির প্রশ্নে ত্রিদিব বোস হাসলেন,

একদম জন্মলগ্ন থেকেই বলতে পারেন। আমিই এখানের প্রথম কর্মী, আমার ঠিক মাস তিনেক পরেই সমর জয়েন করেছিলো।

সেটা কতো দিন আগের কথা?

ত্রিদিব এর বোধহয় মুখস্থ ছিলো,

প্রায় এগারো বছর আগে স্যার! তখন আমার বা সমর কারোরই বিয়ে হয়নি। সমরের বিয়েতেও আমি গিয়েছি।

রবি সোজা হয়ে বসলো,

তার মানে আপনি দীপা দেবীকে চিনতেন?

হ্যাঁ, স্যার! খুব ভালো করে চিনতাম। সমর আমার ভালো বন্ধু ছিলো! ওর যখন স্ত্রীর সঙ্গে গন্ডগোল চলছিলো আমি ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি স্যার।

ডিভোর্স যে হয়ে গিয়েছিলো সেটা কি আপনি জানতেন?

হ্যাঁ জানতাম! তাতে অবশ্য আমি দীপার খুব বেশি দোষ দেখিনি। ওরকম একগুঁয়ে মানুষের সঙ্গে কে থাকবে বলুন তো? বড্ড জেদ ছিলো, যা মনে হতো তাই করতো কারোর কথা শুনতো না। ভীষণ টাকার নেশা ছিলো, সব সময় আরো বড়লোক হতে চাইতো ও।

ওনার বাড়িতে কে কে ছিলো? স্ত্রী, মেয়ে বাদে?

কেউ ছিলো না স্যার, বাবা, মা ছোটো বেলাতেই মারা গিয়েছিলো। তাই তো এইরকম জায়গায় কাজ পেতে সুবিধা হয়েছিলো। আমরা ট্যুর করি সারা বছর, পিছুটান থাকলে সমস্যাই হয়। এখন আমারই পরিবার হয়ে যাবার পরে কতো সমস্যা হচ্ছে। ওরও তো বিয়ের পরে এসব নিয়েই গন্ডগোল শুরু হয়েছিলো প্রথমে, বড্ড টাকার নেশা ছিলো তো! ট্যুরে যাবার সময় বউয়ের হাতে এক্সট্রা কিছু দিয়ে যেতনা, এই নিয়ে ওর বউ একবার মালিকের কাছে কমপ্লেইনও করেছিলো স্যার।

এসব তথ্য আগেই দীপার কাছ থেকে পেয়েছিলো রবি, তাই নতুন প্রশ্নে ফিরলো,

পেশা নিয়ে বলুন কিছু, কতোটা এফিসিয়েন্ট ছিলেন উনি?

ত্রিদিব উচ্ছসিত হলেন,

এই একটা ব্যাপারে ভীষণ তুখোড় ছিলো সমর, লাইনটা খুব ভালো বুঝতো! বহু বার গিয়ে গিয়ে হোটেল মালিক, গাড়ি সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছিল, মালিকও ভীষণ ভরসা করতেন ওকে।

চাকরিটা ছেড়ে দিলেন কেনো তাহলে?

রবির প্রশ্নে ত্রিদিব মাথা নাড়লেন, গলায় আফসোসের আওয়াজ করে বললেন,

ওই যে বড়লোক হওয়ার নেশা স্যার! একবার মাথায় ব্যবসার ভুত চাপলো! অনেকবার বলেছি একা মানুষ এসবে যেও না! কি করবে অতো টাকা! শুনলো না, পার্টনারও পেয়ে গেলো একজন!

সৌমিক এতক্ষন এক মনে রবির জিজ্ঞাসাবাদ শুনছিল, এবার একটু উত্তেজিত হয়ে বললো,

পার্টনারকে চিনতেন নাকি আপনি?

ত্রিদিব একটু গর্ব নিয়েই হাসলেন,

হ্যাঁ, আমরা দুজনেই মোটামুটি একসঙ্গে একটা গ্রুপ নিয়ে যেতাম! আমাদের বোঝাপড়া ভালো ছিলো, তাই সুবিধা হতো! মালিকও তাই চাইতেন। ও আমার সঙ্গে সব কথা শেয়ার করতো স্যার। এরকমই একটা গ্রুপে একবার একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ছিলেন, ওনার সঙ্গে ওনার ভাগ্নে! ছেলেটি বেশ মিশুকে আমাদের ট্যুরে গিয়ে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন সমস্যা হয় সেখানে বেশ হেল্প করছিলো।

রবি হাসলো, মজার গলায় বললো,

টুরিস্টদের দিয়ে কাজও করান নাকি আপনারা? আমি তো আমার এই বন্ধুকে আপনাদের সঙ্গে হানিমুনে পাঠাবো ভাবছিলাম! কিন্তু কাজ করালে তো যাওয়া যাবে না দাদা!

ত্রিদিব লজ্জিত হলেন,

আরে না, না! সেরকম কাজ নয়। প্রায় পনেরোদিনের ট্যুর তো! কতো ধরনের মানুষ যায়। তাদের যে কতো রকমের বায়নাক্কা, ভাবতেও পারবেন না স্যার!

তাই নাকি! তা সেই ছেলে আপনাদের কিরকম সাহায্য করতো?

ত্রিদিব একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালেন,

আমি ঠিক ওই রকম বলতে চাইনি স্যার! ছেলেটি আসলে বেশ এক্সপার্ট ছেলে ছিলো, আমাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতো বেড়াতে গিয়ে। সাধারণত বিভিন্ন কমপ্লেইন হয় সবার, অনেক ঝামেলা থাকে, বিভিন্ন রকমের মানুষ এক সাথে যান! কেউ মাছ খান তো কেউ নিরামিষ, কেউ আবার সময়ে তৈরি হয়ে যান, তো কেউ ঘুম থেকেই ওঠেন না। এসব লক্ষ্য রাখতে গেলে অন্য দিকে চাপ হয়ে যায়। সেই সময় বেশ হেল্প করার মতো কেউ যদি গ্রুপের মধ্যে থাকে তাহলে সুবিধাই হয়! আমাদেরও হয়ে ছিলো। মিশে গিয়েছিলো আমাদের সঙ্গে তারপরে ওই সমরের মাথায় ব্যবসার ভুত ঢোকালো! চাকরি ছেড়ে, টাকা নিয়ে সমর শেষ পর্যন্ত ব্যবসা করতে নেমে পড়লো!

ওনার সঙ্গে ব্যবসার কথা বলছেন তো? মানে ওই ছেলেটি সমরের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা করার কথা বলেছিলো সমর কে?

ত্রিদিব বাবু হাত তুললেন,

না, না স্যার! ব্যবসা তো ছেলেটার মামার ছিলো, মানে সেই বয়স্ক ভদ্রলোকের। যাঁর সঙ্গে ও বেড়াতে এসেছিলো।

আচ্ছা! তারমানে ওই বয়স্ক ভদ্রলোক সমরের পার্টনার ছিলেন, তাই তো? তাঁকে তো তারমানে আপনি চেনেন? দেখলে কি চিনতে পারবেন?

ত্রিদিব ঘাড় কাত করলেন,

হ্যাঁ চিনি তো! তবে সেতো প্রায় চার পাঁচ বছর আগের কথা! তখনই তো উনি বেশ বয়স্ক ছিলেন, এখন বেঁচে আছেন কিনা কে জানে!

আচ্ছা! কতো বয়স ছিলো ভদ্রলোকের? আর ওনার ভাগ্নের?

তখনই প্রায় সত্তর হবে স্যার, আর ছেলেটির তো বছর সাতাশ, আটাশ!

বেশ খানিকটা চিন্তা করে বললেন ত্রিদিব, রবি হেসে ফেললো,

চার পাঁচ বছরে সত্তর বছরের ভদ্রলোক মারা যাবেন কেনো মনে হলো আপনার?

ত্রিদিব একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালেন,

আসলে যদ্দুর মনে পড়ছে উনি মারা গেছেন বলেই সমরের কাছে শুনেছিলাম স্যার!

আচ্ছা! তাই নাকি! তাহলে তো খুব বেশি দিন আগের কথা নয়! আপনার সঙ্গে তো তারমানে সমরের যোগাযোগ ছিলো! কবে শেষ যোগাযোগ হয়েছিলো সমরের সঙ্গে আপনার?

ত্রিদিব এর দিকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো রবি। ত্রিদিব বোধহয় সেটা বুঝতে পারলেন, তাড়াতাড়ি করে উত্তর দিলেন,

না, না স্যার, যোগাযোগ ছিলো না মাঝে। ওই চাকরি ছাড়ার পরে কিছুদিন, তারপরে যা হয় দুজনেই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম! তারপরে হটাৎ করে বছর খানেক আগে একবার ফোন করেছিলো দেখা করার জন্যে। বললো, ব্যবসা ওর দ্বারা হবে না, ওসব অনেক ঝামেলার ব্যাপার। পার্টনারও নাকি মারা গিয়েছে, তাই ব্যবসা তুলে দিয়ে আবার চাকরিতে ফিরতে চায়, মালিকের সঙ্গে কথা বলতে! আমি বলেও ছিলাম কিন্তু আর যোগাযোগ করে নি, ফোন ও বন্ধ ছিলো! তারপর তো শুনলাম ও নাকি মারা গেছে!

বাই এনি চান্স ওই পার্টনারের নাম কি প্রসাদ মিত্র?

মনে করতে পারছি না স্যার! বছরে গোটা কুড়ি ট্যুরে কতো কতো টুরিস্ট নিয়ে যাই! আজ প্রায় এগারো বছর এই লাইনে আছি! কতো নাম মনে রাখবো!

ঠিক আছে, যদি মনে পড়ে তাহলে অবশ্যই জানাবেন,

বলে নিজের একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে রবি উঠে পড়লো, পেছন পেছন সৌমিক। যখন কাঁচের দরজা ঠেলে বেরোচ্ছে ওরা, তখন ভদ্রলোক পেছন থেকে ডাকলেন,

এক মিনিট স্যার! আমাদের সব ট্যুরের শেষ দিনে একটা গ্রুপ ফটো তোলা হয়! সেটাতে নিশ্চয়ই থাকবেন উনি! সেই সময়ও তোলা হয়েছিলো নিশ্চয়ই! ছবিটা দেখাতে পারি কিন্তু নাম বলতে পারবো না!

রবি আর সৌমিক থমকে দাঁড়ালো, কিছুক্ষনের মধ্যেই ভদ্রলোক বেশ কয়েকটা বড়ো আলব্যাম নিয়ে হাজির হলেন, যেখানে প্রতি বছরে করা ট্যুরের শেষ দিনের ফটো গুলো বছর হিসেবে আলাদা আলাদা অ্যালবামে সাজানো আছে। টেবিলের ওপরে রেখে বললেন,

প্রায় চার পাঁচ বছর মতো হিসেব করে নিয়ে খুঁজতে শুরু করুন! কোথাকার ট্যুর ছিলো সেটাও মনে নেই স্যার! সবাই কে হাত লাগাতে হবে! শুধু সেগুলোই খুঁজুন যেগুলোতে আমি আর সমর দুজনেই আছি!

রবি হাসলো, অ্যালবামের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললো,

আচ্ছা! দিন, সবাই মিলে দেখি। বোঝাই যাচ্ছে আপনাদের বন্ডিং ভালো ছিলো, অনেক ট্যুর করেছেন তো একসাথে, অনেক ট্যুরেই তো একসঙ্গে ছবি আছে দেখছি।

ত্রিদিব হাসলেন,

হ্যাঁ, স্যার সেতো বললামই আপনাকে!

বেশ কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজির পরে ত্রিদিবই খুঁজে বার করলেন, একটা ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন,

এই যে! এটা দেখুন স্যার! এই বয়স্ক ভদ্রলোক সম্ভবত সেই ভদ্রলোক যাকে আপনারা খুঁজছেন!

ইনিই কি তাহলে প্রসাদ মিত্র?

রবি আঙুল রাখলো ছবিতে,

সঙ্গে এনার ভাগ্নে ছিলেন বলেছিলেন না? ছবিটা দেখান একটু!

বয়স্ক ভদ্রলোকের পাশে বসা অল্প বয়সী ছেলেটির দিকে আঙুল তুললেন ত্রিদিব,

এই যে! এটা স্যার! আর সমর কে তো চেনেন বললেন আপনি?

রবি উঠে দাঁড়ালো,

হ্যাঁ, ওনাকে চিনি। ওনার স্ত্রী দিয়েছেন ওনার ফটো। এই ফটোটা আমি নিচ্ছি, আপনাদের মালিককে বলে দেবেন একটু। আচ্ছা আপনাদের কাছে নিশ্চয়ই ভ্রমণকারীদের ঠিকানা থাকে, দেখুন না এনার ঠিকানাটা একটু পাওয়া যায় কিনা!

ত্রিদিব একটু ভাবলেন,

নামটা মনে করতে পারলে সুবিধা হতো, তবে কোন সালের কোন ট্যুর সেটা যখন পেয়েছি তখন চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে। লিস্ট তো থাকেই, কজন গিয়েছে, তাদের নাম, ঠিকানা সবই থাকে স্যার। যাঁরা নিয়মিত যান আমাদের সঙ্গে তাঁদেরকে আমরা প্রতিবছর আমাদের ক্যালেন্ডার, কার্ড পাঠাই। সত্যি কথা বলতে কি এটা আমি খুব গর্ব নিয়েই বলি সবাই কে, আমি নিয়মিত কাস্টমারদের পার্সোনালি চিনি, তাঁরাও আমাকে চেনেন। তাঁদের বাড়িতে প্রত্যেক বছর ফোন করে বেড়ানোর সিডিউল জানাই। তবে ইনি মনে হয় একবারই গিয়েছেন তাই নাম মনে করতে পারছি না।

ত্রিদিব এর ইশারায় কাঁচের টেবিলের উল্টো দিকে বসে থাকা তরুণী দিন, বছর মিলিয়ে মিলিয়ে কম্পিউটারে লিস্ট মেলাতে শুরু করলেন দেখে রবি টেবিলের সামনে এগিয়ে গেলো। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো,

এক মিনিট! যদিও আমি শিওর নই তবু প্রসাদ মিত্র নামের কেউ আছে কিনা এটা খুব ভালো করে দেখবেন!

বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হলো না, প্রসাদ মিত্রর নাম খুব সহজেই পাওয়া গেলো, ঠিকানাটা লিখে নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে রবি বললো,

সমরের পার্টনারের খোঁজ পাওয়া গেলো তাহলে! টাকাগুলো প্রসাদ মিত্রর অ্যাকাউন্টে গেছে শুনেই মনে হচ্ছিলো সেটা! জানি ওনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে তবু দেখিস একবার চেষ্টা করে ঠিকানাটা এক কিনা!

সৌমিক চিন্তিত মুখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো,

খুব সহজ হবে না তবে অসম্ভবও নয়। অ্যাকাউন্ট ক্লোজ হয়ে গেলেও ডেটা থাকে ব্যাংকের কাছে, তবে একেক ব্যাংকের একেক নিয়ম। কতদিন থাকে সেটা ওই ব্যাংকের নিয়ম দেখে জানতে হবে।

রবি ঘাড় কাত করলো,

আচ্ছা! তোদের ব্যাংকে কতদিন থাকে?

চার বছর মতো!

আমার কেনো জানিনা ওই পার্টনার ভদ্রলোকের ভাগ্নে কে খুব চেনা চেনা লাগলো, কিন্তু কোথায় দেখেছি সেটা একদম মনে পড়ছে না!
অন্যমনস্ক গলায় বললো রবি, সৌমিক অবাক হলো,

ক্রিমিনাল নাকি রে? থানায় কোনো রেকর্ডে দেখিস নি তো?

রবি কাঁধ ঝাঁকালো,

কি জানি! কাল দেখতে হবে একবার পুরনো রেকর্ডগুলো খুঁজে।
ক্রমশ