ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-৪৬+৪৭

0
192

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৪৬
আরো বেশ কয়েকদিন কেটে যাবার পরে একটা রবিবার এলো। এই কদিনে সৌমিক কে অনেকটা আগের মতো লেগেছে অপর্ণার, মোটামুটি স্বাভাবিক ব্যবহার করছে সৌমিক। যদিও তাকে মায়ের সঙ্গে কোনো কথা বলতে দেখছে না অপর্ণা, এমনকি খাওয়ার সময়টুকু বাদে নিজের ঘরে শুয়েই কাটিয়েছে সৌমিক, খুব প্রয়োজন ছাড়া নিচে নামেনি তবুও তার কথা বার্তার মধ্যে খুব বেশি রাগের আঁচ অপর্ণা পায়নি।

সেদিন ওদের মা ছেলের মধ্যে বন্ধ দরজার আড়ালে ঠিক কি কথা হয়েছে জানতে না পারলেও, শাশুড়ি কে তারপর থেকেই প্রায় মাসখানেক ধরে একদম চুপচাপ হয়ে যেতে দেখেছে অপর্ণা। তবে সেদিন রীতার বাড়ি থেকে আসার কথা জানার পরে যে ঝড়ের সম্মুখীন হতে হবে বলে ভাবছিলো অপর্ণা, সেরকম কিছু আজ পর্যন্ত হয়নি। রীতা পিসি নিশ্চয়ই শ্বশুর মশাইকে জানিয়েছেন, কিন্তু শ্বশুর মশাই এসব নিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে কোনো কথা বলেন নি বলেই অপর্ণা মোটামুটি ধরে নিয়েছে। যখন থেকে ও এটা বুঝতে পেরেছে তখন থেকেই মনের মধ্যে জমে থাকা ভয় একটু একটু করে কেটে গিয়েছে তার। এর মধ্যেই দুদিন আগে মাকে একদম চুপচাপ হয়ে থাকতে দেখে অপর্ণার ভাসুর ঋষি খেতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো,

মা! অনেকদিন বাড়িতে বসে থেকে আর ভালো লাগছে না তোমার বোধহয়। ভাইও বলছিলো সেদিন, চলো দুদিনের জন্যে তোমাকে মাসীর কাছে দিয়ে আসি। জলির বিয়েও তো এগিয়ে এলো প্রায়, তুমি থাকলে মাসীর একটু সুবিধাও হবে।

রীনা মুখে কোনো কথা না বলেই ঘাড় নেড়েছেন, তিনি যে এখন কোথাও যেতে ইচ্ছুক নয় সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যেই একদিন হয়ত সেদিন বলা সৌমিকের কথার জন্যেই রত্না নিজের বাড়ি চলে যেতে চেয়েছে, সকালের চায়ের আসরে বসে বলেছে,

মা, রজত এবার অফিসে জয়েন করবে বলছে তাই আমরা বাড়ি চলে যাবো ঠিক করেছি।

সৌমিক সেখানে ছিলো না, তবে বাড়ির বাকি সদস্যরা ছিলো, ঋষি আপত্তি জানিয়েছিল,

আর কদিন থেকে যা দিদি, জলির বিয়েটা মিটলে একেবারে যাস! চল সবাই একসাথে ঘুরে আসি কদিন। কি মা তাই না?

রীনা চুপ করে ছিলেন কিছুক্ষন, তারপরে বলেছিলেন,

এতে আমি কি বলবো! ওর সুবিধা অনুযায়ী করবে ও! তবে ও যদি চলে যায় তাহলে আর দীপার থাকার দরকার নেই, ঋজু কে বলো ওর টাকা পয়সা মিটিয়ে দিতে।

অনিন্দিতা আর অপর্ণা চোখাচোখি করেছিলো, ওদের দুজনেরই ইচ্ছে ছিলো দীপা কে রেখে দেবার। অনিন্দিতা ঋষি কে আলতো করে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরেছিলো, আচমকাই বউয়ের কনুইয়ের ধাক্কায় ঋষি একটু থতমত খেয়ে বলেছিলো,

দিদি তো এখনই যাচ্ছে না মা, জাস্ট যাবার কথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাই এক্ষুনি দীপা কে ছাড়িয়ে দেবার কথা উঠছে কেনো? আর দীপা থাকলে তো সবারই সুবিধা হয়, তুমি এই শরীরে বাবার পেছনে আর কতো ঘুরবে। দিদি চলে গেলে দীপা কে বরং বাবার জন্যে রেখে দাও, প্রয়োজনে বাড়ির দু একটা কাজেও হাত লাগাতে পারবে।

রীনা প্রথমে কোনো উত্তর দেন নি, অনিন্দিতা এবং অপর্ণা দুজনেই যে দীপা কে রাখার পক্ষে এটা বুঝতে পেরে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলেছিলেন,

মিনতি আছে তারপরেও বাড়িতে একজন অল্প বয়সী মহিলা সব সময় থাকা আমার পছন্দ নয়। যদি সবাই মিলে চালিয়ে নিতে না পারে তাহলে একজন বয়স্ক কাউকে রাখো, টুকটাক হাতে হাতে করে দেবে। অল্প বয়সী মেয়ে থাকা মানেই ঝামেলা, কোনো কিছু হলে সবাই আমাদেরকেই দোষারোপ করবে শেষে।

মায়ের কথায় অনিন্দিতার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকা অগ্রাহ্য করে ঋষি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল,

ঠিক আছে, তাহলে আপাতত থাকুক দীপা, তারপরে বয়স্ক কাউকে খুঁজছি।

আজ রবিবার ছিলো বলেই অনেকদিন পরে দুপুরে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছিলো, সেখানে সৌমিকও উপস্থিত ছিলো। খাওয়া যখন প্রায় শেষের পথে তখন সৌমিক হটাৎ করে সবার উদ্দেশ্যে বললো,

আমার ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে, যদিও সেটা কলকাতাতেই তবে অনেক দূরে, এখান থেকে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। তাই আমাকে ব্যাংকের কাছাকাছি কোথাও ভাড়া নিয়ে থাকতে হবে, কিছুদিনের মধ্যেই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকালো, রত্না কয়েকদিন আগেই হওয়া তর্কাতর্কির কথা ভুলে গিয়ে বললো,

কিন্তু ভাই কলকাতায় মধ্যেই তো! একটু বেশি তাড়াতাড়ি বেরোলে পৌঁছতে পারবি না? একেবারে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে?

সৌমিক কোনো উত্তর দিলো না, তাকে মাথা নিচু করে খেয়ে যেতে দেখে অনিন্দিতা অপর্ণা কে জিজ্ঞেস করলো,

অপর্ণা! তুই কি করবি? তোর ইউনিভার্সিটি তো এখান থেকেই কাছে হবে তাইনা?

অপর্ণা হতভম্ব হয়ে সৌমিকের দিকে তাকালো, তার এই বিষয়ে কিছুই জানা ছিলো না। তাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনিন্দিতা জিজ্ঞেস করলো,

ওই ভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? তুই কি কিছু জানিস না নাকি?

অপর্ণা বুদ্ধিমতি, কিছুক্ষনের জন্যে বোকা হয়ে গিয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজেকে সামলে নিলো,

আমি এখনও কিছু ঠিক করিনি দিদিভাই, তাই কি বলবো বুঝতে পারছি না। দেখি কি করি!

এরপরে সবাই প্রবল কৌতূহল নিয়ে সৌমিক কে একের পর এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, রজত তার দিকে ঘুরে বসলো,

তোমার ব্রাঞ্চটা ঠিক কোথায় বলতো? মানে শনিবার করে যদি চলে আসতে পারো তাহলে অন্তত অপর্ণা এখানেই থাকতে পারতো।

সৌমিক কিছু উত্তর দিতেই যাচ্ছিলো তার আগেই রীনা উঠে দাঁড়ালেন। অর্ধেক খাওয়া ফেলে তাঁকে উঠে দাঁড়াতে দেখে অনিন্দিতা শাশুড়ির দিকে তাকালো,

কি হয়েছে মা? শরীর খারাপ লাগছে? খেলেন না পুরোটা?

রীনা বেসিনে হাত ধুয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,

খিদে নেই!

রীনার উঠে চলে যাবার পরে আলোচনা আর গড়ালো না, সবাই মুখ বন্ধ রেখে খাওয়া সেরে উঠে গেলো ধীরে ধীরে। কিছুক্ষন পরে অপর্ণা খাওয়া সেরে ওপরে এলো, তার মুখ রাগে থমথম করছিলো। ঘরে ঢুকেই সৌমিক কে উদ্দেশ্য করে কড়া গলায় বললো,

আমি হাসব্যান্ড, ওয়াইফ এর স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করি। আজ তুমি যেটা করলে সেটা আমি করলে তুমি আমাকে ঠিক কি বলতে? তোমার ট্রান্সফারের খবরটা কি আমার আগে জানার কথা ছিলো না। যদি এটাও মেনে নিই যে তুমি কালই এটা জানতে পেরেছ, তাহলেও তো অফিস থেকে ফেরার পরে একটা গোটা রাত তুমি সময় পেয়েছিলে আমাকে বলার জন্যে, কিন্তু বলোনি। ওখানে যারা ছিলো তারা সবাই আমার এক্সপ্রেশন থেকে বুঝেছে আমি কিছুই জানিনা, এটা যে আমার কাছে কতোটা অপমানের সেটা তুমি ফিল করতে পারছো কিনা আমি জানিনা! কিন্তু আমার যে ভীষণ খারাপ লেগেছে সেটা আমি তোমাকে বলে দিলাম। ভবিষ্যতে এরকম কিছু যদি আমিও করি তখন তুমি আমাকে দোষারোপ কোরো না। এমনিতেও আমি লক্ষ্য করছি ইদানিং তুমি অনেক কিছু লুকিয়ে যাচ্ছো! রবি দা বলেছিলো সে তোমার অ্যাক্সিডেন্টের কথা মিতার কাছ থেকে জানতে পেরেছে, এটাও আমার কাছে অপমানের, তোমার অ্যাক্সিডেন্টের খবর আমার আগে মিতা জানলো। কি এমন হলো তোমার যে ওটা তুমি আমাকে না জানিয়ে মিতাকে জানিয়েছিলে সেদিন?

সৌমিক চুপ করে থাকলো, তারপরে নরম গলায় বললো,

এমন অনেক কথা হয় অপর্ণা যেগুলো বলতে চাইলেও বলতে পারা যায়না। ধরে নাও এগুলো সেরকমই কিছু কথা যেগুলো আমিও তোমাকে বলতে চেয়েও পারছি না কিছুতেই।

অপর্ণা হাত তুললো,

আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। তুমি ট্রান্সফার হয়ে গেছো, কতদূরে গেছো সেগুলো কিছুই আমি জানিনা। এতে কি এমন লুকিয়ে রাখার মত জিনিষ আছে সেটা আমি বুঝতেও পারছি না। তবে এটা জানি এতে আমার ক্লাসগুলো হ্যাম্পার হবে। তুমি স্পষ্ট করে বলো আমি কি করবো, তোমার সঙ্গে যাবো না এখানে থাকবো? যদি যাই তাহলে ক্লাস করতে পারবো কিনা? যদি না পারি তাহলে তুমি অন্য জায়গায় থাকলেও আমাকে এখানেই থাকতে হবে।

সৌমিক অপর্ণার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো, খাটের পাশে বসিয়ে বললো,

একটা কথা বলবো, যেটা তুমি কাউকে বলতে পারবে না। আমার কোথাও ট্রান্সফার হয়নি, আমি ওখানেই আছি। কিন্তু এমন কিছু ঘটনা আছে যেটা মেনে নিয়ে এই বাড়িতে আর থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বেশ কয়েকদিন ধরে বাড়ি খুঁজছিলাম, যেটা পেয়েছি সেটা তোমার ইউনিভার্সিটির আরো কাছে, তোমার সুবিধাই হবে।

অপর্ণা চমকে উঠে হাত ছাড়িয়ে নিলো,

মানে! কি বলছো তুমি! তোমার কোথাও ট্রান্সফার হয়নি তাও আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো! কি এমন হয়েছে যে এখানে আর থাকতে পারছো না? এই তুমিই না, মিতার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেছিলে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে বলে!

সৌমিক উঠে দাঁড়ালো, ঘরের দরজা দিয়ে বারান্দায় বেরোতে বেরোতে বললো,

তখন যে পরিস্থিতি ছিলো, এখন সেটা নেই! তাই তখন যেতে চাইনি বলে যে আজও যেতে চাইবো না তা তো আর হতে পারে না।

পরিস্থিতির কি পরিবর্তন হলো সেটা তো বলো অন্তত?

অপর্ণার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সৌমিক বেরিয়ে গেলো, অপর্ণা খানিকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে কারণ গুলো ভাবার চেষ্টা করলো। ও রীতা পিসির বাড়িতে গিয়ে যেগুলো বলে এসেছিলো সেগুলো কি তাহলে রীতা পিসি সৌমিক কে জানিয়ে দিয়েছে! নাকি অন্য কিছু ঘটেছে! কি এমন ঘটলো যে সৌমিক কলকাতায় থেকেও অন্য জায়গায় থাকতে চাইছে! কিছুক্ষন পরে অপর্ণা ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলো, সৌমিকের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবার আগেই সৌমিক ওর দিকে ফিরে শান্ত গলায় বললো,

আমি জানি তুমি কি জানতে চাইছো। কিন্তু বিশ্বাস করো ইচ্ছে থাকলেও সেগুলো আমি তোমাকে বলতে পারবো না। তবে এটুকু বলতে পারি আমি রাগের বশে কিছু করছি না, অনেক ভেবে চিন্তে ঠান্ডা মাথায় ডিসিশন নিয়েছি। তাই তুমি এটাকে হঠকারিতা ভেবো না। তবে ঘরে চলো তোমার সঙ্গে আমার অন্য ব্যাপারে কথা বলার আছে।

অপর্ণা একটু অবাক হয়ে ঘরে ঢুকে এলো, পেছনে পেছনে সৌমিক। অপর্ণা এগিয়ে গিয়ে খাটে বসেছে দেখে সৌমিকও ওর পাশে গিয়ে বসলো,

অপর্ণা! তোমার জন্যে সমর সম্পর্কে কিছু নতুন খবর আছে!

অপর্ণা অবাক হলো,

নতুন খবর! তুমি এর মধ্যে আরো কিছু এগিয়েছ নাকি? তোমার বাড়ি ছেড়ে যেতে চাওয়ার সঙ্গে কি সমরেরও কিছু সম্বন্ধ আছে?

সৌমিক মাথা নাড়লো,

না না সেসব কিছু নয়, এটা সম্পূর্ন আলাদা ব্যাপার। আমি ওর বাড়ির মালিকের কাছ থেকে পুরনো অফিসের ঠিকানা পেয়েছিলাম, ব্যবসা করার আগে ও নাকি চাকরি করতো! সেখান থেকেই ওর একটা ফটো পেয়েছি, রবি সেটা তোমাকে দেখাতে বলেছিলো, ও তখন সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলো বলে আমি আর দেখাতে পারিনি। আজ সেটা পাঠিয়েছে আমাকে, দেখে বলোতো এটাই সমর কিনা!

ফোনটা টেবিলের ওপরে রাখা ছিলো, সৌমিক ওটা ওখান থেকে আনতে যতটুকু সময় নিলো, সেই সময়টুকুই যেনো অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছিলো অপর্ণার। বুকের ভেতরে একটা থম মেরে যাওয়া অনুভূতি, হাত দুটো একটু একটু কাঁপছে, শরীরটা যেনো ভীষণ দুর্বল লাগছে! কতদিন, ঠিক কতদিন পরে সমরের ছবি দেখবে ও! কিন্তু ওর কেনো যেনো ছবিটা আর দেখতে ইচ্ছে করছে না, মনে হচ্ছে আর খুনিকে খুঁজতে চায় না ও! সৌমিক কে বলতে ইচ্ছে করছে সেই আবেগ আর নেই, সমরের খুনিকে খোঁজার যে তাগিদ ছিলো এতদিন এখন যেনো সেটা আর পাচ্ছে না। শুধু বুকের মধ্যে একটা তোলপাড় চলছে মনে হচ্ছে ভুলে যাওয়া মুখটা নতুন করে দেখতে গিয়ে যেনো ও কোথাও সৌমিককেই ছোটো করে ফেলছে!

সমরের বয়স কতো ছিলো অপর্ণা? তুমি তো কখনো বলো নি আমাকে!

ফোনটা হাতে নিয়ে খাটের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো সৌমিক। সৌমিকের প্রশ্নে অপর্ণা কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো, প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টে প্রশ্ন করলো,

আচ্ছা, তোমার কি খুব খারাপ লেগেছিলো যখন আমি তোমাকে সমরের খুনিকে খুঁজে দিতে বলেছিলাম?

সৌমিক হেসে ফেললো,

তা একটু লেগেছিলো তো বটেই! বউ যদি সারাক্ষন পুরনো প্রেমিকের কথা ভাবতে থাকে তাহলে তো খারাপ লাগবেই তাই না?

অপর্ণা করুন মুখে তাকালো,

আগে ভাবিনি, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে কাজটা বোধহয় ঠিক করিনি! সত্যিই হয়ত তুমি খুব দুঃখ পেয়েছিলে কিন্তু মুখে বলো নি তখন! এখন মাঝে মাঝে মনে হয় যে গেছে সে আর কখনো ফিরবে না! কিন্তু তোমাকে দিয়ে খুনিকে খোঁজাতে গিয়ে হয়ত আমি তোমাকে সত্যি কষ্ট দিয়েছি, সেটা তুমি মুখে বলতে পারো নি!

সৌমিক অপর্ণার পাশে এসে বসলো,

মৃত ব্যক্তির সঙ্গে আমার কোনো কম্পিটিশন নেই অপর্ণা, আমি জাস্ট মজা করছিলাম। কিন্তু তোমার এতদিন পরে এরকম মনে হলো কেনো?

অপর্ণা মুখ নিচু করলো,

জানিনা! তুমি বোধহয় অনেক বড়ো মনের, কিন্তু আমি খুব সাধারণ! আমি কিন্তু এগুলোর উর্ধ্বে উঠতে পারিনা কিছুতেই! তুমি যতবার মিতার প্রসঙ্গে কোনো কথা বলো আমার ভেতরে কেমন যেনো কষ্ট হয়! মনে হয় এমন কোথাও চলে যাই, যেখানে গেলে মিতার সম্বন্ধে আর কোনো কথা থাকবে না বলার! আমি তোমাকে বলতে পারিনি, আমার ইদানিং মনে হচ্ছে মিতা যেনো আমাকে ইগনোর করে তোমার কাছাকাছি আসতে চাইছে!

সৌমিক অপর্ণা কে জড়িয়ে ধরলো, কপালের ওপরে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বললো,

আমি বুঝতে পারছি তুমি কেনো এটা বললে! রবির কাছ থেকে শুনে তোমার খারাপ লেগেছে! কিন্তু বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু করিনি যার জন্যে তোমার চোখে চোখ রাখতে না পারি! শুধু মিতা কেনো এটা তোমার আগে জানলো, এই সত্যিটা বলতে পারছি না! আরো কিছুদিন সময় দাও আমাকে, একদিন সবটাই বলতে পারার সাহস করবো নিশ্চয়ই!

অপর্ণাও সৌমিক কে জড়িয়ে ধরলো, সৌমিকের বুকে মুখ গুঁজে বললো,

জানতে চাই না! শুধু একটা কথা বলবো রাগ করবে না তো? আমি এই বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইনা!

সৌমিক একটু চুপ করে থেকে বললো,

মায়ের সঙ্গে তো তোমার মাঝে মাঝেই ঝগড়া হয়! তোমার জন্যে তো ভালোই হলো এটা!

অপর্ণা সোজা হয়ে বসলো,

সেতো আমার মায়ের সঙ্গেও হতো, একটুও বনিবনা হতো না কখনো! বাবা আমাকে সাপোর্ট করতো বলে মা বাবার ওপরেও রেগে যেতো! তাই বলে কি আমি মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম কখনো! কেউ আমাকে অন্যায় কিছু বললে আমি প্রতিবাদ করি এটা আমার বরাবরের স্বভাব, এর জন্যে মায়ের কাছেও আমি কম বকুনি খেতাম না! সেটা এখানেও করি, মা ভুল বললে আপত্তি জানাই, তার মানে আমি এখানে থাকতে চাইনা এটা তোমাকে কে বললো!

সৌমিক কয়েক মুহূর্ত অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রসঙ্গ বদলে ফেললো,

ওসব আলোচনা এখন থাক, তুমি বরং ছবিটা দেখো। আমাকে রবিকে জানাতে হবে, তাহলে কয়েকদিনের মধ্যেই অনেক কিছু ক্লিয়ার হবে মনে হচ্ছে!

এতক্ষন অন্য কথা আলোচনার মধ্যে ছবিটার কথা ভুলেই গিয়েছিল অপর্ণা, এবার কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ছবিটার দিকে তাকালো। সৌমিক সমরের ছবির ওপরে আঙুল রাখলো,

এটা তো? বয়স কতো ছিলো বললে না তো?

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

ধ্যাত! এটা তো একটা বুড়ো লোক! অনেক বয়স হবে এর, কম করে ছত্রিশ তো বটেই! বেঁচে থাকলে এখন ত্রিশ মতো হতো সমরের!

সৌমিক অপর্ণার কাছ ঘেঁষে এলো, বিস্ময়ের গলায় বললো,

এটা সমর নয়! এটা তবে কে?

অপর্ণাও অবাক হলো,

আমি কি করে জানবো এটা কে? তুমিই তো দেখালে আমাকে! তবে এতে তো সমরও আছে দেখছি! তুমিই ভুল করছো, আমাকে ভুল ফটো দেখিয়ে ফেলেছো তুমি!

সৌমিক অবাক হয়ে অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

সমর আছে এখানে! কোনটা?

প্রসাদ মিত্রর পাশে বসা তাঁর ভাগ্নের ফটোর ওপরে আঙুল রাখলো অপর্ণা,

এটা!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৪৭
আজকের সকালেটা অন্য দিনের থেকে অনেকটাই আলাদা, অনেকদিন পরে দুপুরে আজ বাড়ি প্রায় খালি। সৌমিক, ঋষি সকালেই বেরিয়ে গেছে, রজতও আজ অফিসে জয়েন করেছে। আগামী সপ্তাহে বাড়ি চলে যাবে ঠিক করায় রত্না নিজের ফ্ল্যাট পরিষ্কার করতে গেছে। অনিন্দিতা তার ঘরে দিবানিদ্রায় ব্যস্ত, কোনো কাজ না থাকায় দীপাও নিচের ঘরে ঘুমাচ্ছে।

একমাত্র অপর্ণা বাড়িতে তার ঘরে শুয়ে শুয়ে বইপত্র নাড়াচাড়া করছিলো। আজ তার ক্লাসের চাপ ছিলো না তাই সে ইউনিভার্সিটি যায়নি। এমনিতেও মনটা ভালো ছিলো না, কলকাতায় থেকেও এই বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে বলে খারাপ লাগছিলো তার। মনের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে এলেও ঠিক মতো জবাব পাচ্ছিলো না অপর্ণা, ঠিক কি কি কারণে সৌমিকের এই ডিসিশন সেগুলো ভাবার চেষ্টা করছিলো। সৌমিককে এই কদিনে ভালোই চিনে গেছে ও, নিজে থেকে বলতে না চাইলে তার মুখ দিয়ে কথা বার করা মুশকিল।

বই হাতে শুয়ে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেনো চোখটা লেগে এসেছিলো বুঝতে পারেনি অপর্ণা, হটাৎ দরজায় মৃদু টোকার আওয়াজে তন্দ্রা ভাঙলো, অপর্ণা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে খাটে উঠে বসে গলা তুললো,

ঢুকে এসো দিদিভাই, জেগেই আছি!

ধীরে ধীরে দরজা খুলে গেলো, দরজার পাল্লার ফাঁক দিয়ে কুণ্ঠিত মুখে শাশুড়িকে উঁকি দিতে দেখে অপর্ণা চমকে গেলো, তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে এসে বললো,

এমা! আপনি এই পা নিয়ে আবার সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলেন কেনো! আমাকে দীপা দিকে দিয়ে ডাকতে পারতেন তো! কিছু বলবেন?

রীনা ঘরে ঢুকে এলেন, নিজেই দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে খাটের এক পাশে বসে বললেন,

হ্যাঁ, বলবো বলেই তো ওপরে উঠে এলাম! সব কথা কি আর নিচে ডেকে বলা যায়!

রীনার গলার স্বরে এমন কিছু ছিলো যেটা অপর্ণা কে ভাবালো, বিয়ের পর থেকেই যে কড়া ব্যবহারের শাশুড়ি কে দেখতে সে অভ্যস্ত ছিলো, এই গলা তার থেকে অনেক আলাদা। রীনা কে একজন সম্পূর্ন বিধ্বস্ত মানুষ দেখাচ্ছিল, যদিও এর কারণ আন্দাজ করা অপর্ণার পক্ষে খুব বেশি অসুবিধের ছিলো না। সে কয়েক মুহূর্ত শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বললো,

আমি বুঝতে পারছি আপনি কেনো এসেছেন। বিশ্বাস করুন আমি নিজেও এখান থেকে যেতে চাইনা, কিন্তু ঋজু বলছে ওর কিছু করার নেই।

রীনা কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন,

ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে কথা বলার দরকার হবে না তাই এতদিন আসিনি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস হয়ে গেছে। তুমি কি জানো ও কেনো চলে যেতে চাইছে?

অপর্ণা মাথা কাত নাড়লো,

ওর ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে তাই! নিজেই তো বললো সেদিন! কেনো অন্য কিছু ঘটেছে নাকি?

রীনা সরাসরি অপর্ণার চোখের দিকে তাকালেন না, মাথা নিচু করেই বললেন,

তোমার কাছে নতুন করে লুকিয়ে রাখার আর নেই কিছু, তুমি তো সবটাই জানো। আমি জানি তুমি আমাকে লুকিয়ে রীতার বাড়িতে গিয়েছিলে। তাই ঋজু যখন প্রথমে আমাকে এই বিষয় নিয়ে কথা বললো তখন আমি ভেবেছিলাম তুমিই ওকে এগুলো বলেছো। কিন্তু ও নিজেই বললো এগুলো ওকে মিতা জানিয়েছে।

অপর্ণা মনে মনে চমকে উঠলো,

মিতা বলেছে এসব কথা সৌমিক কে, তাই জন্যেই কি সৌমিক বাইক অ্যাকসিডেন্ট করেছিলো সেদিন! ওর সঙ্গে কি সেই জন্যেই কফি শপে দেখা হয়েছিল মিতার!

অপর্ণার চমকে ওঠা রীনা লক্ষ্য করলেন,

আমার তোমার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই, আমি জানি তুমি এতদিন যখন এগুলো কাউকে জানাওনি তখন ভবিষ্যতেও জানাবে না। কিন্তু তুমি এটা জানো কিনা আমি জানিনা যে ঋজু এই জন্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। ও যখন কথাগুলো বলেছিলো আমাকে তখন আমি ভেবেছিলাম ও হয়ত সাময়িক রাগে বলছে এসব তাই আমি অতোটা গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু এখন এতদিন পরে আজ যখন ও ট্রান্সফারের কথা বললো তখন বুঝলাম ও সত্যি সত্যিই বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছে!

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

নাহ! আমি সত্যি জানিনা যে ও এই জন্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। আসলে আমি যেমন ওকে জানাতে পারিনি ঠিক তেমনই ও ও হয়তো মিতার সঙ্গে হওয়া কথাগুলো আমাকে জানাতে পারেনি। কিন্তু এই জন্যে ও বাড়ি ছাড়তে চাইছে কেনো সেটা আমি বুঝতে পারছি না!

ও চায় না যে ওর বাবা আর এই বাড়িতে থাকুক! আমি তাতে রাজি হই নি বলে ও এই ডিসিশন নিচ্ছে!

হতাশ গলায় বললেন রীনা, অপর্ণা অবাক হয়ে তাকালো,

কিন্তু এটা তো ও ঠিকই বলছে তাহলে! এটা তো আমারও মনে হচ্ছে। আপনি কেনো চাইছেন বাবাকে এখানে রাখতে? যে লোকটা সারা জীবন এতো বড়ো অন্যায় করে গেছে তাকে তো শাস্তি দেবার এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ! আপনি কি চাননা, বাবা তাঁর অপরাধের শাস্তি পান? আপনার ছেলে যখন ভাবছে না বাইরের লোকজন কি ভাববে, তাহলে আপনি এটা নিয়ে এতো চিন্তা করছেন কেনো?

রীনা কিছুক্ষন মাথা নিচু করে থাকলেন, তারপরে মাথা তুলে অপর্ণার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললেন,

জানি ওই লোকটা আমায় কখনো ভালোবাসেনি, কিন্তু আমি বেসেছিলাম। রত্নাকে নিয়ে বাপের বাড়ি থেকে সাত মাস পরে ফিরে এসেই বুঝেছিলাম ওর মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়েছে। কারণ বুঝতে না পারলেও আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে বলছিলো কিছু হয়েছে এর মধ্যে। যদিও তখন রীতা এখানে ছিলো না, নিজের স্বামীকে সুস্থ করে সে ফিরে গিয়েছিলো তার শ্বশুর বাড়িতে তাই কিছুতেই পরিবর্তনের কারণটা ধরতে পারছিলাম না। রীতা ফিরে গেলেও ওর স্বামী নাকি কিছুতেই পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছিলো না তাই আমার শাশুড়ি মাঝে মাঝেই তাঁর ছেলেকে রীতার শ্বশুর বাড়িতে পাঠাতেন, কখনো কখনো রীতা আসতো এমন কোনো ওষুধ কিনতে যেগুলো কলকাতা ছাড়া কোথাও পাওয়া যায়না। এই করতে করতেই আরো বছর খানেক চলে গেলো, ঋষি হবার সময়ে শুনলাম ওর শ্বশুর বাড়িতে বনিবনা হচ্ছে না তাই ওকে এখানে এনে রাখা হবে। আমি কিছু বলার জায়গায় ছিলাম না কিন্তু একদিন রীতার দাদা আমাদের বাড়ি এলো রীতার স্বামীকে নিয়ে, ঘরে ঢুকে চিৎকার চেঁচামেচি করলো, পাশের ব্লক থেকে আমার মামা শ্বশুর কে ডেকে নিয়ে এসে অপমান করলো। তখন আমি একদিন আড়ালে জিজ্ঞেস করলাম আমার স্বামীকে, যদিও সে সমস্ত কথা অস্বীকার করলো, রত্নার মাথায় হাত রেখে শপথ করলো এমন কোনো কিছু সত্যি নয়। নিতান্তই তারা মা ছেলেতে একটা দুঃখী মেয়ের উপকার করতে চাইছে। যদিও আমার কথার কোনো মূল্য এ বাড়িতে ছিলো না তবুও আমি ওকে বিশ্বাস করলাম, রীতা এখানে এসে উঠলো। তারপরে সব কিছু প্রায় বছর দেড়েক স্বাভাবিক ছিলো অন্তত আমার চোখে ধরা পড়েনি এটুকু বলতে পারি। এর মধ্যে ঋষি হলো, আমি যত বেশি করে বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে লাগলাম ততোই রীতার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে উঠতে লাগলাম, আস্তে আস্তে কখন যে এই বাড়িতে আমি একজন অতিথি হয়ে গেলাম সেটা নিজেও বুঝতে পারিনি। ঋজু হবার পরে তো সকালের দিকটা আমি কিছুই করে উঠতে পারতাম না, রীতাই সব করতো। এরকম সময়ে একদিন সকালে রীতা কে রান্নাঘরে খুঁজতে গিয়ে না পেয়ে আমি খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন করেছিলাম যে সে কোথায় গিয়েছিলো সকালে। তার উত্তরে রীতা আমাকে কড়া গলায় জবাব দিয়েছিলো যে সে শুধু মাত্র আমার শাশুড়ি বাদে কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নয়। আমি খুব অপমানিত হলাম, আমার স্বামীকে এবং শাশুড়ি কে জানালাম, তার উত্তরে শাশুড়ি বললেন যে না পোষালে আমি বাপের বাড়ি চলে যেতে পারি, আমার স্বামীও তাতে সমর্থন জানালেন। আমাদের একান্ত পারিবারিক আলোচনার মধ্যে রীতা ঢুকে পড়লো, তার সম্বন্ধে অভিযোগ জানানোর সাহস কি করে আমার হয় জিজ্ঞেস করে আমাকে যা খুশি তাই বলে অপমান করতে লাগলো। এতকিছুর পরেও আমার শাশুড়ি বা স্বামী তাকে একবারের জন্যেও থামাতে চেষ্টা করলেন না উল্টে তাকেই সমর্থন জানাতে লাগলেন। আমি সবটাই বুঝতে পারলাম, এতদিনের চেপে রাখা মিথ্যেগুলো আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠলো। বাপের বাড়ি চলে যাবার মতো অবস্থা আমার ছিলো না, যদিও থাকলেও যেতাম না, কারণ জেদ টা আমার বরাবরের বেশি ছিলো। সময়ের চাকা ঘোরে আমার জানা ছিলো, আমি নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষায় বসে রইলাম। সব কিছু প্রকাশ্যে এসে যাবার পরে আর লুকোচুরির কিছু ছিলো না, নোংরামি প্রকাশ্যেই চলতে লাগলো।

প্রথম সুযোগ এলো যখন আমার শাশুড়ির স্ট্রোক হলো, তিনি প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়লেন, রত্না তখন বছর তেরো। প্রথম সুযোগেই আমি রীতা কে বাড়ি থেকে বার করে দিলাম। আড়ালে আমার স্বামীকে বললাম যদি তিনি আটকানোর চেষ্টা করেন তাহলে আমি থানায় গিয়ে ওনার আর রীতার নামে অভিযোগ জানাবো। যে মহিলাকে তিনটে ছোটো বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবার হুমকি দেওয়া যায় সেই মহিলা আমি এখন নই। রীতা যদিও চলে গেলো কিন্তু সব গুছিয়ে নিয়ে, আমিও আটকালাম না, যে মানুষটাই আমার নয় তার টাকা পয়সার ওপরে আমার কোনো লোভ নেই। এতো বছর সেগুলোই চলে আসছিলো এতদিনে তুমি সেটা বন্ধ করে দিলে।

অপর্ণা বাধা দিলো, শাশুড়ি কে থামিয়ে বললো,

রীতার এখন কি করে চলবে সেটা আমি জানিনা। আমার মনে হয় এই বয়সে যদি তাকে নতুন করে খরচ চালানোর জন্যে কাজ খুঁজতে হয় তাহলেই তার যথেষ্ট শাস্তি হবে। শুধু বাবাই বাকি থাকবেন যিনি তাঁর কৃতকর্মের জন্যে কোনো শাস্তি পাবেন না। অথচ এই মানুষটার জন্যেই কিন্তু এতো কিছু হচ্ছে, তাই তাঁর ছাড় পেয়ে যাওয়া মানে বড়ো অন্যায় কে মেনে নেওয়া। সত্যি বলতে কি আমিও চাই উনি এ বাড়িতে না থাকুন, বুঝুন অন্তত যে এই জীবনেই সব অন্যায়ের শাস্তি পেয়ে যেতে হয়।

রীনা মুখ তুললেন, শক্ত গলায় বললেন,

বাড়ি থেকে বার করে দিলে কি সে আদৌ কোনো শাস্তি পাবে? রীতার কাছে যাওয়া ছাড়া তখন একটা প্রায় পঙ্গু মানুষের কাছে আর কোনো উপায় থাকবে না। রীতা তো এটাই চায়, সে ওই লোকটাকে নিজের বাড়িতে রাখবে, তার টাকায় তার আবার আগের মতো জীবন যাত্রা চলতে থাকবে। তাহলে ক্ষতি কার হলো, শেষ পর্যন্ত আমাদেরই তো? যে লোকটা আজ পর্যন্ত চক্ষু লজার খাতিরেই বলো আর নিজের সুবিধার কথা ভেবেই বলো, বাড়ি ছাড়তে তো পারেনি, সেই লোকটা আরো বেশি করে স্বাধীন হয়ে যাবে না কি? আমি এই কথাটাই আমার ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি বারবার, সে বুঝছে না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো তুমি বুদ্ধিমতি তাই তুমি বুঝবে, কিন্তু তুমিও বুঝতে পারছো না কিছুতেই!

অপর্ণা চুপ করে থাকলো, প্রশ্নগুলোর যৌক্তিকতা অগ্রাহ্য করতে পারছিলো না সে। কিছুক্ষন পরে হতাশ গলায় বললো,

তার মানে একটা লোক সারা জীবন অন্যায় করেও পার পেয়ে যাবে, আমাদের কিচ্ছু করার থাকবে না!

রীনা মাথা নাড়লেন, একবার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে নিয়ে আচমকা খাটে মুখোমুখি বসে থাকা অপর্ণার দুটো হাত নিজের হাতে নিয়ে নিচু গলায় বললেন,

যদি ধরো আমি তোমাকে বলি যে লোকটাকে আমি ইতিমধ্যেই শাস্তি দিয়েছি, তাহলে কি তুমি সত্যি কথাটা না বলে আমার ছেলেকে এখানে থেকে যাওয়ার জন্যে রাজি করতে পারবে? ও যেনো জানতে না পারে, তাহলে ওর চোখে আমি খুব ছোটো হয়ে যাবো!

অপর্ণা হতভম্ব হয়ে তাকালো, লক্ষ্য করলো শাশুড়ির হাত দুটো কাঁপছে। অপর্ণার হতভম্ব ভাব লক্ষ্য করে রীনা গলা নামালেন, ভাঙা স্বরে বললেন,

তোমার কাছে সত্যি স্বীকার করা ছাড়া এই মুহূর্তে আমার কিছু করার নেই, তাতে যদি আমার সংসারটা বাঁচে শেষ পর্যন্ত! অপর্ণা, আমি জানি এই বাড়িতে এসে থেকে তোমাকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে, ঠান্ডায় বাইরে বসে থাকতে হয়েছে বলে তোমার ক্ষোভ আছে আমি সেটাও জানি। কিন্তু এর পেছনের কারণটা জানলে হয়ত তুমি আমাকে আজ না হলেও আগামীতে কখনো ক্ষমা করে দেবে। আমি কখনো চাইনি রীতা তোমাদের বিয়েতে আসুক, কিন্তু আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আমার স্বামী তাকে নিমন্ত্রণ করে এলেন। আমি তারপরে আশা করেছিলাম সে নিমন্ত্রণ পেলেও নিশ্চয়ই আসবে না কারণ সে জানে যে তাকে আমি বা আমার ছেলে মেয়েরা কেউই খুব বেশি পছন্দ করিনা। কিন্তু আমার ধারণা কে ভুল প্রমাণিত করে সে বিয়ের দিন সকালে এলো এবং সবার এড়িয়ে চলা সত্বেও রাতে এখানে থেকে গেলো।

বরযাত্রীরা ফিরে আসার পরে তাদের মুখ থেকে বিয়ে ঠিক মতো মিটেছে শোনার পরে একটু বেশি রাতের দিকে আমি আর মেজদি ওপরে শুতে এসেছি তোমার এই ঘরটাতে, সবাই যে যার ঘরে শুয়ে পড়েছে তার আগেই। ঘুমিয়েই পড়েছিলাম কিন্তু যতোই হোক ঘুম কিছুতেই পুরোপুরি হচ্ছিলো না, একটা বিয়ে বাড়ির অনেক দায়িত্ব থাকে। বিভিন্ন কথা মনে পড়ছে, এটা করা হয়নি, ওটা বাকি আছে, এরকম নানান বিষয় মনে হচ্ছে আর ঘুমটা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পরে বৃষ্টি থেমেছে নাকি দেখতে বারান্দায় বেরিয়ে দাঁড়িয়েছি, শুনলাম নিচে আমার ঘর থেকে চাপা গলায় কথার আওয়াজ আসছে। এতো রাতে কে কথা বলছে দেখতে গিয়ে ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আমার স্বামীকে আর রীতাকে অসংলগ্ন অবস্থায় দেখতে পেলাম।

অনেক বছর একসময় এইসব নোংরামো চোখের সামনে দেখেও সহ্য করেছিলাম কিন্তু এত বয়সে এসে ছেলের বিয়ের রাতে এই নোংরামি মেনে নেওয়া আর আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হলো না। কয়েক মুহূর্তের জন্যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সজোরে ধাক্কা মারলাম। লোকটার বয়স হয়েছে, অল্প বয়সের গায়ের জোর আর নেই, ধাক্কা খেয়ে যখন চিৎ হয়ে মাটিতে পড়লো, আর মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগলো তখন সম্বিত ফিরলো। আমার লোকটার প্রতি ঘেন্না ছাড়া কিছু নেই, মরে গেলেও কিছু যায় আসে না, কিন্তু নতুন বউ বাড়ি ঢোকার আগেই যদি শ্বশুর মরে যায় তাহলে তোমার বদনাম হয়ে যাবে। এটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে ভয় হলো, সেই মুহূর্তে ঋজু ছাড়া ভরসা যোগ্য কারোর কথা মনে পড়ছে না! কোনো কিছু না ভেবেই বাবা বৃষ্টির জলে পা পিছলে পড়ে গেছে বলে ওকে ফোন করে দিলাম, ইতিমধ্যেই আওয়াজে সবাই ছুটে এসেছে তাদেরকেও একই কথা বললাম, সিঁড়ির জলে পা ভেজা ছিলো, ঘরে ঢুকে স্লিপ করে গেছে। রীতা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো কিন্তু সত্যি কথা বলার সাহস ওর ছিলো না, কারণ তাহলে আরো খারাপ সত্যি স্বীকার করতে হতো ওকে। ঋজু হাসপাতালে চলে যাবার পরে যখন রীতা বরণ করার জন্যে ঋজুর খোঁজ করলো তখন মনে হলো ওকে পাঠিয়ে বিরাট ভুল করে ফেলেছি, তোমার কথাটা ভাবাই হয়নি এর মধ্যে, কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই!

অপর্ণা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, রীনার হাতের মুঠোয় ধরা ওর হাত থরথর করে কাঁপতে দেখে রীনা মুঠো আরো শক্ত করলেন, চোখে জল নিয়ে বললেন,

বিশ্বাস করো তাও তোমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলাম! সবাই যখন তোমার আড়ালে আমাকে বউ অপয়া বলতে লাগলো, এমনকি মেজদি পর্যন্ত কুষ্টি মিলিয়ে দেখা হয়নি বলে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলো তখন আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো, মনে হলো আমার দোষের ভাগীদার তুমি হবে কেনো! কিন্তু কি করলে এগুলো বন্ধ হবে বুঝতে পারছিলাম না, অথচ সত্যিটা স্বীকার করতে গেলে নোংরামির কথাটা প্রকাশ্যে এসে যাবে। শেষে সবার মুখ বন্ধ করার জন্যে পুজো করলাম, যাতে এখানে থেকে তোমাকে এসব বাজে বাজে কথা নিজের মুখে শুনতে না হয় সেই জন্যে তোমার মাকে বললাম পরীক্ষা পর্যন্ত ওখানে রেখে দেওয়ার জন্যে। আমি জানতাম ততদিনে ব্যাপারটা থিতিয়ে যাবে অনেকটা, কিন্তু আমার ছেলে তো আরো জেদী সে তোমাকে ফেরত নিয়ে চলে এলো!

কথা শেষ করে শাশুড়ি, বৌমা দুজনেই অনেকক্ষন চুপ করে বসে রইলো, দুজনের কাছেই বোধহয় বলার মতো কোনো কিছু অবশিষ্ট ছিল না। অনেকক্ষন পরে অপর্ণা মুখ খুললো, কান্না ভেজা গলায় বললো,

আমার আপনার অনেক ব্যবহার খারাপ লেগেছে তখন, যদিও আজ এসব জানার পরে আর লাগছে না। তবুও বলবো আপনি আমার মাকেও একসময় অপমান করেছিলেন আমাদের বাড়িতে রাত কাটাতে অসুবিধে হবে বলে, এটা আমার খুব খারাপ লেগেছিলো। হয়ত আমরা আপনাদের মতো বড়লোক নই কিন্তু আমার বাবা মায়েরও কিন্তু সম্মান আছে।

রীনা চোখের জল মুছলেন,

ওই নোংরা লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে তার স্ত্রীর পরিচয়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ভেবেছিলাম তোমাদের পক্ষে ওখানে হোটেল জোগাড় করা সম্ভব হবে না তাই আমাদের ছাড়াই অনুষ্ঠান হয়ে যাবে। আর আমার ছেলে যে যাবেই সেটা আমার জানাই ছিলো, সেই জন্যে বলেছিলাম ওই ভাবে। পরে বুঝেছি আমি নিজে ভালো থাকতে গিয়ে হয়ত তোমার বাবা মাকে অপমান করে ফেলেছিলাম সেদিন। ওনাদের বলো আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।

শাশুড়ির হাত দুটো ধরে ফেললো অপর্ণা,

থাক ওসব কথা! আর পুরনো কথা মনে করতে চাই না। আপনি একদম মন খারাপ করবেন না, ঋজু কে বোঝানোর চেষ্টা করবো খুব, নিশ্চয়ই বুঝবে ও সবটা। আপনি চান না যখন, তখন ওকে বলবো না কিছু তবে ও জানলেও আপনি ছোটো হতেন না কিছুতেই, মানুষের ধৈর্য্যের তো একটা সীমা থাকে, সেটা যখন পেরিয়ে যায় তখন হয়তো মানুষ এরকমই কিছু করে ফেলে, এতে আপনার কোনো দোষ নেই।
ক্রমশ