চন্দ্রপুকুর পর্ব-২২+২৩+২৪

0
227

#চন্দ্রপুকুর
||২২তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
সারাটা রাত যামিনীর কেটেছে নিরাপত্তাহীন, আক্রমণের ভীতি নিয়ে। সাথে তো মেহমাদ শাহের হতে বিরহের শোক তো আছেই।

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা ভোর হলো এবার তো অশ্রুর পতন রোধ করুন। ক্যানো এতো বেদনা বোধ করছেন, জমিদার বাবু আপনার চৌকাঠে পা রাখবেই দিনশেষে।”

“জানি না দিলরুবা। কেন যেন বোধ হচ্ছে বাবু মশাইকে অতি শিঘ্রই হারিয়ে ফেলবো আমি। এই ভয় আমার অভ্যন্তরে গভীর ভাবে ক্ষত তৈরি করছে।”

আফসোসের সুরে শুধালো যামিনী। দিলরুবার জানা নেই কোন ভাষায় নিজের মনিবকে সান্ত্বনা দিবে সে।

এমন সময় দ্বারে জোরালো করাঘাতের শব্দ। কেঁপে উঠে উভয় নারীই। কেমন এক ভীতি যেন গ্রাস করছে তাদের।

যামিনীর ইশারা পেতেই দেওয়াল হতে তরবারি নামিয়ে দিলরুবা এগিয়ে যায়। এমন অধিক সতর্কতার জন্য দায়ী কোনো এক অজানা কারণে তাদের কক্ষ হতে প্রহরীদের সরানো হয়েছে।

ধীর হস্তে দ্বার খুলতেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করেন পরিচিত মধ্যবয়সী নারীটি। তাঁকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে যামিনী ও দিলরুবা।

“কেমন আছো চন্দ্রমল্লিকা? বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ভাবলাম ভুলে গেলে কি না আমায়, তাই মনে করিয়ে দিতে আসলাম।”

গুলবাহার খাতুনের কথা শুনে বিরক্তিমাখা চোখে তাঁর দিকে তাকালো যামিনী। নারীটি তা দেখে আলতো হাসলো।

“আহা! বিরক্ত, রাগান্বিত হচ্ছো বুঝি? যত্তসব রাগ, বিরক্তি আমার বিষয়েই, আজও অবধি নিজ শ্বশুরালয়ের জন্য বাঁদী হতে রাণী হতে পারলে না তা নিয়ে ক্রোধ নেই কোনো। বাঁদী, বাঁদী, যামিনী বাঁদী।”

“চুপ করুন! সামান্য খাতুন আপনি, আপনার স্পর্ধা কী করে হয় আমাকে এ বলে সম্বোধন করার! আমি বেগম চন্দ্রমল্লিকা, গোটা শেরপুরের জমিদার নবাব মেহমাদ শাহের একমাত্র স্ত্রী। আমাকে বেগম বলুন। বেগম!”

খিলখিল করে হেসে দেন গুলবাহার খাতুন। যামিনী ক্রুব্ধ হওয়ার চাইতে অবাক অধিক হয়।

“হাসালে কন্যা। তোমাকে কে দিয়েছে বেগমের মর্যাদা? নিয়ম মোতাবেক প্রতিটি বেগমকে বেগম লুৎফুন্নেসার উপদেষ্টা স্বরূপ রাখার কথা অন্দরমহলের বৈঠকে বা যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে। আজ অবধি কোন বৈঠকে তুমি উপস্থিত ছিলে বা ডাকা হয়েছিল? বাস্তবতা তো এটাই তুমি সাধারণ এক বাঁদী।”

“চুপ! একদম চুপ! আর একটা শব্দও দু’ঠোঁটের ফাঁক হতে বের হলে জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলবো আমি।”

নারীটি এগিয়ে আসে কিশোরীর দিকে। তাঁর চোখে কোনো ভয় নেই, শুধুই তাচ্ছিল্য ও ক্ষোভ মিশ্রিত চাহনি।

“এতোদিনে এও বোধ করতে পারোনি কিছুতেই ভীতি জাগে না আমার। আর আমি যে মিথ্য কিছু বলিনি তার প্রমাণ তোমার বিনা যুক্তির ক্রোধই। জিভ নাহয় আমার কাটা যাবে, সত্য তো মিথ্যে আর হবে না।”

তিনি গটগট করে বেড়িয়ে যান। মুখে তাঁর জয়ের হাসি। এই রমণীকে শব্দের আগুনে পুড়িয়ে যেন ব্যথা লাঘব হয় তাঁর।

যামিনী ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাঁর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। মানুষটি তো মিথ্যে বলেনি। হুট করেই তার কষ্ট ক্রোধে পরিণত হয়। যা ‘বেগম’ এর প্রাপ্য ক্ষমতা অর্জনের জন্য সকল কিছু জ্বালিয়ে ভস্ম করতেও রাজি।

চোখ জোড়া বন্ধ করে কিছু ভেবেই বলে উঠে,
“দিলরুবা, আজ অন্দরমহলের ভোজনশালায় বিরাট আয়োজন করার আদেশ দাও রন্ধনশালায়। সকলকে বলো আজ আমার জন্মদিন তাদের উপস্থিত। নবাব পরিবারের সদস্যদেরও আমন্ত্রণ করো।”

“যথা আজ্ঞা বেগম।”

দিলরুবা উত্তর দিয়ে কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে বের হয়। যদিও সে অনুধাবন করতে পারছে না কী চলছে যামিনীর মস্তিষ্কে।

___

বেগম নূর বাহার দিলরুবার হতে নিমন্ত্রণ পেয়ে রাগে ফুঁসছেন। অপেক্ষা করছেন শাহাজাদি মেহনূরের আগমনের।

দুশ্চিন্তায় মাথা ব্যথা বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁর। তাই মাথা ও হাত-পা টেপাচ্ছেন দাসীদের দ্বারা। একটু বাদেই আগমন ঘটে শাহাজাদির।

“আসসালামু আলাইকুম মামীজান। আমাকে ডাকিয়েছেন?”

“হ্যাঁ, ডাকিয়েছি। জেনেও না জানার ভান করছো? জানা নেই ক্যানো ডাকিয়েছি?”

“মামীজান।”

অস্ফুটভাবে কথাটা বলে ইশারায় উপস্থিত দাসীদের দেখায় সে। তিনি বুঝতে পেরে আদেশ করেন,

“কক্ষ খালি করা হোক। আমি শাহাজাদির সাথে একান্ত কথা বলতে চাই।”

তারা বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে গেল।

“এখন বলো আমাকে, কী হয়েছে? যেখানে ঐ কন্যার আর্তনাদ পুরো মহলে আলোড়িত হওয়ার কথা প্রভাতে, সেখানে সে আনন্দিত, দিচ্ছে জন্মদিনের দাওয়াত।”

“মামীজান, আল্লাহ নিজ হাতে ঐ ঘুঁটেকুড়ুনিকে বাঁচিয়েছে। আমার লোক তাকে আক্রমণ করতে পারেনি। গুলবাহার খাতুন উপস্থিত ছিল তার কক্ষে।”

“ধুর! এই মেয়েটা বারবার হাতে এসেও হাত হতে পিছলে যাচ্ছে।”

“আপনি চিন্তা করবেন না মামীজান। আমি শাহাজাদি নূর বাহার যখন এ কার্য সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছি। তা সম্পন্ন করেই ছাড়বো।”

“ইনশাআল্লাহ। আমার দোয়া সবসময় তোমার সঙ্গেই আছে আমার চাঁদের আলো।”

উভয় নারী এবার পুনরায় বারান্দায় যেয়ে আলোচনায় বসেন যামিনী নামক অধ্যায়টিকে মেটানোর।

একজন প্রহরী উচ্চ স্বরে জানায়,
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, উপস্থিত হয়েছেন।”

বেগম নূর বাহারের চোখে-মুখে কঠোরতা ছেয়ে যায়। শক্ত কণ্ঠে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়।

“আসসালামু আলাইকুম আম্মিজান। মাশাআল্লাহ অদম্য সৌন্দর্যের মালিক আপনি। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুক।”

“হুম। কিছু বলতে এসেছো কন্যা? তাহলে আমার মূল্যবান সময় অযথা ব্যয় না করিয়ে বলে ফেলো।”

“অবশ্যই, আম্মিজান। আমার জন্মদিন উপলক্ষে করা আয়োজনে আপনাকে আসার আবেদন করতে এসেছি। আপনি এসে আমার অনুষ্ঠানকে ধন্য করুন।”

“হুম, ঠিক আছে।”

“আমি উঠছি, মামীজান। আমার নিজ কক্ষে যাওয়া লাগবে।” শাহাজাদি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে নেয়।

যামিনী হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রস্তাব রাখে,
“তাহলে চলুন না শাহাজাদি একসাথেই যাওয়া যাক। বিদায় আম্মিজান।”

উভয় রমণী একসঙ্গেই কক্ষ হতে বের হয়। হাঁটার মাঝে কিশোরী শুধায়,
“উপস্থিত হবেন কিন্তু বেগম আমার ছোট্ট আয়োজনে। আমার আয়োজনে আপনার উপস্থিতি আবশ্যম, যতোই হোক আপনার ভ্রাতার একমাত্র স্ত্রী আমি।”

“ভ্রাতা? কী সব উল্টোপাল্টা কথা বলছো! শাহ আমার ভাই না। আমার মায়ের গর্ভে তার বেড়ে উঠা নয়।”

“মায়ের পেটের না হোক মামাতো ভাই তো। কারণ আপনাদের বিয়ে তো আর হচ্ছে না কোনো কালেই। আমি থাকতে কীভাবে সম্ভব তা?”

শাহাজাদি মেহনূর হাঁটা থামিয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“তুমি না থাকলে তো সম্ভব, তাই না? নবাব শাহ নেই, তোমার কক্ষের বাহিরের প্রহরীরা নেই। ভীতি জাগছে না তোমার? জাগা উচিত।”

কিশোরীর মুখশ্রী বিবর্ণ হয়ে উঠলো। যুবতী বঁচন কটাক্ষ করে চলে যায় সেখান হতে। যামিনী পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে যেন চরণ দুটোতে শক্তি পাচ্ছে না আর।

___

ভোজনশালায় জমজমাট আয়োজন খাবারের। দাসীরা তো তৃপ্ত। যামিনী নিজ উদ্যোগে দাঁড়িয়ে সবার আহার করা ঠিক-ঠাক হচ্ছে কি না সেটা খেয়াল রাখছে।

কিশোরীর রন্ধনশিল্পে দক্ষতার পরিচয়ে বেগম লুৎফুন্নেসাও তৃপ্ত। যদিও মুখে কিছু বলছেন না।

“ধন্যবাদ বেগম। অনেক অনেক ধন্যবাদ। বহুদিন পরে এতো ভালো ভালো খাবার পেট ভরে আহার করলাম। আপনিই আমাদের যোগ্য বেগম। আল্লাহ আপনি সুখ, শান্তি ও মর্যাদা দিক।”

প্রতিটি দাসী যাওয়ারর হওয়ার পূর্বে যামিনীর হাতে চুমু খেয়ে প্রসংশা বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে। সেও খুব আদরের সহিত তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে কিছু অর্থ।

বেগম লুৎফুন্নেসা আড়চোখে তা খেয়াল করছেন, তার ঠোঁটের কোণে হাসি স্থির। শাহাজাদি নূর বাহার তা খেয়াল করে বেগম নূর বাহারকেও ইশারা করে দেখতে।

সকলে আহার শেষে মহাপরিচারিকা উঠে বেগম লুৎফুন্নেসার কাছে এসে দাঁড়ান। যেন হুট করেই জরুরি কিছু মনে পড়েছে তাঁর।

“বেগম লুৎফুন্নেসা, ক্ষমা করবেন। একটা গুরতর বিষয় আপনাকে জানাতে ভুলে গিয়েছি আমি। অন্দরমহলের কিছু দাসীদের মাঝে দ্রোহের শুরু হয়েছে বেতনকে কেন্দ্র করে সহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে। এই বিষয়ে একটু বিচার-আলোচনার প্রয়োজন।”

“কী! এই কথা তুমি আজ জানাচ্ছো আমায়! তোমার থেকে এরূপ দায়িত্বহীনতা আশা করিনি আমি। যাকগে আগামীকালই এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।”

“অবশ্যই বেগম।”

যামিনী বেগম লুৎফুন্নেসার কাছাকাছি বসায় সবই শুনতে পায়। সে বোধ করেছে দাদীজান প্রকাশ না করলেও তার উপর কিছুটা তুষ্ট আজ। তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুল করে না সে।

“দাদীজান, আপনি অনুমতি দিলে এই আলোচনায় আমি উপস্থিত থাকতে চাই। আপনাকে দেখেই তো আমি শিখবো কীভাবে যোগ্য হওয়া যায় ‘বেগম’ পদবী এর, কীভাবে সমস্যার মোকাবেলা করা যায়। তাই আপনি যদি অনুমতি দিন…”

“আচ্ছা, তুমিও এসো চন্দ্রমল্লিকা।”

মনে মনে খুশি হলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। মেয়েটা অযোগ্য হলে নিষ্ঠাবান নিজের কর্মের প্রতি।

এদিকে দু’জন নারীর এই দৃশ্য দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে ক্রোধে। উভয়েই ধৈর্য্য রাখতে না পেরে দ্রুত বিদায় জানিয়ে স্থান ত্যাগ করে।

___

বেগম নূর বাহার ও শাহাজাদি মেহনূর গভীর চিন্তায় ডুবে।

“মামীজান, নানীজান যেভাবে ধীরে ধীরে সন্তুষ্ট হচ্ছেন চন্দ্রমল্লিকার প্রতি আমার ভয় লাগছে। কারণ একবার যদি যামিনী তাঁর চোখে যোগ্য প্রমাণিত হয়, তিনি নিজেই হবে যামিনীর ঢাল।”

“সেটা তো আমারও দুঃশ্চিন্তা। তবে তুমি চিন্তা কোরো না। এতো দিন যা করেছে, ভেবেছো, সব তোমার দ্বারাই। তবে এবার আমি যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছি। এমন কিছু ভেবেছি যাতে ঐ মেয়ে নিজেই নিজের কাল ডেকে আনবে, আম্মিজান নিজ হস্তে ঐ মেয়েকে মেটাতে উদ্ধত হবেন।”

চলবে…

#চন্দ্রপুকুর
||২৩তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
অন্দরমহলের বিশেষ দপ্তরে হওয়া বৈঠকে উপস্থিত থেকে যামিনী এক কদম এগিয়েছে ক্ষমতার দিকে। অপর ক্ষেত্রে চলছে বিশাল আয়োজন তাকে দশ কদম পিছিয়ে ফেলার।

“শুরু করার আদেশ দেওয়া হলো।”

“বেগম লুৎফুন্নেসা, কয়েকজন দাসী তাদের প্রাপ্ত অর্থ কম বলে বিদ্রোহ করছে। মহলের উত্তর-পশ্চিমের নব দাসদের উদ্দেশ্য বানানো টিনের রন্ধনশালার ছাদে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। পানি পড়ে বলে অভিযোগ জানিয়েছে। আর বেগম…”

“আর কী?”

“বেগম লুৎফুন্নেসা, প্রায় এক বছর ধরে গ্রামে এতিম কিশোরী, স্বল্পবয়সী বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে না, আবার অন্দরমহল হতে চাকরির বিজ্ঞাপনও দেওয়া হচ্ছে না বলে তাদের জীবন বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। গ্রামবাসী বারবার আবেদন করছেন কিছু ব্যবস্থা করার, কেউ কেউ একটু বেশিই উত্তেজিত এ নিয়ে।

আবার বেশ কয়েক যুবতী দাসীদের দৈহিক চাহিদার তাড়নায় দাসদের নিবাসে ঢুকতে দেখা গিয়েছে বলে বিচার এসেছে। শেরপুরের বিভিন্ন মৌলভি ও ইমাম সাহেবের কর্ণগোচর হয়েছে এ খবর। আড়ালে তাঁরা আমাদের নবাব শাহ আর অন্দরমহলের কর্ত্রী তথা আপনার উপর অসন্তুষ্টি, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।”

আসন হতে উঠে দাঁড়ান বেগম লুৎফুন্নেসা, ক্ষুব্ধ তিনি। ক্রোধে তাঁর চোখে-মুখে কঠোরতা ও আঁধার ছেয়ে গিয়েছে।

“এতো ভুল! এতো ভুল! মালিহা খাতুন, আয়েশা খাতুন তোমাদের ন্যায় অভিজ্ঞজনের নিকট এমন ভুল আশা করিনি। এতো কিছু হয়ে গেল আজ জানছি আমি।

পূর্বে জানলে সমস্যাটা এতো বৃদ্ধি পেতেই দিতাম না। কারো কর্ণ অবধি পৌঁছানোর পূর্বেই পাথর চাপা দিয়ে আড়াল করে নিতাম সকল কিছু। এখন তো ক্ষত অনেক গাঢ় হয়েছে, শিফা পাওয়া মুশকিল। দাসীদের সাথে কথা বলে দেখো, কিছুটা বোঝানো যায় কি না…”

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। তারা অনেকটা ক্রোধান্বিত, এই মুহূর্ত তাদের কোনো কথাতেই দমানো যাবে না। সমস্যা আরও বাড়বে বটে। আমার মতে এই মুহূর্তে তাদের প্রাপ্য বেতন বাড়িয়ে দেওয়াই উত্তম হবে।”

“তুমি বুঝতে পারছো না, আয়েশা খাতুন। এ বছর মৎস্যের বাণিজ্যে লোকসানের মুখ দেখতে হয়েছে আমার সিংহকে। এমতাবস্থায় অন্দরমহলের জন্য ধার্যমাণ মাসিক বা বাৎসরিক খরচের অর্থ এতোটা নয় যে বেতন বাড়ানো যাবে না। তাছাড়া একবার তাদের কথা মেনে নিলে, সাহস বাড়িয়ে দেওয়া হবে।”

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন, দাদীজান। আপনি অনুমতি দিলে আমি আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে বিদ্যমান পরামর্শ রাখতে চাই।”

যামিনী বাণীর জন্য বেগম লুৎফুন্নেসা সহ উপস্থিত সকল খাদিম ও বেগম নূরবাহার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এমন চাহনিতে একটু হচকচিয়ে যায় কিশোরী। ভুল করে ফেললো কি না নিজের মূল্য বোধ করাতে এই সভায় অংশগ্রহণ করতে যেয়ে।

“ঠিক আছে। বলো কী বলতে চাও তুমি।”

দাদীজানের গম্ভীর কণ্ঠে কানের দোয়ার পেড়িয়ে গেলেই স্বস্তির শ্বাস ফেলে সে।

“আমার মনে হয় যুবতী দাসীরা নিজের চাহিদা বৈধ ভাবে পূরণ না করতে পেরেই অবৈধ পথে হেঁটেছে। এক্ষেত্রে বিবাহযোগ্য ও বিবাহে ইচ্ছুক দাসীদের বিয়ে করিয়ে দেওয়া যায় খাদিম বা দাসদের সাথে।

এই সিদ্ধান্তে মৌলভি ও ইমামদের মাঝে যে বিদ্রোহনলের সূচনা হয়েছে তাতেও জল পড়বে। আবার নতুন দাসী নিলে গ্রামে নারীগুলোরও অর্থ যোগানোর ব্যবস্থা হবে। এর ফলে অতিরিক্ত অর্থও ব্যয় করা লাগবে না, সমালোচনাও ঠেকানো যাবে।”

এক দমে মেঝেতে দৃষ্টি স্থির রেখে নিজের দৃষ্টিকোণ প্রকাশ করলো রমণী। বড় বড় শ্বাস ফেলল সে ক্লান্তিতে। চোখ তুলে তাকালো দাদীজানের দিকে।

তিনি একমুহূর্ত ব্যয় না করেই উপদেশ গ্রহণ করলেন।
“চমৎকার প্রস্তাব। আয়েশা খাতুন, বেগম চন্দ্রমল্লিকার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করো। ইনশা আল্লাহ বিপদ টলে যাবে। মাশা আল্লাহ কন্যা, আল্লাহ তোমায় আরও সুবুদ্ধি দিক।”

যামিনীর মাথায় মমতা মিশ্রিত হাত বুলিয়ে বৈঠক ত্যাগ করেন তিনি। হনহন করে বেড়িয়ে যান বেগম।নূর বাহারও।

___

“শাহাজাদি, শাহাজাদি, সর্বনাস হয়ে গিয়েছে। ঐ কালা জাদুগর বেগম লুৎফুন্নেসাকেও জাদু করে ফেলেছে।”

শাহাজাদি মেহনূর নিজের হাতে কঙ্কন পরছে। রত্নার কথায় কাজে ব্যাঘাত ঘটে তার।

“রত্না, তোমায় কতদিন বলেছি, এভাবে অসমাপ্ত বাক্য বলবে না। না ঘুরিয়ে সোজাসুজি বলো কী হয়েছে।”

রত্না বৈঠকঘরে হওয়া ঘটনা জানায় তাকে। যুবতী ক্রুব্ধ। বিড়বিড়ায়,
“যতোই এই মেয়েকে ডুবাতে চাচ্ছি। ততোই এই মেয়ে তেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে এই যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ের দিকে।”

আকস্মাৎ প্রবেশ করেন বেগম নূর বাহার। তাঁর ললাটে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে আছে।

“মামীজান, এ কী শুনছি আমি রত্নার থেকে! যামিনী যদি এভাবে সকল বৈঠকে অংশগ্রহণ করে ও প্রসংখার পাত্র হয় তবে তো নানীজানের নজরে…”

“নিচে নেমে যাবে।”

“মানে?”

“তা কাল সকালেই বুঝবে। যাকগে তোমাকে যে কার্য দিয়েছি, তা সম্পূর্ণ করেছো?”

“নানীজানের কানে গুলবাহার খাতুনের সাথে যামিনীর যোগাযোগের খবর নানীজানের কানে দেওয়া? কিন্তু এতে কি লাভ হবে?”

“তোমাকে যা আদেশ করেছি, তা করো মেহনূর। প্রশ্ন কোরো না, ভুলে যেয়ো না আমি বেগম নূর বাহার, নবাবের আম্মিজান। তুমি জানো না, গুলবাহার খাতুন এমন বিষাক্ত বৃক্ষ যাকে মারা তো দূরে থাক সম্মুখে যেতেও ঘৃণা করেন সকলে, বিশেষ করে তোমার নানীজান।”

“মার্জনা করবেন, মামীজান। এতো ভাবনায় আমার চিন্তাশক্তিই লোপ পেয়েছিল। তবে আপনি ভাববেন না, আমি রত্নাকে দিয়ে নানীজানের নতুন একজন দাসীকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েছি এই খবর দাদীজানের কানে দিয়ে সন্দেহের বীজ বইতে।”

“তাহলে আর ভেবো না। আগামীকাল সূর্য মাথার উপরে না স্থির হতেই, শুরু হয়ে যাবে প্রলয়।”

___

যামিনী বারবার পিঠ বদল করছে অস্বস্তিতে, কারো দেহের ঘ্রাণের তৃষ্ণায় নিদ্রা হানা দিচ্ছে না তার চেহারায়। তার কান দু’খানা খুব করে চায় কারো কণ্ঠ শুনতে। দেহ, হৃদয় তড়পাচ্ছে কারো ভালোবাসায় সিক্ত হতে।

বহু প্রচেষ্টার পরও যখন তন্দ্রভাব আসে না আঁখিতে, সে উঠে যায় শয্যা হতে। পা রাখে বারান্দায়। দিলরুবাও আজ তার সাথে নেই, সে ছুটি নিয়ে গ্রামে গিয়েছে তার অসুস্থ মাকে এক পলক দেখে আসতে। গভীর রাত্রি, আঁধার বাড়লেই শীত বাড়ে। শাল গায়ে শক্তভাবে জড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয় সে।

“চন্দ্র-শাহ! চন্দ্র-শাহ! ভালোবাসা! ভালোবাসা!”

চাঁদনির কণ্ঠ শুনে আলতো হাসি ফুটে উঠে। আক্ষেপ করে বলে,
“কোথায় আর ভালোবাসা রে চাঁদনি! বাবু মশাই সেই যে গেল আর তো এলোই না এই চন্দ্রমল্লিকার নিকট। না পাঠালো এক খানা চিঠি। সে তো জানে তার চন্দ্রমল্লিকার রন্ধ্র রন্ধ্র ব্যাকুল তার স্পর্শ পেতে। ভালোবাসি বাবু মশাই, নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসি।”

কিশোরী তার বাবু মশাইয়ের প্রতি সকল অভিযোগ, অভিমান একে একে প্রকাশ করতে শুরু করে অবুঝ পক্ষীটির নিকট। এতেই যেন ব্যথা লাঘব হচ্ছে তার। কথা বলতে বলতে সেখানে বিদ্যমান রাজকীয় দোলনাতেই নিদ্রায় ডুবে যায় সে।

অপরদিকে তার অজান্তেই ধূর্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সূচনা হয়ে গিয়েছে দপ্তর হতে। কালো পোশাকে আবৃত এক ব্যক্তি সকলের আড়ালেই আত্মসাৎ করছে অতি মূল্যবান দলিল ও কাগজ-পত্র।

অতঃপর যামিনীর নিদ্রা এবং প্রহরী ও দিলরুবার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে ব্যক্তিটি ঢুকে যায় কক্ষেও। চুরি করা কাগজ-পত্র রেখে যায় অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সহিত লুকিয়ে।

তবে কি আগামীকাল প্রলয়ের আগমন অনিবার্য?

___

ভোর হয়েছে। বেগম লুৎফুন্নেসার চিৎকার, চেঁচামেচিতে মুখরিত গোটা অন্দরমহল। যামিনীরও নিদ্রা ভঙ্গ হয় তা শুনে।

দ্রুতো পোশাক বদলে কী হয়েছে জানতে বের হয় সে। দাসীদের নিকট জানতে পারে অন্দরমহলে গতকাল রাতে কাগজ-পত্র এদিক-ওদিক করা হয়েছে। বিস্মিত হয় সে। কে করতে পারে এমন কাজ?

বেগম লুৎফুন্নেসা ক্রোধে যেন চেতনাই হারাবেন। দপ্তরের ঐ সিন্দুকে শুধু এই পরিবার ও জমি সংক্রান্ত দলিল ও কাগজই ছিল না। ছিল তার প্রিয় পত্র, যার রহস্য জানে না কেউ। একবার বাহিরের লোক বুঝতে পারলে, এতোকাল ধরে মাটি চাপা দেওয়া রহস্য না খুলে যায়।

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন, বেগম। গোটা নবাব বাড়ি তল্লাশি করেছি, চুরির কোনো চিহ্নই নেই। এমন কী কাগজ-পত্র বাদে দপ্তরে অর্থ ভর্তি সিন্দুক ও মূল্যবান বস্তু থাকা সত্ত্বেও তা চুরি হয়নি।”

“আগামীকাল কে কে এসেছিল দপ্তরে? তাদের মাঝে কেউ কি না দেখো।”

“আগামীকাল বৈঠক শেষে আপনারা যাওয়ার পর কেউ তো আসেনি। আপনারা গেলেন, তার কয়েক মুহূর্ত পরই বেগম চন্দ্রমল্লিকা বের হন। অতঃপর প্রহরী তালা লাগিয়ে দেয়।”

হুট করেই তাঁর মাথায় আসে কাল রাতের চুলে তেল মালিশ করতে করতে নতুন দাসীটির বলা কথাটি। মেয়েটি বলছিল, গুলবাহার খাতুনকে প্রায়শয়ই দেখা যায় যামিনীর কক্ষে, বেশ সুসম্পর্ক তাদের। তাঁর প্ররোচনায় পড়ে যামিনী এই কুকর্ম করেনি তো?

চোখ-মুখ শক্ত করে তিনি আদেশ করলেন,
“চন্দ্রমল্লিকার কক্ষের তল্লাশি করাও আয়েশা। সবার শেষে যেহেতু সে বের হয়েছিল, সন্দেহ তার উপরই।”

“বেগম!” অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকান আয়েশা খাতুন। তবে মিইয়ে যান মনিবের চোখ রাঙানোতে।

অতঃপর বেগম লুৎফুন্নেসার উপস্থিতিতে কিশোরীর কক্ষে অনুসন্ধান চালানো হয়। যামিনী একদম নিশ্চিন্ত হলেও আঁতকে উঠে তার কক্ষ হতে পাওয়া দলিলপত্রাদি দেখে।

“দাদীজান, বিশ্বাস করুন আমি এই অপরাধ করিনি। আমি জানি না কীভাবে এলো এইসব আমার কক্ষে। বিশ্বাস করুন!”

“একদম চুপ কালনাগিনী! আমি তোমাকে অযোগ্য হলেও ভালো মনে করেছিলাম। তুমি তো দেখি চন্দনে লেপ্টে থাকা সর্প। প্রহরী বন্দী করে নেও এই বেইমানকে। আগামীকালই পাঠানো হবে তাকে উত্তরের জঙ্গলের বাড়িতে।”

যামিনী আকুতি করে সত্য জানায়। তাকে মুক্তি দিতে আবেদন করে। তার অশ্রু, আকুতি কিছুই কর্ণগোচর হয় না বেগম লুৎফুন্নেসার।

মোর্শেদা খাতুনও আবেদন করে,
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন, আম্মিজান। তবে জমিদার নবাব শাহ আসার অপেক্ষা করলে বোধহয় ভালো হতো।”

“দিনে দিনে আদবও তোমার সঙ্গ ছাড়ছে খাতুন। তোমার মতো নারীর উপদেশের আমার প্রয়োজন নেই।”

চলবে…

#চন্দ্রপুকুর
||২৪তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
আঁধার চারদিকে, বাহিরের দৃশ্য দর্শনেরও সুযোগ নেই। প্রায় ছাদের সাথে লাগোয়া ছোটো একটা জানালা হতে একফালি আলো গড়িয়ে পড়ছে শুধু। চারটা দিন ধরে স্নান, আহার করা ব্যতীত যামিনী এই কক্ষে, ঠিক কক্ষ বলা যায় না, বন্দীশালাই বলা ঠিক।

“আল্লাহ, এ আমায় কোন বিপদে ফেললে তুমি। কোনো দোয়ারই মুক্ত পাচ্ছি না আলোর সাক্ষাৎ পেতে। এভাবে চললে আমার মৃত্যু অনিবার্য। এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আমি চাই না আমার আল্লাহ। আমার প্রিয়তমের সাথে আমি বার্ধক্য কাটাতে চাই।”

তার আকুতি, দীর্ঘশ্বাস চার দেওয়ালের মাঝেই স্থির থাকে। কর্ণগত হয় না কারো। তবে সে জানে এই দিনের অবসান ঘটবে, বাবু মশাই নিশ্চয়ই তাকে এই অন্ধকারে ঠেলে দিবে না।

“এই মেয়ে।”

চোখ তুলে তাকায় যামিনী। দ্বারের ফাঁক দিয়ে খাবারের থালা ঢুকলো।

কিশোরী আলতো হাসলো, মুখে তুললো না এই খাবার।

চিৎকার করে বলল,
“এই অন্ন আমার গলা দিয়ে ঢুকবে না। আমি বাবু মশাইয়ের বেগম, বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আমার সাথে এই আচারণের শাস্তি সবাই পাবে। সবাই!”

তার চিৎকার ততোটাই মূল্যহীন যতোটা মূল্যহীন হয় দেহের ঘ্রাণ বেলির সুগন্ধির কাছে। বরং, ভিতরে ঢুকে একজন নারী খাদিম বার কয়েক শক্ত হাতের মার লাগাতে ভুল করে না। আজ প্রথম না এই চার দিনে সে বহুবার আঘাত পেয়েছে নিজের বিদ্রোহের কারণে।

এতোদিনের না খাওয়া যামিনী দখল নিতে না পেরে দ্রুতই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। তার মনে হচ্ছে মৃত্যু খুব কাছে।

___

বেগম লুৎফুন্নেসা পান মুখে তুলে নিচ্ছেন। আঁখিজলে ভরে যাচ্ছে তার হাতে বিদ্যমান পুরনো লালচে আভার পত্রটি পড়তে পড়তে। চোখের সামনে ভাসছে পরিচিত মুখ। কতো বছর আগের ছবি, চিঠি, তবুও যেন আজকে পাওয়া ক্ষতের ন্যায়ই তাজা সকল অনুভূতি।

তাঁর ভাবনার মাঝে দরজা ঠেলে প্রবেশ করেন মালিহা খাতুন। উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি, তাই অনুমতি নিতেও ভুলেছেন।

“সাহস কত! অনুমতি ছাড়া আমার কামরায় প্রবেশ করলে!”

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করুন বেগম। তবে কথাটি প্রকাশ না করেও স্বস্তি পাচ্ছি না।”

ভ্রুঁ কুঁচকালের বয়স্ক নারীটি। বয়সের ভাজ পড়া মুখশ্রীতে বিরক্তির আভাও সুস্পষ্ট। দিন কয়েক কেটেছে মাত্র এক ঝামেলা মেটানোর পর এখনই আবার পুনরায় কী হলো?

“মালিহা খাতুন, যা বলার সুস্পষ্ট করে বলো। কোনো রূপ ভনিতা কোরো না। আমি তা নেওয়ার অবস্থায় নেই।”

“হুজুর, আমি… আমি এবং একজন খাদিম আসলে চুরির সময় মানে সেদিন অর্ধরাত্রিতে এক দাসীকে কালো পোশাকে আবৃত হয়ে লুকিয়ে নিবাসে ফিরতে দেখি। দপ্তরে যাওয়ার পথ হতেই ফিরছিল সে। গুরত্বপূর্ণ ভাবিনি বিধায় আর বিষয়টা ঘেঁটে দেখা হয়নি।

সকালে আমি বাজারে গিয়েছিলাম ফিরার পর চুরি এবং বেগম চন্দ্রমল্লিকাকে আটক করার খবর শোনার পর তার উপর সন্দেহ হয়েছিল। তদন্ত করে দেখি সেটাই সত্য, কারণ একজন প্রহরী কালো পোশাকধারী ব্যক্তিকেই বের হতে দেখে দপ্তর হতে।”

আঁতকে উঠেন বেগম লুৎফুন্নেসা। অন্যায়-অবিচার কখনোই তার কর্ম নয়। তাছাড়া যদি যামিনী প্রকৃতপক্ষেই নির্দোষ হয়ে থাকে তবে প্রিয় পৌত্র মেহমাদ শাহকে কী জবাব দিবেন?

“মূর্খ! তুমি এসব এখন জানাচ্ছো আমায়? সেদিন ক্যানো জানাওনি?”

“কারণ ঐ দাসীটি… ঐ দাসীটি বেগম নূর বাহারের খেদমতে নিয়োজিত খাঁস বাঁদী রোকাইয়া।”

মনে মনে যা ভয় করছিলেন তিনি তা-ই হলো। ধপ করে শিমুল তুলোর নরম গদিতে বসে পড়েন তিনি। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী করে করবেন তিনি?

কোনোরকম উচ্চারণ করলেন,
“এই মুহূর্তে বেগম চন্দ্রমল্লিকাকে সসম্মানে নবাব বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হোক। আর ঐ দাসীকে বন্দী করে যেভাবে পারো, যেই প্রক্রিয়ায় জবানবন্দি নেও তার। আর আমার সামনে উপস্থিত করাও মূল অপরাধীকে।”

মালিহা খাতুন সায় জানিয়ে বিদায় নিলেন। বেশ কিছুটা সময় রোকায়াকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হন দু’জন প্রহরী। ছুঁড়ে ফেলেন বেগম লুৎফুন্নেসার চরণে।

পা জড়িয়ে ধরে মার্জনার আবেদন করে যুবতী,
“বেগম, ক্ষমা করুন আমায়। ক্ষমা করুন। আমার কোনো দোষ নেই, শাহাজাদী মেহনূর আর বেগম নূর বাহার আমাকে এই আদেশ দিয়েছিলেন।”

“শাহাজাদী?”

হতভম্ব হয়ে যান বেগম লুৎফুন্নেসা। যে যুবতীকে শীতল মস্তিষ্কের, শান্তশিষ্ট ভেবেছিলেন। সে কি না মুক্ত এক হিতাহিতজ্ঞানশূন্য পশু!

“মালিহা খাতুন, এই বেহায়াকে বন্দী করো, অন্নের একটা দানাও যেন পেটে না যায় তার। সকল দাসী বুঝুক কী হয় অপরাধীর সাথে। আর নূর বাহার এবং মেহনূরকে এক্ষন উপস্থিত হতে বলো।”

শাহাজাদী মেহনূর ও বেগম নূর বাহার আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত হন তাঁর কামরায়। বেগম লুৎফুন্নেসা খেয়াল করেন দু’জনের মুখশ্রীতেই অন্যরকম নূর।

“আয়েশা খাতুন?”

ইশারা পেতেই রোকেয়াকে আড়াল হতে টেনে আনেন আয়েশা খাতুন। সদ্য আসা উভয় নারীর চেহারার রঙ উবে যায় দাসীটিকে দেখে।

ভীতিগ্রস্ত দৃষ্টিতে একদফা শ্রদ্ধেয় বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে নত করে ফেলেন মাথা।

“এখন নিশ্চয়ই বুঝেছো ক্যানো ডাকা হয়েছে তোমাদের? ছিঃ! ছিঃ! মেহনূর, আমার চাঁদের কণা তোমার হতে এই আশা করিনি আমি। এর শাস্তি তোমরা পাবেই। তোমাদের একবারও ভয় হয়নি আমার সিংহের কানে এ খবর গেলে কী ”

যেভাবে সাপ প্যাঁচিয়ে ধরে তার শিকারকে সেভাবেই বেগম নূর বাহার ও শাহাজাদি উভয়ে আঁকড়ে ধরে বেগম লুৎফুন্নেসার চরণ দু’খানা। ভয়ে কাঁদতে শুরু করে।

“ক্ষমা করুন আম্মিজান। আপনি তো জানেন আমার বুদ্ধিশুদ্ধি কম। ভুল করে ফেলেছি। দয়া করে এটা আমার পুত্রের কানে দিবেন না।”

“হ্যাঁ, নানীজান। ক্ষমা করুন। আমার বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। এই খবর শাহ জানলে সারা জীবন আমার ঘৃণা করব। আমাকে শাস্তি দিতে কোনো অংশ বাদ রাখবে না। দয়া করুন।”

নানীজানের ভঙ্গিমায় কিছুটা পরিবর্তম লক্ষ্য করলেও দৃঢ়তা বিদ্যমান। তাই দুর্বলতাতেই হাত রাখলো মেহনূর এবার।

“এছাড়া আম্মিজান আপনার প্রিয় একমাত্র কন্যার বদনাম হবে। এ খবর জানলে বাবা ও দাদীজান নিশ্চয়ই কটাক্ষ-বানে ক্ষত-বিক্ষত করবেন আম্মিজানকে। আম্মিজানের জন্য ক্ষমা করুন আমাকে।”

কিছুক্ষণ ভাবলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। একমাত্র কন্যা তাঁর মেহনূরের মাতা, তাঁর কোনোরূপ অশান্তি তিনি চান না।

“ঠিক আছে, তবে এটাই শেষবার। এরূপ অপরাধ আবার হলে আমি নিজ হস্তে তোমাদের সঁপে দিব আমার সিংহের নিকট।”

___

দিলরুবা গ্রাম হতে ফিরে জানতে পারে তার প্রিয় বেগমের এই দুর্দশার কথা। শুনে সে বেশ দুঃখিত ও হতাশ হয়। বারবার আর্জি করা আল্লাহর নিকট তার মনিবের মুক্তির উদ্দেশ্যে। অবশেষে আজ আয়েশা খাতুনের হতে সে খুশির খবর পেলো।

অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত সে যামিনীর উদ্দেশ্য। যদিও বৈদ্যশালায় অপেক্ষা করার কারণ সে পাচ্ছে না।

ক্ষত-বিক্ষত অচেতন দেহ অন্দরমহলে প্রবেশ করলো যামিনী। তার দৈহিক অবস্থা দেখে ভড়কে যায় দিলরুবা নিজেও।

“ইয়া আল্লাহ” চিৎকার করে নিজের প্রিয় বেগমকে জড়িয়ে ধরে সে।

“এভাবে চেঁচিয়ে সারা ঘরের লোক এক করবে না কি দিলরুবা? শান্ত হও।”

“কিন্তু বেগমের এ দশা?”

“চিন্তা কোরো না। বৈদ্য তো আছেন, দেখছেন। খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে বেগম।”

যামিনীর অচেতন দেহকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তাঁর চেহারা গাম্ভীর্যপূর্ণ ও হতাশা জর্জরিত।

বেগম লুৎফুন্নেসাও উপস্থিত সেখানে। চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলেন,
“কী হলো তোমাকে এমন দেখাচ্ছে ক্যানো? চন্দ্রমল্লিকার কী অবস্থা?”

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম লুৎফুন্নেসা। তবে বেগম চন্দ্রমল্লিকার সুস্থ হওয়ার সুযোগ খুবই স্বল্প, মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে হেলে পড়ছেন বটে।”

“এটা কী কথা তোমার! আমি বেগম চন্দ্রমল্লিকার সুস্থতা চাই।”

“আল্লাহ সহায় হলে অবশ্যই হবে। তবে আমার হাতে কোনো বিশেষ সুযোগ নেই তাকে বাঁচানোর। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তবুও।”

আর কোনো কথা হয় না সেই মুহূর্তে। বেগম লুৎফুন্নেসা সেখানেই থেকে যান।

রাত বাড়ছে, একটু একটু করে অবনতি হচ্ছে যামিনীর শারীরিক অবস্থার। সেই সাথে দরদর করে ঘামছেন বেগম লুৎফুন্নেসা, এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হলে কী জবাব দিবেন তিনি মেহমাদ শাহের নিকট? মেহমাদ শাহের নয়নযুগলে প্রেমের অগ্নি দর্শন পেয়েছেন তিনি, নিশ্চিত এই খবর কর্ণগোচর হলে এই গোটা জমিদারি সুদ্ধ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ফেলবে সে।

তবে কি অতি নিকটে যামিনীর মৃত্যু ও এই জমিদারীর ধ্বংস?
চলবে…