চন্দ্রপুকুর পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
282

#চন্দ্রপুকুর
||৩৭তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
নিজেকে সামলে মেহমাদ শাহ জিজ্ঞেস করে,
“বিশিষ্ট সাংবাদিক আর.কে. হকিংস! তিনি কেন আসছেন? আর তাঁর সাথে মেহনূরের আগমনের সম্পর্ক কী?”

“শেরপুর ভ্রমণ করতে, সে আমাদের শাসন ও স্থান নিয়ে ডকুমেন্টারি করতে চান, আর্টিকেল লিখবেনও হয়তো। আর আমার সিংহ, তুমি জানো না কী সম্পর্ক মেহনূরের আগমনের? চন্দ্রমল্লিকা জ্ঞাত এই নবাববাড়িতে চাপা পড়া রহস্য সম্পর্কে? যা লোকচক্ষুর সামনে আসলে ধ্বংস নামবে।”

“তবে চন্দ্রমল্লিকাকে ব্যক্তিগত ভাবে আমরা সকলে জানা ও বোঝাই এই রহস্য। তাহলেই তো হয় দাদীজান।”

বিরক্তি মাখা চাহনি নিক্ষেপ করে বেগম লুৎফুন্নেসা।

“মতিভ্রষ্ট হয়েছে তোমার না কি? জানো না ও গ্রামের কন্যা, তোমার আম্মিজান বা আমার ন্যায় এই বংশের বা শহরের মেয়ে নয়। যদি গ্রামের মানুষের কথা ভেবে রহস্য উন্মেচন করে ফেলে তখন…?

তাই বলছি তাড়াতাড়ি একটা সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দর্শন করাও। তবে তার পায়ে বেঁধে যাবে দরি, আর আমরাও তখন দ্বিধাহীন হয়ে গোটা গুপ্ত কথা তাকে জানাতে পারব।”

কিছু না বলেই ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে যুবক। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়।

“তোমার বিবাহের খবর শহরেও পৌঁছিয়েছে, জমিদারনি হিসেবে কাউকে তো বেগমের বেশ ধরে সাংবাদিকদের সম্মুখে যেতে হবে। শহুরে বাবুদের সাথে কথা বলতে হবে। এই নবাববাড়ির যে রহস্য অন্তরালে আছে, তা অন্তরালে রাখতে এ কাজ করবে শাহাজাদি মেহনূর।”

“আমির হাওলাদার অর্থাৎ ফুপাজান কি পুনরায় পাঠাবেন তাঁর আদরের কন্যাকে? যেখানে এক দফা অপদস্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে।”

কিছুটা রহস্যচ্ছলে দাদীজান উত্তর দেন,

“সে বিষয়ে তোমার ভাববার প্রয়োজন নেই। তুমি শুধু পাশে থেকো, সমর্থন করো। আর ভাবতে হলো চন্দ্রমল্লিকাকে নিয়ে ভাবো। সে যদি উত্তরাদিকার দিতে অসক্ষম হয়, তবে জানোই কী হবে।”

হাতের মুঠি শক্ত হয় যুবকের। নয়নযুগল অসহায়ত্ব ও ক্রোধে জ্বলজ্বল করছে।

“আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি, দাদীজান। তবে মেহনূর যেন আমার চন্দ্রমল্লিকা হতে দূরে থাকে। এবার যদি সে চন্দ্রমল্লিকার ক্ষতি সাধনের চেষ্টাও সে করে তবে আল্লাহর শপথ তার গর্দান যাবে।”

“যাকে এভাবে রক্ষা করতে চাচ্ছো, সে যদি বাঞ্ছা হয় তখন তাকে ব্যতীত থাকবে কী করে? নিজেকে সামলে নেও আমার সিংহ, জমিদারদের জমিদারি ছাড়া অন্য কিছুতে মন দেওয়ার অধিকার নেই।”

“আমার নিজেকে সামলানোর প্রয়োজন নেই, দাদীজান। চন্দ্রমল্লিকা অক্ষম হলেও প্রয়োজনে আমি তাকে স্ত্রী স্বরূপ রেখে আরেকটি বিবাহ করব। যা আমার সাথে আপনার পূর্বেও কথা হয়েছিল।

তবে তালাক দান? তা কখনোই হবে না আমার দ্বারা। তাই স্পষ্ট ভাবে বলে দিচ্ছি কেউ যদি আমার হতে তাকে পৃথক করার সামান্য চেষ্টা করে আমি প্রলয় হয়ে সব ধ্বংস করে দিব, ওয়াদা।”

দাঁতে দাঁত চেপে বচনগুলো উচ্চারণ করে কক্ষ ত্যাগ করে সে। বেগম লুৎফুন্নেসা অদ্ভুৎ ভাবে বেশ নির্লিপ্ত পৌত্রের কার্য দর্শনের পরেও।

___

মেহমাদ শাহের কক্ষে বসে অপেক্ষার প্রহর গুণছে যামিনী। তার চোখ-মুখ ফুলে আছে ক্রন্দনে। বারবার কপোল মুছছে হাতের পিঠে, যদিও পরমুহূর্তেই আঁখিজলে ভিজে যাচ্ছে তা।

দ্বার খোলার শব্দে নোনাজল মুছে উঠে দাঁড়ায় রমণী। মাথা ঝুঁকে সালাম জানায় মেহমাদ শাহকে।

“আসসালামু আলাইকুম, বাবু মশাই। আল্লাহ আপনাকে নেক হায়াত দান করুক।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি এখানে যামিনী?”

যুবকের উচ্চারিত ‘যামিনী’ শব্দটি কর্ণকুহরে পৌঁছালে মানসিক ধাক্কা লাগে তার। মানুষটি যখন তার উপর অসন্তুষ্ট হয় তখনই এই নামে ডাকে তাকে, তা সম্পর্কে সে জ্ঞাত।

“এমনিতেই আপনাকে দেখতে মন চাইলো। আপনার কি কোনো কারণে মন খারাপ বাবু মশাই?”

“সে বিষয়ে তোমার জানার প্রয়োজন নেই। দাসীকে আদেশ করো অন্দরমহলের বা’দিকে যে শূন্য কামরাগুলো আছে তার দু’টি পরিষ্কার করে রাখতে, শাহাজাদি মেহনূর আসছে। হয়তো ফুপিজানও আসবেন সাথে।”

হৃদয় পাহাড় সম ভার অনুভব হয় তরুণীর। তবুও নিজেকে সামলে নেয়।

আজ যে তার নিজের প্রিয় পুরুষটিকে কেমন যেন অচেনা লাগছে। যেমনটা লেগেছিল সেই পাঁচ বছর পূর্বে শাহাজাদি মেহনূরের সাথে বিবাহের সংবাদ শ্রবণ করার পর।

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বাবু মশাই। আপনি তো শাহাজাদি মেহনূরকে এই নবাববাড়ি হতে বহিষ্কার করে দিয়েছিলেন। তবে আবার সে কী করে ফিরে আসছেন এই অন্দরমহলে পুনরায়?”

“তোমার জন্য।” কিছুটা চাপা ক্রোধের আভাস তার জবাবে।

অবাক হয় যামিনী। বিড়ম্বনাতেও পড়ে।

“মানে? বুঝলাম না বাবু মশাই।”

“মানে তেমন বিশেষ কিছুই নয়। দিন তিনেক বাদে শহুরে বাবুরা আসছেন এই শেরপুর ঘুরে দেখতে। তাদের সম্মুখে তোমার পরিবর্তে মেহনূর আমার স্ত্রী ও বেগম রূপে যাবে।

তারা যতোদিন থাকবে, ততোদিন তুমি একটু আড়ালে থাকবে। আর এমন কোনো ঝামেলা ঘটানো আমি চাই না যার জন্য তাদের সামনে সত্য চলে আসুক। সুতরাং, মেহনূরের সাথে তোমার কোনোরকম তর্কাতর্কি আমি শুনতে চাই না।”

বিস্ময় ও বেদনা ভরা নয়নে তার কথাগুলো শুনলো আঁধার কন্যা। অশ্রু রোধে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।

কোনোরকম উচ্চারণ করে সে,

“কিন্তু আপনার স্ত্রী তো আমি…”

মেহমাদ শাহ কঠোরতার মাঝেই কিছুটা নম্র হয়।।নমনীয়তার সাথে তার বাহু আঁকড়ে ধরে।

“দেখো চন্দ্রমল্লিকা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভেবো না। যতোটুকু বলা হয়েছে ততোটুকুই কর্মতে রূপান্তর করো। দেখো শহুরে বাবুরা আসবে, তাদের সাথে কথা বলায় অনেক বিষয় আছে, অনেক কিছু খেয়াল রাখার আছে।

তুমি লৌকিক সভায় ভাষণদানে একদম অপটু, নব। তোমার দ্বারা কোনো ত্রুটি সম্পাদন হতে পারে, যার জন্য গোটা জমিদার বংশ প্রশ্ন উঠবে। তাই এই ব্যবস্থা করো।

সমর্থন করো, অযথা কোনো সমস্যা দাঁড় কোরো না বা সমস্যা ভেবে নিজেকে ব্যস্ত কোরো না।”

“যথা আজ্ঞা, বাবু মশাই।”

কোনোরকম বিদায় নিয়ে যামিনী বেড়িয়ে যায়। নিজের ব্যক্তিগত কামরার সম্মুখে আসলে দিলরুবা প্রশ্ন করতে এগিয়ে আসে।

“আমি একা থাকতে চাই।”

হুড়মুড়িয়ে কক্ষে ঢুকে দরজা লাগায় সে। দোয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দেয় সে।

“আল্লাহ, আমাকে শক্তি দান করো। আমাকে শক্তি দান করো, উপায় দেখাও। আমি যাতে এই কঠিন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে পারি।”

___

অন্দরমহলে দাঁড়িয়ে আছে সকল দাসী। বেগম লুৎফুন্নেসা নিজের নরম গদিতে বসে, তার চোখজোড়ায় অন্য রকম তৃষ্ণা। বেগম নূর বাহার এবং যামিনী তার পাশে দাঁড়িয়ে।

আজ প্রায় পনেরো বছর পর এই নবাববাড়িতে পা রাখছেন এ বংশের একমাত্র কন্যা শাহাজাদি জান্নাতুল।

মেহমাদ শাহ প্রবেশ করেন শাহাজাদি জান্নাতুল ও শাহাজাদি মেহনূর সহ। দাসীরা সমস্বরে সালাম জানায়।

শাহাজাদি জান্নাতুল হেসে ইশারায় জবাব দেয়। এগিয়ে যায় তিন ক্ষমতাধর নারীর দিকে।

“আম্মিজান” অনুভূতি মাখা কণ্ঠে সবার প্রথমে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। বেগম লুৎফুন্নেসাও পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে স্বীয় কন্যাকে।

“আমার জান্নাতুল, কেমন আছো তুমি? আমার হৃদয়ের রাণী তোমার জন্য তড়পাচ্ছিলাম আমি এতোকাল। আমার হৃদয়ের তৃষ্ণা যেন মিটলো।”

“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি আম্মিজান। আপনার দোয়ায় অনেক অনেক ভালো আছি। আর ভাবীজান, তুমি কেমন আছো।”

“যেমন দেখছে শাহাজাদি।”

ফিকেল হাসি দেন শাহাজাদি জান্নাতুল। অতঃপর নজর টিকান যামিনীর দিকে।

“তুমি নিশ্চয়ই চন্দ্রমল্লিকা, আমার সিংহ বাবার বেগম।”

এতো সময়ে এই প্রথমবার চোখ তুলে তাকায় রমণী নব আগত এই নারীর দিকে। তাকাতেই বিস্ময়ে চোখজোড়া কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায় যেন। অবিকাল তার চেহারা, এমন কী থুঁতনির তিলটাও যেন মেপে মেপে এক। রঙ মাত্রই পার্থক্য, সে কালো, তিনি শুভ্র।

“কোথায় হারালে আদুরে কন্যা?” তুড়ি বাজিয়ে প্রশ্ন করলেন ফুপিজান।

“মার্জনা করবেন ফুপিজান। আসসালামু আলাইকুম। আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো আপনার?”

“একদমই না। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন যুবতী আমিকে দেখছি। শুধুই বর্ণের পার্থক্য। আমার মেহনূর তো পুরো দমে নিজের আব্বাজান আর আম্মিজানের প্রতিমূর্তি হয়েছে। আমার কিছুই সে পায়নি। তুমি যেন আমারই ছায়ামূর্তি।”

“তাতে আমি গর্বিত ফুপিজান। আপনার সৌন্দর্য”

হাস্যোজ্জ্বল মুখে মাথা ঝাঁকায় মধ্যবয়স্ক নারীটি। সেই মুহূর্তে ক্ষীণ কণ্ঠে শাহাজাদি মেহনূর প্রস্তাব রাখে,

“আম্মিজান, আমি খুবই ক্লান্ত। আপনারও তো মাথা ব্যথা করছিল গাড়িতে। চলুন এখন একটু আরাম করতে যাওয়া যাক।”

“তুমি তোমার জন্য নির্ধারিত কামরায় যাও। আমি আম্মিজানের সাথে একটু একাকি সময় কাটাতে চাই।”

আয়েশা খাতুন শাহাজাদি মেহনূরকে নিয়ে চলেন তার কামরার দিকে। বিদায় নেন শাহাজাদি জান্নাতুলও বেগম লুৎফুন্নেসার সাথে। একই সঙ্গে স্থান ত্যাগ করে প্রত্যেকে।

কামরায় ঢুকে মায়ের কোলে মাথা রেখে পালঙ্কে শোন শাহাজাদি জান্নাতুল। ব্যথিত গলায় প্রশ্ন করেন,

“মা, এই কন্যার সাথে কী করে এতোটা নির্দয় হতে পারলে? এর চেহারাই তো তোমার হৃদয়ের তৃষ্ণা লাঘবে জল হওয়ার কথা।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। নীরবে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এই স্পর্শে মমতার সাথে বেদনাও স্পষ্ট।

___

পুনরায় জরুরি ভাবে মেহমাদ শাহের ডাক পড়েছে বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষে। এ ক’দিনে জরুরি ভাবে যেয়ে বারবার দুঃসংবাদ শ্রবণ করে তার বিতৃষ্ণা কাজ করছে। তবুও উপায়হীন হয়ে যাচ্ছে সে।

“আসসালামু আলাইকুম, দাদীজান।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। এসে এখানে বসো।”

যুবক শান্ত ভাবে দাদীজানের নিবেদনে আসন করে। পৌত্রের প্রশ্নসূচক চাহনি পেতেই চোখ সরিয়ে সে কোনো প্রকাশ বাঁধা ও বিড়ম্বনা ব্যতীত বললেন,

“আরমানের থেকে চিঠি এসেছে। সে মিস্টার হকিংসের সাথে শেরপুর আসতে ইচ্ছুক।”

বসা হতে দাঁড়িয়ে যায় মেহমাদ। ক্ষোভে তার দেহ কম্পিত হচ্ছে।

“অসম্ভব! কোনো ভাবেই না! ঐ বেইমান, জানোয়ার আমার পবিত্র ভূমিতে কিছুতেই পা রাখতে পারবে না। আমি হতে দিব না।”

“জিভের লাগাম টানো তরুণ। আরমান তোমার..

চলবে…

#চন্দ্রপুকুর
||৩৮ ও ৩৯তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“জিভের লাগাম টানো তরুণ। আরমান তোমার বড়ো চাচাজান হয় ভুলে যেয়ো না।”

তেঁতে উঠে বলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। যুবক নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বিদ্রূপার্থে হাসে।

“তা আমি কী করে ভুলতে পারি দাদীজান? আমার তো চরম সৌভাগ্য এ নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। কী করে ভুলব আমার এক চাচাজান আরেক চাচাজানের মৃত্যুর জন্য দায়ী? চাচীজান, আম্মাজান ও লোকমান চাচাজানের ধ্বংসের জন্য দায়ী ঐ লোক, আমার জন্মদাতা, আম্মিজান ও দাদাজান।

আম্মিজান যে আমার মাতা তা ভাবতেই আমার ঘৃণা লাগে। আপনি আর আব্বা হুজুর তো আরও চমৎকার মানুষ! আপনি তো বাধ্য ছিলেন, আব্বা হুজুর তো মৌনসম্মতি দিচ্ছিলেন। সব চেয়ে কষ্টকর বিষয় কি জানেন? অজান্তেই হোক আমিও একজন খুনী, আপনাদের দলেই নাম লিখিয়েছি।

এই নবাব পরিবার শুধু উপর দিয়েই স্বর্ণে জড়ানো, চাকচিক্য পরিপূর্ণ, ভিতরে পুরোটাই মরিচিকা ধরা লৌহ। তা আপনিও জানেন।”

বৃদ্ধা নারীটি বিপরীতে কথা বলার ভাষা পান না। প্রিয় পৌত্র তো আদৌ কোনো মিথ্যে প্রকাশ করেনি।

“দেখো আমার সিংহ, পুরাতন কথা ত্যাগ করো। নতুন ও সুন্দর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনা করো। যার মৃত্যু আল্লাহ যেভাবে ও যেখানে হওয়ার ঠিক করে রেখেছেন, সেভাবেই হবে ও হয়েছিল।”

হো হো করে হেসে দেয় মেহমাদ শাহ। তার হাসির ভয়ংকরত্মে দেওয়ালও যেন ভীতিগ্রস্ত হয়ে কম্পন করছে।

“হাস্যকর কথা বলেন আপনি! মাঝে মাঝে আমার হৃদয়ে সত্যিই প্রশ্ন জাগ্রত হয় আপনার মাতৃত্ব নিয়ে। আপনি কি শুধুই জনাব আরমান, ফুপিজান আর আব্বা হুজুরেরই মা বোধ করেন নিজেকে?

আচ্ছা, মানলাম আপনার কথা। সে অনুযায়ীই বলছি, যদি আপনার সুপুত্র আমার শেরপুরে নিজের অপবিত্র চরণ রেখেছে তবে তার মৃত্যুও আমার হাতে হবে লেখিত হয়েছে।”

যুবক একদণ্ড অপেক্ষা না করে এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি ত্যাগ করে। বেগম লুৎফুন্নেসা পৌত্রের কথা শুনে ভাবছেন প্রিয় পুত্রকে কী করে বুঝাবেন।

___

নিজের কক্ষে বসে বইয়ের পাতায় ডুবাত চেষ্টা করছে মেহমাদ শাহ৷ তবে কিছুতেই তার হৃদয় শান্ত হচ্ছে না। সে জানে তার ক্ষত লাঘবের ঔষধিকে প্রয়োজন। আর সেই ঔষধি একমাত্র যামিনী।

মিনারকে আদেশ করে সে,

“বেগম চন্দ্রমল্লিকার কাছে সংবাদ পাঠাও। আমি তাকে এই মুহূর্তে আমার নিকট আসার আদেশ দিয়েছি।”

যামিনী এমন জরুরি তলব পেয়ে শিঘ্রই তার কামরায় এসে পৌঁছায়। মাথা ঝুঁকে সালাম জানায় সে।

“আসসালামু আলাইকুম, বাবু মশাই। আমাকে ডাকিয়েছিলেন?”

মেহমাদ শাহ কোনো প্রকার শব্দ না উচ্চারণ করেই ঝাপটে ধরে তাকে। রমণীও আশ্চর্যান্বিত হয়।

“অনেক বেদনা বক্ষ পিঞ্জিরায় অনুরাগে রেখেছি। তারা আবার জ্বালাতন করা শুরু করেছে চন্দ্রমল্লিকা। কী করে আবার নিজেকে সামলে উঠব আমি? যেই পাপকার্য আমি আমার মুখ দ্বারা করেছি, তার অনুতাপের অনল হতে নিজেকে রক্ষা করব কী করে?”

জমিদার গিন্নি কিছুতেই বোধগম্য করতে পারে না তার বাবু মশাইয়ের ব্যথিত কণ্ঠে উচ্চারিত সকল বাণী। তার নিকট গোটা বচনই আস্ত এক ধাঁধাঁ, যার উত্তর আবিষ্কারে সে অসক্ষম।

“কী হয়েছে বাবু মশাই? আপনি এতোটা বিষণ্ণ ক্যানো? আমার অজান্তেই কি কোনো অঘটন ঘটে গিয়েছে?”

যামিনীর শিশুসুলভ কণ্ঠই মহৌষধ মেহমাদ শাহের বিমর্ষতার। মুহূর্তেই হৃদয় শীতল হয় তার। ললাট, গণ্ডদেশ ও চিবুকে আলতো ঠোঁট ছুয়ে দেয় সে।

হিসহিসিয়ে শুধায়,

“তেমন কিছু না আমার বাচ্চা হরিণী। আমি শুধু একটু মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম, অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল আমার হৃদয়। কিন্তু তুমি আমার আঁধার রাত্রির চন্দ্রিমা আমাকে আলোর দর্শন দিলে। শিঘ্রই সব খুলে বলব তোমাকে, শুধু আমার সন্তান তোমার গর্ভে ধারণ করার অপেক্ষা।”

“ইনশাআল্লাহ বাবু মশাই, আল্লাহর নিকট সেই দোয়াই করছি। ভালোবাসি, বাবু মশাই। আপনার ভাগ কাউকে দিতে পারব না আমি।”

দ্বার খোলার শব্দ ঘোর ভাঙে দু’জনার। একে অপর হতে খাণিক দূরত্বে সরে দাঁড়ায়।

“আসসালামু আলাইকুম, জমিদার নবাব শাহ ও বেগম চন্দ্রমল্লিকা।”

শাহাজাদি মেহনূরের আগমনে যামিনী চাপা ক্ষোভে জর্জরিত হয়ে দ্রুতো কামরা ত্যাগ করে। মেহনাফ শাহের মুখশ্রী পুড়ছে রাগ ও বিরক্তিতে।

“তুমি এখানে মেহনূর? আমার আশ্চর্য বোধ হয় জানো? এতোটা নির্লজ্জ মানুষ কী করে হতে পারে যে এতোকিছুর পরও আমার সম্মুখে আসার স্পর্ধা রাখে!”

যুবতী মাথা ঝুঁকে ফেলে। আড়ষ্টভাব তার মাঝে অনেকাংশই স্পষ্ট।

“আপনাকে ভালোবেসে এসব কাজ আমি সম্পাদন করেছি, শাহ। আমার আপনাকে ভালোবাসা কি ভুল ছিল? আমি কি ভালোবাসার অধিকার রাখি না?”

“অবশ্যই রাখো। তবে সবার প্রথমে হলো আনুগত্য আর বিশ্বাস। আমার বিশ্বাস তুমি ভেঙেছিলে মেহনূর। আমি তোমাকে বন্ধু ভেবে বিশ্বাস করেছিলাম, তোমার সহায়তা আশা করেছিলাম। তুমি তো বেইমান হয়ে আমার পিঠে ছুঁড়ি মেরেছিল।”

“আস্তাগফিরুল্লাহ্! আমার উদ্দেশ্য কখনোই আপনাকে আঘাত করা ছিল না শাহ। না আপনাকে কষ্ট দেওয়া। আমি তো শুধু আমার ভালোবাসাকে আপন করে চেয়েছিলাম মাত্র।

হয়তো নিজের আকাঙ্ক্ষা পূরণের তাড়নায় একটু অধিকই খাপছাড়া, বেইমান ও স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম। তবে সবকিছুর আড়ালে আমার খাঁটি ভালোবাসাই ছিল।”

তার আক্ষেপসূচক বচনও উপেক্ষা করে মেহমাদ শাহের হৃদয়। এই নারীর সকল কিছুই এখন কেমন ছলনা লাগে। মনে প্রশ্ন জাগে, তবে যামিনীও কি সত্য লুকিয়ে মিথ্যের দেওয়াল দিয়ে ছলনা করেনি?

ভাবে,

“নারী বলতেই ছলনাময়ী। সবাই নিজের ক্ষমতা ও ভালোবাসাকে নিজের করে রাখতে আঁধার-আলো সকল ধরনের ছলনা করতে সক্ষম। পার্থক্য হলো সেই ছলনায় ক্ষতিসাধনের পরিণামে।”

“আমি তোমার সাথে এই মুহূর্তে কোনো প্রকার কথা বলতে চাচ্ছি না। আর তুমি তো জ্ঞাতই তোমাকে কী কারণ বশত এই নবাববাড়িতে পুনরায় আনা হয়েছে। তবে মোটেও নিজের হৃদয়ে অহেতুক আশা বা স্বপ্ন সাজিয়ো না। এখন বের হও আমার নজরের সামনে হতে। আমার তোমার চেহারাটাও সহ্য হচ্ছে না।”

শাহাজাদি চোখ তুলে একদফা আহত দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। তার হৃদয়ে একের পর এক ছুঁড়ি আঘাত করেই যাচ্ছে।”

___

শাহাজাদি মেহনূর করাঘাত করে বেগম লুৎফুন্নেসার কামরায়। তিনি তখন কোরআন মাজিদ পাঠরত।

“কে? আসো কামরায়।”

রমণী কক্ষে প্রবেশ করে৷ তিনি খেয়াল করেন নারীটির মুখশ্রীতে না পূর্বের ন্যায় দম্ভ আছে, না আছে কোনো উচ্ছ্বাস।

“আসসালামু আলাইকুম, নানীজান। কেমন আছেন?”

“আছি তো আল্লাহর রহমতে ভালোই। আসো, বসো এখানে বসো।”

শাহাজাদি মেঝেতে রাখা পাটিতে বসে। আয়েশা খাতুন মনিবের ইশারা পেয়ে শরবত এগিয়ে দেন। হাতে নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় যুবতী।

“নানীজান, আমাকে ডাকিয়েছিলেন?”

“হুম, সংবাদ যেহেতু তোমার কর্ণকুহরে পৌঁছিয়েছে তাহলে নিশ্চয়ই আমি ডাকিয়েছি।”

নানীজানের শক্ত কণ্ঠে মাথা নত করে ফেলে পৌত্রি। “হু” বোধক শব্দ নির্গত দু’ঠোঁটের ফাঁক হতে।

“তোমাকে কী জন্য এই নবাববাড়িতে আগমনের নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছিল তা সম্পর্কে কি তুমি জ্ঞাত? না কি নতুন করে বলা প্রয়োজন?”

“জী, আমি জানি। চিঠি পড়েই প্রস্তাবে রাজি হয়ে এসেছি নানীজান। আমাদের বংশমর্যাদা রক্ষার এই সুবর্ণ সুযোগ আমায় দিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন নানীজান।”

“হু। তবে মনে রেখো সকলের সম্মুখে তোমার শুধু আলখাল্লার আড়ালে বেগমের চন্দ্রমল্লিকা হওয়ার অভিনয় করতে হবে। মোটেও মস্তিষ্কে কল্পনা মাত্র ভেবো না তুমি বেগম হবে।”

মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায় যুবতী। দৃষ্টি তার তখনও নত।

বেগম লুৎফুন্নেসা আরও বলেন,

“চন্দ্রমল্লিকা যদি বেগম হওয়ার অযোগ্যও হয়, তবুও আমি তোমাকে আর শেরপুরের বেগম কল্পনা মাত্রও করি না। তুমি পরিপূর্ণ রূপে অযোগ্য।

তোমার যে বিষাক্ত রূপ দেখেছি, তা ভুলবার নয়। প্রয়োজনে অন্য নারী আসবে আমার সিংহের বেগম হয়ে, তবুও তুমি নয়। এখন আমার দৃষ্টির বাহিরে চলে যাও কন্যা।”

শিঘ্রই বিদায় নিয়ে কক্ষ হতে বের হয় মেহনূর। ঠোঁট কামড়ে কাঁদে সে নীরবে। অতঃপর কিছু একটা ভেবেই আলতো হাসে।

___

আকাশে ঘোর কালো মেঘেরা ডানা মেলেছে। মনে হচ্ছে আকাশ রাজাও আজ প্রচণ্ড ক্রোধে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। সকল হতেই ঝিরঝির বৃষ্টির বর্ষণ তো আছেই।

যামিনী এক মনে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। আকাশের বিশালতায় নিজের বিবর্ণ কষ্টগুলো জলাঞ্জলি দিচ্ছে সে৷

হ্যাঁ, বিবর্ণ কষ্ট। কাঁদতে কাঁদতে চোখের নোনাজল হারিয়ে বিবর্ণ হয়েছে, ক্রোধের অনলও হয়ে গিয়েছে বর্ণহীন ফ্যাকাসে।

আজ বিশিষ্ট সাংবাদিক আর.কে. হকিংস তার দল নিয়ে আসবেন শেরপুরে। তাদের আগমনে শুধু যামিনী নয়, সুবিস্তীর্ণ এই গগণও মন খারাপের ডাক দিচ্ছে।

তার মন খারাপের কারণ তো মেহনূরের তার স্থানে দাঁড় করানো, কিন্তু আকাশ রাজার মন খারাপের কারণ কী? তবে সে কি কোনো বিপদ বিপদ গন্ধ অনুভব করতে পারছে সে? কে জানে?

নিজের অহেতুক ভাবনায় নিজেই ব্যথিত হয় যামিনী। তবে চাওয়াটা তার শুধুই আল্লাহতেই। এ যুদ্ধে সে মেহমাদ শাহ হতে কোনো প্রকার সাহায্য আশা করছে না, এমন কী দু’টো সান্ত্বনা বাণীও না।

এর মাঝেই গাড়ির আওয়াজ শ্রবণ করে সে। বোরখা হিজাব, নিকাব পড়ে মহলের অপরপ্রান্তের বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ায়। সেখান হয়ে নবাববাড়ির সম্মুখের দোয়ারের দৃশ্য খুবই স্পষ্ট ভাবে দর্শন করা সম্ভব।

মেহমাদ শাহ, মিনার ও তার লোকজন সমেত দাঁড়িয়ে আছে মিস্টার আর.কে. হকিংস এবং তার দলের স্বাগতমের উদ্দেশ্যে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে বোরখা পরিহিতা চন্দ্রমল্লিকার বেশধারী শাহাজাদি মেহনূর।

গাড়ি হতে নেমে আসেন জনাব আর.কে হকিংস। পিছনে তার তিনজন সঙ্গী। তথা আহিল, মাহিন ও দিনার। তিনজনই নব সাংবাদিক, সাথে ক্যামেরায় ছবি তোলার কাজটাও ভালো রপ্ত করে ফেলেছে।

“ওয়েলকাম মিস্টার হকিংস। হোপ ইউর জার্নি ওয়াজ ইঞ্জয়েব্যাল।”

আলতো মাথা উপর-নিচ করে সম্মুখের যুবকটি। তার মুখে সবসময়কার ন্যায় আজও ফিচেল হাসি। মানুষটার বয়স কতো হবে? বড়োজোর ছত্রিশ বা সাইত্রিশ। এতো কম বয়সেই ব্রিটেনের নামধারী সংবাদপত্রের একজন সুনামধন্য তরুণ সাংবাদিক সে।

“আমার যাত্রা একদম ভালো ছিল জমিদার সাহেব। আমাকে আর.কে. হকিংস ব্রিটিশরা বলে, বাঙালিদের জন্য আরহান করিম। আরহান বলে ডাকলেই বরং খুশি হব।”

“জী, আপনার ইচ্ছে আরহান সাহেব।”

মেহমাদ শাহ মেহনূরকে ইশারা করে স্বাগতম জানাতে। সেও কাঠপুতুলের ন্যায় আদেশ পালন করে।

“আসসালামু আলাইকুম, আরহান বাবু। আশা করি আল্লাহ আপনাকে ভালো রেখেছে।”

“জী। তবে জমিদার সাহেব এই রমণীকে তো চিনতে পারলাম না। আপনি কে জনাবা?”

মেহনূর উত্তর দেয়,

“আমি শেরপুরের বেগম, জমিদার বাবুর স্ত্রী। আমার নাম…”

“চন্দ্রমল্লিকা। আমার স্ত্রী, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। যাকগে সকল কথা কি এখানেই শেষ করবেন না কি? চলুন, মহলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাক। আপনারা বিশ্রাম নিন। বাকি কথা পরে হবে।”

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে যুবক।

অতঃপর মহলে প্রবেশ করে সকলে। মালিকের ইশারায় মিনার শহুরে বাবুদের জন্য নির্ধারিত কামরায় তাদের পৌঁছে দেয়।

যামিনী দ্বিতীয় তলার বারান্দা হতে এ দৃশ্য দেখে, যদিও কী বলেছে তা শুনতে পায়নি সে। তাই ভুল ধারণা সৃষ্টি হয় তার যে মেহমানদের জানানো হয়েছে মেহনূর তার স্ত্রী, চন্দ্রমল্লিকা নামক কেউ নয়। ঝরঝরিয়ে কেঁদে দেয় সে সেখানেই।

___

যামিনী বিবর্ণ মুখ নিয়ে মেহমাদ শাহের কক্ষে বসে আছে। নয়নযুগল হতে অবিরাম ধারায় বেয়ে পড়ছে নোনাজল।

ঘণ্টা খাণেক বাদে দ্বার খুলে প্রবেশ করে মেহমাদ শাহ। যামিনীকে মাথা ঝুঁকে শয্যায় বসে থাকতে দেখে সে কিছুটা অবাক ও আনন্দিতও হয়। সত্যি তো এটাই তার সারাদিনের ক্লান্তি যে কেটে যায় মানুষটিকে দেখে।

“আমার চন্দ্রমল্লিকা, তুমি এসেছো। আজ সূর্য হয়তো অন্য দিকে তাই আজ আমার তলব ব্যতীতই আমার কামরায় এসেছো তুমি। না, না, ভুল বলেছি আমি। আজ হয়তো আমার গগণের পূর্ণিমার রাত্রি, তাই তো আমার আকাশে চন্দ্র এতো দ্রুতো এসে পড়েছে তার চন্দ্রিমায় আমায় ধন্য করতে।”

বিবর্ণ হাসলো রমণী। অতঃপর ঠোঁট কামড়ে অশ্রু আটকিয়ে বলল,

“আপনি আজ ভীষণ খুশি, তাই না বাবু মশাই? এতো হাসি-ঠাট্টায় মেতে আছেন, তাতেই বোঝা যাচ্ছে।”

“তোমাকে দেখেই আমার হৃদয় শীতল হয়ে যায়। আর কী কারণ হবে?”

“আর কতো অভিনয়ের আড়াল করবেন নিজের হৃদয়ের কথা? আপনি তো আজ খুশি হবেনই। নিজের যোগ্য কাউকে নিজের পাশে পেয়েছেন। ডিগ্রিধারী সুশিক্ষিতা, উচ্চবংশীয়, অপরূপা সুন্দরী; একদম ষোলআনা পরিপূর্ণ।

এতোদিনে এই আঁধারিয়া কন্যা চন্দ্রমল্লিকাকে নিজের স্ত্রী বলতে নিশ্চয়ই জঘন্য এক অনুভূতি বোধ করতেন আপনি! আজ যখন সকলের সম্মুখে বললেন ‘এ আমার স্ত্রী মেহনূর’, তখন নিশ্চয়ই তৃপ্তি পেয়েছেন ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছেন।

অস্বাভাবিক কিছু নয়। অস্বাভাবিক তো আমার ভাবনা ও চিন্তাধারা ছিল, যা বাস্তবতা ভুলে বসেছিল। তবে এখন বিশ্বাস করুন, পুরোপুরি বোধগম্য হয়েছে সকল কিছু।”

যামিনীর কথায় মুখশ্রী কঠোর হয়ে যায় মেহমাদ শাহের। তার মনে হলোযার জন্য সে নিজের দাদীজানকেও কথা শোনাতে পিছ পা হয়নি, সে কি তার নিকটও সঠিক মূল্য পেল? বরং, নবাব বলে যেখানে সকলে নজর ঝুঁকিয়ে থাকে সেখানে তার ভালোবাসার আশ্রয় নিয়ে নারীটি তাকে উপহাস করছে বটে।

প্রকৃতপক্ষে সে পূর্ব হতেই ক্ষিপ্ত ছিল রমণীর উপর তার সামনে প্রতারণা ও মিথ্যের দেয়াল তুলে সত্য আড়াল করায়। এখন আরও অধিক ক্রুব্ধ হয়। যে সন্দেহ বহু বছর আগেই দূর করেছিল সে, তা পুনরায় তুলে ধরায়।

“আমার নজরের সীমানা হতে দূরে চলে যাও চন্দ্রমল্লিকা। তোমার এই কর্মের ক্ষমা তুমি কোনোক্রমেই আমার নিকট পাবে না।”

অনুভূতির তীব্র মিশ্রণে যামিনী কোনোদিকে না তাকিয়েই দ্বার খুলে ছুটে চলে যায় নিজের কক্ষের দিকে। সে কিছুতেই মেনে নিতে পাচ্ছে না এই কঠোর বাবু মশাইকে। সে তো নমনীয় বাবু মশাইয়ের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।

রোহিণীর মন ছটফট করছে সে যা শুনেছে তার জন্য। মূলত যামিনী যাওয়ার পর যেই মুহূর্তে শাহাজাদি মেহনূর ও মেহমাদ শাহ কথা বলছিল সেই ক্ষণে কী একটা ভেবে সে পাশের কক্ষে প্রবেশ করেছিল।

শাহাজাদি মেহনূরের কণ্ঠ পেতেই দেয়ালে কান রাখে সে। প্রায় সকল কথাই শ্রবণ করে। তা জানাতেই তার যামিনীর কামরায় আসা এবং তার জন্য অপেক্ষা করা।

গতকাল হতেই যামিনীর সাথে একাকি কথা বলার সুযোগ খুঁজছে সে। তবে জমিদারনি এতোটাই অসহায় বোধ করছে যে কারো সাথে কথোপকথনের ইচ্ছেও ত্যাগ করেছে।

দ্বার খুলে প্রবেশ করে যামিনী। দাঁড়িয়ে যায় রোহিণী।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম। আমার আপনাকে কিছু জানানোর ছিল।”

“এখন না রোহিণী। আমি এখন একা থাকতে চাই। পরে এসো।”

রোহিণী এ বাণীর পরও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিরক্ত হয় যামিনী, ক্ষুব্ধও।

“খুব জরুরি কথা বেগম। সেদিন আপনি জমিদার বাবুর কামরা হতে বের হওয়ার পর তাঁর আর শাহাজাদি মেহনূরের আলাপন আমি শুনেছি আড়াল হতে।” এক শ্বাসে কথাটুকু বলে হাঁপিয়ে যায় কিশোরী।

যুবতী জমিদারনি এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। তার মনে হলো ডুবন্ত অন্ধকারে যেন এক ফালি আশার আলো পেল।

“দ্রুতো বলো রোহিণী, কী বলতে চাও।”

রোহিণী কিছু না লুকিয়ে পুরো কথোপকথন খোলাসা করে তার বেগমের নিকট। যামিনী এতোটুকুতে স্বস্তি পায় যে তার বাবু মশাই শাহাজাদি মেহনূরকে অপছন্দ করে। আবার ভীতিগ্রস্তও বিনা কারণে তাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্যও।

তবে সর্বপ্রথমে মনে উদিত হয় প্রশ্ন। ভাবে,

– শাহাজাদি কি এমন বেইমানি করেছিল তার বাবু মশাইয়ের সাথে যার জন্য সে এতোটা ক্ষিপ্ত? এই কারণটি জানা আবশ্যক। তাও তো হতে পারে তার ব্রহ্মাস্ত্র। কিন্তু খুব দ্রুতো জানতে হবে। মেহনূর নিশ্চয়ই পুনরায় তার বাবু মশাইয়ের মন জয়ের প্রচেষ্টা করবে, এর পূর্বেই জানতে হবে।

___

কম আলোর বাতি জ্বলছে। আবছা আলোয় বসে আছেন একজন ব্যক্তি। তার এক হাতে শামি কাবাব, আরেক হাতে মদের পানপাত্র। আজ আনন্দে একটু বেশিই পান করছে।

চোখজোড়া বন্ধ করতেই কারো সাদাকালো ছবি ভেসে উঠে। আলতো হাসি ফুটিয়ে সে বলে উঠে,

“আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালটি দিয়ে ফেলেছি। এখন শুধু মাত্র শেষ চাল দেওয়ার অপেক্ষা প্রিয়তমা। তারপর সবার ধ্বংস হওয়ার পালা, যার জন্য আমাদের ঘর ধ্বংস হলো।”

চলবে…