চন্দ্রপুকুর পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
218

#চন্দ্রপুকুর
||৩৪তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
আধো আলো আসছে। অন্ধকারচ্ছন্ন কামরা। ঠিক কামরা নয়, চিলেকোঠা মনে হচ্ছে। কাল রাত হতে আহার করেনি রত্না।

দেহ ঝিমঝিম করছে তার। প্রায় দুইদিন পেড়িয়ে গিয়েছে এই বন্দীদশায়। পেটে এক বিন্দু অন্ন তো দূরে থাকুক জলও পড়েনি।

“হে আল্লাহ! কী অপরাধে আমায় এই পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করালে আমি জানি না। তবে আমি আর সইতে পারছি না। আমাকে ক্ষম করো, মুক্তি দাও।”

আল্লাহ তায়ালা হয়তো তার দোয়া শ্রবণ করলেন। কারণ এক মুহূর্তে পেড়িয়ে যেতে না যেতেই বন্ধ দোয়ার খুলে যায়। এক ঝাঁক আলোর প্রবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে যুবতী।

পিটপিট করে চোখ খুলে রত্না। সামনে বাঁকা হাসি সমেত দাঁড়িয়ে আছে যামিনী, মোহিনী ও দিলরুবা।

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা?”

“হুম, আমি। অন্যকাউকে অবশ্যই আশা করা উচিত হয়নি।”

“আমাকে মুক্তি দিন বেগম। কোন ত্রুটির জন্য আমাকে এমন ভাবে আটক করেছেন?”

“জানো না তুমি? তোমার ভুল তো গণনা করে সমাপ্ত করা যাবে না। সবচেয়ে বড়ো ভুল তো করেছিলে আমায় হত্যা করার পরিকল্পনায় নিজের মনিবের সাথে হাত মিলিয়ে। আমার চাঁদনি, কোথায় সে?”

হচকচিয়ে গেল যেন যুবতী দাসী। ঘাবড়েও গেল বটে।

“ক্ষমা করবেন বেগম। আমি এ বিষয়ে কিচ্ছু জানি না। সত্যিই জানি না।”

“নিজের মনিবকে বাঁচানোর জন্য এসব বলছো? হাস্যকর! তোমার মনিবের বাস্তবতা তো দেখে নেও।”

অবাক দৃষ্টিতে তাকায় নারী। যামীণী মোহিনীকে ইশারা করে রত্নার হাতের বাঁধন খুলতে। দিলরুবার হতে চিঠিটি হাতে নিয়ে রত্নার হাতে ধরায় সে।

“তোমার মনিবকে বেনামী চিঠি লিখেছিলাম তোমাকে বন্দী করা হয়েছিল জানিয়ে। মূলত তোমার বিপরীত আমার চাঁদনিকে ফেরত চেয়েছিলাম।

তিনি পরিস্কার ভাবে চিঠিতে জানিয়েছেন, তুমি তাঁর নিকট নিছকই মূল্যহীক এক গোলাম। তুমি বাঁচো আর মরো তাঁর কিছুই যায় আসে না। অদ্ভুৎ না ব্যাপার খানা!”

যামিনী একের পর এক শব্দের তীর ছুঁড়ে যাচ্ছে। তাতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রত্না। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারলো না কৈশোর বয়স হতে সেবা করছে যার, তিনি এমন মনোভাব পোষণ করতে পারেন তাঁর বিষয়ে। বারবার চিঠিটা দেখছে, যদি একখান প্রমাণ পায় এই চিঠির মিথ্যে প্রমাণ হওয়ার।

তা হয়তো কিছুটা অনুধাবণ করতে পারে যামিনী।
“সন্দেহ হলো শাহাজাদির সিলমোহর খানা দেখে নিয়ো। নিজের মালিকের সিলমোহর তো চিনতে তোমার ভুল হওয়ার কথা না। এখন বলো এমন কাউকে বাঁচাতে নিজে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে চাও না কি নিজের প্রাণ রক্ষা করতে চাও?”

অনেকটা সময় নৈশব্দে বসে থাকে সামনের নারীটির। সে পরিকল্পনা করছে না কি বিচার-বিশ্লেষণ না কি নিজেকে সামলাচ্ছে বোধগম্য হয় না কিশোরীর।

“আমি আমার প্রাণ বাঁচাতে চাই বেগম। আমাকে মুক্তি দিন। বিপরীতে যা বলবেন তা-ই করব।”

আকস্মাৎ পা জড়িয়ে ধরে মিনতি করে রত্না। যামিনী বিজয়ীর হাসি দেয়।

___

মেহমাদ শাহ নিজের কামরায় বসে কাগজপত্রে ডুবেছিল। বহুদিন ধরে ধান বিক্রির হিসেবটা ধরা হয় না, আজ ধরে দেখলে কেমন যেন গড়মিল মনে হচ্ছে তার।

তার ব্যস্ততার মাঝে কামরার দোয়ার খুলে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে ছুটে আসে যামিনী। আঁকড়ে ধরে তার বক্ষে অশ্রু বিসর্জন দিতে শুরু করে।

“কী হয়েছে আমার চাঁদের মল্লিকার? আমার সোনালি হরিণ এভাবে কাঁদছো ক্যানো?”

“বাবু মশাই আমার চাঁদনি… আমার চাঁদনি…” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে যামিনী।

আদুরে ভঙ্গিতে পিঠে হাত বুলায় যুবক। যেন একটু শক্ত স্পর্শ পেলেই আঘাত পাবে তার প্রেয়সী।

“আমি মিনারকে আদেশ করেছি তো আমার চন্দ্রমল্লিকা। খুব শিঘ্রই তাকে ফিরে পাবে তুমি।”

“চাঁদনি আর নেই বাবু মশাই। কী করে আমি ফিরে পাব তাকে? মানুষ এতোটা নির্দয় কী করে হতে পারে! প্রতিশোধের নেশায় একটা মাসুম জীবকে…!”

আবারও ক্রন্দনধ্বনি শোনা যায়। মেহমাদ শাহ স্তম্ভিত।

“মানে? কী বলতে চাচ্ছো তুমি? কী হয়েছে সোজাসুজি বলো চন্দ্রমল্লিকা।”

“বাবু মশাই আমি দিলরুবা আর মোহিনীর সাথে মহল ঘুরে দেখতে বের হয়েছিলাম। মহলের পিছন ভাগে জঙ্গলের দিকটায় যেয়ে দেখতে পাই চাঁদনিকে ছুড়ি দিয়ে হত্যা করছে কেউ।”

আরও জোরে শব্দ করে ক্রন্দনক্রিয়ায় লিপ্ত হয় রমণী। যুবক উত্তেজিত।

“কার এতো দুঃসাহস জানাও আমাকে! কাকে দেখেছো তুমি? আর সে এখন কোথায়?”

যামিনী কান্না মৃদু হয়। কোনোরকম দরজার দিকে ঘুরে সে। সেখানে দাঁড়ানো দিলরুবা তার ইশারা পেলেই মোহিনীর সাথে রত্নাকে নিয়ে কামরায় প্রবেশ করে।

“আসসালামু আলাইকুম জমিদার বাবু। শাহাজাদি মেহনূরের খাঁস দাসীকেই আমরা পেয়েছিলাম জঙ্গলের দিকে, অনেক কষ্টে পেয়েছি।”

রত্না চরণ জড়িয়ে ধরে জমিদারের। ক্ষমার আকুতি করতে শুরু করে,
“আমার কোনো দোষ নেই, জমিদার বাবু। আমাকে শাহাজাদি বাধ্য করেছিল এ কাজ করতে। ক্ষমা করুন আমায়। ক্ষমা ভিক্ষে দিন।”

মেহমাদ শাহের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। চিৎকার করে উঠে,
“মিনার! মিনার! এই মেয়ে সহ মেহনূরকে এখনই মহল হতে বহিষ্কার করো। আর এই মুহূর্ত মেহনূরকে পাঠিয়ে দাও তার বাড়ির উদ্দেশ্যে।”

হনহন করে চলে যায় যুবক। হয়তো বেগম লুৎফুন্নেসার কামরাই তার গন্তব্য।

তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দেয় যামিনী। এই অবধি যতোটুকু হৃদয় পুড়ছিল নিজের অপকর্মের উদ্দেশ্যে।

এখন ততোটাই শান্তি বোধ করছে। জয় আর ক্ষমতা পাওয়ার মাঝে যে তৃপ্তি ও শান্তি তা এই পরিকল্পনা সফল হওয়ার পর বোধগম্য হচ্ছে তার।

অতীত,
যামিনীর কথায় রাজি হওয়ার পর রত্নাকে দাঁড় করায়। প্রশ্ন করে,
“আমার চাঁদনিকে কোথায় রাখা হয়েছে? আমাকে তার নিকট নিয়ে যাও।”

“টিয়া পাখিটি মহলের পিছনের দিকে রাখা হয়েছে এক ভৃত্যের অধীনে।”

“ঠিক আছে, তুমি তাদের থেকে পক্ষীটি নিয়ে আসবে। মোটেও ধূর্ততা দেখিয়ে কিছু জানতে দিবে না তাদের। আমার লোকের দৃষ্টি তোমার উপর থাকবে, মনে রেখো।”

“যথা আজ্ঞা বেগম।”

দিলরুবা ও মোহিনী সহ কয়েকজন প্রহরী রত্নার চোখে কাপড় বেঁধে তাকে নিয়ে বের হয়। যামিনী সেখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। একটু বাদেই চাঁদনি সহ সেই অন্ধকার কামরায় প্রবেশ করে রত্না, মোহিনী ও দিলরুবা।

“আমার চাঁদনি, কেমন আছো তুমি?” আদুরে গলায় রমণী দু’হাতে আগলে নেয় টিয়া পাখিটিকে। তারপর রত্নার দিকে দৃষ্টিপাত করে।

“তুমি যেয়ে জমিদার বাবুকে সব স্বীকার করবে। আর ভুলেও দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে যেন আমার নাম না বের হয়।”

মোহিনী বলে উঠে,
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। তবে জমিদার বাবুকে বলে খুব বেশি কিছুই হবে না। বেগম লুৎফুন্নেসার সাথে আলোচনা করে আগের মতোই অপেক্ষা করবেন শাহাজাদির ভ্রাতার আগমনের। তবে শাহাজাদি মেহনূরকে এভাবে এখানে রাখা ভীষণ বিপদজনক।

তাকে দ্রুতো বের করতে হবে। যে আপনার কক্ষে ঢুকে চাঁদনিকে চুরি করতে পারে, সে বড়ো কোনো ধরনের ক্ষতিসাধনও করতে পারে। ছিনিয়ে নিতে পারে আপনার হতে আরও অনেক কিছু। এমন কী জমিদার বাবুকেও!”

যামিনী ভাবে, খুব করে ভাবে। অতঃপর ঐ কামরা হতে বের হয়ে জঙ্গলের দিকে যায়। কোমরে গুঁজে রাখা ছোটো ছুড়িটা দিয়ে এক আঘাতে হত্যা করে চাঁদনিকে। রক্তে ছিটকে পড়ে মাটিতে, সাথে পড়ে যায় চাঁদনিও হাত ফসকে। মাটিতে বসে ঝরঝরিয়ে কেঁদেও দেয় সে। কী পাপ না করতে হচ্ছে তাকে জীবনের এ পর্যায়ে এসে!

চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। রত্নার বাহু ধরে কঠোরভাবে আদেশ করে,
“বাবু মশাইকে বলবে তুমি হত্যা করেছো চাঁদনিকে শাহাজাদির আদেশে, মনে থাকে যেন। আর চিন্তা কোরো না এর বিপরীতে মোটা অংকের অর্থও পেয়ে যাবে।”

“জী, বেগম। শুধু আমার জীবন খানা ভিক্ষে দিয়েন। বাড়িতে আমার এতিম এক পুত্রও আছে।”

___

শাহাজাদি মেহনূর শেষবার নবাববাড়িকে দেখে নিচ্ছে গাড়িতে উঠার পূর্বে। কী এক নির্মম পড়িহাস ভাগ্যের! যখন সে এসেছিল তখন তাকে স্বাগাতম জানাতে এগিয়ে এসেছিল গোটা নবাবপরিবার। অথচ, আজ কেউ নেই।

অনেকটা অপরাধীর বেশেই তাকে চলে যেতে হচ্ছে। সে পাপের শাস্তিও পাচ্ছে যে পাপ সে করেনি কখনও। যুবতী অজ্ঞাত নয় যামিনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে।

তবুও তার হস্তে কিছু নেই। নানীজানও তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই নৈশব্দে সহ্য করে নিল এই পাপের কালিমা লেপণ। মনে প্রতিশোধের আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলছে তার।

চোখের জল মুছে গাড়িতে উঠে বসে শাহাজাদি। শক্ত মুখে বিড়বিড়ায়,
“আমি চলে যাচ্ছি যামিনী। তবে ফিরে আসবো প্রলয় হয়ে। ধ্বংস হবে তোমার জীবনের সুখের পাতার অস্তিত্ব আমার হাত আঁকড়ে ধরে।”

চলবে…

#চন্দ্রপুকুর
||৩৫তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
বারান্দায় হাটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে যামিনী। উদাসীন ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে খাঁচাটির দিকে। চোখ হতে অবিরাম ধারায় নোনা জল বইলেও কোথায় একটা স্বস্তি।

দিলরুবা এগিয়ে আসে। রমণীর কাঁধে হস্ত খানা রেখে সান্ত্বনার সুরে বলে,

“বেগম আপনি দয়া করে এমন বিরস মুখে বসে থাকবেন না। নিজেকে অপরাধী ভাববেন না। আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনার অসহায়ত্ব বোধ করতে পারবে।”

“মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ো না দিলরুবা। তুমি নিজেও নিজ হৃদয়ে আমায় হৃদয়হীনাই বলে ডাকছো। আমিও মানি আমি নির্দয়। তবে প্রয়োজনে আমি নির্দয় হব, তবুও আমি আমার শত্রুদের ধ্বংস করবই।

তুমি জানো না দিলরুবা তাঁরা আমাকে সর্বস্বান্ত করার কী জঘন্য উপয় এঁটেছে! আমার মাতৃত্বে আঘাত করতে চেয়েছেন শাহাজাদি মেহনূর।”

দিলরুবার ললাটে চিন্তার ভাঁজ। বেশ দ্বিধাগ্রস্তও সে।

“কীসের বিষয়ে কথা বলছেন বেগম?”

“তুমি খেয়াল করেছো রত্মাকে আমি যখন আমার পা হতে উঠাচ্ছিলাম তখন সে আমার কানের নিকট কিছু ফিসফিসাচ্ছিল? সে তখন বলেছিল, সে ভুলবশত শুনে ফেলেছে শাহাজাদি মেহনূর ও আম্মিজানকে আমার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করতে।

তাঁরা আমাকে নিঃসন্তান রাখার ব্যবস্থা করবেন। আমার খাবারে এমন কিছু ঔষধি মিলিয়ে দিয়ে আমাকে খাওয়াবেন যা আমাকে মা হওয়া হতে রোধ করবে। আর বাবু মশাইকে আমি কোনো উত্তরাধিকার দিতে পারব না এবং তালাক হয়ে যাবে।”

এ কথা শ্রবণগোচর হতেই হতবাক যুবতী। প্রায় প্রতিটি বাঙালি নারীর জন্য মাতৃত্ব এক অদম্য সুখানুভূতি ও আল্লাহর পরম বরকত স্বরূপ। সে জ্ঞাত নিঃসন্তান থাকা কষ্ট সম্পর্কে।

“বেগম এখন কী করবেন? কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন এত ষড়যন্ত্র হতে?”

“করে নিব রক্ষা, ইনশা আল্লাহ। প্রথম চাল তো দিয়েই ফেলেছি শাহাজাদিকে বহিষ্কার করিয়ে। যদিও এক নিষ্পাপকে হত্যা করে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি, তবে আমি আরও নির্দয় হতে পারি নিজের ক্ষমতা ও নিজেকে রক্ষার্থে।

যতো টুকু আমি খেয়াল করেছি আম্মিজান অর্থাৎ বেগম নূর বাহারকে বাবু মশাই তেমন একটা মূল্য দেন না, অপছন্দও করেন কোনো এক অজানা কারণবশত। আর দাদীজান তো ইদানীংকাল বেশ আমায় বেশ স্নেহই করেন। তাছাড়া তাঁর বয়সও হয়েছে, ক্ষমতা তো আমার হস্তেই যাবে।”

দিলরুবার ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠে।

“আর ক্ষমতা আপনার হাতে আসলে নিজেকে রক্ষা করা আপনার নিকট অনেক সহজতর হয়ে যাবে। তাই না বেগম?”

“হু, তবে তার পূর্বে বেগম নূর বাহারের হাঁকডাক কমানোর ব্যবস্থা করা লাগবে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে, দেখিয়ে, সবাইকে দাবিয়ে। আর হ্যাঁ, আমার আহার করার জন্য তৈরি খাবার খুব দেখে-শুনে এবং পর্যবেক্ষণ করে আমার চক্ষু সম্মুখে রাখবে। আমি কোনো ঝুঁকি নিতে একদমই ইচ্ছুক নয়।”

“অবশ্যই, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। আপনাকে রক্ষা করাই আমার প্রথম কর্ম।”

“হুম, আমি তো জানি। তাই তো সেই মুহূর্তে মোহিনী ও বাকি দাস-দাসীদের মাঝে না বলে তোমায় এখন জানালাম। তবে আমার খুব ভয় হয় বুঝলে? আমি যার ভালোবাসাকে, যাকে নিজের করে রাখার জন্য রক্তে হাত রাঙিয়েছি তারই না ঘৃণা উপহার পাই!”

তীব্র আক্ষেপ যামিনীর কণ্ঠে। দিলরুবার নিকট সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। তবুও তাকে কোনোরকম বুঝিয়ে সামলায় সে।

কিশোরী যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত তখন মহলের এক কোণে বসে কেউ একজন মনে মনে বলছে,

“শাহাজাদি পাঠিয়ে ভাবছিস তুই রক্ষা পাবি? তোর মাতৃত্বের স্বাদ তুই পাবি না কভু। অতঃপর হারাবি জমিদারের সমর্থনও।”

___

মেহমাদ শাহ নিজের কক্ষে বসে শেক্সপিয়ারের একটি বই পড়ছে। বহুদিন পর নিজের সংরক্ষিত বইয়ের ঘরটিতে গিয়েছে সে। যদিও উদ্দেশ্য ছিল মন ভুলানো, তবুও পারছে না। সেই কিশোরী কন্যা এতো গভীর ভাবে নিজের প্রতি আসক্ত করেছে তাকে যা বলার ভাষা রাখে না।

যামিনীর হৃদয়ে পোষণ করা সন্দেহ দূর করার পর হতেই তাকে এড়িয়ে চলে যুবক। বারবার ক্ষমার আকুতি শুনেও উপেক্ষা করেছে। শয্যায় তো স্থান দেয়নিই, বিপরীতে অবশ্য নিজেও নির্ঘুম রাত্রি কাটিয়েছে।

তবে আজ যেন কিছুতেই হৃদয় মানছে না। হয়তো আজ মাঝবেলায় চাঁদনির মৃত্যুতে যামিনীর ক্রন্দনরত মুখশ্রীই তাকে এতোটা পোড়াচ্ছে।

নিজেই নিজেকে বোঝায়,

“চন্দ্রমল্লিকা আমায় অতিরিক্ত ভালোবাসে তাই তো আমায় নিয়ে ভয় তার। হারিয়ে ফেলতে চায়, এজন্যই সন্দেহ ডানা মেলে বক্ষে। আজ বাচ্চা হরিণীটির ভীষণ মন খারাপ, সঙ্গ দিতেও আমার সেখানে উপস্থিত থাকা উচিত।”

নিদ্রার জন্য পরিধান করা সাধারণ পোশাকেই বেড়িয়ে পড়ে সে। মিনার দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে মিটমিট করে হাসে মনিবের পাগলামিতে। আবার দীর্ঘশ্বাসও ফেলে।

ভাবে,

– তাদের জীবনে ভালোবাসা নেই। ভালোবাসার সময় কোথায়? তাদের গোটা জীবন সেবা করতে করতেই কেটে যাবে। ভালোবাসা উচ্চবিত্তদের জন্যই ঠিক।

মেহমাদ শাহ দোয়ার খুলে ঢুকে দেখে যামিনী পালঙ্কে শায়িত। দিলরুবা তেল মালিস করে দিচ্ছে তার মাথায়। বিবর্ণ মুখশ্রী কিশোরীর।

তাকে দেখেই নজর ঝুঁকিয়ে বিদায় জানায় দিলরুবা। স্থান ত্যাগের পূর্বে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় যামিনীকে সে যেন জমিদারকে বুঝতে না দেয় কিছু।

“আসসালামু আলাইকুম, বাবু মশাই। কেমন আছেন? আর কী মনে করেই বা এই নগণ্য নারীর কক্ষে চরণ রাখলেন?”

“আমার চন্দ্রমল্লিকা, আমি কি আসতে পারি না তোমার কামরায়? ঠিক আছে, তবে চলে যাচ্ছি।”

দরজার দিকে ঘুরে মেহমাদ শাহ। যামিনী ছুটে যেয়ে তাকে পিছন হতে জড়িয়ে ধরে।

“বাবু মশাই ভালোবাসা না হোক, একটু তো সহানুভূতি দেখান আপনার চন্দ্রমল্লিকার উপর। পূর্বে চাঁদনিকে দেখে আপনার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির দাবানলে হওয়া ক্ষত লাঘব করতাম। এখন তো সেও নেই। আপনি কি পূর্ণরূপে একাকিত্বের স্বাদ দিতে চাচ্ছেন আমাকে? তবে তো আমি মরে…”

রমণীকে নিজের হতে ছাড়িয়ে নেয় যুবক। ললাটে ভালোবাসা সিক্ত চুমু খেয়ে শুধায়,

“আজ আমাদের মাঝে শুধু ভালোবাসার প্রতিযোগিতা হবে। কোনো অশুভ বা মন খারাপের কথোপকথন নয় ”

যামিনীকে কোলে তুলে নিয়ে শয্যার দিকে এগিয়ে যায় সে। কিশোরী তার বক্ষে মিশে আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রার্থণা করে,

“ইয়া আল্লাহ, আমাদের ভালোবাসায় তুমি এভাবেই সহিহ-সালামাত রেখো। কারো বাজে দৃষ্টি যেন না আঘাত করতে পারে আমার বন্ধনে। তুমি জানো আমার ভালোবাসার পবিত্রতা ও সত্যতা। আমাকে ও আমার ভালোবাসাকে তুমি রক্ষা কোরো।”

___

কেটে গিয়েছে পাঁচ-পাঁচটি বছর। অন্দরমহল পূর্বের ন্যায়ই জমজমাট ভাবে চললেও পরিবর্তন এসেছে শাসনকার্যের মাঝে।

বেগম নূর বাহার সব কিছু হতে বিমুখ হয়ে অনেকটা নৈশব্দে থাকেন নিজ কামরা। এখন আর তাঁর গলাবাজি শ্রবণ করা যায় না। অবশ্য সে এখন পূর্ণাঙ্গ যুবতী। এর পিছনে একটাই কারণ, সেই কিশোরী যামিনী। নিজের ক্ষমতা, কূটনীতি ও জনমতের সহায়তায় সে আজ জয় করে নিয়েছে প্রায় অনেক কিছুই।

এমন কী বেগম লুৎফুন্নেসার মতও অনেকটাই জয় করে নিয়েছে সে। তার প্রমাণ আজকাল প্রায়শয়ই সভায় বা বৈঠকে দর্শন পাওয়া যায় না বেগমের, যামিনী একাই সামলায় শাসনভার।

বর্তমানে ভঙ্গ হৃদয়ে বাগানে বসে আছে তরুণী যামিনী। সামনে লোভনীয় সব খাবার, এতো এতো দাসীদের সেবা কিছুই তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না।

একটাই ভীতি তার। বৈদ্য তাকে একদম স্বাভাবিক গণ্য করার পরও প্রায় দুই বছরের অনবরত চেষ্টার পরও অন্তঃসত্ত্বা হতে পারছে না সে। যদিও এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে এখন সন্তান নিতে চাচ্ছে না বলে এড়িয়ে যায়, তবুও কেউ বাস্তবতা জানলে পরিণাম ভয়ংকর হবে তা সম্পর্কে সে জ্ঞাত।

“বেগম কী হয়েছে? আপনাকে বেশ বিষণ্ণ লাগছে।”

“তুমি তো জানো দিলরুবা আমার বিষণ্ণতার কারণ। এতো চাওয়ার পরও আল্লাহ আমার কোলটা শূন্য রেখেছে। আমার তো এখন ভয় হয় দিলরুবা, শাহাজাদির অনুপস্থিতিতে কেউ তার হয়ে দূরে না রাখছে আমাকে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া হতে।”

“তা কী করে সম্ভব বেগম? বৈদ্য তো আপনাকে পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করে জানালো আপনি একদম সুস্থ আছেন। তাছাড়া আপনার আহার করা খাদ্য সহ ব্যবহার্য সব জিনিসপত্তর কঠোর নজরদারি ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর আপনার নিকট আসে।”

এর মধ্যে মোহিনী আসলো। সে জানালো,

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, জমিদার বাবুকে বেগম লুৎফুন্নেসা জরুরি ভাবে তার কামরায় ডাকিয়েছেন। তাঁকে প্রচণ্ড রাগান্বিতও দেখাচ্ছিল।”

ধ্বক করে উঠে যামিনীর হৃদয়। তার সমস্যার বিষয়ে কোনো ভাবে জানতে তো পারেননি? তবে তো তার বাবু মশাইকে হারানো অপরিবর্তনীয় সত্য। কারণ উইল ও নিয়ম অনুযায়ী জমিদারদের স্ত্রী উত্তরাধিকার দিতে অক্ষম হলে তারা বেগম ও স্ত্রী হিসেবে অযোগ্য এবং সিংহাসন নিজের অধীনে রাখতে হলে তালাক দেওয়া আবশ্যক।

চলবে…

#চন্দ্রপুকুর
||৩৬তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
বেগম লুৎফুন্নেসা কঠোর মুখশ্রী নিয়ে বসে আছেন তাঁর আসনে বসে চা পান করছেন। প্রায় মিনিট দশেক ধরে মেহমাদ শাহ তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে। সে বোধগম্য করতে পারছে না দাদীজানের হুটহাট এমন ক্রোধের কারণ।

“দাদীজান, আপনি কি আমাকে ডাকিয়েছিলেন?”

“এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন মেহমাদ? একটু অপেক্ষা করো। না কি এতোটাই মতিভ্রষ্ট হয়েছে দাদীজানের সম্মান করাও ভুলে বসেছো।”

“দুঃখিত দাদীজানক, আমার তেমন কোনো উদ্দেশ্য বা নিয়ত ছিল না।”

“হু” বোধক ধ্বনি উচ্চারিত হয় বেগম লুৎফুন্নেসার মুখ হতে। শূন্য চায়ের পানপাত্র খানা হাত হতে রেখে দিয়ে পৌত্রের দিকে দৃষ্টি স্থির করে।

“এখন আমাকে জানাও, সন্তান নিচ্ছো না ক্যানো এখনও? আর কবে নিবে?”

“এটা কী ধরনের প্রশ্ন দাদীজান? যখন আল্লাহ এই রহমত দান করবেন এবং আমাদের মনে হবে আমরা পিতা-মাতা হতে প্রস্তুত তখনই…”

“বাচ্চা বা কিশোর নয় তোমরা মেহমাদ। ত্রিশের কোঠা পেড়িয়েছো তুমি বহু পূর্বেই, চন্দ্রমল্লিকাও এখন পূর্ণাঙ্গ যুবতী। এসব মিথ্যে বাহানা না দিয়ে সত্য প্রকাশ করো।”

ভ্রু কুঞ্চিত হয় যুবকের।
“কীসের বাহানা, দাদীজান? আমি তো সত্যই ব্যক্ত করছি। চন্দ্রমল্লিকার বয়স আর কতোই বা, তবুও কন্যাটি এতো দ্রুতো সকল যোগ্যতা অর্জন করে সামলে নিয়েছে। এখন আবার সন্তান নিলে আরেকটা দায় কাঁধে চাপবে…”

হাতের ইশারায় থামিয়ে দেন বৃদ্ধা প্রিয় পৌত্রকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলতে শুরু করেন,

“তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছো না চন্দ্রমল্লিকা তোমাকে, আমি জানি না। তবে এখানে যে কোনো গড়মিল আছে তা খুব ভালো ভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছি আমি।

তোমার স্ত্রী সন্তান গর্ভে ধারণ করতে ইচ্ছুক নয় তা আমি মানলাম। তবে প্রতিনিয়ত সে বৈদ্য কাছে কেন যাচ্ছে নিজের শারীরিক অনস্থা পরীক্ষা করে দেখতে ও দ্রুতো গর্ভধারণের ঔষধ নিতে? আবার কোনো ঔষধিও নিচ্ছে না গর্ভধারণ রোধে”

যুবক শাহ নিজেই এবার বিড়ম্বনায় পড়ে। যামিনীর এমন করার কারণ সে ভেবে পাচ্ছে না। আবার দাদীজান ঠিকভাবে না জেনে দোষারোপও যে করবে না তা সম্পর্কেও সে জ্ঞাত।

তার হৃদয়ে প্রশ্ন উদয় হয়। ভাবে,
– তবে কি সত্যিই যামিনী মিথ্যে কথায় ভুলাচ্ছে তাকে?

মেহমাদ শাহকে নিঃশ্চুপ থাকতে দেখে গলা খাঁকারি দেন বেগম লুৎফুন্নেসা। দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশ্ন করেন,

“চন্দ্রমল্লিকাকে বিবাহ করার পর আমাকে কী ওয়াদা করেছিলে মনে আছে?”

“হ্যাঁ, দাদীজান। তবে চন্দ্রমল্লিকা তো সকল ক্ষেত্রই নিজ যোগ্যতায় জয় করে নিয়েছে। একজন আদর্শ জমিদারনি সে এখন।”

“শোনো আমার সিংহ, জমিদারিতে জমিদারের উত্তরাধিকার হলো মূল। আর বেগমের সবচেয়ে বড়ো যোগ্যতাই হলো উত্তরাধিকারকে গর্ভে ধারণ করা।

যদি তা-ই না হয় তবে সকল যোগ্যতাই আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। যদি তোমার বর্তমান স্ত্রী গর্ভধারণ না করতে পারে, তবে তার বেগমের পদ হতে বহিষ্কার হওয়ার অনিবার্য।”

“তবে দাদীজান ত্রুটি আমার মাঝেও তো থাকতে পারে।”

“জিভে লাগাম লাগাও মেহমাদ। তোমাকে শাহাজাদা হিসেবে লোকচক্ষুর সম্মুখে আনার পূর্বেই তোমার সকল ধরনের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে তোমাকে সব ভাবে সক্ষম হিসেবে জানা হয়েছিল। মনে রাখবে আমি তোমার দাদীজান। তুমি আমার রক্ত।

তবে আমার নিকট সবকিছুর পূর্বে এই জমিদারি, তোমার নিকটও তাই হওয়া উচিত। ভুলে যেয়ো জমিদারি পাওয়ার সময় তোমার দাদাজান ও আব্বা হুজুরের সম্মুখে আল্লাহর শপথ নিয়ে কী ওয়াদা করেছিলে।

তোমাকে তা-ই মাথায় রাখতে হবে। প্রথমে জমিদারি, তারপর অন্যকিছু, তা ভালোবাসাই হোক না ক্যানো। অন্যথায় আমার সিংহ আমি নির্দয় হতে বাধ্য হব। খুব বাজে ভাবে ভাঙবে হৃদয়।”

যুবক আলতো হাসে। দাদীজানের চোখে চোখ রাখে।

“যতোটা নির্দয় হয়েছিলেন নিজের পুত্রের মৃত্যুতে ততোটা? জমিদারি বাঁচাতে আপনার পশুত্বের নিদর্শন তো আমি দেখেছিই। তাই তো সন্তানের মৃত্যুতেও মুখে কুলূপ এঁটে ছিলেন।”

“তা আমার প্রয়োজন ছিল যুবক। তুমি বুঝবে না। আমি চারজন সন্তানের মাতা, এক সন্তানের জীবন রক্ষার্থে বাকি তিন সন্তানকে বিপদে ফেলতে পারতাম না।

যদিও রক্ষাও করতে পারিনি ঠিক-ঠাক। যাকগে তুমি যেতে পারো, তবে আমি যা বলেছি তা মস্তিষ্কে রেখো। আমার খুব দ্রুতোই উত্তরাধিকারের আগমনের সংবাদ চাই, নাহলে… বুদ্ধিমান তুমি, নিশ্চয়ই অনুধাবন করে ফেলেছো।”

সায় জানিয়ে বিদায় হয় পৌত্রে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। সিন্দুক থেকে একটি পুরাতন ছবি বের করে বক্ষের মধ্যিখানে জড়িয়ে চোখের জল ফেলার কার্যে নিয়োজিত হন।

___

মেহমাদ শাহ কামরার এক পাশ হতে অন্য পাশে হাটাহাটি করছে। দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা উভয় গ্রাস করছে তার হৃদয় ও মস্তিষ্ক।

মিনার সংশয় বোধ করে। মনিবকে শান্ত করতে শুধায়,
“জমিদার বাবু আপনি অযথা চিন্তার ভার নিবেন না। বেগম নিশ্চয়ই আপনাকে মিথ্যে কথা বলবেন না। বেগম লুৎফুন্নেসা হয়তো বৃথাই সন্দেহ করছেন।”

“দাদীজান গুরত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা ব্যতীত চন্দ্রমল্লিকার উপর এই কালিমা লেপণ করবে না। তাছাড়া তখন দাদীজানকে না বললেও এটা সত্যিই সে যদি কোনো ঔষধি না নেয় বৈদ্যশালা হতে গর্ভধারণ রোধে, তবে সন্তান গর্ভে না আসা ছাড়া উপায় নেই।”

“তবে আপনিও মানছেন বেগম আপনাকে মিথ্যে বলছেন?”

“জানি না আমি। তবে তার যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকতো তার আমাকে জানানো উচিত ছিল। সে যে বিপদের শঙ্কায় বর্তমানে আছে, তাতে যে কোনো মুহূর্তেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু একটা হতেই পারে।”

“হ্যাঁ, জমিদার বাবু। কারণ বেগম লুৎফুন্নেসা এই ক্ষেত্রে চুপ করে থাকার মানুষ নয়।”

ফোঁস করে শ্বাস ফেলে মেহমাদ শাহ। পরক্ষণেই নিজেকে কঠোর করে সে।

আনমনে বিড়বিড়ায়,
“সবার পূর্বে জমিদারি, তারপর ভালোবাসা ও দুনিয়াদারি। যে পারবে না হৃদয়ে এ কথা রাখতে, সে পারবে না জমিদারি ও জমিদারের সিংহাসন রক্ষা করতে।”

এ কথাটি তাকে সাত বছর বয়সে বলেছিলেন তার দাদীজান। তখন থেকেই খুব ভালো ভাবে মাথায় এঁটে নিয়েছে সে। যদিও অনুভূতি তাকে দুর্বল করে, তবুও নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা সে রাখে।

“মিনার! আমার জন্য উষ্ণ জলে স্নান করার ব্যবস্থা করো। আর পুদিনার তৈল ছিটিয়ে দিতে বোলো স্নানের জলে। আমার একটু স্বস্তি ও আরাম বোধ করা প্রয়োজন।”

“যথা আজ্ঞা জমিদার বাবু।” মিনার বিদায় নেয়।

মেহমাদ শাহ সেখানে দাঁড়িয়ে আবার গভীর ভাবনায় ডুবে যায়। যামিনীকে নিয়ে তার হৃদয়ে জাগ্রত বিভিন্ন সংশয়কে ঘুম পাড়ানো কী এতো সহজতর!

___

যামিনী ও দিলরুবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মোহিনীর উদ্দেশ্যে। দিলরুবাকে প্রচণ্ড অশান্ত দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে যুবতী জমিদারনি একদম শান্ত ভাবে চোখ বন্ধ করে মুখ এগিয়ে রেখেছে মুক্ত গগনের দিকে।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম।” মোহিনী ঝুঁকে সালাম জানায়।

রমণী উত্তর দেয় না। একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় বলতে ইশারা করে।

“বেগম, বেশি কিছু তো জানতে পারিনি। কারণ খুব গোপনীয়তার সাথে আলোচনা হয়েছে তাঁদের মাঝে। ওপারের দেয়ালে দাঁড়িয়ে যতোটুকু শুনতে পেরে যতোটুকু বোধগম্য হয়েছে তা হলো উত্তরাধিকারের বিষয়ে কথা হচ্ছিল। এই শব্দটিই স্পষ্ট শুনেছি আমি।”

নির্বিকার যামিনী। যেন সে জানতো এমন কিছুই হয়ে থাকবে।

“বুঝেছি আমি, মোহিনী। তুমি এখন যেতো পারে।”

“বিদায় বেগম।” স্থান ত্যাগ করে মোহিনী।

কক্ষ শূন্য হতেই ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করে দিলরুবা,
“এখন কী হবে বেগম চন্দ্রমল্লিকা? কীভাবে রক্ষা করবেন আপনি নিজেকে এই মহাসংকট হতে?”

“জানি না আমি। কিছু জানি না। আমি জানতাম এমন কিছু একটাই হবে, এটাই স্বাভাবিক। এমন সত্য শত চেষ্টাতেও আড়াল করা যায় না। এই পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে আমি জ্ঞাত নই।

শুধু এতোটুকু জানি খুব শিঘ্রই যদি কোনো উপায় না খুঁজে পাই তবে যা যা অর্জন করেছি তা তা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে অন্যকেউ। হয়তো সে হবে মেহনূরই। এখন আল্লাহর দরবারে হাত তোলা ছাড়া উপায় নেই।”

“আপনি দুঃশ্চিন্তা পোষণ করবেন না, বেগম। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আল্লাহ মহান, নিশ্চয়ই তিনি আপনাকে নিজেকে রক্ষার পথ দেখাবেন।”

তাদের আলোচনার মাঝে কক্ষের দ্বার খুলে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করে রোহিণী। গত দুই বছরে সে হয়ে উঠেছে যামিনীর ভরসাযোগ্য আরেকজন ভৃত্য। মেয়েটা কিশোরী বলে ছটফটে ধরনের হলেও বেশ বুদ্ধিমতী এবং বিচক্ষণ।

রমণী বেশ ক্রুব্ধ হয় অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করায়। ক্ষিপ্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“এভাবে প্রবেশ করার অর্থ কী রোহিণী? তুমি ছোটো বলে বেগম আদর করি বলে মনে কোরো আদব-কায়দায় ত্রুটি হলে মার্জনা পাবে।”

“দুঃখিত, বেগম। বস্তুত, আড়াল হতে আমি এমন এক দুঃসংবাদ শুনেছি। কোনো কিছু না দেখেই আপনার নিকট ছুটে এসেছি।”

হৃদয় ধড়পড় করে উঠে জমিদারনির। আবার কী অঘটন ঘটলো তার অগোচরে!

“কী হয়েছে রোহিণী? হুট করে কী এমন দুঃসংবাদ শ্রবণ করলে তুমি?”

“বেগম, আমি… আমি আয়েশা খাতুন ও মালিহা খাতুনকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুনেছি। তারা বলেছিলেন শাহাজাদি মেহনূরকে নবাববাড়িতে আগমনের জন্য খবর পাঠিয়েছেন বেগম লুৎফুন্নেসা। আর আমি তো দিলরুবা আপার কাছে শুনেছিলাম শাহাজাদি আপনার প্রধান শত্রু।”

দাঁড়ানো থেকে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নেয় কন্যা রোহিণীর কথা শ্রবণ করে। দিলরুবা “বেগম! বেগম!” বলে আগলে ধরে।

পালঙ্কে শোয়ানো হয় তাকে। যামিনী হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। এতো কষ্ট যে প্রলয়কে নিজ জীবন হতে বের করেছে, সে পুনরায় ফিরে আসলে নিশ্চয়ই আরও ধ্বংসাত্মক হয়ে ফিরে আসবে। এতো বড়ো এক বোঝা মাথায় নিয়ে কীভাবে পুনরায় লড়াই করবে সে!

___

মেহমাদ শাহের কর্ণগোচর হয় শাহাজাদি মেহনূরের আগমনের সংবাদ। ক্ষুব্ধ হয়ে বেগম লুৎফুন্নেসার কামরায় প্রবেশ করে সে।

“আসসালামু আলাইকুম, দাদীজান। এ কী কথা শুনছি আমি? আপনি মেহনূরকে এই অন্দরমহলে পুনরায় ডাকাচ্ছেন? আপনি কি জ্ঞাত নন তাকে আমার বহিষ্কার করা সম্পর্কে! তাছাড়া আপনি আমাকে সময় দিয়েছিলেন আলোচনার পর।”

“থামো, মেহমাদ। আগে পুরো কথা শুনো, তারপর বলো। প্রথমে জানাও তুমি কি জ্ঞাত আর.কে. হকিংস সমেত কয়েকজন লোক শহর হতে আসছে শেরপুর ভ্রমণ করতে?”

আর.কে. হকিংসের নাম শ্রবণপথে প্রবেশ করলে গা হিম হয়ে যায় যুবকের। আকস্মাৎ এই মানুষগুলোর আগমনের কারণ কী?

চলবে…